Ajker Patrika

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর হাতে কী কী ক্ষমতা, কমতে পারে যেখানে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২৫, ১৫: ৩৩
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর হাতে কী কী ক্ষমতা, কমতে পারে যেখানে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে ঐকমত্য ও ভিন্নমত তৈরি হয়েছে, তা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রব্যবস্থার গতিপথ নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। মূল প্রস্তাব ছিল প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানো। কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো। কিন্তু যে পরিমাণ ঐকমত্য হয়েছে, তাতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কতটা কমবে এবং সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দেশের শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর হাতেই নির্বাহী ক্ষমতার প্রায় সবটুকু কেন্দ্রীভূত থাকে। সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করলে এই একচ্ছত্র ক্ষমতার চিত্রটি স্পষ্ট হয়।

সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা

বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম অধ্যায়ে সরকারের নির্বাহী বিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে। এখানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও দায়িত্বের মূল ভিত্তিগুলো আলোচনা করা হলো:

নির্বাহী ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু (অনুচ্ছেদ ৫৮): সংবিধান অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের সব নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত। রাষ্ট্রপতি এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। এর ফলে, যদিও রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান, কিন্তু কার্যত তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া কোনো কাজ করতে পারেন না। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে চলতে হয়।

মন্ত্রিসভার প্রধান (অনুচ্ছেদ ৫৮(২)): প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার প্রধান। তিনি মন্ত্রীদের নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেন। মূলত, প্রধানমন্ত্রী যাকে চান, তিনিই মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। মন্ত্রিসভার সব বৈঠক ও সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে নেওয়া হয়।

আইন প্রণয়নে প্রভাব (অনুচ্ছেদ ৬৫): প্রধানমন্ত্রী যেহেতু সংসদ নেতা এবং তাঁর দল সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, তাই সংসদীয় আইন প্রণয়নে তাঁর প্রভাব অপরিসীম। সরকারি বিলগুলো প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই উত্থাপিত ও পাস হয়।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ (অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)): অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান এবং সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদগুলোতে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন, কিন্তু এই নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক। ফলে, এসব পদে কারা আসবেন, তা কার্যত প্রধানমন্ত্রীই নির্ধারণ করেন।

প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব (অনুচ্ছেদ ৬১): বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেন রাষ্ট্রপতি। তবে, সংবিধান অনুযায়ী, এই ক্ষমতা আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বাস্তবে, প্রধানমন্ত্রীই প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর চূড়ান্ত কর্তৃত্ব বজায় রাখেন।

সংবিধান সংশোধনে ভূমিকা: সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতাসীন দলের প্রধান, তাই তার নেতৃত্বেই সংবিধান সংশোধন সম্ভব হয়।

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে এত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। এর ফলে সংসদ, বিচার বিভাগ এবং অন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই ভারসাম্যহীনতার কারণে প্রায়ই সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তই রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়।

এই একচ্ছত্র ক্ষমতা থেকে বেরিয়ে এসে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে সংবিধান সংস্কারের দাবি উঠেছে। তবে সংবিধানে এখন পর্যন্ত যে বিধানগুলো আছে, তাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের সরকারপ্রধানদের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতা উপভোগ করেন।

প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতার লাগাম টানার চেষ্টা: যতটুকু ঐকমত্য

ঐকমত্য কমিশন এবং বিভিন্ন দলের মধ্যে আলোচনার পর কিছু বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকার মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেওয়া। সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, একজন ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে বা মোট দশ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন। এটি ভবিষ্যতে কোনো একক ব্যক্তির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রবণতা রোধে সহায়ক হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

এ ছাড়া, নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের ক্ষেত্রে একটি নতুন পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারি দল, বিরোধী দল এবং বিচার বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি বাছাই কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং অন্য কমিশনারদের নাম সুপারিশ করবে। তবে এই বাছাই কমিটি সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে পরবর্তী প্রক্রিয়া কী হবে তা নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব হলো, এরপর দুজন বিচারপতি এই বাছাই কমিটিতে যুক্ত হবেন। এরপর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ভিত্তিতে বাছাই চূড়ান্ত করা হবে। তাঁরাও সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে র‍্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং পদ্ধতি অনুসরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিএনপি এর বিরোধিতা করে এই পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে।

রাষ্ট্রপতির হাতে সরাসরি কিছু সাংবিধানিক পদে নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল এবং আইন কমিশন অন্তর্ভুক্ত। জরুরি অবস্থা জারির ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তের বদলে মন্ত্রিসভার অনুমোদন বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো আপাতদৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সামান্য হলেও হ্রাস করবে।

ভিন্নমতের দেয়াল: যেসব প্রস্তাব আটকে আছে

তবে, মূল প্রস্তাবগুলোর অনেকগুলোতেই বিএনপিসহ কয়েকটি দলের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত রয়েছে, যা সংস্কারের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমাতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব করেছিল, যা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগের দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু বিএনপি এবং অন্যান্য দলের আপত্তির কারণে সেই প্রস্তাব বাদ দিয়ে কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়, যেখানেও তাদের আপত্তি ছিল। বিএনপি মনে করে, এ ধরনের কমিটি নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা দুর্বল করে দেবে।

সবচেয়ে বড় ভিন্নমত দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রীর একই সঙ্গে একাধিক পদে থাকা সংক্রান্ত প্রস্তাবে। যেখানে বলা হয়েছিল, কোনো ব্যক্তি একই সময়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না, সেখানেও বিএনপিসহ কয়েকটি দল আপত্তি জানিয়েছে। বিএনপি মতে, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানমন্ত্রী মনোনয়নের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা থাকতে হবে, এর সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কোনো বিরোধ তাঁরা দেখছেন না। এই ভিন্নমতের কারণে, দলটি ক্ষমতায় এলে এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ ছাড়া, সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির মাধ্যমে সদস্য নির্বাচনের প্রস্তাবেও বিএনপির ভিন্নমত রয়েছে। তারা নিম্নকক্ষের প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের পক্ষে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির মতো দলগুলো সংসদ নির্বাচনে মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে (পিআর) উচ্চকক্ষে তাদের প্রতিনিধি পাঠাতে চায়।

আবার সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন বা বাতিলেও আশানুরূপ সিদ্ধান্ত আসেনি। ‘ব্যক্তিগত স্বার্থে’ সংসদ সদস্যরা বিক্রি হয়ে যেতে পারেন, যেটিকে বলে ফ্লোর ক্রসিং—এই আশঙ্কা এবং ‘গণতন্ত্রের সঙ্গে স্থিতিশীল সরকার দরকার’—এমন অজুহাতে এই অনুচ্ছেদ বহাল রাখা পক্ষে অনেকে।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, একজন সংসদ সদস্য যদি সংসদে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেন, নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেন অথবা দল থেকে পদত্যাগ করেন, তাহলে তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে।

এর মাধ্যমে দলের ভোটে জিতে আসা একটি রাজনৈতিক দলকে কার্যত আনচ্যালেঞ্জড থাকার গ্যারান্টি দেওয়া হয়। অবশ্য আস্থা ভোট ও অর্থ বিল বাদে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন— এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এটি বিএনপিরই প্রস্তাব ছিল।

সংবিধানের ৮১ অনুচ্ছেদের আলোচ্য বিষয় অর্থবিল। সরকার যদি উন্নয়নের জন্য কোনো ঋণ গ্রহণ করে এবং এই সম্পর্কিত কোনো বিল সংসদে উত্থাপন করে তাহলে সেই বিলকে অর্থবিল বলে। বাজেটের মধ্যে যে ঋণ থাকে সেটি অর্থবিল। বাজেট নিজেও অর্থবিল। শুল্ক ও কর এবং সাংবিধানিক পদধারীদের বেতন সম্পর্কিত বিলগুলোকেও অর্থবিল বলা হয়।

সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির প্রধান ভূমিকা

বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রধান। সংসদীয় গণতন্ত্রে তিনি প্রতীকী প্রধান হিসেবে কাজ করেন, অর্থাৎ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদটি তাঁর হলেও বেশির ভাগ নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত থাকে। সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও ভূমিকা স্পষ্ট করে।

সংবিধানে নির্দিষ্ট ক্ষমতা

রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রধান (অনুচ্ছেদ ৪৮): রাষ্ট্রপতি হলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে তাঁর স্থান। তিনি সংবিধান ও আইন অনুযায়ী তাঁকে দেওয়া সব ক্ষমতা প্রয়োগ করেন এবং দায়িত্ব পালন করেন।

সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক (অনুচ্ছেদ ৬১): রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। যদিও তাঁর এই ক্ষমতা আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বাস্তবে এটি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকে।

ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা (অনুচ্ছেদ ৪৯): এটি রাষ্ট্রপতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা। তিনি যেকোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের দেওয়া দণ্ডাদেশের মার্জনা, স্থগিত, হ্রাস বা মওকুফ করতে পারেন।

যেসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত

বাংলাদেশের সংবিধান সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা অনুসরণ করে। এ কারণে রাষ্ট্রপতিকে তাঁর বেশির ভাগ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে চলতে হয়। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র দুটি ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন:

১. প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ: সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির আছে।

২. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ: প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতি এককভাবে সিদ্ধান্ত নেন।

এ ছাড়া অন্য সব নির্বাহী ও প্রশাসনিক কাজের জন্য রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হয়। অর্থাৎ, মন্ত্রিপরিষদ, নির্বাচন কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেলসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার সময়ও রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করেন।

সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির পদটি প্রধানত আনুষ্ঠানিক এবং প্রতীকী। এর বিপরীতে, প্রধানমন্ত্রীর পদটি নির্বাহী ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি: কতটা কার্যকরী?

ক্ষমতার ভারসাম্যের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতিকে অধিক ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। ১২টি গুরুত্বপূর্ণ পদে রাষ্ট্রপতিকে সরাসরি নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এর মধ্যে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান, ডিজিএফআই এবং এনএসআই প্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাব থেকে সরে এসে মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল ও আইন কমিশনের মতো কয়েকটি পদে নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কিছুটা বাড়লেও, প্রধানমন্ত্রীর সামগ্রিক ক্ষমতা কাঠামোতে তা বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

সংস্কারের ভবিষ্যৎ

যতটুকু ঐকমত্য হয়েছে, তা দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভারসাম্য কতটা ফিরবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এই সামান্য পরিবর্তনগুলো হয়তো একটি প্রতীকী পদক্ষেপ, যা ভবিষ্যতে আরও বড় সংস্কারের পথ তৈরি করতে পারে। কিন্তু মূল লক্ষ্য ছিল প্রধানমন্ত্রীর এককেন্দ্রিক ক্ষমতা ভেঙে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা, যা এখনো পুরোপুরি অর্জিত হয়নি।

গণতন্ত্রকে টেকসই করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আরও বড় পরিসরে বোঝাপড়া প্রয়োজন। কারণ, ঐকমত্য না থাকলে, শুধু কাগজে-কলমে থাকা সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর করা সম্ভব নয়। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি, জুলাই সনদে যে যে বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকছে সেগুলো আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে বিশ্লেষকেরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন। এখন দেখার বিষয়, আগামীতে এই সংস্কার প্রস্তাবগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হয় এবং তা দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কতটা পরিবর্তন আনতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শেখ হাসিনাকে ফেরতের ব্যাপারে এখনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি ভারত: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

রংপুর প্রতিনিধি
আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪: ০৯
রংপুরে সার্কিট হাউসে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। ছবি: আজকের পত্রিকা
রংপুরে সার্কিট হাউসে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। ছবি: আজকের পত্রিকা

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ‘শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে ভারত এখনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, আমরাও তাদের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় আছি।’

আজ শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) সকালে রংপুর সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। রংপুর অঞ্চলে চার দিনের সফরে এসেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা তো চেয়েছি যে তাঁকে (শেখ হাসিনাকে) ফেরত পাঠানো হোক। যেহেতু উনি একজন কনভিক্টেড, যেহেতু সর্বোচ্চ বিচারিক সংস্থা তাঁকে একটি শাস্তি দিয়েছে। কিন্তু আমরা ইতিবাচক কোনো সাড়া এখন পর্যন্ত পাইনি। এটা নিয়ে আমার মনে হয় স্পেকুলেট না করাই ভালো। দেখা যাক কী হয়। আমরা তো চেয়েছি খুব, এ ধরনের ঘটনায় তো ঝট করে এক দিনে, সাত দিনে কোনো পরিবর্তন ঘটে না। আমরা অপেক্ষা করব, দেখি, ভারতের পক্ষ থেকে কী আসছে রিঅ্যাকশন।’

তৌহিদ হোসেন বলেন, একটা রিঅ্যাকশন আমরা দেখেছি যেটা, সেটা হলো তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে, এ রকম একটা কথা আসছে আমাদের। দেখুক তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ে পররাষ্ট্র দপ্তরে কোনো তথ্য নেই বলে উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, ‘তারেক সাহেব কখন আসবেন, এই সম্বন্ধে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। উনার স্ত্রী সম্ভবত আসছেন বা পৌঁছে গেছেন হয়তো ইতিমধ্যে। আজকে সকালে পৌঁছার কথা ছিল। বেগম জিয়াকে আজকে নেওয়া হচ্ছে না, আমি ঢাকা থেকে আজকে সকালে জানলাম যে আজকে নেওয়া হচ্ছে না। একটু টেকনিক্যাল প্রবলেম দেখা দিয়েছে ওই এয়ারক্র্যাফট নিয়ে। সে ক্ষেত্রে হয়তো এক-আধ দিন দেরি হতে পারে।’

আরাকান আর্মি বাংলাদেশিদের ধরে নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আরাকান আর্মির সাথে আমাদের দ্বিপক্ষীয় আলোচনা সম্ভব নয়। তারা একটা নন-স্টেট অ্যাক্টর। আমরা স্টেট হিসেবে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা যেমন মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ, থাইল্যান্ড বা ভারতের সাথে করতে পারি, সেটা তাদের সাথে করতে পারি না। তবে আমাদের স্বার্থ যেহেতু আছে, আমাদের দেখতে হবে। এই ঘটনা যাতে কমে বা আদৌ না ঘটে, এটার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’

এ ছাড়াও নীলফামারীতে প্রস্তাবিত চীনা হাসপাতালের কার্যক্রম অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত শুরু করে যেতে চায় বলেও জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। একই সঙ্গে নির্বাচিত সরকার এলে এই কাজ সমাপ্ত করবে বলেও আশা তার। এ সময় পিছিয়ে পড়া রংপুরের প্রত্নতাত্ত্বিকসহ সব ক্ষেত্রে নেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সরকারের সদিচ্ছার কথা জানান তৌহিদ হোসেন।

এরপর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সপরিবার রংপুর জমিদার বাড়ি তাজহাটে পরিদর্শনে যান। এ ছাড়াও বিকেলে রংপুর সার্কিট হাউসে চা-চক্রের কথা রয়েছে তৌহিদ হোসেনের। আগামীকাল রংপুরের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জিলা স্কুল পরিদর্শন করার কথাও রয়েছে তাঁর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মধ্যরাতে প্রাথমিকের শিক্ষকদের কর্মবিরতি স্থগিত, রোববার থেকে বার্ষিক পরীক্ষা

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করে শুরু হওয়া সহকারী শিক্ষকদের কর্মবিরতি স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষকেরা রোববার (৭ ডিসেম্বর) থেকে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর আন্দোলনরত শিক্ষক সংগঠনগুলোর দু’টি মোর্চা ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ’ ও ‘প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের’ নেতারা এক যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন।

কর্মবিরতি স্থগিত ঘোষণার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমাদের নৈতিকতা, মানবিকতা এবং সন্তানতুল্য কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে’ রোববার (৭ ডিসেম্বর) থেকে পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত সারা দেশের সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কমপ্লিট শাটডাউন বা তালাবদ্ধ কর্মসূচি স্থগিত করা হলো। রোববার থেকে সব শ্রেণির তৃতীয় প্রান্তিক মূল্যায়ন (বার্ষিক পরীক্ষা) চলবে।

এদিকে আন্দোলনরত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও শিক্ষক নেতাদের ‘হয়রানিমূলক’ বদলি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

প্রাথমিকের শিক্ষক নেতাদের দাবি, বৃহস্পতিবার তিনজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ ৪৪ জন সহকারী শিক্ষককে নিজ জেলার বাইরে অন্য জেলায় বদলি করা হয়েছে। এসব বদলিকে তাঁরা ‘হয়রানিমূলক বদলি’ বলে মন্তব্য করেছেন।

শিক্ষক নেতারা দাবি করেছেন, ‘রেওয়াজ না থাকলেও নিজ জেলার বাইরে হয়রানি করতে প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে বদলি করা হয়েছে।’

যদিও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা ও অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে এসব বদলির আদেশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে প্রাথমিক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামছুদ্দিন মাসুদ জানিয়েছেন, তাঁকে নোয়াখালী সদর উপজেলার কৃপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ চরলক্ষ্মী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।

দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আরেক আহ্বায়ক খায়রুন নাহার লিপি জানিয়েছেন, তিনিসহ বিভিন্ন জেলায় কর্মরত অন্তত ৪৪ জন সহকারী শিক্ষককে অন্য জেলায় প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে বদলি করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

তিনি বলেন, আন্দোলনরত শিক্ষকদের প্রথমে শোকজ ও পরে বদলি করা হলো। এটি হয়রানিমূলক বদলি, আমাদের শাস্তি দিয়েছে কারণ আমরা শিক্ষকদের ন্যায্য দাবির পক্ষে লড়াই করেছি। কিন্তু অনেক শিক্ষক যাঁরা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন না তবুও তাঁরা বদলি হয়েছেন।

‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের’ অনুসারীরা সরকারের দেওয়া আশ্বাস বাস্তবায়নের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার থেকে কর্মবিরতি পালন করেছেন। সোমবার থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বেশ কিছু স্কুলে আন্দোলনরত শিক্ষকেরা তা বর্জন করে কর্মবিরতি চালিয়ে যান।

কয়েক দিন আগে দশম গ্রেডে বেতনসহ তিন দাবিতে তাঁরা আন্দোলন করছিলেন। পরে ১১ তম গ্রেডে বেতনের আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করেন।

গত ৮ নভেম্বর শহীদ মিনারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষকেরা। ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের’ ব্যানারে সেদিন বিকেলে তাঁরা ‘কলম বিরতি কর্মসূচি’ পালনে মিছিল নিয়ে শাহবাগের দিকে এগিয়ে যাওয়া চেষ্টা করলে তাঁদের আটকে দেয় পুলিশ। সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান, লাঠিপেটা, কাঁদুনে গ্যাস প্রয়োগ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ। সেসময় বেশ কয়েকজন আহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষকেরা পরদিন থেকেই কর্মবিরতি শুরু করেন।

পরে ১০ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করেন আন্দোলনরত শিক্ষকেরা, যেখানে একাদশ গ্রেডে বেতন নির্ধারণ এবং উচ্চতর গ্রেড ও পদোন্নতির জটিলতা নিরসনে সরকারে আশ্বাস দিয়েছে জানিয়ে ওই দিন রাতে তাঁরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ব্যালটের নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন এসপিরা

  • দেশের নবজন্মে ধাত্রীর ভূমিকা পালন করবেন এসপিরা: প্রধান উপদেষ্টা
  • সবাইকে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহিত করতে আইজিপির পরামর্শ।
শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা
আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১: ০৫
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ তেজগাঁওয়ে তাঁর কার্যালয়ে জেলা পুলিশ সুপারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বক্তৃতা করেন। ছবি: পিআইডি
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ তেজগাঁওয়ে তাঁর কার্যালয়ে জেলা পুলিশ সুপারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বক্তৃতা করেন। ছবি: পিআইডি

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যালটের নিরাপত্তাকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপাররা (এসপি)। তবে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মনে করেন, ঝুঁকি বিবেচনায় রেখে সব প্রার্থীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নির্বাচন আয়োজন করা গেলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব।

রাজধানীর রাজারবাগে আজ বৃহস্পতিবার সদ্য পদায়ন পাওয়া ৬৪ জেলার এসপি, কমিশনার ও রেঞ্জ ডিআইজিদের সঙ্গে এক বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। এর আগে সকালে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের সব নতুন এসপির সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনকালীন দায়িত্ব ও মাঠপর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে দিকনির্দেশনা দেন।

আইজিপির সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বক্তব্য দেওয়া এসপিদের সবার আলোচনাতেই কমবেশি ভোটকেন্দ্রে ব্যালটের নিরাপত্তার বিষয়টি উঠে আসে। আইজিপি বাহারুল আলম বৈঠকে তাঁর বক্তব্যে বলেন, আসন্ন নির্বাচনে পুলিশ শতভাগ নিরপেক্ষ থাকবে। জেলায় জেলায় এসপিরা সংসদীয় আসনের প্রার্থীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে এবং সবাইকে সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহিত করবে। আইজি এসপিদের বলেছেন, যার যার জেলা ও আসন ধরে ধরে নির্বাচনের সকল প্রার্থীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। এতে কাজটা সহজ হয়ে যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলার এসপি জানান, নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশের প্রশিক্ষণ ঠিকভাবে সম্পন্ন করার ওপর জোর দিয়েছেন আইজিপি। তিনি বলেন, প্রত্যেক সদস্যকে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রার্থীদের মধ্যে সম্ভাব্য সংঘাত বা উত্তেজনার তথ্য আগে থেকেই সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলো বিবেচনায় নিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা রেঞ্জের এক এসপি জানান, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান জোরদার করার নির্দেশও দেওয়া হয়। তাঁর মতে, এসব অস্ত্র উদ্ধার করা গেলে সহিংসতার ঝুঁকিও কমে আসবে বলে মনে করে পুলিশ সদর দপ্তর।

বৈঠকের আলোচনা নিয়ে জানতে চাইলে হবিগঞ্জের এসপি ইয়াসমিন খাতুন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের কিছু সমস্যার কথা বলা হয়েছে। ভোটার, ভোট, ভোটের কেন্দ্র নিয়ে আইজি স্যার আমাদের বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।’

এর আগে সকালে এসপিদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নতুন বাংলাদেশের সূচনা করবে।’ তিনি বলেন, ‘এই নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের জন্ম হবে। এই জন্ম দিতে আপনারা (এসপি) ধাত্রীর ভূমিকা পালন করবেন। সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাই আপনাদের দায়িত্ব।’

অতীতের বিতর্কিত নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এবার সেই ইতিহাস বদলানোর সুযোগ এসেছে। যেন দেশে-বিদেশে সবাই বলতে পারে, বাংলাদেশে এক নজিরবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, এ নির্বাচন কেবল রুটিন নির্বাচন নয়; এটি গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী নির্বাচন। যে স্বপ্ন নিয়ে মানুষ আত্মত্যাগ করেছে, সেই স্বপ্নের স্থায়ী ভিত্তি তৈরির সুযোগ এই নির্বাচন।

গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের চিঠির প্রসঙ্গ টেনে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সেই চিঠি দায়িত্ববোধের বার্তা দিয়ে গেছে। এসপিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা কর্মস্থলে যাওয়ার আগে আনাসের চিঠিটা কাছে রাখবেন। সেটাই আপনাদের দায়িত্ব মনে করিয়ে দেবে।’

পুলিশ সুপারদের পদায়নে লটারির কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এর লক্ষ্য ছিল পক্ষপাতহীনতা নিশ্চিত করা। এতে ব্যক্তিগত অসুবিধা হলেও দায়িত্ব পালনে মনোযোগ বাড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বিএনপির আপত্তি তোলা দুই অধ্যাদেশে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হয়। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হয়। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

বিএনপির পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা সত্ত্বেও পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ ও এনজিও-সংক্রান্ত অধ্যাদেশের অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

সংশোধিত পুলিশ কমিশন আইন ও এনজিও-সংক্রান্ত আইন পাস করা নিয়ে গত ২৮ নভেম্বর উদ্বেগ জানায় বিএনপি। নির্বাচনের আগে এমন পদক্ষেপ নেওয়া থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিরত থাকারও আহ্বান জানায় দলটি।

সেদিন সংবাদমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিশ্বস্ত সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, তাড়াহুড়ো করে দুটি আইন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পাস করাতে চাইছে। একটি সংশোধিত পুলিশ কমিশন আইন, অন্যটি এনজিও-সংক্রান্ত আইন। আমরা মনে করি, নির্বাচনের আগে এই আইনগুলো পাস করার পেছনে সরকারের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে; যা গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করবে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই তড়িঘড়ি করে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইন পাস করা সমীচীন হবে না। আমরা মনে করি, উপরোক্ত বিষয়ে আইনগুলো পরবর্তী জাতীয় সংসদে যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে প্রণয়ন করা সঠিক হবে। সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি, এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য।’

বিএনপির আপত্তি আমলে না নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে প্রধান করে আজ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাঁচ সদস্যের পুলিশ কমিশন গঠনের অনুমোদন দেওয়া হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের (আরপিও) দুটি ক্ষেত্রেও সংশোধনী আনা হয়।

বৈঠক শেষে এ বিষয়ে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।

উপদেষ্টা জানান, পুলিশ কমিশনে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ছাড়াও একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ, অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার নিচে নন—এমন কোনো অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, যিনি কর্মরত হতে পারেন বা অবসরপ্রাপ্তও হতে পারেন এবং মানবাধিকার ও সুশাসন বিষয়ে অন্তত ১৫ বছর অভিজ্ঞতা রয়েছে, এমন একজন ব্যক্তি থাকবেন।

পুলিশকে জনবান্ধব করতে করণীয় সম্পর্কে সরকারকে সুপারিশ করবে কমিশন। এ ছাড়া পুলিশ যাতে সংবেদনশীল হয়, সে জন্য তাদের আধুনিকায়ন কোথায় কোথায় দরকার, কী ধরনের প্রশিক্ষণ দরকার—সেগুলোও চিহ্নিত করবে কমিশন।

কমিশনের কার্যক্রমের মধ্যে থাকবে—পুলিশের বিষয়ে নাগরিকদের যেসব অভিযোগ থাকবে, সেগুলো তদন্ত ও নিষ্পত্তি করা এবং পেশাগত বিষয়ে পুলিশ সদস্যদের যদি কোনো অভিযোগ থাকে, সেগুলোর নিষ্পত্তি করা। পুলিশি কার্যক্রমে দক্ষতা ও উৎকর্ষ আনা, শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান ইত্যাদি কাজও হবে এ কমিশনের।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে রিজওয়ানা হাসান বলেন, সুপারিশ-পরামর্শ কেউ কখনো মানতে বাধ্য না। পুলিশের সঙ্গে জনগণের একটি ব্রিজ (সেতু) করে দেওয়ার জন্যই এ কমিশন। আর পুলিশের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে, আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে, মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সরকারের একটা যোগসূত্র স্থাপন করে দেওয়ার কাজ হচ্ছে এ কমিশনের।

আরপিও সংশোধন করে কোন কোন ভোট বিবেচনায় নেওয়া হবে না এবং পোস্টাল ব্যালটের ভোটগুলো গণনা পদ্ধতি সংযুক্ত করা হয়েছে।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘ব্যালটে যেখানে একটা সিল পড়ার কথা, সেখানে একাধিক সিল পড়লে গণনা করা হবে না। যদি সিল না দেয়, তাহলে গণনা করা হবে না। যখন পোস্টাল ভোট দেওয়া হয়, তখন একটা ডিক্লারেশন স্বাক্ষর করা হবে। ওই ডিক্লারেশনে যদি স্বাক্ষর না থাকে, তাহলে গণনা করা হবে না। আর আমাদের ভোটের দিন পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দেবে নির্বাচন কমিশন। সেই সময়ে যে ব্যালটগুলো এসে পৌঁছাবে রিটার্নিং অফিসারের কাছে—সেগুলো একইভাবে গণনা করা হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত