Ajker Patrika

স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট পুলিশিং

আক্তার হোসেন
আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৬: ২২
স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট পুলিশিং

বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুদৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশ ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী ’৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। আর সেই বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে চলে যাব।’

উন্নয়নের মহাসড়কে চলমান বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ। ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত ধরে উন্নয়নের ধারা বজায় রেখে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে একটি উন্নত, সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ। তবে এ যাত্রায় অনেক সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাড়াতে হবে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা। একই সঙ্গে সার্বিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। 

৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ ২০২৩ উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ সদস্যদের প্রতি বেশ কিছু মূল্যবান ও উপদেশমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে একটি দক্ষ ও বিশ্বমানের “স্মার্ট পুলিশ” গড়ে তোলা।’ সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে উন্নত বাংলাদেশ এবং সেটি হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা জনসাধারণ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশে নাগরিকসেবা থেকে শুরু করে সব আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। 

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো প্রশাসন। আর প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠন হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলতে প্রধানত পুলিশ সার্ভিসকেই বোঝানো হয়। পুলিশের ওপর জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক জীবনযাপন অনেকটাই নির্ভরশীল। উন্নত বিশ্বে পুলিশ জনগণের সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত থাকে। যেকোনো সমস্যায় জনগণ পুলিশের সাহায্য কামনা করে। পুলিশ সদস্যদের কাজই হলো জনগণের যেকোনো সমস্যায় সব ধরনের সহযোগিতা করা। অসহায়, বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি আন্তরিকভাবে সহযোগিতা ও মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। পাশাপাশি জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া। মোটকথা, পুলিশ সদস্যরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় জনগণের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। 

 উন্নত বিশ্বে সাধারণত ধরা হয়ে থাকে যে সমাজের ৯০ শতাংশ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলবে, বাকি ১০ শতাংশ মানুষ আইনের বরখেলাপ করবে অথবা বিপথগামী হবে। পুলিশ তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে অথবা আইনের আওতায় আনবে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, পুলিশ এই ১০ শতাংশ মানুষের কাছ থেকে সমাজের ৯০ শতাংশ শান্তিকামী মানুষকে রক্ষা করবে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ৯০ শতাংশ মানুষ কি আইন মেনে চলে বা চলার মতো পরিবেশ আছে? তবে এ কথা ঠিক, অল্প কিছু মানুষের নিয়মবহির্ভূত কাজের প্রভাব সমাজে অনেক বেশি পড়ে। পুলিশের কাজ মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং কেউ যদি অন্যায়ভাবে আটক হন, তার প্রভাবও বেশি থাকে। সামান্যতম বিচ্যুতিও মানুষকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। পুলিশকে আইনত মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করার অধিকার দেওয়া আছে, তবে তা সম্পূর্ণ ন্যায়সংগতভাবে হতে হবে। 

পুলিশের কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে সতর্ক আছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে, সেটা নিয়ে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিনিয়ত কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। প্রতিদিন দায়িত্ব বণ্টনের আগে কর্মকর্তারা পুলিশ সার্ভিসের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রেখে কাজ করার বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। থানা থেকে শুরু করে পুলিশ লাইনস, পুলিশ ক্যাম্প, বিভাগ—সবখানেই কাউন্সেলিং করা হয়। কাউন্সেলিংকালে পুলিশ সদস্যদের কোথাও তল্লাশি চালাতে হলে কী নিয়ম মানতে হবে, কী ধরনের আচরণ করতে হবে, তা বুঝিয়ে বলা হয়। সাধারণ মানুষকে যেন সম্মান দেওয়া হয়, তাদের প্রতি যেন ভদ্র আচরণ করা হয়। 

 স্মার্ট পুলিশিং হলো তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক পুলিশিং ব্যবস্থা, যেখানে জ্ঞানবিজ্ঞান ব্যবহৃত হয় অত্যধিক। স্মার্ট পুলিশিংয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রমের উপাদানগুলো ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও গবেষণা করা হয়, যা অফিসারদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির সহায়ক। তা ছাড়া নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করা হয় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য। অর্থাৎ, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত সময়ে নির্ধারিত, বাস্তবিক ও কাঙ্ক্ষিত পুলিশিং সেবা প্রদানই হলো স্মার্ট পুলিশিং।

মানুষের ব্যক্তিগত থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ধাপে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক প্রয়োগ ইতিমধ্যে লক্ষণীয় প্রভাব ফেলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো প্রেডিক্টিভ পুলিশিং, যা স্মার্ট পুলিশিং বাস্তবায়নে এমন এক ব্যবস্থাকে বোঝায়; যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে একটি স্বয়ংক্রিয়, দ্রুতগতিসম্পন্ন ও তুলনামূলক নির্ভুল ব্যবস্থাপনা। অপরাধ ও অপরাধীকে শনাক্ত করার মাধ্যমে অপরাধ প্রতিরোধ, বিশ্লেষণ ও প্রতিকারে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। যেমন—সিসি ক্যামেরা, সেন্সর ডিভাইস, পূর্বে তৈরিকৃত ডেটাবেইসের তথ্য বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম। আইন প্রয়োগের ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এ আই) সংযোজন একটি বৈপ্লবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা জননিরাপত্তায় ফোর্স মোবিলাইজেশন, রিসোর্স অ্যালোকেশন, স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অগ্রিম তথ্য প্রদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। 

ডিজিটাল যোগাযোগমাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষ ঘরে বসে তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি সেবা উল্লেখ না করলেই নয়। আমরা সবাই জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর সুবিধাভোগী। বিপদাপদ, অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা বা যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সেবার জন্য ৯৯৯-এ কল করে থাকি। এটা পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং স্বাস্থ্য সমন্বয়ে একটি সেবা। সেবাটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর উদ্বোধন করেন। এটি তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত বা উদ্ভাবন। আরেকটি সেবা অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স। বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের প্রবাসে চাকরি বা অভিবাসন প্রক্রিয়ায় এই ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজন হয়। সেবাটি চালু হয় ২০১৭ সালে। এ ধরনের আরও বহুবিদ অনলাইন সেবা রয়েছে। ডিজিটাল হওয়ার কারণে সেবা দ্রুত মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। এতে সময় ও খরচ দুই-ই কম লাগছে।

 একটি তথ্য ও তথ্যভিত্তিক বা তথ্যনির্ভর সমাধান পদ্ধতি, যাকে কম্পিউটারের ভাষায় বলা হয় Algorithm। উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯। যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে নাগরিকদের সেবা প্রদান করার জন্যই সেবাটি প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে ৯৯৯ ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করছে। কেউ ৯৯৯-এ কল করলে কল সেন্টারে একজন অপারেটর (Call Taker) কলটি গ্রহণ করে এবং কলারের চাহিদামতো কল সংশ্লিষ্ট স্থানীয় ইউনিট, অর্থাৎ থানায় ডেসপাচ করে অথবা কনফারেন্সিংয়ের জন্য থানাকে সংযুক্ত করে দেয়। এই ব্যবস্থায় কলারের লোকেশনও জানা যায় (GPS Location)। অতঃপর থানা থেকে সেবাপ্রত্যাশীকে সাড়া প্রদান করা হচ্ছে। সাড়া প্রদানের সময় (Response Time) আরও সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত করার লক্ষ্যে পুলিশের মোবাইল পেট্রল গাড়িগুলোতে মোবাইল ডেটা টার্মিনাল (এমডিটি) বসানোর কার্যক্রমও সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে। ফলে ৯৯৯ কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার থেকে থানায় ডেসপাচের পরিবর্তে সরাসরি ঘটনাস্থল বা সেবাপ্রত্যাশীর নিকটবর্তী কোনো এমডিটিতে কল ডেসপাচ করলে খুব দ্রুত সাড়া প্রদান করা সম্ভব হবে।

স্মার্ট ৯৯৯, যা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ তথা স্মার্ট গভর্নমেন্টেরই’ অংশ, তা আসলে কী রকম হবে? ডিজিটাল ৯৯৯ যখন স্মার্ট ৯৯৯ হবে, তখন কোনো অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা বা অপরাধ, যেমন—হাউস ট্রেসপাসিং, যৌন হয়রানি ইত্যাদিসহ যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে মানুষকে আর কল করতে হবে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসমৃদ্ধ (AI) যেকোনো IOT (Internet of Things)-এর আশপাশে কোনো ঘটনা, দুর্ঘটনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় সেবার জন্য সংকেত বা কোনো অ্যালার্ম স্মার্ট ৯৯৯ কমান্ড সেন্টারে পাঠাতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোথাও সাপ্তাহিক ছুটি উদ্‌যাপন করতে গিয়েছেন বা আমরা যা সচরাচর করি—ঈদ, পূজার বড় ছুটি পেলে পরিবারের সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে যাই। তখন বাসায় কেউ থাকে না। সে ক্ষেত্রে আপনার বাসায় যদি IOT নামক ডিভাইসটি থাকে আর তার যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থাকে, তবে আপনার অনুপস্থিতিতে যে কেউ আপনার বাসা-বাড়িতে ঢুকলে বা বাসায় কোনো দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড ঘটলে স্মার্ট ৯৯৯ কমান্ড সেন্টারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কল বা অ্যালার্ম বা সিগন্যাল চলে আসবে। শুধু তাই নয়, স্মার্ট ৯৯৯ অবশ্যই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসমৃদ্ধ কলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করে অগ্নিকাণ্ড হলে নিকটবর্তী ফায়ার সার্ভিসকে অথবা কোনো অপরাধসংক্রান্ত হলে নিকটবর্তী ইউনিটকে কল, সংকেত, সিগন্যাল পাঠাবে। সাড়া বা সেবা প্রদান অথবা সাড়া প্রদানকারী ঘটনাস্থলে না পৌঁছানো পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে কলটি লাইভ থাকবে।

 আমরা এমন একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল সময় পার করছি, যেখানে বিশ্ব প্রতিটি মুহূর্তে প্রযুক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি নিত্যনতুন জটিল সমস্যার সাক্ষী হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া প্রযুক্তিগত বিপ্লব পরিবর্তন করে দিচ্ছে আমাদের ধারণা, প্রস্তুতি ও কাজের ধরনকে। কালের পরিক্রমায় আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যুগে প্রবেশ করেছি। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা হয় ৮০ শতাংশেরও বেশি। এ দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনার জন্য AI সংবলিত Automated Software Application ক্যামেরা এবং স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। মহাসড়কে ইতিমধ্যে সংঘটিত দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে। তদনুসারে স্মার্ট ক্যামেরা সড়ক-মহাসড়কে প্রকাশ্য-গোপনে বসানো যেতে পারে। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত ক্যামেরা গতিসীমার অতিরিক্ত গতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করতে পারবে এবং সংশ্লিষ্ট গাড়ি এবং গাড়ির মালিকের তথ্যভান্ডার (Big Data) বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ণয় করতে পারবে। তদুপরি আইন অনুসারে এ অপরাধের জন্য নির্ধারিত জরিমানা সরাসরি অভিযুক্ত গাড়ির মালিকের যোগাযোগের ঠিকানা, মোবাইল ফোন নম্বর বা ই-মেইলে পাঠিয়ে দিতে পারবে। পেমেন্ট সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এটা মুলতবি দেখাবে। তা ছাড়া, ট্রাফিক সিগন্যাল যদি Automated করা যায়, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যানজট শনাক্ত করে তদনুসারে ট্রাফিক সিগন্যাল স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হবে। ফলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা ট্রাফিক সিগন্যালে যানবাহনের জট অনেকাংশে কমে যাবে। কারণ পুরো ট্রাফিক-ব্যবস্থা তখন ডিজিটাল ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হবে। 

পুলিশিং ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের বড় সুবিধা হলো প্রেডিক্টিভ অ্যানালাইসিস। সুবিস্তর তথ্যভান্ডারের স্বয়ংক্রিয় পর্যালোচনার মাধ্যমে এআই অ্যালগোরিদম এমন কিছু ঘটনা ও অপরাধের লক্ষণ শনাক্ত করতে সক্ষম, যা মানুষের পর্যালোচনাশক্তি দ্বারা অসম্ভব। এই পূর্ব শনাক্তকরণ সক্ষমতা পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই অপরাধ দমনে সাহায্য করবে। এই ক্ষেত্রে এআই অপরাধীর আচরণ বিশ্লেষণ করে অপরাধপ্রবণ অঞ্চল, অপরাধের ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী রিসোর্স মোবিলাইজেশন ও প্রো-অ্যাকটিভ সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্রিমিনাল ট্র্যাক ডেটা, মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য ব্যবহার করে থাকে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সমাজের ৩০-৪০ শতাংশ অপরাধ কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে জরুরি সময়ে সেবাপ্রত্যাশীর ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় ২৫-৩০ শতাংশ কমিয়ে আনে। 

 কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মুখমণ্ডল শনাক্তকরণ (ফেইস রিকগনিশন) প্রযুক্তি সন্দেহভাজন অপরাধীকে চিহ্নিত ও তার গতিবিধি লক্ষ করতে সক্ষম। একই সঙ্গে এই প্রযুক্তি নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান, আত্মগোপনে থাকা অপরাধীকে খুঁজে বের করা এবং জনসমাগমে মানুষের নিরাপত্তায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের নিউ অর্লিপ্স শহরের পুলিশ অপরাধী, গাড়ি ও স্থান শনাক্ত করতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার করে। রাশিয়া ও চায়নাতেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত।
 
স্মার্ট বাংলাদেশের পাশাপাশি স্মার্ট সিটির বিষয়টিও এখন বহুল আলোচিত হয়ে উঠেছে। স্মার্ট সিটি নাগরিকদের দ্রুত সেবা প্রদান যেমন নিশ্চিত করবে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করবে। স্মার্ট সিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত স্মার্ট পুলিশিং অপরাধী শনাক্ত-চিহ্নিতকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। অপরাধের ঘটনাস্থল ও অপরাধী দ্রুত শনাক্ত করা যাবে। পৃথিবীর উন্নত দেশের শহরগুলোতে সিসিটিভি বসিয়ে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়। সন্দিগ্ধ বা কোনো অপরাধী অথবা অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে ইন্টেলিজেন্ট ক্যামেরার সাহায্যে সহজেই শনাক্ত করতে পারে। আর এর পেছনে কাজ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেটেড সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন। ২৪/৭ মনিটরিংয়ের ফলে অপরাধীদের নির্বিঘ্ন চলাচল অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এবং অপরাধ সংঘটনের মাত্রা কমে যায়। এই নিরবচ্ছিন্ন মনিটরিং ব্যবস্থায় একটা প্রতিরোধমূলক প্রভাব থাকে। অপরাধী যখন জানে যে অপরাধ করে পার পাবে না, তখন এমনিতেই অপরাধের হার কমে যায়। 

নিরাপদ ও উন্নত শহর বাস্তবায়নে স্মার্ট পুলিশিংয়ের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাকে স্বয়ংক্রিয়, গতিশীল, নির্ভুল, নিরাপদ ও জনবান্ধব করার লক্ষ্যে বিশ্ব্যব্যাপী নানান পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। দি এআই গ্লোবাল সার্ভিল্যান্সের (এআইজিএস) ২০১৯-এর তথ্যমতে ৫৬টি দেশ ইতিমধ্যে নিরাপদ শহর গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্নভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু করেছে। এআই প্রযুক্তির সাহায্যে শহরের রাস্তায় চলমান সব গাড়ির তথ্য সংগ্রহ, ট্রাফিক ফ্লো সিমুলেশন, যানজটের পরিমাণ ও রুট ট্র্যাকিং পর্যালোচনার মাধ্যমে একটি স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব, যার ফলে জনসাধারণের যানজটের ভোগান্তি হ্রাস এবং সময় ও অর্থের সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চলাচল, ফিটনেসবিহীন গাড়ি শনাক্তকরণ, যত্রতত্র পার্কিং, খেয়ালখুশিমতো রাস্তা পারাপারসহ সব অসংলগ্ন ও আইনবহির্ভূত কার্যক্রম রোধ করা সম্ভব হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে শহরের বাস্তবিক তথ্যের ওপর একটি সুবৃহৎ ডেটা সেট তৈরি করার মাধ্যমে ভবিষ্যমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করবে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভার্চুয়াল কার্যক্রম ও নির্ভরতা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। যেহেতু সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি খুবই সংবেদনশীল তুলনামূলক নতুন, তাই এই অপরাধ দমনে, প্রতিকারে ও জনসচেতনতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খুবই কার্যকর ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এআই প্রযুক্তি খুব দ্রুত অসংগতি শনাক্ত করতে এবং ত্বরিত নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে সম্ভাব্য ক্ষতি প্রতিহত করতে সক্ষম। এই প্রো-অ্যাকটিভ ব্যবস্থাপনা দেশের ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে স্বয়ংক্রিয় পাহারাদার হিসেবে কাজ করে। সাইবার সিকিউরিটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার স্মার্ট পুলিশিং বাস্তবায়নে কাজের ব্যাপকতা ও উপযোগিতায় একে অপরের পরিপূরক। 

অধিকন্তু, স্মার্ট পুলিশিং বাস্তবায়নে কাজের ব্যাপকতা ও প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সুষ্ঠু মানবসম্পদ ও সম্পদ বরাদ্দ (রিসোর্স অ্যালোকেশন) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে পেট্রল রুটস অপটিমাইজেশন, লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনা ও মাঠ প্রশাসন ব্যবস্থাপনায় এআই অ্য্যালগোরিদম ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যমুখী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এটি শুধু সেবা প্রদানে গতিশীলতাই আনে না, বরং একই সঙ্গে সেবার মানোন্নয়ন ও জবাবদিহি সুনিশ্চিত করে। ২০১৫ সালের দিকে ৮১ শতাংশ ব্রাজিলিয়ান কোনো না কোনোভাবে হত্যার শিকার হওয়ার আশঙ্কা করতেন। পরবর্তী সময়ে রিও ডি জেনেরিওর পুলিশ হত্যার ঘটনা ও হুমকি পর্যালোচনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেয় এবং উক্ত অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়। 

আমাদের দেশের বিদ্যমান পুলিশিং ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ বিশ্বের সব জনবহুল দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করবে। স্বয়ংক্রিয় ও দ্রুত শনাক্তকরণ, সাড়াদান ও প্রতিকারের এই সক্ষমতা সামাজিকভাবে অপরাধ দমন ও বিস্তার রোধে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে ডেটা ড্রিভেন পর্যালোচনার মাধ্যমে এআই প্রদত্ত ভবিষ্যমুখী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে সামাজিকভাবে অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে, যা একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরাপদ সমাজব্যবস্থার দিকে আমাদের নিয়ে যাবে। 

বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশ শতভাগ না হলেও বহুলাংশেই ডিজিটাল ও আধুনিক হয়ে উঠেছে। দেশের থানাগুলোকে সংযুক্ত করা হয়েছে সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও ডেটাবেইসের আওতায়। অপরাধ তদন্ত, ময়নাতদন্ত, অপরাধী শনাক্তকরণেও ব্যবহৃত হচ্ছে ডিএনএ-ফরেনসিক বিশ্লেষণসহ আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। স্বল্প সময়ে অপরাধীরা ধরাও পড়ছে। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্যই পুলিশ বাহিনী। সেই প্রেক্ষাপটে দেশের পুলিশ বাহিনী সর্বদাই আইনের রক্ষকের ভূমিকায় জনবান্ধব হিসেবে অবতীর্ণ হচ্ছে। 

মোটকথা, অপরাধ করে পার পাবে না কেউ পুলিশের হাত থেকে, তা সে যে ধরনের অপরাধই হোক না কেন। তবে এসবের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের জন্য থাকতে হবে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বাধিক ব্যবহার, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, সিসি ক্যামেরা, দক্ষ জনবল, স্ট্রাইকিং ফোর্স, অত্যাধুনিক যানবাহন, ট্যাকটিক্যাল বেল্ট, আনুষঙ্গিক সরঞ্জামসহ অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার—এ সবই যুক্ত করতে হবে পুলিশ বাহিনীতে। 

স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট পুলিশিং হবে একটি অনিবার্য বাস্তবতা। উৎপাদন, প্রস্তুতকরণ, বিপণন থেকে শুরু করে সেবা প্রদান—সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে। পরিবর্তিত এই প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা, অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে স্মার্ট পুলিশিং হবে একমাত্র নিয়ামক। এই বাস্তবতা সামনে রেখে একটি আধুনিক, দক্ষ, প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট পুলিশ গঠনে বাংলাদেশ পুলিশ এগিয়ে যাচ্ছে। নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ, পদায়ন ও পদোন্নতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার ওপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তদুপরি আধুনিক প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং বাহিনীর সদস্যদের অধিকতর প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্মার্ট পুলিশ ও স্মার্ট পুলিশিং ব্যবস্থাপনা প্রস্তুতি গ্রহণের এখনই সময়। আমরা সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে। আর সেই সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশও হবে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক স্মার্ট পুলিশ। 

লেখক: পুলিশ সুপার, হবিগঞ্জ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইমরান খান

সম্পাদকীয়
ইমরান খান

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।

সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জেলে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তান ক্রিকেটের কিংবদন্তি এবং রাজনীতিবিদ ইমরান খান কারাবন্দী রয়েছেন। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থেকে একসময় তাঁর দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, সরকার গঠন করেছিল। এরপর কীভাবে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কারাগারে তিনি সুস্থ আছেন, এই সংবাদ প্রকাশিত হলে ইমরান খানকে নিয়ে সংশয় কেটে যায়।

পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাঁটলে নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তন কীভাবে হয়, তা যে কেউ জেনে নিতে পারবে। নির্বাচিত সরকারপ্রধানকে সরিয়ে হয় একটা পুতুল সরকার বসানো হয় অথবা সরাসরি ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হন কোনো জেনারেল। ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান হয়ে আসিম মুনিরে এসে ঠেকেছে পাকিস্তানের বিধিলিপি। ফলে পাকিস্তানকে জেনারেলদের দুনিয়া বলা হলেও সত্যের অপলাপ হবে না। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন হতে চাইলেই সে সরকারের ওপর নেমে আসে বিভীষিকা। অরাজকতা যেন সেখানকার ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে।

ইমরান খান জনপ্রিয় নেতা। বিগত নির্বাচনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু দলটির স্বতন্ত্র সদস্যরা জিতে নেন অনেকগুলো আসন। পাকিস্তানি রাজনীতিতে দলটির একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান রয়েছে। জেলখানায় বন্দী ইমরান খান পাকিস্তানে এখনো খুবই জনপ্রিয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি জেনারেলদের বিরোধের মধ্যে পড়ে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন। এ ছাড়াও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা দেখা দেওয়ায় তিনি বিরোধী দলগুলোর রোষানলে পড়েন। যার ফলে তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ইমরান খানের একটি বক্তব্য স্মর্তব্য। তিনি তাঁর দলের সঙ্গে জুলুম হচ্ছে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কী হয়েছিল? সবচেয়ে বড় যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জিতেছিল, তাদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছিল সামরিক বাহিনী। তাদের যে অধিকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি।’ ইমরান আরও বলেছিলেন, ‘আমার জানা ছিল না, সেখানকার মানুষের ভেতরে কী পরিমাণ ঘৃণা জমেছিল। কেন ঘৃণা জমেছিল? তারা নির্বাচনে জিতেছিল আর আমরা তাদের সেই অধিকার দিচ্ছিলাম না। প্রধানমন্ত্রী তাদের হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এখানে (পশ্চিম পাকিস্তানে) বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তাদের প্রধানমন্ত্রী হতে দেব না।’

পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্র আসবে কি না, সেটা নির্ভর করবে দেশটি আইনের শাসনের প্রতি কতটা অনুগত, তার ওপর। আপাতত সেই পরিবেশের উন্নতি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর সেই অন্ধকারই নিয়ন্ত্রণ করছে ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যেখানে মুক্তিযুদ্ধ বেঁচে থাকে

জাহীদ রেজা নূর
‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত। নারীকে সেখানে লালসার শিকার হিসেবে তুলে ধরে বাণিজ্যিক লাভালাভের খোঁজ করেছেন পরিচালকেরা। এরপর ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটাই তো থমকে দাঁড়াল। এমনভাবে সাংস্কৃতিক জগৎটা নির্মাণ করা হলো, যেন মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছুই ঘটেনি এ দেশে। এই মতলবি রাজনীতি চলেছিল অনেক দিন ধরেই। বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশে পরিণত করেছিল যারা, তাদের খায়েশ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে আবার আঁতাত করার। যে রক্ত ঝরেছিল একাত্তরে, তাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল দম্ভ ভরে। কিন্তু সে সময় তাদের সে খায়েশ পূরণ হয়নি। একের পর এক সামরিক শাসক দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে সবচেয়ে যে বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা হলো দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়।

কিছুটা সামাল দিয়ে আশির দশকে আবার শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ। কিন্তু মূলধারার চলচ্চিত্রে উল্লেখ করার মতো চলচ্চিত্র হয়নি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে মানবিক আবেদন আছে বটে, কিন্তু তা শিল্পের দাবির সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।

২. আজ আমরা এমন কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলব, যেগুলো নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার পরে। এই চলচ্চিত্রগুলো পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি নয়, স্বল্পদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবিও নয়। এগুলো তথ্যচিত্র।

ছবিগুলোর মধ্যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নেই। কিন্তু এর মধ্যে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে তুলে ধরে। ভাবায়।

অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, নব্বইয়ের দশকে যখন ‘মুক্তির গান’ নিয়ে এলেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ, তখন কীভাবে আলোড়িত হয়েছিল দেশের তরুণ সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি এই সংযোগ একটা জাগরণী মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন যে ফুটেজগুলো ধারণ করেছিলেন একাত্তরে এবং যেগুলো অলসভাবে পড়ে ছিল তাঁর বেজমেন্টে, সেগুলো উদ্ধার করে এনে তারেক-ক্যাথরিন জুটি যা করলেন, তা আমাদের সত্যিকারের ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল।

হ্যাঁ, সে ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদেরও দেখা গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় হয়ে যা উঠে এসেছে, তা হলো স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কীভাবে যুক্ত হওয়া যায় এই যুদ্ধে। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে যাওয়া শিল্পীরাই সংগঠিত হয়ে তৈরি করেছিলেন গানের দলটি। উদ্বাস্তু শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে তাঁরা শুনিয়েছেন জাগরণী গান। ব্যক্তিগতভাবে এই শিল্পীদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁদের কাছ থেকেই জেনেছি, খেয়ে-না খেয়ে কীভাবে তাঁরা কাজ করেছেন। আবার উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ গানের শেষে জোর করে তাঁদের আপ্যায়ন করেছেন। খুবই সাধারণ খাবার, কিন্তু আন্তরিকতা? যুদ্ধে এই আন্তরিকতার প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধ তো মনস্তাত্ত্বিক খেলা। প্রচারণার খেলা। সেই খেলায় জয়ী হয় তারাই, যাদের পেছনে দেশের মানুষের সমর্থন থাকে। ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ কীভাবে যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে ইতিহাস তুলে ধরার জন্য মাটির গান ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ। আরও অনেক কারণেই তা গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণের কথা তো উল্লেখ করতেই হবে—যারা একাত্তর নিয়ে এখন নতুন মিথ তৈরি করার মতো চালাকি করছে, তারা যেসব কারণে হালে পানি পাবে না, তার একটি হচ্ছে তথ্যভিত্তিক ইতিহাস। এই ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে নতুন বয়ান তৈরি করার চেষ্টা একসময় হাসির খোরাকে পরিণত হবে।

৩. ইদানীং দেখা যায়, অনেকেই একাত্তরে ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে কটাক্ষ করেন। অনেকে তো বলেই থাকেন, এই নারীরা নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় পাকিস্তানি হানাদারদের বাহুলগ্না হয়েছেন। এই অরুচিকর মন্তব্য কারা করতে পারেন, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সচেতন, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের ধারণা আছে। মুশকিল হলো, তরুণ প্রজন্ম ইতিহাসের কোন শিক্ষাটি নেবে? মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে অনেকেই অনেক রকম ফায়দা তুলে নিয়েছেন। ফলে, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিংবা যাদের পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, অথবা যাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনার সৌভাগ্য হয়নি, তারা তো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হতেই পারে। তাদের সামনে প্রামাণ্য উদাহরণ থাকলে তারা মাথা খাটিয়ে নিজেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। তরুণদের দোষারোপ করার কোনো কারণ নেই। তাদের কাছে সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে না পারলে তারা অজায়গা-কুজায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সেখানেই বিপদ। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ইতিহাস খুঁজে নিতে হবে। তেমনই একটি তথ্যভান্ডার হতে পারে ইয়াসমিন কবিরের ‘এ সার্টেইন লিবারেশন।’

‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবিটি দেখতে বসলে প্রথমে বোঝাই যাবে না, এ ছবির প্রাণ কতটা গভীরে। গুরুদাসী মণ্ডলকে উন্মাদ মনে হতে পারে। খুলনার কপিলমুনির রাস্তাঘাটে যে পাগলিকে দেখা যায়, তার জীবনে একটা কাহিনি আছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে নারী, তাকে স্বাধীন বলা হবে নাকি পরাধীন—এই প্রশ্ন তো স্বভাবতই জেগে উঠতে পারে মনে। কাহিনি যত এগিয়ে যেতে থাকে, ততই মানুষ একটু একটু করে অনুভব করতে পারে আপাত এই স্বাধীনতা মোটেই মুক্তি নয়। বেঁচে থাকার অমোঘ নিয়মেই গুরুদাসীর এই পাগল বেশ।

এই ছবিতে অসাধারণ কিছু সংলাপ আছে। তার একটি এখানে বলা যেতে পারে। এক মুসলিম পরিবারের ঘরেই খাওয়াদাওয়া করে গুরুদাসী। এ কারণেই সেই পরিবারে গরুর মাংস রান্না হয় না। এই বাড়ির গৃহকর্ত্রী যখন ধর্মের বিষয়ে তার সরল স্বীকারোক্তি করে, বলে, সবার রক্তই লাল। তখন বড় বড় দার্শনিকের নানা আবিষ্কারও সেই সংলাপের কাছে ম্লান হয়ে যায়। এই নারী কথাগুলো শিখেছে জীবনে চলতে গিয়ে। তাই তা প্রগাঢ় সত্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়।

একটা সময় গুরুদাসীকে নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পড়ে শোনানো হয়। তার স্বামী এবং সন্তানদের কীভাবে তার সামনে হত্যা করা হয়েছে এবং কীভাবে তাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়েছে, সে বিষয়টিও মূর্ত হয়ে ওঠে ছবিতে।

একজন বীরাঙ্গনার জীবনকাহিনি ছবির ভাষায় বর্ণনা করে ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে যেভাবে এনেছেন ইয়াসমিন কবীর, তাতে তাঁকে সাধুবাদ দিতে হয়।

৪. একেবারে অন্য ধরনের একটি ছবি ‘নট এ পেনি, নট এ গান’। মকবুল চৌধুরী নির্মাণ করেছেন ছবিটি। নিজের বাবাকে নিয়ে তৈরি এ ছবিটি। যে বিষয় নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে, সেদিকে সাধারণভাবে চোখ যায় না।

মকবুল চৌধুরীর বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুইয়া ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য অ্যাকশন কমিটি ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইউকের কনভেনর বা আহ্বায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটেনের বার্মিংহামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতেই তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়। আর কখনো ব্রিটেনে ফিরে যাননি। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবার আশা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হবে। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি।

এরপর মকবুল চৌধুরী বার্মিংহামে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বার্মিংহামের বাঙালিদের সংগ্রাম এবং তাঁর নিজের বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুঁইয়ার অবদানের কথা। সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু তাঁরা তাঁদের সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। রেখে দিয়েছেন সেই সংগ্রাম নিয়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার কাটিং।

সেই ছবিতে পরিষ্কার হয়ে যায়, বার্মিংহাম তথা ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য কত আত্মত্যাগ করেছেন কত মানুষ!

শুধু অস্ত্র হাতেই যুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে কতভাবে, সেটা জানা দরকার।

৫. আরও অনেক তথ্যচিত্রের কথা আলোচনায় আনতে হবে। নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে। এবং সে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এই জনযুদ্ধের একজন জননায়ক ছিলেন। এই জনযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়েছে। সেটা মেনে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক তুলে ধরা আজ আরও বেশি প্রয়োজন। যে তিনটি ছবির কথা উল্লেখ করা হলো, সেখানেও নির্মোহভাবে এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করেই নতুন পরিবর্তনগুলো আসবে। অন্যভাবে নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মা কুকুর ও তার আটটি ছানা

স্বপ্না রেজা
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না। প্রকৃতির বিধানে মানবজাতির সঙ্গে কুকুর ও বিড়ালের এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিশ্বস্ততা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে এই দুটি প্রাণীর অবস্থান মানবজাতির সঙ্গে। এটাও যেন সৃষ্টিকর্তার বিধিভুক্ত। কুকুর, বিড়ালের মানুষের সঙ্গে অবস্থানের রহস্য সহনশীলতা, পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা—সবকিছুর পেছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে, যা দৃশ্যমান হয় না। যেটুকু বুঝতে পারা যায় তা হলো, কুকুর-বিড়াল ভালোবেসে কেউ কেউ ঘরে পোষা প্রাণী হিসেবে রাখে, যত্ন করে। এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় সমাজে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। বিশেষ করে যাদের কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা কাজ করে এবং সর্বোপরি যারা প্রকৃতার্থে মানবিক, তারা এমন মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখ পেয়েছে। মূলধারার মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় অন্য প্রাণীপ্রিয় মানুষকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। ঘটনাটি হলো পাবনার ঈশ্বরদী এলাকায় একজন নারী আটটি কুকুরের ছানাকে বস্তাবন্দি করে মেরে ফেলেছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কুকুরের ডাকে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে এমন নির্মম কাজ করেছেন। তাঁর শিশুপুত্র বলেছে, তার মা বস্তায় ভরে কুকুরের ছানাগুলোকে পানিতে ফেলে দিয়েছে। মা কুকুর তার ছানাদের না পেয়ে পুরো এলাকায় কান্না করে বেড়িয়েছে, অসহায় হয়ে ঘুরে ফিরেছে। তার স্তনে ছিল সন্তানদের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আহার। সন্তানদের এই দুগ্ধপান করাতে না পারায় অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে মা কুকুর তার ছানাদের খুঁজে ফিরেছে। তার কণ্ঠে তার মতোই ভাষা ছিল। চোখে ছিল অশ্রু। শরীরের ভেতর নিদারুণ অসহায়ত্ব। একজন মা মানুষের মতোই তার আর্তনাদ ছিল। যিনি হত্যা করেছেন তিনি মা হয়েও বোঝেননি সন্তান হারানোর যন্ত্রণা। স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখে বিষয়টি পড়েছে। তাঁরা মর্মাহত হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে চারপাশের প্রতিবাদে। জানা গেছে, যিনি হত্যা করেছেন তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী এবং ফলাও করে সেটা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এটা তাঁর বড় পরিচয় নয়। বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন মা মানুষ হয়ে একজন মা কুকুরকে নিঃসন্তান করেছেন, আটটি সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন।

যে মা কুকুর তার আটটি সন্তান হারিয়েছে তাকে স্থানীয় লোকজন ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন টমি। তাঁদের ভালোবাসায় সিক্ত টমি তার সন্তানদের আশ্রয় হিসেবে জায়গাটিকে সুরক্ষিত মনে করেছিল। কিন্তু সবকিছুকে অর্থহীন করে দিল একজন নিশি খাতুন, যিনি মা আর সন্তানের মধ্যকার গভীর টান, অনিবার্য সান্নিধ্যটুকু বুঝতে পারেন না। কিংবা স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটা বুঝতে শিখেছেন। সমাজে একটা বোধ বেশ প্রচলন আছে, সেটা হলো, শিশু ও ফুলকে যে ভালোবাসে না সে আদতে ভালো মানুষ নয়। মানুষসহ সব জীবের কথাই এখানে প্রযোজ্য। আমাদের সমাজে প্রায়ই একজন আরেকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে, নিঃস্ব করে, ধ্বংস করে এবং এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদির স্পৃহা। অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিচারহীনতার বেষ্টনীতে থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে। যার পেছনেও থাকে হীন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। অপরাধ করে মুক্ত জীবনে বসবাস—এই এক ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন ঘটেছে আমাদের সমাজে। এই সংস্কৃতির চর্চা সর্বত্র এবং ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে সুবিধাবাদী করতে যথেষ্ট সহায়ক। আমাদের সমাজে শিশুদের যেভাবে হত্যা করা হয়, যেভাবে ধর্ষণ করা হয়, তার পাশে আটটি কুকুরছানাকে বস্তায় ভরে হত্যার ঘটনাটি কিন্তু বেমানান নয়, বরং বেশ মিলে যায়। কিছুদিন আগেও দেখা গেছে যে কুকুর প্রাণীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলছিলেন, এই সমাজে কোনো প্রাণীই আর নিরাপদ নয়। হত্যার বিষয়টি প্রত্যেকের নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেছে। যেভাবে মানুষ হত্যা হচ্ছে, সেভাবে অন্য জীব হত্যা হচ্ছে। হত্যা করাই যেন সহজতর কাজ। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সরকারি ও বেসরকারি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হরিণ মেরে খাওয়ার প্রবণতা ও স্পর্ধার তো অপ্রচলন ঘটেনি কখনো, বরং তা রয়েই গেছে।

পত্রিকান্তরে জানা গেছে, কুকুরছানা হত্যাকারী নিশি রহমান ধরা পড়েছেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তিনি বস্তায় ভরে রেখে এসেছেন কিন্তু পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেননি। কিন্তু নিশি রহমানের শিশুপুত্র বলেছে, কুকুরছানাদের বস্তায় ভরে পানিতে ফেলেছে। সব শিশুর ভেতরেই শিশুসুলভ সরলতা কাজ করে যা সত্য বলতে সহায়ক হয়। নিশি তাঁর অপরাধকে লুকাতে পারেননি নিজের শিশুপুত্রের সরলতার কারণেই। প্রকৃতির হিসাব কখনো ভুল হয়নি, ভুল হয় না। মিডিয়ায় দেখা গেল, মা কুকুরকে স্বস্তি ও শান্তি দেওয়ার জন্য দুটি কুকুরছানা এনে তার দুগ্ধপান করানো হচ্ছে। কাজটি করছেন স্থানীয় তরুণরা এবং বিষয়টি অবলোকন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। মা কুকুরের সঙ্গে কুকুরছানা দুটিকে অভ্যস্ত করা হচ্ছে, টিভির পর্দায় দেখা গেল। মা কুকুর তার দুগ্ধপানে বেশ সহায়তা করছে ছানা দুটিকে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো, এই হিংস্র, হিংসাবিদ্বেষের জগতে ভিন্নতর ও সবচেয়ে মধুর ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করছি যেন। ভীষণ ভালো লাগল। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা জাগল, জগতের সব প্রাণীর স্বস্তি ও শান্তি নিশ্চিত করার চেতনা জাগ্রত হোক সর্বত্র।

একজন বলছিলেন, নিশি রহমানকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়েছে। প্রাণিসম্পদ রক্ষার আইনে তাঁর বিচার হলে মানুষের ভেতর সচেতনতা বাড়বে। এ ধরনের অপরাধ আর কেউ করবে না। ঠিক কথা। কিন্তু শেষ অবধি কী হয় বা হবে ? যেমন আমরা দেখি, মানবসন্তানকে হত্যা করেও অনেক অপরাধী বিচারবহির্ভূত জীবনযাপন করছে, আবার যেকোনো প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসায় শিশুরাই কেবল বলি হয় বা হচ্ছে, সেখানে কঠিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করে এবং অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, যাচ্ছে।

যেকোনো অপরাধ আইনের আওতায় আনা জরুরি এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচার করতে হবে। গোটা প্রক্রিয়া হতে হবে সংবিধান অনুসারে এবং দলীয় রাজনীতিমুক্ত। মিডিয়ায় প্রচারনির্ভর কর্মকাণ্ড নয়, বরং লক্ষ্য হতে হবে প্রতিটি প্রাণীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাতেই সচেতনতা বাড়বে, মায়েদের শান্তি ফিরবে। দেশ হবে সবার বসবাসের উপযোগী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যেথায় হাওয়ায় ভাসে ফুলের কান্না

সানজিদা সামরিন
সানজিদা সামরিন
সানজিদা সামরিন

ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়। শিশুটির কান্না শুনে একজন কৃষক তাকে উদ্ধার করেন। পরে এলাকাবাসীর সহায়তা নিয়ে দ্রুত শিশুটিকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুটির পরিচয় জানা যায়নি।

গত এক মাসের কথাই যদি ধরি, এ রকম আরও কতগুলো খবর পড়তে হয়েছে তার হিসাব নেই। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে পলিব্যাগে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে সন্তানের জন্মের পর মা নিজেই পালিয়ে গেছেন। একজন ডাক্তার ফেসবুক পোস্টের মাধ্য়মে জানিয়েছেন, এক নবজাতকের জন্মের পর একটি কঠিন অসুখ দেখা দেয়। বাবা-মা চিকিৎসা করাতে চাননি। সন্তানটিকে হাসপাতালে ফেলে বাড়ি চলে যান। হাসপাতাল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চেষ্টা করেছে শিশুটিকে বাঁচাতে, কিন্তু সম্ভব হয়নি। সে মৃত্য়ুর কোলে ঢলে পড়ে। নবজাতকের মৃতদেহ নেওয়ার জন্য তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁরা কেউ আসতে রাজি হননি। কী বীভৎস তাই না? ভাবতেই গায়ে শীতকাঁটা দিচ্ছে আমার, হয়তো আপনাদেরও। আবার এমন জানা যায়, হাসপাতালের টয়লেটের ওয়াটার ট্যাংকে নবজাতককে ডুবিয়ে রেখে পালিয়ে গেছেন তারই নিজের মা।

ওপরের প্রতিটি ঘটনা বা খবরই চিরাচরিত সেই কথাটিকে মিথ্য়ে করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, ‘মা’র মতো আপন আর কেউ হয় না।’ যদি তাই হয়, তাহলে যে শিশুটি আজ বা গতকাল পৃথিবীর আলো দেখল, তার স্থান ধানখেতে কেন। কেন সেখানে শিয়াল, কুকুর এসে আঁচড় কাটছে তার ফুলের মতো শরীরে? ময়লার স্তূপে পড়ে কাঁদছে কেন সে? কেন মা নিজেই চান তাঁর সন্তানটি মরে যাক!

অনেকেই হয়তো এর উত্তরে বলবেন, ‘উপায় ছিল না, তাই হয়তো’, অথবা ‘সেই নারী পরিস্থিতির শিকার’। যদি আমি আমার সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে উল্টোপথে হাঁটি, যদি বলি, এই শিশুগুলোর জীবন কোনো পরিস্থিতি নয়, বরং কারও ইচ্ছের ফল। সোজাসাপ্টাভাবে বললে, কোনো নারী, তিনি বিবাহিত হোন বা অবিবাহিত; স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়ান বা ধর্ষণের শিকার হন; ঘটনা যাই হোক, তিনি যদি গর্ভকাল এড়াতে চান তাহলে আগে থেকেই তো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল। ২০২৫-এ এসে কোনো শিশু জন্মের পরে গিয়ে পরিত্যক্ত হবে, এ ঘটনা মেনে নেওয়া কঠিন। বাজারে বিভিন্ন রকমের জন্মনিরোধক পাওয়া যায়, অপরিকল্পিত গর্ভধারণের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য়ে অ্যাবরশনও কিন্তু করা যায়। ফলে যে নারী বা যে দম্পতি সন্তান চাইবেন না, তিনি কেন এসব উপায় বেছে নেন না? আর যদি সেই গর্ভস্থ সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিতই হয়, সমাজের ভয়েই যদি জন্মের পর সন্তানকে ডাস্টবিনে, ওয়াটার ট্যাংকে ফেলে দিতে হয়, তাহলে ৯ মাস ১০ দিন ধরে তাকে গর্ভে রেখেছেনই কীভাবে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। যে নারী সবার চোখের সামনে নিজের গর্ভকাল পার করে ফেলতে পারেন, তিনি কিনা সমাজের দোহাই দিয়ে সদ্য় জন্মানো সন্তানকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন? কথা এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।

নিজের সন্তানকে হত্য়া করার আরও একটি কারণ পাওয়া যায়। হয়তো সেই নারী নতুন আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আর সেই সম্পর্ক সফল করতে হলে সন্তান নামের বাহুল্য না থাকাই হয়তো শ্রেয় বলে ভাবেন তিনি। আমার মতে, সেখানেও তো উপায় রয়েছে। এমন অনেক নিঃসন্তান মা রয়েছেন যাঁরা দিনের পর দিন মা ডাকটি শুনতে চান। এমন নিরাপদ কোনো পরিবার খুঁজে সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিলেই তো হয়। হত্য়ার দায় না নিয়ে জীবনসঙ্গীকে ডিভোর্স ও সন্তানকে দত্তক দিলে নিজের জীবনটাও নির্বিঘ্নে কাটানো যায়। ওই জীবনগুলোও বেঁচে থাকার নতুন কারণ খুঁজে পায়।

একজন মা নিজের সন্তানের জীবননাশকারী আরও একটি কারণে হয়ে ওঠেন। এই কারণটি ২০২৫ সালে এসেও অনেকের কাছে হাস্য়রসের বিষয়। তা হলো–পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। চিকিৎসকদের মতে, বিশ্বজুড়ে সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে ৮৫ জন এই জটিলতায় ভোগেন। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যান অনেকে। কিন্তু যাঁরা স্বাভাবিক হতে পারেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেই ঘটে অঘটন। বেবি ব্লু থেকে সৃষ্টি হয় তীব্র হতাশার, তারপর তা রূপ নেয় পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে। এসব ক্ষেত্রে মা নিজের সন্তানকে হত্য়া পর্যন্ত করতে পারেন। এমনিতেও খেয়াল করলে দেখবেন, একজন মা তাঁর সন্তানের সঙ্গে যত ধরনের বিরূপ আচরণ করেন, তার অন্যতম মূল কারণ পারিবারিক অসহযোগিতা। আমাদের দেশে এই সংকট আরও প্রবল। বেশির ভাগ পরিবারেই দেখা যায়, বাড়ির সব কাজ ও সন্তান লালন-পালনের প্রতিটি বিষয় মায়ের কাঁধে চেপে বসে আছে। ফলে দিন শেষে, তিনিও ভারসাম্য় হারাচ্ছেন। চোটপাট করছেন অবুঝ শিশুটির ওপর।

তবে যে কথা দিয়ে এই লেখার শুরু, তাতে একটা কথাই বলতে ইচ্ছা হচ্ছে; নিজেদের কাছে একটা আশা রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে, তা হলো–যদি কেউ সন্তান না চান, তাকে সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার ইচ্ছা না থাকে বা বুঝে থাকেন পৃথিবীতে এলে তাকে অবহেলাই পেতে হবে; তাহলে তাকে পৃথিবীতে আসার পথ না দেখানোই ভালো। যে শিশু নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না, তাকে আপনি তো আপনার ইচ্ছাতে হত্য়া করতে পারেন না। হাওয়ায় ভেসে আসা নবজাতকের কান্না, শিয়ালের আঁচড়ে কেঁপে ওঠা তার শরীর, জলের বুদ্‌বুদে মিশে যাওয়া তার বুকের মৃদু ধুকপুক শব্দ প্রকৃতিতে যে অভিশাপ ঢেলে দেয়। প্রকৃতি সব মনে রাখে। সেও তো সব কড়ায়-গন্ডায় ফিরিয়ে দেয়। কী, দেয় না?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত