Ajker Patrika

ধার করা খালাম্মা

মনিজা রহমান
আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২২: ০১
ধার করা খালাম্মা

আমরা ভাইবোনরা ওনাকে ডাকতাম ধার করা খালাম্মা। সব সময় আমাদের বাসায় আসতেন টাকা ধার নেবার জন্য—‘বিশটা টাকা হোবে। কদিন পরেই লিয়ে দোব।’

‘লিয়ে দোব’ শব্দটা শুনে মুখে হাত দিয়ে হাসি চাপতাম। মাটির মানুষ আম্মাকেও দেখতাম ওনাকে দেখলে বিরক্ত হতে। খালাম্মা কখনো অন্য কোনো কারণে আসতেন না! শুধু টাকা ধার চাইতে আসতেন। শুধু আমাদের বাসা না, পাড়ার সব বাড়িতে যেতেন একই উদ্দেশ্যে।

আজাদের কাছে শুনেছি, দেশভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা থেকে ঢাকায় এসেছিল ওদের পরিবার। ধার করা খালাম্মার ছোট ছেলে আজাদ আমার সমবয়সী হলেও আমরা এক স্কুলে পড়তাম না। ও পড়ত বয়েজ স্কুলে আর আমি গার্লস স্কুলে। আজাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয় কচিকাঁচার আসর করতে গিয়ে। ওখানে আরও অনেকের মতো আজাদ ছিল আমার সাথি ভাই আর আমি ওর সাথি বোন।
‘আমি কি তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকব?’ 
কচিকাঁচার আসরে গান আর ছবি আঁকা শিখতে আসা শিশুদের আমরা দেখাশোনা করতাম। সংগঠকের কাজ বলতে যা বোঝায়। কোনো দিন সন্ধ্যা হয়ে গেলে আজাদ আমার জন্য অপেক্ষা করত।

রজনী চৌধুরী রোডে কচিকাঁচার ভবন থেকে ডিস্ট্রিলারি রোডের বাসায় হেঁটে আসতে পনেরো-বিশ মিনিট লেগে যেত। ধূপখোলা মাঠের পূর্ব দিকে যে তিনটা গলি চলে গেছে, তার প্রথমটায় থাকতাম আমরা। আজাদেরা থাকত আমাদের বাসা থেকে আরও দশ মিনিট দূরত্বে।

কচিকাঁচায় যুক্ত থাকার কারণে সেই সময় খেলাঘরকে দুই চোখে দেখতে পারতাম না। স্কুলে তো অনেকের সঙ্গে রীতিমতো মারামারি লেগে যেত এ নিয়ে। কচিকাঁচার দুই সাথি ভাই-বোন আজাদ আর আমাকে অবশ্য কেউ সীমান্ত খেলাঘরের লাইব্রেরিতে যেতে আটকাতে পারত না। আজাদ আমাকে পথ দেখিয়েছিল লাইব্রেরির। মাসিক পনেরো টাকায় নিয়মিত ওখান থেকে বই নিয়ে এনে পড়তাম।
‘আচ্ছা, তোর মা সব সময় এভাবে ধার চাইতে আসে কেন?’ 
কথাটা বহুবার ঠোঁটের ডগায় এলেও আজাদকে বলা হয়নি। যেমন ওদের আমরা আড়ালে ঘটি বলে ডাকি, সেটা কখনো বলিনি। ওইটুকু ভদ্রতা-সভ্যতা আব্বা-আম্মা আমাদের ভাইবোনদের শিখিয়েছিলেন।
আব্বার পাড়াতো বন্ধুদের বেশির ভাগ ছিলেন এমন ক্যালকেশিয়ান। এমনকি বরিশালের অজ পাড়াগাঁ থেকে ঢাকায় আসা আম্মারও।

কেউন্দিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পরে আম্মার বিয়ে হয় আব্বার সঙ্গে। তারপর ঢাকায় এসে গেন্ডারিয়ার ফজলুল হক মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ওই কলেজে পড়ার সূত্রে আম্মার যত বান্ধবী হয়েছিল, তাদের বেশির ভাগ ছিলেন ক্যালকেশিয়ান। দেশভাগের পরে আসা মানুষগুলো আমাদের মহল্লায় শিক্ষাদীক্ষায় বেশ অগ্রসর ছিল।

ধার করা খালাম্মা আম্মার বান্ধবী ছিলেন না। তবে আম্মার বান্ধবী রেবা খালাম্মার সঙ্গে এক বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। যে কারণে মাসে দুই-তিনবার যাওয়া হতো ওনাদের বাসায়।

আজাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত মাঝেমধ্যে। বাসায় দেখা হয়ে গেলে ওকে খুব খুশি মনে হতো না। খুশি হওয়ার কোনো কারণও ছিল না ওর আশপাশে। ওর মা যে ধার করে বেড়ান সব জায়গায়, সেটা কিশোর বয়সে ওর স্বতঃস্ফূর্ততা শুষে নিয়েছিল। তদুপরি ওর ছিল মানসিকভাবে অসুস্থ দুই বোন, যাদের সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতে দেখতাম আমি।

আজাদদের বাসার পাশে ছিল বস্তি, তার ওই পাশে রেললাইন। দিনরাত সেখান থেকে ট্রেন যেত প্রচণ্ড আওয়াজ করে। ট্রেনের শব্দ ওদের সহনীয় হয়ে গিয়েছিল। ওদের বাসায় ঢুকতেই একটা কুয়ার মতো ছিল দরজার সঙ্গে। ঢোকার মুখে খুব আতঙ্কে থাকতাম—যদি পা পিছলে কুয়ায় পড়ে যাই, তাহলে তো সলিলসমাধি হবে।

আম্মার বান্ধবী রেবা খালা আর ওনার দুই মেয়ে নীলা ও শিলা গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতিতে বেকারি, সেলাই, ইকেবানাসহ অনেক কিছু শেখাতেন। এত গুণ থাকার পরেও রেবা খালার দুই মেয়ের খুব ভালো বিয়ের সম্বন্ধ আসত না। পরে আম্মার কাছে শুনেছি, ঘটি বলে ওনাদের স্থানীয় পরিবার থেকে কেউ বিয়ে করতে চাইত না।

পাত্র পাওয়া না যাওয়ায় আম্মার দুজন ক্যালকেশিয়ান বান্ধবী শেলি খালা আর কামরুন খালার বিয়ে হয়েছিল বেশি বয়সে। তা-ও আবার বিপত্নীক লোকের সঙ্গে। শেলি আর কামরুন খালা একসঙ্গে পড়লেও আম্মার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। শুধু জেসমিন খালা ছিলেন আম্মার বয়সী, যে কারণে দুজনের মধ্যে ভাব ছিল বেশি। জেসমিন খালা আর ওনার দুই বোন লোটাস আর রোজ খালা—প্রত্যেকে ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী। সেই রকম সেজেগুজে ধূপখোলা মাঠের পশ্চিম পাশে মুরগিটোলার বাসা থেকে আমাদের বাসায় আসতেন দলেবলে।

তখন আমাদের বেশির ভাগ বাড়িতে টেলিভিশন থাকলেও ভিসিআর ছিল না। দোকান থেকে ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া করে সবাই মিলে যেতাম ভিসিআর আছে এমন কারও বাড়িতে। ওই দিনগুলি ছিল আমার কাছে স্বপ্নের মতো। হিন্দি সিনেমার রঙিন কাহিনি আমাকে নিয়ে যেত কল্পনার অন্য জগতে।

চোখের সামনে ধীরে ধীরে শৈশবের পুরান ঢাকা পাল্টাতে লাগল। একতলা বাড়ির ছাদে উঠে জীতেন্দ্র-শ্রীদেবীর সিনেমার গল্প করার আর সময় পেতাম না। আশপাশে বাড়ির ছাদে যেসব ছেলে আমাদের সঙ্গে টাঙ্কি মারত, তারাও কোথায় হারিয়ে গেল।

একতলা ভবনগুলো চারতলা-পাঁচতলা ভবনে রূপান্তরিত হলো। ভবনগুলো উঁচু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়ল। দূরত্ব মোচনের চেয়ে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নতিতে।

কলেজে ওঠার পরে পড়াশোনার ব্যস্ততা বাড়লেও কচিকাঁচার সঙ্গে আমার সম্পর্কের একদম ছেদ পড়তে দিইনি। তবে আজাদ আসত না আর। শুনেছি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পরে ও ইসলামপুরে এক থানকাপড়ের দোকানে কাজ নিয়েছে।

আব্বার সামর্থ্যের অভাবে আমাদের একতলা বাড়ি তখনো চার-পাঁচতলা হয়নি। আমাদের বাসাটা ছিল চার রাস্তার মোড়ে। বাসার এক পাশে ছিল ড্রেন, অন্য পাশে ট্যাপ কল। রিকশাওয়ালারা রিকশা থামিয়ে ওখানে পানি খেয়ে বিশ্রাম নিতেন।

বাসার সামনে একটা রকের মতো ছিল, যেখানে পাড়ার ছেলেরা বসে আড্ডা দিত। অনেক সময় আমরাও বসে থাকতাম। সেরকম একদিন আব্বা বসে পাড়ার একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন আর আমরা আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলাম।

ধার করা খালাম্মা প্রচণ্ড রোদের মধ্যে কোথা থেকে হেঁটে আসছিলেন। পরনে মলিন শিফন শাড়ি আর হাতে একটা বাজারের থলে। এই বেশে তাঁকে দেখা যেত সব সময়। হঠাৎ মোড়ে এসে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন তিনি। আব্বা আর আশপাশের অনেকে ছুটে গিয়ে ওনাকে আমাদের বাড়ির রকে এনে শোয়ালেন। চারপাশে ভিড় জমে যেতে লাগল। সবার চোখে আন্তরিক সমবেদনা।

হয়তো আশপাশের সব বাড়ির মানুষ খালাম্মার কাছে টাকা পেতেন। এর জন্য কাউকে অভিযোগ করতে দেখলাম না, বরং তাঁর জীবনের বঞ্চনার কথা বলতে লাগলেন সবাই। স্বামীর রেখে যাওয়া সামান্য পেনশনের টাকায় দুই মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েকে নিয়ে ওনার লড়াইয়ের বেদনাকে সবাই অনুভব করতেন। বিশ-ত্রিশ টাকা ধার করা মানুষের ওপর বিরক্ত হলেও কেউ ঘৃণা করতেন না ওনাকে। মানুষ তখনো রাঘববোয়ালদের বাদ দিয়ে চুনোপুঁটিদের নিয়ে ব্যস্ত হতে শেখেনি।

আম্মা এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে এসেছিলেন। কোনোক্রমে সেটা পান করানোর পরে দুই প্রতিবেশী বেবিট্যাক্সি ডেকে ওনাকে জনসন রোডে ন্যাশনাল হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। পরে উনি সুস্থ হয়ে ফিরলেও বেশ কাবু হয়ে গিয়েছিলেন।

বিয়ের পরে পুরান ঢাকা ছেড়ে নতুন ঢাকায় থিতু হলাম। মাসে একবার জ্যাম ঠেলে পুরান ঢাকায় যেতাম আব্বা-আম্মার সঙ্গে দেখা করতে। এর মধ্যে একদিন ঢাকা স্টেডিয়ামের বারান্দায় আজাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। স্টেডিয়ামের সুইমিংপুলের উল্টো দিকে ক্রীড়া সাংবাদিকদের অফিস থেকে আমি যাচ্ছিলাম প্রেসবক্সে ফুটবল ম্যাচ কভার করতে।

‘তুই এখানে! কত দিন পর দেখা!’ 

ছোটবেলার সেই হালকা-পাতলা টিনটিনে আজাদ এখন বেশ স্বাস্থ্যবান হয়ে গেছে। মাথার সামনে চুল পাতলা হতে শুরু করায় বেশ বয়স্ক ভাব চলে এসেছে। 

আজাদের মুখে একটা ভালো লাগার হাসি খেলে যায়। শৈশবের বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ দেখার চেয়ে ভালো লাগার কী থাকতে পারে দুনিয়ায়!

‘আমার এক ফ্রেন্ড ডিপফ্রিজ কিনবে। ওকে নিয়ে যাব এক পরিচিত দোকানে।’
‘তোর বন্ধু কোথায়?’ 
‘দৈনিক বাংলা মোড়ে সিগন্যালে আছে, বলল এইমাত্র।’ 
‘ওহ্। তারপর তোর খবর কী?’ 
‘এই তো, ভালো। সদরঘাটে একটা শাড়ির দোকান দিয়েছি। বিয়েও করেছি দুই বছর হলো।’ 
‘দুই বছর! আমি কিছুই জানি না!’ 
‘আমার বউ সীমা বিক্রমপুরের মেয়ে। তুই মনে হয় চিনবি। পুকুরপাড়ে থাকত।’ 
‘তার মানে, প্রেমের বিয়ে!’ 
‘প্রেমের না হলে কি বিক্রমপুরের পরিবার ঘটি ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিত!’ 
আজাদের কথাটা শুনে থমকে যাই। 
‘চাচার সঙ্গে একবার কথা হয়েছিল মসজিদে। তোর বিয়ের খবরও শুনেছি।’ 
‘হ্যাঁ, আমি আমার কলিগকে বিয়ে করেছি। মনে আছে, দুজনে মিলে সীমান্ত গ্রন্থাগার থেকে বই এনে ভাগাভাগি করে পড়তাম।’
‘কতকাল চলে গেল, বই হাতে নিইনি পড়ার জন্য!’ 
‘কী বলিস! তোর মাধ্যমেই তো পরিচয় বাংলা সাহিত্যের তিন সেরা ডিটেকটিভ, কী যেন নাম—টুনুদা, ঘনাদা আর ফেলুদার সঙ্গে।’ 
অবাক লাগে ভাবতে, একসময় আমরা কত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম, অথচ এখন দুজন দুজনের কিছুই জানি না। আজাদকে কখনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতাম না। ওই সুদূর শৈশবে বুঝতে পারতাম ব্যক্তিগত প্রশ্ন ওকে শুধু বিব্রত করে। তবু আজকে না করে পারলাম না। 
‘তোর না দুই বোন ছিল, ওদের কী অবস্থা এখন?’ 
‘ওরা এখন সাভারে এক মানসিক পুনর্বাসনকেন্দ্রে আছে।’ 
আজাদের চেহারা ভাবলেশহীন। 
‘আর খালাম্মা? উনি কেমন আছেন?’ 
‘ধার করা’ শব্দটা ঊহ্য রাখি। বহুদিন পরে ফ্যাকাশে চেহারার মলিন শিফন শাড়ি পরা খালাম্মার অবয়ব চোখে ভাসে। 
‘আম্মা তো মারা গেছেন বছরখানেক হলো!’ 
‘কী বলিস! আমি তো কতবার এর মধ্যে গেন্ডারিয়া গেলাম। আব্বা-আম্মা তো বলল না! কী হয়েছিল ওনার?’ 
ওর মায়ের মৃত্যু যে আমার পরিবারের জন্য তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়, আজাদ সেটা বুঝতে পারছিল। তবু ও ধীরে ধীরে বলল—‘আম্মার তো হাই ব্লাডপ্রেশার, ডায়বেটিস, গ্যাস্ট্রিক—সব সমস্যা ছিল। একটা থেকে ভুগে সুস্থ হলে আরেকটা এসে ধরত। শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন স্ট্রোক করে। ওনাকে আর বেশি কষ্ট করতে হলো না।’ 
আজাদের বন্ধু চলে এসেছে। ও বারবার ফোন করছে আজাদের মোবাইলে। ‘মসজিদে দেখা হলে চাচার কাছ থেকে আমি তোর নম্বর নিয়ে নেব, এখন যাই রে’ বলে আজাদ ঘুরে চলে যায়। 
পেছন থেকে আজাদকে ডাকতে গিয়েও থেমে যাই। পেছন থেকে কাউকে ডাকা শুভ নয়। খুব জানার ইচ্ছে ছিল ধার করা খালাম্মার নাম কী ছিল। আম্মার বান্ধবী রেবা, শেলি, জেসমিন কিংবা কামরুন খালার মতোই কি কোনো নাম! আমার আর জানা হলো না। 

সারা জীবন আমার স্মৃতিতে উনি ধার করা খালাম্মাই থেকে গেলেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

তৌহিদুল হক
তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

রক্ত লাল

আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে

গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়

ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের

জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।

যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে

রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে

প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা

উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।

কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত

শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।

এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়

দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব

মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।

এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ

ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার

অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে

ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে

বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।

যত দেখি

যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে

জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা

শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।

যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।

হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।

যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।

ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত

করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!

সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।

জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ

আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।

তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে

অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই

কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার

প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।

এ যেন কেমন

গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে

চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে

একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির

মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে

এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ

কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা

আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।

সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে

নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার

অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।

জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?

চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার

যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।

চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?

যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!

চলে আসুন সবজি বাজারে

মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু

যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার

উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে

হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।

প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো

পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?

হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে

যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!

চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা

ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।

যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।

আহা! দেখার কেউ নেই!

এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।

কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ

কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?

কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।

চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।

ইতিহাস

আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই

নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব

ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।

আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---

আমি নই কারও!

সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম

ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে

অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ

ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু

এক মুখচ্ছবি।

আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে

হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার

কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।

কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।

দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!

আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না

হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে

ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে

সবকিছুর-ই সময় থাকে---

এরপর---ইতিহাস!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিদায় নেওয়া হুমায়ূন এখনো আছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪২
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’

‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’

হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,

‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।

হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।

তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’

ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’

হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘হীরক রাজার দেশে’ মঞ্চস্থ করল স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।

মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।

হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।

নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।

শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত