Ajker Patrika

নাগরিকদের জন্য শুভবুদ্ধি কত দূর?

মামুনুর রশীদ
নাগরিকদের জন্য শুভবুদ্ধি কত দূর?

মঙ্গলবার রাতে শুধু নয়, বেশ কয়েক রাত ধরে প্রচণ্ড গরমে সাতমসজিদ রোডের বৃক্ষ নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে বিশালসংখ্যক তরুণ-তরুণী দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। প্রতিবাদের ভাষা মার্জিত, জনসাধারণের কোনো অসুবিধা সৃষ্টি না করে বেশ কয়েক দিন ধরে তাঁরা কথা বলেই যাচ্ছেন। মানুষের সমর্থন দিনে দিনে বাড়ছে।

ছেলেগুলোকে দেখে আমি স্মৃতিতাড়িত হই এবং ফিরে যাই আমার কৈশোরে। কৈশোরে আমি ছিলাম এক গণ্ডগ্রামে, যেখানে বিদ্যুৎ ছিল না এবং বিদ্যুৎ আসার আপাতত কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। রাতে হারিকেন এবং প্রচণ্ড গরমে হাতপাখাই একমাত্র উপায়। কিন্তু এ রকম তাপ কখনো সহ্য করতে হতো না। স্কুলে যেতাম কোনো আমগাছের নিচে দিয়ে, সারি সারি সুপারিগাছের পাশ দিয়ে, তারপর লিচুবাগান এবং সবশেষে স্কুলের পাশে খালটা পেরিয়েই বিশাল বিশাল বৃক্ষ।স্কুলের সামনে নদী। চারদিকে টিনের ঘর, পাতার বেড়া এবং টিনের ঘরের ওপরেই এক সারি আমগাছ।

তারপর ঢাকা শহরে এসেছিলাম। শহরটাও যেন একটা বড় গ্রাম। রমনার একদিকে বিশাল পার্ক, নানা রঙের ফুল, ফলদ গাছ এবং নানা ধরনের বৃক্ষরাজি, মাঝখানে একটা পুকুর, সেখানে পদ্মফুল। অন্য প্রান্তে রেসকোর্সের ময়দান, সেটাও বিশাল। ঘোড়দৌড় তখনো ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাজুড়ে গাছ আর গাছ, কৃষ্ণচূড়া, পলাশ ফুটে থাকত। এই এলাকাটা তখন নতুন শহর। পুরান ঢাকা বুড়িগঙ্গার পাড়ে দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র—এসব থাকার পরেও কিছু বৃক্ষ ছায়া দিত। পথচারীরা বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড গরমে একটুখানি নিশ্বাস নিতে পারত। তখনকার ঢাকায় ছিল নির্মল বাতাস। শহরে শীত নামত অক্টোবর মাসে, ফেব্রুয়ারি পার হয়ে গেলেও শীতটা যাই যাই করত। বর্ষায় প্রবল বৃষ্টিতে ভেসে যেত শহর। শহরের পানি গিয়ে নামত ধোলাইখালে। অসংখ্য নৌকার চলাচল সেখানে।

সেই সময়ে আমাদের গ্রামের বাড়ির সামনে মধুপুরের পাহাড়। শাল-গজারির বন পেরিয়ে গভীর অরণ্যে পৌঁছালে বাঘ, বন্য শূকরের ভয়। আর এই অরণ্যরাজিকে পাহারা দিত বন-পাহাড়ের রক্ষক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ, যারা মান্দি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পরেই ধীরে ধীরে বন উজাড় হতে শুরু করল। মান্দিরা পাহাড় ছেড়ে কোথাও সমতলে চলে যায় অথবা দেশত্যাগী হয় কিংবা জীবিকার সন্ধানে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

অরক্ষিত পাহাড় বন বিভাগের হাতে, তার সঙ্গে আছে রাজনৈতিক প্রভাব। ভুয়া মালিকানা তৈরি করে সমগ্র অরণ্যভূমি ধ্বংস হতে শুরু করল। সেই সঙ্গে পাহাড় কেটে সমতল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এদিকে ঢাকায়ও গাছ কাটা শুরু হয়। হাইকোর্টের উল্টো দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে শতবর্ষী গাছগুলো কেটে ফেলা হয়। গাছ না থাকলে কী হয়—এ রকম একটা ভাবনা এ দেশের কিছু মানুষের আছে বলেই গাছ নিধনযজ্ঞে তারা একেকজন বড় বড় সেনাপতি।

এবার যে গ্রীষ্মের দাবদাহ, তা গত ৩৪ বছরে দেখা যায়নি। দাবদাহ থেকে রক্ষাকারী গাছগুলো নেই। গাছের পাশ দিয়ে গেলেও যে চমৎকার একটা ঠান্ডা অনুভব আসে, তা-ও হারিয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম শহরেও বৃক্ষনিধন চলছে সমানতালে। সাতমসজিদ রোডে তরুণ-তরুণীরা কিছু গাছকে বাঁচানোর আশায় দিন-রাত ক্লান্তিহীন সংগ্রাম করে চলেছেন। আমিও তাঁদের সঙ্গে শরিক হয়েছি এবং প্রেস কনফারেন্স, মানববন্ধনে যোগ দিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে কোনো রকম সাড়া পাওয়া যায়নি।

সিটি করপোরেশনের মেয়র আছেন, অনেক কাউন্সিলর আছেন, ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে বিশাল অট্টালিকায় হাজার হাজার পৌরকর্মী আছেন। তাঁদের একজনও এসে ব্যাখ্যা করলেন না যে, কী কারণে সাতমসজিদে ৬০০ গাছ কেটে ফেলতে হলো। অথচ ২৭ নম্বর রোডে এবং সীমান্ত স্কয়ার (পূর্বের রাইফেল স্কয়ার) মোড়ে ডিভাইডার ও গাছগুলো এখনো অক্ষত আছে। এর আগেও অনেক জায়গায় বৃক্ষনিধনের পরিকল্পনা হয়েছে। আমরা কোথাও গিয়ে দাঁড়িয়েছি। সরকার কখনো কখনো বিবেচনায় নিয়েছে এবং গাছ কাটা বন্ধ করে দিয়েছে।

এবার কী হলো, বোঝা গেল না। পত্রপত্রিকায় এত লেখালেখি, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সচিত্র প্রতিবেদন—এ সবই মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। প্রতিবাদ গায়ে মাখছে না কর্তৃপক্ষ। এই গাছ কাটাতে কার লাভ হলো? হিসাব করলে দেখা যাবে, লাভ ঠিকাদারের এবং যাঁরা কাজটি করাচ্ছেন তাঁদের। ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে শংকর থেকে সীমান্ত স্কয়ার পর্যন্ত ডিভাইডার নির্মাণ করা হচ্ছে! এত টাকাই বা কেন লাগবে? পৌর করপোরেশন বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করবে এবং করপোরেশনের জনপ্রতিনিধিরা এলাকার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এলাকার উন্নয়ন সাধন করবেন। কোনো একটি নির্মাণকাজের জন্য আজ পর্যন্ত নাগরিকদের কাছ থেকে কোনো গণশুনানির আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়নি। এমনিতেই অনেকে শহরটাকে ভালোবাসে না। যারা ভালোবাসে, তারা সেই ভালোবাসার মূল্য পায় না। সবাই শহরটিকে শুধু জীবিকার উৎস মনে করে। এ যেন শুধুই টাকা উপার্জনের একটা স্থান।

নাগরিকদের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের কতটুকু ফাঁকা থাকা দরকার, কতটুকু জলাশয় দরকার, নগরীর ফুসফুস বলে পরিচিত কতগুলো পার্ক দরকার—এসবের হিসাব পৌর করপোরেশনের কাছে থাকা উচিত। নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা দেখার জন্য পৃথিবীতে অসংখ্য পৌরসভা আছে। একেকটা শহর তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেড়ে উঠেছে, শহরবাসী শহরটাকে ভালোবেসে আর পৌরসভার যাঁরা নির্বাচিত ও অনির্বাচিত, তাঁরা নগরীর শোভাবর্ধনে নাগরিকদের অবদানকে স্বীকার করে আরও সম্প্রসারণের কাজে হাত দিয়েছেন।

ঢাকা এখন পৃথিবীর অন্যতম বড় শহর, অন্তত জনসংখ্যার দিক থেকে। কিন্তু এখানে নগর-পরিকল্পনাবিদদের কোনো ভূমিকা নেই। মেঠো পথ যেমন একেবারেই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠে, বড় হয়, ছোট হয়; এখানেও তা-ই হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো প্রতিদিন নিত্যনতুন রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। এই আধুনিককালে শহর মানেই সবুজে আচ্ছাদিত একটা জনপদ। শহরে ট্রাম, বাস, ট্রেন, গাড়ি সবই আছে, কিন্তু চারদিকে সবুজ থাকা চাই। বিষাক্ত বায়ু শুষে নিয়ে নির্মল অক্সিজেন ফেরত দিচ্ছে সবুজ।

মানুষের সুযোগ-সুবিধা যে একেবারেই দেখা হয় না, তার প্রমাণ শংকর থেকে সীমান্ত স্কয়ার পর্যন্ত নির্মিত ডিভাইডার। মাঝে কোথাও গাড়ি পার হওয়ার ব্যবস্থা নেই। একেবারে দুনিয়া ঘুরেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আসতে হয়। রাস্তার দুই পাশে বাচ্চাদের স্কুল আছে, তারা কীভাবে পারাপার হবে, সেটাও কর্তৃপক্ষ ভুলে যায়। সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হচ্ছে, শহরের বিভিন্ন অলিগলি, সর্বত্রই জনসংখ্যার চাপ। রিকশা, গাড়ি এবং নানান ধরনের যানবাহনের কারণে গলিপথটি সব সময়ই ঠাসা থাকে। গলি সম্প্রসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব জায়গায় গাছ লাগানোর উপায়টা কী? পৌর করপোরেশন যদি এলাকায় গিয়ে নাগরিকদের নিয়ে বসে, বিভিন্ন কাজে নাগরিকদের সংযুক্ত করে, নাগরিকেরা ইচ্ছা করে তার সঙ্গে যুক্ত হয়।

কিন্তু এটি একটি স্বপ্ন। কোনো দিন এলাকার কাউন্সিলররা আসতে পারেন না, জনে জনে গিয়ে তাঁদের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। এদের কাছে জনগণ হচ্ছে একটা ভোটের যন্ত্র। নির্বাচনের সময় বাড়ি বাড়ি যাবেন, নানান ধরনের প্রতিশ্রুতি দেবেন, কিন্তু নির্বাচিত হয়েই হাওয়া। এই হাওয়াবাজি অবশ্য সাংসদ, মন্ত্রীরাও করে থাকেন। অধিকাংশ সময়ে শহরে থাকেন, গ্রামে গিয়ে কিছু তয়-তদবিরের কাজ করে আবার ফিরে আসেন। এলাকাটিকে প্রাকৃতিক করার চেষ্টা করেন না; বরং ঢাকায় তদবির, ব্যবসা—এসব করতে ছুটে বেড়ান।

যে বিষয়টি প্রবলভাবে আমাদের জীবনে অবহেলিত দেখেছি, তা হলো সংস্কৃতিচর্চা। এলাকায় একসময় পাঠাগার থাকত, চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা থাকত। পৌরসভার কমিউনিটি সেন্টারে নাটক, গানের আসর বসত—ঈদে, পয়লা বৈশাখে, ষোলোই ডিসেম্বরে, ছাব্বিশে মার্চে। বিশেষ করে একুশে ফেব্রুয়ারিতে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। এখন তা কোথাও কোথাও ইভেন্ট ব্যবস্থাপনায় হয়ে থাকে। একদা বটতলাই ছিল শিল্প-সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র।কলকাতায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে বটতলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটা বড় অবদান রেখেছিল। সেই বটবৃক্ষ আজ কোথায়?

গভীর দুঃখ হয়, যখন দিগন্তব্যাপী বিল্ডিং আকাশকে রুদ্ধ করে দেয়, আমরা সবাই ম্যাচ বাক্সের মধ্যে বসবাস করি, সবুজ দেখতে পাই না। শিশিরভেজা ঘাস দেখতে পাই না, তার জন্য রাষ্ট্র কী আয়োজন রেখেছে? তরুণ-তরুণীরা দিনে প্রখর সূর্যের দাবদাহে এবং রাতে বিনিদ্র রজনী পার করছে এই আশায় যে পৌর করপোরেশনের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। হায়! সেই শুভবুদ্ধি কোথায়? কত দূরে?

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাসার বাথরুমে পড়ে ছিল নারী প্রভাষকের লাশ, মাথায় আঘাতের চিহ্ন

খালেদা জিয়ার জন্য জার্মানি থেকে নয়, কাল কাতার থেকেই আসছে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স

মিরপুরে খাঁচা থেকে বেরিয়ে এল সিংহী, আর চিড়িয়াখানা থেকে দর্শনার্থীরা

ফায়ার সার্ভিসে ৬২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করবে সরকার, বাড়বে সুযোগ-সুবিধা

ভারতকে একঘরে করতে দক্ষিণ এশিয়ায় নয়া জোটের সন্ধানে পাকিস্তান, সফল হবে কি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ