Ajker Patrika

মধুডাঙার ঢেউ

গাজী আবদুর রহিম
আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২২: ০৩
মধুডাঙার ঢেউ

অর্ধবৃত্তাকার এক দ্বীপের তিন পাশ নদীবেষ্টিত। যেন একটা সাপ পেঁচিয়ে আছে আড়াআড়ি দ্বিখণ্ডিত বৃক্ষের কোমরে। নদীটার নাম মধুডাঙা। স্বচ্ছ জলের নদী। তবে বারো মাস ঢেউ থাকে। অমাবস্যার রাতে এই নদীর জল মেঘের মতো কালো হয়ে যায়। তখন এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করে মধুডাঙার জল। কেউ হঠাৎ একা দেখলে ভাববে, এটা খুনের রক্তের দরিয়া। এই নদী নিয়ে অনেক রূপকথার গল্প তৈরি হয়েছে।

ওপরে উল্লেখিত দ্বীপটাকে সবাই জেলেপল্লি হিসেবে চেনে। নদীতীরের এই পল্লিতে কোনো পাকা ঘর নেই। যা আছে, সবগুলো মাটির। ওপরে শণের চালা। কারো কারো চালা দিয়ে আবার আসমান দেখা যায়। এই পল্লি ক্ষুধার নিদারুণ এক রাজ্য। তবে ক্ষুধার রাজ্য হলে কী হবে, এখানে কাল্পনিক রাজ্য দেখা যায়। এই দ্বীপ নদীর ওপর ভেসে আছে। ছোট-বড়-মাঝারি ঘরগুলোর দক্ষিণ পাশে বরইগাছের নিচে খসে যাওয়া মাটির ঘর। বারান্দার সঙ্গে রান্নাঘর। এই ঘরটা কালিদাসের। তার ঘরে দেবী বসবাস করে। এই দেবী তার অপূর্ব সুন্দরী ও গুণবতী মেয়ে। নাম ভিমা। এখানে সচরাচর সুন্দরী মেয়ে জন্মে না। কারণ এই দ্বীপে যারা বাস করে, এরা জেলে সম্প্রদায়ের লোক। এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য গায়ের রং কালো হয়। আর সবাই উচ্চ লম্বা হয়। দেহের গড়ন হয় সুঠাম। তবে ভিমার চেহারা ছিল ভিন্ন রকমের। যেন হিন্দি সিনেমার নায়িকা ঐশ্বরিয়া রাইয়ের চেহারার নকল রূপ পেয়েছে। এখন এই সৌন্দর্য তার বিপদের কারণ হলো। নিম্নবর্গের মানুষের ঘরে উচ্চবর্গের চেহারার মেয়ে থাকা যে কতটা বিবাদের তা বলা কষ্টকর। কালিদাস মেয়েকে নিয়ে খুব পেরেশানিতে আছে। দুষ্ট যুবকেরা তার বাড়ির আশপাশে ঘাপটি মেরে থাকে সারাক্ষণ। এদিকে কালিদাসের সংসারে টানাটানি নিদারুণ। স্ত্রী মারা গেছে গত বছর। দীর্ঘদিন সে অসুস্থ ছিল। তার পেছনে হাজার তিরিশেক টাকা খরচ হয়েছিল চিকিৎসা বাবদ। শেষমেশ টাকাও গেল, স্ত্রীও মারা গেল। মাঝখান দিয়ে কালিদাস ঋণের জলে ডুবে গেল। মাছ ধরার নৌকাটাও গেছে ফুটো হয়ে। পানি ওঠে গড়গড় করে। এই পৌষে দূরদূরান্ত থেকে ধান আনা-নেওয়ার খ্যাপের কাজ করতে পারলে তার কিছু রোজগার হতো। তা ছাড়া মধুডাঙায় এখন মাছের ছড়াছড়ি। ধরতে পারলেই হাটে নিয়ে গেলে কাঁচা টাকা পাওয়া যায়। এই অবস্থায় মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না কালিদাস। সমিতির লোকেরা দুবেলা আসে ঋণের কিস্তি আদায় করতে। অন্যান্য পাওনাদারও বাড়তি কথা শোনাচ্ছে। রামেশ্বর বলেছে, সাত দিনের মধ্যে তার টাকা না দিতে পারলে কালিদাসকে বাজারে বটগাছের গায়ে পিঠমোড়া দিয়ে বাঁধবে। রামেশ্বর এই গাঁয়ের কেউ না। ওর বাড়ি মহাদেবপুর বাজারের পাশেই। এদিকে ঘরের চালে শণ কিছুটা ওড়ে দক্ষিণের বাতাসে। তিন মাস বাদেই বর্ষাকাল। 

পাওনাদারের গালি সইতে না পেরে কালিদাস একদিন কালো আঁধারের নিশিতে পাড়ি দিল যশোরে। যশোরে ধান কাটার কাজে বেশ রোজগার হয়। যাওয়ার সময় ভিমাকে বলে গেছে, ‘মা, তুই দেইখা-শুইনা ভালো মতোন থাকিস। আমি বিশ-পঁচিশ দিনের বেশি থাকপো না।’

এ কাজে ধানও পাওয়া যাবে খোরাকির জন্য, আবার বিক্রি করে টাকাও পাওয়া যাবে। এজন্য এই কাজ তার কাছে ঋণ পরিশোধের জন্য উত্তম পন্থা মনে হয়েছে।

এদিকে কালিদাস চলে যাওয়ায় বাড়িতে একা থাকে ভিমা। সকালবেলা সে ভাঙাচোরা নৌকাটা নিয়ে নদীতে যায় মাছ ধরতে। মেয়ে হলে কী হবে, তার ভেতরে শক্তি-সামর্থ্য সবই আছে। খেওলা জাল ফেলতে পারে। সে স্কুলে যায় না। পড়ালেখার আগ্রহ ছিল, কিন্তু কাজ হয়নি। মা অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তাকে বাড়ির সব কাজের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। 
একদিন দুপুরের দিকে রামেশ্বর এসে ডাক পাড়ে, ‘কালিদাস, বাড়িত আছো?’ 
ভিমা তার হাঁসের বাচ্চাগুলোকে শামুক ভেঙে দিচ্ছিল। রামেশ্বরকে দেখে তাড়াতাড়ি বারান্দায় গিয়ে চৌকি এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘বাবা বাড়িতে নাই।’ 
‘কই গ্যাছে?’ 
‘যশোরে। ধান কাটবার কামলা দিবার গ্যাছে।’ 
‘আমার টাকাগুলান এত দিন হইয়া গেল, তবু পরিশোধ করল না। এরকম করলি চলে বলো?’ 
‘সব টাকা পরিশোধ কইরা দিবে, একটু সবুর করেন, কাকাবাবু।’ 
ভিমা ঘর থেকে বাটিতে করে চালভাজা এনে দেয় রামেশ্বরকে। খেতে খেতে দুজন কথা বলে। রামেশ্বর বলে, ‘তোমার নামডা কী য্যান?’ 
‘ভিমা।’ 
মানুষের মন বড়ই উচাটন। মেয়েটাকে দেখে রামেশ্বরের মনে ধরে। সে মনে মনে ঠিক করে, তার ছেলের সঙ্গে বেশ মানাবে। এতক্ষণে ভিমা যে জেলের ঘরের মেয়ে, এটা খেয়াল ছিল না রামেশ্বরের। 
রামেশ্বর বলে, ‘আজ তাইলে যাইগা।’ 
‘আমি রান্ধন বসাইছি। খাইয়া যাইবেন, কাকাবাবু।’ 
‘তা হোকগে। অন্যদিন আইসা খাব।’ 
রামেশ্বর এরপর থেকে নিয়মিত আসে টাকা চাইতে। তবে তার মনে লক্ষ্যের বিপরীতে একটা উপলক্ষও যে ছিল, সেটা আর কে জানে? 
একদিন ভিমার সতেরো বসন্ত পার করে আসা যৌবনে রামেশ্বর গাঢ় ছাপ এঁকে দেয়। এই ছাপ আসলে কলঙ্কের, নাকি স্বর্গের? 
সেদিনও পাওনা আদায়ের জন্য এসেছিল রামেশ্বর। তাকে কাকাবাবু সম্বোধন করে বারান্দায় বসতে দিয়েছিল ভিমা। তারপর শুরু হলো ঘোর বর্ষা। সবকিছু পানিতে তলিয়ে যেতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ করেই একটা জানোয়ার হয়ে ওঠে রামেশ্বর। সেদিন ভিমার শত বাধা, কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে কাকাবাবু ডাক উপেক্ষা করেছিল রামেশ্বর। 
এ ঘটনার পর থেকে সারাক্ষণ মন খারাপ থাকে ভিমার। তার গোলাপের মতো মুখটায় আর ফুটন্ত গোলাপের হাসি আসে না। যেন বিধির এই  গোলাপের পাপড়িগুলো কীটের আক্রমণে বুজে যায় যায় ভাব। সারাক্ষণ পৃথিবীটা ঘুরতে থাকে ওর কাছে। হাঁসের বাচ্চাগুলোর সঙ্গে খেলতে আর ভালো লাগে না ওর। নৌকা নিয়ে নদীতে যেতেও মন চায় না। 
এক মাস পর বাড়িতে আসে কালিদাস। অনেক টাকা কামিয়েছে সে। ভিমার জন্য এনেছে চুরি ও ব্যান ক্লিপ। আর এনেছে সন্দেশ। মেয়েটা তার সন্দেশ পছন্দ করে। বাবাকে দেখে ধীরপায়ে এসে দাঁড়ায় ভিমা। কালিদাস বলে, ‘মা তোর মুখ এত শুকনো ক্যান? কিচ্ছু খাসনি বুঝি? চিন্তা করিস? আর চিন্তা করতে হইব না। এবার সক্কল দেনা পরিশোধ কইরা দিমু।’
ভিমা মনে মনে বলে, ‘যা দেনা ছিল, তার থাইকা বেশি তো নিয়া গ্যাছে জানোয়ার রামেশ্বর। তুমি আবার কী পরিশোধ করবে, বাবা?’ 
ভিমা বলে, ‘বাবা, আইসা ভাত খাইয়া নাও।’ 
কালিদাসের হাতে থাকা ব্যানক্লিপ, চুরি ও সন্দেশের প্যাকেটগুলো ভিমার হাতে দেয়। 
উঠোনে রোদে বসে ভাত খায় কালিদাস। শীত পড়ছে বেশ প্রখরতা নিয়ে। সকালে কুয়াশা পড়ে হালকা। এর মধ্যে একদিন হয়ে গেল ঘোর বর্ষা। ঋতুর যেন ঠিকঠিকানা নেই। 
কালিদাস নৌকা সারাইয়ের কাজ শুরু করেছে। আরশাদ মিস্ত্রি সকাল থেকেই কাজে লেগেছে। নৌকা গড়ার দক্ষ এক কারিগর এই আরশাদ। বয়স নব্বইয়ের ওপরে। চুল সাদা হয়ে গেছে। দাঁত পড়েনি একটাও। জীবনে কয়েক হাজার নৌকা গড়েছে আরশাদ। এখনো গড়ে যাচ্ছে, দুবেলা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার তাগিদে। 
পরদিন রামেশ্বর আসে টাকা চাইতে। ঘর থেকে টাকা এনে দেয় কালিদাস। রামেশ্বরকে দেখে আড়ালে দাঁড়িয়ে থুতু ফেলে ভিমা। রামেশ্বর ভিমার চোখে মানুষরূপী জানোয়ার। 
রামেশ্বর বলে, ‘আজ তাইলে যাইগা কালি।’ 
কালিদাস বলে, ‘এত দেরি হলো দেনা পরিশোধ করতে, আমাকে ক্ষমা কইরা দিও, দাদা।’ 
‘সমস্যা নেই। তুমি যাইও দিন বেড়াইয়া আইসো।’ 
‘নিশ্চয় যাব।’ 
রামেশ্বর চলে যাওয়ার পর কালিদাসের সামনে এসে দাঁড়ায় ভিমা। ভিমা বলে, ‘রামেশ্বর কী জন্যি আইছিল?’ 
‘পাওনা টাকা নিবার লাগি।’ 
ভিমা বাবাকে বলতে গিয়েও বলতে পারেনি। তার ভেতরে অন্যরকম একটা দ্বিধা-ঘৃণা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। 
কালিদাস বের হয় হাটে যাওয়ার জন্য। তার একটা ঘন জালের দরকার। নদীতে ছোট-বড় হরিণা চিংড়ির ছড়াছড়ি। বাজারে দামও ভালো, কেজি পঞ্চাশ টাকা। 
হঠাৎ ভাতপোড়া গন্ধ আসে ভিমার নাকে। ও সেই কখন ভাত বসিয়েছে। তারপর আর খেয়াল করেনি। মেয়েটা সারাক্ষণ চিন্তায় মগ্ন থাকে। কাজে মন বসে না আগের মতো। শুধু মাথা ঘুরায় আর বমি আসে। 
হাসের বাচ্চাগুলো দাঁড়িয়ে আছে উঠানের আঙিনায়। একটু পর আরশাদ মিস্ত্রি আসবে ভাত খেতে। এসে দেরি করবে না। লোকটা কাজে ফাঁকি দেয় না। 
ভিমা পোড়া ভাতগুলো গরুর নান্দায় ঢেলে দিয়ে আবার নতুন করে ভাত বসায়। কালিদাস হাট থেকে বাড়ি ফেরে। নদীর তীর থেকে আসে আরশাদ মিস্ত্রি। কালিদাস বলে, ‘মিস্ত্রি আইছে। ভাত দে, মা।’ 
ভিমা বলে, ‘ভাত হইতে আরেকটু বাকি আছে।’ 
‘আমি হাটে যাইবার সময় না দেইখা গেলাম তুই ভাত বসাইছিলি!’ 
‘হ। বসাইছিলাম। পুইড়া গ্যাছে, তাই আবার বসাইছি।’ 
ওদিকে আরশাদ মিস্ত্রি ডাক পাড়ে, ‘কই, ভাত কই! নিয়া আসো, বেলা গড়াইয়া যাইতেছে। অনেক কাম বাকি এখনো।’ 
কালিদাস বলে, ‘ভাই, দুইডা মিনিট বসেন।’ 
ভিমা বলে, ‘তোমরা দুইজন বসো। আমি চিড়া আর গুড় আনতাছি।’ 
চিড়া আর গুড় খেয়ে নদীর তীরে রওনা দেয় কালিদাস ও আরশাদ। আজকে যে করেই হোক কাজ শেষ করা লাগব। 
সন্ধ্যায় ঘরে চৌকিতে শুয়ে আছে ভিমা। কালিদাস ভিমার কপালে হাত রেখে বলে, ‘কিরে মা, তোর কি শরীল খারাপ করছে?’ 
‘না। কেমুন জানি লাগতাছে।’ 
‘দ্যাখলি, বুঝি আমি। বাবারা মাইয়ার সব দুখ্‌খো বোঝে। বল কী হইছে?’ 
‘জানি না কী হইছে। তবে সারাক্ষণ শুধু ওলডানি আসে আর মাথা ঘুরায়।’ 
এ কথা শুনে কালিদাসের চোখ কপালে উঠে যায়। ‘এখন আমি যা যা জিগাইব, উত্তর দিবি।’ 
‘কী প্রশ্ন, বলো?’ 
‘তুই কি কারো লগে শুইছিলি?’ 
‘অত কিছু কইতে পারুম না। শুধু এটুকুন বলতেছি। হুম। তয় নিজের ইচ্ছায় না। সে জোর করে...’
‘কে সে?’ 
‘তোমার পাওনাদার। এর বেশি কিচ্ছু আমি কইতে পারুম না।’ 
‘রামেশ্বর যে এমন কুত্তার কুত্তা। ওরে দেখলে চেনা যায় না। কুত্তাটারে আমি বলি দিব। তুই এই কথা কাউরে কছ নাই তো?’ 
‘কইলে কী হইব, আর না কইলে কী হইব?’ 
‘লোকে জানলি তোরে বিয়া দিবার পারুম না, মা। খবরদার, কাউরে বলবি না।’ 
এ কথা শোনার পর কালিদাসের মন খারাপের রোগে ধরে। তার কোনো কাজে মন বসতে চায় না। তবে তার তো আর বসে থাকলে চলবে না। কালিদাস তার নতুন জালটা নিয়ে নদীতে যায় মাছ ধরতে। অনেক মাছ উঠেছে জালে। সব মিলিয়ে কেজি দেড়েক চিংড়ি মাছ। সেগুলো নিয়ে হাটে যায় কালিদাস ৷ এগুলো বেচে তরিতরকারি কিনে আনবে সে। 
হাট থেকে ফিরে কালিদাস দেখে ঘরের দরজা বন্ধ। কালিদাস বলে, ‘মা, এই অবেলায় ঘরের দরজা বন্ধ কইরা ঘুমাচ্ছিস ক্যান?’ 
কোনো সাড়া না পেয়ে কালিদাস দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখে, ভিমা আর বেঁচে নেই। সে গলায় রশি নিয়ে এই পৃথিবীর বিষাক্ত মানুষ নামের কীটদের মুখে থুতু দিয়েছে আরও একবার। 
পাড়ার লোকেরা চিতা সাজিয়েছে। মধুডাঙা নদীর তীরে শ্মশান। চন্দনের গন্ধে ভরে গেছে চারপাশ। একটু পরই চিতার মুখে আগুন দেবে কালিদাস। কিন্তু তার চোখে-মুখে কোনো শোকের ছাপ নেই। কারণ তার মনে হচ্ছে, ভিমা স্বর্গে চলে গেছে। 
শ্মশান থেকে ফিরতে রামেশ্বরের সঙ্গে দেখা হয় কালিদাসের। কালিদাস বলে, ‘রামেশ্বর, তুই মানুষ না। তুই আস্তো একটা কুত্তার বাচ্চা। তুই একটা জানোয়ার।’ 
এ কথা শুনে রামেশ্বরের চোখ দুটো বড় হয়ে যায়। যেন চিড়িয়াখানার কোনো জন্তু অনেক দিন পর মানুষের দেখা পেয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

তৌহিদুল হক
তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

রক্ত লাল

আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে

গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়

ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের

জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।

যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে

রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে

প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা

উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।

কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত

শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।

এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়

দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব

মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।

এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ

ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার

অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে

ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে

বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।

যত দেখি

যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে

জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা

শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।

যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।

হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।

যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।

ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত

করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!

সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।

জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ

আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।

তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে

অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই

কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার

প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।

এ যেন কেমন

গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে

চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে

একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির

মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে

এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ

কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা

আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।

সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে

নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার

অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।

জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?

চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার

যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।

চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?

যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!

চলে আসুন সবজি বাজারে

মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু

যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার

উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে

হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।

প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো

পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?

হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে

যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!

চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা

ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।

যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।

আহা! দেখার কেউ নেই!

এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।

কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ

কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?

কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।

চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।

ইতিহাস

আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই

নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব

ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।

আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---

আমি নই কারও!

সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম

ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে

অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ

ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু

এক মুখচ্ছবি।

আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে

হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার

কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।

কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।

দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!

আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না

হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে

ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে

সবকিছুর-ই সময় থাকে---

এরপর---ইতিহাস!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিদায় নেওয়া হুমায়ূন এখনো আছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪২
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’

‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’

হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,

‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।

হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।

তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’

ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’

হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘হীরক রাজার দেশে’ মঞ্চস্থ করল স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।

মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।

হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।

নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।

শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত