Ajker Patrika

হৃদরোগ ইনস্টিটিউট

দুই বছরেও শেষ হয়নি সিসিইউর নির্মাণকাজ

  • অস্থায়ী সিসিইউতে রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে।
  • লেগে থাকে শোরগোল, আছে অব্যবস্থাপনাও।
  • স্বাস্থ্যবিধি না মেনে প্রবেশ করছেন কর্মচারী ও রোগীর স্বজন।
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে (এনআইসিভিডি) পুরোনো করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলছে সেটির নির্মাণকাজ। এই অবস্থায় সংকটাপন্ন রোগীদের জরুরি সেবা দেওয়া হচ্ছে অস্থায়ী সিসিইউতে। কিন্তু একটি সিসিইউর জন্য যে পরিবেশ দরকার, সেখানে তা নেই। নানা অব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন হচ্ছে রোগীর সেবা কার্যক্রম।

এনআইসিভিডি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের মে মাসে মূল ভবনের সিসিইউর পুরোনো কাঠামো ভেঙে নতুন করে নির্মাণ শুরু করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। সে সময় সিসিইউ স্থানান্তর করা হয় দক্ষিণ ভবনের দ্বিতীয় তলায়। নতুন সিসিইউর সিভিল (পুরকৌশল) কাজের জন্য পৌনে ২ কোটি টাকা এবং ইলেকট্রিক্যাল কাজের জন্য পৌনে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু ইলেকট্রিক্যাল কাজ শুরু না হওয়ায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দের অর্থ ফেরত যায়। ওই অর্থবছরে নতুন বরাদ্দ আসেনি। পরে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনআইসিভিডি কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুরোনো বরাদ্দ ফেরত আসে। নির্মাণকাজ শেষ হলেও চলছে ইলেকট্রিক ও অভ্যন্তরীণ নকশার (ইন্টেরিয়র) কাজ।

সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের মূল ভবনের দ্বিতীয় তলায় সিসিইউ স্থাপনের কাজ চলছে। এ জন্য দুই দিকে প্রবেশদ্বারে টিনের বেড়া দেওয়া, ভেতরে চলছে কাজ। সিভিল বা পুরকৌশল ও টাইলস স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। এখন ইলেকট্রিক্যাল, রং করা ও ঘষামাজা চলছে।

এদিকে নতুন সিসিইউ স্থাপনের কাজ শেষ না হওয়ায় হাসপাতালের দক্ষিণ ভবনের দ্বিতীয় তলায় অস্থায়ী সিসিইউতে রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। গত সপ্তাহের দুই কার্যদিবসে অস্থায়ী সিসিইউর সামনে কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করে দেখা গেছে, ৩৮ শয্যার অস্থায়ী সিসিইউতে অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ার মতো। শয্যায় সংকটাপন্ন হৃদ্‌রোগী থাকলেও অন্যান্য ওয়ার্ডের মতো শোরগোল শোনা যায় সেখানে। রোগীদের স্বজন এবং হাসপাতালের কর্মচারীরা বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্যবিধি না মেনে প্রবেশ করছেন। শয্যা ছাড়াও মেঝেতে রোগীর সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ জন। রোগীদের তুলনায় ইউনিটটিতে স্বজন ও অন্য লোকজনের সংখ্যা বেশি। গুরুত্বপূর্ণ ওই ইউনিটে সংক্রমণ ও চিকিৎসার মান নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি স্পষ্ট।

অস্থায়ী সিসিইউতে রোগীর যথাযথ যত্নের ঘাটতির বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সিসিইউর পরিবেশ ভালো রাখতে হলে রোগী সীমিত করতে হবে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে তা সম্ভব নয়। বিশেষত এনআইসিভিডির মতো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে বিষয়টি বেশ কঠিন। এই প্রতিষ্ঠান কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দিতে পারে না। শুধু শয্যা বাড়ানোই সমাধান নয়, শয্যা বাড়ানোর পর যথাযথ সেবাও নিশ্চিত করতে হবে।

চিকিৎসকেরা বলছেন, জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের অবস্থা সংকটাপন্ন হলে সিসিইউতে নেওয়া হয়। অবস্থার উন্নতি হলে হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ), স্থিতিশীল অবস্থার রোগীদের প্রিসিসিইউতে রাখা হয়। অস্ত্রোপচারের পর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রোগীকে রাখা হয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। এর পরবর্তী ধাপে এইচডিইউ এবং ওয়ার্ডে নেওয়া হয়। ভর্তি রোগীদের মধ্যে কারও অবস্থা সংকটাপন্ন হলে তাকে সিসিইউতে পাঠানো হয়।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কার্ডিওভাসকুলার অ্যান্ড থোরাসিক অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের (বিএসিটিএ) সভাপতি অধ্যাপক এ টি এম খলিলুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যেসব রোগীর মারাত্মক হার্ট প্রবলেম, তাদের সিসিইউতে আনা হয়। জরুরি চিকিৎসা যন্ত্রাংশ ও পর্যাপ্ত জনবল নিয়েই সিসিইউ। সবাই সরকারি হাসপাতালের সংকট সম্পর্কে অবগত। তবে সমাধানে সদিচ্ছা দেখা যায় না। সরকারি সিসিইউতে বেশির ভাগ ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনে রোগীরা। শয্যা, যন্ত্রাংশ, অন্যান্য সুবিধাসহ আদর্শ সিসিইউ বলতে যা বোঝায়, তা অবশ্যই থাকতে হবে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের মতো গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে সিসিইউ স্থাপন বা সংস্কারের জন্য তিন বছর লেগে যাবে; কোনো অবস্থায়ই তা গ্রহণযোগ্য নয়।’

নতুন সিসিইউর বিষয়ে এনআইসিভিডির পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী বলেন, ‘সিসিইউ সংস্কার নয়, নতুন করে স্থাপন করা হচ্ছে। যেভাবে কাজ হচ্ছে, তাতে এ মাসের শেষ বা আগামী মাসের শুরুতে সিসিইউটি আমরা বুঝে পাব। আগের সিসিইউ ভেঙে নতুন করে অবকাঠামো করা হয়েছে। কেননা আগে একাধিক কক্ষ ছিল; তা এখন একত্র করা হয়েছে। নতুন সিসিইউতে আমরা ৩৮টি শয্যা করব। এক অংশে রোগীদের এক্সামিনেশনের জন্য স্বতন্ত্র জায়গা রাখা হবে। গত বছরের মাঝামাঝি আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর পুরোনো যে বরাদ্দ ছিল, তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আনা হয়েছে। নতুন সিসিইউ চালু হলে অস্থায়ীটিকে সিসিইউ-২ করা হবে। রোগী কিছুটা স্থিতিশীল হলে মূল সিসিইউ থেকে ইউনিট-২-তে পাঠানো হবে। এতে বেশি সংকটাপন্ন রোগীকে সেবা দেওয়া যাবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ঝাঁকির কারণে শিশুর মস্তিষ্কে আঘাত

ডা. মো. আরমান হোসেন রনি 
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ঝাঁকির কারণে শিশুর মস্তিষ্কে আঘাত বা শেকেন বেবি সিনড্রোম হলো শিশু নির্যাতনের একটি মারাত্মক ও জীবনঘাতী রূপ। এটি প্রধানত ২ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। এই অবস্থায় শিশুকে জোরে জোরে ঝাঁকানোর ফলে মস্তিষ্ক, চোখ ও ঘাড়ে গুরুতর আঘাত সৃষ্টি হয়, যদিও বাহ্যিকভাবে অনেক সময় কোনো আঘাতের চিহ্ন না-ও থাকতে পারে।

কারণ

শিশুর অতিরিক্ত কান্না, বিরক্তি কিংবা অস্থিরতার কারণে অভিভাবক বা পরিচর্যাকারীর রাগ এ ঘটনার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। এই অবস্থায় শিশুকে ঝাঁকালে তাদের ঘাড়ের পেশি দুর্বল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

এ ছাড়া মাথা শরীরের তুলনায় বড় হওয়ায় ঝাঁকানোর সময় তা সামনে-পেছনে দ্রুত নড়াচড়া করে। ফলে মস্তিষ্ক খুলির ভেতরে আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং রক্তনালিগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

কী ঘটে

শিশুকে জোরে ঝাঁকানোর ফলে তিনটি প্রধান ক্ষতি হয়—

মস্তিষ্কে আঘাত: মস্তিষ্ক ও খুলির মাঝখানে থাকা রক্তনালি ছিঁড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয়।

চোখে আঘাত: ভিট্রিওরেটিনাল ট্র্যাকশনের কারণে মাল্টিলেয়ার্ড রেটিনায় রক্তক্ষরণ হয়, যা শেকেন বেবি সিনড্রোমের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।

ঘাড় ও স্পাইনাল ইনজুরি: সার্ভাইক্যাল স্পাইনের ক্ষতি ও মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

লক্ষণ

শেকেন বেবি সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর লক্ষণগুলো হালকা থেকে গুরুতর হতে পারে। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:

অতিরিক্ত কান্না বা অস্বাভাবিক নিস্তেজ হয়ে যাওয়া

  • বমি
  • খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া
  • খিঁচুনি
  • শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া
  • অচেতনতা বা কোমা

চোখের পরীক্ষায় দেখা যায়—

  • এক বা উভয় চোখে মাল্টিলেয়ার্ড রেটিনাল রক্তক্ষরণ
  • ⁠প্রি-রেটিনাল, ইনট্রা-রেটিনাল ও সাব-রেটিনাল রক্তক্ষরণ
  • কখনো কখনো অপটিক ডিস্ক এডিমা

রোগনির্ণয়

শেকেন বেবি সিনড্রোম মূলত ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস। তবে নিশ্চিত করার জন্য—

  • চোখের রেটিনা পরীক্ষা
  • সিটি স্ক্যান বা এমআরআই
  • নিউরোলজিক্যাল মূল্যায়ন
  • শিশুর ইতিহাস ও সামাজিক প্রেক্ষাপট মূল্যায়ন

চিকিৎসা

এর চিকিৎসা একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে করা হয়—

  • শিশুর জীবন রক্ষা ও সাপোর্টিভ কেয়ার
  • খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণ
  • মস্তিষ্কের ভেতরের চাপ কমানো
  • নিউরোসার্জন ও পেডিয়াট্রিশিয়ানের তত্ত্বাবধান
  • চোখের জটিলতার জন্য চক্ষুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া।

চিকিৎসকের আইনগত ও নৈতিক দায়িত্ব

শেকেন বেবি সিনড্রোম একটি শিশু নির্যাতনজনিত অপরাধ। তাই চিকিৎসকের দায়িত্ব শুধু চিকিৎসা করা নয়, বরং—

  • যথাযথ মেডিকো-লিগ্যাল ডকুমেন্টেশন
  • সংশ্লিষ্ট চাইল্ড প্রোটেকশন সার্ভিস বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানানো
  • ভবিষ্যতে শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

চক্ষুবিশেষজ্ঞ ও সার্জন, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে

ফিচার ডেস্ক
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে

আমাদের প্রাত্যহিক কিছু অভ্যাস অজান্তেই শরীরের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সুস্থ হার্টের জন্য রান্নাঘরের করা কিছু ভুল এড়িয়ে চলুন। তাহলেই নিয়ন্ত্রণে থাকবে কোলেস্টেরল।

১। স্বাস্থ্যকর তেলও বেশি খেলে ক্যালরি বেড়ে যায়। সরাসরি বোতল থেকে তেল না ঢেলে চামচ মেপে ব্যবহার করুন। ঘি অথবা মাখনের মতো স্যাচুরেটেড চর্বি সীমিত রাখার চেষ্টা করুন।

২। ডুবো তেলে ভাজা খাবার ট্রান্স-চর্বি তৈরি করে, যা হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ভাজার বদলে বেকিং, গ্রিলিং বা এয়ার-ফ্রাই করার অভ্যাস করুন।

৩। ওটমিল, মটরশুঁটি বা আপেলের মতো দ্রবণীয় ফাইবার রক্তে ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরল শোষণ কমায়। প্রতিদিন অন্তত ১০ গ্রাম অতিরিক্ত ফাইবার হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি ১৭ শতাংশ কমাতে পারে।

৪। অতিরিক্ত চিনি ট্রাইগ্লিসারাইড বাড়ায় এবং অতিরিক্ত লবণ উচ্চ রক্তচাপের কারণ হয়। সস বা ব্রেডের মতো খাবারে লুকিয়ে থাকা চিনির বিষয়ে সতর্ক থাকুন।

৫। চর্বিযুক্ত পাত্রে খাবার রাখা বা পোড়া তেল বারবার ব্যবহার করা ধমনির জন্য ক্ষতিকর। খাবার কাচ বা স্টিলের পাত্রে রাখুন।

৬। পুষ্টিকর খাবারও অতিরিক্ত খেলে ট্রাইগ্লিসারাইড বাড়তে পারে। ছোট প্লেটে পরিমিত খাবার খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করুন।

৭। দোকানের কেনা সস

অথবা ড্রেসিংয়ে প্রচুর চিনি ও সোডিয়াম থাকে। এর বদলে দই, লেবুর রস বা অলিভ অয়েল দিয়ে বাড়িতেই স্বাস্থ্যকর সস তৈরি করুন।

সূত্র: হেলথ শর্টস

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

প্রতিস্থাপনে শূকরের অঙ্গ একদিন মানব অঙ্গের চেয়ে উন্নত হতে পারে: বিশেষজ্ঞ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০: ২৪
২০২৩ সালে নিউইয়র্কে এক রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপনের জন্য একটি শূকরের কিডনি প্রস্তুত করছেন ড. মন্টগোমারি। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
২০২৩ সালে নিউইয়র্কে এক রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপনের জন্য একটি শূকরের কিডনি প্রস্তুত করছেন ড. মন্টগোমারি। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

মানুষের অঙ্গের ঘাটতি মেটাতে শূকর থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপন (জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন) ভবিষ্যতে মানুষের দান করা অঙ্গের চেয়ে উন্নত বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন ড. রবার্ট মন্টগোমারি এই মত দিয়েছেন। তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি (এনওয়াইইউ) ল্যাঙ্গোন ট্রান্সপ্লান্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং বর্তমানে জীবিত মানুষের শরীরে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপনের একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

ড. মন্টগোমারি জানান, এই ট্রায়ালের প্রথম প্রতিস্থাপন ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে এবং আগামী জানুয়ারিতে আরেকটি অপারেশন হওয়ার কথা রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ছয়জন রোগীর শরীরে জিন-সম্পাদিত (জিন এডিটেড) শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হবে। এসব কিডনিতে ১০টি জিনগত পরিবর্তন আনা হয়েছে, যাতে মানবদেহে অঙ্গ প্রত্যাখ্যানের ঝুঁকি কমে। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) অনুমোদন দিলে এই ট্রায়াল আরও বিস্তৃত হয়ে ৪৪টি প্রতিস্থাপনে রূপ নিতে পারে।

বিশ্বজুড়ে মানব অঙ্গের তীব্র সংকট রয়েছে। যুক্তরাজ্যের এনএইচএস ব্লাড অ্যান্ড ট্রান্সপ্লান্টের তথ্য অনুযায়ী, শুধু যুক্তরাজ্যেই গত ১০ বছরে ১২ হাজারের বেশি মানুষ অঙ্গ না পেয়ে মারা গেছেন বা অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। নতুন এই ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীরা এমন রোগী, যাঁরা মানব কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অনুপযুক্ত অথবা অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকলেও পাঁচ বছরের মধ্যে অঙ্গ পাওয়ার আগে মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

ড. মন্টগোমারি নিজেও একজন ট্রান্সপ্লান্ট রোগী। বংশগত হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ২০১৮ সালে হৃদ্‌যন্ত্র প্রতিস্থাপন করান। তাঁর বাবা ও ভাই একই রোগে মারা যান। তিনি বলেন, মানুষের অঙ্গ কখনো পর্যাপ্ত সংখ্যায় মিলবে না। কিন্তু অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষার বাস্তবতা না বুঝলে এই সংকটের গভীরতা বোঝা যায় না।

মন্টগোমারি মানব অঙ্গের জোগান বাড়াতে ডোমিনো-পেয়ার্ড কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট ও হেপাটাইটিস ‘সি’ আক্রান্ত দাতার অঙ্গ ব্যবহারের মতো উদ্যোগে পথিকৃৎ ভূমিকা রেখেছেন। তবু তাঁর মতে, এসব উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। জিন সম্পাদিত শূকর তৈরির প্রযুক্তিই জেনোট্রান্সপ্লান্টেশনকে বাস্তবের কাছাকাছি এনেছে।

ড. মন্টগোমারির ভাষায়, ভবিষ্যতে শূকরের অঙ্গ মানুষের অঙ্গের চেয়ে উন্নত হতে পারে। কারণ, এগুলো ধারাবাহিকভাবে জিনগতভাবে উন্নত করা সম্ভব, যা মানুষের অঙ্গে করা যায় না। এমনকি শূকরের থাইমাস অঙ্গ একসঙ্গে প্রতিস্থাপন করলে রোগীর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এমনভাবে মানিয়ে নিতে পারে, একদিন হয়তো অ্যান্টিরিজেকশন ওষুধের প্রয়োজনীয়তাও কমে যাবে।

মন্টগোমারি জানান, প্রয়োজনে তিনি নিজেও ভবিষ্যতে শূকরের হৃদ্‌যন্ত্র নিতে আপত্তি করবেন না। তাঁর কথায়, ‘আমার সন্তানেরাও একই জেনেটিক ঝুঁকিতে আছে। আমি চাই, তারা যেন আমাদের চেয়ে বেশি বিকল্প নিয়ে বড় হতে পারে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কিডনি রোগীর বন্ধু কামরুল

  • নিজের হাতে ২০০০তম কিডনি প্রতিস্থাপন।
  • নিজে কোনো পারিশ্রমিক নেন না ডা. কামরুল।
  • কিডনি প্রতিস্থাপন ২ লাখ ১৫ হাজার টাকায়।
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯: ২৫
অধ্যাপক কামরুল ইসলাম।
অধ্যাপক কামরুল ইসলাম।

বাংলাদেশে যেখানে কিডনি প্রতিস্থাপন এখনো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, সেখানে অসহায় ও দরিদ্র রোগীদের শেষ ভরসা হয়ে উঠেছেন কিডনির শল্যচিকিৎসক অধ্যাপক কামরুল ইসলাম। দেশে যত কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়, সেগুলোর একটি বড় অংশই করেন তিনি। নিজের প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (সিকেডি) হাসপাতালে গতকাল মঙ্গলবার তিনি ২০০০তম কিডনি প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করেছেন। ব্যয়বহুল এই শল্য-চিকিৎসায় নিজে কোনো পারিশ্রমিক নেন না ২০২২ সালে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত এই চিকিৎসক।

কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে কিডনি রোগের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। প্রায় ২ কোটি মানুষ কিডনির কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগছেন। দেশে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় পাঁচজন রোগীর মৃত্যু হচ্ছে কিডনি অকেজো হয়ে। কিডনি প্রতিস্থাপন সীমিত এবং ডায়ালাইসিস ব্যয়বহুল। ফলে অধিকাংশ রোগী চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত ও চিকিৎসা নিলে ৬০ শতাংশ রোগীর জীবন রক্ষা সম্ভব।

কামরুল ইসলামের জন্ম ১৯৬৫ সালে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে বোর্ডের মেধাতালিকায় যথাক্রমে ১৫তম ও ১০তম স্থান লাভ করেছিলেন তিনি। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৪০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজের মধ্যে সম্মিলিত এমবিবিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে স্বর্ণপদক পান। এরপর ১৯৯৫ সালে এফসিপিএস, ২০০০ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইউরোলজিতে এমএস এবং ২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ থেকে এফআরসিএস ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।

ডা. কামরুলের কর্মজীবন শুরু ১৯৯৩ সালে, বিসিএসের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দিয়ে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি এবং ২০০৭ সালে প্রথম সফল কিডনি প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করেন। ২০১১ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে বেসরকারি একটি মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক পদে দায়িত্ব নেন। পরে ২০১৪ সালে নিজ উদ্যোগে রাজধানীর শ্যামলীতে সিকেডি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।

সিকেডি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ডা. কামরুলের নেতৃত্বে সপ্তাহে ছয়টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। কিডনি দাতা ও গ্রহীতার জন্য একই সঙ্গে দুটি কক্ষে অস্ত্রোপচার চলে। প্রতিটি অস্ত্রোপচারে সাধারণত ১০-১২ জন চিকিৎসক অংশ নেন। যাঁদের মধ্যে থাকেন অবেদনবিদ, কিডনি বিশেষজ্ঞ, ইউরোলজির শল্যচিকিৎসকসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞ, পাশাপাশি নার্স ও টেকনোলজিস্ট।

ডা. কামরুল বলেন, সিকেডিতে প্রতিদিন গড়ে একটি কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়। প্রতিটি অস্ত্রোপচারে ১০-১২ জন চিকিৎসক কাজ করেন। তিনি নিজে পারিশ্রমিক নেন না, তবে অস্ত্রোপচারে আনুষঙ্গিক খরচ থাকে। তাঁর হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্যাকেজ এখন ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা। যার মধ্যে অস্ত্রোপচার, ওষুধ, আইসিইউ এবং অন্যান্য খরচ অন্তর্ভুক্ত। কিডনি দাতা সাধারণত ৩ থেকে ৭ দিন এবং কিডনি গ্রহীতা ৭ থেকে ১০ দিন হাসপাতালে থাকেন।

হাসপাতালের অন্যান্য সার্জারি ও চিকিৎসাসেবার আয়ের অর্থে কিডনি প্রতিস্থাপনের খরচের পুরো প্রক্রিয়া চালানো হয়। সেখানে প্রতিদিন ৭-১২টি কিডনি স্টোন সার্জারি, কিডনি ক্যানসার, প্রস্টেট ক্যানসারসহ অন্যান্য সার্জারি করা হয়। হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা চার শতাধিক। আউটডোরে প্রতিদিন ২৫০-৩০০ রোগী, ইনডোরে প্রায় ১০০ রোগী সেবা নেন। ১০০ শয্যার হাসপাতালটিতে আরও ৫০ শয্যা বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়েছে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে সিকেডি হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাসিন্দা মাইনুল রহমান। ৪৪ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ীর কিডনি অকেজো হয়ে গেলে স্ত্রীর দেওয়া কিডনি নিয়ে তাঁর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। ডা. কামরুল ইসলাম এই অস্ত্রোপচার করেন।

কিডনি প্রতিস্থাপনে সিকেডি হাসপাতাল সোয়া দুই লাখ টাকা নিয়েছে জানিয়ে মাইনুল রহমান গতকাল সন্ধ্যায় আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সিকেডি হাসপাতাল যদি অন্য হাসপাতালের মতো খরচ নিত, তাহলে আমরা তা বহন করতে পারতাম না। এখন প্রতি মাসে ফলোআপ চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। সেখানে গেলে সবকিছু বিনা মূল্যে পাওয়া যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসকের ফি দিতে হয় না।’

এর আগে ২০২৩ সালের অক্টোবরে স্ত্রীর দেওয়া কিডনি নিজের শরীরে প্রতিস্থাপন করেন নারায়ণগঞ্জের ৩৭ বছর বয়সী আবু বকর। তিনি বলেন, ‘ডা. কামরুল স্যার খুবই মানবিক। আমরা খরচের ভয়ে চিকিৎসায় যেতে চাইনি। তিনি কয়েকবার ফোন করে আমাদের খোঁজ নিয়েছেন, তিনি কিডনি বসিয়ে দিয়েছেন।’

ডা. কামরুল জানান, কিডনি প্রতিস্থাপন করা রোগীরা বাসায় গেলে প্রথম এক থেকে দুই বছর অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়; বিশেষ করে ওষুধ ঠিকমতো না খাওয়া, সময়মতো ডোজ না নেওয়া এবং অনিয়মিত জীবনধারা ঝুঁকি বাড়ায়। আবার রোগীরা খরচের ভয়ে ফলোআপ চিকিৎসায় আসতে চান না। ফলে তাঁদের এসব চিকিৎসা আজীবন বিনা মূল্যে করেন তিনি।

ডা. কামরুলের স্ত্রীও একজন চিকিৎসক। তিনি বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। তাঁদের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে শিক্ষানবিশ চিকিৎসক, মেজ মেয়ে এমবিবিএস অধ্যয়ন করছেন।

নিজের প্রতিষ্ঠিত সিকেডি হাসপাতালকে ‘বড় গাছের মতো’ দেখেন ডা. কামরুল ইসলাম। যেখানে আয়ের একটি অংশ দরিদ্র রোগী ও কিডনি প্রতিস্থাপনে ব্যয় করা হয়। তিনি বলেন, ‘মানুষকে নিখুঁত চিকিৎসা দেওয়া আমার কর্তব্য। আমি কিডনি রোগীদের খরচ হাসপাতালের অন্যান্য আয়ের মাধ্যমে বহন করি। এটি যেকোনো হাসপাতালই করতে পারে এবং এর জন্য লোকসান হয়; তা কিন্তু নয়।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত