মঈনুস সুলতান

রাতের রেলগাড়িতে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রো এসে পৌঁছেছি মাঝরাতে। তো বেশ বেলা করে পাবলিক বাসে রওনা হই আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। এক জায়গায় ট্রাফিক জ্যামে বাস দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। আমি কায়রো নগরীর পর্যটন মানচিত্রে চোখ রেখে জানালা দিয়ে জমজমাট স্ট্রিটের দিকে তাকাচ্ছি। আরবি ভাষার নিচে ইংরেজিতে লেখা একটি সাইনবোর্ড নজরে পড়ে, ‘তান্নেউরা ইজিপশিয়ান হেরিটেজ ড্যান্স একাডেমি’। এর নিচে রঙের তরঙ্গ বিভঙ্গে নৃত্যরতা মমির দেশের এক মোমের পুত্তলিপ্রতিম রমণীর রেখাচিত্র।
একটি রংচটা ট্যাক্সি এসে ফুটপাতে দুই চাকা তুলে ব্রেক কষে। তা থেকে হাসিমুখে নামে ময়রা, দীর্ঘ দাড়িওয়ালা একটি ছেলে ট্যাক্সির ভাড়া মেটাচ্ছে। ছেলে-মেয়ে দুটিকে গেল রাতের ট্রেনে ঘনিষ্ঠ হতে আমি চাক্ষুষ করেছি। ময়রাকে আধ-চেনা বলা যায়, তবে দীর্ঘদেহী তরুণটি সম্পর্কে আমার বিশেষ কোনো ধারণা নেই।
দিন তিনেক আগে সাইপ্রাস থেকে উড়ে এসে আমি ল্যান্ড করি আলেকজান্দ্রিয়ায়। বিমানে আমার পাশের সিটে বসেছিল ময়রা। খানিক কথাবার্তাও হয়েছে। ববড করা থুপি থুপি কালো চুলের মেয়েটি যুক্তরাষ্ট্রের এক ইউনিভার্সিটিতে পুরো এক বছর ব্রেক-ইয়ার নিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলে। ওখানকার নাগিব ডেজার্টের কিবুটজ কমিউন বা তরুণদের প্রশিক্ষণের জন্য তৈরি সমবায় খামারে সে পুরো নয় মাস কাটাবে। ইসরায়েল যাওয়ার পথে সাইড-ট্রিপ হিসেবে সপ্তাহ দেড়েক ইজিপ্টে কাটাচ্ছে।
না, আলেকজান্দ্রিয়া শহরে ভিন্ন ভিন্ন গেস্টহাউসে বসবাসের কারণে ময়রার সঙ্গে আমার ফের দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। তবে কায়রো আসার পথে রাতের ট্রেনে তাকে আরেক নজর দেখি। ফার্স্ট ক্লাস অ্যাপার্টমেন্ট-সংলগ্ন করিডরে চলছে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ পর্যটকদের জমজমাট আড্ডা। হাতে হাতে ঘুরছে হার্ড ড্রিংকসের ফ্লাক্স। এদের সঙ্গে ময়রাও আছে। তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সাড়ে ছয় ফুট দেহের শক্তপোক্ত দীর্ঘ দাড়িওয়ালা এক যুবক। ছেলেটির ভেস্টের লেপালে জ্বলজ্বল করছে ইহুদি সম্প্রদায়ের পবিত্র প্রতীক ‘স্টার আব ডেভিড’।
আমি মাইকিং সামলাতে ট্রেনের দেয়ালে হাত রেখে ভারসাম্য রক্ষা করি। খিলখিল করে হেসে ওঠে ময়রা। দেখি, তরুণটি তার খোলা কাঁধে আঙুল দিয়ে কিছু লিখছে। হাসতে হাসতে তার গায়ে গড়িয়ে পড়ে মেয়েটি। আমি কায়ক্লেশে তাদের অতিক্রম করে হেঁটে যাই ডাইনিং কারে।
আল হোসেইন স্কয়ারে আমি বাস থেকে নামে। মানচিত্র অনুযায়ী আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস কাছেই। সামান্য একটু হাঁটতেই চলে আসি অকুস্থলে। আমার ভ্রমণ-বাজেট সীমিত, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে গাইড ছাড়াই এসেছি। ফলক পড়ে জানতে পারি, প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠ স্থাপিত হয়েছিল ৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে, মিসরে কায়েমি খেলাফতের শাসনামলে।
ক্যাফেটেরিয়ায় এসে ছাত্রদের সঙ্গে আমি কথাবার্তা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু সবাই এমন ব্যস্তসমস্ত হয়ে আছে যে আমার সঙ্গে বাতচিতের কারও ফুরসত হয় না। এরা আমাকে দেখিয়ে দেয় প্রশাসনিক ভবনের দালান।
অ্যাডমিশন-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের অজুহাত দিয়ে কোশেশ করি দালানে প্রবেশের। দারোয়ান কেলাশনিকভ বন্দুকটি কেবলামুখি করে বেদুইনদের চাঁছাছোলা জবানে ঘোরতর আপত্তি জানান। বেরিয়ে আসি উদ্যানে।
এদিকে পুষ্পিত তরুলতার সংখ্যা কম। তবে চৌবাচ্চার কাছে খেজুরগাছের ছায়ায় বসে জাবর কাটছে তিনটি উট। ঠিক বুঝতে পারি না, এ জানোয়ারদের এখানে আগমনের হেতুটা কী? ভাবি, হয়তো অধ্যাপকেরা মরুজাহাজদের যানবাহন হিসেবে ইস্তেমাল করছেন। একটি উট খামোকা খেপে গিয়ে আমাকে সশব্দে তাড়া করে আসে। ছোটাছুটি করে আমি বারবার গেট বলে পরিচিত, বেজায় উঁচু ও কারুকাজে চোখধাঁধানো দেউড়ির তলায় ঢুকে পড়ে আত্মরক্ষা করি।
ফিরে তাকাই, মিসরি স্থাপত্যকলার চমৎকার নিদর্শনে ভরপুর আলিশান এ তোরণের দিকে। চোখের সামনে ‘আজ-জোহরা’ নামে দুনিয়াজুড়ে মশহুর আল আজহার মসজিদের খিলানময় বিস্তার। আমি সারি দিয়ে তৈরি ৩০০টি স্তম্ভের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক করতে করতে বেদিশা হয়ে ঢুকে পড়ি প্রার্থনার পবিত্র ইমারতে। খুঁজি, বিবি ফাতেমার পবিত্র স্মৃতিতে উৎসর্গিত কিতাবখানার দরওয়াজা।
দোরগোড়ায় পাগড়িওয়ালা এক পরহেজগার বান্দা আমার পথ রোধ করেন। বলি, শুনেছি যে এ গ্রন্থাগারের পুস্তকের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তিনি ক্যালকুলেটর বের করে সংগৃহীত বইপত্রের সঠিক হিসাব দেখান, স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ওঠে ৬০০,০০০ সংখ্যাটি। বলি, ‘অন্তত একটি বই চোখে দেখার সুযোগ দিন, হুজুর।’ ভদ্রলোক সম্ভবত আমার ভাষা বুঝতে পারেন না, ফের অনুনয় করি কেতাবখানার ভেতরটা চাক্ষুষ করার, চিড়ে ভিজে না।
হুজুর আমার কবজি চেপে ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে দেখান দেয়ালে ঝোলানো নামাজের জোব্বা, টুপি ও তসবি। তিনি ‘ওধু ওধু’ এবং ‘সালাত সালাত’ বলে আওয়াজ দিলে, আন্দাজ করি, তিনি আমাকে অজু করে নামাজ আদায় করার অনুরোধ করছেন। আমি ফের ‘কিতাব কিতাব’ বলে কাকুতি করি, তিনি রোষকষায়িত নজরে আমাকে অবলোকন করে কঠোর স্বরে উচ্চারণ করেন ‘সালাত’। চকিতে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার একটি চরণ ‘নামাজ পড়িস বেটা..’, আমার করোটিতে ঘাই মেরে ওঠে।
প্রার্থনার পবিত্র ইমারত থেকে বেরিয়ে এসে ভারি খাজুল হালতে চুপচাপ হাঁটি। চলে আসি আল হোসেন স্কয়ারের প্রান্তিকে। এদিকে বেশ কিছু মরুপ্রিয় উদ্ভিদের সুশৃঙ্খল বিস্তারে তৈরি হয়েছে আরবান এক পুরোদস্তুর পার্ক, চারদিকে ছড়িয়ে আছে শ্যামল ছায়া। গেটে দাঁড়িয়ে ভাবি, কায়রোতে খানিক ঘোরাফেরার শুরুতেই কুফা লাগল, সীমিত বাজেটের জন্য আমি এ ফারাওকুলের স্মৃতিনন্দিত নগরীতে আরও একটি-দুটি দিন কাটিয়ে ফের গাইডসহ আল আজহারে আসতে পারব না। অর্থাৎ এ বিশ্ববিদ্যালয় ও আজ-জোহরা মসজিদের কেতাবখানাটি আমার অদেখাই থেকে যাবে।
পার্কের গেটে দাঁড়িয়ে আপনমনে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করছি। দেখি, দ্রুত হেঁটে এদিকে আসছে ময়রা। পুলিশের তাড়া খাওয়া গোপন সংগঠনের বিপ্লবীর মতো মেয়েটি বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে সতর্কভাবে পেছন দিকে তাকাচ্ছে, আর প্রায় ছুটছে। আমাকে দেখতে পেয়ে রীতিমতো হকচকিয়ে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ে, অতঃপর দ্রুত সামলে নিয়ে মুখে নার্ভাস হাসি ফুটিয়ে বলে, ‘হাই, গুড টু সি ইউ।’
ছুটে আসার তোড়ে ময়রা নিঃশ্বাস ফেলছে জোরে জোরে। স্বল্প ঝুলের টপে খানিক অনাবৃত বিভাজিকায় বিস্ফারিত হচ্ছে স্তনযুগল, মুখে ও গলায় বুজকুড়ি কাটছে ঘামের তরল বিড। সে পার্স থেকে রুমাল বের করতে করতে জানতে চায়, ‘ক্যান আই ওয়াক আ বিট উইথ ইউ।’ ‘সার্টেনলি’ বলে আমি পার্কটি দেখিয়ে প্রস্তাব করি, ‘হাউ অ্যাবাউট স্পেন্ড সাম টাইম ইন দিস পার্ক?’ গাছপালার ছায়ানিবিড় পরিসরে সময় কাটানোতে সে সম্মতি দিলে, আমরা টিকিট কেটে ঢুকে পড়ি উদ্যানে।
উদ্যানটির কোথাও কোথাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ওয়েসিসের শ্যামলে বালুকার ধূসরিমা আবহ। একটি-দুটি ফোয়ারার ঝিরি ঝিরি জল তাতে যুক্ত করছে সজল ব্যঞ্জনা। আমরা একটি বেঞ্চে বসে পড়ি। ময়রা ক্লিওপেট্রা কুইন নামে একটি সুরভিত সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমাকে এক শলা অফার করে। আমি তা জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে শেয়ার করি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ও আজ-জোহরা মসজিদের লাইব্রেরি দেখতে চেয়ে ব্যর্থ হওয়ার অভিজ্ঞতা।
আধপোড়া সিগারেটটি নিভিয়ে দিয়ে ময়রাও ফ্র্যাংকলি তার অত্যন্ত নেগেটিভ অভিজ্ঞতা অকপটে শেয়ার করে। জানতে পারি, জ্যাকব নামে ইসরায়েলের একটি জুইশ ছেলের সঙ্গে ট্যাক্সিভাড়া শেয়ার করে সে এসেছিল আল হোসেইন স্কয়ারে। ওখানকার আল তান্নেউরা হেরিটেজ ড্যান্স একাডেমিতে নাকি পর্যটকদের জন্য আয়োজিত হয়েছে বেলি ড্যান্স শেখার ক্লাস। ময়রা ক্লাসটি নিতে চায়। তো জ্যাকব তাকে ওখানে ড্রপ করে দিয়ে চলে যায় তার পথে।
ড্যান্স একাডেমিতে ঢুকে ময়রা জানতে পারে, পুরো একটি ক্লাস চালানোর জন্য যথেষ্ট পর্যটক না আসাতে আজকের প্রশিক্ষণ বাতিল করা হয়েছে। তবে একজন আধবুড়ো মেইল ইনস্ট্রাক্টর পনেরো ডলারের বিনিময়ে তাকে ড্যান্সের কিছু অন্ধিসন্ধি দেখিয়ে দিতে রাজি হন। তো স্টুডিওতে তিনি তাকে মিনিট তিরিশেকের প্রশিক্ষণে শিখিয়ে দেন বেশ কয়েকটি মুদ্রা।
তারপর ময়রাকে ড্রেসিংরুমে নিয়ে গিয়ে বেলি ড্যান্সারদের ড্রেস পরতে বলেন। ইনস্ট্রাক্টর তাকে ড্রেস পরতে সাহায্য করতে গিয়ে, তার তলপেট ও নিতম্ব বারবার স্পর্শ করলে সে খেপে গিয়ে, ইনস্ট্রাকটরকে আচমকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে।
একাডেমির সামনে কোনো ট্যাক্সি না পেয়ে সে হেঁটে যেতে চাচ্ছিল খান আল খালিলি নামক বাজারের দিকে। একটি মারকুটে চেহারার ইজিপশিয়ান যুবক তাকে ফলো করে। ছেলেটি বারবার তার শরীর ঘেঁষে হেঁটে যাওয়ার সময় ফের স্পর্শ করছিল তার পশ্চাদ্দেশ, দু-চারজন পথচারীও বিষয়টি দেখেছে, দেখে খিক খিক করে হেসেছে, কিন্তু কেউ তাকে সেভ করতে এগিয়ে আসেনি।
কথা বলতে বলতে ক্রোধে ও উত্তেজনায় ময়রা উঠে দাঁড়ায়। তার হয়রানিতে আমি শুধু ব্যথিত নয়, বেজায় বিব্রতও বোধ করি। আমি সচেতন যে এ ধরনের হয়রানির অভিজ্ঞতা হয়...স্ট্রেসফুল অ্যান্ড ইনটেন্স, কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে প্রচুর। ঠিক বুঝতে পারি না—কী বলব। আমরা চুপচাপ হাঁটি। ময়রা অস্বস্তিকর নীরবতার আইস ব্রেক করে জানতে চায়, ‘খান, আল খালিলি মার্কেট থেকে আমি বেলি ড্যান্সের কিছু আইটেম কিনতে চাচ্ছি। তুমি আমার সঙ্গে যাবে কি?’
বাজারটি পার্কের লাগোয়া। তো আমি যেতে রাজি হই, তবে, ওদিকে যাওয়ার আগে আমি উদ্যান-সংলগ্ন আয়ুবিদ ওয়ালটি চাক্ষুষ করতে চাই। ঐতিহাসিক দেয়ালটির কাছাকাছি হেঁটে আসতে বিশেষ একটা সময় লাগে না। জানতে পারি, ১১৭৬ সালে মিসরের সুলতান সালাদিন এ প্রাচীর, একাধিক বুরুজ ও তোরণ নির্মাণ করিয়েছিলেন ক্রুসেডার যোদ্ধাদের কাছ থেকে নগরীর সুরক্ষার প্রয়োজনে। পুরো এলাকায় চলছে পুরাতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি।
ময়রা কেন জানি উত্ত্যক্ত হয়ে ওঠে কেবলই অভিযোগ করতে থাকে। মিসরে সিনাই ডেজার্টের কাছাকাছি শারম এল শেখের রিসোর্টে সে আগেও এসেছিল একবার। এ ধরনের যৌন হয়রানির ঘটনা সেখানেও ঘটেছিল। এবারকার ট্রিপে আলেকজান্দ্রিয়ার পাবলিক বাস চড়তে গিয়ে একজন যাত্রীও নাকি বারবার তার দেহ অকারণে অত্যন্ত অসংগতভাবে স্পর্শ করেছে।
ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে শুধু দুঃখজনক নয়, পুরুষ হিসেবে আমার জন্য ভীষণ লজ্জাকরও বটে। আমি আন্তরিকভাবে সহানুভূতি জানাই। তাতে খেপে ওঠে ময়রা বারবার বলে, ‘আই হেইট ইজিপ্ট, হেইট অল ইজিপশিয়ান ম্যান...।’ আর কিছু না বলে আমরা খান আল খালিলি বাজারের দিকে রওনা হই। হাঁটতে হাঁটতে সে এবার পুরো মিসরবাসীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে অধৈর্য হয়ে হঠাৎ করে বলে বসি, ‘হোয়াই ইউ ক্লেইম টু ইজিপ্ট অ্যাগেইন, এ দেশে আরেকবার না এলেও তো পারতে ময়রা?’
সে দাঁড়িয়ে পড়ে—আমার কাঁধে চাটি মেরে বলে, ‘শোন, আমার পূর্বপুরুষ এক যুগে—হাজার হাজার বছর আগে—মিসরে ক্রীতদাস হিসেবে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের মেহনতে তৈরি হয়েছে অনেক পিরামিড ও হরেক রকমের ঐতিহাসিক স্থাপনা। আই ডু হ্যাভ দ্য রাইট টু সি দ্য কান্ট্রি দ্যাট মাই এনসেসটার হ্যাড বিল্ট।’
চকিতে আমার করোটিতে ভেসে যায়, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত কাহিনি। তখন মিসরে চলছে ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের রাজত্ব। বনি ইসরায়েল বা ইহুদি সম্প্রদায়কে ক্রীতদাস প্রথার জিঞ্জিরে জড়িয়ে তাদের মেহনতে তিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন নগরী ও নানা ধরনের মনুমেন্ট। এ সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি তার জুলুমের কোনো সীমা-সরহদ্দ ছিল না।
আমি অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে ময়রার হাত স্পর্শ করে বলি, ‘ইউ অলসো হ্যাভ দ্য রাইট টু বি ট্রিটেড ডিসেন্টলি। ইউ মাস্ট নট বি হেরাসড সেকসুয়্যালি অন দি স্ট্রিট অব কায়রো।’
বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে টুকটাক কথাবার্তায় জানতে পারি, পারিবারিক গল্পগাথা থেকে ময়রা জেনেছে, মধ্যযুগে তার পরিবার ছিল স্পেনের আন্দুলিশিয়ার একটি মুসলিম রাজ্যের বাসিন্দা। যুদ্ধে মুর নামে পরিচিত মুসলমানদের পরাজয়ের পর খ্রিষ্টরাজ প্রতিষ্ঠিত হলে, তার পরিবার আন্দুলিশিয়া থেকে বহিষ্কৃত হয়ে অভিবাসী হিসেবে ঘর বেঁধেছিল পোল্যান্ডে। ময়রার বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন নাৎসি সামরিক চক্র পরিচালিত গ্যাস-চেম্বারে নির্মমভাবে নিহতও হয়েছিল। তবে তার দিদিমা নাকি এক সহানুভূতিসম্পন্ন খ্রিষ্টান পরিবারের দত্তক হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পেতে সমর্থ হয়েছিলেন।
আমরা ঢুকে পড়ি খান আল খালিলি নামক ফাতেমি খিলাফতের জামানায় নির্মিত বাজারে। চকমিলান পরিসরে স্থাপত্যের কেরেসমাতিতে সৃষ্টি হয়েছে গলিঘুঁজির রীতিমতো গোলকধাঁধা। হরেক রকমের মশলার পানজেন্ট গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে মিসরের মেস্ক-আম্বরের সুঘ্রাণ। একটি পুরো গলিজুড়ে ডিসপ্লে করা হয়েছে রুপার গোলাপপাশ ও আতরদান। কাছেপিঠে কোথাও ঝলমল করছে সম্ভাব্য কনেদের স্বপ্ন হয়ে স্বর্ণের জেওরাত। আমরা হেঁটে যাই তামা-কাঁসার সরণিতে। এগুলোর জেল্লা দেখে তাক লেগে যাওয়ার জোগাড় হয়। ময়রা ফিসফিস করে বলে, ‘লুক অ্যাট অল দিস সিলভার, কপার অ্যান্ড ব্রাস আইটেমস। ওয়াও...হোয়াট আ কালারফুল ওরিয়েন্টাল বাজার!’
যেহেতু আমার কেনাকাটার বিত্ত নেই, বাজারের সওদাপাতির জৌলুশে খানিক বিরক্ত লাগে। ময়রা কিনতে চায় বেলি ড্যান্সের জন্য পোশাক-আশাক। বলি, আমি না হয় একটি ক্যাফেতে বসি, তুমি কেনাকাটা সেরে ফিরে এস। সে রাজি না হয়ে হাত ধরে বলে, ‘কাম অন...মাত্র পনেরো-বিশ মিনিটের ব্যাপার, আমার শপিং শেষ হলে পর...লেটস হ্যাভ লাঞ্চ টুগেদার।’
একটু যেন অন্তরঙ্গতার ছোঁয়া পাই। ভাবি, ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আয়োজিত মিছিল-মিটিংয়ে আমি হামেশা শরিক হই, যে কারণে ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষজনের সঙ্গে মন খুলে মেলামেশা করতে পারি না। দিস এন অপরচুনিটি ফর মি টু লার্ন অ্যাবাউট আ জুইশ গার্ল। তার সঙ্গে একটু জানাশোনা হলে পর, হয়তো আমার অহেতুক হোস্টাইল ভাব খানিকটা কাটবে।
বেলি ড্যান্সের পোশাক-আশাকে ভরপুর পুরো একটি বিপণিবিতানের তালাশ পাওয়া যায়। ময়রা দক্ষতার সঙ্গে দামদর করে কিনে ফেলে, পর্যটকদের কাছে ‘হেরেম প্যান্ট’ নামে পরিচিত ‘বেদলাহ’ বা ঝলমলে ঝুটা রত্ন বসানো ব্রা ও গাগরা গোছের গাউন। কিন্তু প্রচুর সময় নেয় অচল মুদ্রাগাঁথা হিপ স্কার্ফ নির্বাচনে। কিছুতেই যেন হেরেম প্যান্টের সঙ্গে স্কার্ফের বর্ণ বিচ্ছুরণের সঠিক মিল হয় না। সে বারবার কোমরে ত্রিকোণ হিপ স্কার্ফটি জড়িয়ে ধরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, ঘুরেফিরে নৃত্যের ভঙ্গিতে হরেক মুদ্রায় নিজেকে দেখে। তারপর মতামতের জন্য আমার শরণাপন্ন হয়।
আমি কোমর বাঁকা করে দাঁড়ানো যুবতীটির দিকে নিরিখ করে তাকাই। হিপ স্কার্ফের রুপালি মুদ্রাগুলো তার পৃথুল নিতম্বের রেখায় যুক্ত করেছে মৃদু আভাময় বিচ্ছুরণ। ত্রিকোণ বস্ত্রখণ্ডটি অনাবৃত মিডরিফটে নিম্ন নাভিটির ঠিক নিচে গিট্টি দিয়ে বাঁধা। সে নিম্নাঙ্গে নৃত্যমুদ্রার একটি লঘু ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলে, ফ্রিজ হয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘হাউ অ্যাম আই লুকিং?’ চটজলদি জবাব দিই, ‘ইনডিড অ্যাট্রাকটিভ।’
তোষামোদে তুষ্ট না হয়ে ময়রা ভ্রুকুটি করে বলে, ‘ইজ দ্যাট অল ইউ হ্যাভ টু সে।’ আমি খানিকটা প্ররোচিত হয়ে, সচেতনভাবে চাটুকারিতার বহুল ব্যবহৃত বাণ হানি, ‘এটা পরে ড্যান্স করলে, পুরুষ দর্শকদের শুধু হৃদয়ই ভাঙবে না, লিসেন ময়রা, আই অ্যাম টেলিং ইউ...তাদের ঘরসংসারও তছনছ হবে।’ তোষামোদে কাজ হয়। ময়রা ‘কুল…থ্যাংকস আ লট’ বলে কাউন্টারে এসে পেমেন্ট সারে।
নৃত্য-সংক্রান্ত পোশাকের দোকান থেকে বের হয়ে সে ফিসফিসিয়ে আমাকে যেন নিশ্চিত করে, ‘লিসেন, ইসরায়েলের যে কিবুটস বা সমবায় খামারে আমি নয় মাস কাটাব, ওখানে প্রতি সপ্তাহান্তে বসে ছেলেমেয়েদের জোড়ায় জোড়ায় নৃত্যের আসর। ছেলেদের সবাই এলিজিবল ব্যাচেলর, কারও ঘরসংসার ভাঙার কোনো আশঙ্কা নেই।’
প্রতিক্রিয়ায় বলি, ‘থ্যাংকস আ বাঞ্চ ময়রা...ফর দি এস্যুরেন্স। তবে একটি প্রশ্ন, হোয়াই আর ইউ ইন্টারেস্টেড টু লার্ন বেলি ড্যান্স?’ দ্রুত জবাব আসে, ‘আমার পূর্বপুরুষেরা একসময় মিসরে বসবাস করত। সে যুগে ইহুদি মেয়েরা বেলি ড্যান্স করত। সো ইটস নট বিলং টু অনলি ইজিপশিয়ান আরবস। এই ঐতিহ্যে ইহুদি সম্প্রদায়েরও ভাগ আছে।’
প্রশ্ন না করে পারি না, ‘জাস্ট ফলোইং মিডল ইস্টার্ন জুইশ ট্র্যাডিশন, ইজ দ্যাট অল ময়রা?’ দাঁড়িয়ে পড়ে খুব মিষ্টি করে হেসে সে বলে, ‘লুক, আই লাভ মাই ফিগার...বেলি ড্যান্স ইজ গোয়িং টু কিপ মাই বডি নাইস অ্যান্ড টাইট।’
হাঁটতে হাঁটতে আমি বাজারের চকমিলান পরিসরের বন্ধনীর মতো বাঁকানো কারুকাজ করা খিলানগুলো ফের খেয়াল করে দেখি। ঝিক করে করোটিতে ফিরে আসে, বছর কয়েক আগে পড়া মিসরের যশস্বী লেখক নাগিব মাহফুজের একটি উপন্যাসে খিলানময় গলিপথে ঘুরপাক করার বর্ণনা। ময়রা হাঁটতে হাঁটতে কেবলই উদগ্রীব হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। জানতে চাই, ‘হোয়াট আর ইউ লুকিং ফর?’
অন্যমনস্কভাবে সে জবাব দেয়, ‘আই অ্যাম স্টিল লুকিং ফর জ্যাকব। চেককাটা নেকস্কার্ফ কেনার জন্য তার এ বাজারে আসার কথা। একটু খেয়াল রাখো তো, হি ইজ ভেরি টল।’
কেন জানি বিরক্ত লাগে, ইচ্ছা হয় বলে বসি, ময়রা, তুমি আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছ, সামান্য সময় জ্যাকবের কথা না ভেবে থাকতে পার না। ঝিক করে আমার স্নায়ুতে সৌজন্যবোধের কণিকাগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। নীরবে নিজেকে শাসন করে বলি, মেয়েটি মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে শিকার হয়েছে যৌন হয়রানির। এ মুহূর্তে খামোকা জেলাস হওয়াটা হবে অশ্লীল আচরণের শামিল।
আমরা চলে এসেছি সার্কুলার সরণিতে। দুই কদম সামনে বাড়তেই পাওয়া যায় নাগিব মাহফুজের নামে চমৎকার একটি রেস্তোরাঁ। পেটে খিদেও জানান দিচ্ছে, বলি, ‘লেটস গো অ্যান্ড হ্যাভ লাঞ্চ, ময়রা।’
দেয়ালে ঝুলছে ১৯৮৮ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়া কথাশিল্পী নাগিব মাহফুজের মস্ত বড় ফটোগ্রাফ। তার তলায় আমরা টেবিল পাই। আমি মেনু ঘাঁটি। ময়রা মাহফুজের ছোটগল্প নিয়ে কথা বলে। প্রকাশিত মোট ৩৫০টি গল্পের কোনোটাই মনে হয় তার পড়তে বাকি নেই। খান আল খলিলি বাজারের বর্ণনা আমি কোন বইতে পড়েছি, তা মনে করতে না পারায় ভারি বিব্রত লাগে।
খাবারের তালিকায় পিজিয়ন রাইস নামে একটি আইটেম আমাদের পছন্দ হয়। কিন্তু দামেদরে মনে হয় সব খাবারই এখানে অত্যন্ত চড়া। আমরা একটি ডিশ শেয়ার করতে চাই। বেদুইনদের মতো জালাবিয়া নামে ঢোলা পিরহান পরা ওয়েটার দ্রুত এক্সট্রা প্লেট, নাইফ প্রভৃতি সরবরাহ করে। সাইড হিসেবে গ্রিল করা এগপ্লান্টের সঙ্গে পরিবেশিত হয় চিকপির চাট ও তাবুলি।
পিলাফের মতো তপ্ত রাইস থেকে ছড়াচ্ছে সিনেমন ও লেবুর সুগন্ধ। ভাতের স্তূপের ওপর বসে আছে আধপোড়া একটি পায়রা। আমরা পিকাসোর আঁকা শ্বেতকপোতের প্রতীক নিয়ে কথা বলতে বলতে, মৃত পায়রাটিকে ডানা ধরে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করি। চতুর্দিকে ছড়ায় বেশ কিছু তপ্ত ভাত।
ওয়েটার কোরবানির দুম্বা জবাইয়ের ধারালো একখানা খঞ্জর দিয়ে বিষয়টা সুরাহা করে দেন। মাংসের মুখরোচক টুকরা চিবাতে চিবাতে নীরবে ভাবি, গাঙ্গেয় উপত্যকার এক মুসলিম তরুণের সঙ্গে মিলেঝুলে, ইহুদি একটি মেয়ের শান্তিপূর্ণভাবে কপোত ভক্ষণের বিষয় নিয়ে কখনো কিছু লেখার আমার সুযোগ হবে কি?
আহারের তামাদি হওয়ামাত্র ওয়েটার আওয়াজ দেন, ‘কাহওয়াতুন মিসরিওয়াতুন।’ পরিভাষাটি বুঝতে না পেরে আমি ও ময়রা বেয়াক্কেলের মতো একে অপরের মুখের দিকে তাকাই। নিউইয়র্ক সিটির স্কাইলাইনের ছবি আঁকা টিশার্ট পরা একটি বালক নিয়ে আসে পিতলের বড়সড় কেটলি। কফির গাঢ় সুগন্ধি থেকে যেন ছড়াচ্ছে উদ্দীপনা। ওয়েটার মাশাই পেয়ালায় তা ঢেলে দিয়ে সামনে সাজিয়ে রাখে সুগার পট ও সিনেমন ডাস্টের জার। ময়রা কফির আনুষঙ্গিক অনুপান হিসেবে অর্ডার করে সিসা-হুক্কা।
হুক্কায় ধূমপান সেরে বেশ খোশমেজাজে আমরা শেয়ারে একটি ট্যাক্সি ভাড়া করি। বাতচিতে ফিরে ফিরে আসে নাগিব মাহফুজের গল্পে ব্যবহৃত একাধিক চরিত্রের বর্ণনা। গিজা পিরামিডের চত্বরে নামামাত্র মনে হয়, কায়রো নগরীর অজস্র দালানকোঠার এক সম্প্রসারিত মিছিল মরুপ্রান্তরে এসে যেন হঠাৎ করে ব্রেক কষে থেমে পড়ছে। অপরাহ্ণের তেজি আলোয় একাধিক পিরামিডের দিকে আমরা একসঙ্গে তাকাই।
পর্যটকদের কোলাহলে মনে হয়, এ পরিসর থেকে নির্বাসিত হয়েছে নীরবতা। নগরীর জীবনযাপনের শব্দপুঞ্জও যেন বলকে ওঠা দুধের ফেনার মতো উথলে পড়ছে। ময়রা তাজ্জব হওয়া স্বরে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘হোয়াট আ ম্যাসিভ মনুমেন্ট...ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড ইট ইজ ফোর থাউজেন্ড ফাইভ হানড্রেড ইয়ারস ওল্ড, ওয়াও!’ আমাদের পাশ দিয়ে পর্যটক-পিঠে বালুকা ছিটিয়ে আগুয়ান হয় কয়েকটি উট।
ময়রা জানতে চায়, ‘উড ইউ লাইক টু শেয়ার আ ক্যামেল রাইড উইথ মি?’ পাথরের বিপুল স্তূপে প্রতিফলিত চড়া রোদ সামলে আমি তার দিকে তাকাই। চত্বরটি এত বিরাট যে উটে চড়তে পারলে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে সুবিধা হয়। কিন্তু মতামত দেওয়ার কোনো সুযোগ পাই না।
‘হাই ময়রা, আই অ্যাম লুকিং ফর ইউ,’ বলে তার দিকে ছুটে আসে সাড়ে ছয় ফুটি এক নওজওয়ান। জ্যাকবকে শনাক্ত করতে কোনো অসুবিধা হয় না। এ তরুণকে আমি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রোতে আসার ট্রেনে— করিডরে ময়রার গতর-সংলগ্ন হয়ে দাঁড়াতে দেখেছি।
জ্যাকব ইসরায়েল থেকে আসা পর্যটকদের সঙ্গে মিলেঝুলে অলরেডি ভাড়া করেছে ছোটখাটো উটের একটি কাফেলা। সে জানতে চায়, ময়রা তাদের সঙ্গে যেতে চায় কি না। ময়রা ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকায়, সে বিড়বিড় করে বলে, ‘আই হোপ ইউ ডোন্ট মাইন্ড ইফ আই গো উইথ জ্যাকব অ্যান্ড হিজ পার্টি।’ দ্রুত জবাব দিই, ‘নট অ্যাট অল’।
কাছে এসে সে চোখে চোখ রাখে, কবজিতেও আন্তরিকভাবে একটু চাপ দেয়। বলি, ‘হ্যাভ আ নাইস ক্যামেল ট্রিপ, ময়রা।’ জ্যাকবের সঙ্গে যেতে যেতে সে একবার গ্রীবা ফিরিয়ে তাকায়, আমি হাত নাড়ি।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি চুপচাপ। দু-তিনটি ছোট ছোট কাফেলা আমার দিকে যেন ধেয়ে আসে, সরে দাঁড়াই। কেন জানি খালি খালি লাগে। কাঠফাটা রোদ মাথায় ফারাওদের সমাধি দেখার তুমুল আগ্রহ কী কারণে জানি মন থেকে কর্পূরের মতো উবে যায়। ভারি ক্লান্ত বোধ করি। মনে হয়, ভালোমন্দে কায়রোতে একটি দিন তো প্রায় কেটেই গেল। থাক, পিরামিডের সিঁড়ি ভেঙে আর কাজ নেই। হোটেলে ফিরে যাওয়ার জন্য সস্তায় পাবলিক বাসটাস কিছু পাওয়া যায় কি না, আমি এর তালাশ করি।
(চলবে)

রাতের রেলগাড়িতে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রো এসে পৌঁছেছি মাঝরাতে। তো বেশ বেলা করে পাবলিক বাসে রওনা হই আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। এক জায়গায় ট্রাফিক জ্যামে বাস দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। আমি কায়রো নগরীর পর্যটন মানচিত্রে চোখ রেখে জানালা দিয়ে জমজমাট স্ট্রিটের দিকে তাকাচ্ছি। আরবি ভাষার নিচে ইংরেজিতে লেখা একটি সাইনবোর্ড নজরে পড়ে, ‘তান্নেউরা ইজিপশিয়ান হেরিটেজ ড্যান্স একাডেমি’। এর নিচে রঙের তরঙ্গ বিভঙ্গে নৃত্যরতা মমির দেশের এক মোমের পুত্তলিপ্রতিম রমণীর রেখাচিত্র।
একটি রংচটা ট্যাক্সি এসে ফুটপাতে দুই চাকা তুলে ব্রেক কষে। তা থেকে হাসিমুখে নামে ময়রা, দীর্ঘ দাড়িওয়ালা একটি ছেলে ট্যাক্সির ভাড়া মেটাচ্ছে। ছেলে-মেয়ে দুটিকে গেল রাতের ট্রেনে ঘনিষ্ঠ হতে আমি চাক্ষুষ করেছি। ময়রাকে আধ-চেনা বলা যায়, তবে দীর্ঘদেহী তরুণটি সম্পর্কে আমার বিশেষ কোনো ধারণা নেই।
দিন তিনেক আগে সাইপ্রাস থেকে উড়ে এসে আমি ল্যান্ড করি আলেকজান্দ্রিয়ায়। বিমানে আমার পাশের সিটে বসেছিল ময়রা। খানিক কথাবার্তাও হয়েছে। ববড করা থুপি থুপি কালো চুলের মেয়েটি যুক্তরাষ্ট্রের এক ইউনিভার্সিটিতে পুরো এক বছর ব্রেক-ইয়ার নিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলে। ওখানকার নাগিব ডেজার্টের কিবুটজ কমিউন বা তরুণদের প্রশিক্ষণের জন্য তৈরি সমবায় খামারে সে পুরো নয় মাস কাটাবে। ইসরায়েল যাওয়ার পথে সাইড-ট্রিপ হিসেবে সপ্তাহ দেড়েক ইজিপ্টে কাটাচ্ছে।
না, আলেকজান্দ্রিয়া শহরে ভিন্ন ভিন্ন গেস্টহাউসে বসবাসের কারণে ময়রার সঙ্গে আমার ফের দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। তবে কায়রো আসার পথে রাতের ট্রেনে তাকে আরেক নজর দেখি। ফার্স্ট ক্লাস অ্যাপার্টমেন্ট-সংলগ্ন করিডরে চলছে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ পর্যটকদের জমজমাট আড্ডা। হাতে হাতে ঘুরছে হার্ড ড্রিংকসের ফ্লাক্স। এদের সঙ্গে ময়রাও আছে। তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সাড়ে ছয় ফুট দেহের শক্তপোক্ত দীর্ঘ দাড়িওয়ালা এক যুবক। ছেলেটির ভেস্টের লেপালে জ্বলজ্বল করছে ইহুদি সম্প্রদায়ের পবিত্র প্রতীক ‘স্টার আব ডেভিড’।
আমি মাইকিং সামলাতে ট্রেনের দেয়ালে হাত রেখে ভারসাম্য রক্ষা করি। খিলখিল করে হেসে ওঠে ময়রা। দেখি, তরুণটি তার খোলা কাঁধে আঙুল দিয়ে কিছু লিখছে। হাসতে হাসতে তার গায়ে গড়িয়ে পড়ে মেয়েটি। আমি কায়ক্লেশে তাদের অতিক্রম করে হেঁটে যাই ডাইনিং কারে।
আল হোসেইন স্কয়ারে আমি বাস থেকে নামে। মানচিত্র অনুযায়ী আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস কাছেই। সামান্য একটু হাঁটতেই চলে আসি অকুস্থলে। আমার ভ্রমণ-বাজেট সীমিত, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে গাইড ছাড়াই এসেছি। ফলক পড়ে জানতে পারি, প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠ স্থাপিত হয়েছিল ৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে, মিসরে কায়েমি খেলাফতের শাসনামলে।
ক্যাফেটেরিয়ায় এসে ছাত্রদের সঙ্গে আমি কথাবার্তা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু সবাই এমন ব্যস্তসমস্ত হয়ে আছে যে আমার সঙ্গে বাতচিতের কারও ফুরসত হয় না। এরা আমাকে দেখিয়ে দেয় প্রশাসনিক ভবনের দালান।
অ্যাডমিশন-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের অজুহাত দিয়ে কোশেশ করি দালানে প্রবেশের। দারোয়ান কেলাশনিকভ বন্দুকটি কেবলামুখি করে বেদুইনদের চাঁছাছোলা জবানে ঘোরতর আপত্তি জানান। বেরিয়ে আসি উদ্যানে।
এদিকে পুষ্পিত তরুলতার সংখ্যা কম। তবে চৌবাচ্চার কাছে খেজুরগাছের ছায়ায় বসে জাবর কাটছে তিনটি উট। ঠিক বুঝতে পারি না, এ জানোয়ারদের এখানে আগমনের হেতুটা কী? ভাবি, হয়তো অধ্যাপকেরা মরুজাহাজদের যানবাহন হিসেবে ইস্তেমাল করছেন। একটি উট খামোকা খেপে গিয়ে আমাকে সশব্দে তাড়া করে আসে। ছোটাছুটি করে আমি বারবার গেট বলে পরিচিত, বেজায় উঁচু ও কারুকাজে চোখধাঁধানো দেউড়ির তলায় ঢুকে পড়ে আত্মরক্ষা করি।
ফিরে তাকাই, মিসরি স্থাপত্যকলার চমৎকার নিদর্শনে ভরপুর আলিশান এ তোরণের দিকে। চোখের সামনে ‘আজ-জোহরা’ নামে দুনিয়াজুড়ে মশহুর আল আজহার মসজিদের খিলানময় বিস্তার। আমি সারি দিয়ে তৈরি ৩০০টি স্তম্ভের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক করতে করতে বেদিশা হয়ে ঢুকে পড়ি প্রার্থনার পবিত্র ইমারতে। খুঁজি, বিবি ফাতেমার পবিত্র স্মৃতিতে উৎসর্গিত কিতাবখানার দরওয়াজা।
দোরগোড়ায় পাগড়িওয়ালা এক পরহেজগার বান্দা আমার পথ রোধ করেন। বলি, শুনেছি যে এ গ্রন্থাগারের পুস্তকের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তিনি ক্যালকুলেটর বের করে সংগৃহীত বইপত্রের সঠিক হিসাব দেখান, স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ওঠে ৬০০,০০০ সংখ্যাটি। বলি, ‘অন্তত একটি বই চোখে দেখার সুযোগ দিন, হুজুর।’ ভদ্রলোক সম্ভবত আমার ভাষা বুঝতে পারেন না, ফের অনুনয় করি কেতাবখানার ভেতরটা চাক্ষুষ করার, চিড়ে ভিজে না।
হুজুর আমার কবজি চেপে ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে দেখান দেয়ালে ঝোলানো নামাজের জোব্বা, টুপি ও তসবি। তিনি ‘ওধু ওধু’ এবং ‘সালাত সালাত’ বলে আওয়াজ দিলে, আন্দাজ করি, তিনি আমাকে অজু করে নামাজ আদায় করার অনুরোধ করছেন। আমি ফের ‘কিতাব কিতাব’ বলে কাকুতি করি, তিনি রোষকষায়িত নজরে আমাকে অবলোকন করে কঠোর স্বরে উচ্চারণ করেন ‘সালাত’। চকিতে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার একটি চরণ ‘নামাজ পড়িস বেটা..’, আমার করোটিতে ঘাই মেরে ওঠে।
প্রার্থনার পবিত্র ইমারত থেকে বেরিয়ে এসে ভারি খাজুল হালতে চুপচাপ হাঁটি। চলে আসি আল হোসেন স্কয়ারের প্রান্তিকে। এদিকে বেশ কিছু মরুপ্রিয় উদ্ভিদের সুশৃঙ্খল বিস্তারে তৈরি হয়েছে আরবান এক পুরোদস্তুর পার্ক, চারদিকে ছড়িয়ে আছে শ্যামল ছায়া। গেটে দাঁড়িয়ে ভাবি, কায়রোতে খানিক ঘোরাফেরার শুরুতেই কুফা লাগল, সীমিত বাজেটের জন্য আমি এ ফারাওকুলের স্মৃতিনন্দিত নগরীতে আরও একটি-দুটি দিন কাটিয়ে ফের গাইডসহ আল আজহারে আসতে পারব না। অর্থাৎ এ বিশ্ববিদ্যালয় ও আজ-জোহরা মসজিদের কেতাবখানাটি আমার অদেখাই থেকে যাবে।
পার্কের গেটে দাঁড়িয়ে আপনমনে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করছি। দেখি, দ্রুত হেঁটে এদিকে আসছে ময়রা। পুলিশের তাড়া খাওয়া গোপন সংগঠনের বিপ্লবীর মতো মেয়েটি বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে সতর্কভাবে পেছন দিকে তাকাচ্ছে, আর প্রায় ছুটছে। আমাকে দেখতে পেয়ে রীতিমতো হকচকিয়ে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ে, অতঃপর দ্রুত সামলে নিয়ে মুখে নার্ভাস হাসি ফুটিয়ে বলে, ‘হাই, গুড টু সি ইউ।’
ছুটে আসার তোড়ে ময়রা নিঃশ্বাস ফেলছে জোরে জোরে। স্বল্প ঝুলের টপে খানিক অনাবৃত বিভাজিকায় বিস্ফারিত হচ্ছে স্তনযুগল, মুখে ও গলায় বুজকুড়ি কাটছে ঘামের তরল বিড। সে পার্স থেকে রুমাল বের করতে করতে জানতে চায়, ‘ক্যান আই ওয়াক আ বিট উইথ ইউ।’ ‘সার্টেনলি’ বলে আমি পার্কটি দেখিয়ে প্রস্তাব করি, ‘হাউ অ্যাবাউট স্পেন্ড সাম টাইম ইন দিস পার্ক?’ গাছপালার ছায়ানিবিড় পরিসরে সময় কাটানোতে সে সম্মতি দিলে, আমরা টিকিট কেটে ঢুকে পড়ি উদ্যানে।
উদ্যানটির কোথাও কোথাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ওয়েসিসের শ্যামলে বালুকার ধূসরিমা আবহ। একটি-দুটি ফোয়ারার ঝিরি ঝিরি জল তাতে যুক্ত করছে সজল ব্যঞ্জনা। আমরা একটি বেঞ্চে বসে পড়ি। ময়রা ক্লিওপেট্রা কুইন নামে একটি সুরভিত সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমাকে এক শলা অফার করে। আমি তা জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে শেয়ার করি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ও আজ-জোহরা মসজিদের লাইব্রেরি দেখতে চেয়ে ব্যর্থ হওয়ার অভিজ্ঞতা।
আধপোড়া সিগারেটটি নিভিয়ে দিয়ে ময়রাও ফ্র্যাংকলি তার অত্যন্ত নেগেটিভ অভিজ্ঞতা অকপটে শেয়ার করে। জানতে পারি, জ্যাকব নামে ইসরায়েলের একটি জুইশ ছেলের সঙ্গে ট্যাক্সিভাড়া শেয়ার করে সে এসেছিল আল হোসেইন স্কয়ারে। ওখানকার আল তান্নেউরা হেরিটেজ ড্যান্স একাডেমিতে নাকি পর্যটকদের জন্য আয়োজিত হয়েছে বেলি ড্যান্স শেখার ক্লাস। ময়রা ক্লাসটি নিতে চায়। তো জ্যাকব তাকে ওখানে ড্রপ করে দিয়ে চলে যায় তার পথে।
ড্যান্স একাডেমিতে ঢুকে ময়রা জানতে পারে, পুরো একটি ক্লাস চালানোর জন্য যথেষ্ট পর্যটক না আসাতে আজকের প্রশিক্ষণ বাতিল করা হয়েছে। তবে একজন আধবুড়ো মেইল ইনস্ট্রাক্টর পনেরো ডলারের বিনিময়ে তাকে ড্যান্সের কিছু অন্ধিসন্ধি দেখিয়ে দিতে রাজি হন। তো স্টুডিওতে তিনি তাকে মিনিট তিরিশেকের প্রশিক্ষণে শিখিয়ে দেন বেশ কয়েকটি মুদ্রা।
তারপর ময়রাকে ড্রেসিংরুমে নিয়ে গিয়ে বেলি ড্যান্সারদের ড্রেস পরতে বলেন। ইনস্ট্রাক্টর তাকে ড্রেস পরতে সাহায্য করতে গিয়ে, তার তলপেট ও নিতম্ব বারবার স্পর্শ করলে সে খেপে গিয়ে, ইনস্ট্রাকটরকে আচমকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে।
একাডেমির সামনে কোনো ট্যাক্সি না পেয়ে সে হেঁটে যেতে চাচ্ছিল খান আল খালিলি নামক বাজারের দিকে। একটি মারকুটে চেহারার ইজিপশিয়ান যুবক তাকে ফলো করে। ছেলেটি বারবার তার শরীর ঘেঁষে হেঁটে যাওয়ার সময় ফের স্পর্শ করছিল তার পশ্চাদ্দেশ, দু-চারজন পথচারীও বিষয়টি দেখেছে, দেখে খিক খিক করে হেসেছে, কিন্তু কেউ তাকে সেভ করতে এগিয়ে আসেনি।
কথা বলতে বলতে ক্রোধে ও উত্তেজনায় ময়রা উঠে দাঁড়ায়। তার হয়রানিতে আমি শুধু ব্যথিত নয়, বেজায় বিব্রতও বোধ করি। আমি সচেতন যে এ ধরনের হয়রানির অভিজ্ঞতা হয়...স্ট্রেসফুল অ্যান্ড ইনটেন্স, কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে প্রচুর। ঠিক বুঝতে পারি না—কী বলব। আমরা চুপচাপ হাঁটি। ময়রা অস্বস্তিকর নীরবতার আইস ব্রেক করে জানতে চায়, ‘খান, আল খালিলি মার্কেট থেকে আমি বেলি ড্যান্সের কিছু আইটেম কিনতে চাচ্ছি। তুমি আমার সঙ্গে যাবে কি?’
বাজারটি পার্কের লাগোয়া। তো আমি যেতে রাজি হই, তবে, ওদিকে যাওয়ার আগে আমি উদ্যান-সংলগ্ন আয়ুবিদ ওয়ালটি চাক্ষুষ করতে চাই। ঐতিহাসিক দেয়ালটির কাছাকাছি হেঁটে আসতে বিশেষ একটা সময় লাগে না। জানতে পারি, ১১৭৬ সালে মিসরের সুলতান সালাদিন এ প্রাচীর, একাধিক বুরুজ ও তোরণ নির্মাণ করিয়েছিলেন ক্রুসেডার যোদ্ধাদের কাছ থেকে নগরীর সুরক্ষার প্রয়োজনে। পুরো এলাকায় চলছে পুরাতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি।
ময়রা কেন জানি উত্ত্যক্ত হয়ে ওঠে কেবলই অভিযোগ করতে থাকে। মিসরে সিনাই ডেজার্টের কাছাকাছি শারম এল শেখের রিসোর্টে সে আগেও এসেছিল একবার। এ ধরনের যৌন হয়রানির ঘটনা সেখানেও ঘটেছিল। এবারকার ট্রিপে আলেকজান্দ্রিয়ার পাবলিক বাস চড়তে গিয়ে একজন যাত্রীও নাকি বারবার তার দেহ অকারণে অত্যন্ত অসংগতভাবে স্পর্শ করেছে।
ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে শুধু দুঃখজনক নয়, পুরুষ হিসেবে আমার জন্য ভীষণ লজ্জাকরও বটে। আমি আন্তরিকভাবে সহানুভূতি জানাই। তাতে খেপে ওঠে ময়রা বারবার বলে, ‘আই হেইট ইজিপ্ট, হেইট অল ইজিপশিয়ান ম্যান...।’ আর কিছু না বলে আমরা খান আল খালিলি বাজারের দিকে রওনা হই। হাঁটতে হাঁটতে সে এবার পুরো মিসরবাসীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে অধৈর্য হয়ে হঠাৎ করে বলে বসি, ‘হোয়াই ইউ ক্লেইম টু ইজিপ্ট অ্যাগেইন, এ দেশে আরেকবার না এলেও তো পারতে ময়রা?’
সে দাঁড়িয়ে পড়ে—আমার কাঁধে চাটি মেরে বলে, ‘শোন, আমার পূর্বপুরুষ এক যুগে—হাজার হাজার বছর আগে—মিসরে ক্রীতদাস হিসেবে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের মেহনতে তৈরি হয়েছে অনেক পিরামিড ও হরেক রকমের ঐতিহাসিক স্থাপনা। আই ডু হ্যাভ দ্য রাইট টু সি দ্য কান্ট্রি দ্যাট মাই এনসেসটার হ্যাড বিল্ট।’
চকিতে আমার করোটিতে ভেসে যায়, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত কাহিনি। তখন মিসরে চলছে ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের রাজত্ব। বনি ইসরায়েল বা ইহুদি সম্প্রদায়কে ক্রীতদাস প্রথার জিঞ্জিরে জড়িয়ে তাদের মেহনতে তিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন নগরী ও নানা ধরনের মনুমেন্ট। এ সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি তার জুলুমের কোনো সীমা-সরহদ্দ ছিল না।
আমি অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে ময়রার হাত স্পর্শ করে বলি, ‘ইউ অলসো হ্যাভ দ্য রাইট টু বি ট্রিটেড ডিসেন্টলি। ইউ মাস্ট নট বি হেরাসড সেকসুয়্যালি অন দি স্ট্রিট অব কায়রো।’
বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে টুকটাক কথাবার্তায় জানতে পারি, পারিবারিক গল্পগাথা থেকে ময়রা জেনেছে, মধ্যযুগে তার পরিবার ছিল স্পেনের আন্দুলিশিয়ার একটি মুসলিম রাজ্যের বাসিন্দা। যুদ্ধে মুর নামে পরিচিত মুসলমানদের পরাজয়ের পর খ্রিষ্টরাজ প্রতিষ্ঠিত হলে, তার পরিবার আন্দুলিশিয়া থেকে বহিষ্কৃত হয়ে অভিবাসী হিসেবে ঘর বেঁধেছিল পোল্যান্ডে। ময়রার বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন নাৎসি সামরিক চক্র পরিচালিত গ্যাস-চেম্বারে নির্মমভাবে নিহতও হয়েছিল। তবে তার দিদিমা নাকি এক সহানুভূতিসম্পন্ন খ্রিষ্টান পরিবারের দত্তক হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পেতে সমর্থ হয়েছিলেন।
আমরা ঢুকে পড়ি খান আল খালিলি নামক ফাতেমি খিলাফতের জামানায় নির্মিত বাজারে। চকমিলান পরিসরে স্থাপত্যের কেরেসমাতিতে সৃষ্টি হয়েছে গলিঘুঁজির রীতিমতো গোলকধাঁধা। হরেক রকমের মশলার পানজেন্ট গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে মিসরের মেস্ক-আম্বরের সুঘ্রাণ। একটি পুরো গলিজুড়ে ডিসপ্লে করা হয়েছে রুপার গোলাপপাশ ও আতরদান। কাছেপিঠে কোথাও ঝলমল করছে সম্ভাব্য কনেদের স্বপ্ন হয়ে স্বর্ণের জেওরাত। আমরা হেঁটে যাই তামা-কাঁসার সরণিতে। এগুলোর জেল্লা দেখে তাক লেগে যাওয়ার জোগাড় হয়। ময়রা ফিসফিস করে বলে, ‘লুক অ্যাট অল দিস সিলভার, কপার অ্যান্ড ব্রাস আইটেমস। ওয়াও...হোয়াট আ কালারফুল ওরিয়েন্টাল বাজার!’
যেহেতু আমার কেনাকাটার বিত্ত নেই, বাজারের সওদাপাতির জৌলুশে খানিক বিরক্ত লাগে। ময়রা কিনতে চায় বেলি ড্যান্সের জন্য পোশাক-আশাক। বলি, আমি না হয় একটি ক্যাফেতে বসি, তুমি কেনাকাটা সেরে ফিরে এস। সে রাজি না হয়ে হাত ধরে বলে, ‘কাম অন...মাত্র পনেরো-বিশ মিনিটের ব্যাপার, আমার শপিং শেষ হলে পর...লেটস হ্যাভ লাঞ্চ টুগেদার।’
একটু যেন অন্তরঙ্গতার ছোঁয়া পাই। ভাবি, ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আয়োজিত মিছিল-মিটিংয়ে আমি হামেশা শরিক হই, যে কারণে ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষজনের সঙ্গে মন খুলে মেলামেশা করতে পারি না। দিস এন অপরচুনিটি ফর মি টু লার্ন অ্যাবাউট আ জুইশ গার্ল। তার সঙ্গে একটু জানাশোনা হলে পর, হয়তো আমার অহেতুক হোস্টাইল ভাব খানিকটা কাটবে।
বেলি ড্যান্সের পোশাক-আশাকে ভরপুর পুরো একটি বিপণিবিতানের তালাশ পাওয়া যায়। ময়রা দক্ষতার সঙ্গে দামদর করে কিনে ফেলে, পর্যটকদের কাছে ‘হেরেম প্যান্ট’ নামে পরিচিত ‘বেদলাহ’ বা ঝলমলে ঝুটা রত্ন বসানো ব্রা ও গাগরা গোছের গাউন। কিন্তু প্রচুর সময় নেয় অচল মুদ্রাগাঁথা হিপ স্কার্ফ নির্বাচনে। কিছুতেই যেন হেরেম প্যান্টের সঙ্গে স্কার্ফের বর্ণ বিচ্ছুরণের সঠিক মিল হয় না। সে বারবার কোমরে ত্রিকোণ হিপ স্কার্ফটি জড়িয়ে ধরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, ঘুরেফিরে নৃত্যের ভঙ্গিতে হরেক মুদ্রায় নিজেকে দেখে। তারপর মতামতের জন্য আমার শরণাপন্ন হয়।
আমি কোমর বাঁকা করে দাঁড়ানো যুবতীটির দিকে নিরিখ করে তাকাই। হিপ স্কার্ফের রুপালি মুদ্রাগুলো তার পৃথুল নিতম্বের রেখায় যুক্ত করেছে মৃদু আভাময় বিচ্ছুরণ। ত্রিকোণ বস্ত্রখণ্ডটি অনাবৃত মিডরিফটে নিম্ন নাভিটির ঠিক নিচে গিট্টি দিয়ে বাঁধা। সে নিম্নাঙ্গে নৃত্যমুদ্রার একটি লঘু ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলে, ফ্রিজ হয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘হাউ অ্যাম আই লুকিং?’ চটজলদি জবাব দিই, ‘ইনডিড অ্যাট্রাকটিভ।’
তোষামোদে তুষ্ট না হয়ে ময়রা ভ্রুকুটি করে বলে, ‘ইজ দ্যাট অল ইউ হ্যাভ টু সে।’ আমি খানিকটা প্ররোচিত হয়ে, সচেতনভাবে চাটুকারিতার বহুল ব্যবহৃত বাণ হানি, ‘এটা পরে ড্যান্স করলে, পুরুষ দর্শকদের শুধু হৃদয়ই ভাঙবে না, লিসেন ময়রা, আই অ্যাম টেলিং ইউ...তাদের ঘরসংসারও তছনছ হবে।’ তোষামোদে কাজ হয়। ময়রা ‘কুল…থ্যাংকস আ লট’ বলে কাউন্টারে এসে পেমেন্ট সারে।
নৃত্য-সংক্রান্ত পোশাকের দোকান থেকে বের হয়ে সে ফিসফিসিয়ে আমাকে যেন নিশ্চিত করে, ‘লিসেন, ইসরায়েলের যে কিবুটস বা সমবায় খামারে আমি নয় মাস কাটাব, ওখানে প্রতি সপ্তাহান্তে বসে ছেলেমেয়েদের জোড়ায় জোড়ায় নৃত্যের আসর। ছেলেদের সবাই এলিজিবল ব্যাচেলর, কারও ঘরসংসার ভাঙার কোনো আশঙ্কা নেই।’
প্রতিক্রিয়ায় বলি, ‘থ্যাংকস আ বাঞ্চ ময়রা...ফর দি এস্যুরেন্স। তবে একটি প্রশ্ন, হোয়াই আর ইউ ইন্টারেস্টেড টু লার্ন বেলি ড্যান্স?’ দ্রুত জবাব আসে, ‘আমার পূর্বপুরুষেরা একসময় মিসরে বসবাস করত। সে যুগে ইহুদি মেয়েরা বেলি ড্যান্স করত। সো ইটস নট বিলং টু অনলি ইজিপশিয়ান আরবস। এই ঐতিহ্যে ইহুদি সম্প্রদায়েরও ভাগ আছে।’
প্রশ্ন না করে পারি না, ‘জাস্ট ফলোইং মিডল ইস্টার্ন জুইশ ট্র্যাডিশন, ইজ দ্যাট অল ময়রা?’ দাঁড়িয়ে পড়ে খুব মিষ্টি করে হেসে সে বলে, ‘লুক, আই লাভ মাই ফিগার...বেলি ড্যান্স ইজ গোয়িং টু কিপ মাই বডি নাইস অ্যান্ড টাইট।’
হাঁটতে হাঁটতে আমি বাজারের চকমিলান পরিসরের বন্ধনীর মতো বাঁকানো কারুকাজ করা খিলানগুলো ফের খেয়াল করে দেখি। ঝিক করে করোটিতে ফিরে আসে, বছর কয়েক আগে পড়া মিসরের যশস্বী লেখক নাগিব মাহফুজের একটি উপন্যাসে খিলানময় গলিপথে ঘুরপাক করার বর্ণনা। ময়রা হাঁটতে হাঁটতে কেবলই উদগ্রীব হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। জানতে চাই, ‘হোয়াট আর ইউ লুকিং ফর?’
অন্যমনস্কভাবে সে জবাব দেয়, ‘আই অ্যাম স্টিল লুকিং ফর জ্যাকব। চেককাটা নেকস্কার্ফ কেনার জন্য তার এ বাজারে আসার কথা। একটু খেয়াল রাখো তো, হি ইজ ভেরি টল।’
কেন জানি বিরক্ত লাগে, ইচ্ছা হয় বলে বসি, ময়রা, তুমি আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছ, সামান্য সময় জ্যাকবের কথা না ভেবে থাকতে পার না। ঝিক করে আমার স্নায়ুতে সৌজন্যবোধের কণিকাগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। নীরবে নিজেকে শাসন করে বলি, মেয়েটি মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে শিকার হয়েছে যৌন হয়রানির। এ মুহূর্তে খামোকা জেলাস হওয়াটা হবে অশ্লীল আচরণের শামিল।
আমরা চলে এসেছি সার্কুলার সরণিতে। দুই কদম সামনে বাড়তেই পাওয়া যায় নাগিব মাহফুজের নামে চমৎকার একটি রেস্তোরাঁ। পেটে খিদেও জানান দিচ্ছে, বলি, ‘লেটস গো অ্যান্ড হ্যাভ লাঞ্চ, ময়রা।’
দেয়ালে ঝুলছে ১৯৮৮ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়া কথাশিল্পী নাগিব মাহফুজের মস্ত বড় ফটোগ্রাফ। তার তলায় আমরা টেবিল পাই। আমি মেনু ঘাঁটি। ময়রা মাহফুজের ছোটগল্প নিয়ে কথা বলে। প্রকাশিত মোট ৩৫০টি গল্পের কোনোটাই মনে হয় তার পড়তে বাকি নেই। খান আল খলিলি বাজারের বর্ণনা আমি কোন বইতে পড়েছি, তা মনে করতে না পারায় ভারি বিব্রত লাগে।
খাবারের তালিকায় পিজিয়ন রাইস নামে একটি আইটেম আমাদের পছন্দ হয়। কিন্তু দামেদরে মনে হয় সব খাবারই এখানে অত্যন্ত চড়া। আমরা একটি ডিশ শেয়ার করতে চাই। বেদুইনদের মতো জালাবিয়া নামে ঢোলা পিরহান পরা ওয়েটার দ্রুত এক্সট্রা প্লেট, নাইফ প্রভৃতি সরবরাহ করে। সাইড হিসেবে গ্রিল করা এগপ্লান্টের সঙ্গে পরিবেশিত হয় চিকপির চাট ও তাবুলি।
পিলাফের মতো তপ্ত রাইস থেকে ছড়াচ্ছে সিনেমন ও লেবুর সুগন্ধ। ভাতের স্তূপের ওপর বসে আছে আধপোড়া একটি পায়রা। আমরা পিকাসোর আঁকা শ্বেতকপোতের প্রতীক নিয়ে কথা বলতে বলতে, মৃত পায়রাটিকে ডানা ধরে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করি। চতুর্দিকে ছড়ায় বেশ কিছু তপ্ত ভাত।
ওয়েটার কোরবানির দুম্বা জবাইয়ের ধারালো একখানা খঞ্জর দিয়ে বিষয়টা সুরাহা করে দেন। মাংসের মুখরোচক টুকরা চিবাতে চিবাতে নীরবে ভাবি, গাঙ্গেয় উপত্যকার এক মুসলিম তরুণের সঙ্গে মিলেঝুলে, ইহুদি একটি মেয়ের শান্তিপূর্ণভাবে কপোত ভক্ষণের বিষয় নিয়ে কখনো কিছু লেখার আমার সুযোগ হবে কি?
আহারের তামাদি হওয়ামাত্র ওয়েটার আওয়াজ দেন, ‘কাহওয়াতুন মিসরিওয়াতুন।’ পরিভাষাটি বুঝতে না পেরে আমি ও ময়রা বেয়াক্কেলের মতো একে অপরের মুখের দিকে তাকাই। নিউইয়র্ক সিটির স্কাইলাইনের ছবি আঁকা টিশার্ট পরা একটি বালক নিয়ে আসে পিতলের বড়সড় কেটলি। কফির গাঢ় সুগন্ধি থেকে যেন ছড়াচ্ছে উদ্দীপনা। ওয়েটার মাশাই পেয়ালায় তা ঢেলে দিয়ে সামনে সাজিয়ে রাখে সুগার পট ও সিনেমন ডাস্টের জার। ময়রা কফির আনুষঙ্গিক অনুপান হিসেবে অর্ডার করে সিসা-হুক্কা।
হুক্কায় ধূমপান সেরে বেশ খোশমেজাজে আমরা শেয়ারে একটি ট্যাক্সি ভাড়া করি। বাতচিতে ফিরে ফিরে আসে নাগিব মাহফুজের গল্পে ব্যবহৃত একাধিক চরিত্রের বর্ণনা। গিজা পিরামিডের চত্বরে নামামাত্র মনে হয়, কায়রো নগরীর অজস্র দালানকোঠার এক সম্প্রসারিত মিছিল মরুপ্রান্তরে এসে যেন হঠাৎ করে ব্রেক কষে থেমে পড়ছে। অপরাহ্ণের তেজি আলোয় একাধিক পিরামিডের দিকে আমরা একসঙ্গে তাকাই।
পর্যটকদের কোলাহলে মনে হয়, এ পরিসর থেকে নির্বাসিত হয়েছে নীরবতা। নগরীর জীবনযাপনের শব্দপুঞ্জও যেন বলকে ওঠা দুধের ফেনার মতো উথলে পড়ছে। ময়রা তাজ্জব হওয়া স্বরে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘হোয়াট আ ম্যাসিভ মনুমেন্ট...ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড ইট ইজ ফোর থাউজেন্ড ফাইভ হানড্রেড ইয়ারস ওল্ড, ওয়াও!’ আমাদের পাশ দিয়ে পর্যটক-পিঠে বালুকা ছিটিয়ে আগুয়ান হয় কয়েকটি উট।
ময়রা জানতে চায়, ‘উড ইউ লাইক টু শেয়ার আ ক্যামেল রাইড উইথ মি?’ পাথরের বিপুল স্তূপে প্রতিফলিত চড়া রোদ সামলে আমি তার দিকে তাকাই। চত্বরটি এত বিরাট যে উটে চড়তে পারলে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে সুবিধা হয়। কিন্তু মতামত দেওয়ার কোনো সুযোগ পাই না।
‘হাই ময়রা, আই অ্যাম লুকিং ফর ইউ,’ বলে তার দিকে ছুটে আসে সাড়ে ছয় ফুটি এক নওজওয়ান। জ্যাকবকে শনাক্ত করতে কোনো অসুবিধা হয় না। এ তরুণকে আমি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রোতে আসার ট্রেনে— করিডরে ময়রার গতর-সংলগ্ন হয়ে দাঁড়াতে দেখেছি।
জ্যাকব ইসরায়েল থেকে আসা পর্যটকদের সঙ্গে মিলেঝুলে অলরেডি ভাড়া করেছে ছোটখাটো উটের একটি কাফেলা। সে জানতে চায়, ময়রা তাদের সঙ্গে যেতে চায় কি না। ময়রা ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকায়, সে বিড়বিড় করে বলে, ‘আই হোপ ইউ ডোন্ট মাইন্ড ইফ আই গো উইথ জ্যাকব অ্যান্ড হিজ পার্টি।’ দ্রুত জবাব দিই, ‘নট অ্যাট অল’।
কাছে এসে সে চোখে চোখ রাখে, কবজিতেও আন্তরিকভাবে একটু চাপ দেয়। বলি, ‘হ্যাভ আ নাইস ক্যামেল ট্রিপ, ময়রা।’ জ্যাকবের সঙ্গে যেতে যেতে সে একবার গ্রীবা ফিরিয়ে তাকায়, আমি হাত নাড়ি।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি চুপচাপ। দু-তিনটি ছোট ছোট কাফেলা আমার দিকে যেন ধেয়ে আসে, সরে দাঁড়াই। কেন জানি খালি খালি লাগে। কাঠফাটা রোদ মাথায় ফারাওদের সমাধি দেখার তুমুল আগ্রহ কী কারণে জানি মন থেকে কর্পূরের মতো উবে যায়। ভারি ক্লান্ত বোধ করি। মনে হয়, ভালোমন্দে কায়রোতে একটি দিন তো প্রায় কেটেই গেল। থাক, পিরামিডের সিঁড়ি ভেঙে আর কাজ নেই। হোটেলে ফিরে যাওয়ার জন্য সস্তায় পাবলিক বাসটাস কিছু পাওয়া যায় কি না, আমি এর তালাশ করি।
(চলবে)
মঈনুস সুলতান

রাতের রেলগাড়িতে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রো এসে পৌঁছেছি মাঝরাতে। তো বেশ বেলা করে পাবলিক বাসে রওনা হই আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। এক জায়গায় ট্রাফিক জ্যামে বাস দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। আমি কায়রো নগরীর পর্যটন মানচিত্রে চোখ রেখে জানালা দিয়ে জমজমাট স্ট্রিটের দিকে তাকাচ্ছি। আরবি ভাষার নিচে ইংরেজিতে লেখা একটি সাইনবোর্ড নজরে পড়ে, ‘তান্নেউরা ইজিপশিয়ান হেরিটেজ ড্যান্স একাডেমি’। এর নিচে রঙের তরঙ্গ বিভঙ্গে নৃত্যরতা মমির দেশের এক মোমের পুত্তলিপ্রতিম রমণীর রেখাচিত্র।
একটি রংচটা ট্যাক্সি এসে ফুটপাতে দুই চাকা তুলে ব্রেক কষে। তা থেকে হাসিমুখে নামে ময়রা, দীর্ঘ দাড়িওয়ালা একটি ছেলে ট্যাক্সির ভাড়া মেটাচ্ছে। ছেলে-মেয়ে দুটিকে গেল রাতের ট্রেনে ঘনিষ্ঠ হতে আমি চাক্ষুষ করেছি। ময়রাকে আধ-চেনা বলা যায়, তবে দীর্ঘদেহী তরুণটি সম্পর্কে আমার বিশেষ কোনো ধারণা নেই।
দিন তিনেক আগে সাইপ্রাস থেকে উড়ে এসে আমি ল্যান্ড করি আলেকজান্দ্রিয়ায়। বিমানে আমার পাশের সিটে বসেছিল ময়রা। খানিক কথাবার্তাও হয়েছে। ববড করা থুপি থুপি কালো চুলের মেয়েটি যুক্তরাষ্ট্রের এক ইউনিভার্সিটিতে পুরো এক বছর ব্রেক-ইয়ার নিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলে। ওখানকার নাগিব ডেজার্টের কিবুটজ কমিউন বা তরুণদের প্রশিক্ষণের জন্য তৈরি সমবায় খামারে সে পুরো নয় মাস কাটাবে। ইসরায়েল যাওয়ার পথে সাইড-ট্রিপ হিসেবে সপ্তাহ দেড়েক ইজিপ্টে কাটাচ্ছে।
না, আলেকজান্দ্রিয়া শহরে ভিন্ন ভিন্ন গেস্টহাউসে বসবাসের কারণে ময়রার সঙ্গে আমার ফের দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। তবে কায়রো আসার পথে রাতের ট্রেনে তাকে আরেক নজর দেখি। ফার্স্ট ক্লাস অ্যাপার্টমেন্ট-সংলগ্ন করিডরে চলছে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ পর্যটকদের জমজমাট আড্ডা। হাতে হাতে ঘুরছে হার্ড ড্রিংকসের ফ্লাক্স। এদের সঙ্গে ময়রাও আছে। তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সাড়ে ছয় ফুট দেহের শক্তপোক্ত দীর্ঘ দাড়িওয়ালা এক যুবক। ছেলেটির ভেস্টের লেপালে জ্বলজ্বল করছে ইহুদি সম্প্রদায়ের পবিত্র প্রতীক ‘স্টার আব ডেভিড’।
আমি মাইকিং সামলাতে ট্রেনের দেয়ালে হাত রেখে ভারসাম্য রক্ষা করি। খিলখিল করে হেসে ওঠে ময়রা। দেখি, তরুণটি তার খোলা কাঁধে আঙুল দিয়ে কিছু লিখছে। হাসতে হাসতে তার গায়ে গড়িয়ে পড়ে মেয়েটি। আমি কায়ক্লেশে তাদের অতিক্রম করে হেঁটে যাই ডাইনিং কারে।
আল হোসেইন স্কয়ারে আমি বাস থেকে নামে। মানচিত্র অনুযায়ী আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস কাছেই। সামান্য একটু হাঁটতেই চলে আসি অকুস্থলে। আমার ভ্রমণ-বাজেট সীমিত, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে গাইড ছাড়াই এসেছি। ফলক পড়ে জানতে পারি, প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠ স্থাপিত হয়েছিল ৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে, মিসরে কায়েমি খেলাফতের শাসনামলে।
ক্যাফেটেরিয়ায় এসে ছাত্রদের সঙ্গে আমি কথাবার্তা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু সবাই এমন ব্যস্তসমস্ত হয়ে আছে যে আমার সঙ্গে বাতচিতের কারও ফুরসত হয় না। এরা আমাকে দেখিয়ে দেয় প্রশাসনিক ভবনের দালান।
অ্যাডমিশন-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের অজুহাত দিয়ে কোশেশ করি দালানে প্রবেশের। দারোয়ান কেলাশনিকভ বন্দুকটি কেবলামুখি করে বেদুইনদের চাঁছাছোলা জবানে ঘোরতর আপত্তি জানান। বেরিয়ে আসি উদ্যানে।
এদিকে পুষ্পিত তরুলতার সংখ্যা কম। তবে চৌবাচ্চার কাছে খেজুরগাছের ছায়ায় বসে জাবর কাটছে তিনটি উট। ঠিক বুঝতে পারি না, এ জানোয়ারদের এখানে আগমনের হেতুটা কী? ভাবি, হয়তো অধ্যাপকেরা মরুজাহাজদের যানবাহন হিসেবে ইস্তেমাল করছেন। একটি উট খামোকা খেপে গিয়ে আমাকে সশব্দে তাড়া করে আসে। ছোটাছুটি করে আমি বারবার গেট বলে পরিচিত, বেজায় উঁচু ও কারুকাজে চোখধাঁধানো দেউড়ির তলায় ঢুকে পড়ে আত্মরক্ষা করি।
ফিরে তাকাই, মিসরি স্থাপত্যকলার চমৎকার নিদর্শনে ভরপুর আলিশান এ তোরণের দিকে। চোখের সামনে ‘আজ-জোহরা’ নামে দুনিয়াজুড়ে মশহুর আল আজহার মসজিদের খিলানময় বিস্তার। আমি সারি দিয়ে তৈরি ৩০০টি স্তম্ভের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক করতে করতে বেদিশা হয়ে ঢুকে পড়ি প্রার্থনার পবিত্র ইমারতে। খুঁজি, বিবি ফাতেমার পবিত্র স্মৃতিতে উৎসর্গিত কিতাবখানার দরওয়াজা।
দোরগোড়ায় পাগড়িওয়ালা এক পরহেজগার বান্দা আমার পথ রোধ করেন। বলি, শুনেছি যে এ গ্রন্থাগারের পুস্তকের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তিনি ক্যালকুলেটর বের করে সংগৃহীত বইপত্রের সঠিক হিসাব দেখান, স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ওঠে ৬০০,০০০ সংখ্যাটি। বলি, ‘অন্তত একটি বই চোখে দেখার সুযোগ দিন, হুজুর।’ ভদ্রলোক সম্ভবত আমার ভাষা বুঝতে পারেন না, ফের অনুনয় করি কেতাবখানার ভেতরটা চাক্ষুষ করার, চিড়ে ভিজে না।
হুজুর আমার কবজি চেপে ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে দেখান দেয়ালে ঝোলানো নামাজের জোব্বা, টুপি ও তসবি। তিনি ‘ওধু ওধু’ এবং ‘সালাত সালাত’ বলে আওয়াজ দিলে, আন্দাজ করি, তিনি আমাকে অজু করে নামাজ আদায় করার অনুরোধ করছেন। আমি ফের ‘কিতাব কিতাব’ বলে কাকুতি করি, তিনি রোষকষায়িত নজরে আমাকে অবলোকন করে কঠোর স্বরে উচ্চারণ করেন ‘সালাত’। চকিতে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার একটি চরণ ‘নামাজ পড়িস বেটা..’, আমার করোটিতে ঘাই মেরে ওঠে।
প্রার্থনার পবিত্র ইমারত থেকে বেরিয়ে এসে ভারি খাজুল হালতে চুপচাপ হাঁটি। চলে আসি আল হোসেন স্কয়ারের প্রান্তিকে। এদিকে বেশ কিছু মরুপ্রিয় উদ্ভিদের সুশৃঙ্খল বিস্তারে তৈরি হয়েছে আরবান এক পুরোদস্তুর পার্ক, চারদিকে ছড়িয়ে আছে শ্যামল ছায়া। গেটে দাঁড়িয়ে ভাবি, কায়রোতে খানিক ঘোরাফেরার শুরুতেই কুফা লাগল, সীমিত বাজেটের জন্য আমি এ ফারাওকুলের স্মৃতিনন্দিত নগরীতে আরও একটি-দুটি দিন কাটিয়ে ফের গাইডসহ আল আজহারে আসতে পারব না। অর্থাৎ এ বিশ্ববিদ্যালয় ও আজ-জোহরা মসজিদের কেতাবখানাটি আমার অদেখাই থেকে যাবে।
পার্কের গেটে দাঁড়িয়ে আপনমনে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করছি। দেখি, দ্রুত হেঁটে এদিকে আসছে ময়রা। পুলিশের তাড়া খাওয়া গোপন সংগঠনের বিপ্লবীর মতো মেয়েটি বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে সতর্কভাবে পেছন দিকে তাকাচ্ছে, আর প্রায় ছুটছে। আমাকে দেখতে পেয়ে রীতিমতো হকচকিয়ে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ে, অতঃপর দ্রুত সামলে নিয়ে মুখে নার্ভাস হাসি ফুটিয়ে বলে, ‘হাই, গুড টু সি ইউ।’
ছুটে আসার তোড়ে ময়রা নিঃশ্বাস ফেলছে জোরে জোরে। স্বল্প ঝুলের টপে খানিক অনাবৃত বিভাজিকায় বিস্ফারিত হচ্ছে স্তনযুগল, মুখে ও গলায় বুজকুড়ি কাটছে ঘামের তরল বিড। সে পার্স থেকে রুমাল বের করতে করতে জানতে চায়, ‘ক্যান আই ওয়াক আ বিট উইথ ইউ।’ ‘সার্টেনলি’ বলে আমি পার্কটি দেখিয়ে প্রস্তাব করি, ‘হাউ অ্যাবাউট স্পেন্ড সাম টাইম ইন দিস পার্ক?’ গাছপালার ছায়ানিবিড় পরিসরে সময় কাটানোতে সে সম্মতি দিলে, আমরা টিকিট কেটে ঢুকে পড়ি উদ্যানে।
উদ্যানটির কোথাও কোথাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ওয়েসিসের শ্যামলে বালুকার ধূসরিমা আবহ। একটি-দুটি ফোয়ারার ঝিরি ঝিরি জল তাতে যুক্ত করছে সজল ব্যঞ্জনা। আমরা একটি বেঞ্চে বসে পড়ি। ময়রা ক্লিওপেট্রা কুইন নামে একটি সুরভিত সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমাকে এক শলা অফার করে। আমি তা জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে শেয়ার করি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ও আজ-জোহরা মসজিদের লাইব্রেরি দেখতে চেয়ে ব্যর্থ হওয়ার অভিজ্ঞতা।
আধপোড়া সিগারেটটি নিভিয়ে দিয়ে ময়রাও ফ্র্যাংকলি তার অত্যন্ত নেগেটিভ অভিজ্ঞতা অকপটে শেয়ার করে। জানতে পারি, জ্যাকব নামে ইসরায়েলের একটি জুইশ ছেলের সঙ্গে ট্যাক্সিভাড়া শেয়ার করে সে এসেছিল আল হোসেইন স্কয়ারে। ওখানকার আল তান্নেউরা হেরিটেজ ড্যান্স একাডেমিতে নাকি পর্যটকদের জন্য আয়োজিত হয়েছে বেলি ড্যান্স শেখার ক্লাস। ময়রা ক্লাসটি নিতে চায়। তো জ্যাকব তাকে ওখানে ড্রপ করে দিয়ে চলে যায় তার পথে।
ড্যান্স একাডেমিতে ঢুকে ময়রা জানতে পারে, পুরো একটি ক্লাস চালানোর জন্য যথেষ্ট পর্যটক না আসাতে আজকের প্রশিক্ষণ বাতিল করা হয়েছে। তবে একজন আধবুড়ো মেইল ইনস্ট্রাক্টর পনেরো ডলারের বিনিময়ে তাকে ড্যান্সের কিছু অন্ধিসন্ধি দেখিয়ে দিতে রাজি হন। তো স্টুডিওতে তিনি তাকে মিনিট তিরিশেকের প্রশিক্ষণে শিখিয়ে দেন বেশ কয়েকটি মুদ্রা।
তারপর ময়রাকে ড্রেসিংরুমে নিয়ে গিয়ে বেলি ড্যান্সারদের ড্রেস পরতে বলেন। ইনস্ট্রাক্টর তাকে ড্রেস পরতে সাহায্য করতে গিয়ে, তার তলপেট ও নিতম্ব বারবার স্পর্শ করলে সে খেপে গিয়ে, ইনস্ট্রাকটরকে আচমকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে।
একাডেমির সামনে কোনো ট্যাক্সি না পেয়ে সে হেঁটে যেতে চাচ্ছিল খান আল খালিলি নামক বাজারের দিকে। একটি মারকুটে চেহারার ইজিপশিয়ান যুবক তাকে ফলো করে। ছেলেটি বারবার তার শরীর ঘেঁষে হেঁটে যাওয়ার সময় ফের স্পর্শ করছিল তার পশ্চাদ্দেশ, দু-চারজন পথচারীও বিষয়টি দেখেছে, দেখে খিক খিক করে হেসেছে, কিন্তু কেউ তাকে সেভ করতে এগিয়ে আসেনি।
কথা বলতে বলতে ক্রোধে ও উত্তেজনায় ময়রা উঠে দাঁড়ায়। তার হয়রানিতে আমি শুধু ব্যথিত নয়, বেজায় বিব্রতও বোধ করি। আমি সচেতন যে এ ধরনের হয়রানির অভিজ্ঞতা হয়...স্ট্রেসফুল অ্যান্ড ইনটেন্স, কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে প্রচুর। ঠিক বুঝতে পারি না—কী বলব। আমরা চুপচাপ হাঁটি। ময়রা অস্বস্তিকর নীরবতার আইস ব্রেক করে জানতে চায়, ‘খান, আল খালিলি মার্কেট থেকে আমি বেলি ড্যান্সের কিছু আইটেম কিনতে চাচ্ছি। তুমি আমার সঙ্গে যাবে কি?’
বাজারটি পার্কের লাগোয়া। তো আমি যেতে রাজি হই, তবে, ওদিকে যাওয়ার আগে আমি উদ্যান-সংলগ্ন আয়ুবিদ ওয়ালটি চাক্ষুষ করতে চাই। ঐতিহাসিক দেয়ালটির কাছাকাছি হেঁটে আসতে বিশেষ একটা সময় লাগে না। জানতে পারি, ১১৭৬ সালে মিসরের সুলতান সালাদিন এ প্রাচীর, একাধিক বুরুজ ও তোরণ নির্মাণ করিয়েছিলেন ক্রুসেডার যোদ্ধাদের কাছ থেকে নগরীর সুরক্ষার প্রয়োজনে। পুরো এলাকায় চলছে পুরাতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি।
ময়রা কেন জানি উত্ত্যক্ত হয়ে ওঠে কেবলই অভিযোগ করতে থাকে। মিসরে সিনাই ডেজার্টের কাছাকাছি শারম এল শেখের রিসোর্টে সে আগেও এসেছিল একবার। এ ধরনের যৌন হয়রানির ঘটনা সেখানেও ঘটেছিল। এবারকার ট্রিপে আলেকজান্দ্রিয়ার পাবলিক বাস চড়তে গিয়ে একজন যাত্রীও নাকি বারবার তার দেহ অকারণে অত্যন্ত অসংগতভাবে স্পর্শ করেছে।
ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে শুধু দুঃখজনক নয়, পুরুষ হিসেবে আমার জন্য ভীষণ লজ্জাকরও বটে। আমি আন্তরিকভাবে সহানুভূতি জানাই। তাতে খেপে ওঠে ময়রা বারবার বলে, ‘আই হেইট ইজিপ্ট, হেইট অল ইজিপশিয়ান ম্যান...।’ আর কিছু না বলে আমরা খান আল খালিলি বাজারের দিকে রওনা হই। হাঁটতে হাঁটতে সে এবার পুরো মিসরবাসীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে অধৈর্য হয়ে হঠাৎ করে বলে বসি, ‘হোয়াই ইউ ক্লেইম টু ইজিপ্ট অ্যাগেইন, এ দেশে আরেকবার না এলেও তো পারতে ময়রা?’
সে দাঁড়িয়ে পড়ে—আমার কাঁধে চাটি মেরে বলে, ‘শোন, আমার পূর্বপুরুষ এক যুগে—হাজার হাজার বছর আগে—মিসরে ক্রীতদাস হিসেবে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের মেহনতে তৈরি হয়েছে অনেক পিরামিড ও হরেক রকমের ঐতিহাসিক স্থাপনা। আই ডু হ্যাভ দ্য রাইট টু সি দ্য কান্ট্রি দ্যাট মাই এনসেসটার হ্যাড বিল্ট।’
চকিতে আমার করোটিতে ভেসে যায়, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত কাহিনি। তখন মিসরে চলছে ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের রাজত্ব। বনি ইসরায়েল বা ইহুদি সম্প্রদায়কে ক্রীতদাস প্রথার জিঞ্জিরে জড়িয়ে তাদের মেহনতে তিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন নগরী ও নানা ধরনের মনুমেন্ট। এ সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি তার জুলুমের কোনো সীমা-সরহদ্দ ছিল না।
আমি অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে ময়রার হাত স্পর্শ করে বলি, ‘ইউ অলসো হ্যাভ দ্য রাইট টু বি ট্রিটেড ডিসেন্টলি। ইউ মাস্ট নট বি হেরাসড সেকসুয়্যালি অন দি স্ট্রিট অব কায়রো।’
বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে টুকটাক কথাবার্তায় জানতে পারি, পারিবারিক গল্পগাথা থেকে ময়রা জেনেছে, মধ্যযুগে তার পরিবার ছিল স্পেনের আন্দুলিশিয়ার একটি মুসলিম রাজ্যের বাসিন্দা। যুদ্ধে মুর নামে পরিচিত মুসলমানদের পরাজয়ের পর খ্রিষ্টরাজ প্রতিষ্ঠিত হলে, তার পরিবার আন্দুলিশিয়া থেকে বহিষ্কৃত হয়ে অভিবাসী হিসেবে ঘর বেঁধেছিল পোল্যান্ডে। ময়রার বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন নাৎসি সামরিক চক্র পরিচালিত গ্যাস-চেম্বারে নির্মমভাবে নিহতও হয়েছিল। তবে তার দিদিমা নাকি এক সহানুভূতিসম্পন্ন খ্রিষ্টান পরিবারের দত্তক হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পেতে সমর্থ হয়েছিলেন।
আমরা ঢুকে পড়ি খান আল খালিলি নামক ফাতেমি খিলাফতের জামানায় নির্মিত বাজারে। চকমিলান পরিসরে স্থাপত্যের কেরেসমাতিতে সৃষ্টি হয়েছে গলিঘুঁজির রীতিমতো গোলকধাঁধা। হরেক রকমের মশলার পানজেন্ট গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে মিসরের মেস্ক-আম্বরের সুঘ্রাণ। একটি পুরো গলিজুড়ে ডিসপ্লে করা হয়েছে রুপার গোলাপপাশ ও আতরদান। কাছেপিঠে কোথাও ঝলমল করছে সম্ভাব্য কনেদের স্বপ্ন হয়ে স্বর্ণের জেওরাত। আমরা হেঁটে যাই তামা-কাঁসার সরণিতে। এগুলোর জেল্লা দেখে তাক লেগে যাওয়ার জোগাড় হয়। ময়রা ফিসফিস করে বলে, ‘লুক অ্যাট অল দিস সিলভার, কপার অ্যান্ড ব্রাস আইটেমস। ওয়াও...হোয়াট আ কালারফুল ওরিয়েন্টাল বাজার!’
যেহেতু আমার কেনাকাটার বিত্ত নেই, বাজারের সওদাপাতির জৌলুশে খানিক বিরক্ত লাগে। ময়রা কিনতে চায় বেলি ড্যান্সের জন্য পোশাক-আশাক। বলি, আমি না হয় একটি ক্যাফেতে বসি, তুমি কেনাকাটা সেরে ফিরে এস। সে রাজি না হয়ে হাত ধরে বলে, ‘কাম অন...মাত্র পনেরো-বিশ মিনিটের ব্যাপার, আমার শপিং শেষ হলে পর...লেটস হ্যাভ লাঞ্চ টুগেদার।’
একটু যেন অন্তরঙ্গতার ছোঁয়া পাই। ভাবি, ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আয়োজিত মিছিল-মিটিংয়ে আমি হামেশা শরিক হই, যে কারণে ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষজনের সঙ্গে মন খুলে মেলামেশা করতে পারি না। দিস এন অপরচুনিটি ফর মি টু লার্ন অ্যাবাউট আ জুইশ গার্ল। তার সঙ্গে একটু জানাশোনা হলে পর, হয়তো আমার অহেতুক হোস্টাইল ভাব খানিকটা কাটবে।
বেলি ড্যান্সের পোশাক-আশাকে ভরপুর পুরো একটি বিপণিবিতানের তালাশ পাওয়া যায়। ময়রা দক্ষতার সঙ্গে দামদর করে কিনে ফেলে, পর্যটকদের কাছে ‘হেরেম প্যান্ট’ নামে পরিচিত ‘বেদলাহ’ বা ঝলমলে ঝুটা রত্ন বসানো ব্রা ও গাগরা গোছের গাউন। কিন্তু প্রচুর সময় নেয় অচল মুদ্রাগাঁথা হিপ স্কার্ফ নির্বাচনে। কিছুতেই যেন হেরেম প্যান্টের সঙ্গে স্কার্ফের বর্ণ বিচ্ছুরণের সঠিক মিল হয় না। সে বারবার কোমরে ত্রিকোণ হিপ স্কার্ফটি জড়িয়ে ধরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, ঘুরেফিরে নৃত্যের ভঙ্গিতে হরেক মুদ্রায় নিজেকে দেখে। তারপর মতামতের জন্য আমার শরণাপন্ন হয়।
আমি কোমর বাঁকা করে দাঁড়ানো যুবতীটির দিকে নিরিখ করে তাকাই। হিপ স্কার্ফের রুপালি মুদ্রাগুলো তার পৃথুল নিতম্বের রেখায় যুক্ত করেছে মৃদু আভাময় বিচ্ছুরণ। ত্রিকোণ বস্ত্রখণ্ডটি অনাবৃত মিডরিফটে নিম্ন নাভিটির ঠিক নিচে গিট্টি দিয়ে বাঁধা। সে নিম্নাঙ্গে নৃত্যমুদ্রার একটি লঘু ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলে, ফ্রিজ হয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘হাউ অ্যাম আই লুকিং?’ চটজলদি জবাব দিই, ‘ইনডিড অ্যাট্রাকটিভ।’
তোষামোদে তুষ্ট না হয়ে ময়রা ভ্রুকুটি করে বলে, ‘ইজ দ্যাট অল ইউ হ্যাভ টু সে।’ আমি খানিকটা প্ররোচিত হয়ে, সচেতনভাবে চাটুকারিতার বহুল ব্যবহৃত বাণ হানি, ‘এটা পরে ড্যান্স করলে, পুরুষ দর্শকদের শুধু হৃদয়ই ভাঙবে না, লিসেন ময়রা, আই অ্যাম টেলিং ইউ...তাদের ঘরসংসারও তছনছ হবে।’ তোষামোদে কাজ হয়। ময়রা ‘কুল…থ্যাংকস আ লট’ বলে কাউন্টারে এসে পেমেন্ট সারে।
নৃত্য-সংক্রান্ত পোশাকের দোকান থেকে বের হয়ে সে ফিসফিসিয়ে আমাকে যেন নিশ্চিত করে, ‘লিসেন, ইসরায়েলের যে কিবুটস বা সমবায় খামারে আমি নয় মাস কাটাব, ওখানে প্রতি সপ্তাহান্তে বসে ছেলেমেয়েদের জোড়ায় জোড়ায় নৃত্যের আসর। ছেলেদের সবাই এলিজিবল ব্যাচেলর, কারও ঘরসংসার ভাঙার কোনো আশঙ্কা নেই।’
প্রতিক্রিয়ায় বলি, ‘থ্যাংকস আ বাঞ্চ ময়রা...ফর দি এস্যুরেন্স। তবে একটি প্রশ্ন, হোয়াই আর ইউ ইন্টারেস্টেড টু লার্ন বেলি ড্যান্স?’ দ্রুত জবাব আসে, ‘আমার পূর্বপুরুষেরা একসময় মিসরে বসবাস করত। সে যুগে ইহুদি মেয়েরা বেলি ড্যান্স করত। সো ইটস নট বিলং টু অনলি ইজিপশিয়ান আরবস। এই ঐতিহ্যে ইহুদি সম্প্রদায়েরও ভাগ আছে।’
প্রশ্ন না করে পারি না, ‘জাস্ট ফলোইং মিডল ইস্টার্ন জুইশ ট্র্যাডিশন, ইজ দ্যাট অল ময়রা?’ দাঁড়িয়ে পড়ে খুব মিষ্টি করে হেসে সে বলে, ‘লুক, আই লাভ মাই ফিগার...বেলি ড্যান্স ইজ গোয়িং টু কিপ মাই বডি নাইস অ্যান্ড টাইট।’
হাঁটতে হাঁটতে আমি বাজারের চকমিলান পরিসরের বন্ধনীর মতো বাঁকানো কারুকাজ করা খিলানগুলো ফের খেয়াল করে দেখি। ঝিক করে করোটিতে ফিরে আসে, বছর কয়েক আগে পড়া মিসরের যশস্বী লেখক নাগিব মাহফুজের একটি উপন্যাসে খিলানময় গলিপথে ঘুরপাক করার বর্ণনা। ময়রা হাঁটতে হাঁটতে কেবলই উদগ্রীব হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। জানতে চাই, ‘হোয়াট আর ইউ লুকিং ফর?’
অন্যমনস্কভাবে সে জবাব দেয়, ‘আই অ্যাম স্টিল লুকিং ফর জ্যাকব। চেককাটা নেকস্কার্ফ কেনার জন্য তার এ বাজারে আসার কথা। একটু খেয়াল রাখো তো, হি ইজ ভেরি টল।’
কেন জানি বিরক্ত লাগে, ইচ্ছা হয় বলে বসি, ময়রা, তুমি আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছ, সামান্য সময় জ্যাকবের কথা না ভেবে থাকতে পার না। ঝিক করে আমার স্নায়ুতে সৌজন্যবোধের কণিকাগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। নীরবে নিজেকে শাসন করে বলি, মেয়েটি মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে শিকার হয়েছে যৌন হয়রানির। এ মুহূর্তে খামোকা জেলাস হওয়াটা হবে অশ্লীল আচরণের শামিল।
আমরা চলে এসেছি সার্কুলার সরণিতে। দুই কদম সামনে বাড়তেই পাওয়া যায় নাগিব মাহফুজের নামে চমৎকার একটি রেস্তোরাঁ। পেটে খিদেও জানান দিচ্ছে, বলি, ‘লেটস গো অ্যান্ড হ্যাভ লাঞ্চ, ময়রা।’
দেয়ালে ঝুলছে ১৯৮৮ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়া কথাশিল্পী নাগিব মাহফুজের মস্ত বড় ফটোগ্রাফ। তার তলায় আমরা টেবিল পাই। আমি মেনু ঘাঁটি। ময়রা মাহফুজের ছোটগল্প নিয়ে কথা বলে। প্রকাশিত মোট ৩৫০টি গল্পের কোনোটাই মনে হয় তার পড়তে বাকি নেই। খান আল খলিলি বাজারের বর্ণনা আমি কোন বইতে পড়েছি, তা মনে করতে না পারায় ভারি বিব্রত লাগে।
খাবারের তালিকায় পিজিয়ন রাইস নামে একটি আইটেম আমাদের পছন্দ হয়। কিন্তু দামেদরে মনে হয় সব খাবারই এখানে অত্যন্ত চড়া। আমরা একটি ডিশ শেয়ার করতে চাই। বেদুইনদের মতো জালাবিয়া নামে ঢোলা পিরহান পরা ওয়েটার দ্রুত এক্সট্রা প্লেট, নাইফ প্রভৃতি সরবরাহ করে। সাইড হিসেবে গ্রিল করা এগপ্লান্টের সঙ্গে পরিবেশিত হয় চিকপির চাট ও তাবুলি।
পিলাফের মতো তপ্ত রাইস থেকে ছড়াচ্ছে সিনেমন ও লেবুর সুগন্ধ। ভাতের স্তূপের ওপর বসে আছে আধপোড়া একটি পায়রা। আমরা পিকাসোর আঁকা শ্বেতকপোতের প্রতীক নিয়ে কথা বলতে বলতে, মৃত পায়রাটিকে ডানা ধরে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করি। চতুর্দিকে ছড়ায় বেশ কিছু তপ্ত ভাত।
ওয়েটার কোরবানির দুম্বা জবাইয়ের ধারালো একখানা খঞ্জর দিয়ে বিষয়টা সুরাহা করে দেন। মাংসের মুখরোচক টুকরা চিবাতে চিবাতে নীরবে ভাবি, গাঙ্গেয় উপত্যকার এক মুসলিম তরুণের সঙ্গে মিলেঝুলে, ইহুদি একটি মেয়ের শান্তিপূর্ণভাবে কপোত ভক্ষণের বিষয় নিয়ে কখনো কিছু লেখার আমার সুযোগ হবে কি?
আহারের তামাদি হওয়ামাত্র ওয়েটার আওয়াজ দেন, ‘কাহওয়াতুন মিসরিওয়াতুন।’ পরিভাষাটি বুঝতে না পেরে আমি ও ময়রা বেয়াক্কেলের মতো একে অপরের মুখের দিকে তাকাই। নিউইয়র্ক সিটির স্কাইলাইনের ছবি আঁকা টিশার্ট পরা একটি বালক নিয়ে আসে পিতলের বড়সড় কেটলি। কফির গাঢ় সুগন্ধি থেকে যেন ছড়াচ্ছে উদ্দীপনা। ওয়েটার মাশাই পেয়ালায় তা ঢেলে দিয়ে সামনে সাজিয়ে রাখে সুগার পট ও সিনেমন ডাস্টের জার। ময়রা কফির আনুষঙ্গিক অনুপান হিসেবে অর্ডার করে সিসা-হুক্কা।
হুক্কায় ধূমপান সেরে বেশ খোশমেজাজে আমরা শেয়ারে একটি ট্যাক্সি ভাড়া করি। বাতচিতে ফিরে ফিরে আসে নাগিব মাহফুজের গল্পে ব্যবহৃত একাধিক চরিত্রের বর্ণনা। গিজা পিরামিডের চত্বরে নামামাত্র মনে হয়, কায়রো নগরীর অজস্র দালানকোঠার এক সম্প্রসারিত মিছিল মরুপ্রান্তরে এসে যেন হঠাৎ করে ব্রেক কষে থেমে পড়ছে। অপরাহ্ণের তেজি আলোয় একাধিক পিরামিডের দিকে আমরা একসঙ্গে তাকাই।
পর্যটকদের কোলাহলে মনে হয়, এ পরিসর থেকে নির্বাসিত হয়েছে নীরবতা। নগরীর জীবনযাপনের শব্দপুঞ্জও যেন বলকে ওঠা দুধের ফেনার মতো উথলে পড়ছে। ময়রা তাজ্জব হওয়া স্বরে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘হোয়াট আ ম্যাসিভ মনুমেন্ট...ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড ইট ইজ ফোর থাউজেন্ড ফাইভ হানড্রেড ইয়ারস ওল্ড, ওয়াও!’ আমাদের পাশ দিয়ে পর্যটক-পিঠে বালুকা ছিটিয়ে আগুয়ান হয় কয়েকটি উট।
ময়রা জানতে চায়, ‘উড ইউ লাইক টু শেয়ার আ ক্যামেল রাইড উইথ মি?’ পাথরের বিপুল স্তূপে প্রতিফলিত চড়া রোদ সামলে আমি তার দিকে তাকাই। চত্বরটি এত বিরাট যে উটে চড়তে পারলে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে সুবিধা হয়। কিন্তু মতামত দেওয়ার কোনো সুযোগ পাই না।
‘হাই ময়রা, আই অ্যাম লুকিং ফর ইউ,’ বলে তার দিকে ছুটে আসে সাড়ে ছয় ফুটি এক নওজওয়ান। জ্যাকবকে শনাক্ত করতে কোনো অসুবিধা হয় না। এ তরুণকে আমি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রোতে আসার ট্রেনে— করিডরে ময়রার গতর-সংলগ্ন হয়ে দাঁড়াতে দেখেছি।
জ্যাকব ইসরায়েল থেকে আসা পর্যটকদের সঙ্গে মিলেঝুলে অলরেডি ভাড়া করেছে ছোটখাটো উটের একটি কাফেলা। সে জানতে চায়, ময়রা তাদের সঙ্গে যেতে চায় কি না। ময়রা ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকায়, সে বিড়বিড় করে বলে, ‘আই হোপ ইউ ডোন্ট মাইন্ড ইফ আই গো উইথ জ্যাকব অ্যান্ড হিজ পার্টি।’ দ্রুত জবাব দিই, ‘নট অ্যাট অল’।
কাছে এসে সে চোখে চোখ রাখে, কবজিতেও আন্তরিকভাবে একটু চাপ দেয়। বলি, ‘হ্যাভ আ নাইস ক্যামেল ট্রিপ, ময়রা।’ জ্যাকবের সঙ্গে যেতে যেতে সে একবার গ্রীবা ফিরিয়ে তাকায়, আমি হাত নাড়ি।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি চুপচাপ। দু-তিনটি ছোট ছোট কাফেলা আমার দিকে যেন ধেয়ে আসে, সরে দাঁড়াই। কেন জানি খালি খালি লাগে। কাঠফাটা রোদ মাথায় ফারাওদের সমাধি দেখার তুমুল আগ্রহ কী কারণে জানি মন থেকে কর্পূরের মতো উবে যায়। ভারি ক্লান্ত বোধ করি। মনে হয়, ভালোমন্দে কায়রোতে একটি দিন তো প্রায় কেটেই গেল। থাক, পিরামিডের সিঁড়ি ভেঙে আর কাজ নেই। হোটেলে ফিরে যাওয়ার জন্য সস্তায় পাবলিক বাসটাস কিছু পাওয়া যায় কি না, আমি এর তালাশ করি।
(চলবে)

রাতের রেলগাড়িতে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রো এসে পৌঁছেছি মাঝরাতে। তো বেশ বেলা করে পাবলিক বাসে রওনা হই আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। এক জায়গায় ট্রাফিক জ্যামে বাস দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। আমি কায়রো নগরীর পর্যটন মানচিত্রে চোখ রেখে জানালা দিয়ে জমজমাট স্ট্রিটের দিকে তাকাচ্ছি। আরবি ভাষার নিচে ইংরেজিতে লেখা একটি সাইনবোর্ড নজরে পড়ে, ‘তান্নেউরা ইজিপশিয়ান হেরিটেজ ড্যান্স একাডেমি’। এর নিচে রঙের তরঙ্গ বিভঙ্গে নৃত্যরতা মমির দেশের এক মোমের পুত্তলিপ্রতিম রমণীর রেখাচিত্র।
একটি রংচটা ট্যাক্সি এসে ফুটপাতে দুই চাকা তুলে ব্রেক কষে। তা থেকে হাসিমুখে নামে ময়রা, দীর্ঘ দাড়িওয়ালা একটি ছেলে ট্যাক্সির ভাড়া মেটাচ্ছে। ছেলে-মেয়ে দুটিকে গেল রাতের ট্রেনে ঘনিষ্ঠ হতে আমি চাক্ষুষ করেছি। ময়রাকে আধ-চেনা বলা যায়, তবে দীর্ঘদেহী তরুণটি সম্পর্কে আমার বিশেষ কোনো ধারণা নেই।
দিন তিনেক আগে সাইপ্রাস থেকে উড়ে এসে আমি ল্যান্ড করি আলেকজান্দ্রিয়ায়। বিমানে আমার পাশের সিটে বসেছিল ময়রা। খানিক কথাবার্তাও হয়েছে। ববড করা থুপি থুপি কালো চুলের মেয়েটি যুক্তরাষ্ট্রের এক ইউনিভার্সিটিতে পুরো এক বছর ব্রেক-ইয়ার নিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলে। ওখানকার নাগিব ডেজার্টের কিবুটজ কমিউন বা তরুণদের প্রশিক্ষণের জন্য তৈরি সমবায় খামারে সে পুরো নয় মাস কাটাবে। ইসরায়েল যাওয়ার পথে সাইড-ট্রিপ হিসেবে সপ্তাহ দেড়েক ইজিপ্টে কাটাচ্ছে।
না, আলেকজান্দ্রিয়া শহরে ভিন্ন ভিন্ন গেস্টহাউসে বসবাসের কারণে ময়রার সঙ্গে আমার ফের দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। তবে কায়রো আসার পথে রাতের ট্রেনে তাকে আরেক নজর দেখি। ফার্স্ট ক্লাস অ্যাপার্টমেন্ট-সংলগ্ন করিডরে চলছে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ পর্যটকদের জমজমাট আড্ডা। হাতে হাতে ঘুরছে হার্ড ড্রিংকসের ফ্লাক্স। এদের সঙ্গে ময়রাও আছে। তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সাড়ে ছয় ফুট দেহের শক্তপোক্ত দীর্ঘ দাড়িওয়ালা এক যুবক। ছেলেটির ভেস্টের লেপালে জ্বলজ্বল করছে ইহুদি সম্প্রদায়ের পবিত্র প্রতীক ‘স্টার আব ডেভিড’।
আমি মাইকিং সামলাতে ট্রেনের দেয়ালে হাত রেখে ভারসাম্য রক্ষা করি। খিলখিল করে হেসে ওঠে ময়রা। দেখি, তরুণটি তার খোলা কাঁধে আঙুল দিয়ে কিছু লিখছে। হাসতে হাসতে তার গায়ে গড়িয়ে পড়ে মেয়েটি। আমি কায়ক্লেশে তাদের অতিক্রম করে হেঁটে যাই ডাইনিং কারে।
আল হোসেইন স্কয়ারে আমি বাস থেকে নামে। মানচিত্র অনুযায়ী আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস কাছেই। সামান্য একটু হাঁটতেই চলে আসি অকুস্থলে। আমার ভ্রমণ-বাজেট সীমিত, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে গাইড ছাড়াই এসেছি। ফলক পড়ে জানতে পারি, প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠ স্থাপিত হয়েছিল ৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে, মিসরে কায়েমি খেলাফতের শাসনামলে।
ক্যাফেটেরিয়ায় এসে ছাত্রদের সঙ্গে আমি কথাবার্তা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু সবাই এমন ব্যস্তসমস্ত হয়ে আছে যে আমার সঙ্গে বাতচিতের কারও ফুরসত হয় না। এরা আমাকে দেখিয়ে দেয় প্রশাসনিক ভবনের দালান।
অ্যাডমিশন-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের অজুহাত দিয়ে কোশেশ করি দালানে প্রবেশের। দারোয়ান কেলাশনিকভ বন্দুকটি কেবলামুখি করে বেদুইনদের চাঁছাছোলা জবানে ঘোরতর আপত্তি জানান। বেরিয়ে আসি উদ্যানে।
এদিকে পুষ্পিত তরুলতার সংখ্যা কম। তবে চৌবাচ্চার কাছে খেজুরগাছের ছায়ায় বসে জাবর কাটছে তিনটি উট। ঠিক বুঝতে পারি না, এ জানোয়ারদের এখানে আগমনের হেতুটা কী? ভাবি, হয়তো অধ্যাপকেরা মরুজাহাজদের যানবাহন হিসেবে ইস্তেমাল করছেন। একটি উট খামোকা খেপে গিয়ে আমাকে সশব্দে তাড়া করে আসে। ছোটাছুটি করে আমি বারবার গেট বলে পরিচিত, বেজায় উঁচু ও কারুকাজে চোখধাঁধানো দেউড়ির তলায় ঢুকে পড়ে আত্মরক্ষা করি।
ফিরে তাকাই, মিসরি স্থাপত্যকলার চমৎকার নিদর্শনে ভরপুর আলিশান এ তোরণের দিকে। চোখের সামনে ‘আজ-জোহরা’ নামে দুনিয়াজুড়ে মশহুর আল আজহার মসজিদের খিলানময় বিস্তার। আমি সারি দিয়ে তৈরি ৩০০টি স্তম্ভের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক করতে করতে বেদিশা হয়ে ঢুকে পড়ি প্রার্থনার পবিত্র ইমারতে। খুঁজি, বিবি ফাতেমার পবিত্র স্মৃতিতে উৎসর্গিত কিতাবখানার দরওয়াজা।
দোরগোড়ায় পাগড়িওয়ালা এক পরহেজগার বান্দা আমার পথ রোধ করেন। বলি, শুনেছি যে এ গ্রন্থাগারের পুস্তকের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তিনি ক্যালকুলেটর বের করে সংগৃহীত বইপত্রের সঠিক হিসাব দেখান, স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ওঠে ৬০০,০০০ সংখ্যাটি। বলি, ‘অন্তত একটি বই চোখে দেখার সুযোগ দিন, হুজুর।’ ভদ্রলোক সম্ভবত আমার ভাষা বুঝতে পারেন না, ফের অনুনয় করি কেতাবখানার ভেতরটা চাক্ষুষ করার, চিড়ে ভিজে না।
হুজুর আমার কবজি চেপে ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে দেখান দেয়ালে ঝোলানো নামাজের জোব্বা, টুপি ও তসবি। তিনি ‘ওধু ওধু’ এবং ‘সালাত সালাত’ বলে আওয়াজ দিলে, আন্দাজ করি, তিনি আমাকে অজু করে নামাজ আদায় করার অনুরোধ করছেন। আমি ফের ‘কিতাব কিতাব’ বলে কাকুতি করি, তিনি রোষকষায়িত নজরে আমাকে অবলোকন করে কঠোর স্বরে উচ্চারণ করেন ‘সালাত’। চকিতে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার একটি চরণ ‘নামাজ পড়িস বেটা..’, আমার করোটিতে ঘাই মেরে ওঠে।
প্রার্থনার পবিত্র ইমারত থেকে বেরিয়ে এসে ভারি খাজুল হালতে চুপচাপ হাঁটি। চলে আসি আল হোসেন স্কয়ারের প্রান্তিকে। এদিকে বেশ কিছু মরুপ্রিয় উদ্ভিদের সুশৃঙ্খল বিস্তারে তৈরি হয়েছে আরবান এক পুরোদস্তুর পার্ক, চারদিকে ছড়িয়ে আছে শ্যামল ছায়া। গেটে দাঁড়িয়ে ভাবি, কায়রোতে খানিক ঘোরাফেরার শুরুতেই কুফা লাগল, সীমিত বাজেটের জন্য আমি এ ফারাওকুলের স্মৃতিনন্দিত নগরীতে আরও একটি-দুটি দিন কাটিয়ে ফের গাইডসহ আল আজহারে আসতে পারব না। অর্থাৎ এ বিশ্ববিদ্যালয় ও আজ-জোহরা মসজিদের কেতাবখানাটি আমার অদেখাই থেকে যাবে।
পার্কের গেটে দাঁড়িয়ে আপনমনে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করছি। দেখি, দ্রুত হেঁটে এদিকে আসছে ময়রা। পুলিশের তাড়া খাওয়া গোপন সংগঠনের বিপ্লবীর মতো মেয়েটি বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে সতর্কভাবে পেছন দিকে তাকাচ্ছে, আর প্রায় ছুটছে। আমাকে দেখতে পেয়ে রীতিমতো হকচকিয়ে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ে, অতঃপর দ্রুত সামলে নিয়ে মুখে নার্ভাস হাসি ফুটিয়ে বলে, ‘হাই, গুড টু সি ইউ।’
ছুটে আসার তোড়ে ময়রা নিঃশ্বাস ফেলছে জোরে জোরে। স্বল্প ঝুলের টপে খানিক অনাবৃত বিভাজিকায় বিস্ফারিত হচ্ছে স্তনযুগল, মুখে ও গলায় বুজকুড়ি কাটছে ঘামের তরল বিড। সে পার্স থেকে রুমাল বের করতে করতে জানতে চায়, ‘ক্যান আই ওয়াক আ বিট উইথ ইউ।’ ‘সার্টেনলি’ বলে আমি পার্কটি দেখিয়ে প্রস্তাব করি, ‘হাউ অ্যাবাউট স্পেন্ড সাম টাইম ইন দিস পার্ক?’ গাছপালার ছায়ানিবিড় পরিসরে সময় কাটানোতে সে সম্মতি দিলে, আমরা টিকিট কেটে ঢুকে পড়ি উদ্যানে।
উদ্যানটির কোথাও কোথাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ওয়েসিসের শ্যামলে বালুকার ধূসরিমা আবহ। একটি-দুটি ফোয়ারার ঝিরি ঝিরি জল তাতে যুক্ত করছে সজল ব্যঞ্জনা। আমরা একটি বেঞ্চে বসে পড়ি। ময়রা ক্লিওপেট্রা কুইন নামে একটি সুরভিত সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমাকে এক শলা অফার করে। আমি তা জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে শেয়ার করি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ও আজ-জোহরা মসজিদের লাইব্রেরি দেখতে চেয়ে ব্যর্থ হওয়ার অভিজ্ঞতা।
আধপোড়া সিগারেটটি নিভিয়ে দিয়ে ময়রাও ফ্র্যাংকলি তার অত্যন্ত নেগেটিভ অভিজ্ঞতা অকপটে শেয়ার করে। জানতে পারি, জ্যাকব নামে ইসরায়েলের একটি জুইশ ছেলের সঙ্গে ট্যাক্সিভাড়া শেয়ার করে সে এসেছিল আল হোসেইন স্কয়ারে। ওখানকার আল তান্নেউরা হেরিটেজ ড্যান্স একাডেমিতে নাকি পর্যটকদের জন্য আয়োজিত হয়েছে বেলি ড্যান্স শেখার ক্লাস। ময়রা ক্লাসটি নিতে চায়। তো জ্যাকব তাকে ওখানে ড্রপ করে দিয়ে চলে যায় তার পথে।
ড্যান্স একাডেমিতে ঢুকে ময়রা জানতে পারে, পুরো একটি ক্লাস চালানোর জন্য যথেষ্ট পর্যটক না আসাতে আজকের প্রশিক্ষণ বাতিল করা হয়েছে। তবে একজন আধবুড়ো মেইল ইনস্ট্রাক্টর পনেরো ডলারের বিনিময়ে তাকে ড্যান্সের কিছু অন্ধিসন্ধি দেখিয়ে দিতে রাজি হন। তো স্টুডিওতে তিনি তাকে মিনিট তিরিশেকের প্রশিক্ষণে শিখিয়ে দেন বেশ কয়েকটি মুদ্রা।
তারপর ময়রাকে ড্রেসিংরুমে নিয়ে গিয়ে বেলি ড্যান্সারদের ড্রেস পরতে বলেন। ইনস্ট্রাক্টর তাকে ড্রেস পরতে সাহায্য করতে গিয়ে, তার তলপেট ও নিতম্ব বারবার স্পর্শ করলে সে খেপে গিয়ে, ইনস্ট্রাকটরকে আচমকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছুটে বেরিয়ে আসে।
একাডেমির সামনে কোনো ট্যাক্সি না পেয়ে সে হেঁটে যেতে চাচ্ছিল খান আল খালিলি নামক বাজারের দিকে। একটি মারকুটে চেহারার ইজিপশিয়ান যুবক তাকে ফলো করে। ছেলেটি বারবার তার শরীর ঘেঁষে হেঁটে যাওয়ার সময় ফের স্পর্শ করছিল তার পশ্চাদ্দেশ, দু-চারজন পথচারীও বিষয়টি দেখেছে, দেখে খিক খিক করে হেসেছে, কিন্তু কেউ তাকে সেভ করতে এগিয়ে আসেনি।
কথা বলতে বলতে ক্রোধে ও উত্তেজনায় ময়রা উঠে দাঁড়ায়। তার হয়রানিতে আমি শুধু ব্যথিত নয়, বেজায় বিব্রতও বোধ করি। আমি সচেতন যে এ ধরনের হয়রানির অভিজ্ঞতা হয়...স্ট্রেসফুল অ্যান্ড ইনটেন্স, কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে প্রচুর। ঠিক বুঝতে পারি না—কী বলব। আমরা চুপচাপ হাঁটি। ময়রা অস্বস্তিকর নীরবতার আইস ব্রেক করে জানতে চায়, ‘খান, আল খালিলি মার্কেট থেকে আমি বেলি ড্যান্সের কিছু আইটেম কিনতে চাচ্ছি। তুমি আমার সঙ্গে যাবে কি?’
বাজারটি পার্কের লাগোয়া। তো আমি যেতে রাজি হই, তবে, ওদিকে যাওয়ার আগে আমি উদ্যান-সংলগ্ন আয়ুবিদ ওয়ালটি চাক্ষুষ করতে চাই। ঐতিহাসিক দেয়ালটির কাছাকাছি হেঁটে আসতে বিশেষ একটা সময় লাগে না। জানতে পারি, ১১৭৬ সালে মিসরের সুলতান সালাদিন এ প্রাচীর, একাধিক বুরুজ ও তোরণ নির্মাণ করিয়েছিলেন ক্রুসেডার যোদ্ধাদের কাছ থেকে নগরীর সুরক্ষার প্রয়োজনে। পুরো এলাকায় চলছে পুরাতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি।
ময়রা কেন জানি উত্ত্যক্ত হয়ে ওঠে কেবলই অভিযোগ করতে থাকে। মিসরে সিনাই ডেজার্টের কাছাকাছি শারম এল শেখের রিসোর্টে সে আগেও এসেছিল একবার। এ ধরনের যৌন হয়রানির ঘটনা সেখানেও ঘটেছিল। এবারকার ট্রিপে আলেকজান্দ্রিয়ার পাবলিক বাস চড়তে গিয়ে একজন যাত্রীও নাকি বারবার তার দেহ অকারণে অত্যন্ত অসংগতভাবে স্পর্শ করেছে।
ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে শুধু দুঃখজনক নয়, পুরুষ হিসেবে আমার জন্য ভীষণ লজ্জাকরও বটে। আমি আন্তরিকভাবে সহানুভূতি জানাই। তাতে খেপে ওঠে ময়রা বারবার বলে, ‘আই হেইট ইজিপ্ট, হেইট অল ইজিপশিয়ান ম্যান...।’ আর কিছু না বলে আমরা খান আল খালিলি বাজারের দিকে রওনা হই। হাঁটতে হাঁটতে সে এবার পুরো মিসরবাসীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে অধৈর্য হয়ে হঠাৎ করে বলে বসি, ‘হোয়াই ইউ ক্লেইম টু ইজিপ্ট অ্যাগেইন, এ দেশে আরেকবার না এলেও তো পারতে ময়রা?’
সে দাঁড়িয়ে পড়ে—আমার কাঁধে চাটি মেরে বলে, ‘শোন, আমার পূর্বপুরুষ এক যুগে—হাজার হাজার বছর আগে—মিসরে ক্রীতদাস হিসেবে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের মেহনতে তৈরি হয়েছে অনেক পিরামিড ও হরেক রকমের ঐতিহাসিক স্থাপনা। আই ডু হ্যাভ দ্য রাইট টু সি দ্য কান্ট্রি দ্যাট মাই এনসেসটার হ্যাড বিল্ট।’
চকিতে আমার করোটিতে ভেসে যায়, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত কাহিনি। তখন মিসরে চলছে ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের রাজত্ব। বনি ইসরায়েল বা ইহুদি সম্প্রদায়কে ক্রীতদাস প্রথার জিঞ্জিরে জড়িয়ে তাদের মেহনতে তিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন নগরী ও নানা ধরনের মনুমেন্ট। এ সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি তার জুলুমের কোনো সীমা-সরহদ্দ ছিল না।
আমি অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে ময়রার হাত স্পর্শ করে বলি, ‘ইউ অলসো হ্যাভ দ্য রাইট টু বি ট্রিটেড ডিসেন্টলি। ইউ মাস্ট নট বি হেরাসড সেকসুয়্যালি অন দি স্ট্রিট অব কায়রো।’
বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে টুকটাক কথাবার্তায় জানতে পারি, পারিবারিক গল্পগাথা থেকে ময়রা জেনেছে, মধ্যযুগে তার পরিবার ছিল স্পেনের আন্দুলিশিয়ার একটি মুসলিম রাজ্যের বাসিন্দা। যুদ্ধে মুর নামে পরিচিত মুসলমানদের পরাজয়ের পর খ্রিষ্টরাজ প্রতিষ্ঠিত হলে, তার পরিবার আন্দুলিশিয়া থেকে বহিষ্কৃত হয়ে অভিবাসী হিসেবে ঘর বেঁধেছিল পোল্যান্ডে। ময়রার বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন নাৎসি সামরিক চক্র পরিচালিত গ্যাস-চেম্বারে নির্মমভাবে নিহতও হয়েছিল। তবে তার দিদিমা নাকি এক সহানুভূতিসম্পন্ন খ্রিষ্টান পরিবারের দত্তক হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পেতে সমর্থ হয়েছিলেন।
আমরা ঢুকে পড়ি খান আল খালিলি নামক ফাতেমি খিলাফতের জামানায় নির্মিত বাজারে। চকমিলান পরিসরে স্থাপত্যের কেরেসমাতিতে সৃষ্টি হয়েছে গলিঘুঁজির রীতিমতো গোলকধাঁধা। হরেক রকমের মশলার পানজেন্ট গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে মিসরের মেস্ক-আম্বরের সুঘ্রাণ। একটি পুরো গলিজুড়ে ডিসপ্লে করা হয়েছে রুপার গোলাপপাশ ও আতরদান। কাছেপিঠে কোথাও ঝলমল করছে সম্ভাব্য কনেদের স্বপ্ন হয়ে স্বর্ণের জেওরাত। আমরা হেঁটে যাই তামা-কাঁসার সরণিতে। এগুলোর জেল্লা দেখে তাক লেগে যাওয়ার জোগাড় হয়। ময়রা ফিসফিস করে বলে, ‘লুক অ্যাট অল দিস সিলভার, কপার অ্যান্ড ব্রাস আইটেমস। ওয়াও...হোয়াট আ কালারফুল ওরিয়েন্টাল বাজার!’
যেহেতু আমার কেনাকাটার বিত্ত নেই, বাজারের সওদাপাতির জৌলুশে খানিক বিরক্ত লাগে। ময়রা কিনতে চায় বেলি ড্যান্সের জন্য পোশাক-আশাক। বলি, আমি না হয় একটি ক্যাফেতে বসি, তুমি কেনাকাটা সেরে ফিরে এস। সে রাজি না হয়ে হাত ধরে বলে, ‘কাম অন...মাত্র পনেরো-বিশ মিনিটের ব্যাপার, আমার শপিং শেষ হলে পর...লেটস হ্যাভ লাঞ্চ টুগেদার।’
একটু যেন অন্তরঙ্গতার ছোঁয়া পাই। ভাবি, ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আয়োজিত মিছিল-মিটিংয়ে আমি হামেশা শরিক হই, যে কারণে ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষজনের সঙ্গে মন খুলে মেলামেশা করতে পারি না। দিস এন অপরচুনিটি ফর মি টু লার্ন অ্যাবাউট আ জুইশ গার্ল। তার সঙ্গে একটু জানাশোনা হলে পর, হয়তো আমার অহেতুক হোস্টাইল ভাব খানিকটা কাটবে।
বেলি ড্যান্সের পোশাক-আশাকে ভরপুর পুরো একটি বিপণিবিতানের তালাশ পাওয়া যায়। ময়রা দক্ষতার সঙ্গে দামদর করে কিনে ফেলে, পর্যটকদের কাছে ‘হেরেম প্যান্ট’ নামে পরিচিত ‘বেদলাহ’ বা ঝলমলে ঝুটা রত্ন বসানো ব্রা ও গাগরা গোছের গাউন। কিন্তু প্রচুর সময় নেয় অচল মুদ্রাগাঁথা হিপ স্কার্ফ নির্বাচনে। কিছুতেই যেন হেরেম প্যান্টের সঙ্গে স্কার্ফের বর্ণ বিচ্ছুরণের সঠিক মিল হয় না। সে বারবার কোমরে ত্রিকোণ হিপ স্কার্ফটি জড়িয়ে ধরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, ঘুরেফিরে নৃত্যের ভঙ্গিতে হরেক মুদ্রায় নিজেকে দেখে। তারপর মতামতের জন্য আমার শরণাপন্ন হয়।
আমি কোমর বাঁকা করে দাঁড়ানো যুবতীটির দিকে নিরিখ করে তাকাই। হিপ স্কার্ফের রুপালি মুদ্রাগুলো তার পৃথুল নিতম্বের রেখায় যুক্ত করেছে মৃদু আভাময় বিচ্ছুরণ। ত্রিকোণ বস্ত্রখণ্ডটি অনাবৃত মিডরিফটে নিম্ন নাভিটির ঠিক নিচে গিট্টি দিয়ে বাঁধা। সে নিম্নাঙ্গে নৃত্যমুদ্রার একটি লঘু ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলে, ফ্রিজ হয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘হাউ অ্যাম আই লুকিং?’ চটজলদি জবাব দিই, ‘ইনডিড অ্যাট্রাকটিভ।’
তোষামোদে তুষ্ট না হয়ে ময়রা ভ্রুকুটি করে বলে, ‘ইজ দ্যাট অল ইউ হ্যাভ টু সে।’ আমি খানিকটা প্ররোচিত হয়ে, সচেতনভাবে চাটুকারিতার বহুল ব্যবহৃত বাণ হানি, ‘এটা পরে ড্যান্স করলে, পুরুষ দর্শকদের শুধু হৃদয়ই ভাঙবে না, লিসেন ময়রা, আই অ্যাম টেলিং ইউ...তাদের ঘরসংসারও তছনছ হবে।’ তোষামোদে কাজ হয়। ময়রা ‘কুল…থ্যাংকস আ লট’ বলে কাউন্টারে এসে পেমেন্ট সারে।
নৃত্য-সংক্রান্ত পোশাকের দোকান থেকে বের হয়ে সে ফিসফিসিয়ে আমাকে যেন নিশ্চিত করে, ‘লিসেন, ইসরায়েলের যে কিবুটস বা সমবায় খামারে আমি নয় মাস কাটাব, ওখানে প্রতি সপ্তাহান্তে বসে ছেলেমেয়েদের জোড়ায় জোড়ায় নৃত্যের আসর। ছেলেদের সবাই এলিজিবল ব্যাচেলর, কারও ঘরসংসার ভাঙার কোনো আশঙ্কা নেই।’
প্রতিক্রিয়ায় বলি, ‘থ্যাংকস আ বাঞ্চ ময়রা...ফর দি এস্যুরেন্স। তবে একটি প্রশ্ন, হোয়াই আর ইউ ইন্টারেস্টেড টু লার্ন বেলি ড্যান্স?’ দ্রুত জবাব আসে, ‘আমার পূর্বপুরুষেরা একসময় মিসরে বসবাস করত। সে যুগে ইহুদি মেয়েরা বেলি ড্যান্স করত। সো ইটস নট বিলং টু অনলি ইজিপশিয়ান আরবস। এই ঐতিহ্যে ইহুদি সম্প্রদায়েরও ভাগ আছে।’
প্রশ্ন না করে পারি না, ‘জাস্ট ফলোইং মিডল ইস্টার্ন জুইশ ট্র্যাডিশন, ইজ দ্যাট অল ময়রা?’ দাঁড়িয়ে পড়ে খুব মিষ্টি করে হেসে সে বলে, ‘লুক, আই লাভ মাই ফিগার...বেলি ড্যান্স ইজ গোয়িং টু কিপ মাই বডি নাইস অ্যান্ড টাইট।’
হাঁটতে হাঁটতে আমি বাজারের চকমিলান পরিসরের বন্ধনীর মতো বাঁকানো কারুকাজ করা খিলানগুলো ফের খেয়াল করে দেখি। ঝিক করে করোটিতে ফিরে আসে, বছর কয়েক আগে পড়া মিসরের যশস্বী লেখক নাগিব মাহফুজের একটি উপন্যাসে খিলানময় গলিপথে ঘুরপাক করার বর্ণনা। ময়রা হাঁটতে হাঁটতে কেবলই উদগ্রীব হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। জানতে চাই, ‘হোয়াট আর ইউ লুকিং ফর?’
অন্যমনস্কভাবে সে জবাব দেয়, ‘আই অ্যাম স্টিল লুকিং ফর জ্যাকব। চেককাটা নেকস্কার্ফ কেনার জন্য তার এ বাজারে আসার কথা। একটু খেয়াল রাখো তো, হি ইজ ভেরি টল।’
কেন জানি বিরক্ত লাগে, ইচ্ছা হয় বলে বসি, ময়রা, তুমি আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছ, সামান্য সময় জ্যাকবের কথা না ভেবে থাকতে পার না। ঝিক করে আমার স্নায়ুতে সৌজন্যবোধের কণিকাগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। নীরবে নিজেকে শাসন করে বলি, মেয়েটি মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে শিকার হয়েছে যৌন হয়রানির। এ মুহূর্তে খামোকা জেলাস হওয়াটা হবে অশ্লীল আচরণের শামিল।
আমরা চলে এসেছি সার্কুলার সরণিতে। দুই কদম সামনে বাড়তেই পাওয়া যায় নাগিব মাহফুজের নামে চমৎকার একটি রেস্তোরাঁ। পেটে খিদেও জানান দিচ্ছে, বলি, ‘লেটস গো অ্যান্ড হ্যাভ লাঞ্চ, ময়রা।’
দেয়ালে ঝুলছে ১৯৮৮ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়া কথাশিল্পী নাগিব মাহফুজের মস্ত বড় ফটোগ্রাফ। তার তলায় আমরা টেবিল পাই। আমি মেনু ঘাঁটি। ময়রা মাহফুজের ছোটগল্প নিয়ে কথা বলে। প্রকাশিত মোট ৩৫০টি গল্পের কোনোটাই মনে হয় তার পড়তে বাকি নেই। খান আল খলিলি বাজারের বর্ণনা আমি কোন বইতে পড়েছি, তা মনে করতে না পারায় ভারি বিব্রত লাগে।
খাবারের তালিকায় পিজিয়ন রাইস নামে একটি আইটেম আমাদের পছন্দ হয়। কিন্তু দামেদরে মনে হয় সব খাবারই এখানে অত্যন্ত চড়া। আমরা একটি ডিশ শেয়ার করতে চাই। বেদুইনদের মতো জালাবিয়া নামে ঢোলা পিরহান পরা ওয়েটার দ্রুত এক্সট্রা প্লেট, নাইফ প্রভৃতি সরবরাহ করে। সাইড হিসেবে গ্রিল করা এগপ্লান্টের সঙ্গে পরিবেশিত হয় চিকপির চাট ও তাবুলি।
পিলাফের মতো তপ্ত রাইস থেকে ছড়াচ্ছে সিনেমন ও লেবুর সুগন্ধ। ভাতের স্তূপের ওপর বসে আছে আধপোড়া একটি পায়রা। আমরা পিকাসোর আঁকা শ্বেতকপোতের প্রতীক নিয়ে কথা বলতে বলতে, মৃত পায়রাটিকে ডানা ধরে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করি। চতুর্দিকে ছড়ায় বেশ কিছু তপ্ত ভাত।
ওয়েটার কোরবানির দুম্বা জবাইয়ের ধারালো একখানা খঞ্জর দিয়ে বিষয়টা সুরাহা করে দেন। মাংসের মুখরোচক টুকরা চিবাতে চিবাতে নীরবে ভাবি, গাঙ্গেয় উপত্যকার এক মুসলিম তরুণের সঙ্গে মিলেঝুলে, ইহুদি একটি মেয়ের শান্তিপূর্ণভাবে কপোত ভক্ষণের বিষয় নিয়ে কখনো কিছু লেখার আমার সুযোগ হবে কি?
আহারের তামাদি হওয়ামাত্র ওয়েটার আওয়াজ দেন, ‘কাহওয়াতুন মিসরিওয়াতুন।’ পরিভাষাটি বুঝতে না পেরে আমি ও ময়রা বেয়াক্কেলের মতো একে অপরের মুখের দিকে তাকাই। নিউইয়র্ক সিটির স্কাইলাইনের ছবি আঁকা টিশার্ট পরা একটি বালক নিয়ে আসে পিতলের বড়সড় কেটলি। কফির গাঢ় সুগন্ধি থেকে যেন ছড়াচ্ছে উদ্দীপনা। ওয়েটার মাশাই পেয়ালায় তা ঢেলে দিয়ে সামনে সাজিয়ে রাখে সুগার পট ও সিনেমন ডাস্টের জার। ময়রা কফির আনুষঙ্গিক অনুপান হিসেবে অর্ডার করে সিসা-হুক্কা।
হুক্কায় ধূমপান সেরে বেশ খোশমেজাজে আমরা শেয়ারে একটি ট্যাক্সি ভাড়া করি। বাতচিতে ফিরে ফিরে আসে নাগিব মাহফুজের গল্পে ব্যবহৃত একাধিক চরিত্রের বর্ণনা। গিজা পিরামিডের চত্বরে নামামাত্র মনে হয়, কায়রো নগরীর অজস্র দালানকোঠার এক সম্প্রসারিত মিছিল মরুপ্রান্তরে এসে যেন হঠাৎ করে ব্রেক কষে থেমে পড়ছে। অপরাহ্ণের তেজি আলোয় একাধিক পিরামিডের দিকে আমরা একসঙ্গে তাকাই।
পর্যটকদের কোলাহলে মনে হয়, এ পরিসর থেকে নির্বাসিত হয়েছে নীরবতা। নগরীর জীবনযাপনের শব্দপুঞ্জও যেন বলকে ওঠা দুধের ফেনার মতো উথলে পড়ছে। ময়রা তাজ্জব হওয়া স্বরে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘হোয়াট আ ম্যাসিভ মনুমেন্ট...ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড ইট ইজ ফোর থাউজেন্ড ফাইভ হানড্রেড ইয়ারস ওল্ড, ওয়াও!’ আমাদের পাশ দিয়ে পর্যটক-পিঠে বালুকা ছিটিয়ে আগুয়ান হয় কয়েকটি উট।
ময়রা জানতে চায়, ‘উড ইউ লাইক টু শেয়ার আ ক্যামেল রাইড উইথ মি?’ পাথরের বিপুল স্তূপে প্রতিফলিত চড়া রোদ সামলে আমি তার দিকে তাকাই। চত্বরটি এত বিরাট যে উটে চড়তে পারলে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে সুবিধা হয়। কিন্তু মতামত দেওয়ার কোনো সুযোগ পাই না।
‘হাই ময়রা, আই অ্যাম লুকিং ফর ইউ,’ বলে তার দিকে ছুটে আসে সাড়ে ছয় ফুটি এক নওজওয়ান। জ্যাকবকে শনাক্ত করতে কোনো অসুবিধা হয় না। এ তরুণকে আমি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রোতে আসার ট্রেনে— করিডরে ময়রার গতর-সংলগ্ন হয়ে দাঁড়াতে দেখেছি।
জ্যাকব ইসরায়েল থেকে আসা পর্যটকদের সঙ্গে মিলেঝুলে অলরেডি ভাড়া করেছে ছোটখাটো উটের একটি কাফেলা। সে জানতে চায়, ময়রা তাদের সঙ্গে যেতে চায় কি না। ময়রা ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকায়, সে বিড়বিড় করে বলে, ‘আই হোপ ইউ ডোন্ট মাইন্ড ইফ আই গো উইথ জ্যাকব অ্যান্ড হিজ পার্টি।’ দ্রুত জবাব দিই, ‘নট অ্যাট অল’।
কাছে এসে সে চোখে চোখ রাখে, কবজিতেও আন্তরিকভাবে একটু চাপ দেয়। বলি, ‘হ্যাভ আ নাইস ক্যামেল ট্রিপ, ময়রা।’ জ্যাকবের সঙ্গে যেতে যেতে সে একবার গ্রীবা ফিরিয়ে তাকায়, আমি হাত নাড়ি।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি চুপচাপ। দু-তিনটি ছোট ছোট কাফেলা আমার দিকে যেন ধেয়ে আসে, সরে দাঁড়াই। কেন জানি খালি খালি লাগে। কাঠফাটা রোদ মাথায় ফারাওদের সমাধি দেখার তুমুল আগ্রহ কী কারণে জানি মন থেকে কর্পূরের মতো উবে যায়। ভারি ক্লান্ত বোধ করি। মনে হয়, ভালোমন্দে কায়রোতে একটি দিন তো প্রায় কেটেই গেল। থাক, পিরামিডের সিঁড়ি ভেঙে আর কাজ নেই। হোটেলে ফিরে যাওয়ার জন্য সস্তায় পাবলিক বাসটাস কিছু পাওয়া যায় কি না, আমি এর তালাশ করি।
(চলবে)

আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
২৩ নভেম্বর ২০২৫
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
১৩ নভেম্বর ২০২৫
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫তৌহিদুল হক

রক্ত লাল
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে
গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়
ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের
জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে
রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে
প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা
উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।
কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত
শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।
এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়
দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব
মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।
এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ
ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার
অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে
ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে
বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।
যত দেখি
যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে
জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা
শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।
যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।
হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।
যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।
ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত
করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!
সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।
জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ
আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।
তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে
অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই
কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার
প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।
এ যেন কেমন
গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে
চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে
একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির
মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে
এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ
কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা
আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।
সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে
নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার
অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।
জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?
চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার
যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।
চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?
যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!
চলে আসুন সবজি বাজারে
মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু
যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার
উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে
হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।
প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো
পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?
হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে
যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!
চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা
ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।
যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।
আহা! দেখার কেউ নেই!
এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।
কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ
কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?
কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।
চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।
ইতিহাস
আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই
নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব
ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।
আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---
আমি নই কারও!
সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম
ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে
অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ
ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু
এক মুখচ্ছবি।
আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে
হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার
কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।
কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।
দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!
আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না
হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে
ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে
সবকিছুর-ই সময় থাকে---
এরপর---ইতিহাস!

রক্ত লাল
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে
গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়
ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের
জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে
রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে
প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা
উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।
কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত
শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।
এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়
দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব
মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।
এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ
ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার
অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে
ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে
বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।
যত দেখি
যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে
জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা
শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।
যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।
হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।
যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।
ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত
করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!
সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।
জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ
আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।
তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে
অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই
কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার
প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।
এ যেন কেমন
গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে
চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে
একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির
মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে
এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ
কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা
আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।
সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে
নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার
অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।
জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?
চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার
যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।
চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?
যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!
চলে আসুন সবজি বাজারে
মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু
যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার
উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে
হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।
প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো
পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?
হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে
যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!
চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা
ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।
যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।
আহা! দেখার কেউ নেই!
এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।
কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ
কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?
কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।
চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।
ইতিহাস
আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই
নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব
ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।
আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---
আমি নই কারও!
সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম
ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে
অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ
ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু
এক মুখচ্ছবি।
আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে
হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার
কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।
কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।
দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!
আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না
হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে
ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে
সবকিছুর-ই সময় থাকে---
এরপর---ইতিহাস!

রাতের রেলগাড়িতে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রো এসে পৌঁছেছি মাঝরাতে। তো বেশ বেলা করে পাবলিক বাসে রওনা হই আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। এক জায়গায় ট্রাফিক জ্যামে বাস দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ।
০৪ ডিসেম্বর ২০২২
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
১৩ নভেম্বর ২০২৫
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’
‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’
হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,
‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।
হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।
তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’
ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’
হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’
‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’
হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,
‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।
হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।
তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’
ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’
হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

রাতের রেলগাড়িতে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রো এসে পৌঁছেছি মাঝরাতে। তো বেশ বেলা করে পাবলিক বাসে রওনা হই আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। এক জায়গায় ট্রাফিক জ্যামে বাস দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ।
০৪ ডিসেম্বর ২০২২
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
২৩ নভেম্বর ২০২৫
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

রাতের রেলগাড়িতে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রো এসে পৌঁছেছি মাঝরাতে। তো বেশ বেলা করে পাবলিক বাসে রওনা হই আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। এক জায়গায় ট্রাফিক জ্যামে বাস দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ।
০৪ ডিসেম্বর ২০২২
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
২৩ নভেম্বর ২০২৫
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
১৩ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫আজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

রাতের রেলগাড়িতে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রো এসে পৌঁছেছি মাঝরাতে। তো বেশ বেলা করে পাবলিক বাসে রওনা হই আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। এক জায়গায় ট্রাফিক জ্যামে বাস দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ।
০৪ ডিসেম্বর ২০২২
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
২৩ নভেম্বর ২০২৫
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
১৩ নভেম্বর ২০২৫
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫