Ajker Patrika

রোকেয়া দিবস

রোকেয়ার নারী মুক্তির দর্শন

বেগম ড. এম এ সবুর
বেগম রোকেয়া। ছবি: সংগৃহীত
বেগম রোকেয়া। ছবি: সংগৃহীত

নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন বাঙালি নারীসমাজকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। তাঁর সমকালে সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় অজ্ঞতার কারণে বাঙালি নারীসমাজ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। এ জন্য ধর্মীয় অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ক্ষুরধার মসিযুদ্ধ চালিয়েছেন তিনি। তাঁর জ্ঞানের অগ্নিশিখায় অজ্ঞতার অন্ধকার দূরীভূত হয়ে আলোর প্রভা উদ্ভাসিত হয় এবং মুসলিম নারীসমাজে জাগরণ সৃষ্টি হয়।

তাঁর সমকালে অনেকে নারীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার কথা শুনলেই চমকে উঠত। শিক্ষার প্রতি যথেষ্ট আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও সামাজিক কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার কারণে বাঙালি মুসলিম নারীসমাজ শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। বিশ শতকের ত্রিশের দশকে প্রতিবেশী হিন্দু নারীরা পুরুষের সঙ্গে শিক্ষাসহ বিভিন্ন কাজকর্মে অংশগ্রহণ করলেও বাঙালি মুসলিম নারীরা ছিল অনেক পিছিয়ে। জ্ঞান ও প্রতিভা বিকাশের পথ রুদ্ধ করে নারীদের ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হতো। আশঙ্কা করা হতো, নারীরা শিক্ষিত হলে উচ্ছৃঙ্খল হবে, তাদের পতিভক্তি কমে যাবে। লেখাপড়ার পরিবর্তে নারীদের ঘরকুনো করে রাখার দিকে পিতা-মাতার আগ্রহ ছিল বেশি।

নারীর শিক্ষার জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ছিল না। মৌলভি রেখে অভিজাত শ্রেণির নারীদের ঘরে আরবি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হলেও, তাদের বাংলা-ইংরেজি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হতো। এতে নারীমনের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ তো হতোই না, অধিকন্তু নানা কুসংস্কার বাসা বাঁধত। বাঙালি মুসলিম নারীসমাজের এহেন করুণ দশা দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। তিনি নারীসমাজকে উদ্ধার ও কুসংস্কারমুক্ত করতে প্রথমেই নারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন।

নারী শিক্ষার প্রতি উদাসীনতাকেই তিনি নারীসমাজের দুঃখ-দুর্দশার মূল কারণ উল্লেখ করে বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সমিতির সভায় অভিভাষণে বলেন, ‘মোছলমানদের যাবতীয় দৈন্য-দুর্দশার একমাত্র কারণ স্ত্রীশিক্ষায় ঔদাস্য।’ তিনি যর্থাথই বুঝতে পেরেছিলেন সমাজ ও জাতির উন্নতির জন্য প্রয়োজন নারী শিক্ষা। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য রূপচর্চার পরিবর্তে জ্ঞানচর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি। অলংকারকে তিনি নারীর জন্য দাসত্বের শিকল মনে করেছেন। এ জন্য বেগম রোকেয়া ‘বোরকা’ প্রবন্ধে মেয়েদের অলংকার ছেড়ে জ্ঞান শিক্ষার আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন, ‘নারীর শোভন-অলংকার ছাড়িয়া জ্ঞানভূষণ লাভের জন্য ললনাদের আগ্রহ বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্ছনীয়।’ নারী শিক্ষাবিরোধী কথিত আলেমদের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং নারী শিক্ষায় ধর্মীয় নির্দেশ প্রমাণ করতে তিনি নারী শিক্ষা সমিতি প্রবন্ধে বলেন, ‘পৃথিবীর যিনি সর্বপ্রথম পুরুষ-স্ত্রীলোককে সমভাবে সুশিক্ষা দান করা কর্তব্য বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন তিনি আমাদের রসূল মকবুল (অর্থাৎ পয়গম্বর সাহেব)।’ তিনি নারীসমাজে যেমন শিক্ষার চেতনা জাগ্রত করেছেন, তেমনি নারী শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। অনেক বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে বাঙালি মুসলিম সমাজের শিক্ষা বিস্তারে এ প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ ছাড়া আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিম নারীসমাজকে সংঘবদ্ধ করেছেন তিনি।

বেগম রোকেয়ার সমকালে সমাজের প্রায় অর্ধেক অংশ নারীসমাজকে বাদ দিয়ে সমাজ উন্নয়নের চেষ্টা করা হতো। সে সময় নারীদের উন্নয়নের যথার্থ চিন্তাভাবনা ছিল না। নারীর সহযোগিতা ছাড়া পুরুষের একার পক্ষে সমাজ উন্নয়ন যে সম্ভব নয় তৎকালীন মুসলিম সমাজ তা বুঝত না। অফিস-আদালতে নারীদের কাজ করার কথা বাঙালি মুসলিম সমাজ চিন্তা করতেই পারত না। সামাজিক কোনো কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণের কথা মানুষ ভাবতেই পারেনি। এক শ্রেণিকে অবনত রেখে অপর শ্রেণি উন্নত হলে সমগ্র সমাজ উন্নয়ন হয় না। এ বিষয়টি যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বেগম রোকেয়া।

সে সময় স্বামী-স্ত্রীর শিক্ষা ও জ্ঞানের পার্থক্যও ছিল ব্যাপক। স্বামী যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা-গবেষণায় নিয়োজিত, স্ত্রী তখন ঘরের মধ্যে গৃহস্থালির ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। বেগম রোকেয়া ব্যথিত হৃদয়ে জ্ঞানের এ বৈষম্য উল্লেখ করে নারীসমাজকে জাগ্রত করার প্রয়াস চালিয়ে ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে লেখেন, ‘স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়ারের দৈর্ঘ্য প্রস্থ (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন! স্বামী যখন কল্পনার সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রমালা বেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন, সূর্যমন্ডলের ঘনফল তুলাদন্ডে ওজন করেন এবং ধুমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাল-ডাল ওজন করেন এবং রাঁধুনির গতি নির্ণয় করেন।’

মুসলিম নারীসমাজের বঞ্চনা ও গঞ্জনা দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। বাঙালি নারীসমাজের মুক্তির জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি। নারীসমাজকে জাগ্রত করতে তিনি প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেছেন প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে। নির্যাতিত ও অসহায় নারীসমাজকে পুরুষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রেরণা ও শক্তি জুগিয়েছেন তিনি। পুরুষের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে নারীসমাজকে অধিকার আদায়ের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তিনি পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের জন্য নারীসমাজকে সামাজিক বাধা উপেক্ষা এবং কঠোর পরিশ্রমের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে লেডী কেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী-ম্যাজিস্ট্রেট, লেডী-জজ, লেডী-ব্যারিস্টার সবই হইব। পঞ্চাশ বৎসর পর লেডী ভাইসরয় হইয়া এদেশের সমস্ত নারীকে ‘রাণী’ করিয়া ফেলিব।’ প্রকৃতপক্ষেই বাঙালি নারীকে ‘রাণী’ করার তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। তাঁরা পুরুষসমাজের আধিপত্যের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়েছেন। অধিকন্তু সর্বস্তরে নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিতের চেষ্টা-আন্দোলন অব্যাহত আছে। নারীসমাজের এ উন্নতি-অগ্রগতির জন্য সমগ্র বাঙালি জাতি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার কাছে ঋণী, আমরা তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

লেখক: বেগম ড. এম এ সবুর, আহ্বায়কডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব নন গভর্নমেন্ট টিচার্স (ড্যাঙ্গট)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...