Ajker Patrika

বাদামচাষি থেকে নোবেলজয়, প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের কর্মময় জীবন

আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২: ৩৭
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। ছবি: এএফপি
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। ছবি: এএফপি

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে জিমি কার্টার মার্কিন জনগণকে ওয়াদা করেছিলেন, তিনি কখনোই তাদের সঙ্গে মিথ্যা বলবেন না। সেই জিমি কার্টার ১০০ বছর বয়সে মারা গেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংস্থা কার্টার সেন্টার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি পরবর্তী অস্থির সময়ে জর্জিয়ার সাবেক এই চিনাবাদাম চাষি প্রেসিডেন্ট ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহণ এড়িয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের ক্ষমা করেছিলেন এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া প্রথম মার্কিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, জিমি মিশর ও ইসরায়েলের মধ্যে ঐতিহাসিক ক্যাম্প ডেভিড শান্তি চুক্তি সম্পাদনে সহায়তা করেছিলেন। কিন্তু ইরানের জিম্মি সংকট এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত আক্রমণের মোকাবিলায় খাবি খেয়েছেন। প্রথম মেয়াদ পূর্ণ করার পর ১৯৮০ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে পরাজিত হন তিনি।

হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর কার্টার বিশ্বজুড়ে শান্তি, পরিবেশ এবং মানবাধিকার নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তাঁর এই পরিশ্রমের ফলস্বরূপ তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘজীবী প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। তিনি ২০২৪ সালের অক্টোবরে তাঁর ১০০ তম জন্মদিন উদ্‌যাপন করেন। তিনি দীর্ঘ সময় ক্যানসারের চিকিৎসাও নিয়েছিলেন এবং জীবনের শেষ ১৯ মাস হসপিস কেয়ারে কাটিয়েছেন।

জেমস আর্ল কার্টার জুনিয়র ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর জর্জিয়ার শহর প্লেইনসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চার ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। তাঁর বাবা পারিবারিক চিনাবাদামের ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং মা লিলিয়ান ছিলেন নিবন্ধিত নার্স। ১৯৩০—এর দশকে মহামন্দার অভিজ্ঞতা এবং দৃঢ় ধর্মবিশ্বাস তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করেছিল।

উচ্চ বিদ্যালয়ে তারকা বাস্কেটবল খেলোয়াড় ছিলেন কার্টার। এরপর তিনি মার্কিন নৌবাহিনীতে সাত বছর কাজ করেন। সেসময়ই তিনি তাঁর বোনের বন্ধু রোজালিনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং সাবমেরিন অফিসার হন। তবে ১৯৫৩ সালে বাবার মৃত্যুর পর কার্টার বাদাম চাষে নামেন। প্রথম বছরের ফসল খরার কারণে নষ্ট হয়েছিল। তবে তারপরও কার্টার ব্যবসা চাঙা করেন এবং ক্রমেই সম্পদশালী হয়ে ওঠেন। তিনি স্থানীয় স্কুল ও গ্রন্থাগারের পরিচালনা পরিষদে নির্বাচিত হয়ে রাজনীতিতে পা রাখেন। এর কয়েক বছর পর জর্জিয়া সিনেটে সিনেটর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট স্কুলে বর্ণবৈষম্য বিলুপ্ত করার রায় দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য থেকে ওঠে আসা কৃষক হিসেবে কার্টারের এই পরিবর্তনের বিরোধিতা করার কথা ছিল—কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। জর্জিয়া সিনেটে দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে তিনি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গ এড়িয়ে চলেছিলেন, যদিও তাঁর বাবা বিচ্ছিন্নতার পক্ষে ছিলেন। এমনকি তাঁর দল ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যেও অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিল।

এরপর ১৯৭০ সালে জর্জিয়ার গভর্নর হন জিমি। এর পর তিনি নাগরিকদের আরও অধিকারের পক্ষে প্রকাশ্যে সমর্থন জানাতে শুরু করেন। গভর্নর হিসেবে শপথ নেওয়ার দিনে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের সৎভাবে বলছি। বর্ণবৈষম্যের সময় শেষ।’ তাঁর মেয়াদে তিনি রাজধানীর বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে মার্টিন লুথার কিংয়ের ছবি আঁকিয়েছিলেন।

গভর্নর হিসেবে তিনি নিশ্চিত করেছিলেন যে, আফ্রিকান-আমেরিকানদের সরকারি কাজে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তবে, গর্ভপাত আইন নিয়ে তাঁর উদার মনোভাব এবং তাঁর দৃঢ় খ্রিষ্টান বিশ্বাসের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন ছিল। তিনি নারীদের গর্ভপাতের অধিকার সমর্থন করলেও তিনি এটির জন্য তহবিল বাড়াতে অস্বীকৃতি জানান।

জিমি কার্টার ১৯৭৪ সালে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থিতার জন্য প্রচারণা শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্র তখনো ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রচারণায় তিনি নিজেকে এক চিনাবাদাম চাষি হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি ক্যাপিটল হিলের পেশাদার রাজনীতিবিদদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

তাঁর সময়োপযোগী প্রচারণা কাজ করে। আমেরিকানরা একজন নবাগত নেতা চেয়েছিল এবং কার্টার সেই চাহিদা পূরণ করেছিলেন। নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর প্রথমদিকে, জনমত জরিপে দেখা গিয়েছিল যে, তিনি মাত্র ৪ শতাংশ ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন পাবেন। কিন্তু ৯ মাস পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডকে পরাজিত করেন।

নিজের বাদাম ক্ষেতে জিমি কার্টার। ছবি: সংগৃহীত
নিজের বাদাম ক্ষেতে জিমি কার্টার। ছবি: সংগৃহীত

ক্ষমতায় প্রথম দিনেই তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে সেনাবাহিনীতে যোগদানের নির্দেশ এড়িয়ে যাওয়া কয়েক লাখ পুরুষকে ক্ষমা করেন। সে সময়কার রিপাবলিকান সিনেটর ব্যারি গোল্ডওয়াটার এই সিদ্ধান্তকে ‘কোনো প্রেসিডেন্টের নেওয়া সবচেয়ে লজ্জাজনক কাজ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। কার্টার স্বীকার করেছিলেন, এটি তাঁর দায়িত্ব পালনকালে নেওয়া সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল।

কার্টার তাঁর প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদের নিয়োগ দেন এবং রোজালিনকে ফার্স্ট লেডি হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে সক্রিয় ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করেন। তিনি মার্কিন সংবিধানে একটি সমান অধিকার সংশোধনী আনার চেষ্টা করেছিলেন। যেটি লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আইনি সুরক্ষা প্রতিশ্রুতি দিত।

জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া প্রথম আন্তর্জাতিক নেতাদের একজন হিসেবে কার্টার হোয়াইট হাউসে জিন্স ও সোয়েটার পরতেন এবং শক্তি সংরক্ষণের জন্য হিটার বন্ধ রাখতেন। তিনি হোয়াইট হাউস ভবনের ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন করেন—যা পরে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান সরিয়ে ফেলেন—এবং আলাস্কার অনাবাদি জমি রক্ষার জন্য আইন পাশ করেন।

আমেরিকার অর্থনীতি মন্দার দিকে যেতে থাকলে কার্টারের জনপ্রিয়তা পড়তে শুরু করে। জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় কঠোর পদক্ষেপ—যার মধ্যে গ্যাসোলিন রেশনিংও ছিল—গ্রহণ করতে দেশকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি, কিন্তু কংগ্রেসে তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি হন। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চালু করার পরিকল্পনাও পার্লামেন্টে ব্যর্থ হয়। বেকারত্ব ও সুদের হার দুটোই আকাশচুম্বী হয়ে যায়।

মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে তাঁর শুরুটা ছিল বিজয়ের মধ্য দিয়ে। ১৯৭৮ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু বিদেশে সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ইরানে বিপ্লব এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন ছিল কঠিন পরীক্ষা।

কার্টার তেহরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তেহরানে জিম্মি মার্কিনিদের উদ্ধারে বলপ্রয়োগের চেষ্টা বিপর্যয়ে পরিণত হয়। এতে আট মার্কিন সেনা নিহত হন। এই ঘটনা নিশ্চিতভাবেই তাঁর পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনাকে শেষ করে দেয়। এরপর ১৯৮০ সালের নির্বাচনের আগে ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন বাগিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিকে পরাস্ত করেন কার্টার এবং পরবর্তী নির্বাচনে ৪১ শতাংশ পপুলার ভোট পান। কিন্তু এটি রোনাল্ড রিগ্যানকে পরাজিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। সাবেক এই অভিনেতা ইলেকটোরাল কলেজে বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন।

প্রেসিডেন্সির শেষ দিনে কার্টার ইরান থেকে জিম্মিদের মুক্তির জন্য সফল আলোচনার ঘোষণা দেন। তবে তিনি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে জিম্মি মুক্তি দেখে যেতে পারেননি। দায়িত্ব ছাড়ার সময় কার্টারের জনপ্রিয়তা ছিল আমেরিকার যেকোনো প্রেসিডেন্টের মধ্যে সবচেয়ে কম। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি তাঁর সুনাম পুনরুদ্ধারের জন্য অনেক প্রচেষ্টা চালান।

মার্কিন সরকারের পক্ষে তিনি উত্তর কোরিয়ায় শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ করেন—যা শেষ পর্যন্ত পরমাণু অস্ত্র ভেঙে ফেলার জন্য একটি প্রাথমিক চুক্তি ‘অ্যাগ্রিড ফ্রেমওয়ার্কের’ দিকে নিয়ে যায়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরি ‘কার্টার প্রেসিডেনশিয়াল সেন্টার’ আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান এবং সংকট মোকাবিলায় ধারণা ও প্রোগ্রামগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

জিমি কার্টার ২০০২ সালে তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে—থিয়োডর রুজভেল্ট এবং উড্রো উইলসনের পর—নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তবে তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি তাঁর প্রেসিডেন্সির পরের কাজের জন্য এই সম্মান পান। তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে একত্রে ‘দ্য এল্ডারস’ নামে একটি গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা বিশ্বব্যাপী শান্তি এবং মানবাধিকারের জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০০২ সালে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করার সময়—তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি এটি পান—তিনি বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে গুরুতর এবং সর্বজনীন সমস্যা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী এবং দরিদ্র মানুষের মধ্যে বাড়তে থাকা ফারাক।’

দায়িত্ব থেকে অবসরের পর কার্টার একটি সাধারণ জীবনধারা বেছে নেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের আসন তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলেছেন এবং জর্জিয়ার প্লেইনসে স্ত্রী রোজালিনের সঙ্গে সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। জিমি কার্টার ওয়াশিংটন পোস্টকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এতে কিছু ভুল দেখি না; যারা এটি করে তাদের দোষারোপ করি না। কিন্তু কখনই আমার ধনবান হওয়ার ইচ্ছা ছিল না।’

জিমি কার্টারই ছিলেন একমাত্র আধুনিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি রাজনীতিতে প্রবেশের আগে যে বাড়িতে বাস করতেন দায়িত্ব ছাড়ার পর সেখানেই ফিরে যান। তাঁর এই বাড়িটি ছিল একটি একতলা ও দুই শয়নকক্ষের বাড়ি। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুসারে, কার্টারদের বাড়ির মূল্য ছিল ১ লাখ ৬৭ হাজার ডলার। যা তাদের রক্ষা করার জন্য বাইরে থাকা সিক্রেট সার্ভিসের গাড়ির মূল্যের চেয়েও কম।

জিমি কার্টার ২০১৫ সালে জানান, তিনি ক্যানসারের চিকিৎসা নিচ্ছেন। এই রোগেই তাঁর বাবা-মা এবং তিন বোন মারা গিয়েছিলেন। সে বছরই কোমর ভাঙার অপারেশনের কয়েক মাস পর তিনি আবার হ্যাবিট্যাট ফর হিউম্যানিটির স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজে ফেরেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ও তাঁর স্ত্রী ১৯৮৪ সালে দাতব্য সংস্থাটির সঙ্গে কাজ শুরু করেন এবং বছরের পর বছর ৪ হাজারের বেশি বাড়ি মেরামত করতে সাহায্য করেন।

তিনি প্লেইনসের মারানাথা ব্যাপটিস্ট চার্চের একটি সানডে স্কুলে পড়াতেও থাকেন। কখনো কখনো তিনি ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের তাঁর ক্লাসে আমন্ত্রণও জানিয়েছেন। ২০২৩ সালের নভেম্বরে রোজালিন কার্টার মারা যাওয়ার পর স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘৭৭ বছরের বিবাহিত জীবনের আমার স্ত্রী আমার করা প্রতিটি কাজের সমান অংশীদার ছিলেন।’

চলতি বছর নিজের জন্ম শতবর্ষ উদ্‌যাপনকালে কার্টার প্রমাণ করেন যে, তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা এখনো প্রখর। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি শুধু নভেম্বরের নির্বাচনে কামলা হ্যারিসের জন্য ভোট দিতে চাই।’ তিনি সত্যিই ভোট দিতে পেরেছিলেন। তবে তাঁর রাজ্য জর্জিয়া শেষ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দেয়।

কার্টারের আজীবন জনসেবার চালিকাশক্তি ছিল, তাঁর গভীর ধর্মবিশ্বাস। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি ধর্মীয় বিশ্বাস এবং জনসেবাকে আলাদা করতে পারবেন না। আমি কখনোই ঈশ্বরের ইচ্ছা এবং আমার রাজনৈতিক কর্তব্যের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব অনুভব করিনি। যদি আপনি একটিকে লঙ্ঘন করেন, তবে অন্যটিকেও লঙ্ঘন করবেন।’

তথ্যসূত্র: বিবিসি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

থাই-কম্বোডিয়া সীমান্তে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো বিষ্ণু মূর্তি, নিন্দা জানাল ভারত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মূর্তিটি ২০১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত
মূর্তিটি ২০১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া সীমান্তে দুই দেশের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ এলাকায় ভগবান বিষ্ণুর একটি মূর্তি ধ্বংসের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে ভারত। আজ বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ঘটনাকে একটি ‘অসম্মানজনক কাজ’ হিসেবে অভিহিত করেছে এবং সংশ্লিষ্ট দুই দেশকেই আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আসার আহ্বান জানিয়েছে।

কম্বোডিয়ার প্রিয়া বিহার প্রদেশের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, গত সোমবার (২২ ডিসেম্বর) থাই সামরিক বাহিনী একটি এক্সকাভেটর ব্যবহার করে ভগবান বিষ্ণুর মূর্তিটি গুঁড়িয়ে দেয়।

বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূর্তিটি ২০১৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। এটি সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ মিটার ভেতরে কম্বোডিয়ার আন সেস এলাকায় অবস্থিত ছিল।

প্রিয়া বিহারের মুখপাত্র লিম চানপানহা এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘বৌদ্ধ ও হিন্দু অনুসারীদের কাছে পূজনীয় প্রাচীন মন্দির ও মূর্তি ধ্বংসের এই ঘটনা আমরা কোনোভাবেই মেনে নেব না।’ তবে থাইল্যান্ডের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে বলেন, সীমান্ত বিরোধের জের ধরে এ ধরনের কাজ অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন, ‘ভূখণ্ড নিয়ে দাবি যাই থাকুক না কেন, এ ধরনের অসম্মানজনক কাজ বিশ্বজুড়ে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। এমন ঘটনা ঘটা উচিত নয়।’

ভারত আবারও উভয় পক্ষকে শান্তি বজায় রাখতে এবং জানমাল ও ঐতিহ্যের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সংলাপ ও কূটনীতির পথে ফেরার অনুরোধ জানিয়েছে।

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিনের। ঔপনিবেশিক আমলের সীমানা নির্ধারণকে কেন্দ্র করে এই বিরোধের শুরু। গত জুলাইয়ে পাঁচ দিনের লড়াইয়ে কয়েক ডজন মানুষ নিহত হয়েছিল। গত ডিসেম্বরে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘাতে এ পর্যন্ত ৪০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

বুধবার থেকে উভয় দেশের সামরিক কর্মকর্তারা আবারও যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন।

বিষ্ণু মূর্তি ধ্বংসের এই ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মহল আশা করছে, সংঘাতের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমেই এই সংকটের সমাধান হবে। হিন্দু ও বৌদ্ধ দেবতারা এই অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র এবং এটি আমাদের অভিন্ন সভ্যতা ও ঐতিহ্যের অংশ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গাজায় ধ্বংসস্তূপের মাঝেই বড়দিনের আনন্দ খুঁজছে ক্ষুদ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
গত ২১ ডিসেম্বর গাজা সিটিতে ক্রিসমাস উদযাপনের আগে হলি ফ্যামিলি ক্যাথলিক চার্চের বাইরে গাজার শিশু ও সন্ন্যাসিনীরা। ছবি: এপির সৌজন্যে
গত ২১ ডিসেম্বর গাজা সিটিতে ক্রিসমাস উদযাপনের আগে হলি ফ্যামিলি ক্যাথলিক চার্চের বাইরে গাজার শিশু ও সন্ন্যাসিনীরা। ছবি: এপির সৌজন্যে

গাজা উপত্যকায় গত দুই বছর ধরে চলা ধ্বংসলীলা আর লাশের মিছিলের মাঝেও বড়দিনের আনন্দ ফিরে পাওয়ার এক বিষাদময় চেষ্টা চালাচ্ছে সেখানকার ক্ষুদ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়। একটি নড়বড়ে যুদ্ধবিরতি কিছুটা স্বস্তি দিলেও, ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি আর বাস্তুচ্যুত মানুষের হাহাকার অনেক ঐতিহ্যবাহী উৎসবকে ম্লান করে দিয়েছে।

৭৬ বছর বয়সী আত্তাল্লাহ তরাজি সম্প্রতি বড়দিনের উপহার হিসেবে এক জোড়া মোজা আর স্কার্ফ পেয়েছেন। গাজার কনকনে শীত থেকে বাঁচতে এগুলোই এখন তাঁর বড় সম্বল। গির্জার অন্যান্য সদস্যদের সাথে তরাজি যখন গাইলেন—‘খ্রিস্টের জন্ম হয়েছে, হালেলুইয়া’ (একটি হিব্রু শব্দ, যার অর্থ প্রভুর প্রশংসা), তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার বিভীষিকা ঢাকা পড়েছিল বিশ্বাসের সুরে।

গাজার সেন্ট্রাল সিটি এলাকার ‘হলি ফ্যামিলি চার্চ’ কম্পাউন্ডে আশ্রয় নেওয়া তরাজি বলেন, ‘আমরা এই পবিত্র মুহূর্তে যুদ্ধ, বিপদ আর বোমাবর্ষণের কথা ভুলে যেতে চাই। খ্রিস্টের জন্মের আনন্দ আমাদের সব তিক্ততাকে ছাপিয়ে যাক।’

তবে সবার জন্য উৎসবের অনুভূতি এক নয়। শাদি আবু দাউদের জন্য এবারের বড়দিনটি অত্যন্ত কষ্টের। গত জুলাই মাসে এই ক্যাথলিক চার্চ কম্পাউন্ডেই ইজরায়েলি হামলায় তাঁর মা নিহত হন ও ছেলে আহত হয়। ইজরায়েল একে ‘দুর্ঘটনা’ বলে দুঃখ প্রকাশ করলেও স্বজন হারানোর ক্ষত এখনও দগদগে। আবু দাউদ বলেন, জখম এখনও কাঁচা। এখানে কোনো উৎসব নেই, আমরা এখনও ‘না যুদ্ধ না শান্তি’র এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে বাস করছি।

গাজার প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে খ্রিস্টানদের সংখ্যা এখন নগণ্য। যুদ্ধের কারণে অনেক পরিবার দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ২৩ বছর বয়সী ওয়াফা ইমাদ এলসায়েঘ জানান, বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়রা না থাকায় আগের মতো আমেজ নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিবার নিয়ে সাজসজ্জা করছি ঠিকই, কিন্তু যাদের সাথে সব আনন্দ ভাগ করে নিতাম, তারা আজ গাজায় নেই। এই পরিবেশ আগের মতো করে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।’

৩৫ বছর বয়সী মা এলিনোর আমাশ তাঁর সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে ঘরে বড়দিনের গাছ (ক্রিসমাস ট্রি) সাজিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানেরা কিছু চকলেট আর মিষ্টি পেয়ে বোমার ভয় ছাড়া শ্বাস নিতে পারছে। কিন্তু তাবুগুলোতে বসবাসকারী মানুষের কষ্ট দেখে চোখে জল আসে।’

গাজার খ্রিস্টানরা মনে করেন, তাঁরা সংখ্যায় যত কমই হোক না কেন, এটি এই ভূমির প্রতি ভালোবাসা এবং বিশ্বাসের এক অটল সাক্ষ্য। আত্তাল্লাহ তরাজি প্রার্থনা করেন যেন তাঁর জাতি শান্তি ও স্বাধীনতা পায়। তিনি বিশ্বাস করেন, এই পরিস্থিতির চেয়েও বড়দিনের আনন্দ এবং তাঁদের বিশ্বাস অনেক বেশি শক্তিশালী।

গত অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির পর গাজায় হামলার তীব্রতা কমলেও মাঝেমধ্যেই প্রাণঘাতী আঘাত আসছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইজরায়েলি অভিযানে এ পর্যন্ত প্রায় ৭১ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অর্ধেকই নারী ও শিশু।

অতিবৃষ্টিতে বাস্তুচ্যুত মানুষের তাবুগুলো তলিয়ে গেছে, যা ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মস্কোতে বিস্ফোরণ, দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ নিহত তিন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১: ৪২
মস্কোর ঘটনাস্থলে পুলিশ। ছবি: বিবিসি
মস্কোর ঘটনাস্থলে পুলিশ। ছবি: বিবিসি

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে এক বিস্ফোরণে দুজন ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা এবং আরেকজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। রাশিয়ার তদন্ত সংস্থাগুলোর বরাতে জানা গেছে, দক্ষিণ মস্কোর ইয়েলেতস্কায়া স্ট্রিট এলাকায় এই বিস্ফোরণ ঘটে স্থানীয় সময় বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) ভোরে। ঘটনাস্থলটি সেই জায়গার কাছে, যেখানে চলতি সপ্তাহের শুরুতে এক রুশ জেনারেল গাড়িবোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন।

রাশিয়ার ইনভেস্টিগেটিভ কমিটির বিবৃতির বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে আটকের চেষ্টা করার সময় বিস্ফোরণটি ঘটে। পুলিশ কর্মকর্তারা যখন ওই ব্যক্তির কাছে যান, তখনই একটি বিস্ফোরক ডিভাইস সক্রিয় হয়ে যায়। বিস্ফোরণের ফলে ঘটনাস্থলেই দুই পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণ হারান। এ সময় তাঁদের পাশে থাকা আরেকজন ব্যক্তিও বিস্ফোরণে নিহত হন।

নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার বয়স ছিল ২৪ ও ২৫ বছর। আল জাজিরার মস্কো প্রতিনিধি ইউলিয়া শাপোভালোভার তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে একজনের স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটি তাদের পরিবারের জন্য এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি।’ বিস্ফোরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য এখনো স্পষ্ট নয় বলে জানিয়েছে রুশ কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিস্ফোরণের শব্দ ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। কাছাকাছি বসবাসকারী আলেক্সান্ডার নামের এক ব্যক্তি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘একটা ভয়ংকর শব্দ হয়েছিল, কয়েক দিন আগের গাড়ি বিস্ফোরণের মতোই।’ আরেক বাসিন্দা রোজা জানান, বিস্ফোরণের সময় তাঁদের পুরো ভবনটি কেঁপে ওঠে এবং তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠেন।

বিস্ফোরণের পরপরই এলাকাটি ঘিরে ফেলে পুলিশ বাহিনী। রুশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ছবিতে দেখা গেছে, ঘটনাস্থলে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। তদন্তকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এবং বিস্ফোরক পাচারের অভিযোগে একটি মামলা করেছে।

এই বিস্ফোরণ ঘটেছে সেই এলাকার কাছে, যেখানে গত সোমবার রুশ জেনারেল ফানিল সারভারভ গাড়ির নিচে পেতে রাখা বিস্ফোরক ডিভাইসের মাধ্যমে নিহত হন। সারভারভ রুশ জেনারেল স্টাফের অপারেশনাল ট্রেনিং বিভাগের প্রধান ছিলেন এবং ইউক্রেনে চলমান সামরিক অভিযানের জন্য সেনাদের প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

রাশিয়া জেনারেল সারভারভ হত্যার পেছনে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। তবে ইউক্রেন এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে রাশিয়া ও দখল করা ইউক্রেনীয় অঞ্চলে একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনায় রুশ সামরিক কর্মকর্তা এবং এই যুদ্ধের সমর্থক বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শানলিউরফা: নবীদের যে নগরে মিলেছে তিন ধর্মের মানুষ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
তুরস্কের শানলিউরফা শহর। ছবি: সিএনএন
তুরস্কের শানলিউরফা শহর। ছবি: সিএনএন

দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের শানলিউরফা শহরকে বলা হয় ‘নবীদের নগরী’। সিরিয়া সীমান্ত থেকে মাত্র ৪০ মাইল উত্তরে অবস্থিত এই শহরটি হাজার বছরের ইতিহাস, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির এক অনন্য সংযোগস্থল। এখানে ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম—এই তিন একেশ্বরবাদী ধর্মের কাহিনি এসে মিলেছে।

বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সিএনএন জানিয়েছে, শানলিউরফার পুরোনো শহরের দেরগাহ মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত নীলাভ পানির ‘বালিক্লিগোল’ বা ‘মাছের হ্রদ’। মূলত এখানে আছে দুটি পুকুর। ধর্মীয় মতে, দুটি পুকুরের বড়টিতে নবী ইব্রাহিম (আ.)-কে আগুনে নিক্ষেপ করেছিলেন মেসোপটেমিয়ার রাজা নমরুদ। আল্লাহ তৎক্ষণাৎ ওই আগুনকে পানি এবং জ্বলন্ত কাঠকে মাছে রূপান্তরিত করেছিলেন। এ ছাড়া ‘আইনজেলিহা’ নামের ছোট পুকুরটির নামকরণ করা হয়েছে নমরুদের কন্যা জেলিহার নামে। ইব্রাহিম নবীর প্রতি বিশ্বাসের কারণে এই পুকুরে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জেলিহা প্রাণ হারিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস।

দুটি পুকুরই কালো দাগওয়ালা কার্প মাছে ভরা। এগুলোকে পবিত্র মনে করা হয়। তাই এই মাছগুলোকে ধরা বা এগুলোর ক্ষতি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই কারণেই বালিক্লিগোল শুধু একটি পর্যটনস্থল নয়, বরং গভীর ধর্মীয় আবেগ ও ইতিহাসের প্রতীক। মাছের গায়ে থাকা কালো দাগগুলোকে আগুনের ছাইয়ের চিহ্ন হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

বালিক্লিগোলে ভেসে বেড়ায় কালো দাগওয়ালা কার্প মাছ। ছবি: সিএনএন
বালিক্লিগোলে ভেসে বেড়ায় কালো দাগওয়ালা কার্প মাছ। ছবি: সিএনএন

ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে শানলিউরফা নানা নামে পরিচিত ছিল। আরামীয়রা একে ডাকত উরহাই, গ্রিক শাসনামলে নাম ছিল এডেসা, আরব বিজয়ের পর নাম হয় রোহা। অটোমানেরা ১৬০৭ সালে এই নগরীর নাম রাখে উরফা। পরে ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিরোধের স্বীকৃতি হিসেবে যুক্ত হয় ‘শানলি’, অর্থাৎ ‘গৌরবময়’।

এই শহরটি ইব্রাহিম (আ.), আইয়ুব (আ.), নূহ (আ.) ও জেথ্রোর মতো নবীদের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে বিশ্বাস করা হয়। পুরোনো শহরের দেরগাহ মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত বালিক্লিগোল মুসলিম তীর্থযাত্রীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। এখানেই রয়েছে মেভলিদ-ই-হালিল গুহা। বিশ্বাস করা হয়, এখানেই জন্ম হয়েছিল ইব্রাহিম নবীর। নারীরা সন্তান কামনায় ও আরোগ্য লাভের আশায় এই গুহায় আসেন।

তবে শানলিউরফার ইতিহাস শুধু ধর্মগ্রন্থেই সীমাবদ্ধ নয়। শহরটি থেকে ১৪ মাইল দূরেই আছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা বা উপাসনালয় হিসেবে চিহ্নিত ‘গ্যোবেকলি তেপে’। প্রায় ১১-১২ হাজার বছরের পুরোনো এই স্থাপনাটি মানবসভ্যতার ধারণাকেই বদলে দিয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৯৬০০ সালের এই নিওলিথিক স্থাপনাটি কৃষি ও মৃৎশিল্পের আগেই নির্মিত—যা প্রমাণ করে, ধর্মীয় আচার হয়তো সভ্যতার সূচনাতেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখানে পাওয়া টি-আকৃতির স্তম্ভ ও খোদাই করা পশুর ভাস্কর্য বিশ্বব্যাপী বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা বা উপাসনালয় হিসেবে চিহ্নিত ‘গ্যোবেকলি তেপে’। ছবি: সিএনএন
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা বা উপাসনালয় হিসেবে চিহ্নিত ‘গ্যোবেকলি তেপে’। ছবি: সিএনএন

শানলিউরফা প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে ১০ হাজারের বেশি নিদর্শন। এর মধ্যে ‘উরফা ম্যান’ নামের ১১ হাজার ৫০০ বছরের পুরোনো মানব মূর্তিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাশেই হালেপলিবাহচে মোজাইক জাদুঘর ও কিজিলকয়ুন নেক্রোপলিস শহরের রোমান যুগের ইতিহাস তুলে ধরে।

ইতিহাস ও ধর্মের পাশাপাশি শানলিউরফা খাবার ও আতিথেয়তার জন্যও বিখ্যাত। উরফা কাবাব, পাটলিজান কাবাব, চি কফতে ও শিল্লিক তাতলিসি এখানকার জনপ্রিয় খাবার। স্থানীয়দের সঙ্গে ধীরে চা পান, পুরোনো বাজারে হাঁটা আর ‘সিরা গেসেসি’ নামের সাংস্কৃতিক আড্ডায় অংশ নিলে বোঝা যায়—এই শহর শুধু দেখার নয়, অনুভব করারও।

শানলিউরফা নগরীতে ‘সিরা গেসেসি’ নামে রাতের আড্ডা। ছবি: সিএনএন
শানলিউরফা নগরীতে ‘সিরা গেসেসি’ নামে রাতের আড্ডা। ছবি: সিএনএন

বলা যায়—শানলিউরফা যেন এক জীবন্ত জাদুঘর; যেখানে ধর্ম, ইতিহাস ও মানবসভ্যতার গল্প একসূত্রে গেঁথে পাশাপাশি হাঁটে অতীত ও বর্তমান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত