আক্তার হোসেন

বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুদৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশ ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী ’৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। আর সেই বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে চলে যাব।’
উন্নয়নের মহাসড়কে চলমান বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ। ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত ধরে উন্নয়নের ধারা বজায় রেখে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে একটি উন্নত, সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ। তবে এ যাত্রায় অনেক সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাড়াতে হবে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা। একই সঙ্গে সার্বিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ ২০২৩ উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ সদস্যদের প্রতি বেশ কিছু মূল্যবান ও উপদেশমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে একটি দক্ষ ও বিশ্বমানের “স্মার্ট পুলিশ” গড়ে তোলা।’ সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে উন্নত বাংলাদেশ এবং সেটি হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা জনসাধারণ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশে নাগরিকসেবা থেকে শুরু করে সব আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো প্রশাসন। আর প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠন হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলতে প্রধানত পুলিশ সার্ভিসকেই বোঝানো হয়। পুলিশের ওপর জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক জীবনযাপন অনেকটাই নির্ভরশীল। উন্নত বিশ্বে পুলিশ জনগণের সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত থাকে। যেকোনো সমস্যায় জনগণ পুলিশের সাহায্য কামনা করে। পুলিশ সদস্যদের কাজই হলো জনগণের যেকোনো সমস্যায় সব ধরনের সহযোগিতা করা। অসহায়, বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি আন্তরিকভাবে সহযোগিতা ও মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। পাশাপাশি জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া। মোটকথা, পুলিশ সদস্যরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় জনগণের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
উন্নত বিশ্বে সাধারণত ধরা হয়ে থাকে যে সমাজের ৯০ শতাংশ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলবে, বাকি ১০ শতাংশ মানুষ আইনের বরখেলাপ করবে অথবা বিপথগামী হবে। পুলিশ তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে অথবা আইনের আওতায় আনবে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, পুলিশ এই ১০ শতাংশ মানুষের কাছ থেকে সমাজের ৯০ শতাংশ শান্তিকামী মানুষকে রক্ষা করবে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ৯০ শতাংশ মানুষ কি আইন মেনে চলে বা চলার মতো পরিবেশ আছে? তবে এ কথা ঠিক, অল্প কিছু মানুষের নিয়মবহির্ভূত কাজের প্রভাব সমাজে অনেক বেশি পড়ে। পুলিশের কাজ মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং কেউ যদি অন্যায়ভাবে আটক হন, তার প্রভাবও বেশি থাকে। সামান্যতম বিচ্যুতিও মানুষকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। পুলিশকে আইনত মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করার অধিকার দেওয়া আছে, তবে তা সম্পূর্ণ ন্যায়সংগতভাবে হতে হবে।
পুলিশের কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে সতর্ক আছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে, সেটা নিয়ে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিনিয়ত কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। প্রতিদিন দায়িত্ব বণ্টনের আগে কর্মকর্তারা পুলিশ সার্ভিসের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রেখে কাজ করার বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। থানা থেকে শুরু করে পুলিশ লাইনস, পুলিশ ক্যাম্প, বিভাগ—সবখানেই কাউন্সেলিং করা হয়। কাউন্সেলিংকালে পুলিশ সদস্যদের কোথাও তল্লাশি চালাতে হলে কী নিয়ম মানতে হবে, কী ধরনের আচরণ করতে হবে, তা বুঝিয়ে বলা হয়। সাধারণ মানুষকে যেন সম্মান দেওয়া হয়, তাদের প্রতি যেন ভদ্র আচরণ করা হয়।
স্মার্ট পুলিশিং হলো তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক পুলিশিং ব্যবস্থা, যেখানে জ্ঞানবিজ্ঞান ব্যবহৃত হয় অত্যধিক। স্মার্ট পুলিশিংয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রমের উপাদানগুলো ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও গবেষণা করা হয়, যা অফিসারদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির সহায়ক। তা ছাড়া নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করা হয় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য। অর্থাৎ, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত সময়ে নির্ধারিত, বাস্তবিক ও কাঙ্ক্ষিত পুলিশিং সেবা প্রদানই হলো স্মার্ট পুলিশিং।
মানুষের ব্যক্তিগত থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ধাপে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক প্রয়োগ ইতিমধ্যে লক্ষণীয় প্রভাব ফেলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো প্রেডিক্টিভ পুলিশিং, যা স্মার্ট পুলিশিং বাস্তবায়নে এমন এক ব্যবস্থাকে বোঝায়; যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে একটি স্বয়ংক্রিয়, দ্রুতগতিসম্পন্ন ও তুলনামূলক নির্ভুল ব্যবস্থাপনা। অপরাধ ও অপরাধীকে শনাক্ত করার মাধ্যমে অপরাধ প্রতিরোধ, বিশ্লেষণ ও প্রতিকারে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। যেমন—সিসি ক্যামেরা, সেন্সর ডিভাইস, পূর্বে তৈরিকৃত ডেটাবেইসের তথ্য বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম। আইন প্রয়োগের ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এ আই) সংযোজন একটি বৈপ্লবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা জননিরাপত্তায় ফোর্স মোবিলাইজেশন, রিসোর্স অ্যালোকেশন, স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অগ্রিম তথ্য প্রদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
ডিজিটাল যোগাযোগমাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষ ঘরে বসে তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি সেবা উল্লেখ না করলেই নয়। আমরা সবাই জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর সুবিধাভোগী। বিপদাপদ, অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা বা যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সেবার জন্য ৯৯৯-এ কল করে থাকি। এটা পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং স্বাস্থ্য সমন্বয়ে একটি সেবা। সেবাটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর উদ্বোধন করেন। এটি তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত বা উদ্ভাবন। আরেকটি সেবা অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স। বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের প্রবাসে চাকরি বা অভিবাসন প্রক্রিয়ায় এই ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজন হয়। সেবাটি চালু হয় ২০১৭ সালে। এ ধরনের আরও বহুবিদ অনলাইন সেবা রয়েছে। ডিজিটাল হওয়ার কারণে সেবা দ্রুত মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। এতে সময় ও খরচ দুই-ই কম লাগছে।
একটি তথ্য ও তথ্যভিত্তিক বা তথ্যনির্ভর সমাধান পদ্ধতি, যাকে কম্পিউটারের ভাষায় বলা হয় Algorithm। উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯। যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে নাগরিকদের সেবা প্রদান করার জন্যই সেবাটি প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে ৯৯৯ ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করছে। কেউ ৯৯৯-এ কল করলে কল সেন্টারে একজন অপারেটর (Call Taker) কলটি গ্রহণ করে এবং কলারের চাহিদামতো কল সংশ্লিষ্ট স্থানীয় ইউনিট, অর্থাৎ থানায় ডেসপাচ করে অথবা কনফারেন্সিংয়ের জন্য থানাকে সংযুক্ত করে দেয়। এই ব্যবস্থায় কলারের লোকেশনও জানা যায় (GPS Location)। অতঃপর থানা থেকে সেবাপ্রত্যাশীকে সাড়া প্রদান করা হচ্ছে। সাড়া প্রদানের সময় (Response Time) আরও সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত করার লক্ষ্যে পুলিশের মোবাইল পেট্রল গাড়িগুলোতে মোবাইল ডেটা টার্মিনাল (এমডিটি) বসানোর কার্যক্রমও সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে। ফলে ৯৯৯ কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার থেকে থানায় ডেসপাচের পরিবর্তে সরাসরি ঘটনাস্থল বা সেবাপ্রত্যাশীর নিকটবর্তী কোনো এমডিটিতে কল ডেসপাচ করলে খুব দ্রুত সাড়া প্রদান করা সম্ভব হবে।
স্মার্ট ৯৯৯, যা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ তথা স্মার্ট গভর্নমেন্টেরই’ অংশ, তা আসলে কী রকম হবে? ডিজিটাল ৯৯৯ যখন স্মার্ট ৯৯৯ হবে, তখন কোনো অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা বা অপরাধ, যেমন—হাউস ট্রেসপাসিং, যৌন হয়রানি ইত্যাদিসহ যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে মানুষকে আর কল করতে হবে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসমৃদ্ধ (AI) যেকোনো IOT (Internet of Things)-এর আশপাশে কোনো ঘটনা, দুর্ঘটনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় সেবার জন্য সংকেত বা কোনো অ্যালার্ম স্মার্ট ৯৯৯ কমান্ড সেন্টারে পাঠাতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোথাও সাপ্তাহিক ছুটি উদ্যাপন করতে গিয়েছেন বা আমরা যা সচরাচর করি—ঈদ, পূজার বড় ছুটি পেলে পরিবারের সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে যাই। তখন বাসায় কেউ থাকে না। সে ক্ষেত্রে আপনার বাসায় যদি IOT নামক ডিভাইসটি থাকে আর তার যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থাকে, তবে আপনার অনুপস্থিতিতে যে কেউ আপনার বাসা-বাড়িতে ঢুকলে বা বাসায় কোনো দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড ঘটলে স্মার্ট ৯৯৯ কমান্ড সেন্টারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কল বা অ্যালার্ম বা সিগন্যাল চলে আসবে। শুধু তাই নয়, স্মার্ট ৯৯৯ অবশ্যই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসমৃদ্ধ কলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করে অগ্নিকাণ্ড হলে নিকটবর্তী ফায়ার সার্ভিসকে অথবা কোনো অপরাধসংক্রান্ত হলে নিকটবর্তী ইউনিটকে কল, সংকেত, সিগন্যাল পাঠাবে। সাড়া বা সেবা প্রদান অথবা সাড়া প্রদানকারী ঘটনাস্থলে না পৌঁছানো পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে কলটি লাইভ থাকবে।
আমরা এমন একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল সময় পার করছি, যেখানে বিশ্ব প্রতিটি মুহূর্তে প্রযুক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি নিত্যনতুন জটিল সমস্যার সাক্ষী হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া প্রযুক্তিগত বিপ্লব পরিবর্তন করে দিচ্ছে আমাদের ধারণা, প্রস্তুতি ও কাজের ধরনকে। কালের পরিক্রমায় আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যুগে প্রবেশ করেছি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা হয় ৮০ শতাংশেরও বেশি। এ দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনার জন্য AI সংবলিত Automated Software Application ক্যামেরা এবং স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। মহাসড়কে ইতিমধ্যে সংঘটিত দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে। তদনুসারে স্মার্ট ক্যামেরা সড়ক-মহাসড়কে প্রকাশ্য-গোপনে বসানো যেতে পারে। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত ক্যামেরা গতিসীমার অতিরিক্ত গতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করতে পারবে এবং সংশ্লিষ্ট গাড়ি এবং গাড়ির মালিকের তথ্যভান্ডার (Big Data) বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ণয় করতে পারবে। তদুপরি আইন অনুসারে এ অপরাধের জন্য নির্ধারিত জরিমানা সরাসরি অভিযুক্ত গাড়ির মালিকের যোগাযোগের ঠিকানা, মোবাইল ফোন নম্বর বা ই-মেইলে পাঠিয়ে দিতে পারবে। পেমেন্ট সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এটা মুলতবি দেখাবে। তা ছাড়া, ট্রাফিক সিগন্যাল যদি Automated করা যায়, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যানজট শনাক্ত করে তদনুসারে ট্রাফিক সিগন্যাল স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হবে। ফলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা ট্রাফিক সিগন্যালে যানবাহনের জট অনেকাংশে কমে যাবে। কারণ পুরো ট্রাফিক-ব্যবস্থা তখন ডিজিটাল ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হবে।
পুলিশিং ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের বড় সুবিধা হলো প্রেডিক্টিভ অ্যানালাইসিস। সুবিস্তর তথ্যভান্ডারের স্বয়ংক্রিয় পর্যালোচনার মাধ্যমে এআই অ্যালগোরিদম এমন কিছু ঘটনা ও অপরাধের লক্ষণ শনাক্ত করতে সক্ষম, যা মানুষের পর্যালোচনাশক্তি দ্বারা অসম্ভব। এই পূর্ব শনাক্তকরণ সক্ষমতা পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই অপরাধ দমনে সাহায্য করবে। এই ক্ষেত্রে এআই অপরাধীর আচরণ বিশ্লেষণ করে অপরাধপ্রবণ অঞ্চল, অপরাধের ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী রিসোর্স মোবিলাইজেশন ও প্রো-অ্যাকটিভ সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্রিমিনাল ট্র্যাক ডেটা, মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য ব্যবহার করে থাকে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সমাজের ৩০-৪০ শতাংশ অপরাধ কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে জরুরি সময়ে সেবাপ্রত্যাশীর ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় ২৫-৩০ শতাংশ কমিয়ে আনে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মুখমণ্ডল শনাক্তকরণ (ফেইস রিকগনিশন) প্রযুক্তি সন্দেহভাজন অপরাধীকে চিহ্নিত ও তার গতিবিধি লক্ষ করতে সক্ষম। একই সঙ্গে এই প্রযুক্তি নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান, আত্মগোপনে থাকা অপরাধীকে খুঁজে বের করা এবং জনসমাগমে মানুষের নিরাপত্তায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের নিউ অর্লিপ্স শহরের পুলিশ অপরাধী, গাড়ি ও স্থান শনাক্ত করতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার করে। রাশিয়া ও চায়নাতেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত।
স্মার্ট বাংলাদেশের পাশাপাশি স্মার্ট সিটির বিষয়টিও এখন বহুল আলোচিত হয়ে উঠেছে। স্মার্ট সিটি নাগরিকদের দ্রুত সেবা প্রদান যেমন নিশ্চিত করবে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করবে। স্মার্ট সিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত স্মার্ট পুলিশিং অপরাধী শনাক্ত-চিহ্নিতকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। অপরাধের ঘটনাস্থল ও অপরাধী দ্রুত শনাক্ত করা যাবে। পৃথিবীর উন্নত দেশের শহরগুলোতে সিসিটিভি বসিয়ে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়। সন্দিগ্ধ বা কোনো অপরাধী অথবা অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে ইন্টেলিজেন্ট ক্যামেরার সাহায্যে সহজেই শনাক্ত করতে পারে। আর এর পেছনে কাজ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেটেড সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন। ২৪/৭ মনিটরিংয়ের ফলে অপরাধীদের নির্বিঘ্ন চলাচল অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এবং অপরাধ সংঘটনের মাত্রা কমে যায়। এই নিরবচ্ছিন্ন মনিটরিং ব্যবস্থায় একটা প্রতিরোধমূলক প্রভাব থাকে। অপরাধী যখন জানে যে অপরাধ করে পার পাবে না, তখন এমনিতেই অপরাধের হার কমে যায়।
নিরাপদ ও উন্নত শহর বাস্তবায়নে স্মার্ট পুলিশিংয়ের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাকে স্বয়ংক্রিয়, গতিশীল, নির্ভুল, নিরাপদ ও জনবান্ধব করার লক্ষ্যে বিশ্ব্যব্যাপী নানান পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। দি এআই গ্লোবাল সার্ভিল্যান্সের (এআইজিএস) ২০১৯-এর তথ্যমতে ৫৬টি দেশ ইতিমধ্যে নিরাপদ শহর গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্নভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু করেছে। এআই প্রযুক্তির সাহায্যে শহরের রাস্তায় চলমান সব গাড়ির তথ্য সংগ্রহ, ট্রাফিক ফ্লো সিমুলেশন, যানজটের পরিমাণ ও রুট ট্র্যাকিং পর্যালোচনার মাধ্যমে একটি স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব, যার ফলে জনসাধারণের যানজটের ভোগান্তি হ্রাস এবং সময় ও অর্থের সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চলাচল, ফিটনেসবিহীন গাড়ি শনাক্তকরণ, যত্রতত্র পার্কিং, খেয়ালখুশিমতো রাস্তা পারাপারসহ সব অসংলগ্ন ও আইনবহির্ভূত কার্যক্রম রোধ করা সম্ভব হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে শহরের বাস্তবিক তথ্যের ওপর একটি সুবৃহৎ ডেটা সেট তৈরি করার মাধ্যমে ভবিষ্যমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করবে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভার্চুয়াল কার্যক্রম ও নির্ভরতা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। যেহেতু সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি খুবই সংবেদনশীল তুলনামূলক নতুন, তাই এই অপরাধ দমনে, প্রতিকারে ও জনসচেতনতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খুবই কার্যকর ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এআই প্রযুক্তি খুব দ্রুত অসংগতি শনাক্ত করতে এবং ত্বরিত নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে সম্ভাব্য ক্ষতি প্রতিহত করতে সক্ষম। এই প্রো-অ্যাকটিভ ব্যবস্থাপনা দেশের ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে স্বয়ংক্রিয় পাহারাদার হিসেবে কাজ করে। সাইবার সিকিউরিটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার স্মার্ট পুলিশিং বাস্তবায়নে কাজের ব্যাপকতা ও উপযোগিতায় একে অপরের পরিপূরক।
অধিকন্তু, স্মার্ট পুলিশিং বাস্তবায়নে কাজের ব্যাপকতা ও প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সুষ্ঠু মানবসম্পদ ও সম্পদ বরাদ্দ (রিসোর্স অ্যালোকেশন) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে পেট্রল রুটস অপটিমাইজেশন, লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনা ও মাঠ প্রশাসন ব্যবস্থাপনায় এআই অ্য্যালগোরিদম ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যমুখী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এটি শুধু সেবা প্রদানে গতিশীলতাই আনে না, বরং একই সঙ্গে সেবার মানোন্নয়ন ও জবাবদিহি সুনিশ্চিত করে। ২০১৫ সালের দিকে ৮১ শতাংশ ব্রাজিলিয়ান কোনো না কোনোভাবে হত্যার শিকার হওয়ার আশঙ্কা করতেন। পরবর্তী সময়ে রিও ডি জেনেরিওর পুলিশ হত্যার ঘটনা ও হুমকি পর্যালোচনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেয় এবং উক্ত অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
আমাদের দেশের বিদ্যমান পুলিশিং ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ বিশ্বের সব জনবহুল দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করবে। স্বয়ংক্রিয় ও দ্রুত শনাক্তকরণ, সাড়াদান ও প্রতিকারের এই সক্ষমতা সামাজিকভাবে অপরাধ দমন ও বিস্তার রোধে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে ডেটা ড্রিভেন পর্যালোচনার মাধ্যমে এআই প্রদত্ত ভবিষ্যমুখী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে সামাজিকভাবে অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে, যা একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরাপদ সমাজব্যবস্থার দিকে আমাদের নিয়ে যাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশ শতভাগ না হলেও বহুলাংশেই ডিজিটাল ও আধুনিক হয়ে উঠেছে। দেশের থানাগুলোকে সংযুক্ত করা হয়েছে সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও ডেটাবেইসের আওতায়। অপরাধ তদন্ত, ময়নাতদন্ত, অপরাধী শনাক্তকরণেও ব্যবহৃত হচ্ছে ডিএনএ-ফরেনসিক বিশ্লেষণসহ আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। স্বল্প সময়ে অপরাধীরা ধরাও পড়ছে। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্যই পুলিশ বাহিনী। সেই প্রেক্ষাপটে দেশের পুলিশ বাহিনী সর্বদাই আইনের রক্ষকের ভূমিকায় জনবান্ধব হিসেবে অবতীর্ণ হচ্ছে।
মোটকথা, অপরাধ করে পার পাবে না কেউ পুলিশের হাত থেকে, তা সে যে ধরনের অপরাধই হোক না কেন। তবে এসবের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের জন্য থাকতে হবে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বাধিক ব্যবহার, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, সিসি ক্যামেরা, দক্ষ জনবল, স্ট্রাইকিং ফোর্স, অত্যাধুনিক যানবাহন, ট্যাকটিক্যাল বেল্ট, আনুষঙ্গিক সরঞ্জামসহ অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার—এ সবই যুক্ত করতে হবে পুলিশ বাহিনীতে।
স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট পুলিশিং হবে একটি অনিবার্য বাস্তবতা। উৎপাদন, প্রস্তুতকরণ, বিপণন থেকে শুরু করে সেবা প্রদান—সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে। পরিবর্তিত এই প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা, অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে স্মার্ট পুলিশিং হবে একমাত্র নিয়ামক। এই বাস্তবতা সামনে রেখে একটি আধুনিক, দক্ষ, প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট পুলিশ গঠনে বাংলাদেশ পুলিশ এগিয়ে যাচ্ছে। নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ, পদায়ন ও পদোন্নতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার ওপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তদুপরি আধুনিক প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং বাহিনীর সদস্যদের অধিকতর প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্মার্ট পুলিশ ও স্মার্ট পুলিশিং ব্যবস্থাপনা প্রস্তুতি গ্রহণের এখনই সময়। আমরা সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে। আর সেই সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশও হবে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক স্মার্ট পুলিশ।
লেখক: পুলিশ সুপার, হবিগঞ্জ

বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুদৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশ ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী ’৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। আর সেই বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে চলে যাব।’
উন্নয়নের মহাসড়কে চলমান বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ। ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত ধরে উন্নয়নের ধারা বজায় রেখে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে একটি উন্নত, সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ। তবে এ যাত্রায় অনেক সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাড়াতে হবে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা। একই সঙ্গে সার্বিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ ২০২৩ উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ সদস্যদের প্রতি বেশ কিছু মূল্যবান ও উপদেশমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে একটি দক্ষ ও বিশ্বমানের “স্মার্ট পুলিশ” গড়ে তোলা।’ সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে উন্নত বাংলাদেশ এবং সেটি হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা জনসাধারণ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশে নাগরিকসেবা থেকে শুরু করে সব আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো প্রশাসন। আর প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠন হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলতে প্রধানত পুলিশ সার্ভিসকেই বোঝানো হয়। পুলিশের ওপর জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক জীবনযাপন অনেকটাই নির্ভরশীল। উন্নত বিশ্বে পুলিশ জনগণের সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত থাকে। যেকোনো সমস্যায় জনগণ পুলিশের সাহায্য কামনা করে। পুলিশ সদস্যদের কাজই হলো জনগণের যেকোনো সমস্যায় সব ধরনের সহযোগিতা করা। অসহায়, বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি আন্তরিকভাবে সহযোগিতা ও মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। পাশাপাশি জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া। মোটকথা, পুলিশ সদস্যরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় জনগণের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
উন্নত বিশ্বে সাধারণত ধরা হয়ে থাকে যে সমাজের ৯০ শতাংশ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলবে, বাকি ১০ শতাংশ মানুষ আইনের বরখেলাপ করবে অথবা বিপথগামী হবে। পুলিশ তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে অথবা আইনের আওতায় আনবে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, পুলিশ এই ১০ শতাংশ মানুষের কাছ থেকে সমাজের ৯০ শতাংশ শান্তিকামী মানুষকে রক্ষা করবে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ৯০ শতাংশ মানুষ কি আইন মেনে চলে বা চলার মতো পরিবেশ আছে? তবে এ কথা ঠিক, অল্প কিছু মানুষের নিয়মবহির্ভূত কাজের প্রভাব সমাজে অনেক বেশি পড়ে। পুলিশের কাজ মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং কেউ যদি অন্যায়ভাবে আটক হন, তার প্রভাবও বেশি থাকে। সামান্যতম বিচ্যুতিও মানুষকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। পুলিশকে আইনত মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করার অধিকার দেওয়া আছে, তবে তা সম্পূর্ণ ন্যায়সংগতভাবে হতে হবে।
পুলিশের কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে সতর্ক আছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে, সেটা নিয়ে পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিনিয়ত কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। প্রতিদিন দায়িত্ব বণ্টনের আগে কর্মকর্তারা পুলিশ সার্ভিসের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রেখে কাজ করার বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। থানা থেকে শুরু করে পুলিশ লাইনস, পুলিশ ক্যাম্প, বিভাগ—সবখানেই কাউন্সেলিং করা হয়। কাউন্সেলিংকালে পুলিশ সদস্যদের কোথাও তল্লাশি চালাতে হলে কী নিয়ম মানতে হবে, কী ধরনের আচরণ করতে হবে, তা বুঝিয়ে বলা হয়। সাধারণ মানুষকে যেন সম্মান দেওয়া হয়, তাদের প্রতি যেন ভদ্র আচরণ করা হয়।
স্মার্ট পুলিশিং হলো তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক পুলিশিং ব্যবস্থা, যেখানে জ্ঞানবিজ্ঞান ব্যবহৃত হয় অত্যধিক। স্মার্ট পুলিশিংয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রমের উপাদানগুলো ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও গবেষণা করা হয়, যা অফিসারদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির সহায়ক। তা ছাড়া নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করা হয় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য। অর্থাৎ, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত সময়ে নির্ধারিত, বাস্তবিক ও কাঙ্ক্ষিত পুলিশিং সেবা প্রদানই হলো স্মার্ট পুলিশিং।
মানুষের ব্যক্তিগত থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ধাপে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক প্রয়োগ ইতিমধ্যে লক্ষণীয় প্রভাব ফেলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো প্রেডিক্টিভ পুলিশিং, যা স্মার্ট পুলিশিং বাস্তবায়নে এমন এক ব্যবস্থাকে বোঝায়; যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে একটি স্বয়ংক্রিয়, দ্রুতগতিসম্পন্ন ও তুলনামূলক নির্ভুল ব্যবস্থাপনা। অপরাধ ও অপরাধীকে শনাক্ত করার মাধ্যমে অপরাধ প্রতিরোধ, বিশ্লেষণ ও প্রতিকারে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। যেমন—সিসি ক্যামেরা, সেন্সর ডিভাইস, পূর্বে তৈরিকৃত ডেটাবেইসের তথ্য বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম। আইন প্রয়োগের ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এ আই) সংযোজন একটি বৈপ্লবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা জননিরাপত্তায় ফোর্স মোবিলাইজেশন, রিসোর্স অ্যালোকেশন, স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অগ্রিম তথ্য প্রদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
ডিজিটাল যোগাযোগমাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষ ঘরে বসে তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি সেবা উল্লেখ না করলেই নয়। আমরা সবাই জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর সুবিধাভোগী। বিপদাপদ, অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা বা যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সেবার জন্য ৯৯৯-এ কল করে থাকি। এটা পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং স্বাস্থ্য সমন্বয়ে একটি সেবা। সেবাটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর উদ্বোধন করেন। এটি তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত বা উদ্ভাবন। আরেকটি সেবা অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স। বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের প্রবাসে চাকরি বা অভিবাসন প্রক্রিয়ায় এই ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজন হয়। সেবাটি চালু হয় ২০১৭ সালে। এ ধরনের আরও বহুবিদ অনলাইন সেবা রয়েছে। ডিজিটাল হওয়ার কারণে সেবা দ্রুত মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। এতে সময় ও খরচ দুই-ই কম লাগছে।
একটি তথ্য ও তথ্যভিত্তিক বা তথ্যনির্ভর সমাধান পদ্ধতি, যাকে কম্পিউটারের ভাষায় বলা হয় Algorithm। উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯। যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে নাগরিকদের সেবা প্রদান করার জন্যই সেবাটি প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে ৯৯৯ ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করছে। কেউ ৯৯৯-এ কল করলে কল সেন্টারে একজন অপারেটর (Call Taker) কলটি গ্রহণ করে এবং কলারের চাহিদামতো কল সংশ্লিষ্ট স্থানীয় ইউনিট, অর্থাৎ থানায় ডেসপাচ করে অথবা কনফারেন্সিংয়ের জন্য থানাকে সংযুক্ত করে দেয়। এই ব্যবস্থায় কলারের লোকেশনও জানা যায় (GPS Location)। অতঃপর থানা থেকে সেবাপ্রত্যাশীকে সাড়া প্রদান করা হচ্ছে। সাড়া প্রদানের সময় (Response Time) আরও সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত করার লক্ষ্যে পুলিশের মোবাইল পেট্রল গাড়িগুলোতে মোবাইল ডেটা টার্মিনাল (এমডিটি) বসানোর কার্যক্রমও সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে। ফলে ৯৯৯ কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার থেকে থানায় ডেসপাচের পরিবর্তে সরাসরি ঘটনাস্থল বা সেবাপ্রত্যাশীর নিকটবর্তী কোনো এমডিটিতে কল ডেসপাচ করলে খুব দ্রুত সাড়া প্রদান করা সম্ভব হবে।
স্মার্ট ৯৯৯, যা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ তথা স্মার্ট গভর্নমেন্টেরই’ অংশ, তা আসলে কী রকম হবে? ডিজিটাল ৯৯৯ যখন স্মার্ট ৯৯৯ হবে, তখন কোনো অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা বা অপরাধ, যেমন—হাউস ট্রেসপাসিং, যৌন হয়রানি ইত্যাদিসহ যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে মানুষকে আর কল করতে হবে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসমৃদ্ধ (AI) যেকোনো IOT (Internet of Things)-এর আশপাশে কোনো ঘটনা, দুর্ঘটনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় সেবার জন্য সংকেত বা কোনো অ্যালার্ম স্মার্ট ৯৯৯ কমান্ড সেন্টারে পাঠাতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, আপনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোথাও সাপ্তাহিক ছুটি উদ্যাপন করতে গিয়েছেন বা আমরা যা সচরাচর করি—ঈদ, পূজার বড় ছুটি পেলে পরিবারের সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে যাই। তখন বাসায় কেউ থাকে না। সে ক্ষেত্রে আপনার বাসায় যদি IOT নামক ডিভাইসটি থাকে আর তার যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থাকে, তবে আপনার অনুপস্থিতিতে যে কেউ আপনার বাসা-বাড়িতে ঢুকলে বা বাসায় কোনো দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড ঘটলে স্মার্ট ৯৯৯ কমান্ড সেন্টারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কল বা অ্যালার্ম বা সিগন্যাল চলে আসবে। শুধু তাই নয়, স্মার্ট ৯৯৯ অবশ্যই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসমৃদ্ধ কলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করে অগ্নিকাণ্ড হলে নিকটবর্তী ফায়ার সার্ভিসকে অথবা কোনো অপরাধসংক্রান্ত হলে নিকটবর্তী ইউনিটকে কল, সংকেত, সিগন্যাল পাঠাবে। সাড়া বা সেবা প্রদান অথবা সাড়া প্রদানকারী ঘটনাস্থলে না পৌঁছানো পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে কলটি লাইভ থাকবে।
আমরা এমন একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল সময় পার করছি, যেখানে বিশ্ব প্রতিটি মুহূর্তে প্রযুক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি নিত্যনতুন জটিল সমস্যার সাক্ষী হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া প্রযুক্তিগত বিপ্লব পরিবর্তন করে দিচ্ছে আমাদের ধারণা, প্রস্তুতি ও কাজের ধরনকে। কালের পরিক্রমায় আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যুগে প্রবেশ করেছি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা হয় ৮০ শতাংশেরও বেশি। এ দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনার জন্য AI সংবলিত Automated Software Application ক্যামেরা এবং স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। মহাসড়কে ইতিমধ্যে সংঘটিত দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে। তদনুসারে স্মার্ট ক্যামেরা সড়ক-মহাসড়কে প্রকাশ্য-গোপনে বসানো যেতে পারে। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত ক্যামেরা গতিসীমার অতিরিক্ত গতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করতে পারবে এবং সংশ্লিষ্ট গাড়ি এবং গাড়ির মালিকের তথ্যভান্ডার (Big Data) বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ণয় করতে পারবে। তদুপরি আইন অনুসারে এ অপরাধের জন্য নির্ধারিত জরিমানা সরাসরি অভিযুক্ত গাড়ির মালিকের যোগাযোগের ঠিকানা, মোবাইল ফোন নম্বর বা ই-মেইলে পাঠিয়ে দিতে পারবে। পেমেন্ট সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এটা মুলতবি দেখাবে। তা ছাড়া, ট্রাফিক সিগন্যাল যদি Automated করা যায়, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যানজট শনাক্ত করে তদনুসারে ট্রাফিক সিগন্যাল স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হবে। ফলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা ট্রাফিক সিগন্যালে যানবাহনের জট অনেকাংশে কমে যাবে। কারণ পুরো ট্রাফিক-ব্যবস্থা তখন ডিজিটাল ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হবে।
পুলিশিং ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের বড় সুবিধা হলো প্রেডিক্টিভ অ্যানালাইসিস। সুবিস্তর তথ্যভান্ডারের স্বয়ংক্রিয় পর্যালোচনার মাধ্যমে এআই অ্যালগোরিদম এমন কিছু ঘটনা ও অপরাধের লক্ষণ শনাক্ত করতে সক্ষম, যা মানুষের পর্যালোচনাশক্তি দ্বারা অসম্ভব। এই পূর্ব শনাক্তকরণ সক্ষমতা পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই অপরাধ দমনে সাহায্য করবে। এই ক্ষেত্রে এআই অপরাধীর আচরণ বিশ্লেষণ করে অপরাধপ্রবণ অঞ্চল, অপরাধের ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী রিসোর্স মোবিলাইজেশন ও প্রো-অ্যাকটিভ সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্রিমিনাল ট্র্যাক ডেটা, মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য ব্যবহার করে থাকে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সমাজের ৩০-৪০ শতাংশ অপরাধ কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে জরুরি সময়ে সেবাপ্রত্যাশীর ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় ২৫-৩০ শতাংশ কমিয়ে আনে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মুখমণ্ডল শনাক্তকরণ (ফেইস রিকগনিশন) প্রযুক্তি সন্দেহভাজন অপরাধীকে চিহ্নিত ও তার গতিবিধি লক্ষ করতে সক্ষম। একই সঙ্গে এই প্রযুক্তি নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান, আত্মগোপনে থাকা অপরাধীকে খুঁজে বের করা এবং জনসমাগমে মানুষের নিরাপত্তায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের নিউ অর্লিপ্স শহরের পুলিশ অপরাধী, গাড়ি ও স্থান শনাক্ত করতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার করে। রাশিয়া ও চায়নাতেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত।
স্মার্ট বাংলাদেশের পাশাপাশি স্মার্ট সিটির বিষয়টিও এখন বহুল আলোচিত হয়ে উঠেছে। স্মার্ট সিটি নাগরিকদের দ্রুত সেবা প্রদান যেমন নিশ্চিত করবে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করবে। স্মার্ট সিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংবলিত স্মার্ট পুলিশিং অপরাধী শনাক্ত-চিহ্নিতকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। অপরাধের ঘটনাস্থল ও অপরাধী দ্রুত শনাক্ত করা যাবে। পৃথিবীর উন্নত দেশের শহরগুলোতে সিসিটিভি বসিয়ে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়। সন্দিগ্ধ বা কোনো অপরাধী অথবা অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে ইন্টেলিজেন্ট ক্যামেরার সাহায্যে সহজেই শনাক্ত করতে পারে। আর এর পেছনে কাজ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেটেড সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন। ২৪/৭ মনিটরিংয়ের ফলে অপরাধীদের নির্বিঘ্ন চলাচল অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এবং অপরাধ সংঘটনের মাত্রা কমে যায়। এই নিরবচ্ছিন্ন মনিটরিং ব্যবস্থায় একটা প্রতিরোধমূলক প্রভাব থাকে। অপরাধী যখন জানে যে অপরাধ করে পার পাবে না, তখন এমনিতেই অপরাধের হার কমে যায়।
নিরাপদ ও উন্নত শহর বাস্তবায়নে স্মার্ট পুলিশিংয়ের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাকে স্বয়ংক্রিয়, গতিশীল, নির্ভুল, নিরাপদ ও জনবান্ধব করার লক্ষ্যে বিশ্ব্যব্যাপী নানান পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। দি এআই গ্লোবাল সার্ভিল্যান্সের (এআইজিএস) ২০১৯-এর তথ্যমতে ৫৬টি দেশ ইতিমধ্যে নিরাপদ শহর গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্নভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু করেছে। এআই প্রযুক্তির সাহায্যে শহরের রাস্তায় চলমান সব গাড়ির তথ্য সংগ্রহ, ট্রাফিক ফ্লো সিমুলেশন, যানজটের পরিমাণ ও রুট ট্র্যাকিং পর্যালোচনার মাধ্যমে একটি স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব, যার ফলে জনসাধারণের যানজটের ভোগান্তি হ্রাস এবং সময় ও অর্থের সাশ্রয় হবে। একই সঙ্গে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চলাচল, ফিটনেসবিহীন গাড়ি শনাক্তকরণ, যত্রতত্র পার্কিং, খেয়ালখুশিমতো রাস্তা পারাপারসহ সব অসংলগ্ন ও আইনবহির্ভূত কার্যক্রম রোধ করা সম্ভব হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে শহরের বাস্তবিক তথ্যের ওপর একটি সুবৃহৎ ডেটা সেট তৈরি করার মাধ্যমে ভবিষ্যমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করবে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভার্চুয়াল কার্যক্রম ও নির্ভরতা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। যেহেতু সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি খুবই সংবেদনশীল তুলনামূলক নতুন, তাই এই অপরাধ দমনে, প্রতিকারে ও জনসচেতনতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খুবই কার্যকর ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এআই প্রযুক্তি খুব দ্রুত অসংগতি শনাক্ত করতে এবং ত্বরিত নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে সম্ভাব্য ক্ষতি প্রতিহত করতে সক্ষম। এই প্রো-অ্যাকটিভ ব্যবস্থাপনা দেশের ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে স্বয়ংক্রিয় পাহারাদার হিসেবে কাজ করে। সাইবার সিকিউরিটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার স্মার্ট পুলিশিং বাস্তবায়নে কাজের ব্যাপকতা ও উপযোগিতায় একে অপরের পরিপূরক।
অধিকন্তু, স্মার্ট পুলিশিং বাস্তবায়নে কাজের ব্যাপকতা ও প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সুষ্ঠু মানবসম্পদ ও সম্পদ বরাদ্দ (রিসোর্স অ্যালোকেশন) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে পেট্রল রুটস অপটিমাইজেশন, লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনা ও মাঠ প্রশাসন ব্যবস্থাপনায় এআই অ্য্যালগোরিদম ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যমুখী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এটি শুধু সেবা প্রদানে গতিশীলতাই আনে না, বরং একই সঙ্গে সেবার মানোন্নয়ন ও জবাবদিহি সুনিশ্চিত করে। ২০১৫ সালের দিকে ৮১ শতাংশ ব্রাজিলিয়ান কোনো না কোনোভাবে হত্যার শিকার হওয়ার আশঙ্কা করতেন। পরবর্তী সময়ে রিও ডি জেনেরিওর পুলিশ হত্যার ঘটনা ও হুমকি পর্যালোচনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেয় এবং উক্ত অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
আমাদের দেশের বিদ্যমান পুলিশিং ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ বিশ্বের সব জনবহুল দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করবে। স্বয়ংক্রিয় ও দ্রুত শনাক্তকরণ, সাড়াদান ও প্রতিকারের এই সক্ষমতা সামাজিকভাবে অপরাধ দমন ও বিস্তার রোধে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে ডেটা ড্রিভেন পর্যালোচনার মাধ্যমে এআই প্রদত্ত ভবিষ্যমুখী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে সামাজিকভাবে অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে, যা একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরাপদ সমাজব্যবস্থার দিকে আমাদের নিয়ে যাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশ শতভাগ না হলেও বহুলাংশেই ডিজিটাল ও আধুনিক হয়ে উঠেছে। দেশের থানাগুলোকে সংযুক্ত করা হয়েছে সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও ডেটাবেইসের আওতায়। অপরাধ তদন্ত, ময়নাতদন্ত, অপরাধী শনাক্তকরণেও ব্যবহৃত হচ্ছে ডিএনএ-ফরেনসিক বিশ্লেষণসহ আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। স্বল্প সময়ে অপরাধীরা ধরাও পড়ছে। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্যই পুলিশ বাহিনী। সেই প্রেক্ষাপটে দেশের পুলিশ বাহিনী সর্বদাই আইনের রক্ষকের ভূমিকায় জনবান্ধব হিসেবে অবতীর্ণ হচ্ছে।
মোটকথা, অপরাধ করে পার পাবে না কেউ পুলিশের হাত থেকে, তা সে যে ধরনের অপরাধই হোক না কেন। তবে এসবের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের জন্য থাকতে হবে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বাধিক ব্যবহার, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, সিসি ক্যামেরা, দক্ষ জনবল, স্ট্রাইকিং ফোর্স, অত্যাধুনিক যানবাহন, ট্যাকটিক্যাল বেল্ট, আনুষঙ্গিক সরঞ্জামসহ অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার—এ সবই যুক্ত করতে হবে পুলিশ বাহিনীতে।
স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট পুলিশিং হবে একটি অনিবার্য বাস্তবতা। উৎপাদন, প্রস্তুতকরণ, বিপণন থেকে শুরু করে সেবা প্রদান—সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে। পরিবর্তিত এই প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা, অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে স্মার্ট পুলিশিং হবে একমাত্র নিয়ামক। এই বাস্তবতা সামনে রেখে একটি আধুনিক, দক্ষ, প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট পুলিশ গঠনে বাংলাদেশ পুলিশ এগিয়ে যাচ্ছে। নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ, পদায়ন ও পদোন্নতিতে গুণগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার ওপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তদুপরি আধুনিক প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং বাহিনীর সদস্যদের অধিকতর প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্মার্ট পুলিশ ও স্মার্ট পুলিশিং ব্যবস্থাপনা প্রস্তুতি গ্রহণের এখনই সময়। আমরা সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে। আর সেই সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশও হবে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক স্মার্ট পুলিশ।
লেখক: পুলিশ সুপার, হবিগঞ্জ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১৬ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের কৃষি খাতে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তা নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক অর্জন। লাখ লাখ ক্ষুদ্র কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী, গবেষক, কৃষি উদ্ভাবন এবং সরকারের ধারাবাহিক সহায়তায় বাংলাদেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে একটি শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে। তবে কৃষি আজ আর কেবল খাদ্য উৎপাদনের বিষয় নয়।
১৬ ঘণ্টা আগে
ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোয় যারা হামলা চালিয়েছিল, তাদের কয়েকজনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
১৭ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয়ের ৫৪তম বার্ষিকী উদ্যাপন যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ও মহাসমারোহে হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বড় একটা ছন্দপতন ঘটে গেছে। অথচ বিজয়ের এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)।
২ দিন আগেদীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম, সে দেশের ইতিহাসকে তথ্যবিকৃতি ও অসত্যাচার দিয়ে মুছে ফেলা কখনোই এবং কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং সেটিকে মেনে নিয়ে পারস্পরিক মমতা, সৌহার্দ্য ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবাটাই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এই মুহূর্তের উত্তম কর্তব্য।
আবু তাহের খান

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। আলোচনা সভার বিষয়বস্তু এবং এ বিষয়ে তাঁর দেওয়া বক্তব্যের ধরন থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে এ ধরনের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যই বস্তুত পরিকল্পিত শিরোনামের আওতায় পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ওই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘মুক্তচিন্তা’র নামে যে চিন্তার প্রকাশ তিনি আলোচনা সভায় ঘটালেন, তা কি মুক্তচিন্তা নাকি বিকৃত মিথ্যাচার? একজন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক হয়ে, তা তিনি যে রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকই হোন না কেন, এ ধরনের বিকৃত মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া কি সঠিক হয়েছে?
একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আজ বিশ্বস্বীকৃত ইতিহাসের অংশ। ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এর বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট উল্লেখ রয়েছে। প্রায় একই সময়ে বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তর’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত তৎকালীন পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি জেনারেল এ এ খান নিয়াজি এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর বক্তব্য থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বস্তুত রাও ফরমান আলীই ছিলেন এ পরিকল্পনার মূল হোতা, যার বাস্তবায়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল এ এ খান নিয়াজির সেনাসদস্য এবং আলবদর ও আলশামসের সদস্যরা। উল্লেখ্য, সে সময় রাও ফরমান আলীর কাছ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকাও পাওয়া গিয়েছিল। উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার লক্ষ্যে রাও ফরমান আলী অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ধীরস্থিরভাবে ওই তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন। আর ওই তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে এসে হত্যা করার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছিল তৎকালীন ইসলামি ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে গঠিত আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও সে সময় সবিস্তারে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এ বিষয়ে ১৯৭১ সালের ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘সোনার বাংলায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড’। আর ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়ও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘রক্তস্নাত বাংলাদেশ কাঁদো’। উল্লেখ্য, সে সময় দেশের সব পত্রিকাই সাদাকালো রঙে ছাপা হলেও দৈনিক পূর্বদেশ সেদিন বড় অঙ্কের আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করে প্রথম পৃষ্ঠায় ৮ কলামে রঙিন শিরোনাম করেছিল রক্তের রঙে—লাল কালিতে। অন্যদিকে এ বিষয়ে বেতার সম্প্রচার তো ছিলই। বাংলাদেশ বেতারের ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রচারিত প্রায় প্রতিটি সংবাদে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল, সে-সংক্রান্ত কিছু কিছু রেকর্ড এখনো বাংলাদেশ বেতারের আর্কাইভে পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা যায়। ভয় হয়, এ প্রবন্ধে উল্লিখিত তথ্যসূত্রের কথা শুনে হত্যাকারীদের অনুগামীরা না আবার এসব রেকর্ডপত্র বিনষ্ট করার উদ্যোগ নিয়ে নেয়, যেমনটি সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নানা স্থানে নানা ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা গেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষত এর উপ-উপাচার্য ইতিহাসকে পাল্টে ফেলার ব্যাপারে এতটা লজ্জাবর্জিত ও বিবেকহীন হয়ে উঠলেন কেমন করে? চিন্তা ও মননে তিনি যত পশ্চাদমুখীই হোন না কেন, পেশাগত পরিচয়ে এখনো তো তিনি একজন শিক্ষক। আর একাত্তরের ওই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশই তো শিক্ষক ছিলেন। তো সেই সুবাদেও কি এ রকম বিকৃত মিথ্যাচারের সঙ্গে যুক্ত হতে আপনার বিবেক আপনাকে এতটুকু বাধা দেয়নি! এ ক্ষেত্রে কষ্ট পাচ্ছি এই ভেবে যে একজন শিক্ষক যদি বিকৃতি ও অসত্যাচারে যুক্ত হন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে এবং সেই ধারাবাহিকতায় এ জাতির ভবিষ্যৎই-বা কী? প্রায় একই সময়ে (৯ ডিসেম্বর ২০২৫) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান ইতিহাসের অন্যতম মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে বললেন ‘মুরতাদ কাফির’। আর তাঁর ওই বক্তব্যের মাত্র পাঁচ দিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে ইতিহাস থেকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যোগী হলেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান ও খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসানের রাজনৈতিক অভিভাবকেরা অবশ্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করেননি। তাঁরা এটিকে বলেছেন ‘দিল্লির পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে (প্রাগুক্ত)। ওবায়দুল কাদেরের নির্লজ্জ ভারত তোষণমূলক বক্তব্যের যেমন নিন্দা করেছি ও করছি, তেমনি প্রত্যাখ্যান করছি তাঁদের এ তথাকথিত দিল্লি ষড়যন্ত্রের স্লোগানকেও। উল্লেখ্য, উপ-উপাচার্যের সঙ্গে মিলে একই দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এ মন্তব্য করেন। আয়োজন ও মন্তব্যের ধরন থেকে মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও অবলোপনের এ উদ্যোগটি তাঁরা পরিকল্পিতভাবেই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কেন? জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের কাছে বিনীতভাবে একটি প্রশ্ন রাখি, এ দেশকে কি আর কোনো দিন পাকিস্তানের অংশ করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অতীতের ভুলত্রুটি স্বীকার করে অনুতপ্ত হয়ে কেন আপনারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিতে পারছেন না? এ দেশে অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করলে তা থেকে শুধু আপনাদের কেন, কারও পক্ষেই কি লাভবান হওয়ার কিছু আছে? অথচ দেখুন তো, নানা দল, মত ও পথের রাজনীতিকদের সৃষ্ট নানাবিধ অস্থিরতার কারণে এ দেশের সাধারণ মানুষ আজ কত কষ্ট পাচ্ছে। তাদের জীবন আজ নানা দুর্ভোগ ও অশান্তিতে কত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের এসব কষ্ট কি আপনাদের এতটুকুও স্পর্শ করে না? যদি করে, তাহলে অতীতের সব রাগ, ক্ষোভ ও জিঘাংসার কথা ভুলে গিয়ে সব ধরনের ধর্মীয় উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশের মূলধারার অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যান। দেখবেন আপনারা সবাই ভালো আছেন।
পরিশেষে বলি, দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম, সে দেশের ইতিহাসকে তথ্যবিকৃতি ও অসত্যাচার দিয়ে মুছে ফেলা কখনোই এবং কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং সেটিকে মেনে নিয়ে পারস্পরিক মমতা, সৌহার্দ্য ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবাটাই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এই মুহূর্তের উত্তম কর্তব্য। আর আশা করছি, বিবেকের তাড়নায় তৈরি এ লেখার জন্য মব বা অন্য কোনোরূপ পীড়নের শিকার হব না।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। আলোচনা সভার বিষয়বস্তু এবং এ বিষয়ে তাঁর দেওয়া বক্তব্যের ধরন থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে এ ধরনের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যই বস্তুত পরিকল্পিত শিরোনামের আওতায় পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ওই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘মুক্তচিন্তা’র নামে যে চিন্তার প্রকাশ তিনি আলোচনা সভায় ঘটালেন, তা কি মুক্তচিন্তা নাকি বিকৃত মিথ্যাচার? একজন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক হয়ে, তা তিনি যে রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকই হোন না কেন, এ ধরনের বিকৃত মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া কি সঠিক হয়েছে?
একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আজ বিশ্বস্বীকৃত ইতিহাসের অংশ। ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এর বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট উল্লেখ রয়েছে। প্রায় একই সময়ে বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তর’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত তৎকালীন পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি জেনারেল এ এ খান নিয়াজি এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর বক্তব্য থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বস্তুত রাও ফরমান আলীই ছিলেন এ পরিকল্পনার মূল হোতা, যার বাস্তবায়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল এ এ খান নিয়াজির সেনাসদস্য এবং আলবদর ও আলশামসের সদস্যরা। উল্লেখ্য, সে সময় রাও ফরমান আলীর কাছ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকাও পাওয়া গিয়েছিল। উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার লক্ষ্যে রাও ফরমান আলী অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ধীরস্থিরভাবে ওই তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন। আর ওই তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে এসে হত্যা করার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছিল তৎকালীন ইসলামি ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে গঠিত আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও সে সময় সবিস্তারে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এ বিষয়ে ১৯৭১ সালের ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘সোনার বাংলায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড’। আর ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়ও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘রক্তস্নাত বাংলাদেশ কাঁদো’। উল্লেখ্য, সে সময় দেশের সব পত্রিকাই সাদাকালো রঙে ছাপা হলেও দৈনিক পূর্বদেশ সেদিন বড় অঙ্কের আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করে প্রথম পৃষ্ঠায় ৮ কলামে রঙিন শিরোনাম করেছিল রক্তের রঙে—লাল কালিতে। অন্যদিকে এ বিষয়ে বেতার সম্প্রচার তো ছিলই। বাংলাদেশ বেতারের ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রচারিত প্রায় প্রতিটি সংবাদে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল, সে-সংক্রান্ত কিছু কিছু রেকর্ড এখনো বাংলাদেশ বেতারের আর্কাইভে পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা যায়। ভয় হয়, এ প্রবন্ধে উল্লিখিত তথ্যসূত্রের কথা শুনে হত্যাকারীদের অনুগামীরা না আবার এসব রেকর্ডপত্র বিনষ্ট করার উদ্যোগ নিয়ে নেয়, যেমনটি সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নানা স্থানে নানা ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা গেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষত এর উপ-উপাচার্য ইতিহাসকে পাল্টে ফেলার ব্যাপারে এতটা লজ্জাবর্জিত ও বিবেকহীন হয়ে উঠলেন কেমন করে? চিন্তা ও মননে তিনি যত পশ্চাদমুখীই হোন না কেন, পেশাগত পরিচয়ে এখনো তো তিনি একজন শিক্ষক। আর একাত্তরের ওই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশই তো শিক্ষক ছিলেন। তো সেই সুবাদেও কি এ রকম বিকৃত মিথ্যাচারের সঙ্গে যুক্ত হতে আপনার বিবেক আপনাকে এতটুকু বাধা দেয়নি! এ ক্ষেত্রে কষ্ট পাচ্ছি এই ভেবে যে একজন শিক্ষক যদি বিকৃতি ও অসত্যাচারে যুক্ত হন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে এবং সেই ধারাবাহিকতায় এ জাতির ভবিষ্যৎই-বা কী? প্রায় একই সময়ে (৯ ডিসেম্বর ২০২৫) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান ইতিহাসের অন্যতম মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে বললেন ‘মুরতাদ কাফির’। আর তাঁর ওই বক্তব্যের মাত্র পাঁচ দিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে ইতিহাস থেকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যোগী হলেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান ও খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসানের রাজনৈতিক অভিভাবকেরা অবশ্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করেননি। তাঁরা এটিকে বলেছেন ‘দিল্লির পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে (প্রাগুক্ত)। ওবায়দুল কাদেরের নির্লজ্জ ভারত তোষণমূলক বক্তব্যের যেমন নিন্দা করেছি ও করছি, তেমনি প্রত্যাখ্যান করছি তাঁদের এ তথাকথিত দিল্লি ষড়যন্ত্রের স্লোগানকেও। উল্লেখ্য, উপ-উপাচার্যের সঙ্গে মিলে একই দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এ মন্তব্য করেন। আয়োজন ও মন্তব্যের ধরন থেকে মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও অবলোপনের এ উদ্যোগটি তাঁরা পরিকল্পিতভাবেই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কেন? জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের কাছে বিনীতভাবে একটি প্রশ্ন রাখি, এ দেশকে কি আর কোনো দিন পাকিস্তানের অংশ করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অতীতের ভুলত্রুটি স্বীকার করে অনুতপ্ত হয়ে কেন আপনারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিতে পারছেন না? এ দেশে অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করলে তা থেকে শুধু আপনাদের কেন, কারও পক্ষেই কি লাভবান হওয়ার কিছু আছে? অথচ দেখুন তো, নানা দল, মত ও পথের রাজনীতিকদের সৃষ্ট নানাবিধ অস্থিরতার কারণে এ দেশের সাধারণ মানুষ আজ কত কষ্ট পাচ্ছে। তাদের জীবন আজ নানা দুর্ভোগ ও অশান্তিতে কত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের এসব কষ্ট কি আপনাদের এতটুকুও স্পর্শ করে না? যদি করে, তাহলে অতীতের সব রাগ, ক্ষোভ ও জিঘাংসার কথা ভুলে গিয়ে সব ধরনের ধর্মীয় উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশের মূলধারার অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যান। দেখবেন আপনারা সবাই ভালো আছেন।
পরিশেষে বলি, দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম, সে দেশের ইতিহাসকে তথ্যবিকৃতি ও অসত্যাচার দিয়ে মুছে ফেলা কখনোই এবং কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং সেটিকে মেনে নিয়ে পারস্পরিক মমতা, সৌহার্দ্য ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবাটাই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এই মুহূর্তের উত্তম কর্তব্য। আর আশা করছি, বিবেকের তাড়নায় তৈরি এ লেখার জন্য মব বা অন্য কোনোরূপ পীড়নের শিকার হব না।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

স্মার্ট পুলিশিং হলো তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক পুলিশিং ব্যবস্থা, যেখানে জ্ঞানবিজ্ঞান ব্যবহৃত হয় অত্যধিক। স্মার্ট পুলিশিংয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রমের উপাদানগুলো ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও গবেষণা করা হয়, যা অফিসারদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির সহায়ক। তা ছাড়া নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করা হয় অপ
০৩ জুলাই ২০২৪
বাংলাদেশের কৃষি খাতে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তা নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক অর্জন। লাখ লাখ ক্ষুদ্র কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী, গবেষক, কৃষি উদ্ভাবন এবং সরকারের ধারাবাহিক সহায়তায় বাংলাদেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে একটি শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে। তবে কৃষি আজ আর কেবল খাদ্য উৎপাদনের বিষয় নয়।
১৬ ঘণ্টা আগে
ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোয় যারা হামলা চালিয়েছিল, তাদের কয়েকজনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
১৭ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয়ের ৫৪তম বার্ষিকী উদ্যাপন যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ও মহাসমারোহে হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বড় একটা ছন্দপতন ঘটে গেছে। অথচ বিজয়ের এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)।
২ দিন আগেশাইখ সিরাজ

বাংলাদেশের কৃষি খাতে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তা নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক অর্জন। লাখ লাখ ক্ষুদ্র কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী, গবেষক, কৃষি উদ্ভাবন এবং সরকারের ধারাবাহিক সহায়তায় বাংলাদেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে একটি শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে। তবে কৃষি আজ আর কেবল খাদ্য উৎপাদনের বিষয় নয়। নগরায়ণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা কৃষিকে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের কৃষি খাত ধীরে ধীরে রূপান্তরের পথে এগোচ্ছে। শস্য উৎপাদনের পাশাপাশি উদ্যানবিদ্যা, প্রাণিসম্পদ, মৎস্য, জলজ চাষ এবং ব্লু ইকোনমির মতো ক্ষেত্রগুলোতে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে কৃষিপণ্যের মানসম্মত প্রক্রিয়াজাতকরণ, জলবায়ু সহনশীল ফসল উদ্ভাবন এবং উন্নত কৃষি অনুশীলনের গুরুত্ব আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে।
স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে হলে কৃষিকে অবশ্যই তথ্যনির্ভর ও প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে। ডেটা-ড্রিভেন সিদ্ধান্ত, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জ্ঞানভিত্তিক সহযোগিতা ছাড়া ভবিষ্যতের কৃষি কল্পনা করা যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ যে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তা মোকাবিলা করেই কৃষির পূর্ণ সক্ষমতাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। কৃষিবৈচিত্র্যের সম্ভাবনা সীমাহীন হলেও এর জন্য প্রয়োজন সৎ প্রচেষ্টা, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এবং দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও বাণিজ্যিকীকরণকে অগ্রাধিকার দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের কৃষি খাত একাধিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজার ব্যবস্থাপনা ও কৃষকের জীবনযাত্রা পর্যন্ত বিস্তৃত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনিয়মিত বৃষ্টি, দীর্ঘ খরা, আকস্মিক বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় ফসলের ক্ষতি বাড়িয়ে দিচ্ছে, বিশেষ করে উপকূলীয় ও হাওর অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও জলাবদ্ধতা কৃষিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। একই সঙ্গে আবাদযোগ্য জমি দ্রুত কমে হচ্ছে নগরায়ণ। শিল্পায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নের চাপের ফলে খাদ্য উৎপাদনের ওপর বাড়ছে চাপ। উৎপাদন পর্যায়ে কৃষককে ভোগাচ্ছে সার, বীজ, কীটনাশক ও সেচের উচ্চমূল্য, যেখানে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলেও ন্যায্যমূল্য পাওয়া অনিশ্চিতই থেকে যাচ্ছে। ফসল কাটার পর পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগার, হিমাগার ও আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার অভাবে বিপুল পরিমাণ পণ্য নষ্ট হচ্ছে, যা কৃষকের ক্ষতির পাশাপাশি বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য কৃষক ও ভোক্তা উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে, কারণ কৃষক কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হলেও ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। কৃষিবিমা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কৃষককে আরও অসহায় করে তোলে।
অন্যদিকে, গবেষণা ও সম্প্রসারণ সেবার সীমাবদ্ধতা, আধুনিক প্রযুক্তির ধীর গ্রহণযোগ্যতা এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তের ঘাটতি কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি, রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণে কাঠামোগত দুর্বলতা থাকায় বৈশ্বিক বাজারে সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এসব সংকট সম্মিলিতভাবে কৃষিকে এক জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে টেকসই নীতি, প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান ও সমন্বিত বাজার সংস্কার ছাড়া কৃষক ও কৃষি উভয়ের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করা কঠিন হয়ে উঠছে।
আমরা খুব ভালোভাবেই জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি কৃষিতে উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া, ফসল কাটার পর সংরক্ষণের অভাবে ক্ষতি, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং অপর্যাপ্ত খাদ্যগুদাম ব্যবস্থার মতো সমস্যাগুলো কৃষকের জীবনকে প্রতিনিয়ত কঠিন করে তুলছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি হতে পারে এক অনস্বীকার্য হাতিয়ার। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে আমি নিজ চোখে দেখেছি, কীভাবে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে কৃষি আরও লাভজনক, টেকসই এবং নিরাপদ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ একটি বৃহৎ বদ্বীপ। বিস্তৃত নদীব্যবস্থা এই ভূখণ্ডকে করেছে উর্বর ও প্রাণবন্ত। নদীর জালের মতো বিস্তৃত নেটওয়ার্ক সহজ সেচসুবিধা নিশ্চিত করে এবং ফলায় সোনার ফসল। কিন্তু এই নদীমাতৃক ভূপ্রকৃতি যেমন আশীর্বাদ, তেমনি ঝুঁকিরও কারণ। বর্ষা মৌসুমে দেশের প্রায় ৫৫-৬০ শতাংশ জমি পানিতে তলিয়ে যায়, আবার শুষ্ক মৌসুমে অনেক এলাকায় পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। উপকূলীয় অঞ্চল ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে রয়েছে।
এই বাস্তবতায় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা পুরো কৃষি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন, সেচব্যবস্থা, নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা এখন সময়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের কৃষিখাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ধীরে হলেও ধারাবাহিকভাবে বিকশিত হয়েছে। এই শিল্প মূলত দেশীয় কৃষিপণ্যের ওপর নির্ভরশীল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কৃষিখাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাত দেশের মোট প্রক্রিয়াজাত উৎপাদনের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে এবং উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৭০০টি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে ছোট, মাঝারি ও বড় ইউনিট অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে অন্তত ৩০টি প্রতিষ্ঠান ফল ও সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণে বিশেষায়িত।
এই খাতের জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার যেমন বড়, তেমনি রপ্তানি বাজারেও ক্রমেই সম্ভাবনা বাড়ছে। বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষি শিল্পজাত পণ্যের রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মাছ, কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে, যা দেশের বৈদেশিক আয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কৃষিকে নতুন এক মাত্রা দিয়েছে। ইন্টারনেট অব থিংস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস এবং আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি কৃষি উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাকে আরও দক্ষ করে তুলছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য গ্রামীণ অর্থনীতিকে রূপান্তরের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো। এই প্রক্রিয়ায় স্মার্ট কৃষি একটি প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। প্রযুক্তির ব্যবহারে শ্রম খরচ কমবে, উৎপাদনের গুণগত মান বজায় থাকবে এবং কৃষক সরাসরি বাজার ও তথ্যের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন।
তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মাটি, পানি ও বনভূমির অবক্ষয় টেকসই কৃষির জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে। আবাদি জমি কমে যাচ্ছে, আবহাওয়া হয়ে উঠছে অনিশ্চিত। এই অবস্থায় প্রান্তিক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য টেকসই কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ, গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সময়োপযোগী নীতি বাস্তবায়ন অপরিহার্য। নিরাপদ ও টেকসই ভবিষ্যতের জন্য কৃষি উৎপাদনশীলতা ও পরিবেশ সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
এই সময় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ এখন অত্যন্ত জরুরি। কৃষককে আধুনিক কৃষিযন্ত্র ও কৌশলে দক্ষ করে তুলতে হবে। ফসল সংরক্ষণ, বাজার ব্যবস্থাপনা ও বিতরণ ব্যবস্থায় কাঠামোগত সংস্কার আনতে হবে। কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে এবং উৎপাদক হিসেবে তাঁদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। শস্যবিমা, স্বাস্থ্যবিমা ও পেনশনব্যবস্থার মতো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। উন্নত কৃষি গবেষণা, বেসরকারি বিনিয়োগ, কৃষিজমি সুরক্ষা এবং কর প্রণোদনার মতো বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
ষাটের দশকের সবুজবিপ্লব যেমন কৃষিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল, আজ তেমনি আরেকটি বিপ্লবের জন্য সময় এসেছে। এই বিপ্লব হবে স্মার্ট, দক্ষ এবং প্রযুক্তিনির্ভর। কৃষকের জন্য বাস্তবসম্মত ও সহজ ডিজিটাল প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা গেলে কৃষি খাত আরও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াবে।
স্মার্ট কৃষি শুধু উৎপাদন বাড়াবে না, এটি আমাদের জীবনযাত্রার ধরন বদলে দেবে। এটি দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমাতে সহায়তা করবে। কৃষক, সরকার, নীতিনির্ধারক, গবেষক এবং উন্নয়ন অংশীদার—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কারণ, পরিবর্তন আসে দূরদৃষ্টি থেকে, আর ভবিষ্যতের কৃষি গড়ে ওঠে আজকের সিদ্ধান্তে। হাল ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

বাংলাদেশের কৃষি খাতে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তা নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক অর্জন। লাখ লাখ ক্ষুদ্র কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী, গবেষক, কৃষি উদ্ভাবন এবং সরকারের ধারাবাহিক সহায়তায় বাংলাদেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে একটি শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে। তবে কৃষি আজ আর কেবল খাদ্য উৎপাদনের বিষয় নয়। নগরায়ণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা কৃষিকে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের কৃষি খাত ধীরে ধীরে রূপান্তরের পথে এগোচ্ছে। শস্য উৎপাদনের পাশাপাশি উদ্যানবিদ্যা, প্রাণিসম্পদ, মৎস্য, জলজ চাষ এবং ব্লু ইকোনমির মতো ক্ষেত্রগুলোতে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে কৃষিপণ্যের মানসম্মত প্রক্রিয়াজাতকরণ, জলবায়ু সহনশীল ফসল উদ্ভাবন এবং উন্নত কৃষি অনুশীলনের গুরুত্ব আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে।
স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে হলে কৃষিকে অবশ্যই তথ্যনির্ভর ও প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে। ডেটা-ড্রিভেন সিদ্ধান্ত, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জ্ঞানভিত্তিক সহযোগিতা ছাড়া ভবিষ্যতের কৃষি কল্পনা করা যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ যে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তা মোকাবিলা করেই কৃষির পূর্ণ সক্ষমতাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। কৃষিবৈচিত্র্যের সম্ভাবনা সীমাহীন হলেও এর জন্য প্রয়োজন সৎ প্রচেষ্টা, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এবং দারিদ্র্য হ্রাসে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও বাণিজ্যিকীকরণকে অগ্রাধিকার দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের কৃষি খাত একাধিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজার ব্যবস্থাপনা ও কৃষকের জীবনযাত্রা পর্যন্ত বিস্তৃত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনিয়মিত বৃষ্টি, দীর্ঘ খরা, আকস্মিক বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় ফসলের ক্ষতি বাড়িয়ে দিচ্ছে, বিশেষ করে উপকূলীয় ও হাওর অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও জলাবদ্ধতা কৃষিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। একই সঙ্গে আবাদযোগ্য জমি দ্রুত কমে হচ্ছে নগরায়ণ। শিল্পায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়নের চাপের ফলে খাদ্য উৎপাদনের ওপর বাড়ছে চাপ। উৎপাদন পর্যায়ে কৃষককে ভোগাচ্ছে সার, বীজ, কীটনাশক ও সেচের উচ্চমূল্য, যেখানে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলেও ন্যায্যমূল্য পাওয়া অনিশ্চিতই থেকে যাচ্ছে। ফসল কাটার পর পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগার, হিমাগার ও আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার অভাবে বিপুল পরিমাণ পণ্য নষ্ট হচ্ছে, যা কৃষকের ক্ষতির পাশাপাশি বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য কৃষক ও ভোক্তা উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে, কারণ কৃষক কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হলেও ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। কৃষিবিমা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কৃষককে আরও অসহায় করে তোলে।
অন্যদিকে, গবেষণা ও সম্প্রসারণ সেবার সীমাবদ্ধতা, আধুনিক প্রযুক্তির ধীর গ্রহণযোগ্যতা এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তের ঘাটতি কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি, রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণে কাঠামোগত দুর্বলতা থাকায় বৈশ্বিক বাজারে সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এসব সংকট সম্মিলিতভাবে কৃষিকে এক জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে টেকসই নীতি, প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান ও সমন্বিত বাজার সংস্কার ছাড়া কৃষক ও কৃষি উভয়ের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করা কঠিন হয়ে উঠছে।
আমরা খুব ভালোভাবেই জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি কৃষিতে উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া, ফসল কাটার পর সংরক্ষণের অভাবে ক্ষতি, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং অপর্যাপ্ত খাদ্যগুদাম ব্যবস্থার মতো সমস্যাগুলো কৃষকের জীবনকে প্রতিনিয়ত কঠিন করে তুলছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি হতে পারে এক অনস্বীকার্য হাতিয়ার। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে আমি নিজ চোখে দেখেছি, কীভাবে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে কৃষি আরও লাভজনক, টেকসই এবং নিরাপদ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ একটি বৃহৎ বদ্বীপ। বিস্তৃত নদীব্যবস্থা এই ভূখণ্ডকে করেছে উর্বর ও প্রাণবন্ত। নদীর জালের মতো বিস্তৃত নেটওয়ার্ক সহজ সেচসুবিধা নিশ্চিত করে এবং ফলায় সোনার ফসল। কিন্তু এই নদীমাতৃক ভূপ্রকৃতি যেমন আশীর্বাদ, তেমনি ঝুঁকিরও কারণ। বর্ষা মৌসুমে দেশের প্রায় ৫৫-৬০ শতাংশ জমি পানিতে তলিয়ে যায়, আবার শুষ্ক মৌসুমে অনেক এলাকায় পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। উপকূলীয় অঞ্চল ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে রয়েছে।
এই বাস্তবতায় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা পুরো কৃষি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন, সেচব্যবস্থা, নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা এখন সময়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের কৃষিখাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ধীরে হলেও ধারাবাহিকভাবে বিকশিত হয়েছে। এই শিল্প মূলত দেশীয় কৃষিপণ্যের ওপর নির্ভরশীল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কৃষিখাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাত দেশের মোট প্রক্রিয়াজাত উৎপাদনের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে এবং উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৭০০টি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে ছোট, মাঝারি ও বড় ইউনিট অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে অন্তত ৩০টি প্রতিষ্ঠান ফল ও সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণে বিশেষায়িত।
এই খাতের জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার যেমন বড়, তেমনি রপ্তানি বাজারেও ক্রমেই সম্ভাবনা বাড়ছে। বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষি শিল্পজাত পণ্যের রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মাছ, কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে, যা দেশের বৈদেশিক আয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কৃষিকে নতুন এক মাত্রা দিয়েছে। ইন্টারনেট অব থিংস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস এবং আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি কৃষি উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাকে আরও দক্ষ করে তুলছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য গ্রামীণ অর্থনীতিকে রূপান্তরের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো। এই প্রক্রিয়ায় স্মার্ট কৃষি একটি প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। প্রযুক্তির ব্যবহারে শ্রম খরচ কমবে, উৎপাদনের গুণগত মান বজায় থাকবে এবং কৃষক সরাসরি বাজার ও তথ্যের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন।
তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মাটি, পানি ও বনভূমির অবক্ষয় টেকসই কৃষির জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে। আবাদি জমি কমে যাচ্ছে, আবহাওয়া হয়ে উঠছে অনিশ্চিত। এই অবস্থায় প্রান্তিক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য টেকসই কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ, গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সময়োপযোগী নীতি বাস্তবায়ন অপরিহার্য। নিরাপদ ও টেকসই ভবিষ্যতের জন্য কৃষি উৎপাদনশীলতা ও পরিবেশ সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
এই সময় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ এখন অত্যন্ত জরুরি। কৃষককে আধুনিক কৃষিযন্ত্র ও কৌশলে দক্ষ করে তুলতে হবে। ফসল সংরক্ষণ, বাজার ব্যবস্থাপনা ও বিতরণ ব্যবস্থায় কাঠামোগত সংস্কার আনতে হবে। কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে এবং উৎপাদক হিসেবে তাঁদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। শস্যবিমা, স্বাস্থ্যবিমা ও পেনশনব্যবস্থার মতো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। উন্নত কৃষি গবেষণা, বেসরকারি বিনিয়োগ, কৃষিজমি সুরক্ষা এবং কর প্রণোদনার মতো বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
ষাটের দশকের সবুজবিপ্লব যেমন কৃষিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল, আজ তেমনি আরেকটি বিপ্লবের জন্য সময় এসেছে। এই বিপ্লব হবে স্মার্ট, দক্ষ এবং প্রযুক্তিনির্ভর। কৃষকের জন্য বাস্তবসম্মত ও সহজ ডিজিটাল প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা গেলে কৃষি খাত আরও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াবে।
স্মার্ট কৃষি শুধু উৎপাদন বাড়াবে না, এটি আমাদের জীবনযাত্রার ধরন বদলে দেবে। এটি দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমাতে সহায়তা করবে। কৃষক, সরকার, নীতিনির্ধারক, গবেষক এবং উন্নয়ন অংশীদার—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কারণ, পরিবর্তন আসে দূরদৃষ্টি থেকে, আর ভবিষ্যতের কৃষি গড়ে ওঠে আজকের সিদ্ধান্তে। হাল ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

স্মার্ট পুলিশিং হলো তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক পুলিশিং ব্যবস্থা, যেখানে জ্ঞানবিজ্ঞান ব্যবহৃত হয় অত্যধিক। স্মার্ট পুলিশিংয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রমের উপাদানগুলো ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও গবেষণা করা হয়, যা অফিসারদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির সহায়ক। তা ছাড়া নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করা হয় অপ
০৩ জুলাই ২০২৪
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১৬ ঘণ্টা আগে
ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোয় যারা হামলা চালিয়েছিল, তাদের কয়েকজনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
১৭ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয়ের ৫৪তম বার্ষিকী উদ্যাপন যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ও মহাসমারোহে হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বড় একটা ছন্দপতন ঘটে গেছে। অথচ বিজয়ের এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)।
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোয় যারা হামলা চালিয়েছিল, তাদের কয়েকজনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যার পর তাঁর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার বিষয়ে সরকার বদ্ধপরিকর। কথাগুলো তিনি বলেছেন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে।
যে জায়গাগুলোয় হামলা হয়েছে, যেখানে একজন মানুষকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, সে জায়গাগুলোর অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। ইন্টারনেটে যুক্ত হতে পারেন, এমন যে কেউ সেই ফুটেজগুলোতে এই দুর্বৃত্তদের চেহারা স্পষ্ট দেখতে পাবেন। এই হামলাবাজদের শনাক্ত করা মোটেই কঠিন কাজ নয়। ফুটেজ দেখে কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বটে, কিন্তু তাদের শাস্তি নিশ্চিত না হলে হামলার ঘটনাগুলো ঘটতেই থাকবে। মনে রাখতে হবে, ওসমান হাদির মর্মান্তিক মৃত্যুর পর সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু লোক পরিকল্পিতভাবে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে, যার সঙ্গে হাদি হত্যার কোনো সম্পর্ক নেই।
কোনো সন্দেহ হলেই ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে আঘাত করার রীতি চালু হয়ে গেলে কেউই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। তখন আইনকানুন বলে কিছু থাকবে না। সে সময় উচ্ছৃঙ্খল একদল মানুষের আক্রমণ থেকে জনগণকে বা জনগণের সম্পত্তি রক্ষা করতে হলে পাড়ায় পাড়ায় স্থানীয় জনগণকে তাঁর নিজ সম্পত্তি পাহারা দিতে হবে। সে হবে সামগ্রিকভাবে অন্য এক ব্যবস্থা। মতাদর্শগত পার্থক্য তখন পরিণত হবে সংঘাতে। প্রচলিত রাজনৈতিক আচরণ বদলে গিয়ে তখন একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতাই চোখে পড়বে। আদালতের বিচারকেরা চাকরি হারাবেন, আইনজীবীদের পেশা বদলাতে হবে, পুলিশ বিভাগে কাজ করার জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে না। নিজের মতের সঙ্গে না মিললে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালানোর সংবাদই হয়ে উঠবে পত্রিকার মূল সংবাদ।
ওসমান হাদির হন্তারককে গ্রেপ্তার করা যেমন জরুরি, তেমনি তাঁর মৃত্যুর পর পরিকল্পিতভাবে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ীদের গ্রেপ্তার করাও জরুরি। সিসি ক্যামেরায় হামলাকারীদের প্রত্যেকের চেহারাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গোয়েন্দা বিভাগ সক্রিয় হলে এত দিনে তাদের খোঁজে লেগে পড়তে পারত।
এ কথা সবাই বোঝে, পত্রিকা অফিস, সাংস্কৃতিক সংগঠনে হামলার ঘটনার আন্তর্জাতিক প্রভাব রয়েছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় দীপু হত্যাকাণ্ডও কারও নজর এড়ায়নি। এই হামলাগুলোর সুষ্ঠু বিচার না হলে আন্তর্জাতিকভাবে বিপাকে পড়তে পারে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনো বার্তা আসা দরকার, যেকোনো আইনবিরোধী আচরণের জন্য সরকারের থাকবে জিরো টলারেন্স। পুলিশ বাহিনীর মনে সেই সাহস ফিরিয়ে আনতে হবে, যে সাহসের বলে আইনের শাসনের প্রতি তারা জনগণকে ফিরিয়ে আনতে পারে। সরকার যদি চায়, তাহলে সেটা সম্ভব। জনগণকেও এই ধরনের হামলার বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলতে হবে। মানুষের জানমাল রক্ষা করার কাজটি সরকারের, সেটা যেন সরকার মনে রাখে।

ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোয় যারা হামলা চালিয়েছিল, তাদের কয়েকজনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যার পর তাঁর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার বিষয়ে সরকার বদ্ধপরিকর। কথাগুলো তিনি বলেছেন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে।
যে জায়গাগুলোয় হামলা হয়েছে, যেখানে একজন মানুষকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, সে জায়গাগুলোর অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। ইন্টারনেটে যুক্ত হতে পারেন, এমন যে কেউ সেই ফুটেজগুলোতে এই দুর্বৃত্তদের চেহারা স্পষ্ট দেখতে পাবেন। এই হামলাবাজদের শনাক্ত করা মোটেই কঠিন কাজ নয়। ফুটেজ দেখে কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বটে, কিন্তু তাদের শাস্তি নিশ্চিত না হলে হামলার ঘটনাগুলো ঘটতেই থাকবে। মনে রাখতে হবে, ওসমান হাদির মর্মান্তিক মৃত্যুর পর সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু লোক পরিকল্পিতভাবে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে, যার সঙ্গে হাদি হত্যার কোনো সম্পর্ক নেই।
কোনো সন্দেহ হলেই ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে আঘাত করার রীতি চালু হয়ে গেলে কেউই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। তখন আইনকানুন বলে কিছু থাকবে না। সে সময় উচ্ছৃঙ্খল একদল মানুষের আক্রমণ থেকে জনগণকে বা জনগণের সম্পত্তি রক্ষা করতে হলে পাড়ায় পাড়ায় স্থানীয় জনগণকে তাঁর নিজ সম্পত্তি পাহারা দিতে হবে। সে হবে সামগ্রিকভাবে অন্য এক ব্যবস্থা। মতাদর্শগত পার্থক্য তখন পরিণত হবে সংঘাতে। প্রচলিত রাজনৈতিক আচরণ বদলে গিয়ে তখন একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতাই চোখে পড়বে। আদালতের বিচারকেরা চাকরি হারাবেন, আইনজীবীদের পেশা বদলাতে হবে, পুলিশ বিভাগে কাজ করার জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে না। নিজের মতের সঙ্গে না মিললে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালানোর সংবাদই হয়ে উঠবে পত্রিকার মূল সংবাদ।
ওসমান হাদির হন্তারককে গ্রেপ্তার করা যেমন জরুরি, তেমনি তাঁর মৃত্যুর পর পরিকল্পিতভাবে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ীদের গ্রেপ্তার করাও জরুরি। সিসি ক্যামেরায় হামলাকারীদের প্রত্যেকের চেহারাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গোয়েন্দা বিভাগ সক্রিয় হলে এত দিনে তাদের খোঁজে লেগে পড়তে পারত।
এ কথা সবাই বোঝে, পত্রিকা অফিস, সাংস্কৃতিক সংগঠনে হামলার ঘটনার আন্তর্জাতিক প্রভাব রয়েছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় দীপু হত্যাকাণ্ডও কারও নজর এড়ায়নি। এই হামলাগুলোর সুষ্ঠু বিচার না হলে আন্তর্জাতিকভাবে বিপাকে পড়তে পারে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনো বার্তা আসা দরকার, যেকোনো আইনবিরোধী আচরণের জন্য সরকারের থাকবে জিরো টলারেন্স। পুলিশ বাহিনীর মনে সেই সাহস ফিরিয়ে আনতে হবে, যে সাহসের বলে আইনের শাসনের প্রতি তারা জনগণকে ফিরিয়ে আনতে পারে। সরকার যদি চায়, তাহলে সেটা সম্ভব। জনগণকেও এই ধরনের হামলার বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলতে হবে। মানুষের জানমাল রক্ষা করার কাজটি সরকারের, সেটা যেন সরকার মনে রাখে।

স্মার্ট পুলিশিং হলো তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক পুলিশিং ব্যবস্থা, যেখানে জ্ঞানবিজ্ঞান ব্যবহৃত হয় অত্যধিক। স্মার্ট পুলিশিংয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রমের উপাদানগুলো ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও গবেষণা করা হয়, যা অফিসারদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির সহায়ক। তা ছাড়া নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করা হয় অপ
০৩ জুলাই ২০২৪
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১৬ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের কৃষি খাতে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তা নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক অর্জন। লাখ লাখ ক্ষুদ্র কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী, গবেষক, কৃষি উদ্ভাবন এবং সরকারের ধারাবাহিক সহায়তায় বাংলাদেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে একটি শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে। তবে কৃষি আজ আর কেবল খাদ্য উৎপাদনের বিষয় নয়।
১৬ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয়ের ৫৪তম বার্ষিকী উদ্যাপন যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ও মহাসমারোহে হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বড় একটা ছন্দপতন ঘটে গেছে। অথচ বিজয়ের এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)।
২ দিন আগেগণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও শান্তিপ্রত্যাশী জনগণ চাইছে, দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সরকার আসুক। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় সেই জনপ্রত্যাশারই প্রতিফলন ঘটে।
আজাদুর রহমান চন্দন

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয়ের ৫৪তম বার্ষিকী উদ্যাপন যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ও মহাসমারোহে হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বড় একটা ছন্দপতন ঘটে গেছে। অথচ বিজয়ের এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খোদ রাজধানীতে সম্ভাব্য এক তরুণ প্রার্থীকে গুলি করার ঘটনায় পুরোনো শঙ্কা-সংশয় আরও জেঁকে বসে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা অন্যতম প্রধান শর্ত, তার ছিদ্রটা হাঁ হয়ে যায় ওই একটি ঘটনায়। শুধু তা-ই নয়, কয়েক দিনের মাথায় বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই গুলিবিদ্ধ তরুণের মৃত্যুর খবরজনিত ক্ষোভ-উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে সংবাদমাধ্যমের ওপর ন্যক্কারজনক আক্রমণ চালানো হয়। আক্রান্ত হয় বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের প্রধান কার্যালয়। রাজধানীর ধানমন্ডিতে ছায়ানট ভবনে পরিচালিত হয়ে আসছে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন এবং শিশু-কিশোরদের জন্য সংস্কৃতি-সমন্বিত ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দার কার্যক্রম। পরদিনই হামলা চালানো হয় দেশের ঐতিহ্যবাহী আরেক সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, ৫০-৬০ জনের একটি দল মিছিল নিয়ে গিয়ে ছায়ানট ভবনে হামলা করে। প্রথমে পার্কিং লটের দিকে আগুন দেওয়া হয়। পরে তারা ভবনের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। মিলনায়তনে হামলাকারীরা যা পেয়েছে তা-ই ভাঙচুর করে। তবলা, হারমোনিয়াম, তানপুরা থেকে শুরু করে কোনো বাদ্যযন্ত্রই অক্ষত রাখা হয়নি। ভাঙচুর করা ছাড়াও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তছনছ করা হয়েছে বই-কাগজপত্র। পুরো মনিটরিং সিস্টেম, ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা, স্পিকার, লাইট ও ফ্যান ভেঙে ফেলা হয়। ভেঙে ফেলা হয় সেখানে থাকা মাটির তৈরি চারুকর্ম ও শিল্পকর্ম, কক্ষ ও অফিস রুমের বেশির ভাগ আসবাব। ওই হামলার পর ছায়ানট ভবনে পরিচালিত ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের ক্লাসসহ সংগঠনের সব কার্যক্রম পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এসব ঘটনায় কারোরই বুঝতে বাকি থাকে না যে এর আসল উদ্দেশ্যটা কী! এরা আসন্ন নির্বাচন বানচাল করে দেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদির হত্যাকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমে হামলার ঘটনা আগামী জাতীয় নির্বাচন তথা গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়াকে অনিশ্চিত করার ষড়যন্ত্র বলে মনে করছে দেশে ক্রিয়াশীল সবচেয়ে বড় দল বিএনপি। গত শুক্রবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা জানায় দলটি। ব্রিফিংয়ে বলা হয়, হাদি হত্যাকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার মাঝরাতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে একদল উচ্ছৃঙ্খল লোক অগ্নিসংযোগ করে। কর্মরত সাংবাদিকদের জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়। একই সঙ্গে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নিউ এজের সম্পাদক দেশবরেণ্য সাংবাদিক নূরুল কবীরের ওপর আক্রমণ করা হয়। এ ছাড়া ছায়ানটসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ঘৃণা প্রকাশ করে বিএনপি বলেছে, এসব ঘটনা প্রমাণ করে একটি পুরোনো চিহ্নিত মহল দেশকে পরিকল্পিতভাবে নৈরাজ্যের পথে ধাবিত করতে চায়। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক অধিকারকে তারা নস্যাৎ করে দেশে ফ্যাসিবাদের নতুন সংস্করণ তৈরি করতে চায়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) মনে করে, এসব ঘটনা দেশকে অস্থিতিশীল করে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র। একই রকম বক্তব্য বাংলাদেশ জাসদসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলেরও।
সংবাদমাধ্যমে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তাঁর মতে, সরকারের দুর্বলতার কারণেই ‘মবতন্ত্র’ প্রশ্রয় পেয়েছে এবং এটি কঠোর হাতে দমন করা প্রয়োজন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’ উপলক্ষে রোববার দুপুরে রাজধানীর র্যাডিসন ব্লু হোটেলে গণমাধ্যমের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা তো চেয়েছিলাম ডেমোক্রেসি। কিন্তু কেন হয়ে যাবে মবোক্রেসি? তাকে কেন লালন করতে দেওয়া হবে?’ গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেন রোববার ক্ষতিগ্রস্ত ডেইলি স্টার ভবন পরিদর্শনকালে বলেন, দুটি গণমাধ্যমে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালানো ব্যক্তিরা গণবিরোধী শক্তি, তারা দেশের মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, এ ধরনের সহিংসতা অগ্রহণযোগ্য এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও ভবিষ্যতের জন্য গুরুতর হুমকি।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড এবং শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানজনিত পরিস্থিতি দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। সেই ন্যায্য ক্ষোভকে ভিত হিসেবে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সুপ্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে চরম ডানপন্থী অগণতান্ত্রিক শক্তি নিজেদের নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত একটি বিকল্প রাজনৈতিক অবয়ব গড়ার চেষ্টাও তাদের আছে বলে মনে করা যেতে পারে। দেশে প্রতিবেশী বড় দেশের কূটনৈতিক কেন্দ্রগুলোতে হামলা মূলত সেই নীলনকশা বাস্তবায়নের পক্ষে জনমত ধরে রাখার কৌশল ছাড়া কিছু নয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কর্মরত এক প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিকের আশঙ্কা, ওসমান হাদির ভাবমূর্তি এবং তাঁর হত্যাজনিত ক্ষোভের পাটাতনে দাঁড়িয়ে অচিরেই একটি তথাকথিত বিপ্লবী সরকারের ধারণা উপস্থাপন করার তোড়জোড় চলছে।
দেশে এখন যে সরকার আছে তা গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি অন্তর্বর্তী সরকার। গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও শান্তিপ্রত্যাশী জনগণ চাইছে, দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সরকার আসুক। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় সেই জনপ্রত্যাশারই প্রতিফলন ঘটে। এরই মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তনেরও প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে। দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের কাছে তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন অভাবনীয় আবেগ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করছে। ব্যক্তিগতভাবে যাঁরা তারেক রহমানকে পছন্দ করেন না তাঁদেরও অনেকের মতে, দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তারেক রহমানের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প বিপ্লবী সরকারের ধারণা বেশ দুরভিসন্ধিমূলক।
কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা অনেকাংশে নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চার ওপর। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের দুরবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ রাজনৈতিক দলগুলোতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও জবাবদিহির অভাব। বিএনপি জুলাই আন্দোলনের বছরখানেক আগেই ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব হাজির করলেও দলের ভেতরে গণতন্ত্রচর্চার প্রসার ঘটানোর কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় প্রস্তাবগুলো তেমন বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। ২০১১ থেকে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ তখনকার সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার লক্ষ্যে এক দফা আন্দোলন শুরু করেছিল বিএনপি। সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই বিএনপি তাদের ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব বা রূপরেখা উপস্থাপন করে। রূপরেখাটি মূলত দুই ভাগে বিভক্ত—প্রথম ভাগে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কারের প্রস্তাব এবং দ্বিতীয় ভাগে অর্থনীতি ও সমাজসংক্রান্ত নানা বিষয়ে নীতি-সংস্কারের প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত। সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন, সম্প্রীতিমূলক সমন্বিত রাষ্ট্রসত্তা প্রতিষ্ঠা ও ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন, নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা নির্ধারণ—এগুলো জনগণের যতটা নজর কাড়ার কথা ছিল, বাস্তবে তেমনটা দেখা যায়নি। এর প্রধান কারণ, প্রতিশ্রুতির বিষয়ে দলটির আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ। এই সন্দেহ অনেকাংশে নিরসন করা যেত দলের ভেতরে সংস্কার শুরু করে।
অস্বীকার করা যাবে না, আন্দোলনের সময় বিএনপিকে মিত্রদের যতটা গুরুত্ব দিতে দেখা যেত, গণ-অভ্যুত্থানের পর তাতে অনেকটা ভাটা পড়েছে। এ নিয়ে হতাশাও ভর করছে মিত্র দলগুলোর নেতাদের মধ্যে। ঝড়ঝঞ্ঝার এই দেশের মানুষ সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়। রাজনীতিতেও বারবার জয় পেয়েও হারিয়ে ফেলার নজির আছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এই ভয় কতটা দূর করতে পারবেন, তার ওপর দেশের মঙ্গলও অনেকখানি নির্ভরশীল।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয়ের ৫৪তম বার্ষিকী উদ্যাপন যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ও মহাসমারোহে হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বড় একটা ছন্দপতন ঘটে গেছে। অথচ বিজয়ের এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খোদ রাজধানীতে সম্ভাব্য এক তরুণ প্রার্থীকে গুলি করার ঘটনায় পুরোনো শঙ্কা-সংশয় আরও জেঁকে বসে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা অন্যতম প্রধান শর্ত, তার ছিদ্রটা হাঁ হয়ে যায় ওই একটি ঘটনায়। শুধু তা-ই নয়, কয়েক দিনের মাথায় বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই গুলিবিদ্ধ তরুণের মৃত্যুর খবরজনিত ক্ষোভ-উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে সংবাদমাধ্যমের ওপর ন্যক্কারজনক আক্রমণ চালানো হয়। আক্রান্ত হয় বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের প্রধান কার্যালয়। রাজধানীর ধানমন্ডিতে ছায়ানট ভবনে পরিচালিত হয়ে আসছে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন এবং শিশু-কিশোরদের জন্য সংস্কৃতি-সমন্বিত ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দার কার্যক্রম। পরদিনই হামলা চালানো হয় দেশের ঐতিহ্যবাহী আরেক সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, ৫০-৬০ জনের একটি দল মিছিল নিয়ে গিয়ে ছায়ানট ভবনে হামলা করে। প্রথমে পার্কিং লটের দিকে আগুন দেওয়া হয়। পরে তারা ভবনের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। মিলনায়তনে হামলাকারীরা যা পেয়েছে তা-ই ভাঙচুর করে। তবলা, হারমোনিয়াম, তানপুরা থেকে শুরু করে কোনো বাদ্যযন্ত্রই অক্ষত রাখা হয়নি। ভাঙচুর করা ছাড়াও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তছনছ করা হয়েছে বই-কাগজপত্র। পুরো মনিটরিং সিস্টেম, ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা, স্পিকার, লাইট ও ফ্যান ভেঙে ফেলা হয়। ভেঙে ফেলা হয় সেখানে থাকা মাটির তৈরি চারুকর্ম ও শিল্পকর্ম, কক্ষ ও অফিস রুমের বেশির ভাগ আসবাব। ওই হামলার পর ছায়ানট ভবনে পরিচালিত ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের ক্লাসসহ সংগঠনের সব কার্যক্রম পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এসব ঘটনায় কারোরই বুঝতে বাকি থাকে না যে এর আসল উদ্দেশ্যটা কী! এরা আসন্ন নির্বাচন বানচাল করে দেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদির হত্যাকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমে হামলার ঘটনা আগামী জাতীয় নির্বাচন তথা গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়াকে অনিশ্চিত করার ষড়যন্ত্র বলে মনে করছে দেশে ক্রিয়াশীল সবচেয়ে বড় দল বিএনপি। গত শুক্রবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা জানায় দলটি। ব্রিফিংয়ে বলা হয়, হাদি হত্যাকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার মাঝরাতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে একদল উচ্ছৃঙ্খল লোক অগ্নিসংযোগ করে। কর্মরত সাংবাদিকদের জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়। একই সঙ্গে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নিউ এজের সম্পাদক দেশবরেণ্য সাংবাদিক নূরুল কবীরের ওপর আক্রমণ করা হয়। এ ছাড়া ছায়ানটসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ঘৃণা প্রকাশ করে বিএনপি বলেছে, এসব ঘটনা প্রমাণ করে একটি পুরোনো চিহ্নিত মহল দেশকে পরিকল্পিতভাবে নৈরাজ্যের পথে ধাবিত করতে চায়। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক অধিকারকে তারা নস্যাৎ করে দেশে ফ্যাসিবাদের নতুন সংস্করণ তৈরি করতে চায়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) মনে করে, এসব ঘটনা দেশকে অস্থিতিশীল করে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র। একই রকম বক্তব্য বাংলাদেশ জাসদসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলেরও।
সংবাদমাধ্যমে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তাঁর মতে, সরকারের দুর্বলতার কারণেই ‘মবতন্ত্র’ প্রশ্রয় পেয়েছে এবং এটি কঠোর হাতে দমন করা প্রয়োজন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’ উপলক্ষে রোববার দুপুরে রাজধানীর র্যাডিসন ব্লু হোটেলে গণমাধ্যমের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা তো চেয়েছিলাম ডেমোক্রেসি। কিন্তু কেন হয়ে যাবে মবোক্রেসি? তাকে কেন লালন করতে দেওয়া হবে?’ গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেন রোববার ক্ষতিগ্রস্ত ডেইলি স্টার ভবন পরিদর্শনকালে বলেন, দুটি গণমাধ্যমে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালানো ব্যক্তিরা গণবিরোধী শক্তি, তারা দেশের মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, এ ধরনের সহিংসতা অগ্রহণযোগ্য এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও ভবিষ্যতের জন্য গুরুতর হুমকি।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড এবং শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানজনিত পরিস্থিতি দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। সেই ন্যায্য ক্ষোভকে ভিত হিসেবে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সুপ্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে চরম ডানপন্থী অগণতান্ত্রিক শক্তি নিজেদের নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত একটি বিকল্প রাজনৈতিক অবয়ব গড়ার চেষ্টাও তাদের আছে বলে মনে করা যেতে পারে। দেশে প্রতিবেশী বড় দেশের কূটনৈতিক কেন্দ্রগুলোতে হামলা মূলত সেই নীলনকশা বাস্তবায়নের পক্ষে জনমত ধরে রাখার কৌশল ছাড়া কিছু নয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কর্মরত এক প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিকের আশঙ্কা, ওসমান হাদির ভাবমূর্তি এবং তাঁর হত্যাজনিত ক্ষোভের পাটাতনে দাঁড়িয়ে অচিরেই একটি তথাকথিত বিপ্লবী সরকারের ধারণা উপস্থাপন করার তোড়জোড় চলছে।
দেশে এখন যে সরকার আছে তা গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি অন্তর্বর্তী সরকার। গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও শান্তিপ্রত্যাশী জনগণ চাইছে, দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সরকার আসুক। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় সেই জনপ্রত্যাশারই প্রতিফলন ঘটে। এরই মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তনেরও প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে। দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের কাছে তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন অভাবনীয় আবেগ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করছে। ব্যক্তিগতভাবে যাঁরা তারেক রহমানকে পছন্দ করেন না তাঁদেরও অনেকের মতে, দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তারেক রহমানের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প বিপ্লবী সরকারের ধারণা বেশ দুরভিসন্ধিমূলক।
কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা অনেকাংশে নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চার ওপর। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের দুরবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ রাজনৈতিক দলগুলোতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও জবাবদিহির অভাব। বিএনপি জুলাই আন্দোলনের বছরখানেক আগেই ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব হাজির করলেও দলের ভেতরে গণতন্ত্রচর্চার প্রসার ঘটানোর কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় প্রস্তাবগুলো তেমন বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। ২০১১ থেকে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ তখনকার সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার লক্ষ্যে এক দফা আন্দোলন শুরু করেছিল বিএনপি। সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই বিএনপি তাদের ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব বা রূপরেখা উপস্থাপন করে। রূপরেখাটি মূলত দুই ভাগে বিভক্ত—প্রথম ভাগে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কারের প্রস্তাব এবং দ্বিতীয় ভাগে অর্থনীতি ও সমাজসংক্রান্ত নানা বিষয়ে নীতি-সংস্কারের প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত। সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন, সম্প্রীতিমূলক সমন্বিত রাষ্ট্রসত্তা প্রতিষ্ঠা ও ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন, নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা নির্ধারণ—এগুলো জনগণের যতটা নজর কাড়ার কথা ছিল, বাস্তবে তেমনটা দেখা যায়নি। এর প্রধান কারণ, প্রতিশ্রুতির বিষয়ে দলটির আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ। এই সন্দেহ অনেকাংশে নিরসন করা যেত দলের ভেতরে সংস্কার শুরু করে।
অস্বীকার করা যাবে না, আন্দোলনের সময় বিএনপিকে মিত্রদের যতটা গুরুত্ব দিতে দেখা যেত, গণ-অভ্যুত্থানের পর তাতে অনেকটা ভাটা পড়েছে। এ নিয়ে হতাশাও ভর করছে মিত্র দলগুলোর নেতাদের মধ্যে। ঝড়ঝঞ্ঝার এই দেশের মানুষ সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়। রাজনীতিতেও বারবার জয় পেয়েও হারিয়ে ফেলার নজির আছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এই ভয় কতটা দূর করতে পারবেন, তার ওপর দেশের মঙ্গলও অনেকখানি নির্ভরশীল।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

স্মার্ট পুলিশিং হলো তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক পুলিশিং ব্যবস্থা, যেখানে জ্ঞানবিজ্ঞান ব্যবহৃত হয় অত্যধিক। স্মার্ট পুলিশিংয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রমের উপাদানগুলো ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও গবেষণা করা হয়, যা অফিসারদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির সহায়ক। তা ছাড়া নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করা হয় অপ
০৩ জুলাই ২০২৪
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১৬ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের কৃষি খাতে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তা নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক অর্জন। লাখ লাখ ক্ষুদ্র কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী, গবেষক, কৃষি উদ্ভাবন এবং সরকারের ধারাবাহিক সহায়তায় বাংলাদেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে একটি শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে। তবে কৃষি আজ আর কেবল খাদ্য উৎপাদনের বিষয় নয়।
১৬ ঘণ্টা আগে
ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেছেন, ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোয় যারা হামলা চালিয়েছিল, তাদের কয়েকজনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
১৭ ঘণ্টা আগে