Ajker Patrika

অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণে ভালো কোম্পানি, বিনিয়োগকারী সংকট ও প্রাইস বাবলের ঝুঁকি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ২০: ৩০
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হলে কোম্পানিকে টানা পাঁচ বছর প্রবৃদ্ধি দেখাতে হবে, আইপিওর টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা যাবে না, বোনাস শেয়ার ইস্যুর পর দুই বছর আইপিও আবদেন করতে পারবে না এবং তালিকাভুক্তির পর ছয় মাস শেয়ার লক-ইন থাকবে বা বিক্রি করা যাবে না। প্রস্তাবিত নতুন পাবলিক ইস্যু রুলস বা আইপিও নীতিমালায় এমন কঠোর ও জটিল শর্ত রাখা হয়েছে। এসব আইন কার্যকর হলে আইপিও আবেদনের পথ সংকুচিত হবে। ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তি বাধাগ্রস্ত হবে। সাপ্লাই সংকট তৈরি হয়ে ‘প্রাইস বাবলের’ ঝুঁকিও বাড়বে। নতুন বিনিয়োগকারীও তৈরি হবে না।

আজ বুধবার রাজধানীর নিকুঞ্জে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) টাওয়ারে ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক অফার অব ইক্যুইটি সিকিউরিটিজ) রুলস, ২০২৫’—এর ওপর অংশীজন (স্টেকহোল্ডার) পরামর্শ সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। ডিএসই এবং ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করে।

সভায় বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ (বিএপিএলসি), বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ), ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজের (বিএপিআই) প্রতিনিধি ও পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্টরা অংশ নেন।

সভায় ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চাই মার্কেটে রেগুলেশন আসুক। কিন্তু নীতিমালার যে প্রধান উদ্দেশ্য, সেটি যেন বাস্তবায়ন হয়। আমরা দেখেছি, দীর্ঘ দুই দশকে শেয়ার মার্কেটে ভালো কোম্পানি খুব কম এসেছে। ফলে মার্কেটে ভালো কোম্পানি কীভাবে আনা যায়, সেটি আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।’

ডিবিএ প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মনে করে যে আমাদের পাবলিক ইস্যু রুলস জটিল। দেশের শেয়ারবাজারকে এগিয়ে নিতে তারা এটিকে এশিয়ার অন্যদেশগুলোর মতো করার মত দিচ্ছেন।’

১৫ বছর আগেও ভিয়েতনামের অবস্থান বাংলাদেশের মতো ছিল উল্লেখ করে সাইফুল ইসলাম বলেন, এখন তারা অনেক এগিয়ে গেছে, অথচ আমরা এগোতে পারিনি। বরং পিছিয়ে গিয়েছি। ভালো কোম্পানি বাজারে আনার জন্য পাবলিক ইস্যু রুলস খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিএসইসিকে পাবলিক ইস্যু রুলস সহজ করার পরামর্শ দিয়ে ডিবিএ সভাপতি সাইফুল বলেন, ‘এটি চূড়ান্ত করার পূর্বে বিএসইসির কাছে আমাদের দাবি, তারা যেন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে। যদি কোনো বিষয় থাকে যেগুলো স্টেকহোল্ডাররা বলার পরও আইনে পরিবর্তন আনা যাবে না, তার কারণগুলো যেন জানানো হয়।’

তিনি যোগ করেন, আমরা চাই, শেষ পর্যন্ত এটি যেন এমন আইন হয়, যার মাধ্যমে ভালো কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসতে উদ্ধুদ্ধ হবে।

ডিএসইর পরিচালক রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, আইন যত জটিল হবে, তত বেশি ভুল ও ওয়েভারের সুযোগ তৈরি হবে। একটা কোম্পানিকে ২০ থেকে ৩০টা ওয়েভার দিয়ে যদি বাজারে তোলা হয়, তাহলে আইন থাকার লাভ কী? বিএসইসি, ডিএসই ও অডিটর—এই তিনটি মূল জায়গা ঠিক হলে অর্ধেক সমস্যা এমনিতেই সমাধান হয়ে যাবে।

রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, অতীতে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবী, যাদের শেয়ারবাজার নিয়ে কোনো ধারণা নেই, তারা আইপিওর মাধ্যমে স্টক মার্কেট সম্বন্ধে প্রথমে ধারণা নেয়। তারপরে তারা একসময় স্থায়ীভাবে বিনিয়োগকারী হিসেবে সেকেন্ডারি মার্কেটে ব্যাপকভাবে আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু এই প্রাথমিক এন্ট্রি লেভেলকেই যদি বন্ধ করে দেই, তাহলে আমরা বিনিয়োগকারী পাব কোথা থেকে? সাধারণ বিনিয়োগকারী হিসেবে আইপিওতে আবেদন করতে হলে ৫০ হাজার টাকার বিনিয়োগ বা শেয়ার থাকতেই হবে, এটা সম্পূর্ণভাবে অন্যায়।

ডিএসইর পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, এত বেশি আইন, ডাইরেক্টিভ দিয়ে ব্যবসা হয় না। ব্যবসা হতে হবে ওপেন মার্কেট। এখানে সকলকে সুযোগ দিতে হবে। ভুল হলে টিচার বা ডাক্তারের যে অ্যাপ্রোচ, সেভাবে এগুতে হবে।

বিএমবিএ প্রেসিডেন্ট মাজেদা খাতুন বলেন, গত দেড় বছরে বিএমবিএর পক্ষ থেকে রুলস সংশোধনের বিষয়ে বহু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব চূড়ান্ত খসড়ায় যুক্ত হয়নি।

মাজেদা খাতুন আরও বলেন, কোনো অনিয়ম ঘটলে পরে আইন প্রয়োগ তথা শাস্তি দেওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বরং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ইস্যু ম্যানেজারের ওপর অতিরিক্ত দায় চাপানোর প্রবণতা থেকে বের হতে হবে। কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে তাদের মনিটরিংয়ের দায়িত্ব স্টক এক্সচেঞ্জ ও রেগুলেটরের। সেই জায়গায় ইস্যু ম্যানেজারের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে তা বাস্তবসম্মত হবে না।

প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, খসড়া নীতিতে থাকা কিছু ধারা কার্যকর হলে ভালো মানের কোম্পানির আইপিও প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে।

মনিরুজ্জামান আরও বলেন, প্রস্তাবিত নীতিতে পাঁচ বছরের হিস্টোরিকাল গ্রোথ রেটকে ভিত্তি ধরার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। এটি যৌক্তিক না। এটি তিন বছরের জন্য করা যেতে পারে।

মনিরুজ্জামান আরও বলেন, প্রস্তাবিত নীতিতে আইপিও তহবিল দিয়ে লোন রিপেমেন্ট নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে আইপিও অনুমোদনে অনেক সময় লাগে। উদ্যোক্তা প্রকল্প চালাতে বাধ্য হয়ে ব্যাংক ঋণ নেন। পরে সেই ঋণ শোধ করার সুযোগ না দিলে তারা আরও বিপাকে পড়বে। এ ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ লোন রিপেমেন্ট অনুমোদন করা যেতে পারে।

মনিরুজ্জামান উল্লেখ করেন, খসড়া নীতিমালায় আছে, কোনো কোম্পানি যদি বোনাস শেয়ার বা শেয়ার–স্ট্রাকচারে পরিবর্তন আনে, তাহলে তারা দুই বছর আইপিওতে আসতে পারবে না। আইপিওর প্রস্তুতির সময় কোম্পানির বোর্ড পরিবর্তন, পেইড–আপ ক্যাপিটাল বাড়ানো কিংবা বোনাস শেয়ার দেওয়া খুবই স্বাভাবিক। ফলে এই বিধান কার্যকর হলে আগামী দুই–তিন বছর প্রায় কোনো নতুন আইপিও দেখা যাবে না।

ঢাকা ব্যাংক সিকিউরিটিজের এমডি নাফিজ-আল-তারিক বলেন, অনেক এলিজিবল ইনভেস্টরের আর্থিক অবস্থা নাজুক। যদি ছয় মাসের লক-ইন সময়ের নিয়ম বহাল থাকে, তাহলে এক একটি আইপিও থেকে অর্থ ফেরতে আট থেকে সাড়ে আট মাস সময় লেগে যাবে। এতে নতুন আইপিওতে অংশ নেওয়ার সুযোগ কমে যাবে এবং ডিমান্ড–সাইড দুর্বল হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে ছয় মাস সেল–রেস্ট্রিকশন থাকার কারণে সাপ্লাই সংকট তৈরি হয়ে স্বল্প সময়ে ‘প্রাইস বাবল’ তৈরি হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, আইপিওতে ৫০ শতাংশ শেয়ার লক-ইনমুক্ত রাখা যায় এবং তিন মাস পর বাকি ১০০ শতাংশ লক-ইন কার্যকর করা যায়।

নাফিজ আরও বলেন, সরাসরি তালিকাভুক্তি (ডিরেক্ট লিস্টিং) শুধু সরকারি কোম্পানির জন্য নয়, মাল্টিন্যাশনাল ও বড় করপোরেটগুলির জন্যও উন্মুক্ত করা উচিত। অনেক বড় কোম্পানির নতুন মূলধনের প্রয়োজন নেই। তাই তাদের বাজারে আনতে হলে ডাইরেক্ট লিস্টিং–ই কার্যকর পথ।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের এমডি ও সিইও কায়সার হামিদ বলেন, খসড়া রুলসে এমন ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে যা ইস্যুয়িং কোম্পানিকে সবসময় ‘লাভজনক প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে ধরে নেয়, কিন্তু বাস্তবে যে কোনো ব্যবসায়ই লাভ–ক্ষতি দুই-ই হতে পারে। আমরা যারা ব্যবসা করি, আমাদের শেয়ারহোল্ডাররা বছরের পর বছর সঙ্গে থাকেন। তাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রুলসে দেখা যাচ্ছে না।

কায়সার আরও বলেন, ‘কোম্পানি কতটুকু ব্যাংক ঋণ নেবে, কতটুকু ইক্যুইটি রাখবে—এসব নির্ধারণ হয় বাজার ও ব্যবসার প্রয়োজন অনুসারে। রুলস দিয়ে বলা যাবে না যে, আপনি ব্যাংক লোন পে করতে পারবেন না।

পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট নতুন বিধিমালা প্রণয়নে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বাজারকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে জানান সংস্থাটির অতিরিক্ত পরিচালক লুৎফুল কবীর। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন একটি শিফটিং প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। আগে রুলস ছিল অনেকটাই নির্দিষ্ট কাঠামোর, কী করা যাবে আর কী করা যাবে না। নতুন রুলস বাজার চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি হচ্ছে। তাই আপনাদের প্রতিটা মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ