Ajker Patrika

‘ঘুষের টাকা লেনদেন’: সিনিয়র অফিসারকে ফাঁকি দেন না এসআই মহিউদ্দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২৫, ১৮: ৩২
পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মহিউদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত
পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মহিউদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত

‘ভাই, আমি যে চাকরি করি, আমি ভাই এর মধ্যে কোনো ফাঁক রাখি না। আমি যদি পাঁচ টাকা খাই, এই কাজ আমি করি না যে সিনিয়র অফিসারকে ফাঁকি দেব। এই কাজ আমি করি না, কোনো দিনও না। এখন আমার কোনো সমস্যা হলে সিনিয়র অফিসার আমাকে সেফ করে কীভাবে?’

মোবাইল ফোনে মাহমুদ হাসান লিমন নামের মামলার এক আসামির সঙ্গে এভাবেই কথা বলেছেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মহিউদ্দিন। এসব কথোপকথনের ফোনকল রেকর্ড পাওয়া গেছে। মহিউদ্দিন এখন নগরের বোয়ালিয়া থানায় কর্মরত। আগে ছিলেন চন্দ্রিমা থানায়। আসামির সঙ্গে কথোপকথনটি সে সময়ের। আসামিপক্ষ বলছে, এসআই মহিউদ্দিন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে টাকা নিয়েছেন।

মামলাটির আসামি রয়েছেন রাজশাহী মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান শিশিলও। তাঁর অভিযোগ, পারিবারিক বিরোধের কারণে তাঁর আপন বড় ভাই মেহেদি হাসান সিজারের শাশুড়ি হাবিবা আক্তার মুক্তা একটি মামলায় পরিকল্পিতভাবে তাঁকে ও তাঁর বন্ধু মাহমুদ হাসান লিমনকে আসামি করেছেন। ওই মামলার ঘটনার সঙ্গে তাঁরা সম্পৃক্ত না থাকলেও এসআই মহিউদ্দিন ও চন্দ্রিমা থানা থেকে বদলি হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। চন্দ্রিমা থানার তৎকালীন ওসি আবুল কালাম আজাদও এখন বোয়ালিয়া থানায়।

গত ২ জুলাই শহরের ভদ্রা পারিজাত আবাসিক এলাকার হাবিবা আক্তার মুক্তার বাসায় রাজশাহী মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌরিদ আল মাসুদ রনির অবস্থানের খবর পেয়ে ছাত্র-জনতা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা বাসাটি অবরুদ্ধ করেন। পরে পুলিশ নিয়ে বাসায় তল্লাশি চালালে সেখানে রনির সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরে মুক্তা মামলা করেন যে, তাঁর ফ্ল্যাট থেকে ২ লাখ টাকা ও ১২ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করা হয়েছে। এ মামলায় শিশিল ও লিমনকেও আসামি করা হয়। ঘটনার সঙ্গে যে শিশিল সম্পৃক্ত নন, তা এসআই মহিউদ্দিনের কথোপকথনেই উঠে আসে। তবে ফোনকল রেকর্ডে শোনা যায়, ওসি আবুল কালাম আজাদ তা কিছুতেই মানছেন না বলে এসআই মহিউদ্দিন শিশিলকে বলেছেন।

ফোনকল রেকর্ডে শোনা যায়, শিশিল এসআই মহিউদ্দিনকে প্রশ্ন করছেন, ‘আপনি কি তদন্ত করেছেন আমি গেছি কি না বা চুরি করেছি কি না?’ জবাবে এসআই বলেন, ‘না, না রে ভাই। ওগুলো কিছুই নাই। এগুলো নিয়েই তো ওসি লেগেছিল আমার সঙ্গে। আমি বললাম—স্যার, ইনি (শিশিল) কি ২ লাখ টাকা চুরি করবেন? এগুলো কিচ্ছু নাই। শিশিল ওপরে যায়ওনি। ওসি আমাকে বলেন, ‘কীভাবে জানলেন ওপরে যায়নি?’ আমি বলি, ‘ক্যামেরা দেখেন। একটা টাকা, এতটুকু স্বর্ণও চুরি হয়নি।’ আমি এসব বলে আসছি।’

এ সময় শিশিল বলেন, ‘সুষ্ঠুভাবে যেটা হবে, সেটা করবেন। আমার পক্ষেও করার দরকার নাই।’ কিন্তু তারপরও সিনিয়র অফিসারদের কথা বলে টাকা নেন এসআই মহিউদ্দিন। শিশিলের বন্ধু লিমন তাঁকে বিকাশের মাধ্যমেও টাকা দেন। এর স্ক্রিনশট পাওয়া গেছে। আবার লিমনের সঙ্গে মহিউদ্দিনের কথোপকথনের রেকর্ডে শোনা যাচ্ছে, মহিউদ্দিন তাঁকে প্রশ্ন করছেন, ‘তুমি যে আমাকে বিকাশে টাকা দিছ, এই স্ক্রিনশট মানুষের কাছে গেল কীভাবে? তোমরা যদি টাকা ব্যাক চাও, আমি তো ভাই টাকা খরচ কইরে ফেলছি, সবই জানো।’ এ সময় লিমন বলেন, ‘আপনি আমাকে বললেন যে, “আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। ২ লাখ দিলেই এটা ঠিক করে দিচ্ছি।” আমি আপনাকে ওইডাই (সেটাই) দিতে চাহাচ্ছি (চাচ্ছি) ভাই। আপনি করে দেন।’

আরও এক ফোনকল রেকর্ডে শোনা যায়, লিমন মহিউদ্দিনকে বলছেন, ‘আমি লিমন নিজে বলছি। আমার নাম থেকে যাক। আপনি ভাইয়ের (শিশিল) নামটা শুধু বাদ দেন।’ এ সময় মহিউদ্দিন বলেন, ‘এ ভাই, আমি তো পারব না রে ভাই। তোমরা তো বিষয়ই বুছতেছ না। মামলার মনিটরিং অফিসার হলো ডিসি স্যার। ডিসির ওপরে হলো কমিশনার। তোমরা কী জানো? মামলা খালি আমাদের কাছে থাকে, তাই? সব ডিরেকশন উনারা দেন। আমরা চাকরি করি ভাই, সবাইকে লিয়েই (নিয়ে)। বোঝো নাই? আমার দ্বারা একটা লাইনও কারও ক্ষতি হবে না।’

মামলার আসামি মাহমুদ হাসান শিশিল বলেন, ‘আমাদের নামে মিথ্যা মামলা করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা মহিউদ্দিনই বলেছেন যে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। চুরির ঘটনাও নেই। তারপরও ওসি, ডিসি ও কমিশনারকে দেখিয়ে অভিযোগপত্র দেওয়ার ভয় দেখিয়ে এসআই মহিউদ্দিন টাকা নিয়েছেন। তারপরও তিনি আদালতে প্রতিবেদন না দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছেন।’

ফোনকল রেকর্ড নিয়ে জানতে চাইলে এসআই মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমি এখন আর কী বলব ভাই? যা বলি, আমার গায়ে লেগে যায়। মাঝখানে অনেক কথা কেটে দিয়ে কিছু অংশ ওরা প্রচার করছে। হয়তো ওদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে, সে জন্য এটা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’ এ বিষয়ে আরএমপির মুখপাত্র গাজিউর রহমান বলেন, এ বিষয়ে একটি অভিযোগ এসেছে। একজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ