Ajker Patrika

শিক্ষকদের প্রস্তুত করাই বড় চ্যালেঞ্জ

শহীদুল ইসলাম, ঢাকা
আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮: ৩২
শিক্ষকদের প্রস্তুত করাই বড় চ্যালেঞ্জ

নতুন শিক্ষাক্রমে বদলে যাচ্ছে শিক্ষার খোলনলচে। নতুন ধারার এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আগে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কিন্তু প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আগামী বছর নতুন শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলকভাবে শুরুর আগেই তাঁদের প্রশিক্ষণ শুরু করবে সরকার।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে শুধু ক্লাসের পড়া আর মুখস্থ নির্ভর থাকছে। এই কার্যক্রমে শিক্ষকের পাশাপাশি সহপাঠী, অভিভাবক ছাড়াও প্রকল্প অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন মূল্যায়ন করবেন। তবে মূল্যায়ন বা পড়ানোর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব থাকবে শিক্ষকদের। ফলে নতুন শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রস্তুত করাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ অধিকাংশ শিক্ষক প্রচলিত ধারার সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে পরিচিত। সেই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা আজকের পত্রিকাকে বলেন, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগেই সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

করোনা মহামারির মধ্যে সশরীরের পাশাপাশি অনলাইনেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আগামী বছর থেকে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে। পাইলটিংয়ে যাওয়ার আগে কারিকুলাম চূড়ান্ত করে পাঠ্যবই ছাপানো হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। চূড়ান্ত শিক্ষাক্রমে প্রশ্নের ধরন, মূল্যায়নের পদ্ধতি এবং শিখনকালীন মূল্যায়নের কৌশল ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত বলে দেওয়া হবে বলে জানান অধ্যাপক নারায়ণ।

জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির মহাপরিচালক মো. শাহ আলম আকজের পত্রিকাকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রাথমিকের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এখন তাঁদের যেভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে তাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হবে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলেই আমরা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরু করব।’

এ বিষয়ে ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলছেন, ‘সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা চ্যালেঞ্জ তো হবেই। কারণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে কোনো জোরালো কার্যক্রম আমাদের নেই। নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবভিত্তিক। সে জন্য সুচিন্তিত কার্যক্রম নিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য যা অর্থ লাগবে তা সরকারকে দিতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদের অধ্যাপক এসএম হাফিজুর রহমান মনে করেন, সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও ক্লাসরুম তার ভালো কিছু পাওয়া যায় না। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরুর আগে এ বিষয়ে ছক করে নিতে হবে। কোন শিক্ষকের কোন বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাগবে তা চিহ্নিত করে নিতে হবে।

শিক্ষকদের প্রস্তুত করাই বড় চ্যালেঞ্জ

শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে চাপ কমিয়ে পড়াশোনার পরিবেশ আনন্দময় করতে গত সোমবার নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুমোদন করেছে সরকার। এদিকে আগামী বছর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করে ২০২৫ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। মাদ্রাসা ও কারিগরির শিক্ষার্থীদেরও নতুন এই শিক্ষাক্রমের আওতায় আনা হয়েছে। তবে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা আগের মতোই ব্রিটিশ কাউন্সিলের সিলেবাস অনুযায়ী পড়বে। 

নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না। এই চার ক্লাসে শিক্ষার্থীদের শুধু শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে। চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ৪০ শতাংশ নম্বরের জন্য পরীক্ষা দেবেন, বাকি ৬০ শতাংশ নম্বর আসবে তাদের শিখনকালীন মূল্যায়নের মাধ্যমে। নবম-দশমে ৫০ শতাংশ নম্বরের জন্য পরীক্ষা, বাকি ৫০ শতাংশ নম্বর শিখনকালীন এবং একাদশ-দ্বাদশে ৭০ শতাংশ নম্বর পরীক্ষা এবং ৩০ শতাংশ নম্বর শিখনকালীন মূল্যায়নে দেওয়া হবে। পরীক্ষার নম্বরের সঙ্গে শিখনকালীন মূল্যায়ন যোগ করে মূল ফলাফল ঘোষণা করা হবে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিক আহসান গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে একজন শিক্ষার্থী আরেক শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করবে। অভিভাবক সন্তানদের মূল্যায়ন করবেন। এ ছাড়া কমিউনিটিভিত্তিক মূল্যায়ন হবে। শিক্ষার্থীদের প্রকল্পভিত্তিক যেসব বিষয় শেখানো হবে, প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা মূল্যায়ন করবেন। শিক্ষার্থীদের শুধু শিক্ষকই মূল্যায়ন করবেন, সেই সুযোগ আর থাকছে না।’

জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর এবং নবম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তর হওয়ার কথা থাকলে নতুন শিক্ষাক্রম সেভাবে হয়নি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর ধরে নতুন শিক্ষাক্রম করা হয়েছে। 

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাকে আরও আনন্দময় করতে তাদের টেক্সট বুক কমিয়ে ওয়ার্ডবুক ও টিচার্স গাইড করা হবে। শিক্ষক কীভাবে ক্লাসে পড়াবেন তা টিচার্স গাইডে বিস্তারিতভাবে বলা থাকবে। কোন বিষয়গুলো পড়াতে হবে তা ওয়ার্ডবুকে নির্দেশক হিসেবে দেওয়া হবে, শিক্ষক সেসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ধারণা দেবেন। অন্য সোর্সগুলো খুঁজে পেতে সহায়তা করবেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আগেই সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ জন্য শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় শিক্ষকদের স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী বছর থেকেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে। নতুন করে যারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবেন তাদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণেও নতুন পাঠ্যক্রমের বিষয়টি রাখা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের নাম বদলে ‘ভালো থাকা’ করা হবে। এই বইয়ে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে শিক্ষার্থীদের শেখানো হবে। 

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে জানান, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির আলোকে এসএসসি পরীক্ষা হবে। একাদশ শ্রেণিতে একটি এবং দ্বাদশে আরেকটি পাবলিক পরীক্ষা নেবে সংশ্লিষ্ট বোর্ড। এই দুই পরীক্ষার ফলের সঙ্গে একাদশ ও দ্বাদশের শিখনকালীন মূল্যায়নের ফল যোগ করে এইচএসসির ফল প্রকাশ করা হবে।

নতুন শিক্ষাক্রম চালু হলে শুক্র ও শনিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। প্রাক-প্রাথমিকে ৫০০ ঘণ্টা, প্রথম-তৃতীয় শ্রেণিতে ৬৩০ ঘণ্টা, চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণিতে ৮৪০ ঘণ্টা, ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণিতে ১০৫০ ঘণ্টা, নবম-দশম শ্রেণিতে ১১১৭.৫ ঘণ্টা এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ১১৬৭.৫ ঘণ্টা শিখন সময় (বছরে) নির্ধারণ করা হয়েছে।

আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, সময় উপযোগী শিক্ষাক্রম ঘোষণা করেছে সরকার। এখন ১৬ বছর পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী সমান জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাবে। একমুখী শিক্ষার জন্য এ ধরনের শিক্ষাক্রমের প্রয়োজন ছিল। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘মেডিকেলে চান্স না পেয়ে’ ৩৩ হাজার ভোল্ট বিদ্যুতের তারে শুয়ে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, দাবি স্বজনদের

সিঙ্গাপুর যাত্রার আগে হাদির শারীরিক অবস্থা নিয়ে যা জানাল মেডিকেল বোর্ড

তাইওয়ানে যুদ্ধে জড়ালে চীনের কাছে হারতে পারে যুক্তরাষ্ট্র— পেন্টাগনের গোপন নথি ফাঁস

ফলের দোকানদার ও বেকার ছেলে: অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে হামলাকারী সম্পর্কে যা জানা গেল

হাদিকে নিয়ে সিঙ্গাপুরের পথে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

রক্তসাগর পাড়ি দিয়ে পুব আকাশে স্বাধীনতার সূর্য

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বেলা পৌনে ১১টায় উপকণ্ঠ থেকে মূল ঢাকা শহরে প্রবেশ করেন বিজয়ী মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সেনারা। অন্যদিকে শীর্ষ কর্মকর্তা পর্যায়ে চলতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি।

১৫ ডিসেম্বর ছিল বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সদর্প বিচরণের শেষ দিন। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর চূড়ান্ত অভিযানে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই কার্যত ঢাকায় পাকিস্তানি দুর্গের পতনের ক্ষণগণনা চলছিল। উপায় না দেখে পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান আবদুল্লাহ খান নিয়াজি শীর্ষ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ১৫ তারিখ আত্মসমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের দলিল এবং সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা চূড়ান্ত করার জন্য ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান মেজর জেনারেল জ্যাকব ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকা এসে পৌঁছান। বিকেল ৪টার আগেই বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর দুটি ইউনিটসহ মোট চার ব্যাটালিয়ন সেনা ঢাকায় প্রবেশ করে। সঙ্গে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকার এত দিনের জনবিরল সড়কগুলো ক্রমেই জনাকীর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে। সবার মুখে একাত্তরের পরিচিতি রণধ্বনি’ জয় বাংলা’।

কারফিউ জারি থাকলেও মানুষ তার পরোয়া না করে রাস্তায় বেরিয়ে উল্লাস করতে থাকেন। পাকিস্তানি বাহিনীর নয় মাসের গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের পর মুক্তির আনন্দে তাঁরা তখন আত্মহারা। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর কয়েক লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে তাঁরা পেয়েছেন নতুন দেশ—বাংলাদেশ। বিজয়ের আনন্দ, স্বজন হারানোর শোক আর অজানা আগামীর প্রত্যাশায় সবার মনে এক বিচিত্র অনুভূতি। এর মধ্যেও ঘটে কিছু দুঃখজনক ঘটনা। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পলায়নপর কিছু পাকিস্তানি সেনা ও বিহারি এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে অনেক বাঙালিকে হতাহত করে।

বিকেল ৪টায় বাংলাদেশের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকার, ভারত-বাংলাদেশ যুগ্ম কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ও অন্য সামরিক কর্মকর্তারা বিমানে ঢাকা অবতরণ করেন। এর কিছু সময় পরই ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল উৎফুল্ল জনতার উপস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন পাকিস্তানি সমরাধিনায়ক লে. জেনারেল নিয়াজি। পাকিস্তানি বাহিনীর দখল থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হলো বাংলাদেশ। সগর্বে জায়গা করে নিল বিশ্বের মানচিত্রে।

ঢাকায় ১৬ ডিসেম্বরই ধীরে ধীরে সবাই জানতে পারেন আগের কয়েক দিনে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, লেখকসহ বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর। নিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি সেনাদের এদেশীয় সহযোগীরা তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিল; কিন্তু কেউই আর ফিরে আসেননি। দেশের এই মেধাবী, কৃতী সন্তানদের পরিণতির কথা ভেবে জনমনে ছড়িয়ে পড়ে উদ্বেগ। পরদিনই মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে রায়েরবাজার বধ্যভূমির বীভৎস দৃশ্যের খবর। রাজধানীর রায়েরবাজার ও মিরপুরের বিভিন্ন জায়গার অনেক বধ্যভূমিতে পাওয়া যায় নির্যাতিত মানুষের ক্ষতবিক্ষত দেহ। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের অনেকের হাত বা চোখ বাঁধা, বেয়নেট বা গুলিতে বিদ্ধ লাশের খোঁজ মেলে রায়েরবাজারে। বিজয়ের আনন্দের মধ্যে এই শোকের খবর, বধ্যভূমির ভয়াবহ দৃশ্য স্তম্ভিত করে মানুষকে।

এদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই কাজে লেগে যায় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার। ১৬ ডিসেম্বরই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকার সদর দপ্তর থেকে গোটা দেশে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে। নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসকদের কাছে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি পাঠানো শুরু হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ায় শুরু হয় পুরো সরকারের দেশে ফেরার প্রক্রিয়াও। ৭ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার পর থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই উনিশটি জেলার জন্য জেলা প্রশাসকদের মনোনয়ন ও নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছিল। শুরু হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের নতুন কঠিন যুদ্ধ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘মেডিকেলে চান্স না পেয়ে’ ৩৩ হাজার ভোল্ট বিদ্যুতের তারে শুয়ে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, দাবি স্বজনদের

সিঙ্গাপুর যাত্রার আগে হাদির শারীরিক অবস্থা নিয়ে যা জানাল মেডিকেল বোর্ড

তাইওয়ানে যুদ্ধে জড়ালে চীনের কাছে হারতে পারে যুক্তরাষ্ট্র— পেন্টাগনের গোপন নথি ফাঁস

ফলের দোকানদার ও বেকার ছেলে: অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে হামলাকারী সম্পর্কে যা জানা গেল

হাদিকে নিয়ে সিঙ্গাপুরের পথে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ত্যাগ, বীরত্ব আর গৌরবের জ্বলন্ত সাক্ষী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

শরীফ নাসরুল্লাহ, ঢাকা
দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর জন্ম নেয় নতুন একটি দেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সে সংগ্রাম, আত্মত্যাগের চিত্র জীবন্ত হয়ে রয়েছে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। ছবি: আজকের পত্রিকা
দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর জন্ম নেয় নতুন একটি দেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সে সংগ্রাম, আত্মত্যাগের চিত্র জীবন্ত হয়ে রয়েছে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। ছবি: আজকের পত্রিকা

কালো ফ্রেমে বাঁধাই করা একটি জামা। হলুদ জমিনের মাঝে লাল রং। জামাটি রেহানা নামের এক দুধের শিশুর। একাত্তরের যুদ্ধদিনে তার বয়স ছিল মাত্র দুই মাস। রেহানার বাবা আবদুস সালাম খান ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। এই অপরাধে পাক সেনারা বাড়িতে হানা দিয়ে শিশু রেহানাকে নির্মমভাবে আছাড় মেরে এবং বুটের তলায় পিষে হত্যা করে। একটি ছবিও না থাকায় মেয়ের চিহ্ন বলতে বাবার কাছে রয়ে যায় এ জামা।

বিজয়ের ভোর আনতে রেহানার মতো ঝরেছে কত প্রাণ। একাত্তরকে ঘিরে আছে কত সাহস, বীরত্ব আর আত্মত্যাগের কাহিনি। তারই বেশ কিছু নমুনা রয়েছে আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গ্যালারিগুলোতে। একে একে চারটি গ্যালারি পেরিয়ে এলে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো যেন চোখের সামনে তাজা হয়ে ফিরে আসে।

খুলনার সেনহাটিতে বাসা ছিল মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম খানের। যুদ্ধের শুরুর দিকে, ৩০ এপ্রিল পাক সেনারা স্থানীয় দালালদের সহায়তায় তাঁর বাসা ঘেরাও করে। সালামকে না পেয়ে তারা শিশু রেহানাকে হত্যা করে। রাতের আঁধারে বাবা গোপনে বাড়িতে এসে লাশটি ধুয়েমুছে রূপসা নদীতে ভাসিয়ে দেন। স্বাধীনতার পরে মেয়ের জামাটিই হয়ে ওঠে তাঁর বুকের ধন। জামাটি তিনি ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখেন দীর্ঘ ২৫ বছর। একপর্যায়ে তাঁর কাছ থেকে এটি সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কার্যত এক মহাকাব্যিক ঘটনা। এ রকম কত ঘটনাই না তখন ঘটেছে। দেশের প্রায় সব মানুষ যার যার সাধ্যমতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তির লড়াইয়ে। কেউ রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে লড়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে, খাবার খাইয়ে, শত্রুর গতিবিধি জানিয়ে কিংবা উদ্দীপনামূলক গান শুনিয়ে যে যেভাবে পেরেছেন সহায়তা করেছেন।

গ্যালারি-২-এ ঢুকতেই চোখে পড়বে একটা লুবিটেল-২ ক্যামেরা। আলোকচিত্রী শুকুর মিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবি তুলেছিলেন এই ক্যামেরা দিয়ে। একটু এগোলেই ভয় ধরানো এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মৃদু আলো জ্বলছে। ওপরে লেখা, ‘অপারেশন সার্চলাইট: গণহত্যার নীল নকশা ও পঁচিশ মার্চের কালরাত্রি’।

পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরুর সেই ভয়ানক রাতের কথা ডায়েরিতে লিখেছিলেন কবি, নারী অধিকার আন্দোলনের নেত্রী সুফিয়া কামাল। আরও অনেকের মতো নাখালপাড়ার বাড়িতে বসে নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছিল তখনকার ৭ম শ্রেণির ছাত্রী স্বাতী চোধুরী। সুফিয়া কামালের ডায়েরি আর স্বাতীর স্কুলের সেই খাতা আছে এখানে।

সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত আর তার ভেতরে বাংলাদেশের হলুদ মানচিত্র। প্রথম নকশার বাংলাদেশের এই জাতীয় পতাকা ৭ মার্চ উড়েছিল লে. সিকান্দার আলীর বাড়িতে। পতাকাটি আছে জাদুঘরের এই গ্যালারিতে। মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান অসামান্য। ঢাকার রাজপথে ডামি রাইফেল হাতে নারীদের মিছিলের আলোকচিত্রও আছে।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। ২৫ মার্চ রাতের প্রথম শহীদদের অন্যতম তিনি। তাঁর ব্যবহৃত বাইনোকুলার আর পোশাক রাখা হয়েছে জাদুঘরে। দেখা যাবে শহীদ অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, আব্দুল মুকতাদির, দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, কবি মেহেরুন্নেসাসহ অনেকের স্মৃতিবিজড়িত ব্যবহৃত জিনিস। রয়েছে জাতীয় চার নেতার ব্যবহৃত কোট, লাইটার, চশমা ইত্যাদি। গ্যালারি-২-এ আরও দেখা মিলবে একটি টাইপরাইটারের। জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর চালানো গণহত্যা বন্ধের আবেদন করা হয়েছিল এই টাইপরাইটারে লিখে।

গ্যালারি-৩-এ বিশাল আলোকচিত্রে একাত্তরের শরণার্থী শিবিরের কষ্টকর জীবনের দৃশ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিল ১ কোটি মানুষ। এখানে আছে শরণার্থীদের নিয়ে করা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য ইকোনমিকস, টাইম, নিউইয়র্ক টাইমস, ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনের আলোকচিত্র। আছে সে সময়ের সাংস্কৃতিক দলের কার্যক্রমের বিভিন্ন ছবি।

এই গ্যালারিতে দেখা মিলবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের বিভিন্ন চিত্র, একুশের গানের স্রষ্টা শহীদ আলতাফ মাহমুদের ইলেকট্রিক শেভিং রেজার। একটি জায়গায় দেখা যায়, একটি বাড়ির জানালা। জানালার অন্যপাশে একটি ছবিতে অন্ধকারে অস্ত্র হাতে মুক্তিসেনা। ছবিটি এমনভাবে রাখা হয়েছে, দেখে মনে হবে, সত্যিই যেন জানালার ওপারে অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধা। গ্যালারি-৩-এর শেষ দিকে চোখ আটকে যাবে একটি কালো রঙের গাড়িতে। শহীদ ডা. ফজলে রাব্বির এই গাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে ব্যবহৃত হতো। ১৫ ডিসেম্বর আল-বদরের সদস্যরা তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল।

জাদুঘরের নারী নির্যাতন অংশে চোখ বুলালে শিউরে উঠতে হয়। সিলেটের পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের দেয়ালে আঁকা ছবি রাখা হয়েছে এখানে। বাঙালি মেয়েদের নির্যাতন শিবিরের দেয়াল বুঝিয়ে দেয় কী ভয়াবহ নির্যাতন ঘটেছিল সেখানে।

একটি ছবিতে দেখা মেলে দুই কিশোরীর। তারা ঝুড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে কচুরিপানা। সেই কচুরিপানার আড়ালে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেনেড।

গ্যালারি-৪-এ দেখা মেলে বাঙালির বিজয়ের স্মৃতির নমুনা। দেখা মেলে মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের আলোকচিত্র ও স্মৃতিবিজড়িত বস্তু। এর মধ্যে রয়েছে বিলোনিয়া, পরশুরাম, চিথলিয়া, ফুলগাজী, ফেনী, মন্দভাগ, কসবা-সালদা নদী, নারায়ণগঞ্জ-কামরাঙ্গীরচর, শেরপুর, কামালপুর যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন। ঢাকা শহরে ট্রাকে চড়ে মানুষের বিজয় উল্লাস।

গ্যালারি-১-এ আছে একাত্তর পর্যন্ত এ ভূখণ্ডের বিভিন্ন শাসনামলের ইতিহাস। বাকি তিনটি গ্যালারিজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক। বিজয় দিবসের ঠিক আগের দিনে জাদুঘরে দেখা গেল সপরিবারে আসা মোহা. আসলাম উদ্দিনকে। তিনি বললেন, ‘বিজয়ের মাসে হঠাৎ করেই জাদুঘরে ঘুরতে আসা। এসে ঘুরতে ঘুরতে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনার যেন সাক্ষী হয়ে গেলাম।’

দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে যায়। পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের ম্লান আলো পড়ছে জাদুঘরের সামনে টাঙানো লাল-সবুজ পতাকায়। রাত পেরোলেই দেখা দেবে নতুন সূর্য। সে সূর্য মুক্তির, বিজয়ের।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘মেডিকেলে চান্স না পেয়ে’ ৩৩ হাজার ভোল্ট বিদ্যুতের তারে শুয়ে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, দাবি স্বজনদের

সিঙ্গাপুর যাত্রার আগে হাদির শারীরিক অবস্থা নিয়ে যা জানাল মেডিকেল বোর্ড

তাইওয়ানে যুদ্ধে জড়ালে চীনের কাছে হারতে পারে যুক্তরাষ্ট্র— পেন্টাগনের গোপন নথি ফাঁস

ফলের দোকানদার ও বেকার ছেলে: অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে হামলাকারী সম্পর্কে যা জানা গেল

হাদিকে নিয়ে সিঙ্গাপুরের পথে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নতুন প্রত্যাশা জাতির মনে

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের ৫৪ বছর পূর্তি এবার। এই ভূখণ্ডের মানুষের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল দিন ১৬ ডিসেম্বর। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিশ্বের বুকে জন্ম নেয় নতুন এক দেশ—বাংলাদেশ। দিনটি একই সঙ্গে বিজয়ের আনন্দ-উচ্ছ্বাস ও শহীদের স্মরণে ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালন করবে দেশবাসী।

জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসনের পতনে বাংলাদেশে এখন এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা। স্বৈরশাসককে বিদায় জানানোর পাশাপাশি ঘুণে ধরা রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার করে নতুন সম্ভাবনাকে স্বাগত জানাতে চায় জনগণ। এমন ভিন্ন ধরনের এক প্রেক্ষাপটে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিতর্কহীন, অবাধ ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনে দেশবাসী তাদের পছন্দের প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার অপেক্ষায়। এবারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা অতীতের ব্যর্থতা, সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতাকে কাটিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সাধ্যমতো সচেষ্ট হবেন– এটিই এবারের বিজয় দিবসের প্রাক্কালে দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষা।

এই আনন্দের দিনে জাতি পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী বীর সন্তানদের। শ্রদ্ধার ফুলে ফুলে ভরে উঠবে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এ উপলক্ষে লাল-সবুজে সেজেছে দেশ। সর্বত্র উড়ছে জাতীয় পতাকা। বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রথামতো বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। রাষ্ট্রপতি বাণীতে বলেন, ‘দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের এই দিনে আমরা অর্জন করি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। বিজয়ের এই দিনে আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সকল বীর শহীদ, যুদ্ধাহতসহ সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা, সম্ভ্রমহারা মা-বোন, শহীদ পরিবারের সদস্য ও আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রাখা সকল সংগ্রামী যোদ্ধাকে, যাঁদের ত্যাগ ও আত্মদানের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ।’

রাষ্ট্রপতি আরও বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতায় সীমাবদ্ধ ছিল না, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য। বিগত পাঁচ দশকের পথচলায় জনগণের পূর্ণ রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক মুক্তি এখনো অর্জিত হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়তে নতুন আশা জাগিয়েছে।

একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তাঁদের এই আত্মদান আমাদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা ও সাহস জোগায়, সকল সংকটে-সংগ্রামে দেখায় মুক্তির পথ।’ প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যে নতুন সূর্য উদিত হয়েছিল, বিগত বছরগুলোতে তা বারবার স্বৈরাচার আর অপশাসনে ম্লান হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা আবারও একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েছি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একটি উন্নত ও সুশাসিত বাংলাদেশের শক্তিশালী ভিত গড়ে তুলতে যে বিস্তৃত সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, দেশের আপামর জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আজ আমরা সে কর্মযজ্ঞের সফল পরিসমাপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছি।’

বিজয় দিবস উপলক্ষে সারা দেশে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও স্থাপনাকেন্দ্রিক বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। রাজধানী ঢাকা থেকে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত সড়কে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পোশাকধারী বাহিনীর পাশাপাশি সাদাপোশাকে পুলিশ মোতায়েন থাকবে।

আজ ভোরে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতার সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান উপদেষ্টা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বিদেশি কূটনীতিক এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানাবেন।

বিজয় দিবসে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপ জাতীয় পতাকায় সজ্জিত করা হয়েছে।

আজ বিকেলে বঙ্গভবনে মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। এ ছাড়া মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। দেশের সব শিশুপার্ক ও জাদুঘর বিনা টিকিটে সর্বসাধারণের জন্য খোলা থাকবে। সিনেমা হলে বিনা মূল্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র দেখানো হবে। দেশের সব জেলা ও উপজেলায় দিনব্যাপী বিজয় মেলার আয়োজন করা হয়েছে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতেও দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরতে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘মেডিকেলে চান্স না পেয়ে’ ৩৩ হাজার ভোল্ট বিদ্যুতের তারে শুয়ে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, দাবি স্বজনদের

সিঙ্গাপুর যাত্রার আগে হাদির শারীরিক অবস্থা নিয়ে যা জানাল মেডিকেল বোর্ড

তাইওয়ানে যুদ্ধে জড়ালে চীনের কাছে হারতে পারে যুক্তরাষ্ট্র— পেন্টাগনের গোপন নথি ফাঁস

ফলের দোকানদার ও বেকার ছেলে: অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে হামলাকারী সম্পর্কে যা জানা গেল

হাদিকে নিয়ে সিঙ্গাপুরের পথে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ হবে অর্থহীন ও আত্মঘাতী: টিআইবি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ হবে অর্থহীন ও আত্মঘাতী: টিআইবি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক পুলিশব্যবস্থা গঠনের দীর্ঘদিনের জনদাবিকে উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার প্রণীত পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ কার্যত লোকদেখানো ও অর্থহীন উদ্যোগ। সংস্থাটির মতে, প্রস্তাবিত এই কমিশন স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা—কোনোটিই নিশ্চিত করতে পারবে না; বরং এটি হবে আত্মঘাতী ও জনগণের অর্থ অপচয়ের আরেকটি আমলাতান্ত্রিক কাঠামো।

আজ সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এই উদ্বেগের কথা জানায় টিআইবি। এতে বলা হয়, রক্তক্ষয়ী জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র সংস্কারের ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি হয়েছিল, পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী কমিশন গঠিত হলে তা স্বাধীন হওয়ার বদলে সরকারের আজ্ঞাবহ অবসরপ্রাপ্ত এবং প্রেষণে নিয়োজিত আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের কর্তৃত্ব চর্চার নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠবে।

অধ্যাদেশটি ধারণাগত, কৌশলগত ও কাঠামোগতভাবে গুরুতর ত্রুটিপূর্ণ জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এই অধ্যাদেশ পুলিশের পেশাদারত্ব ও জবাবদিহি নিশ্চিত না করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ প্রশাসনিক ও পুলিশি আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ আরও গভীর করবে। ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির যে সংকট থেকে পুলিশের জনআস্থার অবনতি হয়েছে, তার উত্তরণ তো হবেই না; বরং তা বৈধতা পাবে।’

ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘যে স্বাধীন পুলিশ কমিশনের জন্য জনগণ ও নাগরিক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে, তার অপরিহার্য শর্ত হলো, সরকারের প্রভাবমুক্ত স্বাধীনতা। অথচ অধ্যাদেশে “স্বাধীনতা” শব্দটি পর্যন্ত অনুপস্থিত।’

কমিশনের গঠনপ্রক্রিয়াকে স্বার্থসংঘাতপূর্ণ উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে সদস্যসচিব করার বিধান কমিশনের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করবে। তাঁর মতে, বিশ্বের কোথাও এভাবে কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির কর্মকর্তার জন্য কমিশনকে বাধ্যতামূলকভাবে উন্মুক্ত রাখার নজির নেই।

অধ্যাদেশের বিভিন্ন ধারা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে টিআইবি। বিশেষ করে ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘জননিরাপত্তা ও মানবাধিকার ভারসাম্য’-এর অস্পষ্ট ব্যাখ্যাকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বৈধতার ঝুঁকি হিসেবে দেখছে সংস্থাটি। পাশাপাশি নাগরিক অভিযোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং পুলিশ অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটিতে একই কমিশনের সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির বিধান অভিযোগ নিষ্পত্তিকে প্রভাবিত করবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

টিআইবির মতে, অধ্যাদেশের ২৩, ২৪ ও ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতার অভাব প্রস্তাবিত কমিশনকে কার্যত সরকারের একটি অধীনস্থ দপ্তরে পরিণত করবে। বর্তমান কাঠামো বহাল থাকলে বাংলাদেশে প্রকৃত পুলিশ সংস্কারের সম্ভাবনা প্রায় শূন্যে নেমে আসবে।

এ পরিস্থিতিতে সরকারের ভেতরে সক্রিয় সংস্কারবিরোধী চক্রের কাছে নতজানু অবস্থান পরিহার করে পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ-২০২৫ সংশোধনের মাধ্যমে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি। সংস্থাটির দাবি, শুধু সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, স্বাধীন এবং সরকারি ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ কমিশনই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘মেডিকেলে চান্স না পেয়ে’ ৩৩ হাজার ভোল্ট বিদ্যুতের তারে শুয়ে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, দাবি স্বজনদের

সিঙ্গাপুর যাত্রার আগে হাদির শারীরিক অবস্থা নিয়ে যা জানাল মেডিকেল বোর্ড

তাইওয়ানে যুদ্ধে জড়ালে চীনের কাছে হারতে পারে যুক্তরাষ্ট্র— পেন্টাগনের গোপন নথি ফাঁস

ফলের দোকানদার ও বেকার ছেলে: অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে হামলাকারী সম্পর্কে যা জানা গেল

হাদিকে নিয়ে সিঙ্গাপুরের পথে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত