Ajker Patrika

চীন-রাশিয়ার ঋণের চাপে বাংলাদেশ, রিজার্ভ নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তা 

আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২৩, ১৫: ২১
চীন-রাশিয়ার ঋণের চাপে বাংলাদেশ, রিজার্ভ নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তা 

বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প বা মেগা প্রকল্পে চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের সময় ঘনিয়ে আসায় বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চাপ ক্রমেই বাড়ছে। এই চাপ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে চলমান দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তুলছে। জাপানি সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়া এক প্রতিবেদনে এতথ্য জানিয়েছে। 

সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের ঋণে তৈরি বড় দুটি প্রকল্প কর্ণফুলী টানেল ও পদ্মা সেতুর রেল সংযোগে ঋণের কিস্তি বাংলাদেশকে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে দেওয়া শুরু করতে হবে। 

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুই প্রকল্পের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে নেওয়া ১ হাজার ১৮৮ কোটি ডলারের ঋণ চলতি বছরের শুরু থেকেই পরিশোধ শুরু হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে এই ঋণের কিস্তির কিছু অর্থ এসক্রো অ্যাকাউন্টে আটকে আছে। এসক্রো অ্যাকাউন্ট হলো দুই পক্ষের মধ্যে লেনদেন নিষ্পত্তিতে আইনিভাবে নিয়োজিত কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খোলা হিসাব।

২০১৫ সালে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পর বাংলাদেশ যেসব ঋণ নিয়েছে সেগুলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বেশি চাপ সৃষ্টি করেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন বা মান কমে যাওয়াও পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। এক্ষেত্রে এশিয়ায় সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতিতে পড়া শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেক স্বস্তিদায়ক হলেও রিজার্ভ নিয়ে টানাটানি কমছে না।

এই পরিস্থিতি যথাযথভাবে মোকাবিলা না করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কামাল মুজেরী। তিনি নিক্কেই এশিয়াকে বলেন, ‘পরিস্থিতির যথাযথ ব্যবস্থাপনা না হলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি অস্থিতিশীল হতে পারে।’ 

মেগা প্রকল্পগুলোর কাঙ্ক্ষিত সুফল ও বাস্তবতার মধ্যে সবসময় ফারাক থেকে গেছে। এ কারণে অনেক প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণ বোঝায় পরিণত হয়েছেঅর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ হয়েছে ২৭৪ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৭ শতাংশ বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারকে আরো ৩২৮ কোটি ডলারে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এই ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে ২০২৯-২০৩০ অর্থবছরে ৫১৫ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে। 

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি ডলারের নিচে নেমেছে। ২০২১ সালের আগস্টে এর পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। রিজার্ভ কমার কারণ হিসেবে ইউক্রেন সংকটের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়াকে কিছুটা দায়ী করা হয়। 

তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কঠোর মানদণ্ড বিবেচনায় রিজার্ভের পরিমাণ কমে ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি নামতে পারে। রিজার্ভ বাড়াতে এবছরের শুরুর দিকে আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে। কিন্তু বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপে এই অর্থ খুব বেশি ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে না বলে সংশ্লিষ্টদের মত। 

ইআরডির কর্মকর্তারা বলছেন, চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। কারণ আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় তাদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের সময় কম এবং সুদের হারও বেশি। 

তাঁরা বলছেন, ২০১৫ সালের পর থেকে  সুদের হারসহ নানা কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের ব্যয় ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ওই বছর বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পর থেকেই ঋণদাতারা সফট লোন বা স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তের ঋণসুবিধা বাদ দিয়েছে। এখন তারা ‘ব্লেন্ডেড লোন’ বা মিশ্র পদ্ধতির ঋণ দিচ্ছে, যেখানে সুদের হার মাঝারি হয়। ইআরডির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সাধারণত দ্বিপক্ষীয় ঋণগুলোর ক্ষেত্রে উচ্চ সুদহার এবং কঠোর শর্ত বেশি দেওয়া হয়।’

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের পর্যায়ে উত্তরণের পর বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই উচ্চ ব্যয়ের ঋণ বেড়ে গেছে। দেশের অর্থনীতিতে এর বড় প্রভাব পড়েছে। 

মিজানুর রহমান বলেন, চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে বাংলাদেশের নেওয়া ঋণের গ্রেস পিরিয়ড বা কিস্তি মওকুফকাল ও পরিশোধের মেয়াদ দুটোই কম। বিশ্বব্যাংকের অধিকাংশ ঋণের গ্রেস পিরিয়ড থাকে ১০ বছর। অথচ রাশিয়া ও চীনের ঋণের গ্রেস পিরিয়ড এর অর্ধেক।  

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণ পরিশোধে ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় দেয়। বিপরীতে বিভিন্ন দেশ থেকে দ্বিপক্ষীয় ঋণ পরিশোধে সব মিলে গড়ে ১৫ বছর সময় পাওয়া যায়। সময়সীমা কমার কারণে আগের চেয়ে ঋণের কিস্তির আকার যথেষ্ট বড় হয়েছে। 

কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের জন্য ৭০ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ নিতে ২০১৫ সালের জুনে চীনের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ। পরে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য ২০১৮ সালের এপ্রিলে আরও ২৬৭ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি চুক্তি করে। ইআরডির তথ্য বলছে, চীন থেকে নেওয়া বাংলাদেশের মোট ঋণ এখন ১ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার। 

এসব প্রকল্পের বহু আগে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য চুক্তি হয়। কিন্তু এই প্রকল্পের কিস্তি এখনো বাকি। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়াকে ঋণ পরিশোধে বাধার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ তৃতীয় মুদ্রায় (চীনা ইউয়ানে) অর্থ পরিশোধ করতে চাইছে। এ জন্য গত ৭ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি পাঠিয়ে চীনের পিপলস ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে বলেছে ইআরডি।

সব মিলে বাংলাদেশের ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ হাজার ৬৪৫ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ বেড়ে পরের অর্থবছরে ৮ হাজার ৫২৪ কোটি ডলারে দাঁড়াবে। তবে এই ঋণ বাংলাদেশের জন্য খুব বেশি শঙ্কার নয় বলে মনে করেন অধ্যাপক মিজানুর রহমানের। তাঁর মতে, বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণ খুব বেশি নয়। 

২০২২ সালের জুন নাগাদ দেশের বৈদেশিক ঋণ ছিল মোট জিডিপির মাত্র সাড়ে ২০ শতাংশ। দেশের রপ্তানি আয় ও  রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বিবেচনায় নিলে ঋণ পরিশোধের অঙ্কটা খুব বড় নয়। অধ্যাপক মিজানুর বলেন, ‘তবে যেহেতু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে, তাই আমাদের খুব বেশি সতর্ক হতে হবে।’ 

তবে বিপদের এখানেই শেষ নয়, আরও আছে সামনে। কারণ, ২০২৬ সাল থেকে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে চলে যাবে। এর সহজ অর্থ, বিশ্ববাজারে প্রবেশে বাংলাদেশি পণ্য আগে যে ছাড় পেত, তা পাবে না। এর ফলে দেশের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই এই মুহূর্তে ঋণ পরিশোধের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক মিজানুর রহমান। 
 
মোস্তফা কামাল মুজেরীর মতে, গত দশকে বাংলাদেশে যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে ও অর্থনীতি ত্বরান্বিত হয়েছে। এর ফলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের চাহিদাও তৈরি হয়েছে। এই চাহিদাই সরকারকে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিতে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা এবং ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক ঋণ বাড়ানোসহ নানা কারণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। 

তিনি বলেন, মেগা প্রকল্পগুলোর কাঙ্ক্ষিত সুফল ও বাস্তবতার মধ্যে সব সময় ফারাক থেকে গেছে। এ কারণে অনেক প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণ বোঝায় পরিণত হয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশকে ঋণ ব্যবস্থাপনায় আরও দক্ষ ও সতর্ক হতে হবে।

মুজেরী আরও বলেন, ‘যখন থেকে আমরা একই সময়ে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছি, তখন থেকেই আমাদের ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে এবং এটি বাড়তেই থাকবে। তাই সামনের দিনে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের আরও বেশি হিসেবি হতে হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় বাড়ল আরও এক মাস

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় বাড়ল আরও এক মাস

অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময়সীমা দ্বিতীয় দফায় আরও এক মাস বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, করদাতারা কোনো জরিমানা ছাড়াই আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ই-রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। এর আগে দুই দফা সময় বাড়িয়ে শেষ সময় নির্ধারিত ছিল ৩১ ডিসেম্বর।

আজ রোববার এনবিআরের সচিব মো. একরামুল হক স্বাক্ষরিত এক জরুরি আদেশে এই সময়সীমা বাড়ানোর কথা জানানো হয়েছে। এনবিআর সূত্র বলছে, মূলত করদাতাদের সুবিধার্থে এবং অনলাইন সিস্টেমে চাপ সামলাতে এই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যেহেতু চলতি বছর থেকে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তাই অনেক নতুন ব্যবহারকারী কারিগরি সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিলেন। সেই জটিলতা নিরসনেই এই বাড়তি সময় দেওয়া হলো।

সময় বাড়ানোর আগে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘আমরা প্রথমবারের মতো অনলাইন ব্যবস্থাকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করেছি। এটি একটি বড় ধরনের সংস্কার। আমরা চাই না কোনো করদাতা পদ্ধতিগত কারণে ঝামেলার মুখে পড়ুক। সরকার করদাতাদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করেই এই সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ তিনি আরও জানান, যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দেবেন না, তাদের ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী বিলম্ব জরিমানা আরোপ হতে পারে।

এনবিআরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ডিজিটাল কর ব্যবস্থার প্রতি জনগণের ব্যাপক সাড়া মিলেছে। এ পর্যন্ত ২৬ লাখের বেশি করদাতা সফলভাবে তাঁদের ই-রিটার্ন জমা দিয়েছেন। গত আগস্ট থেকে সরকারি কর্মকর্তা, বড় কোম্পানি এবং নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণির করদাতার জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করার পর থেকেই ই-রিটার্ন পোর্টালে ট্রাফিক বৃদ্ধি পায়।

ডিজিটাল পদ্ধতিতে করদাতারা ঘরে বসেই যেকোনো সময় রিটার্ন সাবমিট করতে পারবেন। রিটার্ন দাখিলের পর তাৎক্ষণিকভাবে প্রাপ্তিস্বীকারপত্র (Acknowledgment) এবং ট্যাক্স সার্টিফিকেট ডাউনলোড করা যাবে। বিকাশ, নগদ বা রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে কর পরিশোধের সুযোগ রয়েছে।

যেকোনো যান্ত্রিক ত্রুটি বা আইনি জটিলতা এড়াতে করদাতাদের সহায়তার জন্য এনবিআর একটি কল সেন্টারও চালু রেখেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

তুলা গবেষণা কেন্দ্রের ফুটি কার্পাসে নতুন সম্ভাবনা

রাতুল মণ্ডল, শ্রীপুর (গাজীপুর)  
বাংলার ঐতিহ্য মসলিনের প্রধান কাঁচামাল ফুটি কার্পাস তুলাগাছে ফুল ফুটেছে। গাজীপুরের শ্রীপুর তুলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
বাংলার ঐতিহ্য মসলিনের প্রধান কাঁচামাল ফুটি কার্পাস তুলাগাছে ফুল ফুটেছে। গাজীপুরের শ্রীপুর তুলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

একসময় বিশ্বজুড়ে বাংলার গর্ব ছিল মসলিন। এর অতুলনীয় সূক্ষ্মতা, মসৃণতা ও আরামদায়ক বৈশিষ্ট্যের কারণে রাজা-বাদশাহ থেকে ইউরোপীয় অভিজাত শ্রেণির কাছে মসলিন ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। মসলিনের প্রাণ ফুটি কার্পাস তুলা ইংরেজ শাসনামলে ঔপনিবেশিক বাণিজ্যনীতির বলি হয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। দীর্ঘ বছর পর সে হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে গাজীপুরের শ্রীপুর তুলা গবেষণা কেন্দ্র।

ফুটি কার্পাসের পুনর্জাগরণকে ঘিরে গবেষক, ঐতিহ্য অনুরাগী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নতুন উদ্দীপনা। এটি শুধু একটি বিপন্ন উদ্ভিদের পুনরুদ্ধার নয়; বরং বাংলার হারানো শিল্প-ঐতিহ্য ও সম্ভাব্য উচ্চমূল্যের টেক্সটাইল খাত পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা।

শ্রীপুর তুলা গবেষণা কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড এবং গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে গবেষণা কার্যক্রম চালাচ্ছে। গবেষণার মূল লক্ষ্য—ফুটি কার্পাস তুলা কীভাবে বাণিজ্যিকভাবে চাষযোগ্য করা যায়, উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে সাধারণ মানুষের নাগালে আনা যায় এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে মসলিনকে আবার পরিচিত করা যায়। গবেষকদের প্রত্যাশা, সঠিক নীতিগত সহায়তা ও বিনিয়োগ পেলে আগামী দিনে মসলিন আবার বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পরিচয় বহন করবে।

সম্প্রতি তুলা গবেষণা কেন্দ্র পরিদর্শনে দেখা যায়, সারি সারি ফুটি কার্পাস তুলাগাছ। প্রায় সব গাছেই প্রচুর ফুল এসেছে, যেগুলোর অনেক ফলেও পরিণত হয়েছে। গবেষকদের তথ্যমতে, পুনরুদ্ধার করা ফুটি কার্পাস গাছের উচ্চতা ১৩ থেকে ১৪ ফুট পর্যন্ত। বীজের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি হলেও আঁশ সূক্ষ্ম ও স্বল্প, যা মসলিন তৈরির জন্য উপযোগী।

তুলা গবেষণা কেন্দ্রের ইনচার্জ আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ফুটি কার্পাসের অস্তিত্বের সূত্র প্রথম পাওয়া যায় দৃক গ্যালারি ও জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে। সাংস্কৃতিককর্মী সাইফুল ইসলাম এর খোঁজ পান। কার্পাস তুলা থেকেই ‘কাপাসিয়া’ নামের উৎপত্তি।

ব্রিটিশ আলবার্ট মিউজিয়ামে সংরক্ষিত মোগল আমলের মসলিন শাড়ির অংশবিশেষ পরীক্ষা করে গবেষকেরা নিশ্চিত হয়েছেন, সে সময়ে ফুটি কার্পাস থেকেই এসব বস্ত্র তৈরি হতো। ইতিহাস বলছে, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে এই তুলার চাষ হতো এবং ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে মসলিন রপ্তানি করা হতো।

তুলা গবেষণা কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল আমিন বলেন, ‘ফুটি কার্পাস শুধু একটি তুলা নয়, এটি বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক। ইংরেজ শাসনামলে নিজস্ব শিল্প রক্ষার জন্য ব্রিটিশরা পরিকল্পিতভাবে মসলিনশিল্প ধ্বংস করেছিল। আমরা এখন সে হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

১ জানুয়ারি কার্যকর: দেশের সব স্থলবন্দরের মাশুল বাড়ল ৫ শতাংশ

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
১ জানুয়ারি কার্যকর: দেশের সব স্থলবন্দরের মাশুল বাড়ল ৫ শতাংশ

দেশের সব স্থলবন্দরের মাশুল ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। সব ধরনের সেবা, কর ও টোলহারের ক্ষেত্রে এই বর্ধিত মাশুল প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বলেছে, এই মাশুলই বন্দরের আয়ের প্রধান উৎস। প্রতিবছরের মতো এবারও মাশুল বাড়ানো হয়েছে, যা আগামী ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। তবে অন্যান্য বন্দরের তুলনায় মাশুল বেশি হওয়ায় বেনাপোল স্থলবন্দরের জন্য বর্ধিত মাশুলের আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

বেনাপোল বন্দরে যাত্রীদের জন্য ২০২৫ সালের মাশুল ছিল ৪৯ টাকা ৭৯ পয়সা, যা ২০২৬ সালে বেড়ে ৫২ টাকা ২৭ পয়সা হয়েছে। আমদানি করা বাস, ট্রাক ও লরির মাশুল নতুন বছরে ১৮৪ টাকা ৭০ পয়সা, যা আগের তুলনায় প্রায় ৯ টাকা বেশি। মোটর কার, জিপ ও পিকআপের জন্য এখন নতুন মাশুল ১১০ টাকা ৮২ পয়সা এবং মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেলের জন্য ৩৬ টাকা ৯৫ পয়সা।

বেনাপোল বন্দরে ট্রাক ও লরির জন্য ওজন মাপার যন্ত্র ব্যবহার করতে হলে ৮৮ টাকা ৬৫ পয়সা দিতে হবে। কাগজপত্র প্রক্রিয়ার মাশুল এখন ১৯৫ টাকা ০৭ পয়সা। কোনো যানবাহন যদি রাতভর বন্দরে থাকে, তবে মাশুল ১১১ টাকা ৪৯ পয়সা। গুদামে পণ্য রাখার মাশুলও পণ্যের সময় অনুযায়ী বাড়ানো হয়েছে।

বেনাপোল ছাড়াও অন্যান্য স্থলবন্দরে মাশুল ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য বন্দরে যাত্রীদের মাশুল ২০২৫ সালে ৪৯ টাকা ৭৯ পয়সা ছিল, যা ২০২৬ সালে বেড়ে ৫২ টাকা ২৭ পয়সা হয়েছে। আমদানি করা বাস, ট্রাক ও লরির জন্য নতুন মাশুল ১৫৯ টাকা ২২ পয়সা, মোটর কার ও জিপের জন্য ৯৫ টাকা ৫২ পয়সা এবং মোটরসাইকেল, স্কুটার ও থ্রি-হুইলারের জন্য ৪৭ টাকা ৮৩ পয়সা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর: ফসল ব্যবস্থাপনায় উত্তরের চার জেলায় কৃষির নতুন প্রকল্প

  • ২৫২ কোটির প্রকল্পে বিতরণ হবে ৩,১৮৫টি কৃষি যন্ত্রপাতি
  • উৎপাদন ৫% বৃদ্ধি ও শস্য নিবিড়তা ২৪১ শতাংশে উন্নীত হবে
  • ২০০টি পেঁয়াজ ও ৩টি সবজির সংরক্ষণাগার স্থাপন
মাহফুজুল ইসলাম, ঢাকা
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

দেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষি খাতে টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের ২৫২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। চার বছরের এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য প্রকল্পের আওতাধীন চার জেলায় আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ কমানো এবং কৃষিকে আরও লাভজনক পেশায় রূপান্তর করা।

বগুড়া কৃষি অঞ্চলের টেকসই উন্নয়ন নামের এই প্রকল্প ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০৩০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় বাস্তবায়িত হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে এবং পুরো ব্যয়ভার বহন করবে সরকার। আধুনিক ফসল ব্যবস্থাপনা, পানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তি এবং কৃষকের দক্ষতা উন্নয়ন—এসবের সমন্বয়ে প্রকল্পের কাঠামো তৈরি হয়েছে।

ডিএই মহাপরিচালক এস এম সোহরাব উদ্দিন বলেন, যমুনা-করতোয়া-পদ্মা-বাঙ্গালীবিধৌত বগুড়া অঞ্চলের কৃষি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, কম বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বন্যা ও নদীভাঙন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে আবাদি জমি কমছে। অপর দিকে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে। সার্বিক বাস্তবতা বিবেচনায় এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) প্রকল্পসংশ্লিষ্ট নথিপত্রে দাবি করা হয়েছে, আধুনিক ফসল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদন ৫ শতাংশ বাড়ানোর পাশাপাশি শস্য নিবিড়তা ২৩৬ শতাংশ থেকে ২৪১ শতাংশে উন্নীত করা হবে। এক হাজার নতুন দক্ষ কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি এবং ৩৫ হাজার কৃষি মানবসম্পদকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়ে উৎপাদন ব্যয় কমানোও প্রকল্পের লক্ষ্য।

এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে থাকছে বগুড়ায় উপপরিচালকের কার্যালয় ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণ, ২০০টি পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার, তিনটি আধুনিক ফল-সবজি ও কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার স্থাপন এবং ৩ হাজার ১৮৫টি কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ। কৃষকদের জন্য মোট ৪ হাজার ৮৪০ ব্যাচ প্রশিক্ষণ আয়োজনের পাশাপাশি ৪১ হাজারের বেশি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রদর্শনী এবং ৭০০টি মাঠ দিবস ও কারিগরি আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনাসচিব এস এম শাকিল আখতার আজকের পত্রিকাকে বলেন, টেকসই কৃষি উন্নয়নের স্বার্থে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। তবে নির্ধারিত কর্মসূচি মাঠপর্যায়ে কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয় কি না, সেটাই প্রকল্পের সাফল্য নির্ধারণ করবে।

একই বিষয়ে কৃষিসচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান আজকের পত্রিকাকে জানান, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার আবাদি জমির সঠিক ফসল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে। উৎপাদিত ফসলের সংরক্ষণব্যবস্থা উন্নত হলে কৃষকের ক্ষতি কমবে এবং আয়ের সুযোগ বাড়বে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত