
উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দত্ত। এই লেখক সদ্য গত হয়েছেন। আর তাই সাক্ষাৎকারগ্রহীতা ও বন্ধ সাপ্তাহিকটির তখনকার নির্বাহী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকারের সম্মতিক্রমে আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।
তাপস কুমার দত্ত: ওপার বাংলার বাঙালিদের সঙ্গে এপার বাংলার বাঙালিদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যে পার্থক্য, সেটা যত দিন যাচ্ছে ততই কি দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: দুটো ঘটনা ঘটেছে এখানে, সেটা হচ্ছে—১৯৪৭ সালের আগে যে বাংলা, একত্র দুই বাংলা, যেখানের হিন্দু আর বাঙালিরা ছিল সম্পূর্ণ কলকাতামুখী। মুসলমান বাঙালিদের মধ্যে দুটো শ্রেণি ছিল—একটা শ্রেণি অত্যন্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ, শিক্ষিত লোক এবং বেশির ভাগই ছিল অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মুসলমান। এ অল্প ও অশিক্ষিত মুসলমানদের ওপর স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিরা ডমিনেট করল। ফলে যখন দেশ ভাগ হলো, তখন অল্পশিক্ষিত অশিক্ষিত মুসলমানেরা উল্লসিত হলো, কারণ, শিক্ষিত বাঙালিরা ভয় পেল, দু-একটা জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলো। আমি বাংলাদেশের অনেক জেলার কথা জানি, যেখানে আজ অবধি কোনো মানুষ খুন হয়নি দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে। যেমন ধরুন, রংপুর। সেখানে আজ অবধি কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত না ঘটা সত্ত্বেও রংপুর থেকে অনেক মানুষ চলে এসেছে ভারতবর্ষে। তখন এ রকম একটা প্রচারণা এসেছিল—পূর্ব পাকিস্তান মুসলমানদের জায়গা। অতএব, হিন্দুরা সেখানে থাকলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। তাই ছোটো ইন্ডিয়া। সেই ছোটার কাহিনিটা গত ৫৫ বছরের। সেই ছোটার কাহিনিতে অনেক মানুষ একেবারে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে তলিয়ে গেছে। আবার অনেক মানুষ সংগ্রাম করে করে ওপরে উঠেছে।...
তাপস কুমার দত্ত: এরপর থেকেও তো অনেক সংখ্যালঘু ওপারে চলে গেছে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এপার থেকেও গেছে, তবে তা আনুপাতিক হারে যথেষ্ট কম। যা বলছিলাম, এ ৫৫ বছরে যদি কেউ লাভবান হয়ে থাকে, আমি এপার বাংলার কথা বলছি—তা হলে হয়েছে পশ্চিম বাংলার মেয়েরা। এই যারা পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিল—সংগ্রাম করেছে, কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে, বস্তি বা কলোনিতে কোনোক্রমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে; তাদের দেখাদেখি পশ্চিম বাংলার কনজারভেটিভ পরিবার—যারা মেয়েদের অন্দরমহলে ফেলে রেখেছিল এবং অফিস-কাছারিতে যাওয়া তো স্বপ্নের বাইরে ছিল। যখন পূর্ববঙ্গের মেয়েরা জীবনসংগ্রামের বাধ্যবাধকতায় গ্র্যাজুয়েশন করে স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন অফিসে চাকরিতে ঢুকল; তখন এখানকার মেয়েরা উৎসাহিত হলো। আমরা যখন কলেজে পড়তাম; সন্ধ্যা ৬টার পর ট্রামে-বাসে কোনো মেয়েকে দেখা যেত না; যদি কোনো মেয়েকে দেখা যেত তা হলে সে নিশ্চয়ই বাঙাল (পূর্ববঙ্গীয়) হতো। কিন্তু এ পশ্চাৎপট একদম পাল্টে গেল ১৯৬৮ সালের পর থেকে। তখন বাস্তবিক নিষ্পেষণে পশ্চিম বাংলার মেয়েরাও বেরোতে শুরু করল, যেটা বলতে গিয়ে সরে এসেছি—সেটা হলো, এই দেশবিভাগ এবং এ দেশে উদ্বাস্তু স্রোত আসার অনেক খারাপ দিকের এই একটা ভালো দিক, আমাদের মেয়েরা অর্গল ভেঙে বেরোতে পেরেছিল। কিন্তু ওখানে (বাংলাদেশে) যারা রয়ে গেল (হিন্দু সম্প্রদায়) তাদেরও, আমরা দেখেছি, কেউ ১৯৬৭, কেউ ১৯৭০, কেউ ১৯৭৬-এ চলে আসতে লাগল।
তাপস কুমার দত্ত: এখনো কি অল্পবিস্তর চলে আসছে?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এখনো আসছে এবং এদের একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে এরা আওয়ামীপন্থী ছিল। অর্থাৎ এ দলটির কাছে ওরা নিরাপদ বোধ করত।
তাপস কুমার দত্ত: দেশভাগের পর ওপার বাংলার কী কী বিশেষ পরিবর্তন আপনার কাছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়েছে?
সমরেশ মজুমদার: ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এ ২৪ বছরে বাঙালির জীবনে পূর্ববঙ্গে একটা জিনিসেরই আমদানি ঘটেছে, সেটা হলো ইসলাম এবং ইসলামকেন্দ্রিক আরবি-ফারসি শব্দ। ওই সময় যাঁরা লেখালেখি করতেন, যেমন ধরুন—শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস—এঁরা যে বাংলা লিখতেন, তা ছিল পশ্চিম বাংলার বাংলা; অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারকৃত বাংলা। এঁরা বাংলার প্রাচীন সাহিত্য এবং রামায়ণ-মহাভারত ও আরও সব পৌরাণিক...প্রাচ্য ও পশ্চিমের সাহিত্যের ওপর ভালো দখল রাখতেন এবং সেটা তাঁদের ভেতরে লালন করতেন। ১৯৭১ সালের পর একটা আবেগ এল, আবেগের সঙ্গে ভয় এল। ভয়টা এই—আমরা এত দিন উনুনে পুড়ছিলাম, উনুন থেকে লাফিয়ে গরম তেলে পড়লাম না তো? অর্থাৎ আমরা পাকিস্তানের অত্যাচারে জর্জরিত হচ্ছিলাম, এখন ভারত বড়দাদার মতো দাদাগিরি করবে না তো? আমাদের দখল করবে না তো? তার কিছু কিছু ইন্ধন—আপনারা জানেন—ভারত যে সম্পূর্ণ বৈষ্ণব হয়ে ছিল তা নয়, ভারতের তরফ থেকে যারা দু-একটা বদমায়েশি কাজ করেছে, সেসব বাংলাদেশের কাছে প্রবল হয়ে ধরা দিল। ১৯৭১ সালের ওই আবেগ যখন কমতে শুরু করল, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর ওখানকার রাজনৈতিক দলগুলো জনসাধারণকে সস্তা পথে পাওয়ার জন্য অ্যান্টি-ভারত আবহাওয়া তৈরি করল এবং সেটা তাদের ভোট অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়কও হলো। এ সময় থেকে আমরা দেখতে শুরু করলাম, বাংলা সাহিত্যে যা লেখালেখি হচ্ছে, খবরের কাগজে রিপোর্টিংয়ে যে বাংলায় লেখালেখি হচ্ছে, সেখানে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। এর একটা উদাহরণ হলো জিম্মা। এ ‘জিম্মা’ শব্দটা আগে ওপার-এপার, কোনো বাংলায়ই ব্যবহৃত হতো না। যেমন খাবারটা খেয়ে দারুণ ‘মজা’ লাগল। এ ‘মজা’ শব্দটা হলো রসে-বসে আনন্দে আছি। তা খাবারটা খেয়ে ‘মজা’ লাগবে কেন আমার? খাবারটা খেয়ে আমার দারুণ ভালো লাগবে, অথবা আমি খুব আনন্দ পেলাম খেয়ে। কিন্তু ‘মজা’ লাগা বলতে কোথাও যেন একটু কৌতুক মেশানো থাকে। এ ধরনের কিছু শব্দ তৈরি হতে লাগল। এসব সচেতনভাবে তৈরি হতে লাগল, যাতে পশ্চিম বাংলার ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষা আস্তে আস্তে একটু একটু করে আলাদা হতে থাকে। আবার, আমরা দেখতে পাই, ১৯৬০ বা ’৬৫ সাল অবধি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের আগ অবধি যেকোনো মুসলিম পরিবারে আরবি বা ফারসি নাম দেওয়া হতো। কিন্তু এর পর থেকে দেখা গেল তাদের নামের পাশে ব্র্যাকেট করে একটা ডাকনাম দেওয়া হলো। ১৯৪০-৫০ সালের দিকে কোনো মুসলমানের ডাকনামের তেমন প্রচলন ছিল না। ক্রমে এ ডাকনামই তার হাইলাইটস পেত বেশি, আসল নামটা আড়ালে থাকত। যেমন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। আমরা সবাই জানি ‘বন্যা’। এটা কিন্তু পাশাপাশি সচেতনভাবে বাঙালিত্ব ধরে রাখার প্রচেষ্টা। এর পরবর্তী প্রজন্ম, সত্তরের দশক থেকে যে প্রজন্ম শুরু হলো—তারা আরও অদ্ভুত হলো। তাদের আবার নাম হয়তো আবুল হায়াত, মেয়ের নাম বিপাশা হায়াত বা সুবর্ণা মুস্তাফা। হায়াত বা মুস্তাফা তার পারিবারিক পদবি কিন্তু নামটা বাংলা শব্দ। অর্থাৎ আগে যেটা ব্র্যাকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেটা এখন নামের সাইনবোর্ডে এসে প্রকাশ হলো। পাশাপাশি আরও একটা অদ্ভুত ছবি আছে; ছবিটা হলো—চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মানুষ, ধরুন একজন মা; তার ছেলে হয়তো ঢাকায় চাকরি করে। তিনি যখন তার ছেলেকে চিঠি লিখছেন, তখন চট্টগ্রামের ভাষায় লিখছেন না। তিনি বইয়ের ভাষায় চিঠি লিখছেন এবং ছেলেও তা-ই করছে। কিন্তু ছেলে আর মায়ের যখন পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয়, তখন কিন্তু তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলেন, যা ঢাকার লোক বুঝবে না। তা হলে চিঠিতে কেন বাংলা বর্ণমালায় চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার করছে না? এ নিয়ে আমার নিজস্ব অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু এ বাঙালিত্ব বজায় রাখার জন্য একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি, একবার এক অনুষ্ঠানে একজন লোকের সঙ্গে—তাকে বাংলাদেশের মনে হওয়ায়—কথা বলতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বাংলাদেশের? কোন জেলায় বাড়ি?’ তিন-চারবার প্রশ্ন করার পরও কোনো উত্তর পেলাম না। লোকজন অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার, তুমিও বাঙালি, সে-ও বাঙালি অথচ একে অন্যের ভাষা বুঝতে পারছ না?’ আসলে সে সিলেটের বাঙালি। সে আমাদের ভাষা ভালোভাবে জানে না এবং নিজে যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষা আমাদের কাছে অজানা, তাই কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে। এই যে এত পার্থক্য—এসব পার্থক্যের সুযোগ নিয়েছে—আমার মনে হয়, কিছু ধর্মান্ধ মৌলবাদী, যাতে বাংলা ভাষাকে ভাঙা যায়, নষ্ট করা যায়। একটা নতুন ভাষা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধরুন, যদি মসজিদে যান, মসজিদে যে প্রার্থনা হয় তা বাংলায়। যেখানে একদম পরিষ্কারভাবে, ‘হে পরম পিতা!’—এভাবে শুরু করে।...‘আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি; আমাদের প্রিয়জন তোমার কাছে গিয়েছে, বাসা থেকে কেউ যদি বিদেশে যায়, তবে তার চিঠিপত্তর, টেলিফোনে খবর পাওয়া যায়। তিনি আজ যেখানে গেছেন, সেখানে এসব কোনো পথ নেই; কিন্তু আমরা জানি, তিনি তোমার কাছে গেছেন। অতএব, তুমি তাকে ভালো রাখবে...। আমিন!’ এ কথাগুলো অতি পরিষ্কার সিম্পল বাংলা কথা, এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না; অশিক্ষিত লোকও স্পষ্ট বুঝতে পারছে; কিন্তু ‘আমিন’ শব্দটা উচ্চারণ হওয়ামাত্র একটা অন্যরকম গন্ধ এল। আমিন কথাটা খ্রিষ্টানরা বলে। খ্রিষ্টানরা ‘পরম পিতা’ও বলে। কোরআনকে তো পৃথিবীর সব দেশের সব মুসলমান যথাযথ অনুসরণ করে না। আজকের পৃথিবীর সব মুসলমানের...বাংলাদেশের মুসলমানদের আইডিয়াল হচ্ছে ‘আরবি’ এবং আরবের লোকজন। অথচ আরবরা যে বুর্জোয়া জীবনযাপন করেন—মেয়েদের ক্ষেত্রে পার্টিকুলারলি—সেটা মানতে পারেন না ঢাকার মুসলমানরা; কিন্তু এরপরও ওরা আইডিয়াল। আজ যদি তুমি ঢাকা বা ফরিদপুরের রাস্তায় রোজার সময় যাও, তাহলে দেখবে, পর্দা টানিয়ে হোটেলে খাওয়াদাওয়া চলছে। অর্থাৎ পর্দা টানিয়ে দুপুরে খাওয়া যায়। আমার বন্ধুবান্ধব, যাঁরা আমার কাছে রোজার সময় আসছেন, তাঁরা প্রায়ই বলতেন, ভাই, আমি অসুস্থ, রোজা রাখতে পারছি না। কেউ বলতেন, আমি তো এখন পর্যটক! কারও হাঁটুতে ব্যথা, একটা অজুহাত, যেহেতু নামাজ পড়তে পারবে না...এসব অজুহাত বা ছুতো—এগুলো সবই কিন্তু বেরিয়ে আসার চেষ্টা। কিন্তু তারা ভয়ে থাকে, বেরিয়ে আসতে ভয় পায়। ফলে আমাদের সঙ্গে ওদের যে ডিফারেন্স, সেই ডিফারেন্সটা যথেষ্ট বড়। কারণ, আমরা যারা জন্মসূত্রে হিন্দু, তাদের ৮০ ভাগ হিন্দুধর্মের এ-বি-সি-ও পালন করি না। অথচ আমরা হিন্দু। বলতে হয়, তাই হিন্দু। আমাদের ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়ার মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মাচরণ নেই। দুর্গাপূজা এলে আমরা প্ল্যান করি কোথায় বেড়াতে যাব। পুজোর আচার-আচরণের মধ্যে আমরা নেই। আমরা নানা খাবার দিয়ে, বিস্কুট, চাল-ডাল, চকলেট দিয়ে মূর্তি গড়ি, ছেলেখেলার মতো। কালীপূজার সময় আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখি, পটকাবাজির ভয়ে। তাহলে আমরা হিন্দু হলাম কোথায়? আমরা ধর্ম থেকে সরে গেছি আস্তে আস্তে। তবে এ ধর্ম আমাদের কিছু দেয় না, আমাদের থেকে কিছু নেয়ও না। যখন রামকে নিয়ে সারা ভারতে এত হইচই কাণ্ড চলত, তখন আমরা পশ্চিম বাংলার মানুষজন রামকে একবারও দেবতা বলে মনে করি না। আমরা হনুমানকে দেখে ঠাট্টা করি, ‘কলা খাবি’ বলে। কিন্তু হনুমান ওদের কাছে ঈশ্বরের অবতার। ঘটনা যখন এ রকম ঘটে যায়, তখন বাংলাদেশের মুসলমান যারা; যারা সত্যিকার অর্থে কোরআন মানে, ধর্মান্ধ নয়, তারা কিন্তু আমাদের থেকে অনেক ডিসিপ্লিনড। ধর্ম ডিসিপ্লিন তৈরি করতে সাহায্য করে। ধর্ম একত্র করে মানুষকে। কিন্তু সেই একত্র করার মাঝখানে ধর্মান্ধ বা ধর্ম ব্যবসায়ীরা যত গণ্ডগোল পাকায়। ফলে আমাদের মধ্যে ক্রমেই পার্থক্য বাড়ছে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার কি মনে হয়, কয়েক দশক আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে রাজনীতিতে যে রকম মন্দির-মসজিদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, তাতে করে আগামী কয়েক দশক পর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রকম ধর্মরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে?
সমরেশ মজুমদার: আমার তো উল্টো মনে হয়। আমার মনে হয়, ধর্মান্ধ যারা—সে হিন্দু বা মুসলমান হোক, খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা কখনো শুনিনি। যদিও ক্রিশ্চিয়ানিটি পৃথিবীজুড়ে ছিল, কিন্তু আজ অবধি খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা শুনিনি, বৌদ্ধ ধর্মান্ধ শুনিনি।
তাপস কুমার দত্ত: ইউরোপে এককালে খ্রিষ্টানরাই ব্লাসফেমির মতো ঘৃণ্য আইন ধর্মের বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছিল—ওসব কি ধর্মান্ধতা নয়?
সমরেশ মজুমদার: খ্রিষ্টানরা এখন অনেক শ্রেণির হয়ে গেছে, সেখানে তারা একত্র নয়।
তাপস কুমার দত্ত: না, সেটা অন্য ব্যাপার, প্রশ্নটা হলো...
সমরেশ মজুমদার: আমাদের ভারতবর্ষেও তো হিন্দু ধর্ম একেক জায়গায় একেক রকম। আপনি সাউথ বা নর্থ ইন্ডিয়ায় বা অন্য প্রান্তে যে হিন্দু ধর্ম দেখবেন, তা পশ্চিম বাংলায় পাবেন না; এক জায়গার সঙ্গে অন্য জায়গায় ধর্মীয় অমিলই বেশি।
তাপস কুমার দত্ত: প্রশ্নটা তা নয়। একটা ধর্ম সম্প্রদায় নানা খণ্ডে বহু ধারায় বিভক্ত হতেই পারে। কিন্তু যেকোনো ধারারই একটা প্রচ্ছন্ন গোঁড়ামি আছে, মৌলবাদ আছে; আর সেটাই দিন দিন বিশ্বের ওপর বেশি পরিমাণে চেপে বসছে। আপনি কী মনে করেন?
সমরেশ মজুমদার: না, আমি এর সঙ্গে একমত নই। আমার তো মনে হয়, ধর্ম পৃথিবী থেকে আস্তে আস্তে লোপ পেতে চলেছে। এখন যে চিৎকারটা আমরা শুনতে পাচ্ছি—কারণ, ধর্মবাদীরা আতঙ্কগ্রস্ত বলে চিৎকার করছে।
তাপস কুমার দত্ত: প্রথাগত ধর্মে আপনার বিশ্বাস কতটুকু?
সমরেশ মজুমদার: আমি ধর্মে একদম বিশ্বাসী নই।
তাপস কুমার দত্ত: আর বিবাহ প্রথায়?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, বিবাহ প্রথায় বিশ্বাসী। তবে বিয়ে কীভাবে হবে, সেটা নির্ভর করছে যারা বিয়ে করছে, তাদের ওপর।
তাপস কুমার দত্ত: তৃতীয় বিশ্বে বসবাস করার একটা মানসিক যন্ত্রণা আছে। বিশেষ করে, শিল্পী-সাহিত্যিক...যেকোনো সৃজনশীল মানুষের। আপনি তা কতটা অনুভব করেন?
সমরেশ মজুমদার: এটা ভারতবর্ষে, মানে পশ্চিম বাংলায় নেই, আমি কখনো অনুভব করিনি। এটা গুজরাটে থাকতে পারে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার লেখালেখিতে বা ভাবনায় কখনো সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনো প্রতিবন্ধকতা আসেনি বলছেন?
সমরেশ মজুমদার: সিপিএম যখন ক্ষমতায় এল, তখন আমি নকশাল আন্দোলন নিয়ে উপন্যাস লিখলাম—কালবেলা। তো কালবেলার নায়ক অনিমেষ তখন কিন্তু সিপিএমের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। বলেছে, সিপিএম ভ্রষ্টাচারী। আমাকে কিন্তু ও রকমভাবে কোনো সরকার বা শক্তি আপত্তি করেনি।
তাপস কুমার দত্ত: নিজের বিচারে আপনার প্রিয় লেখা কোনটি?
সমরেশ মজুমদার: তিনটি লেখা আমার খুব প্রিয়। সেটা হচ্ছে—‘উত্তরাধিকার’...
তাপস কুমার দত্ত: এ সিরিজটা? অর্থাৎ ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’?
সমরেশ মজুমদার: না, ‘কালবেলা’ আমার প্রিয় নয়। ‘এখনও সময় আছে’ বলে আমার একটা উপন্যাস আছে, আমার ভীষণ প্রিয়। আর গত বছর আমি ‘দেশ’-এ একটা উপন্যাস লিখেছি—‘উৎসারিত আলো’—এ তিনটি।
তাপস কুমার দত্ত: লেখালেখিতে কতটা অসন্তুষ্টি বা অতৃপ্তি রয়ে গেছে?
সমরেশ মজুমদার: প্রতিটি লেখায়ই আমার অসন্তুষ্টি রয়ে যায়। আমার মনে হয়, আবার লিখলে ভালো করতাম। কিন্তু একবার বই আকারে...।

তাপস কুমার দত্ত: সেটা ওই বইটার নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর। আমার জিজ্ঞাসা হলো, এমন কোনো প্রিয় লেখা কি আপনার ভেতরে লালিত আছে, যা এখনো আপনি লিখে উঠতে পারেননি?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এই যে আপনাকে এর আগে যে কথাগুলো বললাম। আমি হুমায়ূন (আহমেদ)-কে বারবার বলেছিলাম, দ্যাখো, তুমি এত জনপ্রিয় একজন লেখক, তোমার এত হাজার হাজার বই বিক্রি হয়, তোমার তো এখন হারানোর কোনো ভয় নেই। তা তুমি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ২০০৪ সালের এই সময়কাল পর্যন্ত কয়েকটা খণ্ডে লেখো না, উপন্যাস আকারে। সে বলল, আমার লিখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সাহস পাই না। আমি অ্যাকসিডেন্টলি আপনাদের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিচিত ছিলাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আমার কাছে এরশাদ খুব কালারফুল চরিত্র। ঘৃণ্য, কিন্তু কালারফুল। কেউ ওর সঙ্গে দেখা করার সাহস পায়নি, যেতে চায়নি; আমি গিয়েছিলাম ওর আমন্ত্রণে। আমার বিপুল অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এটা নিয়ে তিনটি পর্বে ভাগ করে লিখতে আমার খুব ইচ্ছা হয়। ১৯৪৭ থেকে ’৬৯, শেখ মুজিবুর যখন স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, সেই অবধি। এরপর ১৯৬৯ থেকে ’৭১ এবং ’৭১ থেকে এখন অবধি। এ তিনটি পর্বে বাংলাদেশের পটভূমিতে যদি পারি, তো কখনো লিখব। আমি জানি, এ লেখা এই সরকার থাকলে ওখানে যাবে না।...এই যে দ্যাখো, ‘এত রক্ত কেন’ বইটা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে; ঢাকার ফুটপাতে কিন্তু বইটা পাওয়া যায়। তো ব্যান্ড করে লাভটা কী হলো?
তাপস কুমার দত্ত: এ বইটার জন্য বাংলাদেশের একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে ও-দেশে যাওয়ার ভিসা আপনাকে আটকে দেওয়া হয়। এখন যদি এ জাতীয় সমস্যা না থাকে, তা হলেও কি বাংলাদেশে যেতে কোনো আপত্তি থাকবে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি জানি, এ সরকার যদি এটা তুলেও দেয়, তবু সরকারের যারা অনুচর, তারা আমাকে আক্রমণ করবে।
তাপস কুমার দত্ত: অর্থাৎ আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন?
সমরেশ মজুমদার: অফ কোর্স। আমি শেষবার যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, তখন এত রক্ত কেন বেরিয়েছে, কিন্তু ব্যান হয়নি; সেদিন ঢাকায় এয়ারপোর্টে নেমেই বেশ সমস্যায় পড়েছিলাম। আমাকে নিয়ে অফিসাররা হঠাৎ তটস্থ হয়ে উঠলেন, কেন আমি এসেছি? কী উদ্দেশ্যে এসেছি? তো, আমাকে রিসিভ করতে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদ। আমাকে নিয়ে সে সোজা চলে গেল নুহাশ পল্লীতে। ওখানে তিন রাত ছিলাম। এরপর রাতের অন্ধকারে ঢাকায় এলাম।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অন্য কোনো ভয় পাচ্ছিলেন?
সমরেশ মজুমদার: পুলিশ বোধ হয় ভাবছিল, আমাকে অ্যারেস্ট করা উচিত কি উচিত না। একদিন একটা অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে সেখান থেকে সোজা এয়ারপোর্টে। এরপর আমি যখন অনুষ্ঠানে যাওয়ার পরবর্তী আমন্ত্রণ পেলাম, তখন তারা আমাকে ভিসা দিল না।
তাপস কুমার দত্ত: এখন আপনি কী ধরনের বই পড়ছেন?
সমরেশ মজুমদার: কয়েক দিন আগে ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ হুমায়ুন আজাদের বইটা সকাল থেকে পড়তে শুরু করেছিলাম। সেদিনই সকাল ৯টায়—বইটা পড়ছি, হাতে; খবর এল হুমায়ুন আজাদ মারা গেছেন। ওই বইটাতেই একটা জায়গায় লেখা ছিল, যেকোনো দিন তার মৃত্যু হতে পারে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। এ বইটা খুব বড় বা দামি লেখা নয়। খুব আবেগের লেখা, একই কথা বারবার লেখা; কিন্তু কথাগুলো লিখতে সাহস পায়নি তেমন কেউ।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি কি তাঁর আর কোনো উপন্যাস পড়েছেন?
সমরেশ মজুমদার: একটা পড়েছিলাম অনেক আগে, নামটা ভুলে গেছি। দাঁড়াও, নামটা মনে করি...
তাপস কুমার দত্ত: ‘শুভব্রত’, তার সম্পর্কিত সুসমাচার?
সমরেশ মজুমদার: না, আর কয়েকটা নাম বলো তো।
তাপস কুমার দত্ত: ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, সবকিছু ভেঙে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, হ্যাঁ, ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, বইগুলো বেশির ভাগ সময়ই কলকাতায় সহজে পাওয়া যায় না।
তাপস কুমার দত্ত: বয়স তো যথেষ্ট হলো। একদিন চলে যেতে হবে, তার দিনক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে...কোনো আতঙ্ক বা আক্ষেপ?
সমরেশ মজুমদার: না, না। আজ রাতেও চলে যেতে পারি; আবার হয়তো দশ বা কুড়ি বছর পরও যেতে পারি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অবশ্যই দীর্ঘায়ু হবেন, আমি এর দার্শনিক দিকটা জানতে চাচ্ছি।
সমরেশ মজুমদার: আমি খুব বাস্তববাদী মানুষ। আমি আজকে লেখালেখি করে যেটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি, সেটুকু আমার পাওয়ার কথা ছিল না। আমার লেখক হওয়ারই কথা ছিল না।
তাপস কুমার দত্ত: অনেক বছর আগে বাংলাদেশের একটা সাপ্তাহিক কাগজে আপনি বলেছিলেন, এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেবেন।
সমরেশ মজুমদার: ওসব কথা বাড়িয়ে লিখতে ভালোবাসে কিছু সাংবাদিক। যেমন অন্য একটা জায়গায় আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তসলিমার ‘ক’ পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে? আমি এর উত্তরে বলেছিলাম, আমি ‘ক’ পড়েছি এবং আমার মনে হয়েছে, একটা বারবনিতাকে যদি বলা হয়, তোমার আত্মজীবনী লেখ, সে তার অনেক কষ্টের কথা লিখবে; কিন্তু যেসব ক্লায়েন্ট তার কাছে আসে, তাদের বিস্তৃত পরিচয় দেবে না সে, এটুকু সৌজন্য দেখাবে। এ উত্তরটা তারা এভাবে লিখেছে যে, সমরেশ মজুমদার বলেছেন, তসলিমা নাসরিন বেশ্যা। এর উত্তরে তসলিমা লিখলেন আনন্দবাজারে, সমরেশ মজুমদারের গলায় গলা মিলিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, তসলিমা বেশ্যা। এর উত্তরে আমি আবার চিঠি লিখলাম আনন্দবাজারে—কোথায়, কখন বলেছি? কাকে বলেছি? যদি দয়া করে আমাকে জানানো হয়...। অতএব, যদি কোথাও কখনো লেখা হয়ে থাকে, আমি বলেছি এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেব—এগুলো বাজে কথা। হয়তো এভাবে বলেছি, লিখে টাকা পাওয়া যায়, জানতাম না। যখন লিখে টাকা পেতে শুরু করলাম, তখন আমাকে যদি বলা হয়, কেন লেখেন? আমি বলি, টাকার জন্য লিখি।
তাপস কুমার দত্ত: কথাটা এভাবে বলেছিলেন, একজন কৃষক যে কারণে চাষাবাদ করেন, একজন...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম, একজন কৃষক যখন চাষাবাদ করেন, তিনি তো দেশ গড়ার জন্য চাষ করেন না; তিনি তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য চাষাবাদ করেন। একজন মাস্টার যখন পড়ান, তখন মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার চেয়ে তার সন্তানসন্ততিকে বড় করার জন্য পড়ান। তো, একজন লেখকের কী দায় আছে, তিনি দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন? আমাদের দেশে কোনো লেখক যদি জনপ্রিয় হন, তখন ধরেই নেওয়া হয়, ওগুলো ভুসিমাল। যদি সে ধরনের লেখক জনপ্রিয়তা না পান বা বিক্রি না হয়, তখন তিনি একজন বিরাট লেখক। প্রশ্ন হলো, জনপ্রিয়তা যদি কেউ বেশি পান, কেন পান? কারণ, পাঠকদের ভালো লাগছে বলেই। কোনো একটা বই হয়তো বেশি পাঠকের ভালো লেগেছে। এমন নয় যে বছরের পর বছর তিনি জনপ্রিয় হয়ে থাকেন। তা হলে যিনি পাঠককে সহজে স্পর্শ করতে পারছেন না, তার কোথাও খুঁত আছে নিশ্চয়ই। ভালো একটা ছবি তিন দিন সিনেমা হলে থেকে চলে গেল। আর একটা ছবি ‘বাবা কেন চাকর’ মাসের পর মাস চলল, জনপ্রিয় হলো। আবার ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর যখন হাজারটা শো চলে, তখন বলতেই হয়, গুপী গাইন বাঘা বাইন খারাপ ছবি? চার্লি চ্যাপলিন তা হলে খারাপ ছবির নাম? ‘পথের পাঁচালী’ও ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল—ওটাও তা হলে খারাপ ছবি?

তাপস কুমার দত্ত: ধরুন, হাইপোথেটিক্যালি আমরা ধরে নিলাম, কোনো ধনকুবের আপনার যাবতীয় চাহিদার স্পন্সরশিপের দায়িত্ব নিল। একজন কৃষক যে কারণে কৃষিকাজ করেন বা আর দশজন পেশাজীবী মানুষ যে কারণে পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, সেই প্রয়োজনটা আপনার আর রইল না। তখন কি লেখালেখি আপনি ছেড়ে দেবেন?
সমরেশ মজুমদার: চাহিদার কিন্তু শেষ নেই। আগে বাস-ট্রামে চড়তাম, আমার এখন বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। এখনো অবশ্য ইচ্ছা করে মাঝেমধ্যে বাস-ট্রামে উঠি। তো, আগে আমি জলপাইগুড়ি আমার বাড়ি যেতাম সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে, রিজারভেশন ছাড়া। এরপর রিজারভেশনে। এরপর এসি থ্রি-টিয়ার, এরপর এসি টু-টিয়ার। এর মানে এই নয়, আমি এখন এসি টু-টিয়ার ছাড়া যেতে পারব না। কিন্তু যদি কমফোর্ট পাই, তা আমি নেব না কেন?
তাপস কুমার দত্ত: আমি বলতে চাচ্ছি, শুধু ভরণপোষণ আর কমফোর্ট—এসব কারণেই লেখালেখি? ভোগবাদী ব্যাপার ছাড়া তা কি নিজের ভেতর থেকে উঠে আসে না?
সমরেশ মজুমদার: শুনুন, আমাকে যদি এক কোটি টাকা দেওয়া হয় একটা উপন্যাস লেখার জন্য—সাত দিন চেষ্টা করেও লিখে উঠতে পারব না। আবার, আমাকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি, আমি লিখতে বসলাম, হয়তো দুদিনেই লেখাটা শেষ করে ফেলতে পারব।
তাপস কুমার দত্ত: তা হলে লেখালেখিটা শুধু হালচাষির হালচাষের মতো জীবিকা নির্বাহ নয়, আলাদা একটা ভেতরের তাগিদও...
সমরেশ মজুমদার: অবশ্যই।
তাপস কুমার দত্ত: বেশির ভাগ জনপ্রিয় লেখকের লেখায় দেখা যায়, কতগুলো পাগলামোর ঘটনা, কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনা, কিছু সুখকর ঘটনা ও একটু বেদনাদায়ক ঘটনা। যেন ছাঁচে ঢেলে গরম তেলে ভেজে তোলা হট কেক...
সমরেশ মজুমদার: এটা আমার কাছে খুব অস্পষ্ট। ধরুন, আমার একটা বই, ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে এক লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। সেই বইটা কলকাতায় ৫০-৬০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। ধরে নিতে পারি, বইটা জনপ্রিয়।
তাপস কুমার দত্ত: বইটার নাম কী?
সমরেশ মজুমদার: ‘গর্ভধারিণী’। তা ওটা কোন ফর্মুলায় লেখা, বলুন তো?
তাপস কুমার দত্ত: ওই বইটাতে আসলে এমন একটা সাসপেন্স বা থ্রিল এবং এর সঙ্গে আবেগ, বর্তমান সমাজব্যবস্থার কিছু মানুষের অমানবিক নোংরা দিকের প্রতি...।
সমরেশ মজুমদার: এসব তো অনেক বইতেই আছে।
তাপস কুমার দত্ত: হ্যাঁ, তা ঠিক, ‘মেঘ ছিল, ‘বৃষ্টিও’-তেও আছে। ‘আট কুঠুরী নয় দরজা’তেও।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে সেগুলো ওভাবে বিক্রি হয়নি কেন?
তাপস কুমার দত্ত: না, আমি বলছি ‘গর্ভধারিণী’র মতো বিশাল জনপ্রিয়তা না পেলেও ওই লেখাগুলোও বেশ জনপ্রিয়।
সমরেশ মজুমদার: যদি জানতাম, গর্ভধারিণীর মতো ওভাবে সাসপেন্স মেশালে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হবে, তা হলে তো সব বই ওভাবেই লেখা হতো। তা হলে ‘সাতকাহন’ কেন এত বিক্রি হলো? স্ট্রাগল করা মেয়েদের গল্প তো আমি আগেও লিখেছি, পরেও লিখেছি, সেগুলো কেন সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হলো না? আমি যদি আরেকটা দীপাবলীকে নিয়ে লিখি, সেটা কি সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হবেই?
তাপস কুমার দত্ত: সাতকাহনের দ্বিতীয় পর্ব কিন্তু প্রথম পর্বের মতো অত জনপ্রিয় নয়।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে? আসলে আমার কাছে মনে হয়, যেকোনো...আমি আপনাকে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখাটার কথা বললাম, ‘এখনো সময় আছে’ বইটা তিন থেকে চার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। লোকে না পড়লে আমার কষ্ট হয়, আমি তো লোকে লোকে গিয়ে বলতে পারি না, আপনি বইটা পড়ুন। কোত্থেকে ‘কালবেলা’ এক লাখ কপি বিক্রি হলো! ‘উত্তরাধিকার’ বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার। অথচ উত্তরাধিকার ওটার চেয়ে অনেক বেটার উপন্যাস। তাই কোন লেখাটা জনপ্রিয় হবে, তা আগে থেকে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। একটা লেখা জনপ্রিয় হতে পারে। একটা মেমসাহেব, একটা দৃষ্টিপাত, একটা মরুতীর্থ হিংলাজ জনপ্রিয় হতে পারে। কয়েকটা নয়।
তাপস কুমার দত্ত: ওপারের লেখকদের লেখা সম্পর্কে...
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, ওপারের এক নম্বরের সঙ্গে দুই নম্বরের ব্যবধান এত বিস্তর...জাফর ইকবাল সম্প্রতি সেই ব্যবধান একটু কমিয়ে এনেছেন। তো, গতবার যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, তখন একজন লেখক আমাকে এসে বললেন, সমরেশ দা, আপনাকে একটা ভালো খবর দিই।
আমি বললাম, কী?
বলল, আমি এখন তিন নম্বরে।
আমি জানতে চাইলাম, কিসের তিন নম্বর? সে জানাল, জনপ্রিয়তার। তার পেছনে নাকি মিলন চলে গেছে, অমুক-তমুক অনেকে চলে গেছে। আমি হাসব না কাঁদব, ভেবে পাচ্ছিলাম না।
তাপস কুমার দত্ত: কে?
সমরেশ মজুমদার: নামটা নাই-বা বললাম।
তাপস কুমার দত্ত: বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের রুচিবোধ আপনার কতটা উঁচুদরের বলে মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: আপনি যা ইচ্ছা তা-ই লিখে পাঠকদের ভোলাতে পারবেন না। পাঠকদের বিচারশক্তি দারুণ প্রখর। একটা লেখা দিয়ে ভোলাতে পারবেন, পরের দুটোয় হাফ ভোলাতে পারবেন; তৃতীয়টায় আর পারবেন না।
তাপস কুমার দত্ত: পাঠকেরা আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমাকে তেমন প্রভাবিত করতে পারে না। তবে কিছু কিছু ঘটনায় মাঝেমধ্যে কষ্ট হয়। একবার বইমেলায় এক ভদ্রমহিলা তিনখানা (বড় ক্যানভাসের) বই বইতে পারছিলেন না, চেহারা দেখে বোঝা যায়, যথেষ্ট (আর্থিক) অসচ্ছল পরিবার। আমি বললাম, আপনি কী করেন?
তিনি বললেন, আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়াই।
আমার খুব খারাপ লাগল, আপনি এত দামি তিনটি বই কিনলেন?
তিনি বললেন, সারা বছর আমরা অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছি।
এরপর দেখলাম, দূরে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। ক্রাচ হাতে, একটা পা ডিফেক্টেড। ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে যেতেই তিনি বললেন, আমি আপনার অনিমেষ।
আমি বললাম, তার মানে?
তিনি জানালেন, তিনি নকশাল আন্দোলন করতেন এবং হাওড়া জেলে পুলিশের অত্যাচারে একটা পা নষ্ট হয়ে (অনিমেষের মতোই) গেছে। আমরা একসঙ্গে থাকি। (অনিমেষ-মাধবীলতার মতো), আমরা বিয়ে করিনি।
আরেকটা ঘটনা বলে শেষ করি—হ্যাঁ, একবার বিদেশে রাতে আমার খুব খিদে পেয়েছে, একটা বড় রেস্টুরেন্ট দেখে ভেতরে ঢুকে পড়ি। এরপর মেনু কার্ডের সবচেয়ে ছোট আইটেম যেটা, সেটার অর্ডার দিলাম। বেয়ারাগুলোকে দেখে মনে হলো এশিয়ান। তো, একটা বেয়ারা এসে বলল, স্যার! আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?
আমি বললাম, ইয়েস।
স্যার! আর ইউ ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল?
আমি আবার বললাম, ইয়েস।
বেয়ারা গিয়ে হোটেল মালিককে তথ্যগুলো জানাতেই হোটেল মালিক উঠে এসে বললেন, নমস্কার স্যার! আপনি বোধ হয় সমরেশ বাবু। আমি আপনার একটাই মাত্র বই পড়েছি। একবার একটা বাস টার্মিনালে দেখলাম একটা বই পড়ে আছে—বাংলা বই, নামটা ‘দৌড়’।
এরপর যতই বলছি, আমার খাওয়া হয়ে গেছে, তবু তিনি আমাকে জোর করে খাওয়াবেন। বিল দিতে গেলাম, বিল নিলেন না। এই অবধি ঠিক আছে। বেয়ারা এরপর বলল, সাহেব, একবার ভেতরে আসবেন? আপায় কইছিল, আপনি সমরেশ মজুমদার কি না জিজ্ঞেস করতে। তো, আমি ভেতরে ঢুকলাম। একজন ভদ্রমহিলা খাটের ওপর বসে নমস্কার জানিয়ে আমার দিকে একটা বই এগিয়ে দিলেন—‘গর্ভধারিণী’। আমার পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। দেখুন, কারোর জানার কথা নয়, আমি ওখানে যাব। কাকতালীয়ভাবে।
তাপস কুমার দত্ত: একবার কবি সম্মেলনে আপনাকে দেশের বাইরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল—কবি হিসেবে, ভুল করে। ঠিক এ রকমই একটা ঘটনার কথা...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আপনি সবই জানেন দেখছি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি বই বাজেয়াপ্ত করাটা কতটা সমর্থন করেন?
সমরেশ মজুমদার: যে কারণে তসলিমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, সেটাকে আমি সমর্থন করি না। তবে আমার হাতে আইন থাকলে তসলিমাকে অভিযুক্ত করতাম। আজ একটা ছেলের সঙ্গে একটা মেয়ের ভালো সম্পর্ক; সম্পর্কটা দুজনকেই আনন্দিত করছে। যদি ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো তিক্ততা আসে, আজকের এ আনন্দটা কিন্তু মিথ্যা হয়ে যাবে না এবং সেই ছেলেটা ও মেয়েটার কোনো রাইট নেই ভবিষ্যতে এই আনন্দিত সম্পর্ককে নিয়ে খোলামেলা...ব্যঙ্গ করে লেখা বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে লেখা। যে ক্ষেত্রে তারা একে অন্যকে ছোট ও অপমান করছে। মিলনের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গিয়ে কী হয়েছে বা অমুকের সঙ্গে অমুকের আর কী হয়েছে—এর ডিটেইলস নিয়ে আমরা আদৌ আগ্রহী নই। আমরা তসলিমার ব্যাপারে এখানেই আগ্রহী যে সে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কী লড়াই করেছিল। তা না করে তার শারীরিক আনন্দের বিবরণ দিয়ে লিখছে—এটা এক ধরনের অসুখ। আমি জানি, আমার বাবা-মায়ের মিলনের ফলে আমি পৃথিবীতে এসেছি; এখন সেই মিলনটা কী রকম ছিল, তার বিবরণ দিয়ে যদি লিখতে যাই, তো আমার জন্মটাকেই আমি সবচেয়ে বেশি কুৎসিত করছি। আমার জন্মের বিবরণের জন্য আমার বাবা-মায়ের শয্যা বিবরণ কি আমি দিতে পারি? নাকি তা আমি ভাবতে চাই? বা ভাবতে পারি?
তাপস কুমার দত্ত: আপনি আপনার খোলামেলা বা বিতর্কিত ভাবনা প্রকাশ করতে কতটা ভয় পান?
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, এ মুহূর্তে বোধ হয় আমিই সবচেয়ে সরাসরি লিখি। ‘পত্রপাঠ’ বলে একটা পত্রিকা আছে, মাসে বেরোয়—সেটায় আমি কলাম লিখি। সেখানে সরাসরি সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে লিখি। একজন কলেজ অধ্যাপককে পুলিশ অ্যারেস্ট করে—জনযুদ্ধগোষ্ঠীর ডায়েরি থেকে নাম পেয়ে তাকে অ্যারেস্ট করে। সারা দিন অত্যাচার করে সন্ধ্যায় তাকে ছেড়ে দেয়। এলাকার লোকজন মনে করে, সে জনযুদ্ধগোষ্ঠীর লোক। সে রেললাইনে আত্মহত্যা করে, তার স্ত্রী এ নিয়ে কেস করে। এ ঘটনা নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। আমি এ-ও লিখেছিলাম, কয়েক দিন আগে ভোটের সময় একজন সাংবাদিক একটা গ্রামে গেছেন। সেখানে এক চায়ের দোকানে নানা আলোচনায় উঠে আসে, আমাদের দেশে যত মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই অবিবাহিত। বিবাহিত ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়, জ্যোতিবাবু। সিদ্ধার্থবাবু, জ্যোতিবাবু কখনো বাজারে যাননি। বুদ্ধবাবু রিকশায় চাপেন, বাজারে যান। আর নামটা দেখুন, বুদ্ধদেব।...বিধানচন্দ্র, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থ হচ্ছে সংসারী নাম।...এ রকম নাম যার, তাকে আমরা ভোট দেব না, তো অন্য লোককে ভোট দেব? সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কেমন আছেন? ওরা বলল, এই যে রাস্তাটা দেখছেন, এর নাম সুচেতনা (‘সুচেতনা’ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মেয়ের নাম)। আমাদের এখানে একটা ভাটিখানা আছে, খুব মারপিট চলত আগে, মদ খেতে খেতে। আমরা সেটার নাম দিয়েছি সুচেতনা...বাংলা বারের প্রতিশব্দ আর কি। ওখানে মদ খেয়ে এখন আর কেউ চেতনা হারাচ্ছে না। ফলে বুঝতেই পারছেন, আমরা সবই বুদ্ধবাবুর লোক। এ গল্পটা বের হওয়ার পর বুদ্ধবাবু আমায় বললেন, আমাকে নিয়ে লিখলেন, ঠিক আছে; আমার মেয়েকে জড়ালেন কেন? আমি বললাম, ‘হাওড়ার একটা লাইব্রেরি উদ্বোধন করতে তোমার মেয়ে আর তোমার স্ত্রী গিয়েছিলেন, লাইব্রেরিটার নাম রাখা হয়েছে সুচেতনা পাঠাগার। তোমার মেয়ে এখনই এমন কী যোগ্যতা অর্জন করেছে যে তার নামে একটা পাঠাগার রাখা হবে? যেহেতু সে তোমার মেয়ে, তাই রাখা হয়েছে।’ এখন, আপনি কী মনে করেন না, এর চেয়ে সরাসরি আক্রমণ করে লেখা—আর বড়াই করে বলি, আমাদের কোনো লেখকই লিখছেন না। লিখতে পারেন, কিন্তু লিখছেন না।
তাপস কুমার দত্ত: এত সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সমরেশ মজুমদার: থ্যাঙ্ক ইউ।

উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দত্ত। এই লেখক সদ্য গত হয়েছেন। আর তাই সাক্ষাৎকারগ্রহীতা ও বন্ধ সাপ্তাহিকটির তখনকার নির্বাহী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকারের সম্মতিক্রমে আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।
তাপস কুমার দত্ত: ওপার বাংলার বাঙালিদের সঙ্গে এপার বাংলার বাঙালিদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যে পার্থক্য, সেটা যত দিন যাচ্ছে ততই কি দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: দুটো ঘটনা ঘটেছে এখানে, সেটা হচ্ছে—১৯৪৭ সালের আগে যে বাংলা, একত্র দুই বাংলা, যেখানের হিন্দু আর বাঙালিরা ছিল সম্পূর্ণ কলকাতামুখী। মুসলমান বাঙালিদের মধ্যে দুটো শ্রেণি ছিল—একটা শ্রেণি অত্যন্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ, শিক্ষিত লোক এবং বেশির ভাগই ছিল অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মুসলমান। এ অল্প ও অশিক্ষিত মুসলমানদের ওপর স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিরা ডমিনেট করল। ফলে যখন দেশ ভাগ হলো, তখন অল্পশিক্ষিত অশিক্ষিত মুসলমানেরা উল্লসিত হলো, কারণ, শিক্ষিত বাঙালিরা ভয় পেল, দু-একটা জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলো। আমি বাংলাদেশের অনেক জেলার কথা জানি, যেখানে আজ অবধি কোনো মানুষ খুন হয়নি দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে। যেমন ধরুন, রংপুর। সেখানে আজ অবধি কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত না ঘটা সত্ত্বেও রংপুর থেকে অনেক মানুষ চলে এসেছে ভারতবর্ষে। তখন এ রকম একটা প্রচারণা এসেছিল—পূর্ব পাকিস্তান মুসলমানদের জায়গা। অতএব, হিন্দুরা সেখানে থাকলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। তাই ছোটো ইন্ডিয়া। সেই ছোটার কাহিনিটা গত ৫৫ বছরের। সেই ছোটার কাহিনিতে অনেক মানুষ একেবারে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে তলিয়ে গেছে। আবার অনেক মানুষ সংগ্রাম করে করে ওপরে উঠেছে।...
তাপস কুমার দত্ত: এরপর থেকেও তো অনেক সংখ্যালঘু ওপারে চলে গেছে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এপার থেকেও গেছে, তবে তা আনুপাতিক হারে যথেষ্ট কম। যা বলছিলাম, এ ৫৫ বছরে যদি কেউ লাভবান হয়ে থাকে, আমি এপার বাংলার কথা বলছি—তা হলে হয়েছে পশ্চিম বাংলার মেয়েরা। এই যারা পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিল—সংগ্রাম করেছে, কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে, বস্তি বা কলোনিতে কোনোক্রমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে; তাদের দেখাদেখি পশ্চিম বাংলার কনজারভেটিভ পরিবার—যারা মেয়েদের অন্দরমহলে ফেলে রেখেছিল এবং অফিস-কাছারিতে যাওয়া তো স্বপ্নের বাইরে ছিল। যখন পূর্ববঙ্গের মেয়েরা জীবনসংগ্রামের বাধ্যবাধকতায় গ্র্যাজুয়েশন করে স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন অফিসে চাকরিতে ঢুকল; তখন এখানকার মেয়েরা উৎসাহিত হলো। আমরা যখন কলেজে পড়তাম; সন্ধ্যা ৬টার পর ট্রামে-বাসে কোনো মেয়েকে দেখা যেত না; যদি কোনো মেয়েকে দেখা যেত তা হলে সে নিশ্চয়ই বাঙাল (পূর্ববঙ্গীয়) হতো। কিন্তু এ পশ্চাৎপট একদম পাল্টে গেল ১৯৬৮ সালের পর থেকে। তখন বাস্তবিক নিষ্পেষণে পশ্চিম বাংলার মেয়েরাও বেরোতে শুরু করল, যেটা বলতে গিয়ে সরে এসেছি—সেটা হলো, এই দেশবিভাগ এবং এ দেশে উদ্বাস্তু স্রোত আসার অনেক খারাপ দিকের এই একটা ভালো দিক, আমাদের মেয়েরা অর্গল ভেঙে বেরোতে পেরেছিল। কিন্তু ওখানে (বাংলাদেশে) যারা রয়ে গেল (হিন্দু সম্প্রদায়) তাদেরও, আমরা দেখেছি, কেউ ১৯৬৭, কেউ ১৯৭০, কেউ ১৯৭৬-এ চলে আসতে লাগল।
তাপস কুমার দত্ত: এখনো কি অল্পবিস্তর চলে আসছে?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এখনো আসছে এবং এদের একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে এরা আওয়ামীপন্থী ছিল। অর্থাৎ এ দলটির কাছে ওরা নিরাপদ বোধ করত।
তাপস কুমার দত্ত: দেশভাগের পর ওপার বাংলার কী কী বিশেষ পরিবর্তন আপনার কাছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়েছে?
সমরেশ মজুমদার: ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এ ২৪ বছরে বাঙালির জীবনে পূর্ববঙ্গে একটা জিনিসেরই আমদানি ঘটেছে, সেটা হলো ইসলাম এবং ইসলামকেন্দ্রিক আরবি-ফারসি শব্দ। ওই সময় যাঁরা লেখালেখি করতেন, যেমন ধরুন—শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস—এঁরা যে বাংলা লিখতেন, তা ছিল পশ্চিম বাংলার বাংলা; অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারকৃত বাংলা। এঁরা বাংলার প্রাচীন সাহিত্য এবং রামায়ণ-মহাভারত ও আরও সব পৌরাণিক...প্রাচ্য ও পশ্চিমের সাহিত্যের ওপর ভালো দখল রাখতেন এবং সেটা তাঁদের ভেতরে লালন করতেন। ১৯৭১ সালের পর একটা আবেগ এল, আবেগের সঙ্গে ভয় এল। ভয়টা এই—আমরা এত দিন উনুনে পুড়ছিলাম, উনুন থেকে লাফিয়ে গরম তেলে পড়লাম না তো? অর্থাৎ আমরা পাকিস্তানের অত্যাচারে জর্জরিত হচ্ছিলাম, এখন ভারত বড়দাদার মতো দাদাগিরি করবে না তো? আমাদের দখল করবে না তো? তার কিছু কিছু ইন্ধন—আপনারা জানেন—ভারত যে সম্পূর্ণ বৈষ্ণব হয়ে ছিল তা নয়, ভারতের তরফ থেকে যারা দু-একটা বদমায়েশি কাজ করেছে, সেসব বাংলাদেশের কাছে প্রবল হয়ে ধরা দিল। ১৯৭১ সালের ওই আবেগ যখন কমতে শুরু করল, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর ওখানকার রাজনৈতিক দলগুলো জনসাধারণকে সস্তা পথে পাওয়ার জন্য অ্যান্টি-ভারত আবহাওয়া তৈরি করল এবং সেটা তাদের ভোট অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়কও হলো। এ সময় থেকে আমরা দেখতে শুরু করলাম, বাংলা সাহিত্যে যা লেখালেখি হচ্ছে, খবরের কাগজে রিপোর্টিংয়ে যে বাংলায় লেখালেখি হচ্ছে, সেখানে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। এর একটা উদাহরণ হলো জিম্মা। এ ‘জিম্মা’ শব্দটা আগে ওপার-এপার, কোনো বাংলায়ই ব্যবহৃত হতো না। যেমন খাবারটা খেয়ে দারুণ ‘মজা’ লাগল। এ ‘মজা’ শব্দটা হলো রসে-বসে আনন্দে আছি। তা খাবারটা খেয়ে ‘মজা’ লাগবে কেন আমার? খাবারটা খেয়ে আমার দারুণ ভালো লাগবে, অথবা আমি খুব আনন্দ পেলাম খেয়ে। কিন্তু ‘মজা’ লাগা বলতে কোথাও যেন একটু কৌতুক মেশানো থাকে। এ ধরনের কিছু শব্দ তৈরি হতে লাগল। এসব সচেতনভাবে তৈরি হতে লাগল, যাতে পশ্চিম বাংলার ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষা আস্তে আস্তে একটু একটু করে আলাদা হতে থাকে। আবার, আমরা দেখতে পাই, ১৯৬০ বা ’৬৫ সাল অবধি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের আগ অবধি যেকোনো মুসলিম পরিবারে আরবি বা ফারসি নাম দেওয়া হতো। কিন্তু এর পর থেকে দেখা গেল তাদের নামের পাশে ব্র্যাকেট করে একটা ডাকনাম দেওয়া হলো। ১৯৪০-৫০ সালের দিকে কোনো মুসলমানের ডাকনামের তেমন প্রচলন ছিল না। ক্রমে এ ডাকনামই তার হাইলাইটস পেত বেশি, আসল নামটা আড়ালে থাকত। যেমন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। আমরা সবাই জানি ‘বন্যা’। এটা কিন্তু পাশাপাশি সচেতনভাবে বাঙালিত্ব ধরে রাখার প্রচেষ্টা। এর পরবর্তী প্রজন্ম, সত্তরের দশক থেকে যে প্রজন্ম শুরু হলো—তারা আরও অদ্ভুত হলো। তাদের আবার নাম হয়তো আবুল হায়াত, মেয়ের নাম বিপাশা হায়াত বা সুবর্ণা মুস্তাফা। হায়াত বা মুস্তাফা তার পারিবারিক পদবি কিন্তু নামটা বাংলা শব্দ। অর্থাৎ আগে যেটা ব্র্যাকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেটা এখন নামের সাইনবোর্ডে এসে প্রকাশ হলো। পাশাপাশি আরও একটা অদ্ভুত ছবি আছে; ছবিটা হলো—চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মানুষ, ধরুন একজন মা; তার ছেলে হয়তো ঢাকায় চাকরি করে। তিনি যখন তার ছেলেকে চিঠি লিখছেন, তখন চট্টগ্রামের ভাষায় লিখছেন না। তিনি বইয়ের ভাষায় চিঠি লিখছেন এবং ছেলেও তা-ই করছে। কিন্তু ছেলে আর মায়ের যখন পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয়, তখন কিন্তু তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলেন, যা ঢাকার লোক বুঝবে না। তা হলে চিঠিতে কেন বাংলা বর্ণমালায় চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার করছে না? এ নিয়ে আমার নিজস্ব অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু এ বাঙালিত্ব বজায় রাখার জন্য একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি, একবার এক অনুষ্ঠানে একজন লোকের সঙ্গে—তাকে বাংলাদেশের মনে হওয়ায়—কথা বলতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বাংলাদেশের? কোন জেলায় বাড়ি?’ তিন-চারবার প্রশ্ন করার পরও কোনো উত্তর পেলাম না। লোকজন অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার, তুমিও বাঙালি, সে-ও বাঙালি অথচ একে অন্যের ভাষা বুঝতে পারছ না?’ আসলে সে সিলেটের বাঙালি। সে আমাদের ভাষা ভালোভাবে জানে না এবং নিজে যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষা আমাদের কাছে অজানা, তাই কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে। এই যে এত পার্থক্য—এসব পার্থক্যের সুযোগ নিয়েছে—আমার মনে হয়, কিছু ধর্মান্ধ মৌলবাদী, যাতে বাংলা ভাষাকে ভাঙা যায়, নষ্ট করা যায়। একটা নতুন ভাষা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধরুন, যদি মসজিদে যান, মসজিদে যে প্রার্থনা হয় তা বাংলায়। যেখানে একদম পরিষ্কারভাবে, ‘হে পরম পিতা!’—এভাবে শুরু করে।...‘আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি; আমাদের প্রিয়জন তোমার কাছে গিয়েছে, বাসা থেকে কেউ যদি বিদেশে যায়, তবে তার চিঠিপত্তর, টেলিফোনে খবর পাওয়া যায়। তিনি আজ যেখানে গেছেন, সেখানে এসব কোনো পথ নেই; কিন্তু আমরা জানি, তিনি তোমার কাছে গেছেন। অতএব, তুমি তাকে ভালো রাখবে...। আমিন!’ এ কথাগুলো অতি পরিষ্কার সিম্পল বাংলা কথা, এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না; অশিক্ষিত লোকও স্পষ্ট বুঝতে পারছে; কিন্তু ‘আমিন’ শব্দটা উচ্চারণ হওয়ামাত্র একটা অন্যরকম গন্ধ এল। আমিন কথাটা খ্রিষ্টানরা বলে। খ্রিষ্টানরা ‘পরম পিতা’ও বলে। কোরআনকে তো পৃথিবীর সব দেশের সব মুসলমান যথাযথ অনুসরণ করে না। আজকের পৃথিবীর সব মুসলমানের...বাংলাদেশের মুসলমানদের আইডিয়াল হচ্ছে ‘আরবি’ এবং আরবের লোকজন। অথচ আরবরা যে বুর্জোয়া জীবনযাপন করেন—মেয়েদের ক্ষেত্রে পার্টিকুলারলি—সেটা মানতে পারেন না ঢাকার মুসলমানরা; কিন্তু এরপরও ওরা আইডিয়াল। আজ যদি তুমি ঢাকা বা ফরিদপুরের রাস্তায় রোজার সময় যাও, তাহলে দেখবে, পর্দা টানিয়ে হোটেলে খাওয়াদাওয়া চলছে। অর্থাৎ পর্দা টানিয়ে দুপুরে খাওয়া যায়। আমার বন্ধুবান্ধব, যাঁরা আমার কাছে রোজার সময় আসছেন, তাঁরা প্রায়ই বলতেন, ভাই, আমি অসুস্থ, রোজা রাখতে পারছি না। কেউ বলতেন, আমি তো এখন পর্যটক! কারও হাঁটুতে ব্যথা, একটা অজুহাত, যেহেতু নামাজ পড়তে পারবে না...এসব অজুহাত বা ছুতো—এগুলো সবই কিন্তু বেরিয়ে আসার চেষ্টা। কিন্তু তারা ভয়ে থাকে, বেরিয়ে আসতে ভয় পায়। ফলে আমাদের সঙ্গে ওদের যে ডিফারেন্স, সেই ডিফারেন্সটা যথেষ্ট বড়। কারণ, আমরা যারা জন্মসূত্রে হিন্দু, তাদের ৮০ ভাগ হিন্দুধর্মের এ-বি-সি-ও পালন করি না। অথচ আমরা হিন্দু। বলতে হয়, তাই হিন্দু। আমাদের ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়ার মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মাচরণ নেই। দুর্গাপূজা এলে আমরা প্ল্যান করি কোথায় বেড়াতে যাব। পুজোর আচার-আচরণের মধ্যে আমরা নেই। আমরা নানা খাবার দিয়ে, বিস্কুট, চাল-ডাল, চকলেট দিয়ে মূর্তি গড়ি, ছেলেখেলার মতো। কালীপূজার সময় আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখি, পটকাবাজির ভয়ে। তাহলে আমরা হিন্দু হলাম কোথায়? আমরা ধর্ম থেকে সরে গেছি আস্তে আস্তে। তবে এ ধর্ম আমাদের কিছু দেয় না, আমাদের থেকে কিছু নেয়ও না। যখন রামকে নিয়ে সারা ভারতে এত হইচই কাণ্ড চলত, তখন আমরা পশ্চিম বাংলার মানুষজন রামকে একবারও দেবতা বলে মনে করি না। আমরা হনুমানকে দেখে ঠাট্টা করি, ‘কলা খাবি’ বলে। কিন্তু হনুমান ওদের কাছে ঈশ্বরের অবতার। ঘটনা যখন এ রকম ঘটে যায়, তখন বাংলাদেশের মুসলমান যারা; যারা সত্যিকার অর্থে কোরআন মানে, ধর্মান্ধ নয়, তারা কিন্তু আমাদের থেকে অনেক ডিসিপ্লিনড। ধর্ম ডিসিপ্লিন তৈরি করতে সাহায্য করে। ধর্ম একত্র করে মানুষকে। কিন্তু সেই একত্র করার মাঝখানে ধর্মান্ধ বা ধর্ম ব্যবসায়ীরা যত গণ্ডগোল পাকায়। ফলে আমাদের মধ্যে ক্রমেই পার্থক্য বাড়ছে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার কি মনে হয়, কয়েক দশক আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে রাজনীতিতে যে রকম মন্দির-মসজিদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, তাতে করে আগামী কয়েক দশক পর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রকম ধর্মরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে?
সমরেশ মজুমদার: আমার তো উল্টো মনে হয়। আমার মনে হয়, ধর্মান্ধ যারা—সে হিন্দু বা মুসলমান হোক, খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা কখনো শুনিনি। যদিও ক্রিশ্চিয়ানিটি পৃথিবীজুড়ে ছিল, কিন্তু আজ অবধি খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা শুনিনি, বৌদ্ধ ধর্মান্ধ শুনিনি।
তাপস কুমার দত্ত: ইউরোপে এককালে খ্রিষ্টানরাই ব্লাসফেমির মতো ঘৃণ্য আইন ধর্মের বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছিল—ওসব কি ধর্মান্ধতা নয়?
সমরেশ মজুমদার: খ্রিষ্টানরা এখন অনেক শ্রেণির হয়ে গেছে, সেখানে তারা একত্র নয়।
তাপস কুমার দত্ত: না, সেটা অন্য ব্যাপার, প্রশ্নটা হলো...
সমরেশ মজুমদার: আমাদের ভারতবর্ষেও তো হিন্দু ধর্ম একেক জায়গায় একেক রকম। আপনি সাউথ বা নর্থ ইন্ডিয়ায় বা অন্য প্রান্তে যে হিন্দু ধর্ম দেখবেন, তা পশ্চিম বাংলায় পাবেন না; এক জায়গার সঙ্গে অন্য জায়গায় ধর্মীয় অমিলই বেশি।
তাপস কুমার দত্ত: প্রশ্নটা তা নয়। একটা ধর্ম সম্প্রদায় নানা খণ্ডে বহু ধারায় বিভক্ত হতেই পারে। কিন্তু যেকোনো ধারারই একটা প্রচ্ছন্ন গোঁড়ামি আছে, মৌলবাদ আছে; আর সেটাই দিন দিন বিশ্বের ওপর বেশি পরিমাণে চেপে বসছে। আপনি কী মনে করেন?
সমরেশ মজুমদার: না, আমি এর সঙ্গে একমত নই। আমার তো মনে হয়, ধর্ম পৃথিবী থেকে আস্তে আস্তে লোপ পেতে চলেছে। এখন যে চিৎকারটা আমরা শুনতে পাচ্ছি—কারণ, ধর্মবাদীরা আতঙ্কগ্রস্ত বলে চিৎকার করছে।
তাপস কুমার দত্ত: প্রথাগত ধর্মে আপনার বিশ্বাস কতটুকু?
সমরেশ মজুমদার: আমি ধর্মে একদম বিশ্বাসী নই।
তাপস কুমার দত্ত: আর বিবাহ প্রথায়?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, বিবাহ প্রথায় বিশ্বাসী। তবে বিয়ে কীভাবে হবে, সেটা নির্ভর করছে যারা বিয়ে করছে, তাদের ওপর।
তাপস কুমার দত্ত: তৃতীয় বিশ্বে বসবাস করার একটা মানসিক যন্ত্রণা আছে। বিশেষ করে, শিল্পী-সাহিত্যিক...যেকোনো সৃজনশীল মানুষের। আপনি তা কতটা অনুভব করেন?
সমরেশ মজুমদার: এটা ভারতবর্ষে, মানে পশ্চিম বাংলায় নেই, আমি কখনো অনুভব করিনি। এটা গুজরাটে থাকতে পারে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার লেখালেখিতে বা ভাবনায় কখনো সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনো প্রতিবন্ধকতা আসেনি বলছেন?
সমরেশ মজুমদার: সিপিএম যখন ক্ষমতায় এল, তখন আমি নকশাল আন্দোলন নিয়ে উপন্যাস লিখলাম—কালবেলা। তো কালবেলার নায়ক অনিমেষ তখন কিন্তু সিপিএমের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। বলেছে, সিপিএম ভ্রষ্টাচারী। আমাকে কিন্তু ও রকমভাবে কোনো সরকার বা শক্তি আপত্তি করেনি।
তাপস কুমার দত্ত: নিজের বিচারে আপনার প্রিয় লেখা কোনটি?
সমরেশ মজুমদার: তিনটি লেখা আমার খুব প্রিয়। সেটা হচ্ছে—‘উত্তরাধিকার’...
তাপস কুমার দত্ত: এ সিরিজটা? অর্থাৎ ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’?
সমরেশ মজুমদার: না, ‘কালবেলা’ আমার প্রিয় নয়। ‘এখনও সময় আছে’ বলে আমার একটা উপন্যাস আছে, আমার ভীষণ প্রিয়। আর গত বছর আমি ‘দেশ’-এ একটা উপন্যাস লিখেছি—‘উৎসারিত আলো’—এ তিনটি।
তাপস কুমার দত্ত: লেখালেখিতে কতটা অসন্তুষ্টি বা অতৃপ্তি রয়ে গেছে?
সমরেশ মজুমদার: প্রতিটি লেখায়ই আমার অসন্তুষ্টি রয়ে যায়। আমার মনে হয়, আবার লিখলে ভালো করতাম। কিন্তু একবার বই আকারে...।

তাপস কুমার দত্ত: সেটা ওই বইটার নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর। আমার জিজ্ঞাসা হলো, এমন কোনো প্রিয় লেখা কি আপনার ভেতরে লালিত আছে, যা এখনো আপনি লিখে উঠতে পারেননি?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এই যে আপনাকে এর আগে যে কথাগুলো বললাম। আমি হুমায়ূন (আহমেদ)-কে বারবার বলেছিলাম, দ্যাখো, তুমি এত জনপ্রিয় একজন লেখক, তোমার এত হাজার হাজার বই বিক্রি হয়, তোমার তো এখন হারানোর কোনো ভয় নেই। তা তুমি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ২০০৪ সালের এই সময়কাল পর্যন্ত কয়েকটা খণ্ডে লেখো না, উপন্যাস আকারে। সে বলল, আমার লিখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সাহস পাই না। আমি অ্যাকসিডেন্টলি আপনাদের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিচিত ছিলাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আমার কাছে এরশাদ খুব কালারফুল চরিত্র। ঘৃণ্য, কিন্তু কালারফুল। কেউ ওর সঙ্গে দেখা করার সাহস পায়নি, যেতে চায়নি; আমি গিয়েছিলাম ওর আমন্ত্রণে। আমার বিপুল অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এটা নিয়ে তিনটি পর্বে ভাগ করে লিখতে আমার খুব ইচ্ছা হয়। ১৯৪৭ থেকে ’৬৯, শেখ মুজিবুর যখন স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, সেই অবধি। এরপর ১৯৬৯ থেকে ’৭১ এবং ’৭১ থেকে এখন অবধি। এ তিনটি পর্বে বাংলাদেশের পটভূমিতে যদি পারি, তো কখনো লিখব। আমি জানি, এ লেখা এই সরকার থাকলে ওখানে যাবে না।...এই যে দ্যাখো, ‘এত রক্ত কেন’ বইটা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে; ঢাকার ফুটপাতে কিন্তু বইটা পাওয়া যায়। তো ব্যান্ড করে লাভটা কী হলো?
তাপস কুমার দত্ত: এ বইটার জন্য বাংলাদেশের একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে ও-দেশে যাওয়ার ভিসা আপনাকে আটকে দেওয়া হয়। এখন যদি এ জাতীয় সমস্যা না থাকে, তা হলেও কি বাংলাদেশে যেতে কোনো আপত্তি থাকবে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি জানি, এ সরকার যদি এটা তুলেও দেয়, তবু সরকারের যারা অনুচর, তারা আমাকে আক্রমণ করবে।
তাপস কুমার দত্ত: অর্থাৎ আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন?
সমরেশ মজুমদার: অফ কোর্স। আমি শেষবার যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, তখন এত রক্ত কেন বেরিয়েছে, কিন্তু ব্যান হয়নি; সেদিন ঢাকায় এয়ারপোর্টে নেমেই বেশ সমস্যায় পড়েছিলাম। আমাকে নিয়ে অফিসাররা হঠাৎ তটস্থ হয়ে উঠলেন, কেন আমি এসেছি? কী উদ্দেশ্যে এসেছি? তো, আমাকে রিসিভ করতে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদ। আমাকে নিয়ে সে সোজা চলে গেল নুহাশ পল্লীতে। ওখানে তিন রাত ছিলাম। এরপর রাতের অন্ধকারে ঢাকায় এলাম।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অন্য কোনো ভয় পাচ্ছিলেন?
সমরেশ মজুমদার: পুলিশ বোধ হয় ভাবছিল, আমাকে অ্যারেস্ট করা উচিত কি উচিত না। একদিন একটা অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে সেখান থেকে সোজা এয়ারপোর্টে। এরপর আমি যখন অনুষ্ঠানে যাওয়ার পরবর্তী আমন্ত্রণ পেলাম, তখন তারা আমাকে ভিসা দিল না।
তাপস কুমার দত্ত: এখন আপনি কী ধরনের বই পড়ছেন?
সমরেশ মজুমদার: কয়েক দিন আগে ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ হুমায়ুন আজাদের বইটা সকাল থেকে পড়তে শুরু করেছিলাম। সেদিনই সকাল ৯টায়—বইটা পড়ছি, হাতে; খবর এল হুমায়ুন আজাদ মারা গেছেন। ওই বইটাতেই একটা জায়গায় লেখা ছিল, যেকোনো দিন তার মৃত্যু হতে পারে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। এ বইটা খুব বড় বা দামি লেখা নয়। খুব আবেগের লেখা, একই কথা বারবার লেখা; কিন্তু কথাগুলো লিখতে সাহস পায়নি তেমন কেউ।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি কি তাঁর আর কোনো উপন্যাস পড়েছেন?
সমরেশ মজুমদার: একটা পড়েছিলাম অনেক আগে, নামটা ভুলে গেছি। দাঁড়াও, নামটা মনে করি...
তাপস কুমার দত্ত: ‘শুভব্রত’, তার সম্পর্কিত সুসমাচার?
সমরেশ মজুমদার: না, আর কয়েকটা নাম বলো তো।
তাপস কুমার দত্ত: ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, সবকিছু ভেঙে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, হ্যাঁ, ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, বইগুলো বেশির ভাগ সময়ই কলকাতায় সহজে পাওয়া যায় না।
তাপস কুমার দত্ত: বয়স তো যথেষ্ট হলো। একদিন চলে যেতে হবে, তার দিনক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে...কোনো আতঙ্ক বা আক্ষেপ?
সমরেশ মজুমদার: না, না। আজ রাতেও চলে যেতে পারি; আবার হয়তো দশ বা কুড়ি বছর পরও যেতে পারি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অবশ্যই দীর্ঘায়ু হবেন, আমি এর দার্শনিক দিকটা জানতে চাচ্ছি।
সমরেশ মজুমদার: আমি খুব বাস্তববাদী মানুষ। আমি আজকে লেখালেখি করে যেটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি, সেটুকু আমার পাওয়ার কথা ছিল না। আমার লেখক হওয়ারই কথা ছিল না।
তাপস কুমার দত্ত: অনেক বছর আগে বাংলাদেশের একটা সাপ্তাহিক কাগজে আপনি বলেছিলেন, এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেবেন।
সমরেশ মজুমদার: ওসব কথা বাড়িয়ে লিখতে ভালোবাসে কিছু সাংবাদিক। যেমন অন্য একটা জায়গায় আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তসলিমার ‘ক’ পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে? আমি এর উত্তরে বলেছিলাম, আমি ‘ক’ পড়েছি এবং আমার মনে হয়েছে, একটা বারবনিতাকে যদি বলা হয়, তোমার আত্মজীবনী লেখ, সে তার অনেক কষ্টের কথা লিখবে; কিন্তু যেসব ক্লায়েন্ট তার কাছে আসে, তাদের বিস্তৃত পরিচয় দেবে না সে, এটুকু সৌজন্য দেখাবে। এ উত্তরটা তারা এভাবে লিখেছে যে, সমরেশ মজুমদার বলেছেন, তসলিমা নাসরিন বেশ্যা। এর উত্তরে তসলিমা লিখলেন আনন্দবাজারে, সমরেশ মজুমদারের গলায় গলা মিলিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, তসলিমা বেশ্যা। এর উত্তরে আমি আবার চিঠি লিখলাম আনন্দবাজারে—কোথায়, কখন বলেছি? কাকে বলেছি? যদি দয়া করে আমাকে জানানো হয়...। অতএব, যদি কোথাও কখনো লেখা হয়ে থাকে, আমি বলেছি এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেব—এগুলো বাজে কথা। হয়তো এভাবে বলেছি, লিখে টাকা পাওয়া যায়, জানতাম না। যখন লিখে টাকা পেতে শুরু করলাম, তখন আমাকে যদি বলা হয়, কেন লেখেন? আমি বলি, টাকার জন্য লিখি।
তাপস কুমার দত্ত: কথাটা এভাবে বলেছিলেন, একজন কৃষক যে কারণে চাষাবাদ করেন, একজন...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম, একজন কৃষক যখন চাষাবাদ করেন, তিনি তো দেশ গড়ার জন্য চাষ করেন না; তিনি তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য চাষাবাদ করেন। একজন মাস্টার যখন পড়ান, তখন মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার চেয়ে তার সন্তানসন্ততিকে বড় করার জন্য পড়ান। তো, একজন লেখকের কী দায় আছে, তিনি দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন? আমাদের দেশে কোনো লেখক যদি জনপ্রিয় হন, তখন ধরেই নেওয়া হয়, ওগুলো ভুসিমাল। যদি সে ধরনের লেখক জনপ্রিয়তা না পান বা বিক্রি না হয়, তখন তিনি একজন বিরাট লেখক। প্রশ্ন হলো, জনপ্রিয়তা যদি কেউ বেশি পান, কেন পান? কারণ, পাঠকদের ভালো লাগছে বলেই। কোনো একটা বই হয়তো বেশি পাঠকের ভালো লেগেছে। এমন নয় যে বছরের পর বছর তিনি জনপ্রিয় হয়ে থাকেন। তা হলে যিনি পাঠককে সহজে স্পর্শ করতে পারছেন না, তার কোথাও খুঁত আছে নিশ্চয়ই। ভালো একটা ছবি তিন দিন সিনেমা হলে থেকে চলে গেল। আর একটা ছবি ‘বাবা কেন চাকর’ মাসের পর মাস চলল, জনপ্রিয় হলো। আবার ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর যখন হাজারটা শো চলে, তখন বলতেই হয়, গুপী গাইন বাঘা বাইন খারাপ ছবি? চার্লি চ্যাপলিন তা হলে খারাপ ছবির নাম? ‘পথের পাঁচালী’ও ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল—ওটাও তা হলে খারাপ ছবি?

তাপস কুমার দত্ত: ধরুন, হাইপোথেটিক্যালি আমরা ধরে নিলাম, কোনো ধনকুবের আপনার যাবতীয় চাহিদার স্পন্সরশিপের দায়িত্ব নিল। একজন কৃষক যে কারণে কৃষিকাজ করেন বা আর দশজন পেশাজীবী মানুষ যে কারণে পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, সেই প্রয়োজনটা আপনার আর রইল না। তখন কি লেখালেখি আপনি ছেড়ে দেবেন?
সমরেশ মজুমদার: চাহিদার কিন্তু শেষ নেই। আগে বাস-ট্রামে চড়তাম, আমার এখন বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। এখনো অবশ্য ইচ্ছা করে মাঝেমধ্যে বাস-ট্রামে উঠি। তো, আগে আমি জলপাইগুড়ি আমার বাড়ি যেতাম সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে, রিজারভেশন ছাড়া। এরপর রিজারভেশনে। এরপর এসি থ্রি-টিয়ার, এরপর এসি টু-টিয়ার। এর মানে এই নয়, আমি এখন এসি টু-টিয়ার ছাড়া যেতে পারব না। কিন্তু যদি কমফোর্ট পাই, তা আমি নেব না কেন?
তাপস কুমার দত্ত: আমি বলতে চাচ্ছি, শুধু ভরণপোষণ আর কমফোর্ট—এসব কারণেই লেখালেখি? ভোগবাদী ব্যাপার ছাড়া তা কি নিজের ভেতর থেকে উঠে আসে না?
সমরেশ মজুমদার: শুনুন, আমাকে যদি এক কোটি টাকা দেওয়া হয় একটা উপন্যাস লেখার জন্য—সাত দিন চেষ্টা করেও লিখে উঠতে পারব না। আবার, আমাকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি, আমি লিখতে বসলাম, হয়তো দুদিনেই লেখাটা শেষ করে ফেলতে পারব।
তাপস কুমার দত্ত: তা হলে লেখালেখিটা শুধু হালচাষির হালচাষের মতো জীবিকা নির্বাহ নয়, আলাদা একটা ভেতরের তাগিদও...
সমরেশ মজুমদার: অবশ্যই।
তাপস কুমার দত্ত: বেশির ভাগ জনপ্রিয় লেখকের লেখায় দেখা যায়, কতগুলো পাগলামোর ঘটনা, কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনা, কিছু সুখকর ঘটনা ও একটু বেদনাদায়ক ঘটনা। যেন ছাঁচে ঢেলে গরম তেলে ভেজে তোলা হট কেক...
সমরেশ মজুমদার: এটা আমার কাছে খুব অস্পষ্ট। ধরুন, আমার একটা বই, ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে এক লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। সেই বইটা কলকাতায় ৫০-৬০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। ধরে নিতে পারি, বইটা জনপ্রিয়।
তাপস কুমার দত্ত: বইটার নাম কী?
সমরেশ মজুমদার: ‘গর্ভধারিণী’। তা ওটা কোন ফর্মুলায় লেখা, বলুন তো?
তাপস কুমার দত্ত: ওই বইটাতে আসলে এমন একটা সাসপেন্স বা থ্রিল এবং এর সঙ্গে আবেগ, বর্তমান সমাজব্যবস্থার কিছু মানুষের অমানবিক নোংরা দিকের প্রতি...।
সমরেশ মজুমদার: এসব তো অনেক বইতেই আছে।
তাপস কুমার দত্ত: হ্যাঁ, তা ঠিক, ‘মেঘ ছিল, ‘বৃষ্টিও’-তেও আছে। ‘আট কুঠুরী নয় দরজা’তেও।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে সেগুলো ওভাবে বিক্রি হয়নি কেন?
তাপস কুমার দত্ত: না, আমি বলছি ‘গর্ভধারিণী’র মতো বিশাল জনপ্রিয়তা না পেলেও ওই লেখাগুলোও বেশ জনপ্রিয়।
সমরেশ মজুমদার: যদি জানতাম, গর্ভধারিণীর মতো ওভাবে সাসপেন্স মেশালে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হবে, তা হলে তো সব বই ওভাবেই লেখা হতো। তা হলে ‘সাতকাহন’ কেন এত বিক্রি হলো? স্ট্রাগল করা মেয়েদের গল্প তো আমি আগেও লিখেছি, পরেও লিখেছি, সেগুলো কেন সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হলো না? আমি যদি আরেকটা দীপাবলীকে নিয়ে লিখি, সেটা কি সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হবেই?
তাপস কুমার দত্ত: সাতকাহনের দ্বিতীয় পর্ব কিন্তু প্রথম পর্বের মতো অত জনপ্রিয় নয়।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে? আসলে আমার কাছে মনে হয়, যেকোনো...আমি আপনাকে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখাটার কথা বললাম, ‘এখনো সময় আছে’ বইটা তিন থেকে চার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। লোকে না পড়লে আমার কষ্ট হয়, আমি তো লোকে লোকে গিয়ে বলতে পারি না, আপনি বইটা পড়ুন। কোত্থেকে ‘কালবেলা’ এক লাখ কপি বিক্রি হলো! ‘উত্তরাধিকার’ বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার। অথচ উত্তরাধিকার ওটার চেয়ে অনেক বেটার উপন্যাস। তাই কোন লেখাটা জনপ্রিয় হবে, তা আগে থেকে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। একটা লেখা জনপ্রিয় হতে পারে। একটা মেমসাহেব, একটা দৃষ্টিপাত, একটা মরুতীর্থ হিংলাজ জনপ্রিয় হতে পারে। কয়েকটা নয়।
তাপস কুমার দত্ত: ওপারের লেখকদের লেখা সম্পর্কে...
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, ওপারের এক নম্বরের সঙ্গে দুই নম্বরের ব্যবধান এত বিস্তর...জাফর ইকবাল সম্প্রতি সেই ব্যবধান একটু কমিয়ে এনেছেন। তো, গতবার যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, তখন একজন লেখক আমাকে এসে বললেন, সমরেশ দা, আপনাকে একটা ভালো খবর দিই।
আমি বললাম, কী?
বলল, আমি এখন তিন নম্বরে।
আমি জানতে চাইলাম, কিসের তিন নম্বর? সে জানাল, জনপ্রিয়তার। তার পেছনে নাকি মিলন চলে গেছে, অমুক-তমুক অনেকে চলে গেছে। আমি হাসব না কাঁদব, ভেবে পাচ্ছিলাম না।
তাপস কুমার দত্ত: কে?
সমরেশ মজুমদার: নামটা নাই-বা বললাম।
তাপস কুমার দত্ত: বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের রুচিবোধ আপনার কতটা উঁচুদরের বলে মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: আপনি যা ইচ্ছা তা-ই লিখে পাঠকদের ভোলাতে পারবেন না। পাঠকদের বিচারশক্তি দারুণ প্রখর। একটা লেখা দিয়ে ভোলাতে পারবেন, পরের দুটোয় হাফ ভোলাতে পারবেন; তৃতীয়টায় আর পারবেন না।
তাপস কুমার দত্ত: পাঠকেরা আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমাকে তেমন প্রভাবিত করতে পারে না। তবে কিছু কিছু ঘটনায় মাঝেমধ্যে কষ্ট হয়। একবার বইমেলায় এক ভদ্রমহিলা তিনখানা (বড় ক্যানভাসের) বই বইতে পারছিলেন না, চেহারা দেখে বোঝা যায়, যথেষ্ট (আর্থিক) অসচ্ছল পরিবার। আমি বললাম, আপনি কী করেন?
তিনি বললেন, আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়াই।
আমার খুব খারাপ লাগল, আপনি এত দামি তিনটি বই কিনলেন?
তিনি বললেন, সারা বছর আমরা অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছি।
এরপর দেখলাম, দূরে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। ক্রাচ হাতে, একটা পা ডিফেক্টেড। ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে যেতেই তিনি বললেন, আমি আপনার অনিমেষ।
আমি বললাম, তার মানে?
তিনি জানালেন, তিনি নকশাল আন্দোলন করতেন এবং হাওড়া জেলে পুলিশের অত্যাচারে একটা পা নষ্ট হয়ে (অনিমেষের মতোই) গেছে। আমরা একসঙ্গে থাকি। (অনিমেষ-মাধবীলতার মতো), আমরা বিয়ে করিনি।
আরেকটা ঘটনা বলে শেষ করি—হ্যাঁ, একবার বিদেশে রাতে আমার খুব খিদে পেয়েছে, একটা বড় রেস্টুরেন্ট দেখে ভেতরে ঢুকে পড়ি। এরপর মেনু কার্ডের সবচেয়ে ছোট আইটেম যেটা, সেটার অর্ডার দিলাম। বেয়ারাগুলোকে দেখে মনে হলো এশিয়ান। তো, একটা বেয়ারা এসে বলল, স্যার! আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?
আমি বললাম, ইয়েস।
স্যার! আর ইউ ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল?
আমি আবার বললাম, ইয়েস।
বেয়ারা গিয়ে হোটেল মালিককে তথ্যগুলো জানাতেই হোটেল মালিক উঠে এসে বললেন, নমস্কার স্যার! আপনি বোধ হয় সমরেশ বাবু। আমি আপনার একটাই মাত্র বই পড়েছি। একবার একটা বাস টার্মিনালে দেখলাম একটা বই পড়ে আছে—বাংলা বই, নামটা ‘দৌড়’।
এরপর যতই বলছি, আমার খাওয়া হয়ে গেছে, তবু তিনি আমাকে জোর করে খাওয়াবেন। বিল দিতে গেলাম, বিল নিলেন না। এই অবধি ঠিক আছে। বেয়ারা এরপর বলল, সাহেব, একবার ভেতরে আসবেন? আপায় কইছিল, আপনি সমরেশ মজুমদার কি না জিজ্ঞেস করতে। তো, আমি ভেতরে ঢুকলাম। একজন ভদ্রমহিলা খাটের ওপর বসে নমস্কার জানিয়ে আমার দিকে একটা বই এগিয়ে দিলেন—‘গর্ভধারিণী’। আমার পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। দেখুন, কারোর জানার কথা নয়, আমি ওখানে যাব। কাকতালীয়ভাবে।
তাপস কুমার দত্ত: একবার কবি সম্মেলনে আপনাকে দেশের বাইরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল—কবি হিসেবে, ভুল করে। ঠিক এ রকমই একটা ঘটনার কথা...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আপনি সবই জানেন দেখছি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি বই বাজেয়াপ্ত করাটা কতটা সমর্থন করেন?
সমরেশ মজুমদার: যে কারণে তসলিমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, সেটাকে আমি সমর্থন করি না। তবে আমার হাতে আইন থাকলে তসলিমাকে অভিযুক্ত করতাম। আজ একটা ছেলের সঙ্গে একটা মেয়ের ভালো সম্পর্ক; সম্পর্কটা দুজনকেই আনন্দিত করছে। যদি ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো তিক্ততা আসে, আজকের এ আনন্দটা কিন্তু মিথ্যা হয়ে যাবে না এবং সেই ছেলেটা ও মেয়েটার কোনো রাইট নেই ভবিষ্যতে এই আনন্দিত সম্পর্ককে নিয়ে খোলামেলা...ব্যঙ্গ করে লেখা বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে লেখা। যে ক্ষেত্রে তারা একে অন্যকে ছোট ও অপমান করছে। মিলনের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গিয়ে কী হয়েছে বা অমুকের সঙ্গে অমুকের আর কী হয়েছে—এর ডিটেইলস নিয়ে আমরা আদৌ আগ্রহী নই। আমরা তসলিমার ব্যাপারে এখানেই আগ্রহী যে সে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কী লড়াই করেছিল। তা না করে তার শারীরিক আনন্দের বিবরণ দিয়ে লিখছে—এটা এক ধরনের অসুখ। আমি জানি, আমার বাবা-মায়ের মিলনের ফলে আমি পৃথিবীতে এসেছি; এখন সেই মিলনটা কী রকম ছিল, তার বিবরণ দিয়ে যদি লিখতে যাই, তো আমার জন্মটাকেই আমি সবচেয়ে বেশি কুৎসিত করছি। আমার জন্মের বিবরণের জন্য আমার বাবা-মায়ের শয্যা বিবরণ কি আমি দিতে পারি? নাকি তা আমি ভাবতে চাই? বা ভাবতে পারি?
তাপস কুমার দত্ত: আপনি আপনার খোলামেলা বা বিতর্কিত ভাবনা প্রকাশ করতে কতটা ভয় পান?
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, এ মুহূর্তে বোধ হয় আমিই সবচেয়ে সরাসরি লিখি। ‘পত্রপাঠ’ বলে একটা পত্রিকা আছে, মাসে বেরোয়—সেটায় আমি কলাম লিখি। সেখানে সরাসরি সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে লিখি। একজন কলেজ অধ্যাপককে পুলিশ অ্যারেস্ট করে—জনযুদ্ধগোষ্ঠীর ডায়েরি থেকে নাম পেয়ে তাকে অ্যারেস্ট করে। সারা দিন অত্যাচার করে সন্ধ্যায় তাকে ছেড়ে দেয়। এলাকার লোকজন মনে করে, সে জনযুদ্ধগোষ্ঠীর লোক। সে রেললাইনে আত্মহত্যা করে, তার স্ত্রী এ নিয়ে কেস করে। এ ঘটনা নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। আমি এ-ও লিখেছিলাম, কয়েক দিন আগে ভোটের সময় একজন সাংবাদিক একটা গ্রামে গেছেন। সেখানে এক চায়ের দোকানে নানা আলোচনায় উঠে আসে, আমাদের দেশে যত মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই অবিবাহিত। বিবাহিত ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়, জ্যোতিবাবু। সিদ্ধার্থবাবু, জ্যোতিবাবু কখনো বাজারে যাননি। বুদ্ধবাবু রিকশায় চাপেন, বাজারে যান। আর নামটা দেখুন, বুদ্ধদেব।...বিধানচন্দ্র, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থ হচ্ছে সংসারী নাম।...এ রকম নাম যার, তাকে আমরা ভোট দেব না, তো অন্য লোককে ভোট দেব? সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কেমন আছেন? ওরা বলল, এই যে রাস্তাটা দেখছেন, এর নাম সুচেতনা (‘সুচেতনা’ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মেয়ের নাম)। আমাদের এখানে একটা ভাটিখানা আছে, খুব মারপিট চলত আগে, মদ খেতে খেতে। আমরা সেটার নাম দিয়েছি সুচেতনা...বাংলা বারের প্রতিশব্দ আর কি। ওখানে মদ খেয়ে এখন আর কেউ চেতনা হারাচ্ছে না। ফলে বুঝতেই পারছেন, আমরা সবই বুদ্ধবাবুর লোক। এ গল্পটা বের হওয়ার পর বুদ্ধবাবু আমায় বললেন, আমাকে নিয়ে লিখলেন, ঠিক আছে; আমার মেয়েকে জড়ালেন কেন? আমি বললাম, ‘হাওড়ার একটা লাইব্রেরি উদ্বোধন করতে তোমার মেয়ে আর তোমার স্ত্রী গিয়েছিলেন, লাইব্রেরিটার নাম রাখা হয়েছে সুচেতনা পাঠাগার। তোমার মেয়ে এখনই এমন কী যোগ্যতা অর্জন করেছে যে তার নামে একটা পাঠাগার রাখা হবে? যেহেতু সে তোমার মেয়ে, তাই রাখা হয়েছে।’ এখন, আপনি কী মনে করেন না, এর চেয়ে সরাসরি আক্রমণ করে লেখা—আর বড়াই করে বলি, আমাদের কোনো লেখকই লিখছেন না। লিখতে পারেন, কিন্তু লিখছেন না।
তাপস কুমার দত্ত: এত সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সমরেশ মজুমদার: থ্যাঙ্ক ইউ।

উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দত্ত। এই লেখক সদ্য গত হয়েছেন। আর তাই সাক্ষাৎকারগ্রহীতা ও বন্ধ সাপ্তাহিকটির তখনকার নির্বাহী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকারের সম্মতিক্রমে আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।
তাপস কুমার দত্ত: ওপার বাংলার বাঙালিদের সঙ্গে এপার বাংলার বাঙালিদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যে পার্থক্য, সেটা যত দিন যাচ্ছে ততই কি দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: দুটো ঘটনা ঘটেছে এখানে, সেটা হচ্ছে—১৯৪৭ সালের আগে যে বাংলা, একত্র দুই বাংলা, যেখানের হিন্দু আর বাঙালিরা ছিল সম্পূর্ণ কলকাতামুখী। মুসলমান বাঙালিদের মধ্যে দুটো শ্রেণি ছিল—একটা শ্রেণি অত্যন্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ, শিক্ষিত লোক এবং বেশির ভাগই ছিল অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মুসলমান। এ অল্প ও অশিক্ষিত মুসলমানদের ওপর স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিরা ডমিনেট করল। ফলে যখন দেশ ভাগ হলো, তখন অল্পশিক্ষিত অশিক্ষিত মুসলমানেরা উল্লসিত হলো, কারণ, শিক্ষিত বাঙালিরা ভয় পেল, দু-একটা জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলো। আমি বাংলাদেশের অনেক জেলার কথা জানি, যেখানে আজ অবধি কোনো মানুষ খুন হয়নি দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে। যেমন ধরুন, রংপুর। সেখানে আজ অবধি কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত না ঘটা সত্ত্বেও রংপুর থেকে অনেক মানুষ চলে এসেছে ভারতবর্ষে। তখন এ রকম একটা প্রচারণা এসেছিল—পূর্ব পাকিস্তান মুসলমানদের জায়গা। অতএব, হিন্দুরা সেখানে থাকলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। তাই ছোটো ইন্ডিয়া। সেই ছোটার কাহিনিটা গত ৫৫ বছরের। সেই ছোটার কাহিনিতে অনেক মানুষ একেবারে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে তলিয়ে গেছে। আবার অনেক মানুষ সংগ্রাম করে করে ওপরে উঠেছে।...
তাপস কুমার দত্ত: এরপর থেকেও তো অনেক সংখ্যালঘু ওপারে চলে গেছে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এপার থেকেও গেছে, তবে তা আনুপাতিক হারে যথেষ্ট কম। যা বলছিলাম, এ ৫৫ বছরে যদি কেউ লাভবান হয়ে থাকে, আমি এপার বাংলার কথা বলছি—তা হলে হয়েছে পশ্চিম বাংলার মেয়েরা। এই যারা পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিল—সংগ্রাম করেছে, কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে, বস্তি বা কলোনিতে কোনোক্রমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে; তাদের দেখাদেখি পশ্চিম বাংলার কনজারভেটিভ পরিবার—যারা মেয়েদের অন্দরমহলে ফেলে রেখেছিল এবং অফিস-কাছারিতে যাওয়া তো স্বপ্নের বাইরে ছিল। যখন পূর্ববঙ্গের মেয়েরা জীবনসংগ্রামের বাধ্যবাধকতায় গ্র্যাজুয়েশন করে স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন অফিসে চাকরিতে ঢুকল; তখন এখানকার মেয়েরা উৎসাহিত হলো। আমরা যখন কলেজে পড়তাম; সন্ধ্যা ৬টার পর ট্রামে-বাসে কোনো মেয়েকে দেখা যেত না; যদি কোনো মেয়েকে দেখা যেত তা হলে সে নিশ্চয়ই বাঙাল (পূর্ববঙ্গীয়) হতো। কিন্তু এ পশ্চাৎপট একদম পাল্টে গেল ১৯৬৮ সালের পর থেকে। তখন বাস্তবিক নিষ্পেষণে পশ্চিম বাংলার মেয়েরাও বেরোতে শুরু করল, যেটা বলতে গিয়ে সরে এসেছি—সেটা হলো, এই দেশবিভাগ এবং এ দেশে উদ্বাস্তু স্রোত আসার অনেক খারাপ দিকের এই একটা ভালো দিক, আমাদের মেয়েরা অর্গল ভেঙে বেরোতে পেরেছিল। কিন্তু ওখানে (বাংলাদেশে) যারা রয়ে গেল (হিন্দু সম্প্রদায়) তাদেরও, আমরা দেখেছি, কেউ ১৯৬৭, কেউ ১৯৭০, কেউ ১৯৭৬-এ চলে আসতে লাগল।
তাপস কুমার দত্ত: এখনো কি অল্পবিস্তর চলে আসছে?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এখনো আসছে এবং এদের একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে এরা আওয়ামীপন্থী ছিল। অর্থাৎ এ দলটির কাছে ওরা নিরাপদ বোধ করত।
তাপস কুমার দত্ত: দেশভাগের পর ওপার বাংলার কী কী বিশেষ পরিবর্তন আপনার কাছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়েছে?
সমরেশ মজুমদার: ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এ ২৪ বছরে বাঙালির জীবনে পূর্ববঙ্গে একটা জিনিসেরই আমদানি ঘটেছে, সেটা হলো ইসলাম এবং ইসলামকেন্দ্রিক আরবি-ফারসি শব্দ। ওই সময় যাঁরা লেখালেখি করতেন, যেমন ধরুন—শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস—এঁরা যে বাংলা লিখতেন, তা ছিল পশ্চিম বাংলার বাংলা; অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারকৃত বাংলা। এঁরা বাংলার প্রাচীন সাহিত্য এবং রামায়ণ-মহাভারত ও আরও সব পৌরাণিক...প্রাচ্য ও পশ্চিমের সাহিত্যের ওপর ভালো দখল রাখতেন এবং সেটা তাঁদের ভেতরে লালন করতেন। ১৯৭১ সালের পর একটা আবেগ এল, আবেগের সঙ্গে ভয় এল। ভয়টা এই—আমরা এত দিন উনুনে পুড়ছিলাম, উনুন থেকে লাফিয়ে গরম তেলে পড়লাম না তো? অর্থাৎ আমরা পাকিস্তানের অত্যাচারে জর্জরিত হচ্ছিলাম, এখন ভারত বড়দাদার মতো দাদাগিরি করবে না তো? আমাদের দখল করবে না তো? তার কিছু কিছু ইন্ধন—আপনারা জানেন—ভারত যে সম্পূর্ণ বৈষ্ণব হয়ে ছিল তা নয়, ভারতের তরফ থেকে যারা দু-একটা বদমায়েশি কাজ করেছে, সেসব বাংলাদেশের কাছে প্রবল হয়ে ধরা দিল। ১৯৭১ সালের ওই আবেগ যখন কমতে শুরু করল, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর ওখানকার রাজনৈতিক দলগুলো জনসাধারণকে সস্তা পথে পাওয়ার জন্য অ্যান্টি-ভারত আবহাওয়া তৈরি করল এবং সেটা তাদের ভোট অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়কও হলো। এ সময় থেকে আমরা দেখতে শুরু করলাম, বাংলা সাহিত্যে যা লেখালেখি হচ্ছে, খবরের কাগজে রিপোর্টিংয়ে যে বাংলায় লেখালেখি হচ্ছে, সেখানে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। এর একটা উদাহরণ হলো জিম্মা। এ ‘জিম্মা’ শব্দটা আগে ওপার-এপার, কোনো বাংলায়ই ব্যবহৃত হতো না। যেমন খাবারটা খেয়ে দারুণ ‘মজা’ লাগল। এ ‘মজা’ শব্দটা হলো রসে-বসে আনন্দে আছি। তা খাবারটা খেয়ে ‘মজা’ লাগবে কেন আমার? খাবারটা খেয়ে আমার দারুণ ভালো লাগবে, অথবা আমি খুব আনন্দ পেলাম খেয়ে। কিন্তু ‘মজা’ লাগা বলতে কোথাও যেন একটু কৌতুক মেশানো থাকে। এ ধরনের কিছু শব্দ তৈরি হতে লাগল। এসব সচেতনভাবে তৈরি হতে লাগল, যাতে পশ্চিম বাংলার ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষা আস্তে আস্তে একটু একটু করে আলাদা হতে থাকে। আবার, আমরা দেখতে পাই, ১৯৬০ বা ’৬৫ সাল অবধি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের আগ অবধি যেকোনো মুসলিম পরিবারে আরবি বা ফারসি নাম দেওয়া হতো। কিন্তু এর পর থেকে দেখা গেল তাদের নামের পাশে ব্র্যাকেট করে একটা ডাকনাম দেওয়া হলো। ১৯৪০-৫০ সালের দিকে কোনো মুসলমানের ডাকনামের তেমন প্রচলন ছিল না। ক্রমে এ ডাকনামই তার হাইলাইটস পেত বেশি, আসল নামটা আড়ালে থাকত। যেমন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। আমরা সবাই জানি ‘বন্যা’। এটা কিন্তু পাশাপাশি সচেতনভাবে বাঙালিত্ব ধরে রাখার প্রচেষ্টা। এর পরবর্তী প্রজন্ম, সত্তরের দশক থেকে যে প্রজন্ম শুরু হলো—তারা আরও অদ্ভুত হলো। তাদের আবার নাম হয়তো আবুল হায়াত, মেয়ের নাম বিপাশা হায়াত বা সুবর্ণা মুস্তাফা। হায়াত বা মুস্তাফা তার পারিবারিক পদবি কিন্তু নামটা বাংলা শব্দ। অর্থাৎ আগে যেটা ব্র্যাকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেটা এখন নামের সাইনবোর্ডে এসে প্রকাশ হলো। পাশাপাশি আরও একটা অদ্ভুত ছবি আছে; ছবিটা হলো—চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মানুষ, ধরুন একজন মা; তার ছেলে হয়তো ঢাকায় চাকরি করে। তিনি যখন তার ছেলেকে চিঠি লিখছেন, তখন চট্টগ্রামের ভাষায় লিখছেন না। তিনি বইয়ের ভাষায় চিঠি লিখছেন এবং ছেলেও তা-ই করছে। কিন্তু ছেলে আর মায়ের যখন পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয়, তখন কিন্তু তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলেন, যা ঢাকার লোক বুঝবে না। তা হলে চিঠিতে কেন বাংলা বর্ণমালায় চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার করছে না? এ নিয়ে আমার নিজস্ব অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু এ বাঙালিত্ব বজায় রাখার জন্য একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি, একবার এক অনুষ্ঠানে একজন লোকের সঙ্গে—তাকে বাংলাদেশের মনে হওয়ায়—কথা বলতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বাংলাদেশের? কোন জেলায় বাড়ি?’ তিন-চারবার প্রশ্ন করার পরও কোনো উত্তর পেলাম না। লোকজন অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার, তুমিও বাঙালি, সে-ও বাঙালি অথচ একে অন্যের ভাষা বুঝতে পারছ না?’ আসলে সে সিলেটের বাঙালি। সে আমাদের ভাষা ভালোভাবে জানে না এবং নিজে যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষা আমাদের কাছে অজানা, তাই কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে। এই যে এত পার্থক্য—এসব পার্থক্যের সুযোগ নিয়েছে—আমার মনে হয়, কিছু ধর্মান্ধ মৌলবাদী, যাতে বাংলা ভাষাকে ভাঙা যায়, নষ্ট করা যায়। একটা নতুন ভাষা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধরুন, যদি মসজিদে যান, মসজিদে যে প্রার্থনা হয় তা বাংলায়। যেখানে একদম পরিষ্কারভাবে, ‘হে পরম পিতা!’—এভাবে শুরু করে।...‘আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি; আমাদের প্রিয়জন তোমার কাছে গিয়েছে, বাসা থেকে কেউ যদি বিদেশে যায়, তবে তার চিঠিপত্তর, টেলিফোনে খবর পাওয়া যায়। তিনি আজ যেখানে গেছেন, সেখানে এসব কোনো পথ নেই; কিন্তু আমরা জানি, তিনি তোমার কাছে গেছেন। অতএব, তুমি তাকে ভালো রাখবে...। আমিন!’ এ কথাগুলো অতি পরিষ্কার সিম্পল বাংলা কথা, এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না; অশিক্ষিত লোকও স্পষ্ট বুঝতে পারছে; কিন্তু ‘আমিন’ শব্দটা উচ্চারণ হওয়ামাত্র একটা অন্যরকম গন্ধ এল। আমিন কথাটা খ্রিষ্টানরা বলে। খ্রিষ্টানরা ‘পরম পিতা’ও বলে। কোরআনকে তো পৃথিবীর সব দেশের সব মুসলমান যথাযথ অনুসরণ করে না। আজকের পৃথিবীর সব মুসলমানের...বাংলাদেশের মুসলমানদের আইডিয়াল হচ্ছে ‘আরবি’ এবং আরবের লোকজন। অথচ আরবরা যে বুর্জোয়া জীবনযাপন করেন—মেয়েদের ক্ষেত্রে পার্টিকুলারলি—সেটা মানতে পারেন না ঢাকার মুসলমানরা; কিন্তু এরপরও ওরা আইডিয়াল। আজ যদি তুমি ঢাকা বা ফরিদপুরের রাস্তায় রোজার সময় যাও, তাহলে দেখবে, পর্দা টানিয়ে হোটেলে খাওয়াদাওয়া চলছে। অর্থাৎ পর্দা টানিয়ে দুপুরে খাওয়া যায়। আমার বন্ধুবান্ধব, যাঁরা আমার কাছে রোজার সময় আসছেন, তাঁরা প্রায়ই বলতেন, ভাই, আমি অসুস্থ, রোজা রাখতে পারছি না। কেউ বলতেন, আমি তো এখন পর্যটক! কারও হাঁটুতে ব্যথা, একটা অজুহাত, যেহেতু নামাজ পড়তে পারবে না...এসব অজুহাত বা ছুতো—এগুলো সবই কিন্তু বেরিয়ে আসার চেষ্টা। কিন্তু তারা ভয়ে থাকে, বেরিয়ে আসতে ভয় পায়। ফলে আমাদের সঙ্গে ওদের যে ডিফারেন্স, সেই ডিফারেন্সটা যথেষ্ট বড়। কারণ, আমরা যারা জন্মসূত্রে হিন্দু, তাদের ৮০ ভাগ হিন্দুধর্মের এ-বি-সি-ও পালন করি না। অথচ আমরা হিন্দু। বলতে হয়, তাই হিন্দু। আমাদের ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়ার মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মাচরণ নেই। দুর্গাপূজা এলে আমরা প্ল্যান করি কোথায় বেড়াতে যাব। পুজোর আচার-আচরণের মধ্যে আমরা নেই। আমরা নানা খাবার দিয়ে, বিস্কুট, চাল-ডাল, চকলেট দিয়ে মূর্তি গড়ি, ছেলেখেলার মতো। কালীপূজার সময় আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখি, পটকাবাজির ভয়ে। তাহলে আমরা হিন্দু হলাম কোথায়? আমরা ধর্ম থেকে সরে গেছি আস্তে আস্তে। তবে এ ধর্ম আমাদের কিছু দেয় না, আমাদের থেকে কিছু নেয়ও না। যখন রামকে নিয়ে সারা ভারতে এত হইচই কাণ্ড চলত, তখন আমরা পশ্চিম বাংলার মানুষজন রামকে একবারও দেবতা বলে মনে করি না। আমরা হনুমানকে দেখে ঠাট্টা করি, ‘কলা খাবি’ বলে। কিন্তু হনুমান ওদের কাছে ঈশ্বরের অবতার। ঘটনা যখন এ রকম ঘটে যায়, তখন বাংলাদেশের মুসলমান যারা; যারা সত্যিকার অর্থে কোরআন মানে, ধর্মান্ধ নয়, তারা কিন্তু আমাদের থেকে অনেক ডিসিপ্লিনড। ধর্ম ডিসিপ্লিন তৈরি করতে সাহায্য করে। ধর্ম একত্র করে মানুষকে। কিন্তু সেই একত্র করার মাঝখানে ধর্মান্ধ বা ধর্ম ব্যবসায়ীরা যত গণ্ডগোল পাকায়। ফলে আমাদের মধ্যে ক্রমেই পার্থক্য বাড়ছে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার কি মনে হয়, কয়েক দশক আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে রাজনীতিতে যে রকম মন্দির-মসজিদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, তাতে করে আগামী কয়েক দশক পর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রকম ধর্মরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে?
সমরেশ মজুমদার: আমার তো উল্টো মনে হয়। আমার মনে হয়, ধর্মান্ধ যারা—সে হিন্দু বা মুসলমান হোক, খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা কখনো শুনিনি। যদিও ক্রিশ্চিয়ানিটি পৃথিবীজুড়ে ছিল, কিন্তু আজ অবধি খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা শুনিনি, বৌদ্ধ ধর্মান্ধ শুনিনি।
তাপস কুমার দত্ত: ইউরোপে এককালে খ্রিষ্টানরাই ব্লাসফেমির মতো ঘৃণ্য আইন ধর্মের বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছিল—ওসব কি ধর্মান্ধতা নয়?
সমরেশ মজুমদার: খ্রিষ্টানরা এখন অনেক শ্রেণির হয়ে গেছে, সেখানে তারা একত্র নয়।
তাপস কুমার দত্ত: না, সেটা অন্য ব্যাপার, প্রশ্নটা হলো...
সমরেশ মজুমদার: আমাদের ভারতবর্ষেও তো হিন্দু ধর্ম একেক জায়গায় একেক রকম। আপনি সাউথ বা নর্থ ইন্ডিয়ায় বা অন্য প্রান্তে যে হিন্দু ধর্ম দেখবেন, তা পশ্চিম বাংলায় পাবেন না; এক জায়গার সঙ্গে অন্য জায়গায় ধর্মীয় অমিলই বেশি।
তাপস কুমার দত্ত: প্রশ্নটা তা নয়। একটা ধর্ম সম্প্রদায় নানা খণ্ডে বহু ধারায় বিভক্ত হতেই পারে। কিন্তু যেকোনো ধারারই একটা প্রচ্ছন্ন গোঁড়ামি আছে, মৌলবাদ আছে; আর সেটাই দিন দিন বিশ্বের ওপর বেশি পরিমাণে চেপে বসছে। আপনি কী মনে করেন?
সমরেশ মজুমদার: না, আমি এর সঙ্গে একমত নই। আমার তো মনে হয়, ধর্ম পৃথিবী থেকে আস্তে আস্তে লোপ পেতে চলেছে। এখন যে চিৎকারটা আমরা শুনতে পাচ্ছি—কারণ, ধর্মবাদীরা আতঙ্কগ্রস্ত বলে চিৎকার করছে।
তাপস কুমার দত্ত: প্রথাগত ধর্মে আপনার বিশ্বাস কতটুকু?
সমরেশ মজুমদার: আমি ধর্মে একদম বিশ্বাসী নই।
তাপস কুমার দত্ত: আর বিবাহ প্রথায়?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, বিবাহ প্রথায় বিশ্বাসী। তবে বিয়ে কীভাবে হবে, সেটা নির্ভর করছে যারা বিয়ে করছে, তাদের ওপর।
তাপস কুমার দত্ত: তৃতীয় বিশ্বে বসবাস করার একটা মানসিক যন্ত্রণা আছে। বিশেষ করে, শিল্পী-সাহিত্যিক...যেকোনো সৃজনশীল মানুষের। আপনি তা কতটা অনুভব করেন?
সমরেশ মজুমদার: এটা ভারতবর্ষে, মানে পশ্চিম বাংলায় নেই, আমি কখনো অনুভব করিনি। এটা গুজরাটে থাকতে পারে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার লেখালেখিতে বা ভাবনায় কখনো সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনো প্রতিবন্ধকতা আসেনি বলছেন?
সমরেশ মজুমদার: সিপিএম যখন ক্ষমতায় এল, তখন আমি নকশাল আন্দোলন নিয়ে উপন্যাস লিখলাম—কালবেলা। তো কালবেলার নায়ক অনিমেষ তখন কিন্তু সিপিএমের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। বলেছে, সিপিএম ভ্রষ্টাচারী। আমাকে কিন্তু ও রকমভাবে কোনো সরকার বা শক্তি আপত্তি করেনি।
তাপস কুমার দত্ত: নিজের বিচারে আপনার প্রিয় লেখা কোনটি?
সমরেশ মজুমদার: তিনটি লেখা আমার খুব প্রিয়। সেটা হচ্ছে—‘উত্তরাধিকার’...
তাপস কুমার দত্ত: এ সিরিজটা? অর্থাৎ ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’?
সমরেশ মজুমদার: না, ‘কালবেলা’ আমার প্রিয় নয়। ‘এখনও সময় আছে’ বলে আমার একটা উপন্যাস আছে, আমার ভীষণ প্রিয়। আর গত বছর আমি ‘দেশ’-এ একটা উপন্যাস লিখেছি—‘উৎসারিত আলো’—এ তিনটি।
তাপস কুমার দত্ত: লেখালেখিতে কতটা অসন্তুষ্টি বা অতৃপ্তি রয়ে গেছে?
সমরেশ মজুমদার: প্রতিটি লেখায়ই আমার অসন্তুষ্টি রয়ে যায়। আমার মনে হয়, আবার লিখলে ভালো করতাম। কিন্তু একবার বই আকারে...।

তাপস কুমার দত্ত: সেটা ওই বইটার নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর। আমার জিজ্ঞাসা হলো, এমন কোনো প্রিয় লেখা কি আপনার ভেতরে লালিত আছে, যা এখনো আপনি লিখে উঠতে পারেননি?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এই যে আপনাকে এর আগে যে কথাগুলো বললাম। আমি হুমায়ূন (আহমেদ)-কে বারবার বলেছিলাম, দ্যাখো, তুমি এত জনপ্রিয় একজন লেখক, তোমার এত হাজার হাজার বই বিক্রি হয়, তোমার তো এখন হারানোর কোনো ভয় নেই। তা তুমি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ২০০৪ সালের এই সময়কাল পর্যন্ত কয়েকটা খণ্ডে লেখো না, উপন্যাস আকারে। সে বলল, আমার লিখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সাহস পাই না। আমি অ্যাকসিডেন্টলি আপনাদের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিচিত ছিলাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আমার কাছে এরশাদ খুব কালারফুল চরিত্র। ঘৃণ্য, কিন্তু কালারফুল। কেউ ওর সঙ্গে দেখা করার সাহস পায়নি, যেতে চায়নি; আমি গিয়েছিলাম ওর আমন্ত্রণে। আমার বিপুল অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এটা নিয়ে তিনটি পর্বে ভাগ করে লিখতে আমার খুব ইচ্ছা হয়। ১৯৪৭ থেকে ’৬৯, শেখ মুজিবুর যখন স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, সেই অবধি। এরপর ১৯৬৯ থেকে ’৭১ এবং ’৭১ থেকে এখন অবধি। এ তিনটি পর্বে বাংলাদেশের পটভূমিতে যদি পারি, তো কখনো লিখব। আমি জানি, এ লেখা এই সরকার থাকলে ওখানে যাবে না।...এই যে দ্যাখো, ‘এত রক্ত কেন’ বইটা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে; ঢাকার ফুটপাতে কিন্তু বইটা পাওয়া যায়। তো ব্যান্ড করে লাভটা কী হলো?
তাপস কুমার দত্ত: এ বইটার জন্য বাংলাদেশের একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে ও-দেশে যাওয়ার ভিসা আপনাকে আটকে দেওয়া হয়। এখন যদি এ জাতীয় সমস্যা না থাকে, তা হলেও কি বাংলাদেশে যেতে কোনো আপত্তি থাকবে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি জানি, এ সরকার যদি এটা তুলেও দেয়, তবু সরকারের যারা অনুচর, তারা আমাকে আক্রমণ করবে।
তাপস কুমার দত্ত: অর্থাৎ আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন?
সমরেশ মজুমদার: অফ কোর্স। আমি শেষবার যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, তখন এত রক্ত কেন বেরিয়েছে, কিন্তু ব্যান হয়নি; সেদিন ঢাকায় এয়ারপোর্টে নেমেই বেশ সমস্যায় পড়েছিলাম। আমাকে নিয়ে অফিসাররা হঠাৎ তটস্থ হয়ে উঠলেন, কেন আমি এসেছি? কী উদ্দেশ্যে এসেছি? তো, আমাকে রিসিভ করতে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদ। আমাকে নিয়ে সে সোজা চলে গেল নুহাশ পল্লীতে। ওখানে তিন রাত ছিলাম। এরপর রাতের অন্ধকারে ঢাকায় এলাম।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অন্য কোনো ভয় পাচ্ছিলেন?
সমরেশ মজুমদার: পুলিশ বোধ হয় ভাবছিল, আমাকে অ্যারেস্ট করা উচিত কি উচিত না। একদিন একটা অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে সেখান থেকে সোজা এয়ারপোর্টে। এরপর আমি যখন অনুষ্ঠানে যাওয়ার পরবর্তী আমন্ত্রণ পেলাম, তখন তারা আমাকে ভিসা দিল না।
তাপস কুমার দত্ত: এখন আপনি কী ধরনের বই পড়ছেন?
সমরেশ মজুমদার: কয়েক দিন আগে ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ হুমায়ুন আজাদের বইটা সকাল থেকে পড়তে শুরু করেছিলাম। সেদিনই সকাল ৯টায়—বইটা পড়ছি, হাতে; খবর এল হুমায়ুন আজাদ মারা গেছেন। ওই বইটাতেই একটা জায়গায় লেখা ছিল, যেকোনো দিন তার মৃত্যু হতে পারে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। এ বইটা খুব বড় বা দামি লেখা নয়। খুব আবেগের লেখা, একই কথা বারবার লেখা; কিন্তু কথাগুলো লিখতে সাহস পায়নি তেমন কেউ।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি কি তাঁর আর কোনো উপন্যাস পড়েছেন?
সমরেশ মজুমদার: একটা পড়েছিলাম অনেক আগে, নামটা ভুলে গেছি। দাঁড়াও, নামটা মনে করি...
তাপস কুমার দত্ত: ‘শুভব্রত’, তার সম্পর্কিত সুসমাচার?
সমরেশ মজুমদার: না, আর কয়েকটা নাম বলো তো।
তাপস কুমার দত্ত: ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, সবকিছু ভেঙে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, হ্যাঁ, ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, বইগুলো বেশির ভাগ সময়ই কলকাতায় সহজে পাওয়া যায় না।
তাপস কুমার দত্ত: বয়স তো যথেষ্ট হলো। একদিন চলে যেতে হবে, তার দিনক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে...কোনো আতঙ্ক বা আক্ষেপ?
সমরেশ মজুমদার: না, না। আজ রাতেও চলে যেতে পারি; আবার হয়তো দশ বা কুড়ি বছর পরও যেতে পারি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অবশ্যই দীর্ঘায়ু হবেন, আমি এর দার্শনিক দিকটা জানতে চাচ্ছি।
সমরেশ মজুমদার: আমি খুব বাস্তববাদী মানুষ। আমি আজকে লেখালেখি করে যেটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি, সেটুকু আমার পাওয়ার কথা ছিল না। আমার লেখক হওয়ারই কথা ছিল না।
তাপস কুমার দত্ত: অনেক বছর আগে বাংলাদেশের একটা সাপ্তাহিক কাগজে আপনি বলেছিলেন, এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেবেন।
সমরেশ মজুমদার: ওসব কথা বাড়িয়ে লিখতে ভালোবাসে কিছু সাংবাদিক। যেমন অন্য একটা জায়গায় আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তসলিমার ‘ক’ পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে? আমি এর উত্তরে বলেছিলাম, আমি ‘ক’ পড়েছি এবং আমার মনে হয়েছে, একটা বারবনিতাকে যদি বলা হয়, তোমার আত্মজীবনী লেখ, সে তার অনেক কষ্টের কথা লিখবে; কিন্তু যেসব ক্লায়েন্ট তার কাছে আসে, তাদের বিস্তৃত পরিচয় দেবে না সে, এটুকু সৌজন্য দেখাবে। এ উত্তরটা তারা এভাবে লিখেছে যে, সমরেশ মজুমদার বলেছেন, তসলিমা নাসরিন বেশ্যা। এর উত্তরে তসলিমা লিখলেন আনন্দবাজারে, সমরেশ মজুমদারের গলায় গলা মিলিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, তসলিমা বেশ্যা। এর উত্তরে আমি আবার চিঠি লিখলাম আনন্দবাজারে—কোথায়, কখন বলেছি? কাকে বলেছি? যদি দয়া করে আমাকে জানানো হয়...। অতএব, যদি কোথাও কখনো লেখা হয়ে থাকে, আমি বলেছি এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেব—এগুলো বাজে কথা। হয়তো এভাবে বলেছি, লিখে টাকা পাওয়া যায়, জানতাম না। যখন লিখে টাকা পেতে শুরু করলাম, তখন আমাকে যদি বলা হয়, কেন লেখেন? আমি বলি, টাকার জন্য লিখি।
তাপস কুমার দত্ত: কথাটা এভাবে বলেছিলেন, একজন কৃষক যে কারণে চাষাবাদ করেন, একজন...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম, একজন কৃষক যখন চাষাবাদ করেন, তিনি তো দেশ গড়ার জন্য চাষ করেন না; তিনি তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য চাষাবাদ করেন। একজন মাস্টার যখন পড়ান, তখন মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার চেয়ে তার সন্তানসন্ততিকে বড় করার জন্য পড়ান। তো, একজন লেখকের কী দায় আছে, তিনি দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন? আমাদের দেশে কোনো লেখক যদি জনপ্রিয় হন, তখন ধরেই নেওয়া হয়, ওগুলো ভুসিমাল। যদি সে ধরনের লেখক জনপ্রিয়তা না পান বা বিক্রি না হয়, তখন তিনি একজন বিরাট লেখক। প্রশ্ন হলো, জনপ্রিয়তা যদি কেউ বেশি পান, কেন পান? কারণ, পাঠকদের ভালো লাগছে বলেই। কোনো একটা বই হয়তো বেশি পাঠকের ভালো লেগেছে। এমন নয় যে বছরের পর বছর তিনি জনপ্রিয় হয়ে থাকেন। তা হলে যিনি পাঠককে সহজে স্পর্শ করতে পারছেন না, তার কোথাও খুঁত আছে নিশ্চয়ই। ভালো একটা ছবি তিন দিন সিনেমা হলে থেকে চলে গেল। আর একটা ছবি ‘বাবা কেন চাকর’ মাসের পর মাস চলল, জনপ্রিয় হলো। আবার ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর যখন হাজারটা শো চলে, তখন বলতেই হয়, গুপী গাইন বাঘা বাইন খারাপ ছবি? চার্লি চ্যাপলিন তা হলে খারাপ ছবির নাম? ‘পথের পাঁচালী’ও ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল—ওটাও তা হলে খারাপ ছবি?

তাপস কুমার দত্ত: ধরুন, হাইপোথেটিক্যালি আমরা ধরে নিলাম, কোনো ধনকুবের আপনার যাবতীয় চাহিদার স্পন্সরশিপের দায়িত্ব নিল। একজন কৃষক যে কারণে কৃষিকাজ করেন বা আর দশজন পেশাজীবী মানুষ যে কারণে পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, সেই প্রয়োজনটা আপনার আর রইল না। তখন কি লেখালেখি আপনি ছেড়ে দেবেন?
সমরেশ মজুমদার: চাহিদার কিন্তু শেষ নেই। আগে বাস-ট্রামে চড়তাম, আমার এখন বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। এখনো অবশ্য ইচ্ছা করে মাঝেমধ্যে বাস-ট্রামে উঠি। তো, আগে আমি জলপাইগুড়ি আমার বাড়ি যেতাম সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে, রিজারভেশন ছাড়া। এরপর রিজারভেশনে। এরপর এসি থ্রি-টিয়ার, এরপর এসি টু-টিয়ার। এর মানে এই নয়, আমি এখন এসি টু-টিয়ার ছাড়া যেতে পারব না। কিন্তু যদি কমফোর্ট পাই, তা আমি নেব না কেন?
তাপস কুমার দত্ত: আমি বলতে চাচ্ছি, শুধু ভরণপোষণ আর কমফোর্ট—এসব কারণেই লেখালেখি? ভোগবাদী ব্যাপার ছাড়া তা কি নিজের ভেতর থেকে উঠে আসে না?
সমরেশ মজুমদার: শুনুন, আমাকে যদি এক কোটি টাকা দেওয়া হয় একটা উপন্যাস লেখার জন্য—সাত দিন চেষ্টা করেও লিখে উঠতে পারব না। আবার, আমাকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি, আমি লিখতে বসলাম, হয়তো দুদিনেই লেখাটা শেষ করে ফেলতে পারব।
তাপস কুমার দত্ত: তা হলে লেখালেখিটা শুধু হালচাষির হালচাষের মতো জীবিকা নির্বাহ নয়, আলাদা একটা ভেতরের তাগিদও...
সমরেশ মজুমদার: অবশ্যই।
তাপস কুমার দত্ত: বেশির ভাগ জনপ্রিয় লেখকের লেখায় দেখা যায়, কতগুলো পাগলামোর ঘটনা, কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনা, কিছু সুখকর ঘটনা ও একটু বেদনাদায়ক ঘটনা। যেন ছাঁচে ঢেলে গরম তেলে ভেজে তোলা হট কেক...
সমরেশ মজুমদার: এটা আমার কাছে খুব অস্পষ্ট। ধরুন, আমার একটা বই, ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে এক লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। সেই বইটা কলকাতায় ৫০-৬০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। ধরে নিতে পারি, বইটা জনপ্রিয়।
তাপস কুমার দত্ত: বইটার নাম কী?
সমরেশ মজুমদার: ‘গর্ভধারিণী’। তা ওটা কোন ফর্মুলায় লেখা, বলুন তো?
তাপস কুমার দত্ত: ওই বইটাতে আসলে এমন একটা সাসপেন্স বা থ্রিল এবং এর সঙ্গে আবেগ, বর্তমান সমাজব্যবস্থার কিছু মানুষের অমানবিক নোংরা দিকের প্রতি...।
সমরেশ মজুমদার: এসব তো অনেক বইতেই আছে।
তাপস কুমার দত্ত: হ্যাঁ, তা ঠিক, ‘মেঘ ছিল, ‘বৃষ্টিও’-তেও আছে। ‘আট কুঠুরী নয় দরজা’তেও।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে সেগুলো ওভাবে বিক্রি হয়নি কেন?
তাপস কুমার দত্ত: না, আমি বলছি ‘গর্ভধারিণী’র মতো বিশাল জনপ্রিয়তা না পেলেও ওই লেখাগুলোও বেশ জনপ্রিয়।
সমরেশ মজুমদার: যদি জানতাম, গর্ভধারিণীর মতো ওভাবে সাসপেন্স মেশালে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হবে, তা হলে তো সব বই ওভাবেই লেখা হতো। তা হলে ‘সাতকাহন’ কেন এত বিক্রি হলো? স্ট্রাগল করা মেয়েদের গল্প তো আমি আগেও লিখেছি, পরেও লিখেছি, সেগুলো কেন সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হলো না? আমি যদি আরেকটা দীপাবলীকে নিয়ে লিখি, সেটা কি সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হবেই?
তাপস কুমার দত্ত: সাতকাহনের দ্বিতীয় পর্ব কিন্তু প্রথম পর্বের মতো অত জনপ্রিয় নয়।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে? আসলে আমার কাছে মনে হয়, যেকোনো...আমি আপনাকে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখাটার কথা বললাম, ‘এখনো সময় আছে’ বইটা তিন থেকে চার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। লোকে না পড়লে আমার কষ্ট হয়, আমি তো লোকে লোকে গিয়ে বলতে পারি না, আপনি বইটা পড়ুন। কোত্থেকে ‘কালবেলা’ এক লাখ কপি বিক্রি হলো! ‘উত্তরাধিকার’ বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার। অথচ উত্তরাধিকার ওটার চেয়ে অনেক বেটার উপন্যাস। তাই কোন লেখাটা জনপ্রিয় হবে, তা আগে থেকে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। একটা লেখা জনপ্রিয় হতে পারে। একটা মেমসাহেব, একটা দৃষ্টিপাত, একটা মরুতীর্থ হিংলাজ জনপ্রিয় হতে পারে। কয়েকটা নয়।
তাপস কুমার দত্ত: ওপারের লেখকদের লেখা সম্পর্কে...
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, ওপারের এক নম্বরের সঙ্গে দুই নম্বরের ব্যবধান এত বিস্তর...জাফর ইকবাল সম্প্রতি সেই ব্যবধান একটু কমিয়ে এনেছেন। তো, গতবার যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, তখন একজন লেখক আমাকে এসে বললেন, সমরেশ দা, আপনাকে একটা ভালো খবর দিই।
আমি বললাম, কী?
বলল, আমি এখন তিন নম্বরে।
আমি জানতে চাইলাম, কিসের তিন নম্বর? সে জানাল, জনপ্রিয়তার। তার পেছনে নাকি মিলন চলে গেছে, অমুক-তমুক অনেকে চলে গেছে। আমি হাসব না কাঁদব, ভেবে পাচ্ছিলাম না।
তাপস কুমার দত্ত: কে?
সমরেশ মজুমদার: নামটা নাই-বা বললাম।
তাপস কুমার দত্ত: বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের রুচিবোধ আপনার কতটা উঁচুদরের বলে মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: আপনি যা ইচ্ছা তা-ই লিখে পাঠকদের ভোলাতে পারবেন না। পাঠকদের বিচারশক্তি দারুণ প্রখর। একটা লেখা দিয়ে ভোলাতে পারবেন, পরের দুটোয় হাফ ভোলাতে পারবেন; তৃতীয়টায় আর পারবেন না।
তাপস কুমার দত্ত: পাঠকেরা আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমাকে তেমন প্রভাবিত করতে পারে না। তবে কিছু কিছু ঘটনায় মাঝেমধ্যে কষ্ট হয়। একবার বইমেলায় এক ভদ্রমহিলা তিনখানা (বড় ক্যানভাসের) বই বইতে পারছিলেন না, চেহারা দেখে বোঝা যায়, যথেষ্ট (আর্থিক) অসচ্ছল পরিবার। আমি বললাম, আপনি কী করেন?
তিনি বললেন, আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়াই।
আমার খুব খারাপ লাগল, আপনি এত দামি তিনটি বই কিনলেন?
তিনি বললেন, সারা বছর আমরা অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছি।
এরপর দেখলাম, দূরে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। ক্রাচ হাতে, একটা পা ডিফেক্টেড। ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে যেতেই তিনি বললেন, আমি আপনার অনিমেষ।
আমি বললাম, তার মানে?
তিনি জানালেন, তিনি নকশাল আন্দোলন করতেন এবং হাওড়া জেলে পুলিশের অত্যাচারে একটা পা নষ্ট হয়ে (অনিমেষের মতোই) গেছে। আমরা একসঙ্গে থাকি। (অনিমেষ-মাধবীলতার মতো), আমরা বিয়ে করিনি।
আরেকটা ঘটনা বলে শেষ করি—হ্যাঁ, একবার বিদেশে রাতে আমার খুব খিদে পেয়েছে, একটা বড় রেস্টুরেন্ট দেখে ভেতরে ঢুকে পড়ি। এরপর মেনু কার্ডের সবচেয়ে ছোট আইটেম যেটা, সেটার অর্ডার দিলাম। বেয়ারাগুলোকে দেখে মনে হলো এশিয়ান। তো, একটা বেয়ারা এসে বলল, স্যার! আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?
আমি বললাম, ইয়েস।
স্যার! আর ইউ ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল?
আমি আবার বললাম, ইয়েস।
বেয়ারা গিয়ে হোটেল মালিককে তথ্যগুলো জানাতেই হোটেল মালিক উঠে এসে বললেন, নমস্কার স্যার! আপনি বোধ হয় সমরেশ বাবু। আমি আপনার একটাই মাত্র বই পড়েছি। একবার একটা বাস টার্মিনালে দেখলাম একটা বই পড়ে আছে—বাংলা বই, নামটা ‘দৌড়’।
এরপর যতই বলছি, আমার খাওয়া হয়ে গেছে, তবু তিনি আমাকে জোর করে খাওয়াবেন। বিল দিতে গেলাম, বিল নিলেন না। এই অবধি ঠিক আছে। বেয়ারা এরপর বলল, সাহেব, একবার ভেতরে আসবেন? আপায় কইছিল, আপনি সমরেশ মজুমদার কি না জিজ্ঞেস করতে। তো, আমি ভেতরে ঢুকলাম। একজন ভদ্রমহিলা খাটের ওপর বসে নমস্কার জানিয়ে আমার দিকে একটা বই এগিয়ে দিলেন—‘গর্ভধারিণী’। আমার পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। দেখুন, কারোর জানার কথা নয়, আমি ওখানে যাব। কাকতালীয়ভাবে।
তাপস কুমার দত্ত: একবার কবি সম্মেলনে আপনাকে দেশের বাইরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল—কবি হিসেবে, ভুল করে। ঠিক এ রকমই একটা ঘটনার কথা...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আপনি সবই জানেন দেখছি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি বই বাজেয়াপ্ত করাটা কতটা সমর্থন করেন?
সমরেশ মজুমদার: যে কারণে তসলিমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, সেটাকে আমি সমর্থন করি না। তবে আমার হাতে আইন থাকলে তসলিমাকে অভিযুক্ত করতাম। আজ একটা ছেলের সঙ্গে একটা মেয়ের ভালো সম্পর্ক; সম্পর্কটা দুজনকেই আনন্দিত করছে। যদি ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো তিক্ততা আসে, আজকের এ আনন্দটা কিন্তু মিথ্যা হয়ে যাবে না এবং সেই ছেলেটা ও মেয়েটার কোনো রাইট নেই ভবিষ্যতে এই আনন্দিত সম্পর্ককে নিয়ে খোলামেলা...ব্যঙ্গ করে লেখা বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে লেখা। যে ক্ষেত্রে তারা একে অন্যকে ছোট ও অপমান করছে। মিলনের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গিয়ে কী হয়েছে বা অমুকের সঙ্গে অমুকের আর কী হয়েছে—এর ডিটেইলস নিয়ে আমরা আদৌ আগ্রহী নই। আমরা তসলিমার ব্যাপারে এখানেই আগ্রহী যে সে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কী লড়াই করেছিল। তা না করে তার শারীরিক আনন্দের বিবরণ দিয়ে লিখছে—এটা এক ধরনের অসুখ। আমি জানি, আমার বাবা-মায়ের মিলনের ফলে আমি পৃথিবীতে এসেছি; এখন সেই মিলনটা কী রকম ছিল, তার বিবরণ দিয়ে যদি লিখতে যাই, তো আমার জন্মটাকেই আমি সবচেয়ে বেশি কুৎসিত করছি। আমার জন্মের বিবরণের জন্য আমার বাবা-মায়ের শয্যা বিবরণ কি আমি দিতে পারি? নাকি তা আমি ভাবতে চাই? বা ভাবতে পারি?
তাপস কুমার দত্ত: আপনি আপনার খোলামেলা বা বিতর্কিত ভাবনা প্রকাশ করতে কতটা ভয় পান?
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, এ মুহূর্তে বোধ হয় আমিই সবচেয়ে সরাসরি লিখি। ‘পত্রপাঠ’ বলে একটা পত্রিকা আছে, মাসে বেরোয়—সেটায় আমি কলাম লিখি। সেখানে সরাসরি সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে লিখি। একজন কলেজ অধ্যাপককে পুলিশ অ্যারেস্ট করে—জনযুদ্ধগোষ্ঠীর ডায়েরি থেকে নাম পেয়ে তাকে অ্যারেস্ট করে। সারা দিন অত্যাচার করে সন্ধ্যায় তাকে ছেড়ে দেয়। এলাকার লোকজন মনে করে, সে জনযুদ্ধগোষ্ঠীর লোক। সে রেললাইনে আত্মহত্যা করে, তার স্ত্রী এ নিয়ে কেস করে। এ ঘটনা নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। আমি এ-ও লিখেছিলাম, কয়েক দিন আগে ভোটের সময় একজন সাংবাদিক একটা গ্রামে গেছেন। সেখানে এক চায়ের দোকানে নানা আলোচনায় উঠে আসে, আমাদের দেশে যত মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই অবিবাহিত। বিবাহিত ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়, জ্যোতিবাবু। সিদ্ধার্থবাবু, জ্যোতিবাবু কখনো বাজারে যাননি। বুদ্ধবাবু রিকশায় চাপেন, বাজারে যান। আর নামটা দেখুন, বুদ্ধদেব।...বিধানচন্দ্র, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থ হচ্ছে সংসারী নাম।...এ রকম নাম যার, তাকে আমরা ভোট দেব না, তো অন্য লোককে ভোট দেব? সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কেমন আছেন? ওরা বলল, এই যে রাস্তাটা দেখছেন, এর নাম সুচেতনা (‘সুচেতনা’ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মেয়ের নাম)। আমাদের এখানে একটা ভাটিখানা আছে, খুব মারপিট চলত আগে, মদ খেতে খেতে। আমরা সেটার নাম দিয়েছি সুচেতনা...বাংলা বারের প্রতিশব্দ আর কি। ওখানে মদ খেয়ে এখন আর কেউ চেতনা হারাচ্ছে না। ফলে বুঝতেই পারছেন, আমরা সবই বুদ্ধবাবুর লোক। এ গল্পটা বের হওয়ার পর বুদ্ধবাবু আমায় বললেন, আমাকে নিয়ে লিখলেন, ঠিক আছে; আমার মেয়েকে জড়ালেন কেন? আমি বললাম, ‘হাওড়ার একটা লাইব্রেরি উদ্বোধন করতে তোমার মেয়ে আর তোমার স্ত্রী গিয়েছিলেন, লাইব্রেরিটার নাম রাখা হয়েছে সুচেতনা পাঠাগার। তোমার মেয়ে এখনই এমন কী যোগ্যতা অর্জন করেছে যে তার নামে একটা পাঠাগার রাখা হবে? যেহেতু সে তোমার মেয়ে, তাই রাখা হয়েছে।’ এখন, আপনি কী মনে করেন না, এর চেয়ে সরাসরি আক্রমণ করে লেখা—আর বড়াই করে বলি, আমাদের কোনো লেখকই লিখছেন না। লিখতে পারেন, কিন্তু লিখছেন না।
তাপস কুমার দত্ত: এত সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সমরেশ মজুমদার: থ্যাঙ্ক ইউ।

উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দত্ত। এই লেখক সদ্য গত হয়েছেন। আর তাই সাক্ষাৎকারগ্রহীতা ও বন্ধ সাপ্তাহিকটির তখনকার নির্বাহী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকারের সম্মতিক্রমে আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।
তাপস কুমার দত্ত: ওপার বাংলার বাঙালিদের সঙ্গে এপার বাংলার বাঙালিদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যে পার্থক্য, সেটা যত দিন যাচ্ছে ততই কি দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: দুটো ঘটনা ঘটেছে এখানে, সেটা হচ্ছে—১৯৪৭ সালের আগে যে বাংলা, একত্র দুই বাংলা, যেখানের হিন্দু আর বাঙালিরা ছিল সম্পূর্ণ কলকাতামুখী। মুসলমান বাঙালিদের মধ্যে দুটো শ্রেণি ছিল—একটা শ্রেণি অত্যন্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ, শিক্ষিত লোক এবং বেশির ভাগই ছিল অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মুসলমান। এ অল্প ও অশিক্ষিত মুসলমানদের ওপর স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিরা ডমিনেট করল। ফলে যখন দেশ ভাগ হলো, তখন অল্পশিক্ষিত অশিক্ষিত মুসলমানেরা উল্লসিত হলো, কারণ, শিক্ষিত বাঙালিরা ভয় পেল, দু-একটা জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলো। আমি বাংলাদেশের অনেক জেলার কথা জানি, যেখানে আজ অবধি কোনো মানুষ খুন হয়নি দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে। যেমন ধরুন, রংপুর। সেখানে আজ অবধি কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত না ঘটা সত্ত্বেও রংপুর থেকে অনেক মানুষ চলে এসেছে ভারতবর্ষে। তখন এ রকম একটা প্রচারণা এসেছিল—পূর্ব পাকিস্তান মুসলমানদের জায়গা। অতএব, হিন্দুরা সেখানে থাকলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। তাই ছোটো ইন্ডিয়া। সেই ছোটার কাহিনিটা গত ৫৫ বছরের। সেই ছোটার কাহিনিতে অনেক মানুষ একেবারে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে তলিয়ে গেছে। আবার অনেক মানুষ সংগ্রাম করে করে ওপরে উঠেছে।...
তাপস কুমার দত্ত: এরপর থেকেও তো অনেক সংখ্যালঘু ওপারে চলে গেছে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এপার থেকেও গেছে, তবে তা আনুপাতিক হারে যথেষ্ট কম। যা বলছিলাম, এ ৫৫ বছরে যদি কেউ লাভবান হয়ে থাকে, আমি এপার বাংলার কথা বলছি—তা হলে হয়েছে পশ্চিম বাংলার মেয়েরা। এই যারা পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিল—সংগ্রাম করেছে, কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে, বস্তি বা কলোনিতে কোনোক্রমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে; তাদের দেখাদেখি পশ্চিম বাংলার কনজারভেটিভ পরিবার—যারা মেয়েদের অন্দরমহলে ফেলে রেখেছিল এবং অফিস-কাছারিতে যাওয়া তো স্বপ্নের বাইরে ছিল। যখন পূর্ববঙ্গের মেয়েরা জীবনসংগ্রামের বাধ্যবাধকতায় গ্র্যাজুয়েশন করে স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন অফিসে চাকরিতে ঢুকল; তখন এখানকার মেয়েরা উৎসাহিত হলো। আমরা যখন কলেজে পড়তাম; সন্ধ্যা ৬টার পর ট্রামে-বাসে কোনো মেয়েকে দেখা যেত না; যদি কোনো মেয়েকে দেখা যেত তা হলে সে নিশ্চয়ই বাঙাল (পূর্ববঙ্গীয়) হতো। কিন্তু এ পশ্চাৎপট একদম পাল্টে গেল ১৯৬৮ সালের পর থেকে। তখন বাস্তবিক নিষ্পেষণে পশ্চিম বাংলার মেয়েরাও বেরোতে শুরু করল, যেটা বলতে গিয়ে সরে এসেছি—সেটা হলো, এই দেশবিভাগ এবং এ দেশে উদ্বাস্তু স্রোত আসার অনেক খারাপ দিকের এই একটা ভালো দিক, আমাদের মেয়েরা অর্গল ভেঙে বেরোতে পেরেছিল। কিন্তু ওখানে (বাংলাদেশে) যারা রয়ে গেল (হিন্দু সম্প্রদায়) তাদেরও, আমরা দেখেছি, কেউ ১৯৬৭, কেউ ১৯৭০, কেউ ১৯৭৬-এ চলে আসতে লাগল।
তাপস কুমার দত্ত: এখনো কি অল্পবিস্তর চলে আসছে?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এখনো আসছে এবং এদের একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে এরা আওয়ামীপন্থী ছিল। অর্থাৎ এ দলটির কাছে ওরা নিরাপদ বোধ করত।
তাপস কুমার দত্ত: দেশভাগের পর ওপার বাংলার কী কী বিশেষ পরিবর্তন আপনার কাছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়েছে?
সমরেশ মজুমদার: ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এ ২৪ বছরে বাঙালির জীবনে পূর্ববঙ্গে একটা জিনিসেরই আমদানি ঘটেছে, সেটা হলো ইসলাম এবং ইসলামকেন্দ্রিক আরবি-ফারসি শব্দ। ওই সময় যাঁরা লেখালেখি করতেন, যেমন ধরুন—শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস—এঁরা যে বাংলা লিখতেন, তা ছিল পশ্চিম বাংলার বাংলা; অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারকৃত বাংলা। এঁরা বাংলার প্রাচীন সাহিত্য এবং রামায়ণ-মহাভারত ও আরও সব পৌরাণিক...প্রাচ্য ও পশ্চিমের সাহিত্যের ওপর ভালো দখল রাখতেন এবং সেটা তাঁদের ভেতরে লালন করতেন। ১৯৭১ সালের পর একটা আবেগ এল, আবেগের সঙ্গে ভয় এল। ভয়টা এই—আমরা এত দিন উনুনে পুড়ছিলাম, উনুন থেকে লাফিয়ে গরম তেলে পড়লাম না তো? অর্থাৎ আমরা পাকিস্তানের অত্যাচারে জর্জরিত হচ্ছিলাম, এখন ভারত বড়দাদার মতো দাদাগিরি করবে না তো? আমাদের দখল করবে না তো? তার কিছু কিছু ইন্ধন—আপনারা জানেন—ভারত যে সম্পূর্ণ বৈষ্ণব হয়ে ছিল তা নয়, ভারতের তরফ থেকে যারা দু-একটা বদমায়েশি কাজ করেছে, সেসব বাংলাদেশের কাছে প্রবল হয়ে ধরা দিল। ১৯৭১ সালের ওই আবেগ যখন কমতে শুরু করল, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর ওখানকার রাজনৈতিক দলগুলো জনসাধারণকে সস্তা পথে পাওয়ার জন্য অ্যান্টি-ভারত আবহাওয়া তৈরি করল এবং সেটা তাদের ভোট অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়কও হলো। এ সময় থেকে আমরা দেখতে শুরু করলাম, বাংলা সাহিত্যে যা লেখালেখি হচ্ছে, খবরের কাগজে রিপোর্টিংয়ে যে বাংলায় লেখালেখি হচ্ছে, সেখানে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। এর একটা উদাহরণ হলো জিম্মা। এ ‘জিম্মা’ শব্দটা আগে ওপার-এপার, কোনো বাংলায়ই ব্যবহৃত হতো না। যেমন খাবারটা খেয়ে দারুণ ‘মজা’ লাগল। এ ‘মজা’ শব্দটা হলো রসে-বসে আনন্দে আছি। তা খাবারটা খেয়ে ‘মজা’ লাগবে কেন আমার? খাবারটা খেয়ে আমার দারুণ ভালো লাগবে, অথবা আমি খুব আনন্দ পেলাম খেয়ে। কিন্তু ‘মজা’ লাগা বলতে কোথাও যেন একটু কৌতুক মেশানো থাকে। এ ধরনের কিছু শব্দ তৈরি হতে লাগল। এসব সচেতনভাবে তৈরি হতে লাগল, যাতে পশ্চিম বাংলার ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষা আস্তে আস্তে একটু একটু করে আলাদা হতে থাকে। আবার, আমরা দেখতে পাই, ১৯৬০ বা ’৬৫ সাল অবধি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের আগ অবধি যেকোনো মুসলিম পরিবারে আরবি বা ফারসি নাম দেওয়া হতো। কিন্তু এর পর থেকে দেখা গেল তাদের নামের পাশে ব্র্যাকেট করে একটা ডাকনাম দেওয়া হলো। ১৯৪০-৫০ সালের দিকে কোনো মুসলমানের ডাকনামের তেমন প্রচলন ছিল না। ক্রমে এ ডাকনামই তার হাইলাইটস পেত বেশি, আসল নামটা আড়ালে থাকত। যেমন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। আমরা সবাই জানি ‘বন্যা’। এটা কিন্তু পাশাপাশি সচেতনভাবে বাঙালিত্ব ধরে রাখার প্রচেষ্টা। এর পরবর্তী প্রজন্ম, সত্তরের দশক থেকে যে প্রজন্ম শুরু হলো—তারা আরও অদ্ভুত হলো। তাদের আবার নাম হয়তো আবুল হায়াত, মেয়ের নাম বিপাশা হায়াত বা সুবর্ণা মুস্তাফা। হায়াত বা মুস্তাফা তার পারিবারিক পদবি কিন্তু নামটা বাংলা শব্দ। অর্থাৎ আগে যেটা ব্র্যাকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেটা এখন নামের সাইনবোর্ডে এসে প্রকাশ হলো। পাশাপাশি আরও একটা অদ্ভুত ছবি আছে; ছবিটা হলো—চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মানুষ, ধরুন একজন মা; তার ছেলে হয়তো ঢাকায় চাকরি করে। তিনি যখন তার ছেলেকে চিঠি লিখছেন, তখন চট্টগ্রামের ভাষায় লিখছেন না। তিনি বইয়ের ভাষায় চিঠি লিখছেন এবং ছেলেও তা-ই করছে। কিন্তু ছেলে আর মায়ের যখন পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয়, তখন কিন্তু তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলেন, যা ঢাকার লোক বুঝবে না। তা হলে চিঠিতে কেন বাংলা বর্ণমালায় চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার করছে না? এ নিয়ে আমার নিজস্ব অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু এ বাঙালিত্ব বজায় রাখার জন্য একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি, একবার এক অনুষ্ঠানে একজন লোকের সঙ্গে—তাকে বাংলাদেশের মনে হওয়ায়—কথা বলতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বাংলাদেশের? কোন জেলায় বাড়ি?’ তিন-চারবার প্রশ্ন করার পরও কোনো উত্তর পেলাম না। লোকজন অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার, তুমিও বাঙালি, সে-ও বাঙালি অথচ একে অন্যের ভাষা বুঝতে পারছ না?’ আসলে সে সিলেটের বাঙালি। সে আমাদের ভাষা ভালোভাবে জানে না এবং নিজে যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষা আমাদের কাছে অজানা, তাই কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে। এই যে এত পার্থক্য—এসব পার্থক্যের সুযোগ নিয়েছে—আমার মনে হয়, কিছু ধর্মান্ধ মৌলবাদী, যাতে বাংলা ভাষাকে ভাঙা যায়, নষ্ট করা যায়। একটা নতুন ভাষা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধরুন, যদি মসজিদে যান, মসজিদে যে প্রার্থনা হয় তা বাংলায়। যেখানে একদম পরিষ্কারভাবে, ‘হে পরম পিতা!’—এভাবে শুরু করে।...‘আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি; আমাদের প্রিয়জন তোমার কাছে গিয়েছে, বাসা থেকে কেউ যদি বিদেশে যায়, তবে তার চিঠিপত্তর, টেলিফোনে খবর পাওয়া যায়। তিনি আজ যেখানে গেছেন, সেখানে এসব কোনো পথ নেই; কিন্তু আমরা জানি, তিনি তোমার কাছে গেছেন। অতএব, তুমি তাকে ভালো রাখবে...। আমিন!’ এ কথাগুলো অতি পরিষ্কার সিম্পল বাংলা কথা, এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না; অশিক্ষিত লোকও স্পষ্ট বুঝতে পারছে; কিন্তু ‘আমিন’ শব্দটা উচ্চারণ হওয়ামাত্র একটা অন্যরকম গন্ধ এল। আমিন কথাটা খ্রিষ্টানরা বলে। খ্রিষ্টানরা ‘পরম পিতা’ও বলে। কোরআনকে তো পৃথিবীর সব দেশের সব মুসলমান যথাযথ অনুসরণ করে না। আজকের পৃথিবীর সব মুসলমানের...বাংলাদেশের মুসলমানদের আইডিয়াল হচ্ছে ‘আরবি’ এবং আরবের লোকজন। অথচ আরবরা যে বুর্জোয়া জীবনযাপন করেন—মেয়েদের ক্ষেত্রে পার্টিকুলারলি—সেটা মানতে পারেন না ঢাকার মুসলমানরা; কিন্তু এরপরও ওরা আইডিয়াল। আজ যদি তুমি ঢাকা বা ফরিদপুরের রাস্তায় রোজার সময় যাও, তাহলে দেখবে, পর্দা টানিয়ে হোটেলে খাওয়াদাওয়া চলছে। অর্থাৎ পর্দা টানিয়ে দুপুরে খাওয়া যায়। আমার বন্ধুবান্ধব, যাঁরা আমার কাছে রোজার সময় আসছেন, তাঁরা প্রায়ই বলতেন, ভাই, আমি অসুস্থ, রোজা রাখতে পারছি না। কেউ বলতেন, আমি তো এখন পর্যটক! কারও হাঁটুতে ব্যথা, একটা অজুহাত, যেহেতু নামাজ পড়তে পারবে না...এসব অজুহাত বা ছুতো—এগুলো সবই কিন্তু বেরিয়ে আসার চেষ্টা। কিন্তু তারা ভয়ে থাকে, বেরিয়ে আসতে ভয় পায়। ফলে আমাদের সঙ্গে ওদের যে ডিফারেন্স, সেই ডিফারেন্সটা যথেষ্ট বড়। কারণ, আমরা যারা জন্মসূত্রে হিন্দু, তাদের ৮০ ভাগ হিন্দুধর্মের এ-বি-সি-ও পালন করি না। অথচ আমরা হিন্দু। বলতে হয়, তাই হিন্দু। আমাদের ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়ার মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মাচরণ নেই। দুর্গাপূজা এলে আমরা প্ল্যান করি কোথায় বেড়াতে যাব। পুজোর আচার-আচরণের মধ্যে আমরা নেই। আমরা নানা খাবার দিয়ে, বিস্কুট, চাল-ডাল, চকলেট দিয়ে মূর্তি গড়ি, ছেলেখেলার মতো। কালীপূজার সময় আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখি, পটকাবাজির ভয়ে। তাহলে আমরা হিন্দু হলাম কোথায়? আমরা ধর্ম থেকে সরে গেছি আস্তে আস্তে। তবে এ ধর্ম আমাদের কিছু দেয় না, আমাদের থেকে কিছু নেয়ও না। যখন রামকে নিয়ে সারা ভারতে এত হইচই কাণ্ড চলত, তখন আমরা পশ্চিম বাংলার মানুষজন রামকে একবারও দেবতা বলে মনে করি না। আমরা হনুমানকে দেখে ঠাট্টা করি, ‘কলা খাবি’ বলে। কিন্তু হনুমান ওদের কাছে ঈশ্বরের অবতার। ঘটনা যখন এ রকম ঘটে যায়, তখন বাংলাদেশের মুসলমান যারা; যারা সত্যিকার অর্থে কোরআন মানে, ধর্মান্ধ নয়, তারা কিন্তু আমাদের থেকে অনেক ডিসিপ্লিনড। ধর্ম ডিসিপ্লিন তৈরি করতে সাহায্য করে। ধর্ম একত্র করে মানুষকে। কিন্তু সেই একত্র করার মাঝখানে ধর্মান্ধ বা ধর্ম ব্যবসায়ীরা যত গণ্ডগোল পাকায়। ফলে আমাদের মধ্যে ক্রমেই পার্থক্য বাড়ছে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার কি মনে হয়, কয়েক দশক আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে রাজনীতিতে যে রকম মন্দির-মসজিদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, তাতে করে আগামী কয়েক দশক পর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রকম ধর্মরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে?
সমরেশ মজুমদার: আমার তো উল্টো মনে হয়। আমার মনে হয়, ধর্মান্ধ যারা—সে হিন্দু বা মুসলমান হোক, খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা কখনো শুনিনি। যদিও ক্রিশ্চিয়ানিটি পৃথিবীজুড়ে ছিল, কিন্তু আজ অবধি খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা শুনিনি, বৌদ্ধ ধর্মান্ধ শুনিনি।
তাপস কুমার দত্ত: ইউরোপে এককালে খ্রিষ্টানরাই ব্লাসফেমির মতো ঘৃণ্য আইন ধর্মের বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছিল—ওসব কি ধর্মান্ধতা নয়?
সমরেশ মজুমদার: খ্রিষ্টানরা এখন অনেক শ্রেণির হয়ে গেছে, সেখানে তারা একত্র নয়।
তাপস কুমার দত্ত: না, সেটা অন্য ব্যাপার, প্রশ্নটা হলো...
সমরেশ মজুমদার: আমাদের ভারতবর্ষেও তো হিন্দু ধর্ম একেক জায়গায় একেক রকম। আপনি সাউথ বা নর্থ ইন্ডিয়ায় বা অন্য প্রান্তে যে হিন্দু ধর্ম দেখবেন, তা পশ্চিম বাংলায় পাবেন না; এক জায়গার সঙ্গে অন্য জায়গায় ধর্মীয় অমিলই বেশি।
তাপস কুমার দত্ত: প্রশ্নটা তা নয়। একটা ধর্ম সম্প্রদায় নানা খণ্ডে বহু ধারায় বিভক্ত হতেই পারে। কিন্তু যেকোনো ধারারই একটা প্রচ্ছন্ন গোঁড়ামি আছে, মৌলবাদ আছে; আর সেটাই দিন দিন বিশ্বের ওপর বেশি পরিমাণে চেপে বসছে। আপনি কী মনে করেন?
সমরেশ মজুমদার: না, আমি এর সঙ্গে একমত নই। আমার তো মনে হয়, ধর্ম পৃথিবী থেকে আস্তে আস্তে লোপ পেতে চলেছে। এখন যে চিৎকারটা আমরা শুনতে পাচ্ছি—কারণ, ধর্মবাদীরা আতঙ্কগ্রস্ত বলে চিৎকার করছে।
তাপস কুমার দত্ত: প্রথাগত ধর্মে আপনার বিশ্বাস কতটুকু?
সমরেশ মজুমদার: আমি ধর্মে একদম বিশ্বাসী নই।
তাপস কুমার দত্ত: আর বিবাহ প্রথায়?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, বিবাহ প্রথায় বিশ্বাসী। তবে বিয়ে কীভাবে হবে, সেটা নির্ভর করছে যারা বিয়ে করছে, তাদের ওপর।
তাপস কুমার দত্ত: তৃতীয় বিশ্বে বসবাস করার একটা মানসিক যন্ত্রণা আছে। বিশেষ করে, শিল্পী-সাহিত্যিক...যেকোনো সৃজনশীল মানুষের। আপনি তা কতটা অনুভব করেন?
সমরেশ মজুমদার: এটা ভারতবর্ষে, মানে পশ্চিম বাংলায় নেই, আমি কখনো অনুভব করিনি। এটা গুজরাটে থাকতে পারে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার লেখালেখিতে বা ভাবনায় কখনো সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনো প্রতিবন্ধকতা আসেনি বলছেন?
সমরেশ মজুমদার: সিপিএম যখন ক্ষমতায় এল, তখন আমি নকশাল আন্দোলন নিয়ে উপন্যাস লিখলাম—কালবেলা। তো কালবেলার নায়ক অনিমেষ তখন কিন্তু সিপিএমের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। বলেছে, সিপিএম ভ্রষ্টাচারী। আমাকে কিন্তু ও রকমভাবে কোনো সরকার বা শক্তি আপত্তি করেনি।
তাপস কুমার দত্ত: নিজের বিচারে আপনার প্রিয় লেখা কোনটি?
সমরেশ মজুমদার: তিনটি লেখা আমার খুব প্রিয়। সেটা হচ্ছে—‘উত্তরাধিকার’...
তাপস কুমার দত্ত: এ সিরিজটা? অর্থাৎ ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’?
সমরেশ মজুমদার: না, ‘কালবেলা’ আমার প্রিয় নয়। ‘এখনও সময় আছে’ বলে আমার একটা উপন্যাস আছে, আমার ভীষণ প্রিয়। আর গত বছর আমি ‘দেশ’-এ একটা উপন্যাস লিখেছি—‘উৎসারিত আলো’—এ তিনটি।
তাপস কুমার দত্ত: লেখালেখিতে কতটা অসন্তুষ্টি বা অতৃপ্তি রয়ে গেছে?
সমরেশ মজুমদার: প্রতিটি লেখায়ই আমার অসন্তুষ্টি রয়ে যায়। আমার মনে হয়, আবার লিখলে ভালো করতাম। কিন্তু একবার বই আকারে...।

তাপস কুমার দত্ত: সেটা ওই বইটার নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর। আমার জিজ্ঞাসা হলো, এমন কোনো প্রিয় লেখা কি আপনার ভেতরে লালিত আছে, যা এখনো আপনি লিখে উঠতে পারেননি?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এই যে আপনাকে এর আগে যে কথাগুলো বললাম। আমি হুমায়ূন (আহমেদ)-কে বারবার বলেছিলাম, দ্যাখো, তুমি এত জনপ্রিয় একজন লেখক, তোমার এত হাজার হাজার বই বিক্রি হয়, তোমার তো এখন হারানোর কোনো ভয় নেই। তা তুমি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ২০০৪ সালের এই সময়কাল পর্যন্ত কয়েকটা খণ্ডে লেখো না, উপন্যাস আকারে। সে বলল, আমার লিখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সাহস পাই না। আমি অ্যাকসিডেন্টলি আপনাদের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিচিত ছিলাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আমার কাছে এরশাদ খুব কালারফুল চরিত্র। ঘৃণ্য, কিন্তু কালারফুল। কেউ ওর সঙ্গে দেখা করার সাহস পায়নি, যেতে চায়নি; আমি গিয়েছিলাম ওর আমন্ত্রণে। আমার বিপুল অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এটা নিয়ে তিনটি পর্বে ভাগ করে লিখতে আমার খুব ইচ্ছা হয়। ১৯৪৭ থেকে ’৬৯, শেখ মুজিবুর যখন স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, সেই অবধি। এরপর ১৯৬৯ থেকে ’৭১ এবং ’৭১ থেকে এখন অবধি। এ তিনটি পর্বে বাংলাদেশের পটভূমিতে যদি পারি, তো কখনো লিখব। আমি জানি, এ লেখা এই সরকার থাকলে ওখানে যাবে না।...এই যে দ্যাখো, ‘এত রক্ত কেন’ বইটা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে; ঢাকার ফুটপাতে কিন্তু বইটা পাওয়া যায়। তো ব্যান্ড করে লাভটা কী হলো?
তাপস কুমার দত্ত: এ বইটার জন্য বাংলাদেশের একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে ও-দেশে যাওয়ার ভিসা আপনাকে আটকে দেওয়া হয়। এখন যদি এ জাতীয় সমস্যা না থাকে, তা হলেও কি বাংলাদেশে যেতে কোনো আপত্তি থাকবে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি জানি, এ সরকার যদি এটা তুলেও দেয়, তবু সরকারের যারা অনুচর, তারা আমাকে আক্রমণ করবে।
তাপস কুমার দত্ত: অর্থাৎ আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন?
সমরেশ মজুমদার: অফ কোর্স। আমি শেষবার যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, তখন এত রক্ত কেন বেরিয়েছে, কিন্তু ব্যান হয়নি; সেদিন ঢাকায় এয়ারপোর্টে নেমেই বেশ সমস্যায় পড়েছিলাম। আমাকে নিয়ে অফিসাররা হঠাৎ তটস্থ হয়ে উঠলেন, কেন আমি এসেছি? কী উদ্দেশ্যে এসেছি? তো, আমাকে রিসিভ করতে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদ। আমাকে নিয়ে সে সোজা চলে গেল নুহাশ পল্লীতে। ওখানে তিন রাত ছিলাম। এরপর রাতের অন্ধকারে ঢাকায় এলাম।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অন্য কোনো ভয় পাচ্ছিলেন?
সমরেশ মজুমদার: পুলিশ বোধ হয় ভাবছিল, আমাকে অ্যারেস্ট করা উচিত কি উচিত না। একদিন একটা অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে সেখান থেকে সোজা এয়ারপোর্টে। এরপর আমি যখন অনুষ্ঠানে যাওয়ার পরবর্তী আমন্ত্রণ পেলাম, তখন তারা আমাকে ভিসা দিল না।
তাপস কুমার দত্ত: এখন আপনি কী ধরনের বই পড়ছেন?
সমরেশ মজুমদার: কয়েক দিন আগে ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ হুমায়ুন আজাদের বইটা সকাল থেকে পড়তে শুরু করেছিলাম। সেদিনই সকাল ৯টায়—বইটা পড়ছি, হাতে; খবর এল হুমায়ুন আজাদ মারা গেছেন। ওই বইটাতেই একটা জায়গায় লেখা ছিল, যেকোনো দিন তার মৃত্যু হতে পারে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। এ বইটা খুব বড় বা দামি লেখা নয়। খুব আবেগের লেখা, একই কথা বারবার লেখা; কিন্তু কথাগুলো লিখতে সাহস পায়নি তেমন কেউ।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি কি তাঁর আর কোনো উপন্যাস পড়েছেন?
সমরেশ মজুমদার: একটা পড়েছিলাম অনেক আগে, নামটা ভুলে গেছি। দাঁড়াও, নামটা মনে করি...
তাপস কুমার দত্ত: ‘শুভব্রত’, তার সম্পর্কিত সুসমাচার?
সমরেশ মজুমদার: না, আর কয়েকটা নাম বলো তো।
তাপস কুমার দত্ত: ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, সবকিছু ভেঙে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, হ্যাঁ, ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, বইগুলো বেশির ভাগ সময়ই কলকাতায় সহজে পাওয়া যায় না।
তাপস কুমার দত্ত: বয়স তো যথেষ্ট হলো। একদিন চলে যেতে হবে, তার দিনক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে...কোনো আতঙ্ক বা আক্ষেপ?
সমরেশ মজুমদার: না, না। আজ রাতেও চলে যেতে পারি; আবার হয়তো দশ বা কুড়ি বছর পরও যেতে পারি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অবশ্যই দীর্ঘায়ু হবেন, আমি এর দার্শনিক দিকটা জানতে চাচ্ছি।
সমরেশ মজুমদার: আমি খুব বাস্তববাদী মানুষ। আমি আজকে লেখালেখি করে যেটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি, সেটুকু আমার পাওয়ার কথা ছিল না। আমার লেখক হওয়ারই কথা ছিল না।
তাপস কুমার দত্ত: অনেক বছর আগে বাংলাদেশের একটা সাপ্তাহিক কাগজে আপনি বলেছিলেন, এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেবেন।
সমরেশ মজুমদার: ওসব কথা বাড়িয়ে লিখতে ভালোবাসে কিছু সাংবাদিক। যেমন অন্য একটা জায়গায় আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তসলিমার ‘ক’ পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে? আমি এর উত্তরে বলেছিলাম, আমি ‘ক’ পড়েছি এবং আমার মনে হয়েছে, একটা বারবনিতাকে যদি বলা হয়, তোমার আত্মজীবনী লেখ, সে তার অনেক কষ্টের কথা লিখবে; কিন্তু যেসব ক্লায়েন্ট তার কাছে আসে, তাদের বিস্তৃত পরিচয় দেবে না সে, এটুকু সৌজন্য দেখাবে। এ উত্তরটা তারা এভাবে লিখেছে যে, সমরেশ মজুমদার বলেছেন, তসলিমা নাসরিন বেশ্যা। এর উত্তরে তসলিমা লিখলেন আনন্দবাজারে, সমরেশ মজুমদারের গলায় গলা মিলিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, তসলিমা বেশ্যা। এর উত্তরে আমি আবার চিঠি লিখলাম আনন্দবাজারে—কোথায়, কখন বলেছি? কাকে বলেছি? যদি দয়া করে আমাকে জানানো হয়...। অতএব, যদি কোথাও কখনো লেখা হয়ে থাকে, আমি বলেছি এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেব—এগুলো বাজে কথা। হয়তো এভাবে বলেছি, লিখে টাকা পাওয়া যায়, জানতাম না। যখন লিখে টাকা পেতে শুরু করলাম, তখন আমাকে যদি বলা হয়, কেন লেখেন? আমি বলি, টাকার জন্য লিখি।
তাপস কুমার দত্ত: কথাটা এভাবে বলেছিলেন, একজন কৃষক যে কারণে চাষাবাদ করেন, একজন...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম, একজন কৃষক যখন চাষাবাদ করেন, তিনি তো দেশ গড়ার জন্য চাষ করেন না; তিনি তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য চাষাবাদ করেন। একজন মাস্টার যখন পড়ান, তখন মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার চেয়ে তার সন্তানসন্ততিকে বড় করার জন্য পড়ান। তো, একজন লেখকের কী দায় আছে, তিনি দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন? আমাদের দেশে কোনো লেখক যদি জনপ্রিয় হন, তখন ধরেই নেওয়া হয়, ওগুলো ভুসিমাল। যদি সে ধরনের লেখক জনপ্রিয়তা না পান বা বিক্রি না হয়, তখন তিনি একজন বিরাট লেখক। প্রশ্ন হলো, জনপ্রিয়তা যদি কেউ বেশি পান, কেন পান? কারণ, পাঠকদের ভালো লাগছে বলেই। কোনো একটা বই হয়তো বেশি পাঠকের ভালো লেগেছে। এমন নয় যে বছরের পর বছর তিনি জনপ্রিয় হয়ে থাকেন। তা হলে যিনি পাঠককে সহজে স্পর্শ করতে পারছেন না, তার কোথাও খুঁত আছে নিশ্চয়ই। ভালো একটা ছবি তিন দিন সিনেমা হলে থেকে চলে গেল। আর একটা ছবি ‘বাবা কেন চাকর’ মাসের পর মাস চলল, জনপ্রিয় হলো। আবার ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর যখন হাজারটা শো চলে, তখন বলতেই হয়, গুপী গাইন বাঘা বাইন খারাপ ছবি? চার্লি চ্যাপলিন তা হলে খারাপ ছবির নাম? ‘পথের পাঁচালী’ও ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল—ওটাও তা হলে খারাপ ছবি?

তাপস কুমার দত্ত: ধরুন, হাইপোথেটিক্যালি আমরা ধরে নিলাম, কোনো ধনকুবের আপনার যাবতীয় চাহিদার স্পন্সরশিপের দায়িত্ব নিল। একজন কৃষক যে কারণে কৃষিকাজ করেন বা আর দশজন পেশাজীবী মানুষ যে কারণে পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, সেই প্রয়োজনটা আপনার আর রইল না। তখন কি লেখালেখি আপনি ছেড়ে দেবেন?
সমরেশ মজুমদার: চাহিদার কিন্তু শেষ নেই। আগে বাস-ট্রামে চড়তাম, আমার এখন বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। এখনো অবশ্য ইচ্ছা করে মাঝেমধ্যে বাস-ট্রামে উঠি। তো, আগে আমি জলপাইগুড়ি আমার বাড়ি যেতাম সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে, রিজারভেশন ছাড়া। এরপর রিজারভেশনে। এরপর এসি থ্রি-টিয়ার, এরপর এসি টু-টিয়ার। এর মানে এই নয়, আমি এখন এসি টু-টিয়ার ছাড়া যেতে পারব না। কিন্তু যদি কমফোর্ট পাই, তা আমি নেব না কেন?
তাপস কুমার দত্ত: আমি বলতে চাচ্ছি, শুধু ভরণপোষণ আর কমফোর্ট—এসব কারণেই লেখালেখি? ভোগবাদী ব্যাপার ছাড়া তা কি নিজের ভেতর থেকে উঠে আসে না?
সমরেশ মজুমদার: শুনুন, আমাকে যদি এক কোটি টাকা দেওয়া হয় একটা উপন্যাস লেখার জন্য—সাত দিন চেষ্টা করেও লিখে উঠতে পারব না। আবার, আমাকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি, আমি লিখতে বসলাম, হয়তো দুদিনেই লেখাটা শেষ করে ফেলতে পারব।
তাপস কুমার দত্ত: তা হলে লেখালেখিটা শুধু হালচাষির হালচাষের মতো জীবিকা নির্বাহ নয়, আলাদা একটা ভেতরের তাগিদও...
সমরেশ মজুমদার: অবশ্যই।
তাপস কুমার দত্ত: বেশির ভাগ জনপ্রিয় লেখকের লেখায় দেখা যায়, কতগুলো পাগলামোর ঘটনা, কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনা, কিছু সুখকর ঘটনা ও একটু বেদনাদায়ক ঘটনা। যেন ছাঁচে ঢেলে গরম তেলে ভেজে তোলা হট কেক...
সমরেশ মজুমদার: এটা আমার কাছে খুব অস্পষ্ট। ধরুন, আমার একটা বই, ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে এক লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। সেই বইটা কলকাতায় ৫০-৬০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। ধরে নিতে পারি, বইটা জনপ্রিয়।
তাপস কুমার দত্ত: বইটার নাম কী?
সমরেশ মজুমদার: ‘গর্ভধারিণী’। তা ওটা কোন ফর্মুলায় লেখা, বলুন তো?
তাপস কুমার দত্ত: ওই বইটাতে আসলে এমন একটা সাসপেন্স বা থ্রিল এবং এর সঙ্গে আবেগ, বর্তমান সমাজব্যবস্থার কিছু মানুষের অমানবিক নোংরা দিকের প্রতি...।
সমরেশ মজুমদার: এসব তো অনেক বইতেই আছে।
তাপস কুমার দত্ত: হ্যাঁ, তা ঠিক, ‘মেঘ ছিল, ‘বৃষ্টিও’-তেও আছে। ‘আট কুঠুরী নয় দরজা’তেও।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে সেগুলো ওভাবে বিক্রি হয়নি কেন?
তাপস কুমার দত্ত: না, আমি বলছি ‘গর্ভধারিণী’র মতো বিশাল জনপ্রিয়তা না পেলেও ওই লেখাগুলোও বেশ জনপ্রিয়।
সমরেশ মজুমদার: যদি জানতাম, গর্ভধারিণীর মতো ওভাবে সাসপেন্স মেশালে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হবে, তা হলে তো সব বই ওভাবেই লেখা হতো। তা হলে ‘সাতকাহন’ কেন এত বিক্রি হলো? স্ট্রাগল করা মেয়েদের গল্প তো আমি আগেও লিখেছি, পরেও লিখেছি, সেগুলো কেন সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হলো না? আমি যদি আরেকটা দীপাবলীকে নিয়ে লিখি, সেটা কি সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হবেই?
তাপস কুমার দত্ত: সাতকাহনের দ্বিতীয় পর্ব কিন্তু প্রথম পর্বের মতো অত জনপ্রিয় নয়।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে? আসলে আমার কাছে মনে হয়, যেকোনো...আমি আপনাকে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখাটার কথা বললাম, ‘এখনো সময় আছে’ বইটা তিন থেকে চার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। লোকে না পড়লে আমার কষ্ট হয়, আমি তো লোকে লোকে গিয়ে বলতে পারি না, আপনি বইটা পড়ুন। কোত্থেকে ‘কালবেলা’ এক লাখ কপি বিক্রি হলো! ‘উত্তরাধিকার’ বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার। অথচ উত্তরাধিকার ওটার চেয়ে অনেক বেটার উপন্যাস। তাই কোন লেখাটা জনপ্রিয় হবে, তা আগে থেকে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। একটা লেখা জনপ্রিয় হতে পারে। একটা মেমসাহেব, একটা দৃষ্টিপাত, একটা মরুতীর্থ হিংলাজ জনপ্রিয় হতে পারে। কয়েকটা নয়।
তাপস কুমার দত্ত: ওপারের লেখকদের লেখা সম্পর্কে...
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, ওপারের এক নম্বরের সঙ্গে দুই নম্বরের ব্যবধান এত বিস্তর...জাফর ইকবাল সম্প্রতি সেই ব্যবধান একটু কমিয়ে এনেছেন। তো, গতবার যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, তখন একজন লেখক আমাকে এসে বললেন, সমরেশ দা, আপনাকে একটা ভালো খবর দিই।
আমি বললাম, কী?
বলল, আমি এখন তিন নম্বরে।
আমি জানতে চাইলাম, কিসের তিন নম্বর? সে জানাল, জনপ্রিয়তার। তার পেছনে নাকি মিলন চলে গেছে, অমুক-তমুক অনেকে চলে গেছে। আমি হাসব না কাঁদব, ভেবে পাচ্ছিলাম না।
তাপস কুমার দত্ত: কে?
সমরেশ মজুমদার: নামটা নাই-বা বললাম।
তাপস কুমার দত্ত: বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের রুচিবোধ আপনার কতটা উঁচুদরের বলে মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: আপনি যা ইচ্ছা তা-ই লিখে পাঠকদের ভোলাতে পারবেন না। পাঠকদের বিচারশক্তি দারুণ প্রখর। একটা লেখা দিয়ে ভোলাতে পারবেন, পরের দুটোয় হাফ ভোলাতে পারবেন; তৃতীয়টায় আর পারবেন না।
তাপস কুমার দত্ত: পাঠকেরা আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমাকে তেমন প্রভাবিত করতে পারে না। তবে কিছু কিছু ঘটনায় মাঝেমধ্যে কষ্ট হয়। একবার বইমেলায় এক ভদ্রমহিলা তিনখানা (বড় ক্যানভাসের) বই বইতে পারছিলেন না, চেহারা দেখে বোঝা যায়, যথেষ্ট (আর্থিক) অসচ্ছল পরিবার। আমি বললাম, আপনি কী করেন?
তিনি বললেন, আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়াই।
আমার খুব খারাপ লাগল, আপনি এত দামি তিনটি বই কিনলেন?
তিনি বললেন, সারা বছর আমরা অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছি।
এরপর দেখলাম, দূরে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। ক্রাচ হাতে, একটা পা ডিফেক্টেড। ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে যেতেই তিনি বললেন, আমি আপনার অনিমেষ।
আমি বললাম, তার মানে?
তিনি জানালেন, তিনি নকশাল আন্দোলন করতেন এবং হাওড়া জেলে পুলিশের অত্যাচারে একটা পা নষ্ট হয়ে (অনিমেষের মতোই) গেছে। আমরা একসঙ্গে থাকি। (অনিমেষ-মাধবীলতার মতো), আমরা বিয়ে করিনি।
আরেকটা ঘটনা বলে শেষ করি—হ্যাঁ, একবার বিদেশে রাতে আমার খুব খিদে পেয়েছে, একটা বড় রেস্টুরেন্ট দেখে ভেতরে ঢুকে পড়ি। এরপর মেনু কার্ডের সবচেয়ে ছোট আইটেম যেটা, সেটার অর্ডার দিলাম। বেয়ারাগুলোকে দেখে মনে হলো এশিয়ান। তো, একটা বেয়ারা এসে বলল, স্যার! আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?
আমি বললাম, ইয়েস।
স্যার! আর ইউ ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল?
আমি আবার বললাম, ইয়েস।
বেয়ারা গিয়ে হোটেল মালিককে তথ্যগুলো জানাতেই হোটেল মালিক উঠে এসে বললেন, নমস্কার স্যার! আপনি বোধ হয় সমরেশ বাবু। আমি আপনার একটাই মাত্র বই পড়েছি। একবার একটা বাস টার্মিনালে দেখলাম একটা বই পড়ে আছে—বাংলা বই, নামটা ‘দৌড়’।
এরপর যতই বলছি, আমার খাওয়া হয়ে গেছে, তবু তিনি আমাকে জোর করে খাওয়াবেন। বিল দিতে গেলাম, বিল নিলেন না। এই অবধি ঠিক আছে। বেয়ারা এরপর বলল, সাহেব, একবার ভেতরে আসবেন? আপায় কইছিল, আপনি সমরেশ মজুমদার কি না জিজ্ঞেস করতে। তো, আমি ভেতরে ঢুকলাম। একজন ভদ্রমহিলা খাটের ওপর বসে নমস্কার জানিয়ে আমার দিকে একটা বই এগিয়ে দিলেন—‘গর্ভধারিণী’। আমার পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। দেখুন, কারোর জানার কথা নয়, আমি ওখানে যাব। কাকতালীয়ভাবে।
তাপস কুমার দত্ত: একবার কবি সম্মেলনে আপনাকে দেশের বাইরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল—কবি হিসেবে, ভুল করে। ঠিক এ রকমই একটা ঘটনার কথা...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আপনি সবই জানেন দেখছি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি বই বাজেয়াপ্ত করাটা কতটা সমর্থন করেন?
সমরেশ মজুমদার: যে কারণে তসলিমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, সেটাকে আমি সমর্থন করি না। তবে আমার হাতে আইন থাকলে তসলিমাকে অভিযুক্ত করতাম। আজ একটা ছেলের সঙ্গে একটা মেয়ের ভালো সম্পর্ক; সম্পর্কটা দুজনকেই আনন্দিত করছে। যদি ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো তিক্ততা আসে, আজকের এ আনন্দটা কিন্তু মিথ্যা হয়ে যাবে না এবং সেই ছেলেটা ও মেয়েটার কোনো রাইট নেই ভবিষ্যতে এই আনন্দিত সম্পর্ককে নিয়ে খোলামেলা...ব্যঙ্গ করে লেখা বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে লেখা। যে ক্ষেত্রে তারা একে অন্যকে ছোট ও অপমান করছে। মিলনের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গিয়ে কী হয়েছে বা অমুকের সঙ্গে অমুকের আর কী হয়েছে—এর ডিটেইলস নিয়ে আমরা আদৌ আগ্রহী নই। আমরা তসলিমার ব্যাপারে এখানেই আগ্রহী যে সে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কী লড়াই করেছিল। তা না করে তার শারীরিক আনন্দের বিবরণ দিয়ে লিখছে—এটা এক ধরনের অসুখ। আমি জানি, আমার বাবা-মায়ের মিলনের ফলে আমি পৃথিবীতে এসেছি; এখন সেই মিলনটা কী রকম ছিল, তার বিবরণ দিয়ে যদি লিখতে যাই, তো আমার জন্মটাকেই আমি সবচেয়ে বেশি কুৎসিত করছি। আমার জন্মের বিবরণের জন্য আমার বাবা-মায়ের শয্যা বিবরণ কি আমি দিতে পারি? নাকি তা আমি ভাবতে চাই? বা ভাবতে পারি?
তাপস কুমার দত্ত: আপনি আপনার খোলামেলা বা বিতর্কিত ভাবনা প্রকাশ করতে কতটা ভয় পান?
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, এ মুহূর্তে বোধ হয় আমিই সবচেয়ে সরাসরি লিখি। ‘পত্রপাঠ’ বলে একটা পত্রিকা আছে, মাসে বেরোয়—সেটায় আমি কলাম লিখি। সেখানে সরাসরি সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে লিখি। একজন কলেজ অধ্যাপককে পুলিশ অ্যারেস্ট করে—জনযুদ্ধগোষ্ঠীর ডায়েরি থেকে নাম পেয়ে তাকে অ্যারেস্ট করে। সারা দিন অত্যাচার করে সন্ধ্যায় তাকে ছেড়ে দেয়। এলাকার লোকজন মনে করে, সে জনযুদ্ধগোষ্ঠীর লোক। সে রেললাইনে আত্মহত্যা করে, তার স্ত্রী এ নিয়ে কেস করে। এ ঘটনা নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। আমি এ-ও লিখেছিলাম, কয়েক দিন আগে ভোটের সময় একজন সাংবাদিক একটা গ্রামে গেছেন। সেখানে এক চায়ের দোকানে নানা আলোচনায় উঠে আসে, আমাদের দেশে যত মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই অবিবাহিত। বিবাহিত ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়, জ্যোতিবাবু। সিদ্ধার্থবাবু, জ্যোতিবাবু কখনো বাজারে যাননি। বুদ্ধবাবু রিকশায় চাপেন, বাজারে যান। আর নামটা দেখুন, বুদ্ধদেব।...বিধানচন্দ্র, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থ হচ্ছে সংসারী নাম।...এ রকম নাম যার, তাকে আমরা ভোট দেব না, তো অন্য লোককে ভোট দেব? সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কেমন আছেন? ওরা বলল, এই যে রাস্তাটা দেখছেন, এর নাম সুচেতনা (‘সুচেতনা’ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মেয়ের নাম)। আমাদের এখানে একটা ভাটিখানা আছে, খুব মারপিট চলত আগে, মদ খেতে খেতে। আমরা সেটার নাম দিয়েছি সুচেতনা...বাংলা বারের প্রতিশব্দ আর কি। ওখানে মদ খেয়ে এখন আর কেউ চেতনা হারাচ্ছে না। ফলে বুঝতেই পারছেন, আমরা সবই বুদ্ধবাবুর লোক। এ গল্পটা বের হওয়ার পর বুদ্ধবাবু আমায় বললেন, আমাকে নিয়ে লিখলেন, ঠিক আছে; আমার মেয়েকে জড়ালেন কেন? আমি বললাম, ‘হাওড়ার একটা লাইব্রেরি উদ্বোধন করতে তোমার মেয়ে আর তোমার স্ত্রী গিয়েছিলেন, লাইব্রেরিটার নাম রাখা হয়েছে সুচেতনা পাঠাগার। তোমার মেয়ে এখনই এমন কী যোগ্যতা অর্জন করেছে যে তার নামে একটা পাঠাগার রাখা হবে? যেহেতু সে তোমার মেয়ে, তাই রাখা হয়েছে।’ এখন, আপনি কী মনে করেন না, এর চেয়ে সরাসরি আক্রমণ করে লেখা—আর বড়াই করে বলি, আমাদের কোনো লেখকই লিখছেন না। লিখতে পারেন, কিন্তু লিখছেন না।
তাপস কুমার দত্ত: এত সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সমরেশ মজুমদার: থ্যাঙ্ক ইউ।

টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
২০ ঘণ্টা আগে
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
১৩ দিন আগে
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি।
০৭ অক্টোবর ২০২৫
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ। তাঁর সঙ্গে কথা বলে পর্দার আড়ালের সেই অভিজ্ঞতাগুলোই তুলে ধরেছেন মনিরুল ইসলাম।
মনিরুল ইসলাম

কীভাবে আপনি সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন?
প্রতিটি স্বপ্নের পেছনে একটি করে গল্প থাকে। আমার সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণারও তেমনি একটি গল্প আছে। সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার আগেও ছোটবেলা থেকে আমার বড় মামাকে দেখেছি, তাঁর কথা বলার স্টাইল ছিল ভীষণ হৃদয়গ্রাহী, যা মানুষকে খুব কাছে টানত। ঠিক তখন থেকেই বড় মামা হয়ে যান আমার সুপার হিরো। আমিও চেষ্টা করতাম তেমন করে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তারপর দেখলাম এর সেরা উপায় হলো সংবাদ উপস্থাপক হওয়া। তাঁদের সুন্দর করে কথা বলাটা আমার পছন্দ হতো। সেখান থেকেই মূলত অনুপ্রাণিত হওয়া। তা ছাড়া আমার মরহুম আব্বুর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তাঁর উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা এবং আমার আম্মুর নীরব সমর্থন আমাকে এ পেশায় আসতে সহযোগিতা করেছে।
শুরুতে সংবাদ উপস্থাপনার প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতি কেমন ছিল?
ছোটবেলা থেকেই কবিতা আবৃত্তি করতাম। সেটাও বড় মামার হাত ধরেই। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই যখন নিউজ প্রেজেন্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, তখন থেকেই চিন্তা করতাম এখানে শুদ্ধ উচ্চারণের বিকল্প নেই। তাই উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে টিএসসিভিত্তিক একটি আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই। সেখানেও নিউজ প্রেজেন্টেশনের ক্লাস হতো। তারপর শুধু নিউজ প্রেজেন্টেশনের জন্য একটা একাডেমিতে ভর্তি হই। সেখানে ভর্তি ফি ছিল ৭ হাজার টাকা। পুরোটা দেওয়ার সামর্থ্য তখন ছিল না। তাই তাদের বলেছিলাম, ইনশা আল্লাহ একদিন নিউজ প্রেজেন্টার হয়ে আপনাদের এখানে ফ্রি ক্লাস নেব। সেই থেকে মনের মধ্যে ইচ্ছাটাও প্রবল হয়েছিল।
প্রথমবার লাইভ নিউজ উপস্থাপন করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
প্রথমবার একটা অনলাইন টিভিতে নিউজ পড়েছিলাম। তাদেরও অভিষেক হয়েছিল আমাকে দিয়ে। তাই উচ্ছ্বাসটা দু’পক্ষেরই একটু বেশি ছিল। আমি তাদের গ্রুমিং করা প্রেজেন্টারদের মধ্যে প্রথম ছিলাম। নিজেকে প্রথম কোনো পর্দায় দেখে কি যে ভালো লেগেছিল, তা বলার ভাষা নেই।
উপস্থাপনায় ভাষা, উচ্চারণ ও টোন কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
এ পেশাটা অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে একটু আলাদা। এমনকি বাচিক যেকোনো পেশার চেয়েও। যেমন কাস্টমার কেয়ার, কিংবা কল সেন্টার থেকেও। এখানে ভুল উচ্চারণের কোনো মার্সি বা ক্ষমা নেই। তবে এখানে সংবাদের ভিন্নতার কারণে টোনের পরিবর্তন করতে হয়। নিউজের ভিন্ন ভিন্ন আবেদন টোনের ওঠানামায় ফুটিয়ে তুলতে হয়। টোনের ভেরিয়েশনের কারণে দর্শকের কানও প্রশান্তি পায়।
সংবাদ উপস্থাপনায় সময় ব্যবস্থাপনা বা কলাকৌশল কীভাবে পালন করেন?
এখানে সময় ব্যবস্থাপনাটা সবার আগে। প্রতিটি ন্যানো সেকেন্ডের মূল্য এখানে দিতে হয়। নিউজ শুরুর অনেক আগেই একজন প্রেজেন্টারকে স্টেশনে হাজির থাকতে হয়। সবকিছু বুঝে নিতে হয়। নিউজ শুরু হলে তো তাঁকে আরও বেশি প্রস্তুত থাকতে হয় সময় সম্পর্কে। কারণ প্রতিটি টাইমফ্রেম এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
লাইভ সম্প্রচারে হঠাৎ সময় পরিবর্তন হলে কীভাবে সামলান?
লাইভ নিউজে যেকোনো কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়। প্রেজেন্টারদের কানে একটা গোপন টকব্যাক লাগানো থাকে। যার সঙ্গে পিসিআর অর্থাৎ প্রডিউসার কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হয়। প্রডিউসার যেকোনো আপডেট নিউজ টকব্যাকে জানিয়ে দেন। সেটার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। খুব ঠান্ডা মাথায় যেকোনো ব্রেকিং বুঝে তারপর ডেলিভারি দিতে হয়।
উপস্থাপনার সময় ঘড়ি বা প্রম্পটার দেখে কীভাবে সময় নিয়ন্ত্রণ করেন?
পুরো নিউজটা একটা টাইমফ্রেমে বাঁধা থাকে। বিশেষ কারণ ছাড়া এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি নিউজের জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ থাকে। সেটা বিবেচনা করেই নিউজ পড়ার গতি নির্ধারণ করতে হয়। সময় কন্ট্রোল করার জন্য পিসিআর এবং এমসিআর-মাস্টার কন্ট্রোল রুম সদা তৎপর থাকে। সেভাবেই একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে চলতে হয়।
ক্যামেরার সামনে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার কৌশল কী?
আত্মবিশ্বাসটা অনেক কিছুর সমন্বিত একটা রূপ। যেকোনো ভালো প্রিপারেশন আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এখানে একজন নিউজ প্রেজেন্টারের ভালো প্রিপারেশন অনেক কিছুর সমন্বয়ে হয়ে থাকে। যেমন তাঁর উচ্চারণ, নিউজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা। নিউজ রুম, পিসিআর, এমসিআর, রানডাউন (যেখানে নিউজের ধারাবাহিকতা সাজানো থাকে) সম্পর্কে ধারণা থাকলে তাঁর আত্মবিশ্বাস অটুট থাকে।
ভুল হয়ে গেলে কীভাবে পরিস্থিতি সামলান?
লাইভ নিউজে ভুল হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তবে বারবার একই ভুল যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। ভুল হলে দর্শকের কাছে বিনয়ের সঙ্গে সেটি উপস্থাপন করাটাও ভালো প্রেজেন্টারের কাজ। দর্শকের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখতে হয়।
লাইভ নিউজে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি এলে আপনার মানসিক কৌশল কেমন থাকে?
লাইভ নিউজে প্রতিটি সেকেন্ডই চ্যালেঞ্জের। যেকোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে মাথা সম্পূর্ণ ঠান্ডা রেখে সামলাতে হয়। মানসিকভাবে সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। আমি সব সময় একটা কথা বলি, একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে একটা লোকাল বাসের ড্রাইভারের ভূমিকা পালন করতে হয়। লোকাল বাসের ড্রাইভারকে যেমনিভাবে হরেক রকমের যাত্রীর কথা শুনেও হেলপারের সহযোগিতায় সঠিকভাবে গাড়ি চালাতে হয়, তেমনি প্রেজেন্টারকেও পিসিআরের শত কথা কানে নিয়েও প্রডিউসারের সঠিক দিকনির্দেশনায় টিভি স্টেশন চালাতে হয়। মনে রাখতে হয়, একজন নিউজ প্রেজেন্টার একটি নিউজ বুলেটিনের লাস্ট গেটওয়ে। তাই তাঁকে অনেক সতর্ক থাকতে হয়।
দর্শকদের আগ্রহ ধরে রাখতে আপনি কীভাবে সংবাদ উপস্থাপন করেন?
আমি তো ভাবি, আমি একজন দর্শকের ঘরের লোক। ভাবি নিউজের মাধ্যমে আমি গ্রামের একজন চাষি থেকে শুরু করে দেশের প্রধানের সঙ্গেও নিউজের মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকি। প্রতিটি সংবাদের আলাদা আবেদন আছে। চেষ্টা করি সেটাকে সেভাবেই উপস্থাপনের। দর্শক যেমন আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ মনে করে, তেমনি সেভাবেই তার মনোজগতের কথা চিন্তা করে সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করি।
সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে আপনি কতটা নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেন?
শিশু আর পাগল ছাড়া সবারই নিজস্ব মতাদর্শ আছে। এটা যেমন সঠিক, তেমনি সংবাদিকদেরও নিজস্ব মতাদর্শ থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনে তাঁকে শতভাগ সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কারণ দর্শক পক্ষপাতদুষ্ট নিউজ প্রেজেন্টার কিংবা সাংবাদিক কাউকেই পছন্দ করেন না। সচেতন দর্শকও চান না তাঁর দলের হয়ে সাংবাদিক কথা বলুক। তিনিও চান সাংবাদিক তাঁর নিউজে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখুক। তাই এসব ব্যাপার মাথায় রেখেই আমাদের চলতে হয়।
যারা ভবিষ্যতে সংবাদ উপস্থাপক হতে চান, তাঁদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। আমার মনে আছে, যখন থেকে সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য মনস্থির করেছি, তখন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও নিউজের লিংক পড়তাম। চেষ্টা করতাম কতটা হৃদয়গ্রাহী করে একটা সংবাদ উপস্থাপন করা যায়। তাই আমার কাছে মনে হয়, সঠিক রাস্তা চিনে লেগে থাকতে পারলে সফলতা আসবেই। সেটা ভিন্নভাবে হলেও। তবে পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। সেটা কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগে।
সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য কোন গুণ বা দক্ষতা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন?
সবার আগে এটাকে পেশা হিসেবে নিতে মনস্থির করা। শখের বসে নয়। আপনাকে কোনো একটি পেশায় টিকে থাকতে হলে সে পেশার উপযোগী যত গুণ আছে, সেগুলো রপ্ত করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন নিজের উচ্চারণ ঠিক রাখ, আঞ্চলিকতা পরিহার করা। সর্বোপরি নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।
কীভাবে আপনি সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন?
প্রতিটি স্বপ্নের পেছনে একটি করে গল্প থাকে। আমার সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণারও তেমনি একটি গল্প আছে। সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার আগেও ছোটবেলা থেকে আমার বড় মামাকে দেখেছি, তাঁর কথা বলার স্টাইল ছিল ভীষণ হৃদয়গ্রাহী, যা মানুষকে খুব কাছে টানত। ঠিক তখন থেকেই বড় মামা হয়ে যান আমার সুপার হিরো। আমিও চেষ্টা করতাম তেমন করে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তারপর দেখলাম এর সেরা উপায় হলো সংবাদ উপস্থাপক হওয়া। তাঁদের সুন্দর করে কথা বলাটা আমার পছন্দ হতো। সেখান থেকেই মূলত অনুপ্রাণিত হওয়া। তা ছাড়া আমার মরহুম আব্বুর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তাঁর উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা এবং আমার আম্মুর নীরব সমর্থন আমাকে এ পেশায় আসতে সহযোগিতা করেছে।
শুরুতে সংবাদ উপস্থাপনার প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতি কেমন ছিল?
ছোটবেলা থেকেই কবিতা আবৃত্তি করতাম। সেটাও বড় মামার হাত ধরেই। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই যখন নিউজ প্রেজেন্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, তখন থেকেই চিন্তা করতাম এখানে শুদ্ধ উচ্চারণের বিকল্প নেই। তাই উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে টিএসসিভিত্তিক একটি আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই। সেখানেও নিউজ প্রেজেন্টেশনের ক্লাস হতো। তারপর শুধু নিউজ প্রেজেন্টেশনের জন্য একটা একাডেমিতে ভর্তি হই। সেখানে ভর্তি ফি ছিল ৭ হাজার টাকা। পুরোটা দেওয়ার সামর্থ্য তখন ছিল না। তাই তাদের বলেছিলাম, ইনশা আল্লাহ একদিন নিউজ প্রেজেন্টার হয়ে আপনাদের এখানে ফ্রি ক্লাস নেব। সেই থেকে মনের মধ্যে ইচ্ছাটাও প্রবল হয়েছিল।
প্রথমবার লাইভ নিউজ উপস্থাপন করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
প্রথমবার একটা অনলাইন টিভিতে নিউজ পড়েছিলাম। তাদেরও অভিষেক হয়েছিল আমাকে দিয়ে। তাই উচ্ছ্বাসটা দু’পক্ষেরই একটু বেশি ছিল। আমি তাদের গ্রুমিং করা প্রেজেন্টারদের মধ্যে প্রথম ছিলাম। নিজেকে প্রথম কোনো পর্দায় দেখে কি যে ভালো লেগেছিল, তা বলার ভাষা নেই।
উপস্থাপনায় ভাষা, উচ্চারণ ও টোন কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
এ পেশাটা অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে একটু আলাদা। এমনকি বাচিক যেকোনো পেশার চেয়েও। যেমন কাস্টমার কেয়ার, কিংবা কল সেন্টার থেকেও। এখানে ভুল উচ্চারণের কোনো মার্সি বা ক্ষমা নেই। তবে এখানে সংবাদের ভিন্নতার কারণে টোনের পরিবর্তন করতে হয়। নিউজের ভিন্ন ভিন্ন আবেদন টোনের ওঠানামায় ফুটিয়ে তুলতে হয়। টোনের ভেরিয়েশনের কারণে দর্শকের কানও প্রশান্তি পায়।
সংবাদ উপস্থাপনায় সময় ব্যবস্থাপনা বা কলাকৌশল কীভাবে পালন করেন?
এখানে সময় ব্যবস্থাপনাটা সবার আগে। প্রতিটি ন্যানো সেকেন্ডের মূল্য এখানে দিতে হয়। নিউজ শুরুর অনেক আগেই একজন প্রেজেন্টারকে স্টেশনে হাজির থাকতে হয়। সবকিছু বুঝে নিতে হয়। নিউজ শুরু হলে তো তাঁকে আরও বেশি প্রস্তুত থাকতে হয় সময় সম্পর্কে। কারণ প্রতিটি টাইমফ্রেম এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
লাইভ সম্প্রচারে হঠাৎ সময় পরিবর্তন হলে কীভাবে সামলান?
লাইভ নিউজে যেকোনো কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়। প্রেজেন্টারদের কানে একটা গোপন টকব্যাক লাগানো থাকে। যার সঙ্গে পিসিআর অর্থাৎ প্রডিউসার কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হয়। প্রডিউসার যেকোনো আপডেট নিউজ টকব্যাকে জানিয়ে দেন। সেটার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। খুব ঠান্ডা মাথায় যেকোনো ব্রেকিং বুঝে তারপর ডেলিভারি দিতে হয়।
উপস্থাপনার সময় ঘড়ি বা প্রম্পটার দেখে কীভাবে সময় নিয়ন্ত্রণ করেন?
পুরো নিউজটা একটা টাইমফ্রেমে বাঁধা থাকে। বিশেষ কারণ ছাড়া এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি নিউজের জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ থাকে। সেটা বিবেচনা করেই নিউজ পড়ার গতি নির্ধারণ করতে হয়। সময় কন্ট্রোল করার জন্য পিসিআর এবং এমসিআর-মাস্টার কন্ট্রোল রুম সদা তৎপর থাকে। সেভাবেই একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে চলতে হয়।
ক্যামেরার সামনে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার কৌশল কী?
আত্মবিশ্বাসটা অনেক কিছুর সমন্বিত একটা রূপ। যেকোনো ভালো প্রিপারেশন আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এখানে একজন নিউজ প্রেজেন্টারের ভালো প্রিপারেশন অনেক কিছুর সমন্বয়ে হয়ে থাকে। যেমন তাঁর উচ্চারণ, নিউজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা। নিউজ রুম, পিসিআর, এমসিআর, রানডাউন (যেখানে নিউজের ধারাবাহিকতা সাজানো থাকে) সম্পর্কে ধারণা থাকলে তাঁর আত্মবিশ্বাস অটুট থাকে।
ভুল হয়ে গেলে কীভাবে পরিস্থিতি সামলান?
লাইভ নিউজে ভুল হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তবে বারবার একই ভুল যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। ভুল হলে দর্শকের কাছে বিনয়ের সঙ্গে সেটি উপস্থাপন করাটাও ভালো প্রেজেন্টারের কাজ। দর্শকের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখতে হয়।
লাইভ নিউজে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি এলে আপনার মানসিক কৌশল কেমন থাকে?
লাইভ নিউজে প্রতিটি সেকেন্ডই চ্যালেঞ্জের। যেকোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে মাথা সম্পূর্ণ ঠান্ডা রেখে সামলাতে হয়। মানসিকভাবে সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। আমি সব সময় একটা কথা বলি, একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে একটা লোকাল বাসের ড্রাইভারের ভূমিকা পালন করতে হয়। লোকাল বাসের ড্রাইভারকে যেমনিভাবে হরেক রকমের যাত্রীর কথা শুনেও হেলপারের সহযোগিতায় সঠিকভাবে গাড়ি চালাতে হয়, তেমনি প্রেজেন্টারকেও পিসিআরের শত কথা কানে নিয়েও প্রডিউসারের সঠিক দিকনির্দেশনায় টিভি স্টেশন চালাতে হয়। মনে রাখতে হয়, একজন নিউজ প্রেজেন্টার একটি নিউজ বুলেটিনের লাস্ট গেটওয়ে। তাই তাঁকে অনেক সতর্ক থাকতে হয়।
দর্শকদের আগ্রহ ধরে রাখতে আপনি কীভাবে সংবাদ উপস্থাপন করেন?
আমি তো ভাবি, আমি একজন দর্শকের ঘরের লোক। ভাবি নিউজের মাধ্যমে আমি গ্রামের একজন চাষি থেকে শুরু করে দেশের প্রধানের সঙ্গেও নিউজের মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকি। প্রতিটি সংবাদের আলাদা আবেদন আছে। চেষ্টা করি সেটাকে সেভাবেই উপস্থাপনের। দর্শক যেমন আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ মনে করে, তেমনি সেভাবেই তার মনোজগতের কথা চিন্তা করে সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করি।
সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে আপনি কতটা নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেন?
শিশু আর পাগল ছাড়া সবারই নিজস্ব মতাদর্শ আছে। এটা যেমন সঠিক, তেমনি সংবাদিকদেরও নিজস্ব মতাদর্শ থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনে তাঁকে শতভাগ সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কারণ দর্শক পক্ষপাতদুষ্ট নিউজ প্রেজেন্টার কিংবা সাংবাদিক কাউকেই পছন্দ করেন না। সচেতন দর্শকও চান না তাঁর দলের হয়ে সাংবাদিক কথা বলুক। তিনিও চান সাংবাদিক তাঁর নিউজে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখুক। তাই এসব ব্যাপার মাথায় রেখেই আমাদের চলতে হয়।
যারা ভবিষ্যতে সংবাদ উপস্থাপক হতে চান, তাঁদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। আমার মনে আছে, যখন থেকে সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য মনস্থির করেছি, তখন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও নিউজের লিংক পড়তাম। চেষ্টা করতাম কতটা হৃদয়গ্রাহী করে একটা সংবাদ উপস্থাপন করা যায়। তাই আমার কাছে মনে হয়, সঠিক রাস্তা চিনে লেগে থাকতে পারলে সফলতা আসবেই। সেটা ভিন্নভাবে হলেও। তবে পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। সেটা কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগে।
সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য কোন গুণ বা দক্ষতা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন?
সবার আগে এটাকে পেশা হিসেবে নিতে মনস্থির করা। শখের বসে নয়। আপনাকে কোনো একটি পেশায় টিকে থাকতে হলে সে পেশার উপযোগী যত গুণ আছে, সেগুলো রপ্ত করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন নিজের উচ্চারণ ঠিক রাখ, আঞ্চলিকতা পরিহার করা। সর্বোপরি নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।

উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দ
১১ মে ২০২৩
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
১৩ দিন আগে
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি।
০৭ অক্টোবর ২০২৫
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’। আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশে প্যানোরামা বিভাগে জায়গা করে নিয়েছে বর্ষণ অভিনীত দুটি সিনেমা। ইমতিয়াজ বর্ষণের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিহাব আহমেদ।
শিহাব আহমেদ

দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর অবশেষে মুক্তি পাচ্ছে ওয়েব ফিল্ম অমীমাংসিত। কেমন লাগছে?
আমরা অভিনয়শিল্পীরা কাজ করি দর্শকের জন্য। সেই কাজটা অনেক দিন আটকে থাকা অবশ্যই কষ্টের। অবশেষে ওয়েব ফিল্মটি দর্শক দেখতে পারবেন, এটাই সবচেয়ে ভালো লাগার। সিনেমাটিতে রহস্যের গন্ধ রয়েছে। রহস্যজনকভাবে কে বা কারা খুন করেছে, এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এটি বানিয়েছেন রায়হান রাফী। ভিজ্যুয়াল লুকেও দর্শক নতুনত্ব পাবেন।
ওটিটি কনটেন্ট হওয়ার পরেও গত বছর তৎকালীন সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছিল সিনেমাটি। অনেকেই বলছেন এটি নির্মিত হয়েছে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে। আপনিও কি মনে করেন এই কারণেই এটি আটকে দেওয়া হয়েছিল?
একদম তাই। সবাই যেটা ধারণা করেছে, সেই কারণেই সিনেমাটি এত দিন আটকে ছিল। তৎকালীন সেন্সর বোর্ড গল্পটি সেনসেটিভ ভেবে সিনেমাটি আটকে দিয়েছিল। মুক্তির আগে এর বেশি এখন বলতে চাই না।
এটা নিয়ে প্রথম থেকেই অনেক আলোচনা। দর্শকেরও আলাদা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে কোনো চাপ অনুভব করছেন?
প্রতিটি কাজই শিল্পী ও নির্মাতাদের একধরনের প্রেশার ক্রিয়েট করে। আমি নিজেও যেকোনো কাজ মুক্তির আগে চাপ অনুভব করি। দর্শক কীভাবে নেবেন, তাঁদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। আমরা তো আসলে দর্শকদের ভালো লাগার জন্য, তাঁদের বিনোদন দেওয়ার জন্য কাজ করি। দর্শকের সন্তুষ্টি আমাদের জন্য আশীর্বাদ। অভিনেতা হিসেবে সব সময় আশা রাখি আমার কাজটি যেন দর্শকের ভালো লাগে, গুণে মানে যেন সবার মনঃপূত হয়।
ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহেও আপনার সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। সেই সিনেমা নিয়ে কিছু বলুন।
‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’ নামের সিনেমাটি বানিয়েছেন আহমেদ হাসান সানি। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন, এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের গল্প নিয়ে সিনেমা। আমাদের দেশের রাজনীতির হালচাল দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফুটে উঠেছে রাজনীতি নিয়ে মানুষের ভাবনা। আমাদের দেশে অনেক রেস্টুরেন্ট বা আড্ডার স্থানে লেখা থাকে এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ বা করা যাবে না। আমি মনে করি, এটা মিস কনসেপ্ট। রাজনৈতিক আলাপ প্রতিটি জায়গায় হওয়া উচিত। কারণ, আমরা কেউ রাজনীতির বাইরে নই। প্রতিটি মানুষ রাজনীতির অংশ। সেটা সচেতনভাবে হোক কিংবা অসচেতনভাবে। যারা সচেতন, তারা একটু দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সক্রিয় থাকে। কিন্তু যারা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন বা কেয়ারলেস, তাদেরও একটা ভূমিকা থাকে।
এটা আহমেদ হাসান সানির প্রথম সিনেমা। নির্মাতা হিসেবে কেমন লাগল তাঁকে?
এর আগে আহমেদ হাসান সানির নির্দেশনায় বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি। তবে নির্মাতা হিসেবে আগে থেকেই তাঁকে চিনি। উনি একজন আধুনিক নির্মাতা, তাঁর ভাবনাও আধুনিক। ছোটখাটো বিষয়েও সমান খেয়াল রাখেন তিনি। চিত্রনাট্য, অ্যাক্টিং, সেট—সব ব্যাপারেই তিনি খুঁতখুঁতে। এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি সিনেমাটি দেখার সময় দর্শক তাঁর যত্নের ছাপ দেখতে পাবেন। আমি বিশ্বাস করি, ওনার কাছ থেকে ভালো মানের আরও কাজ পাওয়া যাবে।
সম্প্রতি ছাড়পত্র পেয়েছে আপনার আরেক সিনেমা ‘যাপিত জীবন’। সেই সিনেমার গল্প কী নিয়ে?
এটি একটি পিরিয়ডিকাল সিনেমা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গল্প। এই সিনেমায় আরও অভিনয় করেছেন আফজাল হোসেন, রোকেয়া প্রাচী, আশনা হাবিব ভাবনা প্রমুখ। পরিচালনা করেছেন হাবিবুল ইসলাম হাবিব।
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি এবং যাপিত জীবন সিনেমা দুটি ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে প্রদর্শিত হবে। কেমন অনুভূতি?
২০২০ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমার কোনো না কোনো সিনেমা প্রদর্শিত হয়। এটা আমার জন্য আনন্দের ও গর্বের। এ বছর দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে। শুনছি দুটি সিনেমাই ডিসেম্বরে মুক্তি পাবে। এটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। ভিন্ন সময়ে সিনেমা দুটি মুক্তি পেলে ভালো হতো।
সিনেমা মুক্তি নিয়ে এই আপত্তির কথা জানিয়েছেন নির্মাতাদের?
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি নিয়ে নির্মাতার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ওনারা সিনেমার মুক্তি ও প্রমোশন নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনার কথা আমাকে জানিয়েছেন। যাপিত জীবন নিয়ে আমি অফিশিয়ালি এখনো কিছু জানি না। তাই কথা হয়নি।
‘রবি ইন ঢাকা’ নামের সিনেমার শুটিং করছেন। এ সিনেমাটি নিয়ে বলুন।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই সিনেমার শুটিং শিডিউল আছে। এরপর একটা বিরতি নিয়ে শুরু হবে পরের লটের শুটিং। এই সিনেমার গল্পটিও সমকালীন। নতুন প্রজন্মের কথা আছে। আসলে আমরা যেই সময়েই বসবাস করি না কেন, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। এই শহরে অনেক মানুষ দেখি যাদের দূর থেকে দেখলে মনে হয় সুখে আছে। কিন্তু আসলে তাদের ভেতরে অনেক কষ্ট। নানা ধরনের কষ্টের মাঝেও আমরা এই শহরে আনন্দ খুঁজে বেড়াই। এমন একটা গল্প নিয়েই রবি ইন ঢাকা। গল্পে মিস্ট্রি আছে, সাসপেন্সও আছে। পরিচালনা করছেন রাজীব সালেহীন।
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর অবশেষে মুক্তি পাচ্ছে ওয়েব ফিল্ম অমীমাংসিত। কেমন লাগছে?
আমরা অভিনয়শিল্পীরা কাজ করি দর্শকের জন্য। সেই কাজটা অনেক দিন আটকে থাকা অবশ্যই কষ্টের। অবশেষে ওয়েব ফিল্মটি দর্শক দেখতে পারবেন, এটাই সবচেয়ে ভালো লাগার। সিনেমাটিতে রহস্যের গন্ধ রয়েছে। রহস্যজনকভাবে কে বা কারা খুন করেছে, এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এটি বানিয়েছেন রায়হান রাফী। ভিজ্যুয়াল লুকেও দর্শক নতুনত্ব পাবেন।
ওটিটি কনটেন্ট হওয়ার পরেও গত বছর তৎকালীন সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছিল সিনেমাটি। অনেকেই বলছেন এটি নির্মিত হয়েছে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে। আপনিও কি মনে করেন এই কারণেই এটি আটকে দেওয়া হয়েছিল?
একদম তাই। সবাই যেটা ধারণা করেছে, সেই কারণেই সিনেমাটি এত দিন আটকে ছিল। তৎকালীন সেন্সর বোর্ড গল্পটি সেনসেটিভ ভেবে সিনেমাটি আটকে দিয়েছিল। মুক্তির আগে এর বেশি এখন বলতে চাই না।
এটা নিয়ে প্রথম থেকেই অনেক আলোচনা। দর্শকেরও আলাদা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে কোনো চাপ অনুভব করছেন?
প্রতিটি কাজই শিল্পী ও নির্মাতাদের একধরনের প্রেশার ক্রিয়েট করে। আমি নিজেও যেকোনো কাজ মুক্তির আগে চাপ অনুভব করি। দর্শক কীভাবে নেবেন, তাঁদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। আমরা তো আসলে দর্শকদের ভালো লাগার জন্য, তাঁদের বিনোদন দেওয়ার জন্য কাজ করি। দর্শকের সন্তুষ্টি আমাদের জন্য আশীর্বাদ। অভিনেতা হিসেবে সব সময় আশা রাখি আমার কাজটি যেন দর্শকের ভালো লাগে, গুণে মানে যেন সবার মনঃপূত হয়।
ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহেও আপনার সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। সেই সিনেমা নিয়ে কিছু বলুন।
‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’ নামের সিনেমাটি বানিয়েছেন আহমেদ হাসান সানি। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন, এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের গল্প নিয়ে সিনেমা। আমাদের দেশের রাজনীতির হালচাল দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফুটে উঠেছে রাজনীতি নিয়ে মানুষের ভাবনা। আমাদের দেশে অনেক রেস্টুরেন্ট বা আড্ডার স্থানে লেখা থাকে এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ বা করা যাবে না। আমি মনে করি, এটা মিস কনসেপ্ট। রাজনৈতিক আলাপ প্রতিটি জায়গায় হওয়া উচিত। কারণ, আমরা কেউ রাজনীতির বাইরে নই। প্রতিটি মানুষ রাজনীতির অংশ। সেটা সচেতনভাবে হোক কিংবা অসচেতনভাবে। যারা সচেতন, তারা একটু দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সক্রিয় থাকে। কিন্তু যারা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন বা কেয়ারলেস, তাদেরও একটা ভূমিকা থাকে।
এটা আহমেদ হাসান সানির প্রথম সিনেমা। নির্মাতা হিসেবে কেমন লাগল তাঁকে?
এর আগে আহমেদ হাসান সানির নির্দেশনায় বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি। তবে নির্মাতা হিসেবে আগে থেকেই তাঁকে চিনি। উনি একজন আধুনিক নির্মাতা, তাঁর ভাবনাও আধুনিক। ছোটখাটো বিষয়েও সমান খেয়াল রাখেন তিনি। চিত্রনাট্য, অ্যাক্টিং, সেট—সব ব্যাপারেই তিনি খুঁতখুঁতে। এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি সিনেমাটি দেখার সময় দর্শক তাঁর যত্নের ছাপ দেখতে পাবেন। আমি বিশ্বাস করি, ওনার কাছ থেকে ভালো মানের আরও কাজ পাওয়া যাবে।
সম্প্রতি ছাড়পত্র পেয়েছে আপনার আরেক সিনেমা ‘যাপিত জীবন’। সেই সিনেমার গল্প কী নিয়ে?
এটি একটি পিরিয়ডিকাল সিনেমা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গল্প। এই সিনেমায় আরও অভিনয় করেছেন আফজাল হোসেন, রোকেয়া প্রাচী, আশনা হাবিব ভাবনা প্রমুখ। পরিচালনা করেছেন হাবিবুল ইসলাম হাবিব।
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি এবং যাপিত জীবন সিনেমা দুটি ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে প্রদর্শিত হবে। কেমন অনুভূতি?
২০২০ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমার কোনো না কোনো সিনেমা প্রদর্শিত হয়। এটা আমার জন্য আনন্দের ও গর্বের। এ বছর দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে। শুনছি দুটি সিনেমাই ডিসেম্বরে মুক্তি পাবে। এটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। ভিন্ন সময়ে সিনেমা দুটি মুক্তি পেলে ভালো হতো।
সিনেমা মুক্তি নিয়ে এই আপত্তির কথা জানিয়েছেন নির্মাতাদের?
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি নিয়ে নির্মাতার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ওনারা সিনেমার মুক্তি ও প্রমোশন নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনার কথা আমাকে জানিয়েছেন। যাপিত জীবন নিয়ে আমি অফিশিয়ালি এখনো কিছু জানি না। তাই কথা হয়নি।
‘রবি ইন ঢাকা’ নামের সিনেমার শুটিং করছেন। এ সিনেমাটি নিয়ে বলুন।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই সিনেমার শুটিং শিডিউল আছে। এরপর একটা বিরতি নিয়ে শুরু হবে পরের লটের শুটিং। এই সিনেমার গল্পটিও সমকালীন। নতুন প্রজন্মের কথা আছে। আসলে আমরা যেই সময়েই বসবাস করি না কেন, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। এই শহরে অনেক মানুষ দেখি যাদের দূর থেকে দেখলে মনে হয় সুখে আছে। কিন্তু আসলে তাদের ভেতরে অনেক কষ্ট। নানা ধরনের কষ্টের মাঝেও আমরা এই শহরে আনন্দ খুঁজে বেড়াই। এমন একটা গল্প নিয়েই রবি ইন ঢাকা। গল্পে মিস্ট্রি আছে, সাসপেন্সও আছে। পরিচালনা করছেন রাজীব সালেহীন।

উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দ
১১ মে ২০২৩
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
২০ ঘণ্টা আগে
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি।
০৭ অক্টোবর ২০২৫
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। নিলয় বিশ্ববিদ্যালয়টির ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি নিজের অসামান্য কৃতিত্বের নেপথ্যের গল্প জানিয়েছেন আজকের পত্রিকাকে। তার কথাগুলো শুনেছেন ইলিয়াস শান্ত।
ইলিয়াস শান্ত

গত ২৭ অক্টোবর আইইউটির ৩৭ তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আপনি এতে অংশ নিয়েছেন। আপনার বিভাগ ও ফলাফল সম্পর্কে বলুন।
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে আমি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছি। প্রথম সেমিস্টারে একটি কোর্সে এ+ পাইনি। তাই সেই সেমিস্টারে আমার জিপিএ ছিল ৩.৯৭। তবে এরপরের সাতটি সেমিস্টারেই আমি ধারাবাহিকভাবে ৪.০০ পেয়েছি।
দ্বিতীয় সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর আমার সিজিপিএ দাঁড়ায় ৩.৯৮। তৃতীয় সেমিস্টারের পর হয় ৩.৯৯। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ সেমিস্টারে ৪ ধরে রাখতে পারলেও সিজিপিএ তখনও ৩.৯৯ ছিল। শেষ পর্যন্ত সপ্তম সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর সিজিপিএ অবশেষে ৪–এ পৌঁছায়। তখন সত্যিই আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। এরপর শেষ বা অষ্টম সেমিস্টারেও একই পারফরম্যান্স ধরে রাখার চেষ্টা করি। আলহামদুলিল্লাহ সেটাও সম্ভব হয়। ফলে আমি সিজিপিএ ৪ নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করতে পেরেছি।
এমন সাফল্যের কৃতিত্ব কাকে দিতে চান?
সবার আগে আমি আমার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞ জানাচ্ছি। তারা সবসময় আমার পাশে থেকেছে। প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে সাহস আর অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এরপর আমার শিক্ষকদের কথা, যাদের দিকনির্দেশনা ও আন্তরিক সহযোগিতা আমাকে প্রতিটি ধাপে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আর আমার বন্ধুদের কথাও বলতে হবে। এই চার বছরের যাত্রায় আমার বন্ধুরা সবসময় পাশে থেকেছে–কখনো সহায়তায়, কখনো বা মোটিভেশনে। সবার সম্মিলিত সহযোগিতা আর আমার প্রচেষ্টায় এ জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
আপনার বড় বোনের কথা শুনেছি। তাঁর অবদান কতটুকু?
হ্যাঁ, আমার দুজন বড় বোন আছেন। একজন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন। অন্যজন আইইউটির ছাত্রী ছিলেন। তিনি আইইউটির ১৭ তম ব্যাচের বিজনেস টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তিনি শুরু থেকেই আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তিনি আমাকে পড়াশোনার প্রতি সিরিয়াস থাকতে উৎসাহ দিয়েছেন। বিশেষ করে তিনি আমাকে বোঝাতেন নিয়মিত উপস্থিতি বজায় রাখা, কুইজ ও মিডটার্মের মতো মূল্যায়নগুলো গুরুত্ব সহকারে দেওয়া কতটা জরুরি। এগুলোই আসলে একটি ভালো ফলের ভিত্তি তৈরি করেছে। তার দেওয়া পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা আমার পুরো চার বছরের যাত্রায় দারুণভাবে কাজে দিয়েছে।
স্বর্ণপদক পাওয়ার খবরে আপনার বাবা–মা কী বলেছিলেন?
তারা উভয়েই খুব খুশি হয়েছিলেন। তাঁদের মুখে আনন্দের হাসিটা দেখে মনে হয়েছিল, এই মুহূর্তের জন্যই হয়তো তারা এত বছর ধরে পরিশ্রম আর ত্যাগ স্বীকার করে এসেছেন। আমার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। জীবনে তিনি সবসময় নিয়ম, অধ্যবসায় আর সততার মূল্য শিখিয়েছেন। আর মা একজন গৃহিণী। মা আমাদের পরিবারের মূল শক্তি। ছোটবেলা থেকেই তিনি আমাদেরকে শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারূপ করেছেন। সবসময় পাশে থেকেছেন, কখনো ক্লান্ত হননি।
এমন অসামান্য ফলাফল অর্জনে নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেছিলেন, পড়ালেখার ধরন কেমন ছিল?
প্রথম থেকেই আমি জানতাম সিএসই এমন একটি বিষয়, যেখানে ধারাবাহিক পরিশ্রম ও মনোযোগ ছাড়া ভালো ফল করা সম্ভব নয়। যেহেতু ভর্তি হওয়ার আগে আমার কোডিং নিয়ে তেমন কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই আমি নিজের ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা শুরু করেছি। ইউটিউবে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল দেখে প্রোগ্রামিংয়ের বেসিকগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করে নিয়েছি। আর সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা বাড়িয়েছি।
আমার পড়ালেখার ধরনটা ছিল বেশ দলভিত্তিক। আমি সবসময় বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি করতাম। এতে করে অনেক কঠিন বিষয় সহজে বোঝা যেত। আর কাউকে কোনো বিষয় বুঝিয়ে বলতে গিয়ে নিজের বোঝাটাও আরও মজবুত হতো। এই সহযোগিতামূলক পরিবেশটাই আসলে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। এ ছাড়া আমি ক্লাসের উপস্থিতি, কুইজ ও মিডটার্ম পরীক্ষাগুলোতে বেশ গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ এগুলোই মূলত চূড়ান্ত ফলে বড় ভূমিকা রাখে। সিনিয়র ভাইদের তৈরি করা নোটগুলোও অনেক সময় কাজে দিয়েছে, বিশেষ করে প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে। সবশেষে, প্রতিটি প্রজেক্টও আমি সমান গুরুত্ব দিয়ে করতাম। যেন শুধু নম্বরের জন্য নয়, শেখার জন্যও কাজটা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়।
সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়ে আপনি এখন গ্র্যাজুয়েট। আপনি ওআইসি স্বর্ণপদক পেয়েছেন। অন্য শিক্ষার্থীরা কীভাবে প্রস্তুতি নিলে এমন ফল করতে পারতেন, তাদের প্রস্তুতির কোন কোন জায়গায় ঘাটতি ছিল বলে মনে হয়?
আসলে প্রত্যেকের পড়ার ধরনটা আলাদা হয়। এখানে যে ধরন একজনের জন্য সবচেয়ে কার্যকর, সেটা অন্য কারও জন্য নাও হতে পারে। তাই একেবারে নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন যে, কে কীভাবে পড়লে এমন ফল করতে পারতেন। তবুও আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কয়েকটা জিনিস নিয়মিতভাবে মেনে চললে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। সবচেয়ে আগে, ক্লাসের উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারপর কুইজ আর মিডটার্ম। অনেকে এগুলোকে হালকাভাবে নেন। আমি মনে করি ফলাফলে এগুলোই আসলে মূল ভিত্তি তৈরি করে দেয়। যদি আগে থেকেই কুইজ ও মিডটার্মে ভালো করা যায়, তাহলে ফাইনাল পরীক্ষার সময় চাপ অনেকটাই কমে যায়। আমার গ্রুপ স্টাডির কথা তো আগেই বলেছি। গ্রুপ স্টাডি শেখার পরিবেশটাকে আরও আনন্দদায়ক করে তোলে। কেউ নির্দিষ্ট কোনো বিষয় না বুঝলে অন্য সেটা কেউ বুঝিয়ে দিতে পারছে। এতে পারস্পরিকভাবে সবারই উপকার হয়।
আপনার শৈশব, মাধ্যমিক–উচ্চ মাধ্যমিক ও পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
আমাদের পারিবারিক শেকড় বরিশালে। তবে আমার শৈশবের একটা অংশ কেটেছে ফরিদপুরে। সেখানে আমি সানরাইজ স্কুলে পড়ালেখা করেছি। পরে পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসি। উত্তরায় আসার পর আমি ক্লাস ৩–৫ শ্রেণি পর্যন্ত মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে পড়েছি। এরপর ৬–৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে। পরবর্তীতে আমি আবার মাইলস্টোন কলেজে ভর্তি হই এবং সেখান থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করি। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেছি। এখানে আমার কলেজ জীবনের সুন্দর দুইটি বছর কেটেছে।
ছোটবেলায় আপনার কি হওয়ার স্বপ্ন ছিল?
ছোটবেলায় আকাশে প্লেন উড়তে দেখলেই মনে হতো, ‘ইশ! একদিন যদি আমিও এমন করে উড়তে পারতাম!’ তখন পাইলট হওয়ার স্বপ্নটাই ছিল সবচেয়ে বড়। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আর বাস্তবতা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করার পর সেই স্বপ্নটা বদলে গেছে। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। এখন আমার স্বপ্ন একটু অন্যরকম।
পরবর্তী লক্ষ্য কী, কেমন জব অফার পাচ্ছেন?
এখন আমার মূল লক্ষ্য হলো আইইউটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করা। এজন্যই আমি নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছি। যাতে ক্লাসে পড়ানো এবং গবেষণার কাজ–দুটোই ভালোভাবে করতে পারি। একইসঙ্গে গবেষণার মাধ্যমে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চাই। শেখা আর শেখানোর এই প্রক্রিয়াটার ভেতরেই আমি এখন সবচেয়ে বেশি আনন্দ খুঁজে পাই। দূরদৃষ্টি হিসেবে আমার আরও বড় লক্ষ্য হলো–ভবিষ্যতে বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে পিএইচডি করা। আমি গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন বিষয় জানা ও শেখার সুযোগকে আরও প্রসারিত করতে চাই। আমার বিশ্বাস, এই প্রচেষ্টা আমাদের শিক্ষার্থীদের কাজে দেবে।
আইইউটিতে ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগদানে আগ্রহীদের কোন কোন বিষয়গুলো বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়?
আমার জানা মতে, নির্দিষ্ট কিছু বিষয়কে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো: একাডেমিক রেজাল্ট, অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পূর্ববর্তী ফলাফল। এছাড়া গবেষণার অভিজ্ঞতা, প্রকাশনা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
দেশের বাস্তবতায় সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির সুযোগ কেমন?
বর্তমান বাজারে সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের জন্য চাকরি সুযোগ খুবই প্রশস্ত। তবে এতে প্রতিযোগিতা রয়েছে। আমি বলবো, প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকলে চাকরি পাওয়া কঠিন কিছু নয়। আমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগেই চাকরি পেয়ে গেছেন। এটা আইইউটির ঐতিহ্য। আইইউটি শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই চাকরির অফার পাওয়ার বেশ নজির আছে। এটা ভালো একাডেমিক পরিবেশ, যুগোপযোগী সিলেবাস এবং শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টার কারণে সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি এন্ট্রি লেভেলের চাকরির জন্যেও আইইউটি গ্র্যাজুয়েটদের ভালো বেতন অফার করে থাকে।
উচ্চশিক্ষার জন্য আপনি আইইউটিকে কেন বেছে নিয়েছিলেন?
কলেজ লাইফ শুরুর আগে আমার স্বপ্ন ছিল বুয়েটে পড়ার। তবে তখনো নির্দিষ্ট করে ভাবিনি কোন বিষয়ে পড়বো। এইচএসসির পর আইইউটিতে পরীক্ষা দিয়ে সিএসই বিভাগে চান্স পাই। এরপর বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায়ও সাফল্য আসে। সেখানে পেয়েছিলাম ইইই বিভাগ। কিন্তু ততদিন বুয়েটের ক্লাস শুরু করতে করতে আইইউটিতে আমার প্রথম সেমিস্টারের বেশিরভাগ সময় পার যায়। ওই সময়টায় আমি উপলব্ধি করি, কম্পিউটার সায়েন্সের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। আমি এতে ভালোও করছি। আইইউটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো দীর্ঘ সেশনজট নেই। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডিগ্রি সম্পন্ন করা যায়। একাডেমিক জীবনটা অনেক বেশি সুসংগঠিত থাকে। সবমিলিয়ে আমি বুঝতে পারি, একটি বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং একটি অনুকূল একাডেমিক পরিবেশই সর্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই বুয়েটের ইইই–এর পরিবর্তে আইইউটির সিএসইতে স্থির হয়ে যাই।
স্নাতকের পুরো জার্নিতে পড়ালেখার পাশাপাশি আপনি আর কি কি করেছিলেন?
পড়ালেখার পাশাপাশি আমি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। নতুন নতুন জায়গা ঘুরে দেখেছি। মাঝে মাঝে ফুটবল, ক্যারমের মতো খেলা খেলেছি। এছাড়া কম্পিউটারে গেমও খেলেছি। পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু সময় টিউশনি করেছি। যা নিজের ধারণাকে পরিষ্কার করতে এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সহায়ক হয়েছে।
সিএসই নিয়ে পড়তে আসা নবীন শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার কি বার্তা থাকবে?
নিজেকে শুধুমাত্র একাডেমিক সিলেবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। প্রথম থেকেই নিজের মধ্যে বাড়তি শেখার আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। কোড ফোর্স, হ্যাকার র্যাঙ্ক–এর মতো প্ল্যাটফর্মের কনটেস্টে নিয়মিত অংশ নিতে হবে। এ ছাড়া কম্পেটিটিভ প্রোগ্রামিংয়ে মনোযোগ দিলে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি যুক্তির গভীরতাও শাণিত হবে। ইউটিউবেও পছন্দের বিষয়গুলোর অসংখ্য টিউটোরিয়াল রয়েছে। সেগুলো কাজে লাগিয়ে শেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, চাকরির ক্ষেত্রে যে স্কিলগুলো সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে, তা অনেক সময় একাডেমিক পড়ালেখার চেয়ে কিছুটা আলাদা। একাডেমিক প্রোজেক্টগুলোও কখনই হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। এগুলো যতটা সম্ভব ভালোভাবে করতে হবে। কারণ ভবিষ্যতে সেগুলোই সিভিতে স্থান করবে এবং দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।
আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকার জন্যেও শুভকামনা রইলো।
গত ২৭ অক্টোবর আইইউটির ৩৭ তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আপনি এতে অংশ নিয়েছেন। আপনার বিভাগ ও ফলাফল সম্পর্কে বলুন।
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে আমি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছি। প্রথম সেমিস্টারে একটি কোর্সে এ+ পাইনি। তাই সেই সেমিস্টারে আমার জিপিএ ছিল ৩.৯৭। তবে এরপরের সাতটি সেমিস্টারেই আমি ধারাবাহিকভাবে ৪.০০ পেয়েছি।
দ্বিতীয় সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর আমার সিজিপিএ দাঁড়ায় ৩.৯৮। তৃতীয় সেমিস্টারের পর হয় ৩.৯৯। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ সেমিস্টারে ৪ ধরে রাখতে পারলেও সিজিপিএ তখনও ৩.৯৯ ছিল। শেষ পর্যন্ত সপ্তম সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর সিজিপিএ অবশেষে ৪–এ পৌঁছায়। তখন সত্যিই আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। এরপর শেষ বা অষ্টম সেমিস্টারেও একই পারফরম্যান্স ধরে রাখার চেষ্টা করি। আলহামদুলিল্লাহ সেটাও সম্ভব হয়। ফলে আমি সিজিপিএ ৪ নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করতে পেরেছি।
এমন সাফল্যের কৃতিত্ব কাকে দিতে চান?
সবার আগে আমি আমার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞ জানাচ্ছি। তারা সবসময় আমার পাশে থেকেছে। প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে সাহস আর অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এরপর আমার শিক্ষকদের কথা, যাদের দিকনির্দেশনা ও আন্তরিক সহযোগিতা আমাকে প্রতিটি ধাপে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আর আমার বন্ধুদের কথাও বলতে হবে। এই চার বছরের যাত্রায় আমার বন্ধুরা সবসময় পাশে থেকেছে–কখনো সহায়তায়, কখনো বা মোটিভেশনে। সবার সম্মিলিত সহযোগিতা আর আমার প্রচেষ্টায় এ জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
আপনার বড় বোনের কথা শুনেছি। তাঁর অবদান কতটুকু?
হ্যাঁ, আমার দুজন বড় বোন আছেন। একজন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন। অন্যজন আইইউটির ছাত্রী ছিলেন। তিনি আইইউটির ১৭ তম ব্যাচের বিজনেস টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তিনি শুরু থেকেই আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তিনি আমাকে পড়াশোনার প্রতি সিরিয়াস থাকতে উৎসাহ দিয়েছেন। বিশেষ করে তিনি আমাকে বোঝাতেন নিয়মিত উপস্থিতি বজায় রাখা, কুইজ ও মিডটার্মের মতো মূল্যায়নগুলো গুরুত্ব সহকারে দেওয়া কতটা জরুরি। এগুলোই আসলে একটি ভালো ফলের ভিত্তি তৈরি করেছে। তার দেওয়া পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা আমার পুরো চার বছরের যাত্রায় দারুণভাবে কাজে দিয়েছে।
স্বর্ণপদক পাওয়ার খবরে আপনার বাবা–মা কী বলেছিলেন?
তারা উভয়েই খুব খুশি হয়েছিলেন। তাঁদের মুখে আনন্দের হাসিটা দেখে মনে হয়েছিল, এই মুহূর্তের জন্যই হয়তো তারা এত বছর ধরে পরিশ্রম আর ত্যাগ স্বীকার করে এসেছেন। আমার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। জীবনে তিনি সবসময় নিয়ম, অধ্যবসায় আর সততার মূল্য শিখিয়েছেন। আর মা একজন গৃহিণী। মা আমাদের পরিবারের মূল শক্তি। ছোটবেলা থেকেই তিনি আমাদেরকে শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারূপ করেছেন। সবসময় পাশে থেকেছেন, কখনো ক্লান্ত হননি।
এমন অসামান্য ফলাফল অর্জনে নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেছিলেন, পড়ালেখার ধরন কেমন ছিল?
প্রথম থেকেই আমি জানতাম সিএসই এমন একটি বিষয়, যেখানে ধারাবাহিক পরিশ্রম ও মনোযোগ ছাড়া ভালো ফল করা সম্ভব নয়। যেহেতু ভর্তি হওয়ার আগে আমার কোডিং নিয়ে তেমন কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই আমি নিজের ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা শুরু করেছি। ইউটিউবে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল দেখে প্রোগ্রামিংয়ের বেসিকগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করে নিয়েছি। আর সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা বাড়িয়েছি।
আমার পড়ালেখার ধরনটা ছিল বেশ দলভিত্তিক। আমি সবসময় বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি করতাম। এতে করে অনেক কঠিন বিষয় সহজে বোঝা যেত। আর কাউকে কোনো বিষয় বুঝিয়ে বলতে গিয়ে নিজের বোঝাটাও আরও মজবুত হতো। এই সহযোগিতামূলক পরিবেশটাই আসলে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। এ ছাড়া আমি ক্লাসের উপস্থিতি, কুইজ ও মিডটার্ম পরীক্ষাগুলোতে বেশ গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ এগুলোই মূলত চূড়ান্ত ফলে বড় ভূমিকা রাখে। সিনিয়র ভাইদের তৈরি করা নোটগুলোও অনেক সময় কাজে দিয়েছে, বিশেষ করে প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে। সবশেষে, প্রতিটি প্রজেক্টও আমি সমান গুরুত্ব দিয়ে করতাম। যেন শুধু নম্বরের জন্য নয়, শেখার জন্যও কাজটা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়।
সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়ে আপনি এখন গ্র্যাজুয়েট। আপনি ওআইসি স্বর্ণপদক পেয়েছেন। অন্য শিক্ষার্থীরা কীভাবে প্রস্তুতি নিলে এমন ফল করতে পারতেন, তাদের প্রস্তুতির কোন কোন জায়গায় ঘাটতি ছিল বলে মনে হয়?
আসলে প্রত্যেকের পড়ার ধরনটা আলাদা হয়। এখানে যে ধরন একজনের জন্য সবচেয়ে কার্যকর, সেটা অন্য কারও জন্য নাও হতে পারে। তাই একেবারে নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন যে, কে কীভাবে পড়লে এমন ফল করতে পারতেন। তবুও আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কয়েকটা জিনিস নিয়মিতভাবে মেনে চললে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। সবচেয়ে আগে, ক্লাসের উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারপর কুইজ আর মিডটার্ম। অনেকে এগুলোকে হালকাভাবে নেন। আমি মনে করি ফলাফলে এগুলোই আসলে মূল ভিত্তি তৈরি করে দেয়। যদি আগে থেকেই কুইজ ও মিডটার্মে ভালো করা যায়, তাহলে ফাইনাল পরীক্ষার সময় চাপ অনেকটাই কমে যায়। আমার গ্রুপ স্টাডির কথা তো আগেই বলেছি। গ্রুপ স্টাডি শেখার পরিবেশটাকে আরও আনন্দদায়ক করে তোলে। কেউ নির্দিষ্ট কোনো বিষয় না বুঝলে অন্য সেটা কেউ বুঝিয়ে দিতে পারছে। এতে পারস্পরিকভাবে সবারই উপকার হয়।
আপনার শৈশব, মাধ্যমিক–উচ্চ মাধ্যমিক ও পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
আমাদের পারিবারিক শেকড় বরিশালে। তবে আমার শৈশবের একটা অংশ কেটেছে ফরিদপুরে। সেখানে আমি সানরাইজ স্কুলে পড়ালেখা করেছি। পরে পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসি। উত্তরায় আসার পর আমি ক্লাস ৩–৫ শ্রেণি পর্যন্ত মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে পড়েছি। এরপর ৬–৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে। পরবর্তীতে আমি আবার মাইলস্টোন কলেজে ভর্তি হই এবং সেখান থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করি। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেছি। এখানে আমার কলেজ জীবনের সুন্দর দুইটি বছর কেটেছে।
ছোটবেলায় আপনার কি হওয়ার স্বপ্ন ছিল?
ছোটবেলায় আকাশে প্লেন উড়তে দেখলেই মনে হতো, ‘ইশ! একদিন যদি আমিও এমন করে উড়তে পারতাম!’ তখন পাইলট হওয়ার স্বপ্নটাই ছিল সবচেয়ে বড়। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আর বাস্তবতা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করার পর সেই স্বপ্নটা বদলে গেছে। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। এখন আমার স্বপ্ন একটু অন্যরকম।
পরবর্তী লক্ষ্য কী, কেমন জব অফার পাচ্ছেন?
এখন আমার মূল লক্ষ্য হলো আইইউটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করা। এজন্যই আমি নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছি। যাতে ক্লাসে পড়ানো এবং গবেষণার কাজ–দুটোই ভালোভাবে করতে পারি। একইসঙ্গে গবেষণার মাধ্যমে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চাই। শেখা আর শেখানোর এই প্রক্রিয়াটার ভেতরেই আমি এখন সবচেয়ে বেশি আনন্দ খুঁজে পাই। দূরদৃষ্টি হিসেবে আমার আরও বড় লক্ষ্য হলো–ভবিষ্যতে বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে পিএইচডি করা। আমি গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন বিষয় জানা ও শেখার সুযোগকে আরও প্রসারিত করতে চাই। আমার বিশ্বাস, এই প্রচেষ্টা আমাদের শিক্ষার্থীদের কাজে দেবে।
আইইউটিতে ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগদানে আগ্রহীদের কোন কোন বিষয়গুলো বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়?
আমার জানা মতে, নির্দিষ্ট কিছু বিষয়কে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো: একাডেমিক রেজাল্ট, অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পূর্ববর্তী ফলাফল। এছাড়া গবেষণার অভিজ্ঞতা, প্রকাশনা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
দেশের বাস্তবতায় সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির সুযোগ কেমন?
বর্তমান বাজারে সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের জন্য চাকরি সুযোগ খুবই প্রশস্ত। তবে এতে প্রতিযোগিতা রয়েছে। আমি বলবো, প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকলে চাকরি পাওয়া কঠিন কিছু নয়। আমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগেই চাকরি পেয়ে গেছেন। এটা আইইউটির ঐতিহ্য। আইইউটি শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই চাকরির অফার পাওয়ার বেশ নজির আছে। এটা ভালো একাডেমিক পরিবেশ, যুগোপযোগী সিলেবাস এবং শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টার কারণে সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি এন্ট্রি লেভেলের চাকরির জন্যেও আইইউটি গ্র্যাজুয়েটদের ভালো বেতন অফার করে থাকে।
উচ্চশিক্ষার জন্য আপনি আইইউটিকে কেন বেছে নিয়েছিলেন?
কলেজ লাইফ শুরুর আগে আমার স্বপ্ন ছিল বুয়েটে পড়ার। তবে তখনো নির্দিষ্ট করে ভাবিনি কোন বিষয়ে পড়বো। এইচএসসির পর আইইউটিতে পরীক্ষা দিয়ে সিএসই বিভাগে চান্স পাই। এরপর বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায়ও সাফল্য আসে। সেখানে পেয়েছিলাম ইইই বিভাগ। কিন্তু ততদিন বুয়েটের ক্লাস শুরু করতে করতে আইইউটিতে আমার প্রথম সেমিস্টারের বেশিরভাগ সময় পার যায়। ওই সময়টায় আমি উপলব্ধি করি, কম্পিউটার সায়েন্সের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। আমি এতে ভালোও করছি। আইইউটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো দীর্ঘ সেশনজট নেই। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডিগ্রি সম্পন্ন করা যায়। একাডেমিক জীবনটা অনেক বেশি সুসংগঠিত থাকে। সবমিলিয়ে আমি বুঝতে পারি, একটি বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং একটি অনুকূল একাডেমিক পরিবেশই সর্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই বুয়েটের ইইই–এর পরিবর্তে আইইউটির সিএসইতে স্থির হয়ে যাই।
স্নাতকের পুরো জার্নিতে পড়ালেখার পাশাপাশি আপনি আর কি কি করেছিলেন?
পড়ালেখার পাশাপাশি আমি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। নতুন নতুন জায়গা ঘুরে দেখেছি। মাঝে মাঝে ফুটবল, ক্যারমের মতো খেলা খেলেছি। এছাড়া কম্পিউটারে গেমও খেলেছি। পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু সময় টিউশনি করেছি। যা নিজের ধারণাকে পরিষ্কার করতে এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সহায়ক হয়েছে।
সিএসই নিয়ে পড়তে আসা নবীন শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার কি বার্তা থাকবে?
নিজেকে শুধুমাত্র একাডেমিক সিলেবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। প্রথম থেকেই নিজের মধ্যে বাড়তি শেখার আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। কোড ফোর্স, হ্যাকার র্যাঙ্ক–এর মতো প্ল্যাটফর্মের কনটেস্টে নিয়মিত অংশ নিতে হবে। এ ছাড়া কম্পেটিটিভ প্রোগ্রামিংয়ে মনোযোগ দিলে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি যুক্তির গভীরতাও শাণিত হবে। ইউটিউবেও পছন্দের বিষয়গুলোর অসংখ্য টিউটোরিয়াল রয়েছে। সেগুলো কাজে লাগিয়ে শেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, চাকরির ক্ষেত্রে যে স্কিলগুলো সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে, তা অনেক সময় একাডেমিক পড়ালেখার চেয়ে কিছুটা আলাদা। একাডেমিক প্রোজেক্টগুলোও কখনই হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। এগুলো যতটা সম্ভব ভালোভাবে করতে হবে। কারণ ভবিষ্যতে সেগুলোই সিভিতে স্থান করবে এবং দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।
আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকার জন্যেও শুভকামনা রইলো।

উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দ
১১ মে ২০২৩
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
২০ ঘণ্টা আগে
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
১৩ দিন আগে
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি।
০৭ অক্টোবর ২০২৫
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি। তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এই সাক্ষাৎকার দেন। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব আজ।
আজকের পত্রিকা ডেস্ক

বিবিসি বাংলা: এখন বাংলাদেশের সরকার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
তারেক রহমান: বিষয়টি তো রাজনৈতিক। এটি তো কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়। আমরা প্রথম থেকে যে কথাটি বলছি, আমরা চাই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সফল হোক। অর্থাৎ, অনেক কিছুর মতো বিভিন্ন বিষয় আছে। যেমন—আমরা যদি মূল দুটো বিষয় বলি যে, কিছু সংস্কারের বিষয় আছে, একই সাথে প্রত্যাশিত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, স্বাধীন নির্বাচনের একটি বিষয় আছে।
মূলত কিছু সংস্কারসহ যে সংস্কারগুলো না করলেই নয়, এরকম সংস্কারসহ একটি স্বাভাবিক সুষ্ঠু, স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাই হচ্ছে বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য। আমরা প্রত্যাশা করি, ওনারা উনাদের ওপরে যেটা মূল দায়িত্ব, সেটি ওনারা সঠিকভাবে সম্পাদন করবেন। এটাই তো তাঁদের কাছে আমাদের চাওয়া রাজনৈতিক দল হিসেবে।
আমরা আশা রাখি, প্রত্যাশা করি যে, ওনারা কাজটি সুন্দরভাবে করবেন। স্বাভাবিকভাবে এই কাজের সৌন্দর্য বা কতটুকু ভালো, কতটুকু ভালো বা মন্দভাবে করতে পারছেন, তার ওপরেই মনে হয় সম্পর্কের উষ্ণতা বা শীতলতা যেটাই বলেন, সেটা নির্ভর করবে।
বিবিসি বাংলা: আপনি কয়েক মাস আগে একটি মন্তব্য করেছিলেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আপনার এই মন্তব্য নিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, এ বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী? তিনি তখন বলেছিলেন, সন্দেহটা ওনার মনে। অর্থাৎ, আপনার মনে সন্দেহ আছে কি না, সেটা তিনি জানতে চান। আপনার মনে কি সেই সন্দেহ আছে?
তারেক রহমান: দেখুন, আমি যখন কথাটি বলেছিলাম, এই মুহূর্তে আমার যতটুকু মনে পড়ে, সেই সময় পর্যন্ত ওনারা কিন্তু নির্বাচনের ব্যাপারে সঠিক কোনো টাইম ফ্রেম বা কোনো কিছু বলেননি।
রোডম্যাপ বলতে যা বোঝায়, আমরা নরমালি যা বুঝে থাকি, এরকম কিছু বলেননি। এবং সে কারণেই শুধু আমার মনের মধ্যেই নয়, আমরা যদি সেই সময় বিভিন্ন মিডিয়া দেখি, বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব দেখি, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা করেন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে, প্রায় সবার মনের মধ্যেই সন্দেহ ছিল।
আমরা যখন দেখলাম যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ডক্টর ইউনূস, উনি মোটামুটিভাবে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করলেন। এবং পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার উনি ওনার যে সিদ্ধান্ত, সেটির ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তারপর থেকেই খুব স্বাভাবিকভাবেই এই সন্দেহ বহু মানুষের মন থেকে ধীরে ধীরে চলে যেতে ধরেছে।
আমি মনে করি, ওনারা যা বলেছেন, ওনারা যতক্ষণ পর্যন্ত দৃঢ় থাকবেন, ওনাদের বক্তব্যে, ওনাদের কাজে যত বেশি দৃঢ় থাকবেন, ততই সন্দেহ চলে যাবে আস্তে আস্তে।
বিবিসি বাংলা: সেই সন্দেহ মনে কিছুটা দূরীভূত হয়েছিল লন্ডনে যখন তিনি আপনার সঙ্গে বৈঠক করলেন। তার পরেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা এসেছিল। তো সেই বৈঠকে নির্বাচনের কথা তো হয়েছিল, যেহেতু সেটি পরে এসেছে। এর বাইরে কি আপনাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়েছে? আর কোনো বিষয়ে কোনো চিন্তাভাবনা বা সমঝোতা কিছু হয়েছে?
তারেক রহমান: এর বাইরে স্বাভাবিকভাবেই উনি একজন অত্যন্ত স্বনামধন্য মানুষ। অত্যন্ত বিজ্ঞ মানুষ উনি। এর বাইরে তো অবশ্যই স্বাভাবিকভাবে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হয়েছে। এর বাইরেও উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন যে, জনগণ যদি আপনাদের সুযোগ দেয়, তাহলে আপনারা কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য—এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
আমার কিছু চিন্তাভাবনা দেশের মানুষকে নিয়ে, দেশের জনগণকে নিয়ে, দেশকে নিয়ে আমরা যদি সুযোগ পাই, জনগণ আমাদের যদি সেই সুযোগ দেন, তাহলে আমরা কী কী বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করব, সে বিষয়গুলো নিয়ে কিছু কিছু আলোচনা হয়েছে।
বিবিসি বাংলা: নির্বাচনের বিষয়টি তো আপনি বললেন, এর বাইরে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে গত এক বছরে যে ভূমিকা রেখেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সেটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
তারেক রহমান: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানে ইন্টেরিম, মানে এটা তো ক্ষণস্থায়ী বিষয়। তো খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি দেশ পরিচালনা তো একটি বিশাল বিষয়। আমরা হয়তো ভূখণ্ডের ভিত্তিতে যদি বিবেচনা করি, হয়তো বাংলাদেশকে অনেকে বলবে ছোট দেশ। কিন্তু আমরা যদি জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিবেচনা করি, বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক ভূখণ্ডের চেয়ে বড় দেশ।
ইউকের (যুক্তরাজ্য) জনসংখ্যা ৭ কোটির মতো, বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্লাস-মাইনাস ২০ কোটির মতো এখন। কাজেই ইউকের তিন গুণ বড়। এরকম একটি দেশ পরিচালনা করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই জনগণের ম্যান্ডেটসহ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকার প্রয়োজন। বিভিন্ন বিষয় থাকে, ইস্যুজ থাকে, বিভিন্ন বিষয় আছে।
তো এখন নির্বাচনের বাইরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পারফরমেন্স আপনি যেটা বললেন, আমরা সবকিছু বিবেচনা করলে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, হয়তো ওনারা চেষ্টা করেছেন অনেক বিষয়ে। সব ক্ষেত্রে সবাই তো আর সফল হতে পারে না, স্বাভাবিকভাবে ওনাদের লিমিটেশনস কিছু আছে। সেই লিমিটেশনসের মধ্যে ওনারা হয়তো চেষ্টা করেছেন, যতটুকু পেরেছেন হয়তো চেষ্টা করছেন।
এক এগারোর সরকার নিয়ে মূল্যায়ন কী?
বিবিসি বাংলা: আমি একটু পিছনে তাকাতে চাই।
তারেক রহমান: ভাই, আমরা তো সামনে যেতে চাই। আপনি পেছনে কেন যাচ্ছেন? দেশকে সামনে নিতে হবে।
বিবিসি বাংলা: মানে, পেছন থেকেই তো শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে হয়। তো পেছনের একটা বিষয়, সেটা হচ্ছে, এক-এগারোর সরকার বা সেনাসমর্থিত সরকারের সেই সময়টা নিয়ে রাজনীতিতে অনেক আলোচনা আছে। সে সময়টাকে ঘিরে আপনার মূল্যায়ন কী?
তারেক রহমান: এক বাক্যে বা সংক্ষেপে যদি বলতে হয়, এক-এগারোর সরকার তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি সরকার ছিল।
আমরা দেখেছি, সেই সরকার আসলে কীভাবে দেশের যতটুকু যেমনই হোক বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যতটুকুই রাজনীতি গড়ে উঠেছিল, গণতান্ত্রিক ভিত্তি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল ভুল-ত্রুটি সবকিছুর ভিতর দিয়েই। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, কীভাবে তারা সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, বিরাজনীতিকরণ করতে চেয়েছিল। দেশকে একটি অন্ধকার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দেখেছি যে, খুব সম্ভবত তাদেরই ভিন্ন আরেকটি রূপ; অন্যভাবে দেখেছি আমরা ’ইন দ্য নেম অব ডেমোক্রেসি’।
বিএনপির রাজনীতিতে পরিবর্তন হয়েছে কতটা
বিবিসি বাংলা: ২০০৪ সালে আমি আপনার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ঢাকায়। সে সময় আপনি বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করবেন। তো বিএনপির রাজনীতিতে আসলে কতটা পরিবর্তন হয়েছে; ভবিষ্যৎ বিএনপিই বা কেমন হবে?
তারেক রহমান: আমাদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণ, দেশ এবং দেশের সার্বভৌমত্ব। আমরা দুটো বিষয় নিয়ে বাংলাদেশে খুবই গর্ব করি, অহংকার করি। একটি হচ্ছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প, আরেকটি হচ্ছে প্রবাসীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান—এ দুটোই কিন্তু বিএনপি শুরু করেছিল।
আমরা দেখেছি, বিএনপির সময়ে শুরু হয়েছিল প্রবাসীদের বিদেশ যাওয়া, একই সাথে গার্মেন্ট শিল্পের প্রসার। এর বাইরেও যদি আমরা দেখি, ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষটা হয়েছিল, পরবর্তীতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন, আমরা দেখেছি কীভাবে ধীরে ধীরে দুর্ভিক্ষপীড়িত একটি দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসপূর্ণ করে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ না, অল্প পরিমাণ করে হলেও আমরা কিন্তু সেই সময় বিদেশে খাদ্য রপ্তানি, চাল রপ্তানি করেছিলাম।
আর রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা দেখি, যেখানে একসময় সকল দলকে নিষিদ্ধ করে একটি দল বাকশাল করা হয়েছিল। আমরা দেখেছি যে, বিএনপির কাঁধে যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে, তখন কীভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চালু আবার করা হয়েছিল।
কাজেই আপনি বললেন, অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ইয়েস, আমরা অতীতে এই ভালো কাজগুলো করেছি। ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ এ বিষয়গুলো কনসিডারেশন (বিবেচনায়) রেখেই সামনে এগিয়ে যাব। আমাদের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে ভবিষ্যৎ বিএনপির গণতন্ত্রের যে বুনিয়াদ, একটি শক্তিশালী বুনিয়াদ তৈরি করা। জবাবদিহি তৈরি করা।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অভিযোগ সব সময় থাকে। যখন যারা চেয়ারে বসে, জবাবদিহিতার প্রশ্নটা তখন থাকে না। মানে, এড়িয়ে যায়—এ ধরনের একটা অভিযোগ সব সময় ছিল। সব রাজনৈতিক দল বা যারাই সরকারে এসেছে।
তারেক রহমান: দেখুন, অভিযোগ থাকতেই পারে। আমি আগেই তো বলেছি, একটি বিষয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম অভিযোগ থাকতে পারে। এখন অভিযোগ নিয়ে তো আর বলা যাবে না। কিন্তু অভিযোগটা কনসিডারেশনে (বিবেচনায়) অবশ্যই রাখব। আপনি যেহেতু আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, আমি আপনাকে এটাই বলেছি। আপনি জানতে চেয়েছেন ভবিষ্যৎ কেমন হবে।
আমি আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে যা দেখেছি, বুঝেছি, জেনেছি, আমি আপনার সামনে সেটিই তুলে ধরলাম। অভিযোগ এ দেশেও আছে, কিন্তু আপনি যা জানতে চাইছেন, এটি তো আমি একমাত্র সুযোগ যদি পাই, আমি ইনশআল্লাহ সুযোগ পেলে পরে তখন আস্তে আস্তে জিনিসটি প্রমাণ করা সম্ভব হবে।
হ্যাঁ, এটাও বাস্তবতা। প্রাগমেটিক কথা যেটা, বাস্তব কথা যেটা, আমি সুযোগ পেলে যে সাথে সাথেই বিষয়টি হবে তা না। কারণ, আমি সুযোগ পেলে আপনাকেও বুঝতে হবে। আপনিও কিন্তু দেশ গঠনের একটা পার্ট। কাজেই আপনার মতো এরকম লক্ষকোটি মানুষকে বিষয়টি বুঝতে হবে। এতটুকু বলতে পারি যে, ইয়েস, উই আর কমিটেড। উই উইল ট্রাই আওয়ার বেস্ট টু ডু পারফরম বেস্ট ডু দ্যাট।
বিবিসি বাংলা: জবাবদিহির কথা বলছিলেন। এ প্রসঙ্গে বলি, গত ১৫ বছর আপনি নির্বাসনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ায়, এটা একটা ভিন্ন পরিস্থিতি। নেতৃত্ব নিয়ে আপনার চিন্তাধারায় কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে? আপনি কী অনুভব করেন, অনুধাবন করেন?
তারেক রহমান: গত ১৭ বছর প্রবাসজীবনে আছি এবং অনেকগুলো বছর আমি বাংলাদেশের সাথে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা টাইম ডিফারেন্স, ডিস্টেন্স ডিফারেন্স তো আছেই। রিচিং ডিফারেন্স তো একটা ডিফিকাল্টিস তো আছেই। এটি একটি বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আমি আমার পরিবার অর্থাৎ, আমার স্ত্রী এবং আমার সন্তানকে এখানে ধন্যবাদ দিতে চাই। কারণ তাদের সহযোগিতা না থাকলে হয়তো এই ডিফিকাল্ট কাজটি করা আমার জন্য আরও ডিফিকাল্ট হতো। ওনাদের সহযোগিতা ছিল, সে জন্য আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
একই সাথে আমি আবারও ধন্যবাদ দিতে চাই আমার হাজারো-লক্ষ নেতাকর্মীকে। যাঁরা এই ডিফিকাল্টিজের মধ্যে থেকেও আমাকে সহযোগিতা করেছেন দলকে সুসংগঠিত রাখতে, দলকে রাজপথে নিয়ে যেতে শত অত্যাচার, বাধাবিঘ্নের মাঝেও জনগণের কথা তুলে ধরতে, জনগণের দাবির ব্যাপারে সোচ্চার থাকতে। আপনি জিজ্ঞেস করেছেন মনে হয় যে, এখানে (যুক্তরাজ্যে) থেকে কী কী দেখেছি, শিখেছি বা জেনেছি। আমি মনে করি, এই দেশ থেকে ভালো যা কিছু দেখেছি বা শিখেছি। দেশের নাগরিক হিসেবে এবং যেহেতু আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী, হয়তো আমার একটি সুযোগ আছে দেশের জন্য ভালো কিছু করার।
যদি আমি ইনশাআল্লাহ সেই সুযোগ পাই, তাহলে যতটুকু সম্ভব দেশের মানুষের জন্য বা দেশের জন্য কিছু করার, এভাবে বিষয়টিকে আমি বিবেচনা করি।
কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির মূলনীতি কী হবে?
বিবিসি বাংলা: কূটনীতির প্রসঙ্গে আসি। বিএনপি যদি সরকার গঠন করে, তাহলে কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির মূলনীতি কী হবে?
তারেক রহমান: গুড কোশ্চেন। বিএনপির মূলনীতি একটাই—সবার আগে বাংলাদেশ। কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির নীতি সবার আগে বাংলাদেশ। আমার জনগণ, আমার দেশ, আমার সার্বভৌমত্ব। এটিকে অক্ষুণ্ন রেখে, এর স্বার্থ বিবেচনা করে, এই স্বার্থকে অটুট রেখে বাকি সবকিছু।
বিবিসি বাংলা: এটাকে বৈশ্বিক রাজনীতির একটা প্রভাব বলা যায়? কারণ আপনি যদি বিভিন্ন দেশে দেখেন, এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পও আমেরিকা ফার্স্ট একটা স্লোগান দিয়ে এসেছিলেন।
তারেক রহমান: না, ওদেরটা ওরা বলেছে, আমি ভাই বাংলাদেশি। আমার কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ বড়, আমার কাছে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ বড়। কাজেই কে কী বলল...সবার আগে বাংলাদেশ, সিম্পল, কমপ্লিকেট (জটিল) করার কিছু নাই, এটা সিম্পল ব্যাপার।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে অবস্থান কী?
বিবিসি বাংলা: বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে যে সম্পর্ক ছিল, সেটা নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। তো ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে আপনাদের নীতি কী হবে?
তারেক রহমান: আমার মনে হয়, আপনি একটু আগে যে প্রশ্নগুলো করেছেন, সেখানে বোধহয় আমি ক্লিয়ার করেছি পুরো ব্যাপারটা। সবার আগে বাংলাদেশ। এখানে তো আপনি পার্টিকুলার (সুনির্দিষ্ট) একটি দেশের কথা বলেছেন।
এখানে ওই দেশ বা অন্য দেশ তো বিষয় না। বিষয় তো হচ্ছে, ভাই, বাংলাদেশ আমার কাছে আমার স্বার্থ, আমি আগে আমার দেশের মানুষের স্বার্থ দেখব, আমার দেশের স্বার্থ দেখব। ওটাকে আমি রেখে আপহোল্ড করে আমি যা যা করতে পারব, আমি তা-ই করব।
বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশের স্বার্থ আপনারা সবার আগে নেবেন, সেটা আপনি পরিষ্কার করেছেন। ভারতের কথা বিশেষভাবে আসছে, যেহেতু সেটি বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ এবং বাংলাদেশের তিন পাশেই এই দেশের সীমান্ত রয়েছে। এবং এটি নিয়ে আপনিও জানেন যে, বিভিন্ন সময়ে কথা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও কথা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সময় তো সম্পর্ক নিয়ে বললামই, সেটা নিয়ে কথা হয়েছে। তাদের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বা কেমন থাকা প্রয়োজন—এ নিয়ে আপনার চিন্তা কী?
তারেক রহমান: অবশ্যই আমি আমার পানির হিস্যা চাই। অবশ্যই আমি দেখতে চাই না যে, আরেক ফেলানী ঝুলে আছে। অবশ্যই আমরা এটা মেনে নিব না।
বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশের স্বার্থের প্রসঙ্গে আপনি বলছেন যে, পানির হিস্যা চাওয়া এবং সীমান্ত হত্যার বিষয়টি নিয়ে আপনারা সোচ্চার থাকবেন।
তারেক রহমান: না না, আমি উদাহরণ দিয়ে বললাম। দুটো উদাহরণ দিয়ে বোঝালাম আপনাকে যে আমাদের স্ট্যান্ডটা কী হবে। আমরা আমাদের পানির হিস্যা চাই। অর্থাৎ আমার দেশের হিস্যা, মানুষের হিস্যা আমি চাই, হিসাব আমি চাই।
আমার যেটা ন্যায্য, সেটা আমি চাই। অবশ্যই ফেলানী হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আমি বোঝাতে চেয়েছি যে, আমার মানুষের ওপরে আঘাত আসলে অবশ্যই সেই আঘাতকে এভাবে আমি মেনে নেব না।
বিবিসি বাংলা: একটা বিষয় যদি বলি, ৫ অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবং আপনিও জানেন যে, শেখ হাসিনা দিল্লিতে গেছেন এবং সেখানে আছেন। ভারতের সাথে একটা সম্পর্কের শীতলতা দেখা গেছে গত এক বছর ধরে। যেমন ধরুন, সেটি যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে, ব্যবসার ক্ষেত্রে নানা রকম, সেই ক্ষেত্রে কি কোনো পরিবর্তন আপনারা সরকারে এলে হবে বা পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন—এমন কোনো চিন্তা কি আপনাদের আছে?
তারেক রহমান: এখন তারা যদি স্বৈরাচারকে সেখানে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়, সেখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। এটা বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাদের সাথে শীতল থাকবে। সো, আমাকে আমার দেশের মানুষের সাথে থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর সংসদ ও দলীয় নেতৃত্বের প্রশ্নে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: সংস্কারের প্রশ্নে আসি। এখন খুব আলোচিত ইস্যু। সংস্কারের কিছু বিষয়ে দেখা যাচ্ছে যে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের কিছুটা মতপার্থক্য বা মতবিরোধ হচ্ছে। যেমন—এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা বা দলের প্রধান থাকতে পারবেন না, এরকম একটা প্রস্তাব এসেছে, যেখানে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। যদি এক ব্যক্তি তিন পদে একই সাথে থাকেন, সেটা স্বৈরতান্ত্রিক একটা ব্যবস্থা তৈরির সুযোগ দেয় কি না?
তারেক রহমান: সকলের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এই যে বাংলাদেশে রাষ্ট্র মেরামতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, থাকবেন না—এরকম আরও যে বিষয়গুলো আছে, এগুলো বাংলাদেশে যখন স্বৈরাচার ছিল তাদের মুখের ওপরে, তাদের চোখের দিকে চোখ রেখে আমরা বিএনপিই বলেছিলাম।
এখন হয়তো অনেকে সংস্কারের কথা বলছেন। সেদিন কিন্তু সংস্কারের ’স’-ও তারা বলেননি। তার পরেও সকলের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে আমি বলতে চাই যে, বিএনপি ’নোট অব ডিসেন্ট’ দিলে সেটি সমস্যা, অর্থাৎ বিএনপিকে অ্যাগ্রি (সম্মত) করতে হবে সবার সাথে, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু বিএনপি যদি কোনোটার সাথে একমত না হয়, তাহলে বেঠিক। এটি তো গণতন্ত্র হলো না।
মানে, আমাকে অন্যের সাথে একমত হতে হবে, তাহলে গণতন্ত্র। আমি যদি অন্যের সাথে দ্বিমত করি, তাহলে গণতন্ত্র না। এটি কেমন গণতন্ত্র? কারণ গণতন্ত্রের মানেই তো হচ্ছে, বিভিন্ন মতামত থাকবে। আমরা অনেক ব্যাপারেই একমত হব হয়তো। সকল ব্যাপারে একমত হবো না, কিছু ব্যাপারে হয়তো দ্বিমত থাকতেই পারে। এটাই তো গণতন্ত্র, এটাই তো এসেন্স অব গণতন্ত্র।
আমরা তো কোনো হাইড অ্যান্ড সিক করছি না। আমি যেটা মনে করছি যে ভাই, আমি মনে করছি যেটা আমার দৃষ্টিতে ঠিক না, আমি বলছি ঠিক না।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু দুই বছর আগে ২০২৩ সালে আপনারা ৩১ দফা দিয়েছেন। সেই ৩১ দফাতেই আপনারা সংস্কারের যেসব বিষয় এনেছেন, সেখানে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলেছেন। তাহলে এ বিষয়গুলোতে আপত্তি কেন?
তারেক রহমান: না, আমরা যেটাতে বলেছিলাম, আমরা সেখানে এখনো আছি। যতটুকু ভারসাম্য হওয়া উচিত, যে যে বিষয়ে যতটুকু বিবেচনা করা উচিত, আমরা সে বিষয়ের মধ্যে এখনো কমবেশি আছি। আমাদের অবস্থান থেকে তো আমরা অবস্থান পরিবর্তন করিনি।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু মূল যে বিষয়গুলো, যেমন যেটা বড় বিরোধ হিসেবে আসছে, বড় মতপার্থক্য হিসেবে আসছে যে, এক ব্যক্তির তিন পদে একসাথে থাকা, সেখানেই তো আপত্তিটা থাকছে বিএনপির।
তারেক রহমান: না, আমরা তো তখনো বলিনি যে এক ব্যক্তি তিন পদে থাকতে পারবে না। এটা অন্যরা কেউ বলেছে যে, এক ব্যক্তি তিন পদে থাকতে পারবে না। আমরা মনে করি না যে, এটাতে স্বৈরাচারী হওয়ার কোনো কারণ আছে।
আমরা তো দেখেছি, স্বৈরাচারের সময়ও এবং তার আগে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তাদের টু থার্ড মেজরিটি ছিল। টু থার্ড মেজরিটি ২০০৮ সালে তারা নিয়েছিল। তারা ওটাকে চেঞ্জ করে ফেলেছে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাখেনি।
২০০১ সালে তো বিএনপিরও টু থার্ড মেজরিটি ছিল, বিএনপি তো চেঞ্জ করেনি। যেহেতু জনগণ মনে করে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে; বিএনপি টু থার্ড মেজরিটি থাকার পরেও তো চেঞ্জ করেনি।
কাজেই এক ব্যক্তির হাতে থাকলেই যে স্বৈরাচর হবে তা নয়। এটি নির্ভর করে ব্যক্তি টু ব্যক্তি, শুধু আইন চেঞ্জ করলেই সবকিছু সঠিক হয়ে যাবে না।
৩১ দফা, নাকি জুলাই সনদ, অগ্রাধিকার কী হবে
বিবিসি বাংলা: এই সংস্কারের বিষয়গুলোতে যেখানে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নিয়ে একটা জুলাই সনদ প্রণয়নের কথা। সেটাও বাস্তবায়নের উপায়গুলো নিয়ে বা বাস্তবায়নের পথ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে একটা বিতর্ক আছে। অনেক দল বলছে যে, নির্বাচনের আগেই আইনি ভিত্তি দেওয়া বা বাস্তবায়ন করা। আর বিএনপি বলছে, নির্বাচিত সংসদ সেটা করবে। এই জায়গাটা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী, বিএনপির চিন্তাটা এখন কী?
তারেক রহমান: দেখুন, এখানে আবার আমাকে বলতে হচ্ছে, আমরা কিন্তু কোনো হাইড এন্ড সিক করছি না। যদি আমাদের সেরকম অসৎ উদ্দেশ্য থাকত মনের ভিতরে, বলতাম আরেকটা যে ঠিক আছে, ওকে, অসুবিধা নাই। তার পরে ইনশআল্লাহ আমরা সরকার গঠনে সক্ষম হলে আমরা হয়তো করতাম না। তো আমরা যেটা মনে করছি, সেটাই বলছি।
এখন বিষয় হচ্ছে দেখুন, এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ইম্পর্টেন্ট একটি বিষয়। দেখুন, আমরা যদি ইভেন রিসেন্ট যে ঘটনা, নেপালেও যদি দেখি, আপনি দেখেন, ওরা কিন্তু এত কিছুর মধ্যে যাচ্ছে না। ওরা বলছে যে, গুরুত্বপূর্ণ যা বিষয় আছে, সংস্কার বলেন বা বিভিন্ন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যা বিষয় আছে—নির্বাচিত প্রতিনিধি যাঁরা আসবেন, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি যাঁরা আসবেন, তাঁরা সেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তার পরেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবকিছু বিবেচনা করে রাজনৈতিক দলগুলো বসেছে, অন্তর্বর্তী সরকার আহ্বান করেছে। এখানে যতটুকু হয়েছে, আমরা বলেছি, এখন যতটুকু হয়েছে, যেগুলো শুধু আইন দিয়ে করলে হয়ে যায়, সেগুলো হয়ে যাক। যেগুলোর সাংবিধানিক এনডোর্সমেন্ট লাগবে, সেগুলো আমরা মনে করি যে, নির্বাচিত সংসদ হওয়ার পরে সেখানে গ্রহণ করাটাই ভালো হবে।
কারণ, আপনি যদি নির্বাচিত সংসদের কথা বলেন, অথচ তাকে বাদ দিয়ে যদি আপনি আউট অব দ্য বক্স কিছু করেন এবং এটা যদি রেওয়াজ হয়ে যায়, তাহলে এটা আমরা মনে করি যে, এটা সাংবিধানিকভাবে হোক, আইনগতভাবে হোক বা যে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করেন না কেন, ভবিষ্যতের জন্য এটা একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
সে জন্য আমরা মনে করি, যেটা দেশের জন্য সামগ্রিকভাবে ক্ষতির একটি কারণ হবে। সে জন্যই আমরা এটার সাথে একমত না।
বিবিসি বাংলা: এখন বিএনপির যেহেতু ৩১ দফা আছে, যদিও যেসব বিষয় আলোচনায় এসেছে, অনেক বিষয়ে মিল আছে। তো বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে বা সরকার গঠন করে, তখন ৩১ দফা নাকি জুলাই সনদ—কোনটা অগ্রাধিকার পাবে?
তারেক রহমান: আমরা যেগুলোতে একমত হয়েছি, প্রথমে আমরা সেগুলোর ওপরেই জোর দিব। সেটা আপনি যে নামেই বলেন না কেন, স্বাভাবিকভাবে আমরা ঐকমত্য কমিশনে যেগুলোতে সকলে মিলে একমত হয়েছি, আমরা প্রথমে সেগুলোতে ইনশাআল্লাহ সরকার গঠনের সুযোগ পেলে প্রথমে সেগুলোতেই অবশ্যই জোর দিব।
আর, তারপরে আপনি যেটা ৩১ দফার কথা বললেন, অবশ্যই ৩১ দফা আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট জনগণের প্রতি। আমরা তো আমাদের ৩১ দফার মধ্যে যেগুলোর এটার সাথে মিলে গিয়েছে, সেগুলো তো আমরা করবই। এর বাইরে যেগুলো থাকবে ৩১ দফায় আছে, সেগুলোও বাস্তবায়ন করব।
কারণ ওটা তো আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট। এটাও যেমন পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট, ওটাও আমাদের পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট। এটা আমরা রাজনৈতিক দলগুলো মিলে একত্রিত হয়ে বলেছি। ওটাও আমরা অনেকগুলো রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েই কিন্তু ৩১ দফা দিয়েছি।
‘বিড়ালটি আমার মেয়ের’
বিবিসি বাংলা: রাজনীতি থেকে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। আপনাকে সম্প্রতি প্রাণী অধিকার রক্ষা নিয়ে বেশ সোচ্চার দেখা গেছে। এ-সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে আপনি যোগ দিয়েছেন। রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের বাইরে আপনার পোষা বিড়ালের সঙ্গে আপনার নিয়মিত ছবি দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তো এটা আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কীভাবে?
তারেক রহমান: প্রথমত এখানে একটু ক্লিয়ার করে নেই, বিড়ালটি আমার মেয়ের। ও এখন অবশ্য সবারই হয়ে গিয়েছে। আমরা সবাই ওকে আদর করি।
বিষয়টি হচ্ছে, এরকম শুধু বিড়াল নয়, আমি এবং আমার ভাই যখন ছোট ছিলাম, আমাদের একটি ছোট কুকুরও ছিল। ইভেন, তখন আমাদের বাসায় আম্মা হাঁস-মুরগি পালতেন, ছাগলও ছিল আমাদের বাসায়। উনি ছাগলও কয়েকটি পালতেন।
তো স্বাভাবিকভাবেই আপনি যেই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলেন, পোষা কুকুর-বিড়ালই বলেন, বাই দ্য ওয়ে কবুতরও ছিল আমাদের বাসায়। শুধু কবুতর না, আমাদের বাসায় একটি বিরাট বড় খাঁচা ছিল। সেই খাঁচার মধ্যে কিন্তু পাখি ছিল, বিভিন্ন রকমের এবং আবার আরেকটি খাঁচা ছিল, যেটার মধ্যে একটা ময়না ছিল।
ময়নাটা আমরা বরিশাল থেকে এনেছিলাম। ও আবার বরিশালি ভাষায় কথাও বলত। টুকটুক করে মাঝে মাঝে কিছু কিছু কথাও বলত। কাজেই বিষয়টি হঠাৎ করেই না। এই পশুপাখির প্রতি যে বিষয়টি, এটির সাথে আমি কমবেশি ছোটবেলা থেকে জড়িত আছি। হয়তো এটি এখন প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্নভাবে। বাট, এটির সাথে আমি বা আমার পরিবার, আমরা অনেক আগে থেকেই আছি।
কুকুর-বিড়াল ছিল, গরু-ছাগল ছিল, হাঁস-মুরগি ছিল, পাখি ছিল, ময়না ছিল, কবুতর ছিল। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা চিন্তা করি, আমাদের আল্লাহ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তৈরি করেছেন। আমাদের দায়িত্ব কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টি যা কিছু আছে প্রকৃতির, তার প্রতি কিন্তু যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এটি একটি বিষয়।
আর আমরা যদি মানবিক দৃষ্টিকোণ অথবা আমরা যদি নেচার থেকেও বিষয়টি দেখি, দেখুন, ওরা না থাকলে কিন্তু আমাদের জন্য বেঁচে থাকা কষ্টকর। প্রকৃতি যদি না থাকে, প্রকৃতির ব্যালেন্স যদি না থাকে।
এই আলোচনা শুরু হওয়ার আগে কিন্তু আপনি আমরা তিনজন কিন্তু ওয়েদার নিয়ে কথা বলছিলাম, এই ইংল্যান্ডের বা ইউকের ওয়েদার নিয়ে আমরা আলাপ করছিলাম এবং আমি বলছিলাম যে, আমার এই ১৭ বছর অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ওয়েদার মনে হয় একটু একটু এখানেও চেঞ্জ হয়েছে। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে পত্রপত্রিকায় দেখেছি পলিউশন ঢাকা শহরে। নরমালি আমরা জানি যে, একটি দেশের টোটাল অংশের মধ্যে এটলিস্ট ২৫ শতাংশ গ্রীন দরকার, বনায়ন দরকার। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আমি যতটুকু জেনেছি, এটি ১২ পার্সেন্টের মতো। হুইচ ইস ভেরি ডেঞ্জারাস।
তো এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি—কীভাবে আমরা বাড়াব। তো যেমন এগুলো আছে, ঠিক একই সাথে এই যে আপনি পশুপাখির কথা বললেন, এ বিষয়গুলো আছে নেচার। নেচারকে যদি আমরা মিনিমাম ঠিক রাখতে না পারি, সেখানে মানুষ হিসেবে কিন্তু আমাদের বসবাস করা খুব কঠিন হয়ে যাবে। কাজেই আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এ বিষয়গুলো বোধহয় করা প্রয়োজন।
সামাজিক মাধ্যমে মিম, কার্টুন কীভাবে দেখেন
বিবিসি বাংলা: রাজনীতিতে যেমন আপনাকে নিয়ে অনেক আলোচনা আছে, স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক মাধ্যমেও আপনাকে নিয়ে অনেক আলোচনা আছে এবং আপনি যে পোস্টগুলো করেন, সেটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। আপনাকে নিয়ে অনেক মিমও তৈরি হয়, অনেক কার্টুন হয়। যেমন—একটা মিমের কথা যদি আমি বলি, অনেকে শেয়ার করেছিল যে, আপনি আপনার সাথে আমরা জুমে কথা বলছি, আপনি জুমে বক্তব্য দেন। এটা নিয়ে একটা মিম তৈরি হয়েছে যে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, তো এ ধরনের মিমগুলো আপনি কীভাবে দেখেন?
তারেক রহমান: আমি এনজয় করি বেশ, বেশ আমি এনজয় করি।
বিবিসি বাংলা: আপনি দেখেন এগুলো? আপনার চোখে পড়ে?
তারেক রহমান: হ্যাঁ, চোখে পড়বে না কেন, অবশ্যই চোখে পড়ে। তবে এখানে একটি কথা আছে, যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়টি এল, আমার মনে হয় এ বিষয়ে একটু এড করা উচিত।
দেখুন, সোশ্যাল মিডিয়া এমন একটি বিষয়, আমি নিজেও আছি সোশ্যাল মিডিয়ায় কমবেশি। বহু বহু মানুষ আছেন, লক্ষকোটি মানুষ আছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এটি দিয়ে যেমন খুব দ্রুত একজনের সাথে আরেকজনের যোগাযোগ করা যায়।
আমরা মাঝে মাঝে বলি যে, দেখেন, অনেক সময় অনেক আলোচনায় আসে, সেমিনার-বক্তব্যে আসে যে, ডিনামাইটটা যখন আবিষ্কৃত হয়, ডিনামাইটটা আবিষ্কৃত হয়েছিল আপনার পাহাড় ভেঙে কীভাবে মানুষের চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট তৈরি করা যায়; হয়তো কীভাবে চাষের জমি করা যায়। এরকম লক্ষ্য সামনে রেখেই, উদ্দেশ্য সামনে রেখেই কমবেশি ডিনামাইটের ব্যবহারটা শুরু হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখেছি, এটি মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই যে, অবশ্যই প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে। যেহেতু আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। মানুষের বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাস করি। প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে তার মতামত প্রকাশ করার।
তবে আমরা যদি সকলে এতটুকু সচেতন হই যে, আমি আমার মত প্রকাশ করলাম, কিন্তু এই মত প্রকাশের ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি না—এ বিষয়টিকে যদি আমরা বিবেচনায় রাখি, একটি মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হলো কি না, ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি না—এসব বিষয় বোধহয় আমাদের বিবেচনায় রাখা উচিত; এটি এক নম্বর।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ার বহুল ব্যবহারের ফলে ডিসইনফরমেশন বা মিসইনফরমেশন বিষয়টিও চলে এসেছে সামনে। এ কথাও চলে এসেছে। একটি জিনিস আমি দেখলাম বা শুনলাম, সাথে সাথেই আমি সেটিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তা না করে আমার মনে হয়, ফ্যাক্ট চেক বলে যেই কথাটি আছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, এটা সব জায়গায় আছে—এ ব্যাপারেও যদি আমরা একটু অ্যালার্ট থাকি সবাই, এ ব্যাপারে যদি একটু সচেতন থাকি যে ঠিক আছে, এটি একটু যাচাইবাছাই করে নিই।
যদি সত্য হয়, অবশ্যই আমার সেখানে মতামত থাকবে। কিন্তু যদি মিথ্যা হয় বিষয়টি, কেন আমি এখানে মতামত দিব? একটি মিথ্যার সাথে আমি কেন নিজেকে সংশ্লিষ্ট করব? একটি খারাপ কিছুর সাথে কেন আমি নিজেকে সংশ্লিষ্ট করব? এটি আমি আমার মতামতটা প্রকাশ করলাম।
মানুষের আস্থার প্রশ্নে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: আমরা প্রায় শেষ দিকে চলে এসেছি। আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই যে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন যেটা হয়েছে গত বছরের ৫ আগস্ট। তারপর থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হবে—এই প্রশ্নে মানুষকে কীভাবে আস্থায় নেবেন?
তারেক রহমান: এই প্রশ্নের উত্তরে যদি একটু এভাবে বলি, স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দল হিসেবে তো আমাদের একটি পরিকল্পনা আছে। আপনাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে আমি কিছু কিছু বলেছি।
ব্যাপারটা হচ্ছে এরকম যে, দেখুন এই মুহূর্তে মাঠে আমরা যেই রাজনৈতিক দলগুলো আছি, আমরা ধরে নিতে পারি, সেই রাজনৈতিক দলগুলো ইনশআল্লাহ আগামীতে দেশ পরিচালনা করতে পারে। তার মধ্যে বিএনপিরই কিন্তু দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে।
আপনাকে যদি বলি, ধরেন এখন লন্ডন আসবেন। তো আপনি একটা প্লেনে উঠলেন। যে প্লেন চালাবে, সে যদি আপনাকে বলে যে ভাই কিছু মনে করেন না, আমার ঠিক লাইসেন্সটা হয়নি এখনো, তবে আমার মনে হয় আমি চেষ্টা করলে আপনাকে নিয়ে যেতে পারব লন্ডন পর্যন্ত উড়িয়ে। আপনি কি তার সাথে উঠবেন প্লেনে? নিশ্চয়ই আপনি উঠবেন না।
আপনি একজন অভিজ্ঞ ড্রাইভারের সাথে উঠতে পারেন। কিন্তু অভিজ্ঞ ড্রাইভারও গাড়ি হয়তো ঠিকই চালাচ্ছে সেফলি, কিন্তু রাস্তায় তো গর্ত খানাখন্দ থাকবেই, একটু জার্কিং হতেই পারে। জোরে অনেক সময় ব্রেক হতেই পারে, ঝাঁকুনি লাগতেই পারে, কিন্তু অভিজ্ঞ ড্রাইভার আপনাকে মোটামুটি ঠিকভাবে নিয়ে যাবে। নিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ সে চেষ্টা করবে। কারণ তার সেই অভিজ্ঞতা আছে।
কাজেই আমরা যদি দেখি যে, ভালো কাজ বা কমিটমেন্ট আপনি যেটা বলেন, বিএনপি করবে কি না। আমরা তো করেছি। হতে পারে আমাদের দ্বারা কিছু ভুল-ত্রুটি হয়েছে।
আপনি একটু আগে একটা কথা বলেছিলেন, মানুষ তো অতীত থেকেই শিখে। ইয়েস, আমরাও দেখেছি, আমরাও অতীত থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি যে ঠিক আছে এই কাজটি এভাবে করলে হয়তো ভুল হয়, এটি আমরা ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ করব না। বাট আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা ভালো-মন্দ যাচাই করতে পারব।
একই সাথে আমাদের কমিটমেন্ট আছে, যে কমিটমেন্ট দিয়ে আমরা ডেলিভারি করতে পারব এবং আমরা ডেলিভারি করতে চাই।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান
বিবিসি বাংলা: শেষ প্রশ্নটি করি তাহলে আপনাকে এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই। বিগত সরকারের আমলে তাদের একটা বিষয় বড় সমালোচনা ছিল যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ। আপনারা যদি ক্ষমতায় আসেন, সে ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদ বা সংবাদমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়নের বিষয়গুলো যে আর হবে না, সেই নিশ্চয়তা কি আপনি দিতে পারেন?
তারেক রহমান: জ্ব, ইয়েস পারি। একদম দিতে পারি। আপনি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পত্রপত্রিকা খুলুন। আমি কারও নাম উল্লেখ করব না, কোনো পত্রিকার কথা উল্লেখ করব না। শুধু খুলে দেখুন কীভাবে অনেক খবর ছাপা হয়েছিল, যার সত্যতা কিন্তু ছিল না, অপপ্রচার ছিল। কিন্তু অপপ্রচারটা সংবাদ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আপনি কি শুনেছেন, আপনি কি আমাকে প্রমাণ দিতে পারবেন, বলতে পারবেন যে বিএনপির সময়, আমি কিন্তু বলতে পারব অনেক অনেক সাংবাদিকের নাম, যাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন স্বৈরাচারের সময় এবং পরবর্তীতে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ইভেন, এখনো অনেকে প্রবাসজীবনে আছেন, এরকম বহু সাংবাদিক।
আমি বলতে পারব, স্বৈরাচারের সময় বহু সাংবাদিককে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন করে বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ধমক দেওয়া হতো। বিএনপির সময় এগুলো করা হয়নি, কারণ তখন সংবাদপত্রে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে তৎকালীন বিএনপি সরকার সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে, যদি ওই রকম হতো, তাহলে কিন্তু ওরকম খবর প্রকাশিত হতো না।
অর্থাৎ, বিএনপির সময় যদি অত্যাচার-নির্যাতন থাকত, তাহলে খবরগুলো প্রকাশিত হতো না স্বাভাবিকভাবে, যা হয়নি বিগত সরকারের সময় স্বৈরাচার সরকারের সময়। কাজেই আপনাকে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, বিএনপির অতীত সরকারের সময় যেরকম সাংবাদিকদের গুম করা হয়নি। সাংবাদিকদের নির্যাতন করা হয়নি। সাংবাদিকদের দেশ ছেড়ে যেতে হয়নি, বাধ্য হতে হয়নি। ইনশআল্লাহ ভবিষ্যতেও হবে না।
বিবিসি বাংলা: তাহলে কি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে—এ ধরনের যে আইনগুলো রয়েছে, সেগুলো আপনারা বাতিল করবেন, এটা কি ধরে নেওয়া যায়?
তারেক রহমান: অবশ্যই, আমরা সকলে মিলে বসব, আলোচনা করব। আপনাদের মতো সাংবাদিকসহ যাঁরা আছেন, তাঁদের সাথে আলোচনা করব। আলোচনা করে সেগুলো এরকম কালো আইন যা যা আছে, আমরা আস্তে আস্তে ঠিক করব।
তবে এখানে বোধহয় একটি বিষয় আবার আমাকে উল্লেখ করতে হয়, যেটি আমি সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে বলেছি। দেখুন, এটি তো সবাইকে মিলে করতে হবে। অপপ্রচারকে তো অবশ্যই সংবাদ হিসেবে তো প্রচার করা ঠিক নয়, তাই না?
আমাদের কাছে আপনাদের যেরকম চাওয়া থাকবে, ভবিষ্যৎ সরকারের কাছে, যারাই আসুক সরকারে, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমাদেরও অনুরোধ থাকবে আপনাদের প্রতি যে অপপ্রচার সংবাদ হিসেবে যেন প্রচারিত না হয়—এ বিষয়টি একটু সকলকে সচেতন বা খেয়াল রাখতে হবে।
বিবিসি বাংলা: তারেক রহমান, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলার জন্য।
তারেক রহমান: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমার কথাগুলো দেশের মানুষের সামনে আমি তুলে ধরতে পেরেছি। সেই সুযোগটুকু আপনারা করে দিয়েছেন, তার জন্য আপনাদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ।
বিবিসি বাংলা: এখন বাংলাদেশের সরকার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
তারেক রহমান: বিষয়টি তো রাজনৈতিক। এটি তো কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়। আমরা প্রথম থেকে যে কথাটি বলছি, আমরা চাই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সফল হোক। অর্থাৎ, অনেক কিছুর মতো বিভিন্ন বিষয় আছে। যেমন—আমরা যদি মূল দুটো বিষয় বলি যে, কিছু সংস্কারের বিষয় আছে, একই সাথে প্রত্যাশিত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, স্বাধীন নির্বাচনের একটি বিষয় আছে।
মূলত কিছু সংস্কারসহ যে সংস্কারগুলো না করলেই নয়, এরকম সংস্কারসহ একটি স্বাভাবিক সুষ্ঠু, স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাই হচ্ছে বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য। আমরা প্রত্যাশা করি, ওনারা উনাদের ওপরে যেটা মূল দায়িত্ব, সেটি ওনারা সঠিকভাবে সম্পাদন করবেন। এটাই তো তাঁদের কাছে আমাদের চাওয়া রাজনৈতিক দল হিসেবে।
আমরা আশা রাখি, প্রত্যাশা করি যে, ওনারা কাজটি সুন্দরভাবে করবেন। স্বাভাবিকভাবে এই কাজের সৌন্দর্য বা কতটুকু ভালো, কতটুকু ভালো বা মন্দভাবে করতে পারছেন, তার ওপরেই মনে হয় সম্পর্কের উষ্ণতা বা শীতলতা যেটাই বলেন, সেটা নির্ভর করবে।
বিবিসি বাংলা: আপনি কয়েক মাস আগে একটি মন্তব্য করেছিলেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আপনার এই মন্তব্য নিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, এ বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী? তিনি তখন বলেছিলেন, সন্দেহটা ওনার মনে। অর্থাৎ, আপনার মনে সন্দেহ আছে কি না, সেটা তিনি জানতে চান। আপনার মনে কি সেই সন্দেহ আছে?
তারেক রহমান: দেখুন, আমি যখন কথাটি বলেছিলাম, এই মুহূর্তে আমার যতটুকু মনে পড়ে, সেই সময় পর্যন্ত ওনারা কিন্তু নির্বাচনের ব্যাপারে সঠিক কোনো টাইম ফ্রেম বা কোনো কিছু বলেননি।
রোডম্যাপ বলতে যা বোঝায়, আমরা নরমালি যা বুঝে থাকি, এরকম কিছু বলেননি। এবং সে কারণেই শুধু আমার মনের মধ্যেই নয়, আমরা যদি সেই সময় বিভিন্ন মিডিয়া দেখি, বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব দেখি, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা করেন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে, প্রায় সবার মনের মধ্যেই সন্দেহ ছিল।
আমরা যখন দেখলাম যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ডক্টর ইউনূস, উনি মোটামুটিভাবে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করলেন। এবং পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার উনি ওনার যে সিদ্ধান্ত, সেটির ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তারপর থেকেই খুব স্বাভাবিকভাবেই এই সন্দেহ বহু মানুষের মন থেকে ধীরে ধীরে চলে যেতে ধরেছে।
আমি মনে করি, ওনারা যা বলেছেন, ওনারা যতক্ষণ পর্যন্ত দৃঢ় থাকবেন, ওনাদের বক্তব্যে, ওনাদের কাজে যত বেশি দৃঢ় থাকবেন, ততই সন্দেহ চলে যাবে আস্তে আস্তে।
বিবিসি বাংলা: সেই সন্দেহ মনে কিছুটা দূরীভূত হয়েছিল লন্ডনে যখন তিনি আপনার সঙ্গে বৈঠক করলেন। তার পরেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা এসেছিল। তো সেই বৈঠকে নির্বাচনের কথা তো হয়েছিল, যেহেতু সেটি পরে এসেছে। এর বাইরে কি আপনাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়েছে? আর কোনো বিষয়ে কোনো চিন্তাভাবনা বা সমঝোতা কিছু হয়েছে?
তারেক রহমান: এর বাইরে স্বাভাবিকভাবেই উনি একজন অত্যন্ত স্বনামধন্য মানুষ। অত্যন্ত বিজ্ঞ মানুষ উনি। এর বাইরে তো অবশ্যই স্বাভাবিকভাবে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হয়েছে। এর বাইরেও উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন যে, জনগণ যদি আপনাদের সুযোগ দেয়, তাহলে আপনারা কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য—এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
আমার কিছু চিন্তাভাবনা দেশের মানুষকে নিয়ে, দেশের জনগণকে নিয়ে, দেশকে নিয়ে আমরা যদি সুযোগ পাই, জনগণ আমাদের যদি সেই সুযোগ দেন, তাহলে আমরা কী কী বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করব, সে বিষয়গুলো নিয়ে কিছু কিছু আলোচনা হয়েছে।
বিবিসি বাংলা: নির্বাচনের বিষয়টি তো আপনি বললেন, এর বাইরে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে গত এক বছরে যে ভূমিকা রেখেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সেটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
তারেক রহমান: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানে ইন্টেরিম, মানে এটা তো ক্ষণস্থায়ী বিষয়। তো খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি দেশ পরিচালনা তো একটি বিশাল বিষয়। আমরা হয়তো ভূখণ্ডের ভিত্তিতে যদি বিবেচনা করি, হয়তো বাংলাদেশকে অনেকে বলবে ছোট দেশ। কিন্তু আমরা যদি জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিবেচনা করি, বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক ভূখণ্ডের চেয়ে বড় দেশ।
ইউকের (যুক্তরাজ্য) জনসংখ্যা ৭ কোটির মতো, বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্লাস-মাইনাস ২০ কোটির মতো এখন। কাজেই ইউকের তিন গুণ বড়। এরকম একটি দেশ পরিচালনা করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই জনগণের ম্যান্ডেটসহ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকার প্রয়োজন। বিভিন্ন বিষয় থাকে, ইস্যুজ থাকে, বিভিন্ন বিষয় আছে।
তো এখন নির্বাচনের বাইরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পারফরমেন্স আপনি যেটা বললেন, আমরা সবকিছু বিবেচনা করলে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, হয়তো ওনারা চেষ্টা করেছেন অনেক বিষয়ে। সব ক্ষেত্রে সবাই তো আর সফল হতে পারে না, স্বাভাবিকভাবে ওনাদের লিমিটেশনস কিছু আছে। সেই লিমিটেশনসের মধ্যে ওনারা হয়তো চেষ্টা করেছেন, যতটুকু পেরেছেন হয়তো চেষ্টা করছেন।
এক এগারোর সরকার নিয়ে মূল্যায়ন কী?
বিবিসি বাংলা: আমি একটু পিছনে তাকাতে চাই।
তারেক রহমান: ভাই, আমরা তো সামনে যেতে চাই। আপনি পেছনে কেন যাচ্ছেন? দেশকে সামনে নিতে হবে।
বিবিসি বাংলা: মানে, পেছন থেকেই তো শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে হয়। তো পেছনের একটা বিষয়, সেটা হচ্ছে, এক-এগারোর সরকার বা সেনাসমর্থিত সরকারের সেই সময়টা নিয়ে রাজনীতিতে অনেক আলোচনা আছে। সে সময়টাকে ঘিরে আপনার মূল্যায়ন কী?
তারেক রহমান: এক বাক্যে বা সংক্ষেপে যদি বলতে হয়, এক-এগারোর সরকার তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি সরকার ছিল।
আমরা দেখেছি, সেই সরকার আসলে কীভাবে দেশের যতটুকু যেমনই হোক বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যতটুকুই রাজনীতি গড়ে উঠেছিল, গণতান্ত্রিক ভিত্তি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল ভুল-ত্রুটি সবকিছুর ভিতর দিয়েই। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, কীভাবে তারা সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, বিরাজনীতিকরণ করতে চেয়েছিল। দেশকে একটি অন্ধকার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দেখেছি যে, খুব সম্ভবত তাদেরই ভিন্ন আরেকটি রূপ; অন্যভাবে দেখেছি আমরা ’ইন দ্য নেম অব ডেমোক্রেসি’।
বিএনপির রাজনীতিতে পরিবর্তন হয়েছে কতটা
বিবিসি বাংলা: ২০০৪ সালে আমি আপনার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ঢাকায়। সে সময় আপনি বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করবেন। তো বিএনপির রাজনীতিতে আসলে কতটা পরিবর্তন হয়েছে; ভবিষ্যৎ বিএনপিই বা কেমন হবে?
তারেক রহমান: আমাদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণ, দেশ এবং দেশের সার্বভৌমত্ব। আমরা দুটো বিষয় নিয়ে বাংলাদেশে খুবই গর্ব করি, অহংকার করি। একটি হচ্ছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প, আরেকটি হচ্ছে প্রবাসীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান—এ দুটোই কিন্তু বিএনপি শুরু করেছিল।
আমরা দেখেছি, বিএনপির সময়ে শুরু হয়েছিল প্রবাসীদের বিদেশ যাওয়া, একই সাথে গার্মেন্ট শিল্পের প্রসার। এর বাইরেও যদি আমরা দেখি, ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষটা হয়েছিল, পরবর্তীতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন, আমরা দেখেছি কীভাবে ধীরে ধীরে দুর্ভিক্ষপীড়িত একটি দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসপূর্ণ করে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ না, অল্প পরিমাণ করে হলেও আমরা কিন্তু সেই সময় বিদেশে খাদ্য রপ্তানি, চাল রপ্তানি করেছিলাম।
আর রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা দেখি, যেখানে একসময় সকল দলকে নিষিদ্ধ করে একটি দল বাকশাল করা হয়েছিল। আমরা দেখেছি যে, বিএনপির কাঁধে যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে, তখন কীভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চালু আবার করা হয়েছিল।
কাজেই আপনি বললেন, অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ইয়েস, আমরা অতীতে এই ভালো কাজগুলো করেছি। ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ এ বিষয়গুলো কনসিডারেশন (বিবেচনায়) রেখেই সামনে এগিয়ে যাব। আমাদের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে ভবিষ্যৎ বিএনপির গণতন্ত্রের যে বুনিয়াদ, একটি শক্তিশালী বুনিয়াদ তৈরি করা। জবাবদিহি তৈরি করা।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অভিযোগ সব সময় থাকে। যখন যারা চেয়ারে বসে, জবাবদিহিতার প্রশ্নটা তখন থাকে না। মানে, এড়িয়ে যায়—এ ধরনের একটা অভিযোগ সব সময় ছিল। সব রাজনৈতিক দল বা যারাই সরকারে এসেছে।
তারেক রহমান: দেখুন, অভিযোগ থাকতেই পারে। আমি আগেই তো বলেছি, একটি বিষয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম অভিযোগ থাকতে পারে। এখন অভিযোগ নিয়ে তো আর বলা যাবে না। কিন্তু অভিযোগটা কনসিডারেশনে (বিবেচনায়) অবশ্যই রাখব। আপনি যেহেতু আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, আমি আপনাকে এটাই বলেছি। আপনি জানতে চেয়েছেন ভবিষ্যৎ কেমন হবে।
আমি আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে যা দেখেছি, বুঝেছি, জেনেছি, আমি আপনার সামনে সেটিই তুলে ধরলাম। অভিযোগ এ দেশেও আছে, কিন্তু আপনি যা জানতে চাইছেন, এটি তো আমি একমাত্র সুযোগ যদি পাই, আমি ইনশআল্লাহ সুযোগ পেলে পরে তখন আস্তে আস্তে জিনিসটি প্রমাণ করা সম্ভব হবে।
হ্যাঁ, এটাও বাস্তবতা। প্রাগমেটিক কথা যেটা, বাস্তব কথা যেটা, আমি সুযোগ পেলে যে সাথে সাথেই বিষয়টি হবে তা না। কারণ, আমি সুযোগ পেলে আপনাকেও বুঝতে হবে। আপনিও কিন্তু দেশ গঠনের একটা পার্ট। কাজেই আপনার মতো এরকম লক্ষকোটি মানুষকে বিষয়টি বুঝতে হবে। এতটুকু বলতে পারি যে, ইয়েস, উই আর কমিটেড। উই উইল ট্রাই আওয়ার বেস্ট টু ডু পারফরম বেস্ট ডু দ্যাট।
বিবিসি বাংলা: জবাবদিহির কথা বলছিলেন। এ প্রসঙ্গে বলি, গত ১৫ বছর আপনি নির্বাসনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ায়, এটা একটা ভিন্ন পরিস্থিতি। নেতৃত্ব নিয়ে আপনার চিন্তাধারায় কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে? আপনি কী অনুভব করেন, অনুধাবন করেন?
তারেক রহমান: গত ১৭ বছর প্রবাসজীবনে আছি এবং অনেকগুলো বছর আমি বাংলাদেশের সাথে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা টাইম ডিফারেন্স, ডিস্টেন্স ডিফারেন্স তো আছেই। রিচিং ডিফারেন্স তো একটা ডিফিকাল্টিস তো আছেই। এটি একটি বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আমি আমার পরিবার অর্থাৎ, আমার স্ত্রী এবং আমার সন্তানকে এখানে ধন্যবাদ দিতে চাই। কারণ তাদের সহযোগিতা না থাকলে হয়তো এই ডিফিকাল্ট কাজটি করা আমার জন্য আরও ডিফিকাল্ট হতো। ওনাদের সহযোগিতা ছিল, সে জন্য আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
একই সাথে আমি আবারও ধন্যবাদ দিতে চাই আমার হাজারো-লক্ষ নেতাকর্মীকে। যাঁরা এই ডিফিকাল্টিজের মধ্যে থেকেও আমাকে সহযোগিতা করেছেন দলকে সুসংগঠিত রাখতে, দলকে রাজপথে নিয়ে যেতে শত অত্যাচার, বাধাবিঘ্নের মাঝেও জনগণের কথা তুলে ধরতে, জনগণের দাবির ব্যাপারে সোচ্চার থাকতে। আপনি জিজ্ঞেস করেছেন মনে হয় যে, এখানে (যুক্তরাজ্যে) থেকে কী কী দেখেছি, শিখেছি বা জেনেছি। আমি মনে করি, এই দেশ থেকে ভালো যা কিছু দেখেছি বা শিখেছি। দেশের নাগরিক হিসেবে এবং যেহেতু আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী, হয়তো আমার একটি সুযোগ আছে দেশের জন্য ভালো কিছু করার।
যদি আমি ইনশাআল্লাহ সেই সুযোগ পাই, তাহলে যতটুকু সম্ভব দেশের মানুষের জন্য বা দেশের জন্য কিছু করার, এভাবে বিষয়টিকে আমি বিবেচনা করি।
কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির মূলনীতি কী হবে?
বিবিসি বাংলা: কূটনীতির প্রসঙ্গে আসি। বিএনপি যদি সরকার গঠন করে, তাহলে কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির মূলনীতি কী হবে?
তারেক রহমান: গুড কোশ্চেন। বিএনপির মূলনীতি একটাই—সবার আগে বাংলাদেশ। কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির নীতি সবার আগে বাংলাদেশ। আমার জনগণ, আমার দেশ, আমার সার্বভৌমত্ব। এটিকে অক্ষুণ্ন রেখে, এর স্বার্থ বিবেচনা করে, এই স্বার্থকে অটুট রেখে বাকি সবকিছু।
বিবিসি বাংলা: এটাকে বৈশ্বিক রাজনীতির একটা প্রভাব বলা যায়? কারণ আপনি যদি বিভিন্ন দেশে দেখেন, এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পও আমেরিকা ফার্স্ট একটা স্লোগান দিয়ে এসেছিলেন।
তারেক রহমান: না, ওদেরটা ওরা বলেছে, আমি ভাই বাংলাদেশি। আমার কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ বড়, আমার কাছে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ বড়। কাজেই কে কী বলল...সবার আগে বাংলাদেশ, সিম্পল, কমপ্লিকেট (জটিল) করার কিছু নাই, এটা সিম্পল ব্যাপার।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে অবস্থান কী?
বিবিসি বাংলা: বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে যে সম্পর্ক ছিল, সেটা নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। তো ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে আপনাদের নীতি কী হবে?
তারেক রহমান: আমার মনে হয়, আপনি একটু আগে যে প্রশ্নগুলো করেছেন, সেখানে বোধহয় আমি ক্লিয়ার করেছি পুরো ব্যাপারটা। সবার আগে বাংলাদেশ। এখানে তো আপনি পার্টিকুলার (সুনির্দিষ্ট) একটি দেশের কথা বলেছেন।
এখানে ওই দেশ বা অন্য দেশ তো বিষয় না। বিষয় তো হচ্ছে, ভাই, বাংলাদেশ আমার কাছে আমার স্বার্থ, আমি আগে আমার দেশের মানুষের স্বার্থ দেখব, আমার দেশের স্বার্থ দেখব। ওটাকে আমি রেখে আপহোল্ড করে আমি যা যা করতে পারব, আমি তা-ই করব।
বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশের স্বার্থ আপনারা সবার আগে নেবেন, সেটা আপনি পরিষ্কার করেছেন। ভারতের কথা বিশেষভাবে আসছে, যেহেতু সেটি বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ এবং বাংলাদেশের তিন পাশেই এই দেশের সীমান্ত রয়েছে। এবং এটি নিয়ে আপনিও জানেন যে, বিভিন্ন সময়ে কথা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও কথা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সময় তো সম্পর্ক নিয়ে বললামই, সেটা নিয়ে কথা হয়েছে। তাদের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বা কেমন থাকা প্রয়োজন—এ নিয়ে আপনার চিন্তা কী?
তারেক রহমান: অবশ্যই আমি আমার পানির হিস্যা চাই। অবশ্যই আমি দেখতে চাই না যে, আরেক ফেলানী ঝুলে আছে। অবশ্যই আমরা এটা মেনে নিব না।
বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশের স্বার্থের প্রসঙ্গে আপনি বলছেন যে, পানির হিস্যা চাওয়া এবং সীমান্ত হত্যার বিষয়টি নিয়ে আপনারা সোচ্চার থাকবেন।
তারেক রহমান: না না, আমি উদাহরণ দিয়ে বললাম। দুটো উদাহরণ দিয়ে বোঝালাম আপনাকে যে আমাদের স্ট্যান্ডটা কী হবে। আমরা আমাদের পানির হিস্যা চাই। অর্থাৎ আমার দেশের হিস্যা, মানুষের হিস্যা আমি চাই, হিসাব আমি চাই।
আমার যেটা ন্যায্য, সেটা আমি চাই। অবশ্যই ফেলানী হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আমি বোঝাতে চেয়েছি যে, আমার মানুষের ওপরে আঘাত আসলে অবশ্যই সেই আঘাতকে এভাবে আমি মেনে নেব না।
বিবিসি বাংলা: একটা বিষয় যদি বলি, ৫ অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবং আপনিও জানেন যে, শেখ হাসিনা দিল্লিতে গেছেন এবং সেখানে আছেন। ভারতের সাথে একটা সম্পর্কের শীতলতা দেখা গেছে গত এক বছর ধরে। যেমন ধরুন, সেটি যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে, ব্যবসার ক্ষেত্রে নানা রকম, সেই ক্ষেত্রে কি কোনো পরিবর্তন আপনারা সরকারে এলে হবে বা পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন—এমন কোনো চিন্তা কি আপনাদের আছে?
তারেক রহমান: এখন তারা যদি স্বৈরাচারকে সেখানে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়, সেখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। এটা বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাদের সাথে শীতল থাকবে। সো, আমাকে আমার দেশের মানুষের সাথে থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর সংসদ ও দলীয় নেতৃত্বের প্রশ্নে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: সংস্কারের প্রশ্নে আসি। এখন খুব আলোচিত ইস্যু। সংস্কারের কিছু বিষয়ে দেখা যাচ্ছে যে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের কিছুটা মতপার্থক্য বা মতবিরোধ হচ্ছে। যেমন—এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা বা দলের প্রধান থাকতে পারবেন না, এরকম একটা প্রস্তাব এসেছে, যেখানে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। যদি এক ব্যক্তি তিন পদে একই সাথে থাকেন, সেটা স্বৈরতান্ত্রিক একটা ব্যবস্থা তৈরির সুযোগ দেয় কি না?
তারেক রহমান: সকলের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এই যে বাংলাদেশে রাষ্ট্র মেরামতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, থাকবেন না—এরকম আরও যে বিষয়গুলো আছে, এগুলো বাংলাদেশে যখন স্বৈরাচার ছিল তাদের মুখের ওপরে, তাদের চোখের দিকে চোখ রেখে আমরা বিএনপিই বলেছিলাম।
এখন হয়তো অনেকে সংস্কারের কথা বলছেন। সেদিন কিন্তু সংস্কারের ’স’-ও তারা বলেননি। তার পরেও সকলের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে আমি বলতে চাই যে, বিএনপি ’নোট অব ডিসেন্ট’ দিলে সেটি সমস্যা, অর্থাৎ বিএনপিকে অ্যাগ্রি (সম্মত) করতে হবে সবার সাথে, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু বিএনপি যদি কোনোটার সাথে একমত না হয়, তাহলে বেঠিক। এটি তো গণতন্ত্র হলো না।
মানে, আমাকে অন্যের সাথে একমত হতে হবে, তাহলে গণতন্ত্র। আমি যদি অন্যের সাথে দ্বিমত করি, তাহলে গণতন্ত্র না। এটি কেমন গণতন্ত্র? কারণ গণতন্ত্রের মানেই তো হচ্ছে, বিভিন্ন মতামত থাকবে। আমরা অনেক ব্যাপারেই একমত হব হয়তো। সকল ব্যাপারে একমত হবো না, কিছু ব্যাপারে হয়তো দ্বিমত থাকতেই পারে। এটাই তো গণতন্ত্র, এটাই তো এসেন্স অব গণতন্ত্র।
আমরা তো কোনো হাইড অ্যান্ড সিক করছি না। আমি যেটা মনে করছি যে ভাই, আমি মনে করছি যেটা আমার দৃষ্টিতে ঠিক না, আমি বলছি ঠিক না।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু দুই বছর আগে ২০২৩ সালে আপনারা ৩১ দফা দিয়েছেন। সেই ৩১ দফাতেই আপনারা সংস্কারের যেসব বিষয় এনেছেন, সেখানে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলেছেন। তাহলে এ বিষয়গুলোতে আপত্তি কেন?
তারেক রহমান: না, আমরা যেটাতে বলেছিলাম, আমরা সেখানে এখনো আছি। যতটুকু ভারসাম্য হওয়া উচিত, যে যে বিষয়ে যতটুকু বিবেচনা করা উচিত, আমরা সে বিষয়ের মধ্যে এখনো কমবেশি আছি। আমাদের অবস্থান থেকে তো আমরা অবস্থান পরিবর্তন করিনি।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু মূল যে বিষয়গুলো, যেমন যেটা বড় বিরোধ হিসেবে আসছে, বড় মতপার্থক্য হিসেবে আসছে যে, এক ব্যক্তির তিন পদে একসাথে থাকা, সেখানেই তো আপত্তিটা থাকছে বিএনপির।
তারেক রহমান: না, আমরা তো তখনো বলিনি যে এক ব্যক্তি তিন পদে থাকতে পারবে না। এটা অন্যরা কেউ বলেছে যে, এক ব্যক্তি তিন পদে থাকতে পারবে না। আমরা মনে করি না যে, এটাতে স্বৈরাচারী হওয়ার কোনো কারণ আছে।
আমরা তো দেখেছি, স্বৈরাচারের সময়ও এবং তার আগে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তাদের টু থার্ড মেজরিটি ছিল। টু থার্ড মেজরিটি ২০০৮ সালে তারা নিয়েছিল। তারা ওটাকে চেঞ্জ করে ফেলেছে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাখেনি।
২০০১ সালে তো বিএনপিরও টু থার্ড মেজরিটি ছিল, বিএনপি তো চেঞ্জ করেনি। যেহেতু জনগণ মনে করে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে; বিএনপি টু থার্ড মেজরিটি থাকার পরেও তো চেঞ্জ করেনি।
কাজেই এক ব্যক্তির হাতে থাকলেই যে স্বৈরাচর হবে তা নয়। এটি নির্ভর করে ব্যক্তি টু ব্যক্তি, শুধু আইন চেঞ্জ করলেই সবকিছু সঠিক হয়ে যাবে না।
৩১ দফা, নাকি জুলাই সনদ, অগ্রাধিকার কী হবে
বিবিসি বাংলা: এই সংস্কারের বিষয়গুলোতে যেখানে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নিয়ে একটা জুলাই সনদ প্রণয়নের কথা। সেটাও বাস্তবায়নের উপায়গুলো নিয়ে বা বাস্তবায়নের পথ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে একটা বিতর্ক আছে। অনেক দল বলছে যে, নির্বাচনের আগেই আইনি ভিত্তি দেওয়া বা বাস্তবায়ন করা। আর বিএনপি বলছে, নির্বাচিত সংসদ সেটা করবে। এই জায়গাটা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী, বিএনপির চিন্তাটা এখন কী?
তারেক রহমান: দেখুন, এখানে আবার আমাকে বলতে হচ্ছে, আমরা কিন্তু কোনো হাইড এন্ড সিক করছি না। যদি আমাদের সেরকম অসৎ উদ্দেশ্য থাকত মনের ভিতরে, বলতাম আরেকটা যে ঠিক আছে, ওকে, অসুবিধা নাই। তার পরে ইনশআল্লাহ আমরা সরকার গঠনে সক্ষম হলে আমরা হয়তো করতাম না। তো আমরা যেটা মনে করছি, সেটাই বলছি।
এখন বিষয় হচ্ছে দেখুন, এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ইম্পর্টেন্ট একটি বিষয়। দেখুন, আমরা যদি ইভেন রিসেন্ট যে ঘটনা, নেপালেও যদি দেখি, আপনি দেখেন, ওরা কিন্তু এত কিছুর মধ্যে যাচ্ছে না। ওরা বলছে যে, গুরুত্বপূর্ণ যা বিষয় আছে, সংস্কার বলেন বা বিভিন্ন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যা বিষয় আছে—নির্বাচিত প্রতিনিধি যাঁরা আসবেন, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি যাঁরা আসবেন, তাঁরা সেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তার পরেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবকিছু বিবেচনা করে রাজনৈতিক দলগুলো বসেছে, অন্তর্বর্তী সরকার আহ্বান করেছে। এখানে যতটুকু হয়েছে, আমরা বলেছি, এখন যতটুকু হয়েছে, যেগুলো শুধু আইন দিয়ে করলে হয়ে যায়, সেগুলো হয়ে যাক। যেগুলোর সাংবিধানিক এনডোর্সমেন্ট লাগবে, সেগুলো আমরা মনে করি যে, নির্বাচিত সংসদ হওয়ার পরে সেখানে গ্রহণ করাটাই ভালো হবে।
কারণ, আপনি যদি নির্বাচিত সংসদের কথা বলেন, অথচ তাকে বাদ দিয়ে যদি আপনি আউট অব দ্য বক্স কিছু করেন এবং এটা যদি রেওয়াজ হয়ে যায়, তাহলে এটা আমরা মনে করি যে, এটা সাংবিধানিকভাবে হোক, আইনগতভাবে হোক বা যে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করেন না কেন, ভবিষ্যতের জন্য এটা একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
সে জন্য আমরা মনে করি, যেটা দেশের জন্য সামগ্রিকভাবে ক্ষতির একটি কারণ হবে। সে জন্যই আমরা এটার সাথে একমত না।
বিবিসি বাংলা: এখন বিএনপির যেহেতু ৩১ দফা আছে, যদিও যেসব বিষয় আলোচনায় এসেছে, অনেক বিষয়ে মিল আছে। তো বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে বা সরকার গঠন করে, তখন ৩১ দফা নাকি জুলাই সনদ—কোনটা অগ্রাধিকার পাবে?
তারেক রহমান: আমরা যেগুলোতে একমত হয়েছি, প্রথমে আমরা সেগুলোর ওপরেই জোর দিব। সেটা আপনি যে নামেই বলেন না কেন, স্বাভাবিকভাবে আমরা ঐকমত্য কমিশনে যেগুলোতে সকলে মিলে একমত হয়েছি, আমরা প্রথমে সেগুলোতে ইনশাআল্লাহ সরকার গঠনের সুযোগ পেলে প্রথমে সেগুলোতেই অবশ্যই জোর দিব।
আর, তারপরে আপনি যেটা ৩১ দফার কথা বললেন, অবশ্যই ৩১ দফা আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট জনগণের প্রতি। আমরা তো আমাদের ৩১ দফার মধ্যে যেগুলোর এটার সাথে মিলে গিয়েছে, সেগুলো তো আমরা করবই। এর বাইরে যেগুলো থাকবে ৩১ দফায় আছে, সেগুলোও বাস্তবায়ন করব।
কারণ ওটা তো আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট। এটাও যেমন পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট, ওটাও আমাদের পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট। এটা আমরা রাজনৈতিক দলগুলো মিলে একত্রিত হয়ে বলেছি। ওটাও আমরা অনেকগুলো রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েই কিন্তু ৩১ দফা দিয়েছি।
‘বিড়ালটি আমার মেয়ের’
বিবিসি বাংলা: রাজনীতি থেকে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। আপনাকে সম্প্রতি প্রাণী অধিকার রক্ষা নিয়ে বেশ সোচ্চার দেখা গেছে। এ-সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে আপনি যোগ দিয়েছেন। রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের বাইরে আপনার পোষা বিড়ালের সঙ্গে আপনার নিয়মিত ছবি দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তো এটা আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কীভাবে?
তারেক রহমান: প্রথমত এখানে একটু ক্লিয়ার করে নেই, বিড়ালটি আমার মেয়ের। ও এখন অবশ্য সবারই হয়ে গিয়েছে। আমরা সবাই ওকে আদর করি।
বিষয়টি হচ্ছে, এরকম শুধু বিড়াল নয়, আমি এবং আমার ভাই যখন ছোট ছিলাম, আমাদের একটি ছোট কুকুরও ছিল। ইভেন, তখন আমাদের বাসায় আম্মা হাঁস-মুরগি পালতেন, ছাগলও ছিল আমাদের বাসায়। উনি ছাগলও কয়েকটি পালতেন।
তো স্বাভাবিকভাবেই আপনি যেই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলেন, পোষা কুকুর-বিড়ালই বলেন, বাই দ্য ওয়ে কবুতরও ছিল আমাদের বাসায়। শুধু কবুতর না, আমাদের বাসায় একটি বিরাট বড় খাঁচা ছিল। সেই খাঁচার মধ্যে কিন্তু পাখি ছিল, বিভিন্ন রকমের এবং আবার আরেকটি খাঁচা ছিল, যেটার মধ্যে একটা ময়না ছিল।
ময়নাটা আমরা বরিশাল থেকে এনেছিলাম। ও আবার বরিশালি ভাষায় কথাও বলত। টুকটুক করে মাঝে মাঝে কিছু কিছু কথাও বলত। কাজেই বিষয়টি হঠাৎ করেই না। এই পশুপাখির প্রতি যে বিষয়টি, এটির সাথে আমি কমবেশি ছোটবেলা থেকে জড়িত আছি। হয়তো এটি এখন প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্নভাবে। বাট, এটির সাথে আমি বা আমার পরিবার, আমরা অনেক আগে থেকেই আছি।
কুকুর-বিড়াল ছিল, গরু-ছাগল ছিল, হাঁস-মুরগি ছিল, পাখি ছিল, ময়না ছিল, কবুতর ছিল। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা চিন্তা করি, আমাদের আল্লাহ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তৈরি করেছেন। আমাদের দায়িত্ব কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টি যা কিছু আছে প্রকৃতির, তার প্রতি কিন্তু যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এটি একটি বিষয়।
আর আমরা যদি মানবিক দৃষ্টিকোণ অথবা আমরা যদি নেচার থেকেও বিষয়টি দেখি, দেখুন, ওরা না থাকলে কিন্তু আমাদের জন্য বেঁচে থাকা কষ্টকর। প্রকৃতি যদি না থাকে, প্রকৃতির ব্যালেন্স যদি না থাকে।
এই আলোচনা শুরু হওয়ার আগে কিন্তু আপনি আমরা তিনজন কিন্তু ওয়েদার নিয়ে কথা বলছিলাম, এই ইংল্যান্ডের বা ইউকের ওয়েদার নিয়ে আমরা আলাপ করছিলাম এবং আমি বলছিলাম যে, আমার এই ১৭ বছর অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ওয়েদার মনে হয় একটু একটু এখানেও চেঞ্জ হয়েছে। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে পত্রপত্রিকায় দেখেছি পলিউশন ঢাকা শহরে। নরমালি আমরা জানি যে, একটি দেশের টোটাল অংশের মধ্যে এটলিস্ট ২৫ শতাংশ গ্রীন দরকার, বনায়ন দরকার। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আমি যতটুকু জেনেছি, এটি ১২ পার্সেন্টের মতো। হুইচ ইস ভেরি ডেঞ্জারাস।
তো এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি—কীভাবে আমরা বাড়াব। তো যেমন এগুলো আছে, ঠিক একই সাথে এই যে আপনি পশুপাখির কথা বললেন, এ বিষয়গুলো আছে নেচার। নেচারকে যদি আমরা মিনিমাম ঠিক রাখতে না পারি, সেখানে মানুষ হিসেবে কিন্তু আমাদের বসবাস করা খুব কঠিন হয়ে যাবে। কাজেই আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এ বিষয়গুলো বোধহয় করা প্রয়োজন।
সামাজিক মাধ্যমে মিম, কার্টুন কীভাবে দেখেন
বিবিসি বাংলা: রাজনীতিতে যেমন আপনাকে নিয়ে অনেক আলোচনা আছে, স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক মাধ্যমেও আপনাকে নিয়ে অনেক আলোচনা আছে এবং আপনি যে পোস্টগুলো করেন, সেটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। আপনাকে নিয়ে অনেক মিমও তৈরি হয়, অনেক কার্টুন হয়। যেমন—একটা মিমের কথা যদি আমি বলি, অনেকে শেয়ার করেছিল যে, আপনি আপনার সাথে আমরা জুমে কথা বলছি, আপনি জুমে বক্তব্য দেন। এটা নিয়ে একটা মিম তৈরি হয়েছে যে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, তো এ ধরনের মিমগুলো আপনি কীভাবে দেখেন?
তারেক রহমান: আমি এনজয় করি বেশ, বেশ আমি এনজয় করি।
বিবিসি বাংলা: আপনি দেখেন এগুলো? আপনার চোখে পড়ে?
তারেক রহমান: হ্যাঁ, চোখে পড়বে না কেন, অবশ্যই চোখে পড়ে। তবে এখানে একটি কথা আছে, যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়টি এল, আমার মনে হয় এ বিষয়ে একটু এড করা উচিত।
দেখুন, সোশ্যাল মিডিয়া এমন একটি বিষয়, আমি নিজেও আছি সোশ্যাল মিডিয়ায় কমবেশি। বহু বহু মানুষ আছেন, লক্ষকোটি মানুষ আছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এটি দিয়ে যেমন খুব দ্রুত একজনের সাথে আরেকজনের যোগাযোগ করা যায়।
আমরা মাঝে মাঝে বলি যে, দেখেন, অনেক সময় অনেক আলোচনায় আসে, সেমিনার-বক্তব্যে আসে যে, ডিনামাইটটা যখন আবিষ্কৃত হয়, ডিনামাইটটা আবিষ্কৃত হয়েছিল আপনার পাহাড় ভেঙে কীভাবে মানুষের চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট তৈরি করা যায়; হয়তো কীভাবে চাষের জমি করা যায়। এরকম লক্ষ্য সামনে রেখেই, উদ্দেশ্য সামনে রেখেই কমবেশি ডিনামাইটের ব্যবহারটা শুরু হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখেছি, এটি মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই যে, অবশ্যই প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে। যেহেতু আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। মানুষের বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাস করি। প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে তার মতামত প্রকাশ করার।
তবে আমরা যদি সকলে এতটুকু সচেতন হই যে, আমি আমার মত প্রকাশ করলাম, কিন্তু এই মত প্রকাশের ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি না—এ বিষয়টিকে যদি আমরা বিবেচনায় রাখি, একটি মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হলো কি না, ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি না—এসব বিষয় বোধহয় আমাদের বিবেচনায় রাখা উচিত; এটি এক নম্বর।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ার বহুল ব্যবহারের ফলে ডিসইনফরমেশন বা মিসইনফরমেশন বিষয়টিও চলে এসেছে সামনে। এ কথাও চলে এসেছে। একটি জিনিস আমি দেখলাম বা শুনলাম, সাথে সাথেই আমি সেটিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তা না করে আমার মনে হয়, ফ্যাক্ট চেক বলে যেই কথাটি আছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, এটা সব জায়গায় আছে—এ ব্যাপারেও যদি আমরা একটু অ্যালার্ট থাকি সবাই, এ ব্যাপারে যদি একটু সচেতন থাকি যে ঠিক আছে, এটি একটু যাচাইবাছাই করে নিই।
যদি সত্য হয়, অবশ্যই আমার সেখানে মতামত থাকবে। কিন্তু যদি মিথ্যা হয় বিষয়টি, কেন আমি এখানে মতামত দিব? একটি মিথ্যার সাথে আমি কেন নিজেকে সংশ্লিষ্ট করব? একটি খারাপ কিছুর সাথে কেন আমি নিজেকে সংশ্লিষ্ট করব? এটি আমি আমার মতামতটা প্রকাশ করলাম।
মানুষের আস্থার প্রশ্নে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: আমরা প্রায় শেষ দিকে চলে এসেছি। আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই যে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন যেটা হয়েছে গত বছরের ৫ আগস্ট। তারপর থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হবে—এই প্রশ্নে মানুষকে কীভাবে আস্থায় নেবেন?
তারেক রহমান: এই প্রশ্নের উত্তরে যদি একটু এভাবে বলি, স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দল হিসেবে তো আমাদের একটি পরিকল্পনা আছে। আপনাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে আমি কিছু কিছু বলেছি।
ব্যাপারটা হচ্ছে এরকম যে, দেখুন এই মুহূর্তে মাঠে আমরা যেই রাজনৈতিক দলগুলো আছি, আমরা ধরে নিতে পারি, সেই রাজনৈতিক দলগুলো ইনশআল্লাহ আগামীতে দেশ পরিচালনা করতে পারে। তার মধ্যে বিএনপিরই কিন্তু দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে।
আপনাকে যদি বলি, ধরেন এখন লন্ডন আসবেন। তো আপনি একটা প্লেনে উঠলেন। যে প্লেন চালাবে, সে যদি আপনাকে বলে যে ভাই কিছু মনে করেন না, আমার ঠিক লাইসেন্সটা হয়নি এখনো, তবে আমার মনে হয় আমি চেষ্টা করলে আপনাকে নিয়ে যেতে পারব লন্ডন পর্যন্ত উড়িয়ে। আপনি কি তার সাথে উঠবেন প্লেনে? নিশ্চয়ই আপনি উঠবেন না।
আপনি একজন অভিজ্ঞ ড্রাইভারের সাথে উঠতে পারেন। কিন্তু অভিজ্ঞ ড্রাইভারও গাড়ি হয়তো ঠিকই চালাচ্ছে সেফলি, কিন্তু রাস্তায় তো গর্ত খানাখন্দ থাকবেই, একটু জার্কিং হতেই পারে। জোরে অনেক সময় ব্রেক হতেই পারে, ঝাঁকুনি লাগতেই পারে, কিন্তু অভিজ্ঞ ড্রাইভার আপনাকে মোটামুটি ঠিকভাবে নিয়ে যাবে। নিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ সে চেষ্টা করবে। কারণ তার সেই অভিজ্ঞতা আছে।
কাজেই আমরা যদি দেখি যে, ভালো কাজ বা কমিটমেন্ট আপনি যেটা বলেন, বিএনপি করবে কি না। আমরা তো করেছি। হতে পারে আমাদের দ্বারা কিছু ভুল-ত্রুটি হয়েছে।
আপনি একটু আগে একটা কথা বলেছিলেন, মানুষ তো অতীত থেকেই শিখে। ইয়েস, আমরাও দেখেছি, আমরাও অতীত থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি যে ঠিক আছে এই কাজটি এভাবে করলে হয়তো ভুল হয়, এটি আমরা ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ করব না। বাট আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা ভালো-মন্দ যাচাই করতে পারব।
একই সাথে আমাদের কমিটমেন্ট আছে, যে কমিটমেন্ট দিয়ে আমরা ডেলিভারি করতে পারব এবং আমরা ডেলিভারি করতে চাই।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান
বিবিসি বাংলা: শেষ প্রশ্নটি করি তাহলে আপনাকে এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই। বিগত সরকারের আমলে তাদের একটা বিষয় বড় সমালোচনা ছিল যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ। আপনারা যদি ক্ষমতায় আসেন, সে ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদ বা সংবাদমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়নের বিষয়গুলো যে আর হবে না, সেই নিশ্চয়তা কি আপনি দিতে পারেন?
তারেক রহমান: জ্ব, ইয়েস পারি। একদম দিতে পারি। আপনি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পত্রপত্রিকা খুলুন। আমি কারও নাম উল্লেখ করব না, কোনো পত্রিকার কথা উল্লেখ করব না। শুধু খুলে দেখুন কীভাবে অনেক খবর ছাপা হয়েছিল, যার সত্যতা কিন্তু ছিল না, অপপ্রচার ছিল। কিন্তু অপপ্রচারটা সংবাদ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আপনি কি শুনেছেন, আপনি কি আমাকে প্রমাণ দিতে পারবেন, বলতে পারবেন যে বিএনপির সময়, আমি কিন্তু বলতে পারব অনেক অনেক সাংবাদিকের নাম, যাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন স্বৈরাচারের সময় এবং পরবর্তীতে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ইভেন, এখনো অনেকে প্রবাসজীবনে আছেন, এরকম বহু সাংবাদিক।
আমি বলতে পারব, স্বৈরাচারের সময় বহু সাংবাদিককে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন করে বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ধমক দেওয়া হতো। বিএনপির সময় এগুলো করা হয়নি, কারণ তখন সংবাদপত্রে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে তৎকালীন বিএনপি সরকার সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে, যদি ওই রকম হতো, তাহলে কিন্তু ওরকম খবর প্রকাশিত হতো না।
অর্থাৎ, বিএনপির সময় যদি অত্যাচার-নির্যাতন থাকত, তাহলে খবরগুলো প্রকাশিত হতো না স্বাভাবিকভাবে, যা হয়নি বিগত সরকারের সময় স্বৈরাচার সরকারের সময়। কাজেই আপনাকে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, বিএনপির অতীত সরকারের সময় যেরকম সাংবাদিকদের গুম করা হয়নি। সাংবাদিকদের নির্যাতন করা হয়নি। সাংবাদিকদের দেশ ছেড়ে যেতে হয়নি, বাধ্য হতে হয়নি। ইনশআল্লাহ ভবিষ্যতেও হবে না।
বিবিসি বাংলা: তাহলে কি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে—এ ধরনের যে আইনগুলো রয়েছে, সেগুলো আপনারা বাতিল করবেন, এটা কি ধরে নেওয়া যায়?
তারেক রহমান: অবশ্যই, আমরা সকলে মিলে বসব, আলোচনা করব। আপনাদের মতো সাংবাদিকসহ যাঁরা আছেন, তাঁদের সাথে আলোচনা করব। আলোচনা করে সেগুলো এরকম কালো আইন যা যা আছে, আমরা আস্তে আস্তে ঠিক করব।
তবে এখানে বোধহয় একটি বিষয় আবার আমাকে উল্লেখ করতে হয়, যেটি আমি সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে বলেছি। দেখুন, এটি তো সবাইকে মিলে করতে হবে। অপপ্রচারকে তো অবশ্যই সংবাদ হিসেবে তো প্রচার করা ঠিক নয়, তাই না?
আমাদের কাছে আপনাদের যেরকম চাওয়া থাকবে, ভবিষ্যৎ সরকারের কাছে, যারাই আসুক সরকারে, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমাদেরও অনুরোধ থাকবে আপনাদের প্রতি যে অপপ্রচার সংবাদ হিসেবে যেন প্রচারিত না হয়—এ বিষয়টি একটু সকলকে সচেতন বা খেয়াল রাখতে হবে।
বিবিসি বাংলা: তারেক রহমান, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলার জন্য।
তারেক রহমান: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমার কথাগুলো দেশের মানুষের সামনে আমি তুলে ধরতে পেরেছি। সেই সুযোগটুকু আপনারা করে দিয়েছেন, তার জন্য আপনাদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ।

উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দ
১১ মে ২০২৩
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
২০ ঘণ্টা আগে
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
১৩ দিন আগে
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫