Ajker Patrika

জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় ফিরে আসছে স্কার্ভি রোগ

খাদ্যাভ্যাসের কারণে আবার ফিরে আসছে স্কার্ভি। ছবি: সংগৃহীত
খাদ্যাভ্যাসের কারণে আবার ফিরে আসছে স্কার্ভি। ছবি: সংগৃহীত

জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং ‘অস্বাস্থ্যকর’ খাদ্যাভ্যাস মানুষের মধ্যে নতুন করে স্কার্ভি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে ধারণা করছেন চিকিৎসকেরা। সম্প্রতি পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী পার্থে ভিটামিন সি ঘাটতির কারণে স্কার্ভি রোগে আক্রান্ত এক রোগী পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

পার্থের স্যার চার্লস গায়ার্ডনার হাসপাতালে সেই রোগীর চিকিৎসা করা হয়েছে। স্কার্ভি বর্তমানে বিরল রোগ। এই রোগটি এক সময় নাবিকদের হতো, যারা দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় তাজা ফল ও সবজি খেতে পেতেন না। তবে চিকিৎসকেরা বলছেন, স্কার্ভি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা আবার বাড়ছে।

ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং ব্যারিয়াট্রিক সার্জারি (ওজন কমানোর অস্ত্রোপচার) প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় স্কার্ভি রোগ আবার ফিরে আসছে।

অস্ট্রেলিয়ার পঞ্চাশোর্ধ্ব ওই রোগী আট বছর আগে ওজন কমানোর জন্য গ্যাস্ট্রিক বাইপাস সার্জারি করিয়েছিলেন। একদিন ঘুম থেকে ওঠে দুই পায়ের নিচে র‍্যাশের মতো লাল দাগ দেখতে পান। আক্রান্ত স্থানে ব্যথা অনুভব করছিলেন এবং চলাফেরা করতেও সমস্যা হতো।

চিকিৎসকেরা প্রদাহ, অটো ইমিউন এবং রক্ত পরীক্ষায় কোনো সমস্যা ধরতে পারেননি। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কোনো লক্ষণও ছিল না।

প্রতিবেদনের প্রধান লেখক অ্যান্ড্রু ডার্মাওয়ান বলেন, স্কার্ভি প্রাথমিক পর্যায়ে সহজে শনাক্ত করা যায় না।

তিনি আরও বলেন, ‘স্কার্ভি নির্মূল হয়ে গেছে ধরে নিয়ে বর্তমানে হাসপাতালে সাধারণত এই রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হয় না।’

রেনেসাঁ যুগের রোগ

জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে রোগটিকে ‘রেনেসাঁ যুগের রোগ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেটি এখন আর নেই বলেই ধরে নেওয়া হয়। তবে এই রোগ সহজেই শনাক্ত এবং চিকিৎসা করা যায়।

হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ওই ব্যক্তির র‍্যাশ হাতেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে চিকিৎসক দলটি রোগীর প্রতি বিশেষ নজর দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে ওই রোগী খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন না। তাঁর নিয়মিত খাদ্যতালিকায় প্রধানত ছিল প্রক্রিয়াজাত খাবার। সবজি বা ফলে তেমন খেতেন না। কখনো কখনো সঠিক সময়ে খাবার গ্রহণ করতেন না। তিনি গ্যাস্ট্রিক বাইপাস সার্জারির পর নির্ধারিত ভিটামিন এবং খনিজের সাপ্লিমেন্টও গ্রহণ করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কারণ সেগুলো কেনার সামর্থ্য ছিল না। তাই তাঁর শরীরে একটি মৌলিক পুষ্টির ঘাটতি হয় বলে ধারণা করেছিলেন চিকিৎসকেরা।

পরে রক্ত পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া যায়, তাঁর শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন সি নেই। এরপরই স্কার্ভি রোগ ধরা পড়ে। চিকিৎসকেরা তাঁকে প্রতিদিন ১০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ফোলিক অ্যাসিড এবং মাল্টিভিটামিনের একটি ডোজ দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই রোগীকে প্রতিদিন একটি লেবুও খেতে দেওয়া হয়। ফলে তাঁর ভিটামিন সি’র ঘাটতি কমতে শুরু করে। তাঁকে একটি ডায়েট পরিকল্পনা ও ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট দিয়ে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

চিকিৎসকেরা বলেন, এই রোগীর স্কার্ভিতে আক্রান্ত হওয়ার একাধিক কারণ ছিল। যেমন: খাদ্যাভ্যাস সুষম নয়, ব্যারিয়াট্রিক সার্জারি, প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরের ব্যবহার (পাকস্থলীতে অ্যাসিডের উৎপাদন কমানোর ওষুধ) ও কম উপার্জন। তাঁর দেহে আয়রন, ভিটামিন ডি এবং ফলেট বা ভিটামিন বি৯ ঘাটতির ইতিহাসও তাঁর মৌলিক পুষ্টি ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।

তবে চিকিৎসকেরা জোর দিয়ে বলেছেন, এই ঘটনা স্কার্ভির আকস্মিক উত্থান নয় বা মহামারি আকারে স্কার্ভি ছড়িয়ে পড়ারও কোনো আশঙ্কা নেই। এটি কেবল একটি ঘটনা। বর্তমানে স্কার্ভির প্রাদুর্ভাব স্পষ্ট না হলেও বেশ বিরল। তবে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট চাপ নিয়ে চিকিৎসকেরা চিন্তিত।

প্রতিবেদনের লেখকেরা বলেন, অস্ট্রেলিয়ায় খাদ্যপণ্যের ব্যয় গত ১২ মাসে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে। পরিবারের জন্য সুষম খাবার কেনা কঠিন হয়ে পড়ছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির মানে হচ্ছে—মানুষ সস্তা খাবারের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আর এসব খাবারে সাধারণত পুষ্টিমান কম থাকে।

গত বছর ভিক্টোরিয়া রাজ্যের পাবলিক হেলথ গবেষকেরা সতর্ক করেন, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির চাপ স্কার্ভি এবং রিকেটসের (ভিটামিন ডি–এর অভাবজনিত হাড়ের রোগ) মতো রোগ বাড়িয়ে দিতে পারে।

ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটির কেয়ারিং ফিউচারস ইনস্টিটিউটের প্রধান পুষ্টি এবং ডায়াবেটিস অধ্যাপক রেবেকা গোলি বলেন, যখন স্বাস্থ্যকর খাবারগুলোর দাম বাড়তে শুরু করছে, তখন যুক্তরাজ্যে এসব রোগের পুনরুত্থান ঘটেছে এবং এখন অস্ট্রেলিয়াতেও একই ধরনের সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে।

ড. গোলি বলেন, অস্ট্রেলিয়ার কৃষকেরা পর্যাপ্ত পরিমাণে সবজি উৎপাদন করেন। কিন্তু সে দেশের মানুষ প্রতিদিন প্রয়োজনের অর্ধেকেরও কম সবজি খান।

স্কার্ভির সঙ্গে সামাজিক–অর্থনৈতিক সম্পর্ক

স্কার্ভি রোগীর সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন। কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ায় ভিটামিন সি ঘাটতির ঝুঁকির কারণ নিয়ে একটি বড় আকারের গবেষণা প্রতিবেদন মেডিকেল জার্নাল অব অস্ট্রেলিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।

২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১২ হাজার ৯৩৪টি ভিটামিন সি পরীক্ষার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেন গবেষকেরা। এই বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষের মধ্যে ভিটামিন সি–এর স্তর স্বাভাবিক সীমার মধ্যে, ২৯ দশমিক ৯ শতাংশের ভিটামিন সি–এর মধ্যম পর্যায়ের ঘাটতি এবং ২৪ দশমিক ৫ শতাংশের ভিটামিন সি–এর মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে।

অর্থনৈতিক সংকট খাদ্যাভ্যাসকে প্রভাবিত করে। উপার্জনের তুলনায় ব্যয় বেড়ে গেলে মানুষ তাজা ফল ও সবজি কম খায়, এর ফলে ভিটামিন সি–এর ঘাটতির ঝুঁকি বাড়ে।

কোভিড ১৯ মহামারি শুরু হওয়ার আগে প্রতিবছর মোট জনসংখ্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্যের মধ্যে ভিটামিন সি ঘাটতি কমছিল। প্রতিবেদনের লেখকেরা বলছেন, লকডাউনের সময় খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনের সঙ্গে ২০২১ সালে ভিটামিন সি ঘাটতিতে থাকা লোকের সংখ্যা বৃদ্ধির সম্পর্ক থাকতে পারে। বিশেষ করে লকডাউনের সময় তাজা ফল ও সবজি খেতে পারেননি অনেকে। কিন্তু এই সময় নিয়ে অধিকাংশ গবেষণায় সামাজিক–অর্থনৈতিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে ধর্ষণ করলেন ছাত্রদল নেতা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত