Ajker Patrika

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা

মো. আকিক তানজিল জিহান
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা

গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র কোনো নিরপেক্ষ কাঠামো নয়, এটি ইতিহাসে সব সময় শাসকশ্রেণির ক্ষমতা রক্ষার যন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশের সংবিধান ‘সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণের’ হাতে বলা হলেও, বাস্তবে এই ক্ষমতা একটি আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার হাতে কেন্দ্রীভূত রয়েছে। সামষ্টিক রাষ্ট্রদর্শনে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ মানে, শুধু প্রশাসনিক দায়িত্ব বণ্টন নয়; বরং উৎপাদন, সম্পদ ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া। তাই খুব জরুরি হলো কেন্দ্রীয় ক্ষমতার কাঠামো ভেঙে জনগণনির্ভর স্থানীয় সংসদীয় কাঠামো গড়ে তোলা।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ কার্যত একটি এলিটদের নীতিনির্ধারণী ফোরাম, যেখানে শ্রমজীবী, কৃষক ও প্রান্তিক জনগণের কণ্ঠস্বর প্রতিফলিত হয় না। এই রাষ্ট্রকাঠামোর বৈশিষ্ট্যই হলো, যেখানে নীতি নির্ধারিত হয় শাসকশ্রেণির স্বার্থে। ফলে জনগণ ভোট দিলেও নীতিনির্ধারণে তাদের কোনো প্রকৃত ভূমিকা থাকে না। এই বাস্তবতা পাল্টাতে হলে প্রয়োজন জনগণভিত্তিক সংসদীয় কাঠামোর বিকেন্দ্রীকরণ, যেখানে নীতি প্রণয়ন, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা হবে উৎপাদনকারী শ্রেণির মাধ্যমে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্র হবে জনগণের সংগঠিত সমাজ, কেন্দ্র নয়।

এ ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণের প্রথম ধাপ হতে পারে বিভাগীয় সংসদ গঠন। এটি শুধু প্রশাসনিক সমন্বয় নয়; বরং শ্রম, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা ও পরিবেশ খাতে সমাজমুখী পরিকল্পনার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। প্রতিটি বিভাগে ৫০-৬০ সদস্যবিশিষ্ট সংসদে কৃষক, শ্রমিক, নারী, তরুণ, শিক্ষক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই সংসদ বিভাগীয় সম্পদ; যেমন কৃষি-জমি, বন, পানি ও খনিজ সম্পদ—জনগণের মালিকানায় ব্যবস্থাপনার অধিকার পাবে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে শুধু লাভের জন্য নয়, প্রয়োজনের ভিত্তিতে। বিভাগীয় মুখ্যমন্ত্রী হবেন নির্বাচিত প্রতিনিধি, যিনি জনগণের কাছে জবাবদিহি করবেন এবং তাঁর মন্ত্রিসভা জনশুনানির মাধ্যমে নীতি প্রণয়ন করবে।

জেলা সংসদ হবে রাষ্ট্রব্যবস্থার দ্বিতীয় মূল ভিত্তি, যেখানে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। ৩০-৪০ সদস্যবিশিষ্ট এই সংসদে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রতিনিধি, নারী, তরুণ, কৃষক ও শ্রমিকের অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করতে হবে। জেলা সংসদ স্থানীয় শিল্প পরিকল্পনা, কৃষি উৎপাদন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ ও কর্মসংস্থানের নীতি নির্ধারণ করবে—কেন্দ্রীয় বাজেটের ওপর নির্ভর না করে স্থানীয় রাজস্ব ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার ভিত্তিতে। সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটি হবে জনমালিকানাধীন পরিকল্পনা প্রক্রিয়া, যেখানে বাজেটের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করবে জনগণ।

অনুরূপভাবে উপজেলা সংসদ হবে রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রথম মূল ভিত্তি; যেখানে উৎপাদনের প্রকৃত মালিকেরা; যেমন কৃষক, শ্রমিক, নারী, শিক্ষক ও তরুণসমাজ নীতিনির্ধারণে অংশ নেবেন। এটি কেবল প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান নয়; বরং স্থানীয় সমাজের আত্মনিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র হবে। যদি উপজেলা সংসদে গণভোট বাধ্যতামূলক করা হয়, তবে জনগণ সরাসরি জানাবে কোন প্রকল্প প্রয়োজন, কোন নীতি প্রত্যাখ্যাত হবে। গণভোট ও সামাজিক জবাবদিহি সামষ্টিক গণতন্ত্রের অন্যতম হাতিয়ার। স্থানীয় সংসদগুলোতে নিয়মিত গণভোটের মাধ্যমে জনগণ তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করবে, যা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক হবে। এভাবে ‘প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র’ থেকে বাংলাদেশ ‘অংশগ্রহণমূলক সামষ্টিক গণতন্ত্র’র পথে অগ্রসর হতে পারে। এভাবে রাষ্ট্রের কাঠামো জনগণের রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে একাত্ম হবে এবং রাষ্ট্র পরিণত হবে জনগণের যৌথ মালিকানার সংগঠন হিসেবে। এই বিকেন্দ্রীকরণের জন্য স্থানীয় সংসদগুলোর আর্থিক স্বাধীনতা থাকা খুব জরুরি।

প্রতিটি জেলা ও উপজেলা সংসদকে স্থানীয় কর, কৃষি উৎপাদন, সমবায় শিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা থেকে রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষমতা দিতে হবে। কেন্দ্রীয় বরাদ্দ নয়, বরং জনমালিকানাধীন অর্থনীতি হবে উন্নয়নের চালিকাশক্তি। ফলে জনগণ সরাসরি বাজেট প্রণয়ন, সম্পদ বণ্টন ও প্রকল্প বাস্তবায়নের অংশীদার হবে; যা রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও অকার্যকারিতা রোধ করবে।

রাষ্ট্রের বিকেন্দ্রীকরণ মানে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস নয়, বরং স্থানীয় ও আঞ্চলিক জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জনগণের নিয়ন্ত্রণাধীন পুনর্গঠন। জাতীয় সংসদের পাশাপাশি বিভাগ, জেলা ও উপজেলা সংসদগুলো একসঙ্গে গড়ে তুলবে ‘জনগণের রাষ্ট্র’; যেখানে ক্ষমতা হবে সমবণ্টিত, প্রশাসন হবে জবাবদিহিমূলক, আর উন্নয়ন হবে সমবায়ের ভিত্তিতে। এই কাঠামো রাষ্ট্রের ভিত্তিকে বদলে দেবে; আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার পরিবর্তে জনগণের যৌথ সিদ্ধান্ত, পুঁজির পরিবর্তে মানুষের প্রয়োজন এবং ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা হবে রাষ্ট্রের মূল দর্শন। এ ছাড়া স্থানীয় সংসদগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় সংসদের সম্পর্ক হবে

তল থেকে ওপরের ভিত্তিতে। বিভাগীয় সংসদ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় সংসদে ‘জনপর্যবেক্ষক’ হিসেবে অংশ নেবেন এবং কেন্দ্রীয় সংসদ কোনো নীতি প্রণয়নের আগে স্থানীয় সংসদগুলোর মতামত গ্রহণে বাধ্য থাকবে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় নীতি আর শুধু এলিট শ্রেণির জন্য নয়, বরং জনগণের সার্বিক স্বার্থের প্রতিফলন ঘটাবে।

স্থানীয় সংসদীয় কাঠামো সামষ্টিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে গড়ে উঠলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নতুন রূপ পাবে, এই আশা আমরা করতে পারি। এটি কেবল রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলবে না, বরং একটি সামাজিক বিপ্লব ঘটবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপির আপত্তি তোলা দুই অধ্যাদেশে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন

ভারতে পা রাখলেন পুতিন, নিয়ম ভেঙে ‘কোলাকুলি’ করলেন মোদি

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

গোপালগঞ্জে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ছাত্রীর আত্মহত্যা

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ