Ajker Patrika

গর্বভাষা নিয়ে হীনম্মন্যতায় আমরা কি গর্বিত

জাহাঙ্গীর আলম
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের মহান শহীদ দিবস, একই সঙ্গে এবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ২৫ তম বার্ষিকী উদ্‌যাপিত হচ্ছে। ১৯৫২ সালের এই দিন মাতৃভাষার মর্যাদার রক্ষার জন্য রক্ত দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষ। এই আত্মত্যাগের বৈশ্বিক স্বীকৃতি হিসেবে এই দিনটি এখন ভাষাগত বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং মাতৃভাষাকে উন্নীত করার জন্য প্রতি বছর উদ্‌যাপন করা হয়।

কিন্তু শিগগিরই মাতৃভাষার ধারণা গিয়ে ঠেকেছে তথাকথিত শুদ্ধ ও প্রমিত বাংলায়। শিক্ষিত বাবা–মায়েরা শৈশব থেকেই সন্তানদের ভাষাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য মুখ থেকে যেকোনো প্রকারের গ্রাম্যতা দূর করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। করুণ বাস্তবতা হচ্ছে, ছোটকালে এই প্রমিতকরণের পাল্লায় পড়ে আমাদের ঠোঁটের প্রতিটি শব্দই অস্বাভাবিক মনে হয়। স্কুলের পরীক্ষার খাতায় লিখিত প্রাতিষ্ঠানিক বাংলা, জাতে ওঠার জন্য শেখা ইংরেজি, দাদা–দাদি নানা–নানির ‘উপভাষায়’ বলা স্থানীয় শব্দ ঠোঁটে ঝুলে থাকে, গলার অর্ধেক পথে আটকে যায় কিন্তু মুখে প্রকাশ পায় না। গ্রামে বেড়ে ওঠা প্রতিটি শিশুরই এমন অভিজ্ঞতা হয়।

আমাদের শহরগুলোতে এখন ‘স্পোকেন ইংলিশ’ বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই বাণিজ্যের রমরমা। আমাদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে বাংলায় কথা বলাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। এমনকি বাবা–মায়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া সন্তানের সঙ্গে ঘরেও ইংরেজিতে কথা বলেন। বাংলা বলার ক্ষেত্রে অনেকে কড়া নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকেন।

এভাবে, আমরা সর্বশক্তিমান প্রমিত ও ইংরেজির কাছে নতজানু হয়ে পড়ছি। ব্যাকরণের নিয়ম আত্মস্থ করে ভদ্রস্থ বাংলা এবং বাজার অর্থনীতির যুগে জাতের ওঠার উচ্চাভিলাষের ফাঁদে বাংলাকে উপেক্ষা করছি। আমাদের শ্রম, সময় ও অর্থ বিনিয়োগ করছি তথাকথিত কেজো ভাষা শিক্ষায়!

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলার যে বেহাল দশা তার একটি চিত্র এখানে স্পষ্ট। ২০২৪ সালের মার্চে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএসের) একটি সমীক্ষা প্রকাশ পায়। তাতে দেখা যায়, তৃতীয় শ্রেণির ৭৬ শতাংশ ও চতুর্থ শ্রেণির প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঠিকমতো বাংলা পড়তে পারে না। তৃতীয় শ্রেণির প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী বর্ণ (অক্ষর) ও শব্দ ঠিকঠাক চিনতে পারে না। চতুর্থ শ্রেণির ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী সাধারণ শব্দ চিনতে পারে না। আর পড়ার (রিডিং) ক্ষেত্রেও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর ঘাম ছুটে যায়!

১৮৩৫ সালে লর্ড ম্যাকলে তাঁর শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাবে একটি শ্রেণি তৈরি করার যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন যারা দোভাষী হতে পারে...যারা রক্তে এবং বর্ণে ভারতীয় কিন্তু রুচি, মতামত, নৈতিকতা এবং বুদ্ধিতে হবে ইংরেজ। আমরা আমাদের মুখের ভাষা, সংস্কৃতি ও স্থানীয় জ্ঞানকে পশ্চিমা বিশ্বের শ্রম ও ভোক্তা বাজারে পরিণত করার জন্য বিনিময় করেছি। আমাদের স্থানীয় ভাষাগুলো নিকৃষ্ট, অলিখিত (যদি কথ্য হয়) এবং যেকোনো গুরুতর জ্ঞান সৃষ্টি বা প্রচার প্রক্রিয়ার অংশ হওয়ার জন্য অক্ষম থেকে গেছে। আধুনিককালে ইংরেজির দাপটে আমরা দিশেহারা হয়ে তাকেই আলিঙ্গন করেছি।

বাংলাদেশের শিক্ষার উন্নয়ন ও নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রথম এ দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। এই শিক্ষানীতি ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন কৌশল ও পরিকল্পনাপত্রে এ বিষয়টির উল্লেখ বেশ আগে থেকেই লক্ষ করা গেছে। কিন্তু এখনো সব ভাষায় শিশুদের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন সম্ভব হয়নি। আর আঞ্চলিক ভাষা তো বরাবরই উপেক্ষিত। এমনকি জনপরিসরে আঞ্চলিক ভাষায় ভাব বিনিময়ও রীতিমতো লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলত শহুরে ও গ্রামীণ স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এবং আঞ্চলিক ও নৃগোষ্ঠীর ভাষা এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অবিচল বিভেদ তৈরি হয়ে রয়েছে।

এ ছাড়া সরকারি শিক্ষানীতির বাইরে রয়ে গেছে দেশের ইন্টারন্যাশনাল ব্যাকালোরিয়েট (আইবি) এবং কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল জেনারেল সার্টিফিকেট অব সেকেন্ডারি এডুকেশন (আইজিসিএসই)–এর সঙ্গে যুক্ত স্কুলগুলো। আবার এমন স্কুল রয়েছে যেগুলোর আসলে এ ধরনের কোনো আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেই। এই স্কুলগুলো স্থানীয় ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা দমিয়ে রাখে।

ইদানীং শিক্ষার্থীদের একটি নতুন প্রজন্ম দেখা যাচ্ছে। এরা সংকর ভাষায় কথা বলে। কিন্তু তাদের ডিএনএ–তে সে অর্থে বাংলা ভাষা নেই। এমনকি হিন্দিতে বোল ফুটছে ভালোই, কিন্তু বাংলা বলতে গিয়ে আটক যাচ্ছে। এমন অনেক শিশু আছে যারা ইংরেজিতে কথা বলে, বাংলায় একটি শব্দও বোঝে না।

বাবা–মায়েরা নিজেদের ভাষা হীনমন্যতায় গর্বিত! ‘আমার বাচ্চা ইংরেজিতে কথা বলতে পারে’, এই গর্ব ক্রমে ‘আমার বাচ্চা তো বাংলা বলতেই না’ এই এ পর্যায়ে পর্যবসিত হয়। অভিভাবকদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা হচ্ছে, বাংলা আর শ্রম বা মর্যাদার বাজারে বিপণনযোগ্য নয়, সুতরাং এ ভাষা সন্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে শেখানোর প্রয়োজন নেই, কাজ চালানোর মতো হলেই হবে!

এই প্রবণতা নাগরিকদের একটি নতুন শ্রেণির জন্মকে চিহ্নিত করছে। তারা সে অর্থে ম্যাকলের দোভাষী শ্রেণি নয়; বরং, নিজস্ব পরিচয় স্পষ্ট করতে তাদের আরও আরও সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করতে হবে। তাদের কথিত বৈশ্বিকতা তাদের স্থানীয় সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। শিকড়ের সঙ্গে সংযুক্তির বিচ্ছেদের দিকে ঝোঁক তৈরি করছে।

আন্তর্জাতিক বোর্ডের (ইংরেজি মাধ্যম) শহুরে শিশুরা জাতীয় শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পড়াশোনা করা গ্রামীণ শিশুদের কিছুই বুঝবে না—এই দুই শ্রেণির মধ্যে কোনো সংযোগকারী কোনো ভাষা নেই। দেশীয় ভাষায় সাহিত্য এবং জ্ঞান নিয়ে আলোচনা তো আরও দূরের কথা। প্রমিত বাংলা ও ইংরেজির দাপটে আঞ্চলিক ভাষার বাগধারাগুলো আমাদের দৈনন্দিন ভাষা থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, এতে বাংলার মধ্যে ইংরেজি শব্দ প্রক্ষিপ্ত হওয়ার পথ তৈরি হচ্ছে।

অবশ্য এর জন্য শুধু গ্লোবালাইজেশন, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ আর বাজার অর্থনীতির পাশাপাশি অভিভাবকদের হীনম্মন্যতাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। মূলত বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার বাজারে এগিয়ে থাকতেই অভিভাবকদের ক্রমেই ইংরেজিপ্রীতি ও বাংলার প্রতি অবহেলা বাড়ছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলার ব্যাপক ব্যবহার ও উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তি পর্যায়েও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। ইন্টারনেটের এই যুগে শিশুরা ফিডার ধরতে শেখার আগে মোবাইল হাতে পায়। ইন্টারনেটে শিশুদের উপযোগী বাংলায় ভালো কোনো কনটেন্ট নেই, যেগুলো তারা আনন্দের সঙ্গে দেখবে। ফলে কথা বলতে শেখার আগেই হাতের মুঠোয় পাচ্ছে হিন্দি অথবা ইংরেজি কনটেন্ট। বাংলা শেখার আগেই শিশু ইংরেজিতে গড়গড় করে কথা বলা শিখছে, সেটি অভিভাবকদের জন্য আনন্দের বিষয়ই তো বটে!

বাংলাদেশের উদ্যোগে ১৯৯৯ সালে ইউনেসকোর সাধারণ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায় ২১ ফেব্রুয়ারি। ২০০২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এটিকে স্বাগত জানানো হয়।

ভাষাগত বৈচিত্র্যের মর্যাদা রক্ষা ও সংরক্ষণ এবং শিশুদের মাতৃভাষায় শেখার অধিকারকে সমর্থন করার জন্য এই দিবসটি গৃহীত হয়। যাতে শিশুরা আরও ভালো বোঝাপড়া, সম্পৃক্ততা এবং চিন্তার দক্ষতা অর্জন করতে পারে—এটিই ছিল উদ্দেশ্য। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার দ্বারা প্রভাবিত হয়নি এমন স্থানে টিকে থাকা ভাষাগুলো কত স্তরের দমন সহ্য করছে, সেটিরও একটি অনুস্মারক এটি। আধুনিক শিক্ষা ধারণায় মায়েদের এবং মাতৃভাষাগুলোকে সন্তানদের যথাযথভাবে শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে অক্ষম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এভাবেই তাদের প্রান্তিক করে রাখা হয়।

লেখক: আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জুলাই অভ্যুত্থানে চানখাঁরপুলে হত্যাকাণ্ডের রায় ২০ জানুয়ারি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২: ০১
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুলে ৬ জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আগামী ২০ জানুয়ারি রায় দেবেন ট্রাইব্যুনাল। উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বুধবার রায়ের জন্য এই দিন ধার্য করেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

এই মামলায় আট আসামির বিরুদ্ধে গত ১৪ জুলাই অভিযোগ গঠন করা হয়। আট আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার থাকা শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন, সাবেক কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। আর পলাতক রয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আক্তারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল।

যাত্রাবাড়ীতে তাইম হত্যায় ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশ কর্মকর্তার ছেলে ইমাম হাসান তাইম হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ১১ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ এই অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। যাতে ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারদের হাজিরের জন্য আগামী ৫ জানুয়ারি দিন ধার্য করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পলাতকদের গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন যাত্রাবাড়ী থানার তৎকালীন ওসি আবুল হাসান ও তৎকালীন ওসি (তদন্ত) জাকির হোসাইন। আর পলাতক রয়েছেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, ওয়ারী জোনের সাবেক ডিসি ইকবাল হোসাইন ও এডিসি এস এম শামীম, ডেমরা জোনের তৎকালীন এডিসি মো. মাসুদুর রহমান মনির, তৎকালীন সহকারী পুলিশ কমিশনার নাহিদ ফেরদৌস, যাত্রাবাড়ী থানার তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) ওহিদুল হক মামুন, এসআই (নিরস্ত্র) সাজ্জাদ উজ জামান ও মো. শাহদৎ আলী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বড়দিন উপলক্ষে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার শুভেচ্ছা বিনিময়

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০: ৫১
আজ বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রেস উইং
আজ বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রেস উইং

বড়দিন উপলক্ষে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। আজ বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন তিনি।

ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, বাংলাদেশের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মগুরু আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজ, ন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান ফেলোশিপ অব বাংলাদেশের সভাপতি বিশপ ফিলিপ পি অধিকারী, খ্রিষ্টধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি ড. বেনেডিক্ট আলো ডি রোজারিও, জাতীয় চার্চ পরিষদ বাংলাদেশের সভাপতি খ্রিস্টোফার অধিকারীসহ দেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

এ সময় খ্রিষ্টধর্মের নেতারা তাঁদের শুভেচ্ছা বক্তব্যে বিশ্বজুড়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুনাম এবং দেশের অর্থনীতি ও সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নে তাঁর ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে আগামী নির্বাচনও সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে আয়োজিত হবে বলে তাঁরা আশা প্রকাশ করেন।

আজ বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রেস উইং
আজ বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রেস উইং

আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজ তাঁর শুভেচ্ছা বক্তব্যে যিশুখ্রিষ্টকে সর্বজনীন উল্লেখ করে বলেন, যিশুখ্রিষ্টের ক্ষমা ও মানবসেবার মহান আদর্শ সামনে রেখে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষও এ বছর উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে বড়দিন উদ্‌যাপন করছে।

প্রধান উপদেষ্টাকে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজ বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে জনগণ আপনার ওপর আস্থা রেখেছিল। আপনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। আমরা প্রার্থনা করি, একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আপনার প্রচেষ্টা সফল হবে।’

প্রধান উপদেষ্টা উপস্থিত নেতৃবৃন্দসহ সবাইকে বড়দিন ও আসন্ন নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘আপনারাই সমাজের প্রতিবিম্ব। আপনাদের দেখলে বুঝতে পারি, সবকিছু ঠিক আছে কি না।’

আজ বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রেস উইং
আজ বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রেস উইং

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে চাই। সে জন্যই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে জুলাই সনদ প্রস্তুত করা হয়েছে। এই সনদের ওপর গণভোটের মাধ্যমে দেশ আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে।

তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণভোটও অনুষ্ঠিত হবে। গণভোটে জনগণ যে রায় দেবে, পরবর্তী সময়ে সংসদ সেভাবেই সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করবে।

প্রধান উপদেষ্টা এ সময় আসন্ন নির্বাচন ও গণভোটের বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তুলতে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

বড়দিন উপলক্ষে খ্রিষ্টধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে আড়াই কোটি টাকা অনুদান দেওয়ার জন্য অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান ট্রাস্টের নেতৃবৃন্দ। দেশব্যাপী ৮০০টি চার্চের মধ্যে তিন ধাপে এই অনুদান বিতরণ করা হচ্ছে বলে জানান তাঁরা।

পরে বড়দিন উপলক্ষে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে কেক কাটেন প্রধান উপদেষ্টা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তারেক রহমানের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে সরকার: প্রেস সচিব

বাসস, ঢাকা  
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১: ০২
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আজ বুধবার বিকেলে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আজ বুধবার বিকেলে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

আজ বুধবার বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা তাঁর বাংলাদেশে ফেরাকে স্বাগত জানাই। তাঁর জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দলের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে।’

প্রেস সচিব আরও জানান, সরকার তাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়টি বিএনপির সঙ্গে পরামর্শ করছে এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।’

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদির হত্যাকারীদের বিচারের বিষয়ে শফিকুল আলম বলেন, ‘এ বিষয়ে সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে। আমরা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পাচ্ছি এবং ঘটনার তদন্তে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাস হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে প্রেস সচিব বলেন, ‘সরকার হত্যাকাণ্ডকে নিন্দা জানিয়েছে। ভিডিও বিশ্লেষণের মাধ্যমে অন্তত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা আজ উপদেষ্টা পরিষদকে জানিয়েছেন, দীপু হত্যার বিচার দ্রুত বিচার আইনের আওতায় সম্পন্ন হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি।’

প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনার বিষয়ে শফিকুল আলম বলেন, ‘ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ঘটনায় কয়েকটি মামলা করা হয়েছে। সব দোষীকে আইনের আওতায় আনা হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইন্টারনেট সেবা কখনোই বন্ধ করা যাবে না—বিটিআরসি পাচ্ছে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক। ছবি: পিআইডি
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক। ছবি: পিআইডি

বাংলাদেশে আর কখনোই ইন্টারনেট বা টেলিযোগাযোগ সেবা বন্ধ করা যাবে না। একই সঙ্গে বিতর্কিত ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন্স মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) বিলুপ্ত করে একটি জবাবদিহিমূলক কাঠামো গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আজ বুধবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এসব বিষয় রেখে ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫’-এর চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি জানান, এর মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ খাতে রাষ্ট্রের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের ধরনে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে।

নতুন এই সংশোধনীর মাধ্যমে নাগরিক অধিকার রক্ষা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রধান পরিবর্তনগুলো হলো—কোনো পরিস্থিতিতেই রাষ্ট্র বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ ইন্টারনেট বা টেলিযোগাযোগ সেবা বন্ধ করতে পারবে না।

নজরদারির বিতর্কিত সংস্থা এনটিএমসি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এর বদলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কারিগরি সহায়তার জন্য ‘সেন্টার ফর ইনফরমেশন সাপোর্ট (সিআইএস)’ গঠন করা হয়েছে। এটি ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা অধ্যাদেশ মেনে পরিচালিত হবে।

সিম বা ডিভাইস রেজিস্ট্রেশনের তথ্য ব্যবহার করে কোনো নাগরিককে নজরদারি বা হয়রানি করা এখন থেকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কেবল জাতীয় নিরাপত্তা বা সুনির্দিষ্ট বিচারিক প্রয়োজনে কঠোর গোপনীয়তা বজায় রেখে ইন্টারসেপশন করা যাবে।

লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা বিটিআরসির কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু লাইসেন্স বাদে বাকি সব লাইসেন্স বিটিআরসি নিজেই ইস্যু করতে পারবে।

টেলিযোগাযোগ খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু নতুন কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। জবাবদিহিতা কমিটি—ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

গণশুনানি—বিটিআরসিকে প্রতি চার মাস অন্তর গণশুনানি করতে হবে এবং তার ফলোআপ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।

আধা-বিচারিক কাউন্সিল—আইনানুগ ইন্টারসেপশনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আইনমন্ত্রী, প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার এবং স্বরাষ্ট্র সচিবকে নিয়ে একটি কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। বেআইনি নজরদারির বিরুদ্ধে এখানে অভিযোগ করা যাবে।

সংশোধিত আইনে পূর্বের উচ্চ জরিমানা ও রিকারিং (পুনঃপুন) জরিমানার হার কমানো হয়েছে, যা এই খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করবে। এছাড়া, ‘স্পিচ অফেন্স’ বা কথা বলার অপরাধ সংক্রান্ত নিবর্তনমূলক ধারাগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে কেবল সহিংসতার আহ্বানকেই অপরাধ হিসেবে রাখা হয়েছে।

উল্লেখ্য, এই অধ্যাদেশটি গত ২০ নভেম্বর নীতিগত অনুমোদন পেয়েছিল। অর্থ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাই শেষে আজ এটি চূড়ান্ত অনুমোদন পেল। সরকার জানিয়েছে, এই পুরো ব্যবস্থাপনা জাতিসংঘ এবং আইটিইউ-এর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী পরিচালিত হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত