Ajker Patrika

দেশীয় পর্নোগ্রাফিতে নারী বিদ্বেষ বেশি: গবেষণা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
দেশীয় পর্নোগ্রাফিতে নারী বিদ্বেষ বেশি: গবেষণা

বাংলাদেশে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, ওয়েব সিরিজ কিংবা নাটক-সিনেমায় পর্নোগ্রাফির মতো যেসব পরিবেশনা রয়েছে, সেগুলোতে অশ্লীলতার চেয়ে নারীর প্রতি নিন্দা, নির্যাতন বা অপমানসূচক উপাদানই বেশি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য।

২০২১-এর অক্টোবর থেকে ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পরিচালিত এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদিকে যেমন দেশীয় অনলাইন ও মিডিয়াতে নারীর প্রতি অবমাননাকর, নারীর অশালীন দেহ প্রদর্শন, যৌন আবেদনময় ও পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট বাড়ছে, অন্যদিকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে কিছু অল্পবয়সী মেয়ে বা প্রাপ্তবয়স্ক নারী ছেলেদের প্রলুব্ধ করে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টাও করছে। 

আটটি বিভাগের ১৬টি জেলায় ৫১৮ জন বিভিন্ন স্তরের মানুষ এই গবেষণায় অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে ৮১ শতাংশ মনে করেন, যেসব পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট দেশীয়ভাবে নির্মাণ করা হয়, সমাজে সেগুলোর প্রভাব ও বিস্তার খুব বেশি। আর এখানে দেশীয় পর্নোগ্রাফিতে অশ্লীলতার চাইতেও বেশি থাকে নারীকে নিন্দা, নির্যাতন ও অপমান। 

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির সহজ বিস্তার এবং নারীর প্রতি সহিংসতা’ শীর্ষক গবেষণাটির ফলাফল তুলে ধরা হয়। 

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এ গবেষণা করেছে। গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, সমাজে নারীর প্রতি সহিংস ও নির্যাতনমূলক আচরণ বেড়েছে। গবেষণায় অংশ নেওয়া ৮২ শতাংশ মানুষ এমনটা মনে করেন। এমন মত দেওয়ার ব্যক্তিদের মধ্যে নারী ৪০ শতাংশ এবং পুরুষ ৪২ শতাংশ। 

এ ছাড়া মতামত জরিপে দেখা গেছে, ৮১ শতাংশ মানুষ স্বাধীনচেতা মেয়েদের খারাপ মনে করেন। সেসব মেয়েদের নিয়ে অপমানসূচক মন্তব্য ও বাজে ধারণা রাখেন ৩৯ শতাংশ নারী ও ৪২ শতাংশ পুরুষ। 

দেশে অনলাইন পর্নোগ্রাফির গতিপ্রকৃতি ও গভীরতা বোঝা এবং অনলাইনে যেসব মর্যাদাহানিকর বা অবমাননাকর কনটেন্ট আছে সেগুলো কী? যৌনতা এবং কামোত্তেজনা উসকে দেওয়ার কাজে কীভাবে প্রযুক্তি বা তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা বোঝার জন্য মূলত গবেষণাটি করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। 

সেই সঙ্গে এ ধরনের কনটেন্টের যারা ভোক্তা তাঁদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য জানা—কেন তাঁরা নারী সম্পর্কে নেট দুনিয়াতে যেসব অবমাননাকর কনটেন্ট প্রচারিত হচ্ছে, তা দেখছে বা গ্রহণ করছে। পর্নোগ্রাফি দেখার পর এবং কনটেন্টগুলো নারীর প্রতি অবমাননাকর, এটি জানার পর মানুষ কীভাবে নারীর প্রতি আচরণ করে বা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কেমন প্রভাব পড়ে—তা বিশ্লেষণ করাও এ গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল। 

অনলাইন পর্নোগ্রাফির সহজ প্রবেশগম্যতা এবং নারীর প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য বা কনটেন্টের সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংসতার কী সম্পর্ক এবং এর অন্তর্নিহিত কারণ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন গবেষকেরা। এ গবেষণা করতে গিয়ে গবেষকদের দৃষ্টিতে পর্নোগ্রাফি নতুন আঙ্গিকে ও ভিন্নভাবে ধরা পড়েছে। 

বাংলা ভিডিওতে অশ্লীল গল্প বলা, যৌনপল্লি থেকে সরাসরি, অশ্লীল খবর ও গল্প, বাংলা ইমোতে ভিডিও সেক্স, ওয়েব সিরিজগুলোতে অশ্লীলতা, বাংলা যৌন কামনা উদ্রেককারী ব্লগ, বাংলা ইমো ভিডিও সেক্স প্রমোশন, রিয়াল অ্যান্ড ভার্চ্যুয়াল সেক্স সার্ভিস গ্রুপস ইন ফেসবুক, ইমো সেক্স সার্ভিস কাস্টমার ফেসবুক অ্যান্ড অথেনটিকেশন ইত্যাদি উৎস থেকে দেশে পর্নোগ্রাফি ছড়ানো হচ্ছে। 

গবেষকেরা বলছেন, অনলাইনে নারীর অবমাননাকর যে ভাবমূর্তি দেখানো হয়, তা সমাজে প্রচলিত ‘মন্দ মেয়ের’ ভাবমূর্তিকে আরও পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করছে। বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফি ও অনলাইনে নারীবিষয়ক কী কী কনটেন্ট রয়েছে, তা খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, নারীর প্রতি টিটকারি, অবমাননা, প্রতিশোধ, ভার্চ্যুয়াল সেক্স, সেক্স ট্রেড প্রোমো, অশ্লীলতা এবং নিউজ প্রোমো এতে স্থান পাচ্ছে। 

জরিপে দেখা গেছে, সমাজে ছাঁচে ফেলা ‘ভালো’ ও ‘মন্দ’ মেয়ের ধারণা লালন করেন ৭৯ শতাংশ মানুষ। ৫২ শতাংশ মানুষ মনে করেন, নারীদের মিডিয়ায় বা সিনেমায় কাজ করা, পুরুষের সঙ্গে রাতের শিফটে কাজ করা বা দূর-দুরান্তে একসঙ্গে ভ্রমণ বা কাজে যাওয়া ঠিক নয়। এর মধ্যে ২১ শতাংশ নারী এবং ৩১ শতাংশ পুরুষ এমন ধারণা পোষণ করেন। 

এ ছাড়া যেসব মেয়ে আচরণে ও পোশাকে সামাজিক প্রথা মানে না, স্বাধীনভাবে চলতে চায় এবং আচরণে নারী-পুরুষ ভেদ করে না বলে মনে হয়, তাদের প্রতি মানুষ কটূক্তি, সমালোচনা, তির্যক মন্তব্য ও অপমানজনক আচরণ করতেই পারে—এমন মনে করেন ৬৪ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে নারী শতকরা ২৯ জন ও পুরুষ শতকরা ৩৪ জন। 

গবেষণায় উঠে এসেছে, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা স্মার্টফোনে মোবাইল ডেটা বেশি ব্যবহার করে। তবে মন্দ কনটেন্ট যেমন, প্রাপ্তবয়স্কদের সিনেমা, ন্যুডিটি, পর্নোগ্রাফি দেখে ৭৫ শতাংশ ছেলে। আর টিকটক, লাইকি ও ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রতি নারী-কিশোরীদের আগ্রহ বেশি। 

যেসব মেয়ে স্বাধীনচেতা, সমাজে যাদের মন্দ মেয়ে হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাদের কারণে অন্য ছেলে-মেয়েরা নষ্ট হয়ে যাবে বলে ধারণা পোষণ করেন ৭৯ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে নারী ৪৪ শতাংশ ও পুরুষ ৪৬ শতাংশ। আর তাই অনলাইনে ‘মন্দ মেয়ের’ মতো আচরণ যারা করে, তাদের এসব কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য তাকে হেয় করা, মন্দ বলা ও অপমানজনক আচরণ করা সমাজের জন্য উপকারী বলে মনে করেন ৪৪ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে নারী ১৮ ভাগ ও পুরুষ ২৫ ভাগ। 

যখন কেউ ‘মন্দ’ মেয়ে বা নারীর মতো আচরণ করেন, তখন তার প্রতি বিরূপ মন্তব্য, টিটকারি দেয় ৭১ শতাংশ পথচারী, এর মধ্যে শতকরা ৩৩ জন নারী ও ৩৮ জন পুরুষ। শতকরা ৭৫ জন প্রতিবেশী, পরিবারের সদস্য শতকরা ৪৮ জন, আত্মীয় শতকরা ৬৪ জন এবং অপরিচিত মানুষ ৬৩ জন। 

গবেষণা উপস্থাপন অনুষ্ঠানটি মডারেট করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। বক্তব্য দেন অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সিপি অ্যান্ড সিআরজি, রেহনুমা ই জান্নাত, সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলর এবং সিনিয়র সাংবাদিক নওরোজ ইমতিয়াজ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে। গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই বিশেষ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

আজ বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এ সারা দেশে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২ লাখ ৫৮ হাজার ১৬৮টি মোটরসাইকেল ও ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪১১টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ৩ হাজার ৩৯৪টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

বিষয়:

অপরাধ
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে গত রোববার বিকেল থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২৮ হাজার ৭৬৬টি মোটরসাইকেল ও ৪৩ হাজার ৩৫২টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ২৯১টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

হাদিকে গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন ফয়সাল ওরফে দাউদ কে, মাস্ক পরা ব্যক্তিটিই কি তিনি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩: ০৫
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আলোচিত মুখ ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমে বহুল আলোচিত নাম ফয়সাল করিম মাসুদ কিংবা দাউদ খান। গতকাল শুক্রবার হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই এই দুই নামে এক ব্যক্তির ছবি ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।

হাদিকে গুলির ঘটনায় মাস্ক পরা দুই তরুণ জড়িত বলে তাঁর সহযোদ্ধাদের সন্দেহ। তাঁদের দাবি, কয়েকদিন ধরে দুই তরুণ মাস্ক পরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদির সঙ্গে গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন। বার বার তাঁদের মাস্ক খুলতে বলা হলেও তাঁরা রাজি হননি। হাদিঘনিষ্ঠদের সন্দেহ, এই তরুণরা হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর গতিবিধি বোঝার জন্য তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন।

দুজনের মধ্যে মাস্ক পরা একজন হাদির পাশে বসে আছে— এমন একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই তাকে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে মাস্ক করা এই তরুণই যে হাদিকে গুলি করেছেন, কিংবা এই তরুণই যে ফয়সাল, তা নিশ্চিত করে বলছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে শনাক্ত একজনের ছবি প্রকাশ করে ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ডিএমপির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তদের হামলায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেফতারে রাজধানীতে জোর অভিযান পরিচালনা করছে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ছবির ব্যক্তিকে প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করা গেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ তাকে হন্য হয়ে খুঁজছে। উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে কোন তথ্য থাকলে বা তার সন্ধান পেলে দ্রুত নিম্নলিখিত মোবাইল নম্বর অথবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে জানানোর জন্য বিনীত অনুরোধ করা হলো।’

পুলিশের বিবৃতিতে এই তরুণের নাম উল্লেখ করা না হলেও ছবি দেখে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ বলে আন্দাজ করা যায়। এই তরুণকেও আগে হাদীর সঙ্গে দেখা গেছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে হাদির সঙ্গে গণসংযোগে থাকা মাস্ক পরা তরুণটিই ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ এমন কোনো তথ্য পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম। সেই আলোচনার ছবিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

ফয়সাল করিম নামের তরুণ কার্যক্রমনিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধঘোষিত সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৯ সালের ১১ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সদস্য হন। তাঁর পুরো নাম ফয়সাল করিম দাউদ খান।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা–৮ সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদি। হাদিকে বহনকারী রিকশাকে অনুসরণ করে পেছন দিকে থেকে মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে গুলি করে চলে যায় আততায়ীরা। হাদি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার নামে ওসমান হাদির প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সঙ্গে ফয়সাল করিমের কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই ছবিগুলোতে থাকা ফয়সাল করিমের সঙ্গে মাস্ক পরা ব্যক্তির চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য আছে। সেকারণে গুলি ছোড়ার ঘটনায় তাঁকে সন্দেহ করা হচ্ছে।

এর মধ্যেই দুপুরে ডিএমপি সন্দেহভাজনকে শনাক্তের কথা জানায় এবং ওসমান হাদিকে গুলি করা ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।
গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।

আলোচিত ফয়সাল করিম কে?

পেশাদারদের যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনে ফয়সাল করিমের নামে প্রোফাইল আছে। সেখানে তিনি নিজেকে অ্যাপল সফট আইটি, ওয়াইসিইউ টেকনোলজি ও এনলিস্ট ওয়ার্ক নামে তিন প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

লিংকডইন প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম ২০১৩ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। পরে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমবিএ করেছেন বলে সেখানে উল্লেখ রয়েছে।

২০২৪ সালে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীদের দমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের সঙ্গে মাঠে ছিলেন বলে ছাত্রলীগের সূত্র জানিয়েছে।

ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় নাম আসার পর ফয়সাল করিমের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশের দুইবারের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতার ছবি ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে হাদির সঙ্গে ঢাকা–৮ আসনে গণসংযোগ এবং বাংলামোটরে হাদির প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারের আড্ডায় ফয়সালের অংশ নেওয়ার ছবিও ভাইরাল হয়েছে। অনেকে ধারণা করছেন, ফয়সাল করিম ওসমান হাদিকে বেশ কিছুদিন ধরে অনুসরণ করছিলেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সহযোগিতা ও সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ‘ব্যাটল অব ৭১’ নামে একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করেছিল ফয়সাল করিমের মালিকানাধীন ওয়াইসিইউ টেকনোলজি লিমিটেড। সে বছরের নভেম্বরে ওই গেমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেসিসের তৎকালীন সভাপতি এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও উপস্থিত ছিলেন।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা ও সমন্বয়ক কমিটি’ করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ঢাকা–১২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এই আসনের সমন্বয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন ফয়সাল করিম।

অভ্যুত্থানের অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার ফয়সালের দ্রুত জামিন নিয়ে প্রশ্ন সবার

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় আদাবর থানার মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ফয়সাল করিম।

মামলা হওয়ার কিছুদিন পর ৭ নভেম্বর আদাবর এলাকা থেকে ফয়সাল করিমকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁর কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও পাঁচটি গুলিও উদ্ধার করা হয়। ওই মামলায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ফয়সাল করিম। জামিনের সময়সীমা বাড়াতে গত ১২ আগস্ট আবারও আবেদন করলে হাইকোর্ট নতুন করে তাঁর এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন।

জামিনে থাকা অবস্থায় এবার তাঁর বিরুদ্ধে ওসমান হাদিকে গুলি করার অভিযোগ এল। এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কীভাবে জামিন পেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ, কোনো অপরাধমূলক কাজের প্রমাণ না থাকলেও অভ্যুত্থানের পর শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা সভা করায় গ্রেপ্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকের জামিন বারবার নাকচ করা হয়েছিল। আর এ রকম লুটের ঘটনায় দুটি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে এতো দ্রুত জামিন দেওয়া হলো কীভাবে, সেই প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন আলোচনা–সমালোচনায় সরব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

খুনের পর মোবাইল, ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট, ‘গৃহকর্মী আয়েশা’র পরিচয় মেলেনি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯: ৫৭
ছবি: সিসিটিভির ফুটেজ থেকে নেওয়া
ছবি: সিসিটিভির ফুটেজ থেকে নেওয়া

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মা-মেয়েকে খুন করার পর কথিক গৃহকর্মী আয়েশা ওই বাসা থেকে একটি মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, বেশ কিছু স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট করেন। এ ঘটনায় গতকাল সোমবার রাতে মোহাম্মদপুর থানায় করা হত্যা মামলার এজাহারে এই দাবি করা হয়েছে। তবে আয়েশা নামে পরিচয় দেওয়া ওই তরুণীর প্রকৃত পরিচয় মেলেনি এখনো।

স্ত্রী লায়লা আফরোজ (৪৮) ও মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজ (১৫) হত্যার ঘটনায় গতকাল মামলাটি করেন নাটোরের স্থায়ী বাসিন্দা আ জ ম আজিজুল ইসলাম। মামলায় কথিত গৃহকর্মী মোছা. আয়েশাকে (২০) একমাত্র আসামি করা হয়েছে। তবে এজাহারে তাঁর বাবার নাম ও ঠিকানায় ‘অজ্ঞাত’ লেখা হয়েছে।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে আজকের পত্রিকাকে মামলার এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রকিবুজ্জামান তালুকদার। গতকাল সকাল ৭টা ৫১ মিনিট থেকে ৯টা ৩৫ মিনিটের মধ্যে যেকোনো সময় এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।

এজাহারে বাদী আজিজুল লিখেছেন, তিনি পেশায় একজন শিক্ষক। মোহাম্মদপুরে পরিবার নিয়ে থাকেন। চার দিন আগে উল্লিখিত আসামি তাঁর বাসায় খণ্ডকালীন গৃহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। গতকাল সকাল ৭টার দিকে তিনি (আজিজুল) তাঁর কর্মস্থল উত্তরায় চলে যান। কর্মস্থলে থাকাকালে তিনি তাঁর স্ত্রীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

পরে তিনি বেলা ১১টার দিকে বাসায় আসেন। এসে দেখতে পান, তাঁর স্ত্রীর গলাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কাটা। স্ত্রী রক্তাক্ত জখম হয়ে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন আর মেয়ের গলার নিচে ডান পাশে কাটা। মেয়ে গুরুতর অবস্থায় বাসার প্রধান ফটকে পড়ে আছে। মেয়ের এই অবস্থা দেখে তিনি দ্রুত তাকে উদ্ধার করেন। পরিচ্ছন্নতাকর্মী আশিকের মাধ্যমে মেয়েকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

মামলায় আজিজুল আরও লিখেছেন, তিনি বাসার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করেন। এতে তিনি দেখতে পান, আসামি সকাল ৭টা ৫১ মিনিটের সময় কাজ করার জন্য বাসায় আসেন। সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটের সময় আসামি তাঁর (বাদী) মেয়ের স্কুলড্রেস পরে বাসা থেকে পালিয়ে যান। যাওয়ার সময় একটি মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থসহ অন্যান্য মূলবান সামগ্রী নিয়ে যান আসামি।

মামলায় বাদী লিখেছেন, সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে তিনি নিশ্চিত হন যে, অজ্ঞাত কারণে আসামি তাঁর (বাদী) স্ত্রী ও মেয়েকে ছুরি বা অন্য কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে গুরুতর জখম করে হত্যা করেন।

মা-মেয়ে হত্যার আসামিকে শনাক্ত করা যায়নি। মোহাম্মদপুর থানা-পুলিশ জানায়, গৃহকর্মীর পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশ চেষ্টা চালাচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত