Ajker Patrika

দেশপ্রেম, পীর ও আজান-সম্পর্কিতসহ প্রচলিত ১০ জাল হাদিস

ইসলাম ডেস্ক
আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৩, ১৪: ৪৭
দেশপ্রেম, পীর ও আজান-সম্পর্কিতসহ প্রচলিত ১০ জাল হাদিস

আমাদের সমাজে অনেক কথা হাদিস হিসেবে প্রচলিত আছে, যা আসলে হাদিস নয়। এর মধ্যে অনেক কথার সঙ্গে হাদিসের দূরতম সম্পর্কও নেই। তবে কিছু কিছু কথা অন্যান্য সহিহ্ হাদিসের মর্মের কাছাকাছি পাওয়া যায়। উভয় ধরনের কথাই হাদিস হিসেবে চালিয়ে দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে নাজায়েজ। 

মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছে করে আমার নামে মিথ্যা বলে, সে যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকানা বানিয়ে নেয়।’ (বুখারি: ১১০; মুসলিম: ০৩) 

তাই মিথ্যা, বানোয়াট ও জাল হাদিস বলা থেকে বিরত থাকা সবার কর্তব্য। বহুল প্রচলিত ১০টি জাল হাদিস নিয়ে একটি আলোচনা তুলে ধরা হলো—
 
১. দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ
জন্মভূমিকে ভালোবাসা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। এটি মানুষের মহৎ গুণ। নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা, মায়া-মমতা এবং আন্তরিক টান থাকা ইসলামবিরোধী নয়। বরং মহানবী (সা.)-এর জীবনেও দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে আমাদের সমাজে প্রচলিত ‘দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ’ কথাটি মহানবী (সা.)-এর হাদিস নয়। হাদিস বিশারদ আল্লামা সাগানি একে জাল হাদিস বলেছেন। (রিসালাতুল মাওযুআত: ৭) মোল্লা আলি কারি বলেছেন, ‘হাফেজে হাদিসদের কাছে এর কোনো ভিত্তি নেই।’ (আল-মাসনু: ৯১) 

২. দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞানার্জন করো
জ্ঞান অর্জন করা ইসলামে ফরজ। কখনো তা ফরজে আইন, কখনো ফরজে কিফায়া। কোরআন-হাদিসে বিভিন্নভাবে জ্ঞানচর্চায় উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। জ্ঞানার্জনের কোনো শেষ নেই। শেখার কোনো বয়স নেই। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জ্ঞান আহরণ করে যাওয়াই বিবেকের দাবি। তবে সমাজে প্রচলিত ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ করো’ কথাটি হাদিস নয়; বরং এটি প্রবাদ ও উপদেশবাণী। হাদিস বিশারদ শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ বলেন, ‘এটি হাদিস নয়। বরং এটি প্রবাদ।’ (কিমাতুজ জামান ইনদাল উলামা: ৩০) 

 ৩. যার পীর নেই তার পীর শয়তান
ধার্মিক ও মুত্তাকি ব্যক্তিদের পরামর্শে জীবনযাপন করতে উদ্বুদ্ধ করে ইসলাম। পবিত্র কোরআনেও নেককারদের সান্নিধ্য গ্রহণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তবে এ সম্পর্কিত কথা ‘যার পীর নেই তার পীর শয়তান’—এটি হাদিস নয়। হাফেজ বাদায়ুনি নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যার পীর নেই তার পীর শয়তান—এটি কি রাসুল (রা.)-এর হাদিস?’ তিনি বললেন, ‘না, এটি বুজুর্গদের কথা।’ (ফাওয়ায়িদুল ফুয়াদ: ৫৯) 

তাই এ কথার ওপর ভিত্তি করে পীরের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করা ফরজে আইন দাবি করা ভুল। তবে ধর্মীয় বিষয়ের পণ্ডিত ও নেককার বান্দাদের সান্নিধ্যের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করাও মারাত্মক ভ্রান্তি। (ইমদাদুল ফাতাওয়া: ৫ / ২৩৬-২৩৮) 

৪. পৃথিবী ষাঁড়ের শিঙের ওপর
অনেকেই হাদিস হিসেবে বলেন, ‘পৃথিবী একটি পাথরের ওপর। পাথরটি একটি ষাঁড়ের শিংয়ের ওপর। যখন ষাঁড় শিং হেলায়, তখন পাথর নড়ে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীও কেঁপে ওঠে। আর এটিই ভূমিকম্প।’ এটি হাদিস নয়। মহানবী (সা.) এ কথা বলেছেন, এমন কোনো প্রমাণ নেই। ইবনুল কাইয়িম ও আবু হাইয়ানসহ অনেক মুহাদ্দিস একে জাল ও অবান্তর বলেছেন। (আলমানারুল মুনিফ: ৭৮; আল-ইসরাইলিয়াত ওয়াল-মাওযুআত: ৩০৫) 

৫. মসজিদে দুনিয়াবি কথা বলা
লোকমুখে প্রচলিত আছে, ‘যে ব্যক্তি মসজিদে দুনিয়াবি কথাবার্তা বলবে, আল্লাহ তাআলা তার ৪০ বছরের নেক আমল বরবাদ করে দেবেন।’ হাদিস হিসেবে মানুষের কাছে প্রসিদ্ধ হলেও এটি হাদিস নয়। আল্লামা সাগানি ও আল্লামা কাউকাজি একে জাল হাদিস বলেছেন। মোল্লা আলি কারি, আজলুনি ও শাওকানি এই মতে সমর্থন দিয়েছেন। (আল-মাসনু: ১৮২; আল-মাওজুআতুল কুবরা: ১১৭) এ বিষয়ে প্রায় কাছাকাছি অর্থের আরও কিছু জাল হাদিস সমাজে প্রচলিত রয়েছে। 

এর অর্থ এই নয় যে মসজিদে দুনিয়াবি কথাবার্তা বলা যাবে; বরং তা ইসলামের দৃষ্টিতে নাজায়েজ। তবে কোনো ধর্মীয় কাজে অথবা অপারগতার কারণে বিশ্রাম নিতে মসজিদে গেলে প্রয়োজনে দুনিয়াবি কথা বলা যাবে। মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের আমল থেকে বিষয়টি প্রমাণিত। (সহিহ্ বুখারি: ১ / ৬৩-৬৫; রদ্দুল মুহতার: ১ / ৬৬২) 

৬. মুমিনের উচ্ছিষ্ট ওষুধ
 ‘মুমিনের উচ্ছিষ্ট ওষুধ’—এ কথা মানুষের মুখে হাদিসে হিসেবে প্রচলিত। অথচ এটি হাদিস নয়। মোল্লা আলি কারি বলেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসে এর কোনো ভিত্তি নেই।’ (আল-মাসনু: ১০৬) আল্লামা নাজমুদ্দিন গাযযি বলেছেন, ‘এটি হাদিস নয়।’ (কাশফুল খাফা: ১ / ৪৫৮) 

তবে মানুষের উচ্ছিষ্ট পবিত্র। তা খাওয়া জায়েজই নয়; বরং প্রশংসনীয়ও। হাদিসে এসেছে, ইবনে আব্বাস বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে আমি ও খালিদ ইবনে ওয়ালিদ মাইমুনা (রা.)-এর কাছে গেলে তিনি পাত্রে করে আমাদের জন্য দুধ নিয়ে এলেন। রাসুল (সা.) দুধ পান করলেন। আমি তাঁর ডান দিকে ছিলাম এবং খালিদ বাম দিকে। তিনি আমাকে বললেন, ‘আগে পান করার অধিকার তোমারই, তবে তুমি ইচ্ছা করলে খালিদকে আগে দিতে পারো।’ আমি বললাম, ‘আপনার উচ্ছিষ্ট পানে আমি কাউকে প্রাধান্য দিতে পারি না।’ (তিরমিজি: ৩৬৮৪) 

৭. নখ কাটার বিশেষ নিয়ম
প্রচলিত আছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ডান হাতের তর্জনী থেকে নখ কাটা শুরু করে বৃদ্ধাঙ্গুলে শেষ করতেন। বাম হাতের কনিষ্ঠাঙ্গুল থেকে শুরু করে বৃদ্ধাঙ্গুলে শেষ করতেন।’ এটি মহানবী (সা.)-এর হাদিস নয়। নখ কাটার নির্দিষ্ট নিয়ম ও দিনের ব্যাপারে তাঁর কোনো হাদিস পাওয়া যায় না। ইবনে হাজার আসকালানি বলেন, ‘নখ কাটার নিয়ম সম্পর্কে কোনো প্রমাণিত হাদিস নেই।’ (ফাতহুল বারি: ১০ / ৩৫৭) আল্লামা সাখাবি ও হাফেজ ইরাকিও একই মত দিয়েছেন। (মাকাসিদুল হাসানা: ৩৬২; ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন: ২ / ৪১১) 

তবে মহানবী (সা.) যেহেতু সব ভালো কাজই ডান দিক থেকে শুরু করতেন, তাই নখ কাটার ক্ষেত্রেও ডান দিক থেকে শুরু করা মুস্তাহাব। এর বাইরে অন্য কোনো নিয়ম হাদিস থেকে প্রমাণিত নয়। 

৮. আলেমগণ বনি ইসরায়েলের নবীর সমতুল্য
প্রচলিত আছে, ‘আমার উম্মতের আলেমগণ বনি ইসরায়েলের নবীর মতো।’ এ কথাটি হাদিস হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। যারকাশি, দারেমি, ইবনে হাজার, সুয়ুতি, মোল্লা আলি কারি, শাওকানিসহ অসংখ্য মুহাদ্দিস একে ভিত্তিহীন বলেছেন। (আত-তাযকিরা: ১৬৭; আ-মাকাসিদুল হাসানা: ৩৪০; আ-দুরাদুর মুনতাসিরা: ১৪৩) 

তবে এই হাদিসের মর্মের কাছাকাছি কয়েকটি সহিহ্ হাদিস পাওয়া যায়। যেমন মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আলেমগণ নবীদের ওয়ারিশ।’ (আবু দাউদ: ৩১৫৭; তিরমিজি: ২৬০৬) 

৯. আজানের সময় কথা বললে ইমান থাকবে না
আজানের সময় মুমিনের করণীয় হলো, মনোযোগ দিয়ে আজান শোনা এবং আজানের জবাব দিয়ে দোয়া পড়া। এ কথা সহিহ্ হাদিস থেকে প্রমাণিত। তবে সমাজে প্রচলিত, ‘যে ব্যক্তি আজানের সময় কথা বলবে, তার ইমান চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে’ বা ‘যে ব্যক্তি আজানের সময় কথা বলবে, তার ৪০ বছরের ইবাদত নষ্ট হয়ে যাবে’— এই জাতীয় কথা হাদিস থেকে প্রমাণিত নয়। আল্লামা সাগানি এগুলোকে জাল হাদিস বলেছেন। (রিসালাতুল মাওযুআত: ১২) 

১০. আজান-ইকামতে আঙুলে চুমো খাওয়া
আজান-ইকামতের সময় রাসুল (সা.)-এর নাম উচ্চারিত হলে অনেককে তর্জনীতে চুমো খেয়ে তা চোখে বুলিয়ে দিতে দেখা যায়। এ আমলটি মূলত মুসনাদে দায়লামির একটি জাল হাদিসের ওপর ভিত্তি করে মানুষ চর্চা করে। আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি বলেছেন, ‘মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে রাসুল (সা.)-এর নাম শুনে আঙুলে চুমো খাওয়া এবং তা চোখে মুছে দেওয়া সম্পর্কিত যত বর্ণনাই আছে, সবই জাল ও বানোয়াট।’ (তাইসিরুল মাকাল: ১২৩) হাদিসগুলো শুধু জালই নয়; অন্য কোনো সহিহ্ হাদিস থেকেও আমলটি প্রমাণিত নয়। তাই এই কাজ পরিহার করা উচিত। 

সূত্র: মাওলানা মুতীউর রহমান রচিত ‘এসব হাদিস নয়’ প্রথম খণ্ড

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

খালেদা জিয়ার জানাজা পড়াবেন বায়তুল মোকাররমের খতিব

ইসলাম ডেস্ক 
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জানাজা ও দাফন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।

বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) বাদ জোহর বেলা ২টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এই জানাজায় ইমামতি করবেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মালেক।

মঙ্গলবার দুপুরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

মির্জা ফখরুল জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বুধবার বেলা ২টায় পার্লামেন্ট ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ এলাকায় জানাজা সম্পন্ন হবে। জানাজা শেষে শেরেবাংলা নগরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

প্রিয়জনের মৃত্যুতে শোক পালনে ইসলামের নির্দেশনা

ইসলাম ডেস্ক 
ব্লু মসজিদ, ইস্তাম্বুল। ছবি: সংগৃহীত
ব্লু মসজিদ, ইস্তাম্বুল। ছবি: সংগৃহীত

জীবনে প্রিয়জন হারানো এক অপূরণীয় বেদনা। এই কঠিন মুহূর্তে মানুষ কীভাবে আচরণ করবে, কেমনভাবে শোক প্রকাশ করবে—সেই বিষয়ে ইসলাম দিয়েছে পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো—শোক প্রকাশে ভারসাম্য রাখা, কষ্টকে অস্বীকার না করা, আবার সীমালঙ্ঘনও না করা।

ইসলাম এ বিপদে ধৈর্য ও আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকার শিক্ষা দেয়। তবে কান্না করাকে নিষেধ করেনি, বরং তা স্বাভাবিক ও মানবিক অনুভূতির প্রকাশ হিসেবে বিবেচিত। রাসুলুল্লাহও (সা.) কেঁদেছেন তাঁর সন্তান ইবরাহিম (রা.)-এর মৃত্যুর সময়।

সাহাবি আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) বিস্ময় প্রকাশ করলে নবীজি (সা.) বলেন, ‘এ কান্না স্নেহ-ভালোবাসার প্রকাশ। আমার হৃদয় বেদনাহত, চোখ দুটো সিক্ত, তবে আমি বলছি সেই কথাই, যা আমার রবকে সন্তুষ্ট করে। ইবরাহিম, তোমার বিচ্ছেদে আমরা শোকাহত।’ (সহিহ বুখারি)

ইসলাম কান্নাকে মানবিক বললেও অতিরিক্ত বিলাপ, উচ্চ স্বরে চিৎকার, গায়ে চপেটাঘাত, জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা বা আকুতি-মিনতি করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মৃতের জন্য বিলাপ করা জাহিলি যুগের প্রথা। বিলাপকারী যদি মৃত্যুর আগে তওবা না করে, তবে কিয়ামতের দিন তাকে আগুনের পোশাক ও আলকাতরার চাদর পরানো হবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থরক্ষায় খালেদা জিয়ার অনন্য কিছু উদ্যোগ

ইসলাম ডেস্ক 
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ২৫
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

আজ মঙ্গলবার ভোরে যখন কুয়াশাভেজা প্রকৃতিতে ফজরের আজান ধ্বনিত হচ্ছিল, এর ঠিক কিছু পরেই চিরদিনের জন্য চোখ বুজলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খালেদা জিয়া। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি শুধু একজন সফল প্রধানমন্ত্রীই ছিলেন না, বরং মুসলিম উম্মাহর স্বার্থরক্ষা এবং ইসলামি মূল্যবোধকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার অন্যতম এক বাতিঘর ছিলেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে কজন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধর্মীয় চেতনা ও মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় আপসহীন ভূমিকা রেখেছেন, খালেদা জিয়ার নাম সেখানে অনেকটা অগ্রভাগেই থাকবে।

খালেদা জিয়া শুধু রাজনীতির ময়দানেই বিচরণ করেননি, তিনি অন্তরে লালন করতেন বাংলাদেশি মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শ। গৃহবধূ থেকে দেশের শীর্ষ নেতৃত্বে উঠে আসার দীর্ঘ লড়াইয়ে তিনি সব সময় আলেমসমাজকে পরম মমতায় কাছে টেনে নিয়েছেন।

সংবিধানে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও রাষ্ট্রধর্মের সুরক্ষা

১৯৯১ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর যখন নানামুখী রাজনৈতিক চাপ ছিল, তখন খালেদা জিয়া দৃঢ়তার সঙ্গে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এবং ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বজায় রাখার পক্ষে অবস্থান নেন। ২০০৫ সালের সংসদীয় কার্যবিবরণী সাক্ষ্য দেয়, তিনি বারবার সংসদে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের মর্যাদা রক্ষার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন।

কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসার যুগান্তকারী সংস্কার

আলেমসমাজ ও মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের হৃদয়ে খালেদা জিয়া অমর হয়ে থাকবেন তাঁর শিক্ষা সংস্কারের জন্য।

  • ফাজিল ও কামিলের স্বীকৃতি: ২০০১-০৬ মেয়াদে ফাজিলকে ডিগ্রি এবং কামিলকে মাস্টার্সের সমমান দিয়ে তিনি মাদ্রাসাশিক্ষার্থীদের মূলধারার সঙ্গে প্রতিযোগিতার সুযোগ করে দেন।
  • কওমি সনদের প্রথম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি: ২০০৫ সালে আলেমদের সঙ্গে বৈঠকের পর ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেওয়ার ঐতিহাসিক গেজেট প্রকাশ করেন। সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ায় বাস্তবায়ন অসম্পূর্ণ থাকলেও এটিই ছিল কওমি সনদের প্রথম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাইলফলক।
  • ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়: কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ’ অনুষদসহ নতুন নতুন বিভাগ অনুমোদনের মাধ্যমে উচ্চতর ইসলামি শিক্ষার প্রসারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

ধর্মীয় স্থাপনা ও হজ ব্যবস্থাপনায় সংস্কার

বায়তুল মোকাররম মসজিদের সংস্কার, জাতীয় ঈদগাহের আধুনিকায়ন এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমাম-মুয়াজ্জিন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানো ছিল তাঁর নিয়মিত কাজের অংশ। আল্লাহর ওলিদের মাজার রক্ষণাবেক্ষণেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক। পাশাপাশি হজযাত্রীদের যাতায়াত সহজ করতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে শক্তিশালী করা এবং সৌদি সরকারের সঙ্গে সফল কূটনীতির মাধ্যমে ভিসা সমস্যার সমাধান করেছিলেন তিনি।

ইসলামি অর্থনীতি ও বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব

খালেদা জিয়ার শাসনামলেই বাংলাদেশে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং ও ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা দ্রুত বিস্তৃত হয়। মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে ইসলামি ব্যাংকিংকে আস্থার জায়গায় নিয়ে যেতে তাঁর সরকার নীতিগত সহায়তা প্রদান করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ওআইসিসহ সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও ব্রুনাইয়ের মতো মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিল।

২০০৫ সালে ইউরোপে নবীজি (সা.)-কে নিয়ে অবমাননাকর কার্টুন প্রকাশিত হলে তাঁর সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর নিন্দা জানিয়েছিল।

আজ ফজরের পর তিনি যখন মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন, তখন পেছনে রেখে গেছেন এমন এক কর্মময় জীবন, যা এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের মর্যাদা রক্ষা এবং ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার যে বীজ তিনি বপন করেছিলেন, তা আজ এক বিশাল মহিরুহে পরিণত হয়েছে।

আল্লাহ তাঁকে তাঁর সকল নেক আমল কবুল করে এবং ভুলত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চ মাকাম দান করুন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কারও মৃত্যুর সংবাদ শুনলে যে দোয়া পড়বেন

ইসলাম ডেস্ক 
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

মানুষের জন্ম যেমন অবশ্যম্ভাবী, তেমনি তার মৃত্যুও পৃথিবীর এক অমোঘ সত্য। জীবনে চলার পথে যত সাফল্য, ব্যস্ততা বা আকাঙ্ক্ষা থাকুক; মৃত্যুর মুহূর্তে সবকিছু থেমে যায়। ইসলাম এই বাস্তবতাকে অত্যন্ত গভীরভাবে তুলে ধরেছে এবং আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে যে প্রতিটি প্রাণী একদিন তার প্রভুর কাছে ফিরে যাবে।

মৃত্যু অবধারিত ‎সত্য। তা থেকে পালানোর কোনো পথ নেই। কোনো বস্তু জীবনের অস্তিত্ব লাভ করলে তার মৃত্যু সুনিশ্চিত। কোরআন ও হাদিসে এ ব্যাপারে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে।

কেউ যখন মারা যায়, তার মৃত্যুর খবর শুনলে একটি দোয়া পড়তে হয়, দোয়াটি বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ১৫৬ নম্বর আয়াতে।

দোয়াটি হলো: ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, আল্লাহুম্মা আজিরনি ফি মুসিবাতি; ওয়া আখলিফ-লি খাইরাম মিনহা।’

দোয়ার অর্থ: ‘আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয় আল্লাহর কাছেই ফিরে যাব। হে আল্লাহ, আমাকে আমার এই বিপদে বিনিময় দান করুন এবং আমার জন্য এর চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা করে দিন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত