Ajker Patrika

আল্লামা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দি: কালোত্তীর্ণ আধ্যাত্মিক সাধক

গাজী সানাউল্লাহ রাহমানী
আল্লামা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দি: কালোত্তীর্ণ আধ্যাত্মিক সাধক

বছর পাঁচেক আগের কথা। মদিনায় যে হোটেলে উঠলাম, তার নাম আল উন্দেলোসিয়া। লক্ষ করে দেখলাম, হোটেলে যাঁরা আনাগোনা করছেন, তাঁদের একটি বড় অংশ সফেদ পোশাকের অধিকারী। বয়োজ্যেষ্ঠ যাঁরা আসছেন, তাঁদের লম্বা সাদা দাড়ি। একটি বড় জামাতের আগমনে আমার মধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি করল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, হোটেলে অবস্থান করছেন বিশ্ব বিখ্যাত আধ্যাত্মিক তাপস আল্লামা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দি।

সরল কথামালায় কোরআন এবং হাদিসের দলিলভিত্তিক যে আলোচনা তিনি করেন, এসব আলোচনা সব বয়সের মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। তাঁর আলোচনার অনন্য একটি দিক হলো, আলোচনায় কোনো চিৎকার নেই, হই-হুল্লোড় নেই—এক স্বরে, এক টানে তিনি কথা বলতে থাকেন। কথা নয়, যেন ঝরনা থেকে ঝরে পড়ছে রত্নমালা। প্রতিটা কথা, প্রতিটা বাক্য শুধু কথা আর বাক্য নয়, আবে হায়াতের মতো করে ঝরে পড়ে হৃদয়ের মাঝে। এমন একজন মানুষ, যাঁর অসংখ্য বয়ান শুনেছি, লেখা পড়েছি এই হোটেলে তিনি অবস্থান করছেন, এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে!

হোটেল কর্তৃপক্ষ হজরতের খাদেমের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করল। তাঁর রুমে গেলাম। হজরত আমাকে হাত ধরে তাঁর পাশে বসালেন। ভাঙা-ভাঙা উর্দুতে বিনয় ভরা কণ্ঠে তাঁকে জানালাম, বাংলাদেশে তাঁর বয়ানের অনুবাদ বেশ পাঠকপ্রিয়। অনুবাদের একটি ধারাবাহিক ভলিউমের সংখ্যা ইতিমধ্যে ৪০ খণ্ড ছাড়িয়েছে। তিনি এ সম্পর্কে অবগত আছেন, সেটা জানালেন। অনুবাদক এবং প্রকাশকদের দোয়া দিলেন। বাংলাদেশের আলেমদের প্রতি তাঁর অশেষ ভালোবাসার কথা জানালেন। ওই দিনটি ছিল আমার জন্য আনন্দের এবং সৌভাগ্যের।

কথা বলা শেষে তিনি তাঁর কাঁধে থাকা সাদা রুমালটা আমাদের সামনে এগিয়ে দিলেন। চারপাশের আলেমগণ এগিয়ে এলেন। এগিয়ে এলাম আমিও। তাঁর রুমাল ধরে আমরা তাঁর সঙ্গে কিছু বাক্য উচ্চারণ করলাম। এ পদ্ধতিকে বলা হয় বায়াত। এটি আধ্যাত্মিকতার একটি সবক। আমরা ইস্তিগফার পড়লাম। দরুদ শরিফ পড়লাম। জীবনের সমস্ত গুনাহ থেকে ক্ষমা চাইলাম।

আল্লামা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দি জীবনের শুরুতে ছিলেন জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত। ১৯৬৭ সালে তিনি মেট্রিক পাস করেন ফার্স্ট ক্লাস হয়ে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পাঞ্জাব থেকে বিএসসি পাস করেন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। ১৯৯৬ সালে বিএসসি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উত্তীর্ণ হন ফার্স্ট ডিভিশনে। তাঁর জন্মভূমি পাকিস্তান ছাড়াও সুইডেনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তিনি উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর দ্বীন শিক্ষার সূচনা হয় ১৯৬২ সালে। একাধারে ২০ বছর অধ্যাপনার পর ১৯৮২ সালে মাদ্রাসাশিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। ১৯৭১ সাল থেকে তাঁর আধ্যাত্মিক পথচলা শুরু হয়। সে সময় তিনি সিলসিলায়ে নকশবন্দির বায়াত গ্রহণ করেন পৃথিবীর বিখ্যাত আধ্যাত্মিক তাপস মোরশেদে আলম গোলাম হাবিবের সান্নিধ্য সৌরভে। ১৯৮৩ সালে তিনি তাঁর মুরশিদের পক্ষ থেকে খলিফা হিসেবে মনোনীত হন। এরপরের গোটা সময়টা তিনি ব্যয় করেন আধ্যাত্মিকতার অনন্য দাওয়াতে, একাধারে মৃত্যু পর্যন্ত।

১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো সুইডেনে ইসলাম বিষয়ে তাঁর ঐতিহাসিক আলোচনা উপস্থাপন করেন। এর পর থেকে তাঁর বিশ্বব্যাপী দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু হয়। গালফ ক্লাবে লেকচার, রোটারি ক্লাবে লেকচার—দুটোই ছিল ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে তাঁর বিখ্যাত আলোচনা। এরপর সৌদি আরব, মিসর, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, নেপাল, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আমেরিকার ২২টি প্রদেশ, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাতারিস্থান, রাশিয়া, ইউক্রেন, আফগানিস্তান, হাঙ্গেরি, ব্রিটেন, জার্মান, নরওয়েসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তিনি সফর করেছেন। হৃদয়ে গভীর ভালোবাসা নিয়ে আলোচনা উপস্থাপন করে মানুষের জীবনে অনন্য পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন।

বিখ্যাত এই মনীষী ১৪ ডিসেম্বর অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান। তাঁর মৃত্যুতে আমরা আধ্যাত্মিকতার এক জগৎকে হারিয়ে ফেললাম।

লেখক: খতিব, মাদ্রাসাশিক্ষক ও টিভি আলোচক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ