Ajker Patrika

দুর্নীতিমুক্ত দেশের আকাঙ্ক্ষা ও ইসলাম

মো. আবুবকর সিদ্দীক
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবী থেকে একদিন চিরতরে চলে যেতে হবে। যথাসময়ে মৃত্যুদূত দরজায় এসে কড়া নাড়বে। মৃত্যুর হাত থেকে কারও নিস্তার নেই। জন্ম নিলে মরতেই হবে। পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি, কখনো ঘটবে না। পৃথিবীতে মানুষের আয়ুষ্কালের তারতম্য আছে, এটা মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। বিন্দুমাত্র হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মৃত্যুর পর কয়েক টুকরা সাদা কাপড়েই বিদায় দেওয়া হবে। শূন্য হাতে অন্ধকার কবরে হবে ঠাঁই। মৃত্যুর পরে মহান আল্লাহর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, দিতে হবে কৃতকর্মের হিসাব। পাপপুণ্যের এই হিসাবে উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্যেই জীবনের চরম ও পরম সফলতা। কিন্তু বিপরীতটা হলে জীবনটা ষোলো আনাই ব্যর্থ।

আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। ইসলামে মৌলিক ইবাদতগুলো কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হালাল রুজি। ইবাদত করা যেমন ফরজ, তেমনি হালাল উপার্জনও ফরজ। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘হালাল রুজি অন্বেষণ করা ফরজের পরও একটি ফরজ।’ (বায়হাকি) ইসলামে হালাল উপার্জনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ, তোমরা একে অন্যের সম্পদ অবৈধভাবে ভক্ষণ কোরো না।’ (সুরা বাকারা: ২৩)

এ প্রসঙ্গে এক হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধূসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করছে—হে আমার প্রভু, হে আমার প্রভু। অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। বলো, তার প্রার্থনা কীভাবে কবুল হবে? (মুসলিম: ২৩৯৩)

অবৈধ পথে উপার্জনকারী বা হারাম ভক্ষণকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘এমন শরীর কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যা হারাম দ্বারা বর্ধিত। জাহান্নামই তার উপযুক্ত স্থান। (মুসনাদে আহমাদ: ১৪৪৪১)

অসততা, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, কালোবাজারি, অতিরিক্ত মুনাফাখোর, ভেজাল কারবারি ইত্যাদি শরিয়তবিরোধী পথে টাকা কামানো নিতান্তই বোকামি। এটি জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দেওয়ারই নামান্তর। অবৈধ পথে কিংবা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ সঞ্চয় করা কোনো সুবিবেচক মানুষের কাজ হতে পারে না। এটা নিকৃষ্ট, জঘন্যতম ও নিখাদ পাপ। আর পাপের প্রায়শ্চিত্ত অনিবার্য। যিনি করবেন তাকেই পাপের প্রতিফল ভোগ করতে হবে। পরকালে কেউ কারও সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। কারও পাপের ভাগ কেউই নেবেন না।

সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক মহান আল্লাহপাক মানুষের প্রতিটি কাজের হিসাব নেবেন। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনো কিছুই বাদ যাবে না। পাপের চেয়ে পুণ্যের পাল্লা ভারী হলে আছে সুসংবাদ, বিপরীত হলে ভয়ানক দুঃসংবাদ। নেককার বান্দাদের জন্য মহান আল্লাহ পুরস্কার হিসেবে চির শান্তির বেহেশত প্রস্তুত করে রেখেছেন। অন্যদিকে পাপিষ্ঠদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন জাহান্নাম। জাহান্নামে পাপিষ্ঠদের জন্য শাস্তির যে বন্দোবস্ত আল্লাহ করে রেখেছেন, তা অত্যন্ত ভয়াবহ।

জাহান্নামের এই ভয়ানক শাস্তি থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ হলো কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে জীবন পরিচালনা করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা অবলম্বন করলে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ। ‘হাওজে’ (কাওসারে) আমার নিকট অবতরণ না করা পর্যন্ত তা বিচ্ছিন্ন হবে না।’ (হাকেম ৩১৯)

হাশরের দিনে মহান আল্লাহপাকের কাছে আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে হবে। এই হিসাব না দিয়ে কোনোভাবেই পার পাওয়ার সুযোগ নেই। হাদিসে বর্ণিত আছে, কিয়ামতের ময়দানে প্রত্যেক মানুষকে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে—১) সে তার জীবন কোন পথে শেষ করেছে, ২) যতটুকু দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করেছে তার ওপর কতটুকু আমল করেছে, ৩) সম্পদ কোন পথে আয় করেছে, ৪) সম্পদ কোন পথে ব্যয় করেছে, ৫) নিজের যৌবনকে কোন পথে শেষ করেছে। (জামে তিরমিজি: ২৪১৭)

অবৈধ পথে সম্পদ অর্জন করলে শেষবিচারের দিনে মহান আল্লাহর কাছে পাকড়াও হতে হবে, ভোগ করতে হবে কঠিন শাস্তি। জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে। কেউই অন্য কারও পাপের দায়ভার নেবে না। তাহলে কেন অবৈধ পথে পা বাড়াবেন?

পৃথিবীতে মানুষের আয়ুষ্কাল অতি সামান্য। পরকালের জীবন অসীম-অনন্ত। ইহকালের সামান্য কয়েকটি বছর স্বাচ্ছন্দ্যে কাটানোর জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নিলে পরকালের অনন্ত সময়ে নিদারুণ কষ্ট ও যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। জাহান্নামের অতি তীব্র আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। ইহলোকের সামান্য সময়টুকু সততার সঙ্গে পার করতে পারলেই পরলোকের অনন্ত সময় সুখ ও শান্তিতে কাটবে। পারলৌকিক জীবনের ব্যাপারে উদাসীন মানুষটিই পৃথিবীর সবচেয়ে নির্বোধ মানুষ। সকল কাজে পরকালকে প্রাধান্য দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। লোভ-লালসা, দুঃখ-কষ্ট কিংবা কোনো চাপের কাছে মাথা নত করা যাবে না। কোনো পরিস্থিতিতেই পরকালকে বিসর্জন দেওয়া যাবে না।

পরকালের পরিণতির ভাবনাই মানুষকে দুর্নীতির মতো পাপকাজ থেকে বিরত রাখতে পারে। অধিকন্তু সমাজের সর্বস্তরে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে দুর্নীতির ক্ষেত্রসমূহ বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। জনগণকে অধিকার সচেতন হওয়ার পাশাপাশি প্রতিবাদমুখর হতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা দেখাতে হবে। পরিবারের সদস্যদের আয়-ব্যয়ের খোঁজখবর রাখতে হবে। সর্বোপরি, নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হবে। অন্য কোনো ব্যক্তিকে পরিবর্তন করার চেয়ে নিজে পরিবর্তিত হওয়াটাই দুর্নীতি প্রতিরোধের সহজতম উপায়। তুমি, আমি তথা আমরা মিলেই তো দেশ। নিজেকে বদলে ফেললেই দেশটা বদলে যাবে। নিজে দুর্নীতিমুক্ত হলেই পূরণ হবে দুর্নীতিমুক্ত দেশের আকাঙ্ক্ষা।

লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আজকের নামাজের সময়সূচি: ২১ ডিসেম্বর ২০২৫

ইসলাম ডেস্ক 
আজকের নামাজের সময়সূচি। ছবি: সংগৃহীত
আজকের নামাজের সময়সূচি। ছবি: সংগৃহীত

জীবনকে সুশৃঙ্খল করতে এবং আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে নামাজের কোনো বিকল্প নেই। একজন মুমিনের জন্য নামাজ হলো আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যম। এটি এমন এক ইবাদত—যা আমাদের মনে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি আনে, জীবনের প্রতিটি কাজে আনে বরকত।

প্রতিদিন সময় মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর আবশ্যক। তাই জেনে নেওয়া যাক আজ কোন ওয়াক্তের নামাজ কখন আদায় করতে হবে।

আজ রোববার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ইংরেজি, ০৬ পৌষ ১৪৩২ বাংলা, ২৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৭ হিজরি। ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকার নামাজের সময়সূচি তুলে ধরা হলো—

আজকের নামাজের সময়সূচি
নামাজ ওয়াক্ত শুরুওয়াক্ত শেষ
তাহাজ্জুদ ও সেহরির শেষ সময়০০: ০০০৫: ১৪ মিনিট
ফজর০৫: ১৫ মিনিট০৬: ৩৫ মিনিট
জোহর১১: ৫৭ মিনিট০৩: ৪০ মিনিট
আসর০৩: ৪১ মিনিট০৫: ১৫ মিনিট
মাগরিব০৫: ১৭ মিনিট০৬: ৩৬ মিনিট
এশা০৬: ৩৭ মিনিট০৫: ১৪ মিনিট

উল্লিখিত সময়ের সঙ্গে যেসব বিভাগের সময় যোগ-বিয়োগ করতে হবে, সেগুলো হলো:

বিয়োগ করতে হবে—
চট্টগ্রাম: ০৫ মিনিট
সিলেট: ০৬ মিনিট

যোগ করতে হবে—
খুলনা: ০৩ মিনিট
রাজশাহী: ০৭ মিনিট
রংপুর: ০৮ মিনিট
বরিশাল: ০১ মিনিট

নামাজ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি যেমন আমাদের দৈহিক পবিত্রতা নিশ্চিত করে, তেমনই আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। আজকের এই নামাজের সময়সূচি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবনের ব্যস্ততা যতই থাকুক না কেন, আল্লাহর জন্য সময় বের করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব।

আসুন, নামাজের মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে তাঁর আরও কাছে নিয়ে যাই। জীবনে নিয়ে আসি ইমানের নুর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নূরানী বোর্ডের ফল প্রকাশ, পাসের হার ৯০.৩৬

ইসলাম ডেস্ক 
নূরানী বোর্ডের ফল প্রকাশ, পাসের হার ৯০.৩৬

নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ড বাংলাদেশ (এনটিকিউবি) পরিচালিত তৃতীয় শ্রেণির ১৯তম সমাপনী পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে।

শনিবার (২০ ডিসেম্বর) বোর্ডের মোহাম্মদপুরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের শায়খুল কোরআন মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই ফল প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে অনুষ্ঠানে জুলাই যোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির রুহের মাগফিরাত কামনায় বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বোর্ডের পরিচালক মাওলানা কালিমুল্লাহ জামিল হুসাইন।

দেশের মোট ১ হাজার ১২টি কেন্দ্রে গত ২৯ নভেম্বর দেশব্যাপী একযোগে এই সমাপনী পরীক্ষা শুরু হয়ে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। এতে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৬৩ হাজার ৫৩২ এবং পাসের হার ৯০ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে মাওলানা কালিমুল্লাহ জামিল হুসাইন বলেন, ‘দেশব্যাপী তরুণ আলেমদের কাছে অনুরোধ করছি, একটি নীরব সাধনায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে হবে। তা হচ্ছে প্রতিটি গ্রামে-পাড়া-মহল্লায় নূরানি মাদ্রাসা, নূরানি স্কুল, নূরানি মক্তব ও ইসলামিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের প্রতিটি সন্তানের কাছে দ্বীন শেখাকে সহজ থেকে সহজতর করতে হবে।’

পরীক্ষা বাস্তবায়ন কমিটির মহাসচিব ইসমাইল বেলায়েত হুসাইন বলেন, ‘শিশুরা কাঁচা মাটির মতো। তাদের যেভাবে গড়ে তুলবেন, তারা সেভাবেই গড়ে উঠবে। আমরা দ্বীন ধর্ম ও মাতৃভূমির ভালোবাসায় সন্তানদের গড়ে তুলি। সুনাগরিক ও দেশপ্রেমিক প্রজন্ম গড়ে তুলতে কাজ করে নূরানী বোর্ড।’

এদিকে অনুষ্ঠানে তরুণদের জন্য ‘শায়খুল কোরআন আল্লামা কারি বেলায়েত হুসাইন (রহ.) স্কলারশিপ’-এরও ঘোষণা দেওয়া হয়। ১০ লাখ টাকা সমমূল্যের এই স্কলারশিপ পাবেন ১০০ তরুণ। মনোনীত ১০০ তরুণ ১০ হাজার টাকা সমমূল্যের নূরানি মুয়াল্লিম প্রশিক্ষণ কোর্সটি বিনা মূল্যে করতে পারবেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মাওলানা আবু বকর, মাওলানা তারেক হুসাইনসহ নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ডের কর্মকর্তা ও দায়িত্বশীলেরা।

প্রসঙ্গত, শায়খুল কোরআন আল্লামা কারি বেলায়েত হুসাইন (রহ.) প্রতিষ্ঠিত এই বোর্ডটি দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরাঞ্চলেও শিশু শিক্ষায় অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে এই ধারার হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সারা দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যে মাদ্রাসায় বেড়ে উঠেছিলেন ওসমান হাদি

কাউসার লাবীব
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ২৯
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

একটি সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারের সন্তান থেকে শুরু করে রাজপথের আপসহীন বক্তা—শরিফ ওসমান হাদির শিকড় প্রোথিত ছিল ধর্মীয় শিক্ষার গভীরে। ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার খাসমহল এলাকায় এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা প্রয়াত মাওলানা আব্দুল হাদি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ মাদ্রাসাশিক্ষক। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ওসমান হাদি ছিলেন সবার ছোট। পরিবারের প্রত্যেক সদস্য আলেম বা দ্বীনি শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত, যা ওসমান হাদির চিন্তা ও চরিত্রে এনেছিল দৃঢ় নৈতিক ভিত্তি।

তাঁর বড় ভাই মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক বরিশালের ঐতিহ্যবাহী শরফুদ্দীন আহমেদ সেন্টু জামে মসজিদের খতিব; মেজো ভাই মাওলানা ওমর ফারুক একজন ব্যবসায়ী। তাঁর তিন ভগ্নিপতিও মাদ্রাসায় শিক্ষকতা ও ইমামতির সঙ্গে যুক্ত, যাঁরা স্থানীয় পর্যায়ে অত্যন্ত সম্মানিত।

ওসমান হাদির শিক্ষাজীবনের শুরু ঝালকাঠির বিখ্যাত এন এস কামিল মাদ্রাসায়। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন তুখোড় মেধাবী এবং অসাধারণ বক্তা। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার স্পৃহা তাঁর মধ্যে কাজ করত শৈশব থেকেই। এক সাক্ষাৎকারে তিনি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে তাঁর প্রিয় মাদ্রাসার স্মৃতিচারণা করেছিলেন।

ওসমান হাদি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমাকে এটা যদি কেউ জিজ্ঞেস করে—আল্লাহ যদি আমাকে আবারও দুনিয়ায় পাঠায়, আমি কয়টা জিনিস চাইব। আমি প্রথমেই বলব—ইন্টার পর্যন্ত যে মাদ্রাসাটায় পড়েছি, সেই মাদ্রাসায় আবার আমি পড়তে চাইব। বাংলাদেশে এটা কেউ চিন্তাও করতে পারবে না যে মাদ্রাসায় রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ হয়। আমি যখন চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি; তখন ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে অনেকবার বিতর্ক, আবৃত্তি, বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে এসেছি এবং স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা মিলিয়ে আমি অনেকবার ফার্স্ট হয়েছি।’

ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা শুধু আমি না, ওই প্রতিষ্ঠানের আমার অনেক ছোট ভাই, বন্ধু জাতীয় পর্যায়ের এমন প্রচুর পুরস্কার পেত। আমাদের এমনভাবে কালচারাল নার্সিং হতো—রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, জারি, ভাটিয়ালি আমরা গাইতাম। যেহেতু মাদ্রাসা, তাই একমাত্র নৃত্যটা হতো না।’

মাদ্রাসার গণ্ডি পেরিয়ে ওসমান হাদি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে (২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ)। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেও তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখেন। জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে তিনি প্রাইভেট পড়িয়েছেন, সাইফুর’সসহ বিভিন্ন নামী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ তিনি ইউনিভার্সিটি অব স্কলারসে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা তাঁকে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তাঁর সাহসী ভূমিকা এবং পরে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে টক শো ও সভা-সমাবেশে তাঁর যুক্তিপূর্ণ ও ঝাঁজালো বক্তব্য তাঁকে অনেক তরুণের আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজের পর রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংক এলাকায় রিকশায় যাওয়ার সময় মোটরসাইকেলে আসা দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে লক্ষ্য করে খুব কাছ থেকে গুলি করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হলেও মৃত্যুর কাছে হার মানেন তিনি। ১৮ ডিসেম্বর রাত পৌনে ১০টায় সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার মাত্র এক মাস আগে নভেম্বর মাসে ওসমান হাদি নিজের জীবনের ঝুঁকির কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন। দেশি-বিদেশি অসংখ্য নম্বর থেকে আসা প্রাণনাশের হুমকির কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছিলেন—‘জীবননাশের আশঙ্কা সত্ত্বেও ইনসাফের লড়াই থেকে আমি পিছিয়ে যাব না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জানাজা ও দাফনে অংশ নিলে যে সওয়াব

আবরার নাঈম 
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ৫৮
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

দুনিয়ার সফরের শেষ গন্তব্য মৃত্যু। মৃত্যু এক অপ্রিয় সত্য, যা সুনিশ্চিত অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রতিটি প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৮৫)

জানাজার নামাজ ফরজে কিফায়া। অর্থাৎ কোনো মুসলমান মারা গেলে মহল্লার অল্পসংখ্যক লোক জানাজার নামাজ আদায় করলে বাকিরা দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। এ ছাড়া একজন মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের পাঁচটি হক আছে। এর মধ্যে মৃত ব্যক্তির জানাজায় অংশ নেওয়াও একটি হক।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এক মুসলমানের অধিকার অন্য মুসলমানের ওপর পাঁচটি: সালামের জবাব দেওয়া, রোগীকে দেখতে যাওয়া, জানাজার সঙ্গে যাওয়া, দাওয়াত কবুল করা এবং হাঁচি দিলে তার জবাব দেওয়া।’ (রিয়াদুস সলেহিন: ৯০০)

কোনো মুসলমানের জানাজায় অংশগ্রহণ ও তাকে কবরস্থ করা সমাজের মুসলমানদের ইমানি দায়িত্ব। পাশাপাশি এতে রয়েছে অধিক পরিমাণে সওয়াব। যদিও সবার অংশগ্রহণ জরুরি নয়। তাই বলে এমন সওয়াবের কাজ থেকে পিছিয়ে থাকা কখনোই সমীচীন নয়।

জানাজা ও দাফনকার্যে অংশগ্রহণের লাভ সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি (আল্লাহর প্রতি) বিশ্বাস রেখে এবং নেকির আশা রেখে কোনো মুসলমানের জানাজার সঙ্গে যাবে এবং তার জানাজার নামাজ আদায় করবে এবং দাফন করা পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকবে, সে দুই কিরাত (পরিমাপের একক) সওয়াব নিয়ে (বাড়ি) ফিরবে। এক কিরাত উহুদ পাহাড়ের সমান। আর যে ব্যক্তি জানাজার নামাজ আদায় করে মৃতকে সমাধিস্থ করার আগেই ফিরে আসবে, সে এক কিরাত সওয়াব নিয়ে (বাড়ি) ফিরবে।’ (রিয়াদুস সলেহিন: ৯৩৫)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত