Ajker Patrika

পাহাড়ি পথে রোমাঞ্চকর জার্নি: পর্ব-৬

আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩: ৩৫
পাহাড়ি পথে রোমাঞ্চকর জার্নি: পর্ব-৬

সকালে ঘুম থেকে উঠে খানিকটা ভালো লাগছিল। পুরোপুরি না। অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথাও গিয়ে নাশতা করতে ইচ্ছা করছিল না। এদিন থেকে আমার চেয়ে ভুবনের অবস্থা খারাপ হতে লাগল। আমরা নাশতা করিনি। ভাবলাম যাত্রাপথে খেয়ে নেব। গলা দিয়ে কিছু নামার অবস্থায় নেই। আমরা প্রস্তুত হয়ে নিচে নেমে গিয়েছিলাম। কিন্তু অপেক্ষা করতে হলো অনেকক্ষণ। তখনো গাড়ির ব্যবস্থা হয়নি। অমরদা বলেছিলেন সকাল ৭টার মধ্যে রওনা দিতে পারব। কিন্তু সেখানে ৮টার ওপরে বেজে গিয়েছিল। বড় দলটাও চলে যাবে শিলিগুড়ি। এদিকে দেরি দেখে আকাশ ভাইয়ারা ক্ষেপে যাচ্ছিলেন। কেননা, তাঁদের সময়মতো পৌঁছে বাস ধরতে হবে। অমরদা এদিক-সেদিক ফোন ঘুরিয়ে অবশেষে একটা গাড়ি নিশ্চিত করলেন।

আসলে হয়েছিল কী, যে চালক আসার কথা ছিল, তিনি শেষ মুহূর্তে আর আসেননি। আমাদের অবস্থা তখন কিছুটা উন্নতির দিকে। হোটেলের লবিতে বসে থাকার চেয়ে বাইরে মল রোডের বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করাটা ভালো লাগছিল। অবশেষে একটা জিপ গাড়ি এসে উপস্থিত হলো আমাদের জন্য। হুড়োহুড়ি করে উঠে গেলাম গাড়িতে। জিপ চালু করার আগে অমরদা বিদায় নিতে এলেন। তিনি আরেকটা দলকে গাইড করার জন্য থেকে যাচ্ছিলেন। খুব করে বলে দিলেন গাড়ির চালককে পরিচয় করিয়ে, ‘ও কিন্তু আমার নিজের লোক। আমার বন্ধু। আপনারা নিশ্চিন্তে যান। কোনো অসুবিধা হবে না।’ কিন্তু চালককে দেখে খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছিল না। তিনি প্রথমেই বাদ সাধলেন আমাদের দুজনের সামনে বসা নিয়ে। তবু আমরা বসেছিলাম। কারণ পেছনে গাদাগাদি করে বসা সম্ভব নয়। তিনি যতই মুড দেখিয়ে রেগে যাচ্ছিলেন, ততই আমরা বিনয়ী হয়ে তাকে বোঝাচ্ছিলাম।

যাত্রাপথে র‍্যাংপোতে আবার থামতে হয়েছিল। আমাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছিল। কিছু নাশতাপানি খাওয়া দরকার ছিল। ভুবন নেমে দোকান থেকে ব্রিটানিয়ার কেক, পানি আর সেখানকার কোনো একটা প্যারাসিটামল কিনে আনল। বাকিরা কোথা থেকে যেন নাশতা খেয়ে এলেন। আমি একবিন্দুও নামলাম না গাড়ি থেকে। ভীষণ খারাপ লাগছিল। যখন কেউ ছিল না, তখন চালকের সে কী হম্বিতম্বি! একে তো আমাদের দুজনের একসঙ্গে সামনে বসা নিয়ে তার সমস্যা, তার ওপর কেউ কেন জলদি ফিরে আসছে না, সেটা নিয়েও সমস্যা। অথচ সবার নাশতা সারতে যতক্ষণ সময় লাগার কথা, ততক্ষণেই সবাই ফিরে এসেছিলেন। আবার চালকের অনুপস্থিতেও সবাই যার যার রাগ ঝেড়ে নিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই চালকের সঙ্গে আমাদের মতের বনিবনা হচ্ছিল না বলে এই অবস্থা। আমি আর ভুবন একটু কেক খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিলাম। ভুবন পেয়ারা ফ্লেভারের একটা পানির বোতল এনেছিল। বোতলটা সুন্দর। এখনো বাসায় রেখে দিয়েছি। পানিও খেতে ভালো। সবাই গাড়িতে উঠে পড়লে আবার যাত্রা শুরু হলো।

এবার মনে হয় আগের চেয়ে বেশি বিনয় দেখাচ্ছিলেন সবাই। শুধু চালককে ‘গরম’ থেকে ‘নরম’ করার জন্য। ভাবের চোটে তো চালক কথা তেমন বলছিলেন না, কিন্তু যখন শুরু করলেন, তখন মনে হলো লোকটা বেশ মিশুক। সেদিনের যাত্রাটা গানের বদলে রানাদার জীবনের গল্প শুনে কেটে গিয়েছিল। চালকের নাম রানা। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। এর চেয়ে কমও হতে পারে। জানা হয়নি। জিপটা তাঁর নিজের। এ রকম আরও ৮-৯টা জিপের মালিক তিনি। বাকিগুলোর জন্য চালক রেখেছেন। ভগবানের কৃপায় নাকি এখন তার যথেষ্ট উপার্জন হয়। অন্যদিকে তাঁর স্ত্রী সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মাসে ৪০ হাজার রুপি বেতন। বেশ চলে যায় সংসার খরচ। মেয়ে আছে, পড়ে ক্লাস এইটে। এই বয়সেই ধনী বন্ধুদের দেখে নাকি অনেক দামি জিনিস বায়না ধরে। কিন্তু মেয়েকে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে চান রানা দম্পতি। মেয়ের সব আবদার পূরণ করেন না। বুঝেশুনে করেন। মেয়ে থাকে হোস্টেলে। ছুটিতে বাড়িতে আসে। মেয়ের কথা থেকে চলে গেলেন তাঁর প্রেমের গল্পে। খুব মজা নিয়ে শুনছিলাম আমরা।

ফোনে পরিচয় হয় নেপালি, মানে সিকিমের মেয়ের সঙ্গে। ভুল নম্বরে কথা বলে মেয়ের কণ্ঠটা খুব ভালো লেগেছিল রানাদার। বলছিলেন, ‘পাহাড়ি মেয়ে পটানো খুব সোজা। কণ্ঠটা ভালো লেগে গেল, তাই পটিয়ে ফেললাম।’ হো হো করে হেসে উঠলাম সবাই। এরপর বললেন লোভনীয় কথা, ‘নেপালিরা মেয়ে বিয়ে দিলে বরকে সম্পত্তি উপহার দেয়। সেই লোভেও তো এই মেয়েকে বিয়ে করা চাই!’ আরও একটু হেসে নিলাম আমরা। রানাদার প্রেমের কাহিনি শুনতে শুনতে অনেকটুকু পথ পাড়ি দিয়েছিলাম। মাঝপথে কারও কারও প্রকৃতির ডাক এসেছিল। রানাদা বললেন, ‘এই একটু সামনে ভালো জায়গা আছে। যেখানে-সেখানে তো নামা যাবে না। আমি যেখানে নিয়ে যাব, সেখানে নামতে পারবেন। মেয়েছেলেরাও নামে ওখানে।’ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমিও নামতে পারবে।’ আমার নামার কোনো দরকার পড়েনি। অযথা নেমে আর কী করব। যাই হোক, রানাদার ‘আরেকটু সামনে’ এল অনেকক্ষণ সময় পর। আধা ঘণ্টার ওপরে হবে সবাইকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। অবশেষে যথাস্থানে গাড়ি থামালে ‘ভালো জায়গা’ পেলাম না। বরং উদ্যানের মতো খোলা জায়গা! সেখানে বানরের ছড়াছড়ি। মনের আনন্দে খেলছে, লাফাচ্ছে, খাচ্ছে, উকুন বেছে দিচ্ছে। সবাই নামলেন। আমি আর ভুবন বসেই রইলাম। রানাদা দেখিয়ে দিলেন, কাজ সারতে এক পাশে পাহাড়ের চিপায় জংলার মধ্যে যেতে। আমাকে বললে আমি মানা করে দিলাম। কারণ আমার দরকার নাই। কিন্তু তিনি অভয় দিচ্ছিলেন, ‘দেখো, কত মহিলা মানুষ যাচ্ছে।’ আমি বোঝালাম, ‘আমার তো প্রয়োজন নেই দাদা।’ আমি বসে বানরের কীর্তি দেখছিলাম। আমাদের খাওয়ার পর বাকি থাকা কেক সৌরভ ভাই বানরদের খেতে দিলেন। তখন আমার কিছুটা সুস্থ লাগছিল।

সবাই কাজ সেরে গাড়িতে উঠে এলে রানাদা এবার শুরু করলেন তার প্রেমিকার কাহিনি। না না, যাঁকে বিয়ে করেছেন তাঁর কথা বলছি না। বিয়ের পর পরকীয়া করছেন, সেই গল্প করলেন। ভয়ানক কাহিনি শুনে আমাদের মুখের চোয়াল নিচে ঝুলে গেল! এতক্ষণ কী আসলেই এই লোকটার কাহিনি শুনছিলাম? যিনি স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানের প্রতি এত দায়িত্বশীল আর শ্রদ্ধেয়? কান খাড়া করে রইলাম আবার জিজ্ঞেস করে। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না প্রথমে। আকাশ ভাই মশকরা করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বউদি জানে আপনার প্রেমিকার কথা?’ অবলীলায় রানাদা বলে গেলেন, ‘অবশ্যই। আমি আমার স্ত্রীকে না জানিয়ে কিছু করি না।’ আমাদের চোয়াল ঝুলতে ঝুলতে ব্যথা হয়ে যাওয়ার অবস্থা! রানাদা বলতে লাগলেন, ‘আমার স্ত্রী কিছুই মনে করে না। ও জানে আমি যখন শিলিগুড়ি যাই, এক রাত হোটেলে আমার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে কাটাই। গল্পগুজব করে আমার মন ভালো হয়ে গেলে আমি গ্যাংটকে ফিরে যাই। এমনকি আমার গার্লফ্রেন্ডের বাসায়ও জানে। ওর বর জানে যে আমার সঙ্গে সময় কাটায়। কিচ্ছু বলে না।’ আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কিছু বলার খুঁজে পাচ্ছিলাম না কেউ। আকাশ ভাই শুধু বললেন, ‘বেশ বেশ। খুব ভালো!’ মনে মনে একচোট হেসে নিলাম। কিছুক্ষণ পর রানাদাকে দেখলাম হাতের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে পিষে পিষে মুখে ভরছে। এটা কী জানতে চাইলাম। বললেন, ‘গুল। আমার আবার বাজে কোনো নেশা নাই। চা-বিড়ি কিছুই না। একটু গুল খাই। এটা ভালো।’ মনে মনে ভাবলাম, ভাইরে, নেশা তো নেশাই! ভালো আর মন্দ কী!

কথায় কথায় সময়ের আগে পৌঁছাতে পারলাম শিলিগুড়িতে। রানাদা তার একটা কার্ড দিলেন, নম্বরসহ। বললেন, ‘ইন্ডিয়ায় আবার এলে আমাকে ফোন করবেন। বললেই হবে, রানাদা, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। যেকোনো দরকারে ফোন করতে পারেন। আমার নেটওয়ার্ক ভালো। আমার নাম রানা। এখানে রানাদাকে সবাই চেনে।’ কার্ডটা সম্ভবত আকাশ ভাই রেখেছিলেন। আমরা নেমে বিদায় দিয়ে দিলাম রানাদাকে। তাঁকে ফিরতে হবে গ্যাংটকে। জরুরি কাজ আছে। ভুবনের ধারণা, রানাদার এসব গল্প পুরোটাই চাপা! হোক, তা-ও তো নতুন গল্প শুনলাম।

আকাশ ভাইয়ারা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেননি। বাস কাউন্টারে বিশ্রাম নেওয়ার সময় ছিল না। বাস চলে এসেছিল। এই বাস দিয়ে ফিরবেন চেংড়াবান্ধা সীমানায়। তারা বিদায় নিয়ে বাসে উঠে গেলেন। রইলাম বাকি আমি, ভুবন, সৌরভ ভাই আর ইমরান ভাই। বাবা বলেছিলেন, বাস কাউন্টারের পেছনে কম দামের হোটেল আছে, ভালো। আমাকে কাউন্টারে অপেক্ষা করতে বলে ভুবন ঘুরে এসে জানাল, ওই হোটেলগুলোর পরিবেশ পছন্দ হয়নি। কাউন্টারের ঠিক পাশের হোটেল সেন্ট্রাল প্লাজায় দরদাম করে একটা কক্ষে উঠে গেলাম। সৌরভ ভাইদের কাছাকাছি রুম পেলাম। তাঁদেরটা আগে থেকেই বুকিং দেওয়া ছিল শ্যামলী পরিবহনের মাধ্যমে। অমরদা ডিসকাউন্টে ঠিক করে দিয়েছিলেন। আমদের জন্যও অমরদা ডিসকাউন্টের কথা বলে দিলেন। আমাদের রুম গুছিয়ে দিতে সময় নিচ্ছিল। কিছুক্ষণ সৌরভ ভাইদের রুমে বিশ্রাম নিলাম। আমাদের রুমটা পেলে সবাই ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেতে বের হলাম। কোথায় খাওয়া যায়? খুব গরুর মাংসের বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছা করছিল। আমার একার না, সবার। তখন সুস্থ লাগছিল।

ভেবেছিলাম দুপুরের খাবারের পর মার্কেটে যাব। ব্যাটারির একটা রিকশা ভাড়া করে চালককে বললাম মুসলিম কোনো রেস্তোরাঁয় নিয়ে যেতে, যেখানে গরুর মাংস পাওয়া যায়। চালক আমাদের নামিয়ে দিলেন মুসলিম একটা রেস্তোরাঁয়। কিন্তু হায়, সেখানে গরুর মাংসের কিছুই নেই। আশপাশে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওইটাই একমাত্র মুসলিম হোটেল এদিকের। তেমন কিছু চিনি-জানি না বলে সেখানেই খেতে ঢুকলাম। নিলাম খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি, বাসমতি চালের। সৌরভ ভাই মাংস খাবেন না। তাই নিলেন ডিম বিরিয়ানি। আমি এক লোকমা মুখে দিয়েই বিস্বাদ অনুভূতি পেলাম। লবণের ছড়াছড়ি। অন্যরা কষ্ট করে খেতে পারলেও আমি আর ভুবন পারছিলাম না একদম। ভুবন তা-ও আমার চেয়ে বেশি খেতে পেরেছিল। আমি অর্ধেকের বেশি নষ্ট করলাম আর মনে মনে নিজেকে গাল দিলাম! খাবার নষ্ট করা আমার একেবারেই পছন্দ না। অবাক করে দিয়ে চেটেপুটে খেলেন সৌরভ ভাই। তারও এক কথা, ‘খাবার নষ্ট করা ঠিক না।’ ওয়েটারকে বিল দিতে বলা হলো। বিল নিয়ে এলে আমি ঠাট্টার ছলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, আপনাদের এখানে কি লবণের দাম কম? না মানে আমি নিয়ে যেতে চাই তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম আরকি।’

লোকটা খুব খুশি হয়ে জবাব দিলেন, ‘দিদি, শুধু লবণ কেন! আমাদের যেকোনো মুদি দোকানে যান। কম দামে আরও ভালো ভালো জিনিস পাবেন।’ আমি ধন্যবাদ দিয়ে মনে মনে বললাম, আহা বেচারা, আমার ঠাট্টাটাই বুঝল না! বিল চুকিয়ে আমরা বের হয়ে গেলাম সেখান থেকে। শরীর আবার অসুস্থ লাগা শুরু হয়ে গেল। রাস্তার ধারে জুসের দোকান দেখে ভাবলাম খেয়ে নিই, হয়তো জ্বরের মুখে ভালো লাগবে। সবাই মিলেই খেলাম। কেউ আনারস, কেউ মাল্টা, কেউ লেবু। তাজা ফল কেটে সামনেই বানিয়ে দেয়। ভালোই লাগল। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম আর শরীর চলবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হোটেলে ফিরে গেলাম। ভাবলাম, একটু জিরিয়ে নিলে ঠিক হয়ে যাবে হয়তো। সন্ধ্যায় বিধান মার্কেটে যাব, এরপর বাইরে কোথাও খেয়ে ফিরব। তাই দুজনেই ওষুধ খেয়ে নিলাম। কিন্তু অবস্থার অবনতি ছাড়া উন্নতি হলো না। আমার এক সহকর্মী থাকেন মুম্বাইতে, দেবারতি নাম। বাঙালি। কলকাতার মেয়ে। তাঁকে জানিয়েই আমি ভারতে গিয়েছিলাম। তিনি তাঁর বড় ভাইয়ের ফোন নম্বর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘যেকোনো সমস্যায় দাদাকে ফোন দিও।

দাদা শিলিগুড়িতেই থাকেন।’ জ্বরের ঘোরেও দাদাকে জানাতে ভুললাম না আমাদের অসুস্থতার কথা। এর আগেও ভারতে পৌঁছে দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করে রেখেছিলাম। যাই হোক, দাদা শুনে খুব দুঃখ পেলেন। জানালেন, তিনি কাজের জন্য কলকাতা গিয়েছেন। পরদিন ফিরবেন। ফিরে দেখা করবেন। এদিকে আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হচ্ছে। ভুবন তো একদম বাসি লিকলিকে বরবটির মতো নেতিয়ে পড়ছিল। আমার শরীরের তাপমাত্রা কমে গেলেও দুর্বলতা বাড়ছিল। আর ভুবনের জ্বর ১০৩ ডিগ্রিতে উঠে বসে ছিল। নামার কোনো খবরই নেই! হোটেল থেকেই থার্মোমিটার দিয়েছিল মাপতে। বিকেলে সৌরভ ভাইয়ারা মার্কেটে যাওয়ার আগে আমাদের জানিয়ে গেলেন।

আমরা পড়ে রইলাম হোটেল রুমেই, জ্বরে কাতর। টিভিতে খুব অল্প চ্যানেল দেখা যায়। তা-ও বেশির ভাগ চ্যানেলে অপরিচিত ভাষায় সব অনুষ্ঠান। ঘুরেফিরে দু-একটা হিন্দি চ্যানেল পেয়ে সেগুলোই দেখছিলাম এই ভেবে, যেন শরীর খারাপ লাগাটা ভুলে থাকতে পারি। কিন্তু ভুবনের অবস্থা দেখে দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগল। সন্ধ্যার দিকে হোটেলের এক কর্মচারীকে ডেকে জানতে চাইলাম আশপাশে কোনো হাসপাতালে নেওয়া যাবে কি না। বললেন, ‘দিদি, এখন যদি কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যান, তবে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করিয়ে দেবে। খামোখা খরচা হবে। আর এমন সময় ডাক্তারও পাবেন না সেখানে। আমি ওষুধ এনে দিচ্ছি। সেটা খাইয়ে দিন। ঠিক হয়ে যাবে।’ ভরসা করে তাঁর দেওয়া ওষুধ খাওয়লাম ভুবনকে। কিন্তু নাহ, অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। সৌরভ ভাইয়ারা ফিরে এসে দেখালেন তাঁদের কেনাকাটা। ভুবন শুধু আফসোস করছিল, ‘ইশ্‌ ভাই। রিজনেবল দামে এত জুতা এনেছেন। আমরা সুস্থ থাকলে যেতাম। শ্রীলেদার থেকে কয়েক জোড়া জুতা কেনার ইচ্ছা ছিল।’ সৌরভ ভাই তো পরিবারের সবার জন্য ৮-১০ জোড়া জুতা কিনে নিয়েছিলেন।

রাতে স্যুপ ফরমাশ করলাম। কোথাও যাওয়ার তো অবস্থা ছিল না। এত জঘন্য লাগছিল খাবার, পারছিলাম না খেতে। তবু জোর করে কিছুটা খেয়ে নিলাম। কারণ, শক্তি দরকার। ওষুধও খাওয়া দরকার। ভুবন যে নিজে উঠে খাবে, সেই অবস্থায় ছিল না। আমি জোর করে অল্প একটু খাইয়ে দিলাম ওকে। জোর করে খাইয়ে যা হয় আরকি, বমি করে ফেলে দিল সব! দুজনে ওষুধপত্র খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।

চলবে...

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বড়দিনে কেন টার্কি খাওয়া হয়, প্রচলন হয়েছিল কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১: ৫৪
ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে স্পেনীয় অভিযাত্রীদের মাধ্যমে টার্কি প্রথম ইউরোপে আসে। ছবি: সংগৃহীত
ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে স্পেনীয় অভিযাত্রীদের মাধ্যমে টার্কি প্রথম ইউরোপে আসে। ছবি: সংগৃহীত

বড়দিন বা ক্রিসমাস মানেই ডাইনিং টেবিলে সাজানো বড়সড় এক টার্কি রোস্ট। কিন্তু উত্তর আমেরিকার আদি নিবাসী এই পাখি কীভাবে ইউরোপীয়দের উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে উঠল, তা বেশ কৌতূহল উদ্দীপক। ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতে স্পেনীয় অভিযাত্রীদের মাধ্যমে টার্কি প্রথম ইউরোপে আসে। তার আগে উৎসবের ভোজ বলতে ছিল ময়ূর বা রাজহাঁসের মাংস।

ইংল্যান্ডের রাজা হেনরি অষ্টম প্রথম ব্রিটিশ সম্রাট হিসেবে বড়দিনের ভোজে টার্কি খেয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তবে টার্কিকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দেওয়ার মূল কৃতিত্ব ভিক্টোরিয়ান যুগের। রানি ভিক্টোরিয়া যখন তাঁর রাজকীয় ক্রিসমাস ভোজে টার্কি খাওয়া শুরু করেন, তখন থেকেই এটি আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।

ইংল্যান্ডের রাজা হেনরি অষ্টম প্রথম ব্রিটিশ সম্রাট হিসেবে বড়দিনের ভোজে টার্কি খেয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
ইংল্যান্ডের রাজা হেনরি অষ্টম প্রথম ব্রিটিশ সম্রাট হিসেবে বড়দিনের ভোজে টার্কি খেয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

রাজকীয় পছন্দের বাইরে সাধারণ মানুষের ঘরে টার্কিকে জনপ্রিয় করার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল লেখক চার্লস ডিকেন্সের। ১৮৪৩ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘আ ক্রিসমাস ক্যারল’-এ দেখা যায়, একসময়ের কৃপণ ইবেনেজার স্ক্রুজ বড়দিনে ক্র্যাচিট পরিবারকে একটি বিশাল টার্কি উপহার পাঠাচ্ছেন। এই গল্প সাধারণ মানুষের মনে গেঁথে দেয় যে—বড়দিনের আদর্শ খাবার মানেই টার্কি।

কেন টার্কিই সেরা পছন্দ

টার্কি জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে কিছু ব্যবহারিক কারণও রয়েছে। আকার ও উপযোগিতা—গরু দুধ দেয় আর মুরগি দেয় ডিম; কিন্তু টার্কির অন্য কোনো ব্যবহার নেই। এ ছাড়া একটি বড় টার্কি দিয়ে অনায়াসেই পুরো পরিবারের ভোজ সম্পন্ন করা যায়। অনেকগুলো ছোট পাখি রান্না করার চেয়ে একটি বড় পাখি রান্না করা অনেক বেশি সাশ্রয়ী।

হিমায়িত বা ফ্রোজেন টার্কি—রেফ্রিজারেশন বা ফ্রিজ আবিষ্কারের আগে টাটকা টার্কি কেনা ছিল বেশ ঝক্কির কাজ। কিন্তু ফ্রোজেন টার্কি বাজারে আসার পর মানুষ আগে থেকেই পরিকল্পনা করে এটি কিনতে শুরু করে, যা এর জনপ্রিয়তা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

রাজকীয় পছন্দের বাইরে সাধারণ মানুষের ঘরে টার্কিকে জনপ্রিয় করার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল লেখক চার্লস ডিকেন্সের। ছবি: সংগৃহীত
রাজকীয় পছন্দের বাইরে সাধারণ মানুষের ঘরে টার্কিকে জনপ্রিয় করার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল লেখক চার্লস ডিকেন্সের। ছবি: সংগৃহীত

পরদিনের চমৎকার নাশতা—বড়দিনের পরদিন অর্থাৎ ‘বক্সিং ডে’তে টার্কির বেঁচে যাওয়া মাংস (Leftovers) দিয়ে স্যান্ডউইচ, স্টু, কারি বা পাই তৈরি করা যায়। বিশেষ করে, টার্কি কারি এখন অনেক দেশেই বেশ জনপ্রিয়।

যুক্তরাজ্যে টার্কির একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আজও ক্রিসমাসে টার্কি খাওয়ার রীতি বজায় আছে।

যাঁরা বড় টার্কি রান্না করতে চান না বা ঝামেলা ছাড়াই উৎসবের খাবার উপভোগ করতে চান, তাঁদের জন্যও আজ নানা ধরনের প্রস্তুত টার্কি খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে—যা ক্রিসমাস উদ্‌যাপনকে আরও সহজ করে তুলেছে। বড়দিনের এই দীর্ঘ ঐতিহ্যের কারণে আজও বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ টার্কি ছাড়া উৎসবের কথা কল্পনাও করতে পারেন না। আপনিও কি এবার বড়দিনের আয়োজনে টার্কি রাখছেন?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কাজুবাদাম কেন খাবেন, কতটুকু খাবেন

ফিচার ডেস্ক
এতে আছে ম্যাগনেশিয়াম, কপার আর জিংক। ছবি: সংগৃহীত
এতে আছে ম্যাগনেশিয়াম, কপার আর জিংক। ছবি: সংগৃহীত

কাজুবাদামকে বলা হয় ‘পুষ্টির ছোট প্যাকেট’। এটি যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর। এ কারণে যে আপনি মুঠো মুঠো করে সব সময় এটি খেতেই থাকবেন, তা হবে না। নিয়মিত কাজুবাদাম পরিমিত খেতে হবে। এতে আপনি পেতে পারেন দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সুস্থতা। মূলত ব্রাজিলীয় বংশোদ্ভূত এই বৃক্ষজাত বীজ বর্তমানে বিশ্বজুড়ে তার স্বাস্থ্যগুণের জন্য সমাদৃত। হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধ থেকে শুরু করে ওজন নিয়ন্ত্রণ—কাজুবাদামের আছে বহুমুখী উপকারিতা। এটি নিয়মিত খাওয়ার পেছনে অনেকগুলো স্বাস্থ্যগত কারণ আছে। আবার খাওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে কিছু সতর্কতাও। তাই নিজের খাবারের তালিকায় কাজুবাদাম রাখার আগে ভালো ও খারাপ দিক জেনে রাখুন।

হৃদ্‌যন্ত্রের সুরক্ষা

কাজুবাদামে রয়েছে প্রচুর অসম্পৃক্ত চর্বি। এটি রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল বা এলডিএলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত বাদাম খেলে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ২৭ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। এ ছাড়া এতে থাকা ম্যাগনেশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।

ওজন নিয়ন্ত্রণ

কাজুবাদাম উচ্চ ক্যালরিযুক্ত হলেও এটি ওজন কমাতে সহায়ক হতে পারে। এর কারণ হলো, কাজুবাদামের সবটুকু ক্যালরি শরীর শোষণ করতে পারে না। এর ভেতরের আঁশ বা ফাইবার চর্বিকে আটকে ফেলে, যা হজমের সময় শরীরে পুরোপুরি শোষিত হয় না। ফলে এটি দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে এবং আজেবাজে খাওয়ার প্রবণতা কমায়।

ডায়াবেটিসের জন্য উপকারী

টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের জন্য কাজুবাদাম খুবই উপকারী। এতে থাকা আঁশ রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাওয়া রোধ করে। এ ছাড়া এর ম্যাগনেশিয়াম ইনসুলিন হরমোনের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক ক্যালরির ১০ শতাংশ কাজুবাদাম থেকে গ্রহণ করলে ইনসুলিনের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে।

শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধক্ষমতা

কাজুবাদাম কপার ও জিঙ্কের চমৎকার উৎস। এই দুটি খনিজ উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে শক্তিশালী রাখতে অপরিহার্য। এ ছাড়া এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (পলিফেনল ও ক্যারোটিনয়েড) শরীরের ভেতরের ব্যথা কমাতে এবং কোষের ক্ষতি রোধ করতে কাজ করে।

হাড় ও মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য

কাজুবাদামে আছে ভরপুর ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, ভিটামিন কে। এগুলো হাড়ের গঠনে ভূমিকা রাখে। এর কপার উপাদান মস্তিষ্কের সুস্থ বিকাশ ও শক্তি উৎপাদনে সরাসরি সাহায্য করে।

কাঁচা কাজু নিরাপদ কি না

আমরা বাজারে যে কাজুবাদাম কাঁচা হিসেবে কিনি, তা আসলে পুরোপুরি কাঁচা নয়। গাছের তাজা কাজুবাদামের খোসায় ইউরুশিয়াল নামক বিষাক্ত উপাদান থাকে, যা ত্বকে অ্যালার্জি বা ফোসকা তৈরি করতে পারে। প্রক্রিয়াজাত করার সময় তাপ দিয়ে এই বিষাক্ত অংশ দূর করা হয়। তাই গাছ থেকে সরাসরি পেড়ে কাজু খাওয়া নিরাপদ নয়।

খাদ্যাভ্যাসে যুক্ত করার সহজ উপায়

কাজুবাদাম খুব সহজে প্রতিদিনের খাবারে যোগ করা যায়। বিকেলের নাশতায় এক মুঠো ভাজা কাজু খেতে পারেন। সালাদ, স্যুপ বা স্ট্যুতে কাজুবাদাম ছড়িয়ে দিলে স্বাদ ও পুষ্টি—দুই-ই বেড়ে যায়। কাজুবাদাম ভিজিয়ে ব্লেন্ড করে দুধ মুক্ত ক্রিম বা পনির তৈরি করা সম্ভব। টোস্ট বা ওটমিলের সঙ্গে কাজু বাটার ব্যবহার করা যায়।

মনে রাখবেন

পরিমাণ: কাজুবাদাম অত্যন্ত পুষ্টিকর হলেও এতে ক্যালরি বেশি। তাই দিনে ২৮ গ্রাম বা প্রায় ১৮টি বাদাম খাওয়াই যথেষ্ট।

লবণ ও তেল: অতিরিক্ত লবণ বা তেলে ভাজা কাজুর চেয়ে শুকনো ভাজা বা আনসলটেড কাজু বেছে নেওয়া ভালো।

অ্যালার্জি: যাদের কাঠবাদাম বা পেস্তাবাদামে অ্যালার্জি আছে, তাদের কাজু খাওয়ার আগে সতর্ক হওয়া উচিত। শ্বাসকষ্ট বা চুলকানির মতো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

সূত্র: হেলথ লাইন, ইভিএন এক্সপ্রেস, ওয়েব মেড

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গরম কড়াইয়ে কেন ঠান্ডা পানি ঢালবেন না

ফিচার ডেস্ক
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

কড়াইসহ যেকোনো ধাতব হাঁড়িপাতিল কেন বাঁকা হয়ে যায়, জানেন? এর উত্তর লুকিয়ে আছে ধাতব পাত্রে ঠান্ডা পানি ঢালার অভ্যাসের মধ্যে।

চুলা থেকে নামানো গরম কড়াইয়ে হঠাৎ ঠান্ডা পানি ঢাললে যে শব্দ হয়, অনেকের কাছে তা সাধারণ মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এটি একটি সতর্কবার্তা। আপনার কড়াইটি তখন থার্মাল শকের শিকার হচ্ছে, যা ধীরে ধীরে রান্নার পাত্রের আয়ু কমিয়ে দেয়। অনেক গৃহিণী ও রান্নাপ্রেমী মনে করেন, গরম কাড়াই সরাসরি সিঙ্কে নিয়ে ঠান্ডা পানি ঢাললে পোড়া খাবারের অংশ সহজে উঠে যায়। কিন্তু অল-ক্ল্যাড ও ক্যালফালনের মতো নামকরা কুকওয়্যার ব্রান্ড সতর্ক করে বলছে, এটি কড়াই নষ্ট হওয়ার বড় কারণগুলোর একটি।

থার্মাল শক কীভাবে ক্ষতি করে

ধাতু গরম হলে প্রসারিত হয় এবং ঠান্ডা হলে সংকুচিত হয়। এটি পদার্থবিজ্ঞানের সাধারণ নিয়ম। যখন প্রায় ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার একটি কড়াই হঠাৎ ঠান্ডা পানির সংস্পর্শে আসে, তখন ধাতব অণুগুলো দ্রুত সংকুচিত হয়। এই হঠাৎ পরিবর্তনই সৃষ্টি করে থার্মাল শক, যা কড়াইয়ের গঠনকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

কড়াই বাঁকা হয়ে যাওয়া

থার্মাল শকের সবচেয়ে সাধারণ ফল হলো কড়াই বাঁকা হয়ে যাওয়া। হঠাৎ ঠান্ডায় কড়াইয়ের নিচের অংশ সংকুচিত হয়ে ভাঁজ হয়ে যায়। ফলে কড়াই চুলার ওপর ঠিকভাবে বসে না এবং তাপ সমানভাবে ছড়ায় না। এর ফল হিসেবে রান্নার সময় এক পাশে খাবার পুড়ে যায়, অন্য পাশে ঠিকমতো রান্না হয় না।

নন-স্টিক কড়াই বাড়তি ঝুঁকি

নন-স্টিক কড়াইয়ের ক্ষেত্রে থার্মাল শক আরও বেশি ক্ষতিকর। কারণ, প্যানের ধাতু ও নন-স্টিক কোটিংয়ের প্রসারণ ও সংকোচনের হার এক নয়। হঠাৎ ঠান্ডা হলে কোটিং ফেটে যেতে বা উঠে যেতে পারে। এতে প্যানের নন-স্টিক ক্ষমতা নষ্ট হয় এবং কোটিংয়ের ক্ষুদ্র কণা খাবারের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ক্ষতিগ্রস্ত নন-স্টিক কোটিং থেকে পিএফএএস জাতীয় ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গত হতে পারে। যেগুলো দীর্ঘ মেয়াদে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং ক্যানসারের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

ফাটল ধরার ঝুঁকি

কাস্ট আয়রন, স্টোনওয়্যার বা সিরামিক প্যানের ক্ষেত্রে থার্মাল শক কখনো কখনো তাৎক্ষণিক ফাটল ধরাতে পারে। এসব উপাদান স্টেইনলেস স্টিল বা অ্যালুমিনিয়ামের তুলনায় বেশি ভঙ্গুর হওয়ায় হঠাৎ তাপমাত্রা পরিবর্তন সহ্য করতে পারে না।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

কড়াই রক্ষা করার নিয়ম

বিশেষজ্ঞদের মতে, কড়াই ভালো রাখার সহজ নিয়ম হলো ধৈর্য। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে—

রান্না শেষ হলে কড়াইটি চুলার ওপর বা পাশে রেখে স্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা হতে দিন।

পুরোপুরি ঠান্ডা হলে তারপর ধুয়ে ফেলুন।

তাড়াহুড়া থাকলে ঠান্ডা পানির বদলে গরম বা কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন, যাতে তাপমাত্রার পার্থক্য কম থাকে।

আরও কিছু সাধারণ ভুল

বিশেষজ্ঞরা আরও কয়েকটি ভুলের কথা উল্লেখ করেন। সেগুলো হলো—

ঠান্ডা পানিতে লবণ দিলে লবণের কণা তলায় জমে স্টেইনলেস স্টিলের পাত্রে ক্ষুদ্র গর্ত তৈরি করতে পারে। তাই পানি ফুটে ওঠার পর লবণ যোগ করা ভালো।

নন-স্টিক প্যান একটির ওপর আরেকটি রাখলে ওপরের প্যানের তলা নিচের প্যানের কোটিংয়ে আঁচড় ফেলতে পারে।

নন-স্টিক প্যানে ধাতব স্ক্রাবার বা শক্ত ঘষামাজা একেবারেই এড়িয়ে চলা উচিত।

কাস্ট আয়রন প্যান পরিষ্কারে সাবান কম ব্যবহার করে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে দ্রুত শুকিয়ে হালকা তেল মেখে রাখা ভালো, এতে মরিচা ধরবে না।

রান্নার পাত্রের যত্ন নেওয়া মানে শুধু খরচ বাঁচানো নয়; এটি খাবারের মান, স্বাদ এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখে। একটি ভালো পাত্র দীর্ঘদিন ভালো থাকলে সমানভাবে রান্না হয়। খাবার পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমে এবং ক্ষতিকর পদার্থ খাবারের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়। গরম প্যানে ঠান্ডা পানি ঢালার অভ্যাসটি ত্যাগ করলে কড়াইয়ের গঠন ও কোটিং অক্ষত এবং সেটি দীর্ঘদিন ব্যবহারের উপযোগী থাকবে।

সূত্র: হাফ পোস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ারে অদ্ভুত ট্রেন্ডের জয়জয়কার

ফিচার ডেস্ক, ঢাকা 
বিভিন্ন বিখ্যাত অভিধান বেছে নিয়েছে এ বছরের সেরা শব্দগুলো। প্রতীকী ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি।
বিভিন্ন বিখ্যাত অভিধান বেছে নিয়েছে এ বছরের সেরা শব্দগুলো। প্রতীকী ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি।

২০২৫ সাল প্রায় শেষের পথে। প্রতিবছরের মতো এবারও বিশ্বের খ্যাতনামা অভিধানগুলো তাদের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ বা বছরের সেরা শব্দ ঘোষণা করেছে। তবে এবারের নির্বাচনগুলোতে একটি বিশেষ সুর ফুটে উঠেছে। তা হলো ডিজিটাল জগতের প্রতি ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস ও অনিশ্চয়তা। যেমন একুশ শতকের প্রথম দশকে অর্থাৎ ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইন্টারনেটের প্রতি প্রবল উৎসাহের কারণে ব্লগ বা টুইটের মতো শব্দগুলো নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু ২০২৫-এর শব্দগুলো বলছে অন্য কথা। এবারের শব্দগুলোতে কৃত্রিমতা, আবেগীয় কারসাজি এবং অদ্ভুত সব ট্রেন্ডের জয়জয়কার।

২০২৫ সালের নির্বাচিত শব্দগুলোর মাধ্যমে মানুষের ডিজিটাল জীবনের একটি বিবর্তনমূলক চিত্র ফুটে উঠেছে। এ বছর এই শব্দগুলো একসঙ্গে বিশ্লেষণ করলে একটি বিশেষ মানসিক অবস্থার খোঁজ পাওয়া যায়। যাকে বলা হচ্ছে ডিজিটাল নিহিলিজম। ভুল তথ্য, এআই-জেনারেটেড ছবি এবং ষড়যন্ত্রতত্ত্বের এই ভিড়ে মানুষ এখন কাকে বিশ্বাস করবে, তা নিয়ে সন্দিহান। এই অনিশ্চয়তাকে একটি ইমোজি দিয়ে সবচেয়ে ভালো প্রকাশ করা যায়। আর তা হলো ‘কাঁধ ঝাঁকানো’ ইমোজি। অর্থাৎ, ডিজিটাল জীবনের এই অরাজকতায় মানুষ এখন কিছুটা উদাসীন এবং নিরুপায়।

অস্ট্রেলীয় ইংরেজি ভাষার প্রধান নির্দেশিকা ম্যাককুয়ারি ডিকশনারি। ছবি: উইকিপিডিয়া
অস্ট্রেলীয় ইংরেজি ভাষার প্রধান নির্দেশিকা ম্যাককুয়ারি ডিকশনারি। ছবি: উইকিপিডিয়া

ইন্টারনেটের নতুন জঞ্জাল এআই স্লপ

অস্ট্রেলীয় ইংরেজি ভাষার প্রধান নির্দেশিকা ম্যাককুয়ারি ডিকশনারি বছরের সেরা শব্দ হিসেবে বেছে নিয়েছে ‘এআই স্লপ’ শব্দটিকে। এটি মূলত জেনারেটিভ এআই দিয়ে তৈরি নিম্নমানের কনটেন্ট, যা ইন্টারনেটে না চাইতেই আমাদের সামনে চলে আসে। ত্রুটিপূর্ণ এআই ইমেজ থেকে শুরু করে লিঙ্কডইনে দেওয়া অদ্ভুত সব ক্যারিয়ার পরামর্শ সবই এই স্লপের অন্তর্ভুক্ত। এটি শুধু একটি শব্দ নয়, বরং ইন্টারনেটের অর্থহীন তথ্যের ভিড়ে প্রকৃত তথ্য খুঁজে পাওয়ার লড়াইকে ফুটিয়ে তোলে।

প্যারাসোশ্যাল (Parasocial): কৃত্রিম সম্পর্কের মায়া

‘কেমব্রিজ ডিকশনারি’ নির্বাচন করেছে ‘প্যারাসোশ্যাল’ শব্দটি। এটি এমন এক ধরনের মানসিক সম্পর্ক, যেখানে একজন ব্যক্তি কোনো সেলিব্রিটি, কাল্পনিক চরিত্র, এমনকি এআই চ্যাটবটের প্রতি একতরফা টান অনুভব করেন। ১৯৫৬ সালে সমাজবিজ্ঞানীরা শব্দটি তৈরি করলেও ২০২৫ সালে এটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। গায়িকা টেলর সুইফট ও ট্র্যাভিস কেলসের বাগদান নিয়ে ভক্তদের অতি উৎসাহ কিংবা নিঃসঙ্গ মানুষের চ্যাটবটের প্রেমে পড়া—এই ঘটনাগুলো প্যারাস্যোশাল শব্দটির ব্যবহার বাড়ার পেছনে বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। মানুষ এখন রক্তমাংসের মানুষের চেয়ে স্ক্রিনের ওপারের চরিত্রের সঙ্গে বেশি মানসিক সংযোগ খুঁজছে।

রাগের কারসাজি রেজ বাইট (Rage Bait)

‘অক্সফোর্ড ডিকশনারি’ এ বছর বেছে নিয়েছে ‘রেজ বাইট’ শব্দটি। এটি এমন এক ধরনের কনটেন্টকে বোঝায়, যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মানুষকে রাগান্বিত বা উত্তেজিত করার জন্য তৈরি করা হয়। মূল লক্ষ্য হলো ইন্টারনেটে ট্রাফিক বা এনগেজমেন্ট বাড়ানো। ‘অ্যাটেনশন ইকোনমি’ বা মানুষের মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার এই নোংরা কৌশল রাজনৈতিক মেরুকরণকেও ত্বরান্বিত করছে। ২০২৫ সালে এই শব্দের ব্যবহার আগের বছরের তুলনায় তিন গুণ বেড়েছে। এ ঘটনা প্রমাণ করে, আমাদের আবেগ নিয়ে খেলা করার বিষয়টির প্রতি আমরা এখন অনেক বেশি সচেতন।

৬-৭ (6-7): অর্থহীনতার জয়জয়কার

এবার সবচেয়ে অদ্ভুত এবং বিতর্কিত নির্বাচনটি করেছে ‘ডিকশনারি ডট কম’। তারা কোনো শব্দ নয়, বরং সংখ্যাকে বছরের সেরা বলে ঘোষণা করেছে। তারা বেছে নিয়েছে ‘৬-৭’। জেনারেশন আলফার এই স্লাং মূলত অর্থহীন এবং অদ্ভুতুড়ে। র‍্যাপার স্ক্রিলার এর একটি গান থেকে এটি জনপ্রিয় হয়। এটি ব্যবহারের সময় দুই হাত দিয়ে দাঁড়িপাল্লার মতো একটি ভঙ্গি করা হয়। শুধু র‍্যাপার নন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকেও একটি স্কুল এই সাইন পরিদর্শন করতে দেখা গেছে। মজার ব্যাপার হলো, এই শব্দের কোনো নির্দিষ্ট অর্থ নেই। মূলত কিশোর-কিশোরীরা বড়দের বিভ্রান্ত করতেই এটি বেশি ব্যবহার করে।

ভাইব কোডিং (Vibe Coding): প্রযুক্তির সহজ পাঠ

‘কোলিন্স ডিকশনারি’ বেছে নিয়েছে ‘ভাইব কোডিং’ শব্দটি। এটি মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সাধারণ ভাষায় কমান্ড দিয়ে কম্পিউটার কোড লেখানোর পদ্ধতি। ওপেন এআইয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা আন্দ্রেজ কারপাথি শব্দটি জনপ্রিয় করেন। এর ফলে এখন কোডিংয়ের গভীর জ্ঞান না থাকলেও কেবল ‘ভাইব’ বা অনুভূতির মাধ্যমে সফটওয়্যার তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে।

সূত্র: টাইমস ম্যাগাজিন, ইভিএন এক্সপ্রেস

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত