Ajker Patrika

ট্রাম্পের নতুন ভিসানীতিতে হুমকির মুখে ভারতের ২৮৩ বিলিয়ন ডলারের আইটি শিল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি। ছবি: সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের ২৮৩ বিলিয়ন ডলারের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে তাদের বহু দশকের পুরোনো কৌশল বদলাতে হবে। কারণ, গতকাল রোববার থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন এইচ-১বি ভিসার জন্য ১ লাখ ডলার ফি আরোপ করেছেন। বিশ্লেষক, আইনজীবী, অর্থনীতিবিদ এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অভিজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে দক্ষ হয়ে দেশে ফেরার মাধ্যমে দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে ঘুরিয়ে দেওয়ার ভারতীয় কৌশলকে বড় ধাক্কা দেবে।

ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মোট আয়ের প্রায় ৫৭ শতাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। দেশটি বহুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম ভিসা কর্মসূচি ও সফটওয়্যার ও ব্যবসায়িক সেবা আউটসোর্সিং খাত থেকে উপকৃত হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক মানুষ চাকরি হারানোর কারণে বিষয়টি সব সময় বিতর্কিত থেকেছে।

গত বছর এইচ-১বি ভিসার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী দেশ ছিল ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, অনুমোদিত ভিসাধারীদের মধ্যে ৭১ শতাংশই ভারতীয়। দ্বিতীয় স্থানে থাকা চীনের অংশীদারত্ব ছিল মাত্র ১১ দশমিক ৭ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের এইচ-১বি কর্মসূচি নিয়ে নতুন পদক্ষেপের ফলে অ্যাপল, জেপিমর্গান চেজ, ওয়ালমার্ট, মাইক্রোসফট, মেটা ও অ্যালফাবেটের গুগলের মতো ক্লায়েন্ট থাকা ভারতীয় আইটি কোম্পানিগুলোকে অনশোর রোটেশন থামাতে হবে, অফশোর সেবা বাড়াতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও গ্রিন কার্ডধারীদের নিয়োগ বাড়াতে হবে।

হাতছাড়া হচ্ছে ‘আমেরিকান ড্রিম’

ভারতীয় আইটি আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান জেনসারের সাবেক প্রধান নির্বাহী গণেশ নটরাজন বলেছেন, কর্মীদের জন্য ‘আমেরিকান ড্রিম’ বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। তিনি আরও বলেন, এখন মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো সীমান্ত পারাপারের ভ্রমণ সীমিত করবে এবং ভারত, মেক্সিকো, ফিলিপাইনের মতো দেশ থেকেই বেশি কাজ করিয়ে নেবে।

টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেস (টিসিএস), ইনফোসিস, এইচসিএলটেক, উইপ্রো ও টেক মাহিন্দ্রা—এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলেও তারা কোনো মন্তব্য করেনি। শিল্প সংগঠন ন্যাসকম জানিয়েছে, এ পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভাবন-ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলতে পারে এবং অনশোর প্রকল্পে ব্যবসার ধারাবাহিকতা ব্যাহত করতে পারে।

এমকেই গ্লোবালের প্রধান অর্থনীতিবিদ মাধবী অরোরা বলেছেন, ‘সেবা রপ্তানিও এখন বৈশ্বিক বাণিজ্য ও প্রযুক্তি যুদ্ধে টেনে আনা হয়েছে।’ তিনি জানান, এর ফলে আইটি খাতের অনসাইট-অফশোর মডেল ব্যাহত হতে পারে, মুনাফার ওপর চাপ তৈরি করতে পারে এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় জটিলতা তৈরি করতে পারে।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ট্রাম্পের পদক্ষেপ ক্লায়েন্টের সঙ্গে ভারতীয় কর্মীদের সামনাসামনি ভূমিকা সীমিত করবে। এতে আইটি চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার গতি কমে যাবে এবং প্রকল্প বড় আকারে নেওয়ার প্রক্রিয়াও দীর্ঘ হবে। এই বিষয়ে এইচএফএস রিসার্চের প্রধান নির্বাহী ফিল ফারশ্ট বলেছেন, ‘ক্লায়েন্টরা আইটি প্রকল্পের পুনঃ মূল্যায়ন চাইবে অথবা আইনগত স্পষ্টতা না আসা পর্যন্ত শুরুর তারিখ পিছিয়ে দেবে। কিছু প্রকল্প নতুনভাবে পরিকল্পনা করা হবে যাতে অনশোর কর্মী কম লাগে। আবার কিছু প্রকল্প শুরু থেকেই অফশোর বা নিকটবর্তী দেশে সরিয়ে নেওয়া হবে।’

ভবিষ্যতে কেবল গুরুত্বপূর্ণ পদেই এইচ-১বি ভিসা

যুক্তরাষ্ট্রের আইটি খাতকে এইচ-১বি ভিসা অপব্যবহারের অভিযোগ এনে ট্রাম্পের ঘোষণায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এতে ভিসার আবেদনকারীদের কাছ থেকে আইনজীবীরা বিপুলসংখ্যক কল পান। তারা জানান, নতুন ভিসা ফি অনেক বেশি।

মার্কিন আইনি পরামর্শক সংস্থা গোয়েল অ্যান্ড অ্যান্ডারসনের ম্যানেজিং পার্টনার ভিক গোয়েল বলেন, ‘আমরা আশা করি, প্রতিষ্ঠানগুলো ভিসা স্পনসর করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি বাছাই করা হবে। শুধু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদেই এইচ-১বি ফাইল করা হবে।’ তিনি জানান, এতে অনেক দক্ষ বিদেশি নাগরিকের জন্য ভিসার সুযোগ কমে যাবে এবং নিয়োগদাতাদের চাহিদা নতুনভাবে গড়ে উঠবে।

অনেক অভিবাসন আইনজীবী আশা করছেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দ্রুত মামলা করা হবে। অ্যালকর্ন ইমিগ্রেশন ল ফার্মের প্রধান নির্বাহী সোফি অ্যালকর্ন বলেন, ‘আমরা আশা করছি, এই সপ্তাহেই বেশ কিছু মামলা করা হবে।’

ভারতের আইটি খাতের জন্য এই নতুন চ্যালেঞ্জ এসেছে এমন সময়ে যখন দেশটি আউটসোর্সিং পেমেন্টে ২৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে দুর্বল রাজস্ব প্রবৃদ্ধি, অপ্রয়োজনীয় প্রযুক্তি খাতে খরচ কমানো, মুদ্রাস্ফীতি ও শুল্ক অনিশ্চয়তার চাপও মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যশোরের খেজুর রস: লক্ষ্য ১২০ কোটি টাকার গুড় উৎপাদন

জাহিদ হাসান, যশোর
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

শীতের রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই যশোরের গ্রামাঞ্চলে শুরু হয় ব্যস্ততা। খেজুরগাছের নিচে হাজির হন গাছিরা। আগের বিকেলে কাটা গাছের ‘চোখ’ বেয়ে সারা রাত মাটির হাঁড়িতে জমেছে সুমিষ্ট খেজুর রস। ভোরে সেই রস নামিয়ে শুরু হয় আরেক কর্মযজ্ঞ; চুলায় জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজ। বাড়ির নারীরাই মূলত এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন। কয়েক ঘণ্টা জ্বালানোর পর তৈরি হয় সুস্বাদু খেজুর গুড় ও পাটালি।

শীত মৌসুম এলেই এমন দৃশ্য দেখা যায় খেজুর গুড়ের জেলা খ্যাত যশোরের প্রায় প্রতিটি গ্রামে। সম্প্রতি যশোরের খেজুর গুড় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় এর ঐতিহ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও নতুন করে সামনে এসেছে।

উৎপাদন ও বাজারের চিত্র

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে যশোরে প্রায় ১২০ কোটি টাকার খেজুর রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল করবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

বর্তমানে খেজুরের কাঁচা রস প্রতি মাটির হাঁড়ি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, দানা গুড় প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা এবং পাটালি প্রতি কেজি ৪৫০-৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারদর বাড়লেও গাছিরা বলছেন, শ্রম ও ঝুঁকির তুলনায় লাভ সীমিত।

গাছির সংকট বড় চ্যালেঞ্জ

যশোর সদর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের গাছি আজিবর প্রায় ৩৫ বছর ধরে খেজুর গাছ কাটছেন। তিনি বলেন, ‘আগে দেড় শ গাছ কাটতাম, এখন বয়সের কারণে ৩৫-৪০টার বেশি পারি না। রস ও গুড়ের দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু কাটার মতো গাছ কমে গেছে। আবার গাছ থাকলেও দক্ষ গাছির অভাব। এবার বেশি শীত পড়ায় রসও ভালো নামছে, গুড়ের উৎপাদনও বেশি।’

গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

মনিরামপুর উপজেলার সরসকাটি গ্রামের গাছি অতিয়ারও প্রায় ৪০ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত। তিনি বলেন, এবার ৫০টা গাছ কাটছি। প্রতিদিন ৮-১০ কেজি গুড় তৈরি হয়। কাজটা খুব কষ্টের। তবে শীত মৌসুমে এই আয়েই পুরো বছরের সংসার চলে।

ই-কমার্সে বাড়ছে চাহিদা

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, যশোর জেলায় মোট খেজুরগাছের সংখ্যা ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫। এগুলোর মধ্যে চলতি মৌসুমে রস আহরণের উপযোগী গাছ রয়েছে ৩ লাখ ৭ হাজার ১৩০টি।

উৎপাদিত গুড় প্রথমে স্থানীয় হাটে বিক্রি হয়, পরে পাইকারদের মাধ্যমে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। যশোরের খেজুর গুড় এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। পাশাপাশি ই-কমার্স ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক উদ্যোক্তাদের হাত ধরে গুড় ও পাটালি সরাসরি ভোক্তার ঘরে পৌঁছানো হচ্ছে। এতে বাজার যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান।

কৃষি বিভাগের উদ্যোগ

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, যশোরের খেজুর গুড়ের স্বাদ ও মানের কারণে চাহিদা সব সময় বেশি। এবার শীত বেশি হওয়ায় রসের পরিমাণ ও মান—দুটোই ভালো। চলতি মৌসুমে প্রায় ১২০ কোটি টাকার রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নিরাপদ খেজুর রস এবং গুড় উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গাছিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামি ১০ ও সরকারি ৬ ব্যাংক: ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা 
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২৭
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা

দেশের ব্যাংকিং খাতের ভেতরে জমে থাকা অনিয়ম, রাজনৈতিক আশ্রয় ও কৃত্রিম হিসাবের পর্দা চলতি বছর যেন একে একে সরে যেতে শুরু করেছে। আর তাতেই সামনে এসেছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। সরকারি ও শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের ভারে এখন কার্যত দিশেহারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশে, আর ইসলামি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা আরও বেশি—৫৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, এই দুটি খাতেই বিতরণ করা ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। যেখানে বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপির হার ৪১ দশমিক ৯৫ ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপির হার মাত্র ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শরিয়াহভিত্তিক ১০টি ইসলামি ব্যাংক মোট ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ঋণ বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, প্রতি ১০ টাকার প্রায় ৬ টাকাই এখন আদায় অনিশ্চিত। সেই তুলনায় শরিয়াহসহ দেশীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এই তুলনাতেই স্পষ্ট, খেলাপির বোঝা এককভাবে সবচেয়ে বেশি ইসলামি ব্যাংকগুলোর ঘাড়েই।

সরকারি ছয় ব্যাংকের অবস্থাও খুব একটা ভিন্ন নয়। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় অর্ধেকই সেখানে অনাদায়ি। ব্যাংকার ও বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট রাতারাতি তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে দুর্বল তদারকি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে আড়াল করার প্রবণতা ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলোকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, খেলাপি ঋণের এত উচ্চ হার শুধু ব্যাংকিং খাতের ভেতরের সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি। ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে পারছে না, বিনিয়োগ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে, শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ থেমে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। তাঁর মতে, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ঋণ আদায়ে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।

ইসলামি ব্যাংকিং খাতে এস আলম, নাসা ও বেক্সিমকো গ্রুপের নাম বারবার আলোচনায় এসেছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন সরকারি মদদে এসব গ্রুপ বিপুল ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। এখন সেই বাস্তবতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতের চিত্র আরও উদ্বেগজনক। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর যে অপচেষ্টা ছিল, তা এখন ভেঙে পড়েছে। সঠিক হিসাব সামনে আসায় হার ৩৬ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা বাস্তবতারই প্রতিফলন। তিনি আবারও শীর্ষ ১০ খেলাপির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, আগের সরকারের আমলে লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ প্রকাশ পাওয়ায় এই হার বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ঋণ আদায়ে কঠোর নির্দেশনার কারণে আগের তুলনায় আদায় বেড়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ছয় মাসে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
বাংলাদেশ ব্যাংক। ফাইল ছবি
বাংলাদেশ ব্যাংক। ফাইল ছবি

ডলার এখন রেমিট্যান্স, রপ্তানি, হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ—সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাই বাজারে ডলার হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে সবাই চুপ। এই ডলারের সরবরাহ ও দাম স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি পুরো বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্য ঠিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত বিরতিতে ডলার কিনছে। সেই ধারাবাহিকতায় শুধু চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান এ প্রসঙ্গে আজকের পত্রিকাকে জানান, ডিসেম্বর মাসে কেনা ডলারের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, ৯২ কোটি ডলার এবং চলতি অর্থবছর ধরে মোট কেনা হয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। জুলাইয়ে প্রথম ডলার কেনা হয়েছিল ৪৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার, আগস্টে ৪৫ কোটি ৪০ লাখ, সেপ্টেম্বরেই তা বেড়ে ৯২ কোটি ৯০ লাখে পৌঁছায়। এরপর অক্টোবর ও নভেম্বরে অবশ্য অনেকটাই কমে ১৪ কোটি ২০ লাখ এবং ৫ কোটি ৪০ লাখে নেমে আসে। ডিসেম্বরেই তার বড় উল্লম্ফন ঘটে, কেনার পরিমাণ দাঁড়ায় ৯২ কোটি ১০ লাখ ডলারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং চ্যানেলের শক্তিশালীকরণ এবং অনলাইনে আন্তর্জাতিক পণ্যের বাজার মনিটরিংয়ের ফলে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। এ ছাড়া ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধ হওয়ায় ব্যবসার আড়ালে ডলার পাচার কমেছে। এসব কারণে ব্যাংকগুলোতে জমে থাকা অতিরিক্ত ডলার ক্রয় করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আগের অর্থবছরগুলোর সঙ্গে তুলনায় এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রেতার ভূমিকায়, যেখানে অতীতের বছরগুলোতে বড় অঙ্কে বিক্রি হতো। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিক্রি হয়েছিল ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন, ২০২২-২৩ এ ছিল ১৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন, ২০২৩-২৪ এ ১২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন এবং ২০২৪-২৫ এ ১ দশমিক ১২৪ বিলিয়ন ডলার। এই পরিবর্তন বাজারে স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বর্তমান খোলাবাজারে ডলারের দর ১২৪-১২৫ টাকার মধ্যে, যেখানে গত বছরের এই সময়ে তা ছিল ১৩১ টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে পণ্য আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১ বিলিয়ন ডলার, আগের বছরের তুলনায় ৭ শতাংশ কম। অনলাইনে বাজার নজরদারি এবং ওভার/আন্ডার ইনভয়েসিং নিয়ন্ত্রণে আসায় পণ্যের আড়াল থেকে ডলার পাচারও অনেক কমেছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার ক্রয় বাজারে স্থিতিশীলতা আনার জন্য সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এর ফলে আমদানি, বিনিয়োগ ও বাজার ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হয়েছে।’

সব মিলিয়ে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ, পাচার কমে আসা—সব মিলিয়ে ডলার বাজারে স্বস্তি ফিরিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ডলার বিক্রেতা নয়; বরং ক্রেতার ভূমিকায়, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

এনবিআর কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়ে টাকা দাবি, সতর্কবার্তা

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন পথচারীরা। ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন পথচারীরা। ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের দপ্তরের ব্যক্তিগত সহকারী মো. কাউসারের নাম ভাঙিয়ে একটি প্রতারক চক্র বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা দাবি করছে। এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে এবং আনুষ্ঠানিক সতর্কবার্তা দিয়েছে এনবিআর।

এনবিআর জানায়, প্রতারকেরা মিথ্যা পরিচয় ব্যবহার করে ফোন, মেসেজসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করছে। তবে মো. কাউসারের সঙ্গে এ কর্মকাণ্ডের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সর্বসাধারণকে এই প্রতারক চক্র সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। কেউ এ ধরনের ফোনকল বা বার্তার সম্মুখীন হলে নিকটস্থ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

জিডিতে মো. কাউসার উল্লেখ করেন, ২৩ ডিসেম্বর এনবিআরের উপ-কর কমিশনার রইসুন নেসা (বর্তমানে যুগ্ম কর কমিশনার) তাঁকে জানান, কাউসারের নাম ব্যবহার করে ০১৭০১৮৯০৩৮৭ নম্বর থেকে কল করে তাঁর বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ আছে’ উল্লেখ করে টাকা দাবি করা হয়। বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর নির্দেশও দেওয়া হয় ০১৩২৮০৮৩২১৬ নম্বরে। পরে দেখা যায়, একই চক্র আরও অনেক কর্মকর্তার কাছ থেকে একই কৌশলে অর্থ আদায় করার চেষ্টা করেছে। পরে কাউসার জানতে পারেন আরও অনেক কর্মকর্তার কাছ থেকে একই নম্বর থেকে টাকা দাবি করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা কে বা কারা তাঁর পরিচয় দিয়ে অজ্ঞাতসারে বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা দাবি করছে, তা জানা নেই বলে উল্লেখ করেন কাউসার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর অঞ্চল-কুষ্টিয়ার পরিদর্শী রেঞ্জ-৪-এর যুগ্ম কর কমিশনার রইসুন নেসা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাকে কাউসারের নামেই ফোন করে। আমি বিষয়টি কাউসারকে জানাই। পরে আর ফোন করেনি। কোনো কথাও হয়নি।’

জানতে চাইলে মো. কাউসার বলেন, কোনো একটা চক্র এটা করছে। এর আগে চেয়ারম্যান স্যারের হোয়াটসঅ্যাপ হ্যাক করে টাকা চেয়েছিল বিভিন্নজনের কাছ থেকে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত