ফজলুল কবির

বন্ধুকে খুঁজে বের করতে হবে, মনের অজান্তেই হাত বা কার্সর চলে যায় স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের ফেসবুক-টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া আইকনে। শপিং করতে বা শপিংয়ে যাওয়ার আগে বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য ই-কমার্স সাইটগুলোয় বা তেমন দক্ষ না হলে নিদেনপক্ষে গুগলে ঢুঁ মারাটা তো আজকের দিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ঘরের মধ্যেই আস্ত সিনেমা হল ঢুকে পড়ার গল্প তো এখন পুরোনো। সব মিলিয়ে গোটা বিশ্ব সত্যিই এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু কার হাতের? নিজের হাতের দিকে না তাকিয়ে বরং সত্যিকারের হাতটি খুঁজুন। ভেবে দেখুন আদতে কতগুলো আইকনে আপনার চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে না চাইতেই।
হ্যাঁ, ১৯৯০-এর দশকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ) যুগে বিশ্ব প্রবেশের পর এর শুধু বিস্তার দেখছে মানুষ। আজকের দিনে এই থ্রি-ডব্লিউ ছাড়া একটি দিন কাটানো আপাত-সুবিধাপ্রাপ্ত জনতার জন্য ভাবনার অতীত। কিন্তু এই যুগে প্রবেশের সময় যে আশা বা আদর্শের কথা প্রচার করা হয়েছিল, তা কি এখন বাস্তব? এক কথায় উত্তর দেওয়ার সুযোগ নেই।
একটু বুঝে নেওয়া যাক বিষয়টি। থ্রি-ডব্লিউ-এর নেতৃত্বাধীন আজকের ইন্টারনেট জমানার শুরুর সময় গণতন্ত্রবাদী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নানা স্তরের মানুষ বেশ আশা দেখেছিল। অনেকে তো একে একেবারে বিপ্লব হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। বলা হচ্ছিল, তথ্য কুক্ষিগত করার চল শেষ হবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সঙ্গে ছিল নিরাপত্তার ধোঁয়াটে বিষয়াদিও। কিন্তু এর একটিও কি দেখা গেছে? নাকি সময়ের সঙ্গে এই সবকিছুকেই মানুষ গুটিকয় কিছু করপোরেশনের হাতে বন্দী হতে দেখছে?
বর্তমান দুনিয়ায় থ্রি-ডব্লিউ ও ইন্টারনেট আদতে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমার্থক হয়ে উঠেছে, যেখানে কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে তথ্যের দুনিয়াকে বন্দী অবস্থায় আমরা দেখি। আর এটি করা হয়েছে ধীরে ও কৌশলী ধারায়। ডিজিটাল রেভল্যুশন নামে ১৯৯০-এর মাঝামাঝি যে ইন্টারনেটের যাত্রা, তা আর বিপ্লব হয়ে ওঠেনি সাধারণের জন্য। অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন এটি আনতে পারেনি। অথচ এর যাত্রাবিন্দুতে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা বহু মানুষ একে তাদের সম্ভাব্য হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তারা ভেবেছিল, পুঁজির মালিক হিসেবে গুটিকয়ের যে শাসন, তাকে তারা এর মাধ্যমে ভেঙে দিতে পারবে।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পরীক্ষাগার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মানুষের জন্য উন্মুক্ত হতে শুরু করে ইন্টারনেট। আজ এই ইন্টারনেটই মানুষে-মানুষে যোগাযোগ, শিক্ষা, বিনোদন, ব্যবসা ইত্যাদির সবচেয়ে সহজ পথ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা বিশ্বব্যাপী একচেটিয়া শাসনের কাঠামোকে হটাতে পারেনি, বরং তাকে আরও কেন্দ্রীভূত করেছে। ইন্টারনেটের যাত্রা শুরুর সে সময়ে মার্কিন সমাজবিদ ডেনিয়েল বেল শিল্প বিপ্লবোত্তর সমাজের বদলে তথ্য-সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্নের কতটা অর্জন হয়েছে। ইউরোপের সার্ন পরীক্ষাগার থেকে বিশ্বভ্রমণে বেরোনো ইন্টারনেট এখনো তার ভ্রমণ অক্ষুণ্ন রেখেছে। তবে তা মুখ্যত করপোরেট পুঁজির হাত ধরে। তার পরনে মুক্তমত ও তথ্যের স্বাধীনতার খোলস থাকলেও ভেতরে আছে একচেটিয়াকরণের হাড়-মাংস।
এর আদলটিও অন্য যেকোনো পুঁজিবাদী কাঠামোর মেনে চলা তিনটি মূলনীতিকেই অনুসরণ করে। প্রথমত, এটি পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বকে আড়াল করে; দ্বিতীয়ত, গুটিকয় করপোরেট খেলোয়াড়ের জন্যই শুধু প্রতিযোগিতার ভূমিটি উন্মুক্ত রাখে এবং তৃতীয়ত, সাধারণ জনতা বলতে যাদের বোঝায়, তাদের সামনে প্রভাববলয়ে ঢোকার পথটি সম্ভাব্য সব বাধা দিয়ে আকীর্ণ করে তাকে ‘অগণতান্ত্রিক’ কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার ‘মহান আদর্শ’ মেনে চলার ফুসলানি দেয়। এটি তিন শ্রেণির মানুষের জন্য তিনটি ভিন্ন সম্ভাবনার কথা বলে।

প্রথমত, এটি জ্ঞানপিপাসু শ্রেণিকে নিজের দিকে টেনে নেয়। বলা হয়, ইন্টারনেট হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাঠাগার, যেখানে এসে জড়ো হতে থাকবে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো জ্ঞান। উইকিপিডিয়ার মতো উন্মুক্ত বিশ্বকোষগুলো এই সম্ভাবনার একটি বাস্তব উদাহরণ হিসেবে সামনে হাজির থাকে। সত্যিই তো, আজ যেকোনো কিছু জানার জন্য ইন্টারনেটে একটু ঢুঁ মারলেই তো চলছে। তাহলে কথা তো অসত্য নয়।
দ্বিতীয় যে সম্ভাবনা বা আশঙ্কা সামনে আনা হয়, তা হলো নিরাপত্তা। মূলত রক্ষণশীল ও সামরিক-মনস্কদের লক্ষ্য করেই এই ‘নিরাপত্তা’ কার্ডটি খেলা হয়। দক্ষ রাষ্ট্রের মতো করেই জনমানসে এই ইন্টারনেটকে একটি প্রতিরক্ষা বর্ম হিসেবে হাজির করা হয়। বলা হয়, সবকিছু ভেঙে পড়লে এই ইন্টারনেটই বিকল্প যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। আজ ইন্টারনেট একধরনের সর্বজনীন হয়ে ওঠার পর এর আবার নানা ধরনও তৈরি করা হয়েছে। গড়ে উঠছে সাইবার আর্মিও।

আর তৃতীয় সম্ভাবনা হিসেবে ‘গণতন্ত্রের’ কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এটি মূলত সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা লোকজনের জন্য এক উৎকৃষ্ট বড়ি। এই তিন সম্ভাব্যতাই আবার একটি অভিন্ন অনুভূতির জন্ম দেয়। আর তা হলো—ভয়। মুফতে পাওয়া ‘জ্ঞানকোষ’ হারানো, ‘গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ খর্ব হওয়া এবং অতি অবশ্যই সামরিক ভয়। যে স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এর জন্ম হয়েছিল, সেই স্নায়ুযুদ্ধ কখনোই মানুষের পিছু ছাড়েনি। আর আজকের রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট এই সামরিক ভয়কে তো বাস্তব করে তুলেছে। তথ্যহীনতা বা তথ্যের প্রাপ্তি নিয়ে সংশয় বা ভয় মানুষকে বিস্তর ‘অপতথ্যের’ ভয়ের দুনিয়ায় আজ নিয়ে এসেছে।
পুঁজিতান্ত্রিক কাঠামোর প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠার কারণেই কিনা, এরও রয়েছে পুঁজির মতোই ক্ষুধা। প্রতিনিয়তই সে নিজেকে বাড়িয়ে তুলছে। প্রবৃদ্ধির দৌড়ে কিন্তু ইন্টারনেট নিজেই হাজির। সেটা কেমন? ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ প্রতি মিনিটে ভিডিও আপলোডের পরিমাণ কততে গিয়ে দাঁড়িয়েছে জানেন? মিনিটে ৫০০ ঘণ্টা।
কী আছে এই প্রতি মিনিটের ৫০০ ঘণ্টা আপলোড হওয়া ভিডিওগুলোতে? তথ্য। হ্যাঁ, তথ্যই আছে। কোনটি সত্য বা কোনটি মিথ্যা, সে মীমাংসা পরে। মূল কথা হলো, তথ্য আছে এসবের মধ্যে, সে এবার সিনেমা, নাটক, মিম, কৌতুক, তথ্যচিত্র, টিউটোরিয়াল—যে আঙ্গিকেই হোক না কেন। আদতে গত ৩০ বছরের ইন্টারনেট-জীবন মানুষকে এক তথ্যের সাগরে নিয়ে এসেছে। এই তথ্যের সমুদ্রের মধ্য থেকে কোনটি সে নেবে, আর কোনটি নেবে না—তা নির্বাচন করাটা এক কঠিন বিষয় হয়ে উঠেছে। তার চেয়ে বেশি যা কঠিন হয়েছে, তা হলো মার্কিন কবি ও অ্যাকটিভিস্ট জন পেরি বারলো ঘোষিত সাইবার স্পেসের স্বাধীনতা। ১৯৯৫ সালে তিনি এই সাইবার স্পেসের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর তার পরের বছরই ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব বাণিজ্যিকভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত হয়। ফলে বারলো ঘোষিত স্বাধীনতা যেন বলতে না-বলতেই হাতে চলে এল।

আজকের প্রযুক্তি দুনিয়ায় মহিরুহ হয়ে ওঠা চার প্রতিষ্ঠান—আমাজন, গুগল, মেটা ও অ্যাপলের দিকে তাকালে বোঝা যাবে সেই ক্ষণিকের স্বাধীনতা কতটা হৃত হয়েছে। ২০২১ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজেদের ব্যবসায় দাঁড়ানোর পরই এই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলোকে কিনতে শুরু করে। কতটা? জন্মের পর থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত অ্যাপল মোট ১২৩টি ছোট-বড় কোম্পানিকে কিনেছে। এর মধ্যে ২৭টি ছিল নিজ ঘরানার প্রতিষ্ঠান। বাকি সবই তার জন্য নতুন ক্ষেত্র। আমাজন এ ক্ষেত্রে নিজের ধারার প্রতিষ্ঠান কিনেছে ৪০টি। আর নতুন ধারার কিনেছে ৭১টি। গুগল শুধু সার্চ ইঞ্জিনই কিনেছে ৮১টি। আর নতুন ধারার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কিনেছে ১৮৭টি। এই দৌড়ে ফেসবুক বা হালের মেটা কিছুটা পিছিয়ে আছে। তারা নিজ ধারার প্রতিষ্ঠান কিনেছে ২৮টি, আর নতুন ধারার ৭৭টি। এই প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজ ধারার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিনে অন্যদের বেড়ে ওঠার পথ রুদ্ধ করেছে। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা হয়ে উঠেছে একচেটিয়া। আর নতুন ধারার প্রতিষ্ঠান কিনে তারা নিজেদের ‘অস্ত্রাগার’ সমৃদ্ধ করেছে। প্রতিটি নতুন ধারার প্রযুক্তিতে নিজেদের অবস্থানের জানান দিয়ে তারা একইভাবে সংশ্লিষ্ট ধারায় নতুন কারও বেড়ে ওঠার পথকে রুদ্ধ করেছে।
এ তো গেল ২০২১ সাল পর্যন্ত হিসাব, যা জানাল ওয়াশিংটন পোস্ট। জেফ বেজোসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি কিন্তু নিজেদেরও এই মহলে ঢুকে পড়া আটকাতে পারেনি। তারা জানিয়েছে, ইন্টারনেট-দুনিয়ায় নিজেকে একচেটিয়া করে তুলতে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে বেজোস যে বিনিয়োগ শুরু করেন, সে পথ ধরেই ওয়াশিংটন পোস্টও তাঁর থলিতে গিয়ে জমা হয়। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে বিশ্বের শীর্ষ ১০ হাজার ওয়েবসাইটের মধ্যে অর্ধেকেরই হোস্টিং অথোরিটি চলে আসে বেজোসের হাতে। সে যাক। ২০২১ সালের পর কী হলো? ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানাচ্ছে, ২০২১ সালে টেক-জায়ান্টরা অন্য কোম্পানি কেনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে। পরিমাণটা কত? ২৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলার!
এগুলো যে মানুষের জীবনকে সহজ করেনি, এমন নয়। করেছে। বিস্ময়কর পরিবর্তন এসেছে এসব প্রযুক্তির কল্যাণে। কিন্তু আলাপটি প্রযুক্তির উৎকর্ষ নিয়ে নয়; বরং এর কেন্দ্রীভূত হওয়া নিয়ে। যে তথ্যের প্রাপ্যতার জন্য মানুষ এত কিছুর সঙ্গে নিজের সমন্বয় করল, তা হাতছাড়া হওয়া নিয়ে। সাইবার স্পেসের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে, কীভাবে—সে প্রশ্নটি মগজ থেকে একেবারে উধাও হওয়া নিয়েই বরং এ প্রশ্ন। মানুষ এখন চূড়ান্ত ভোক্তায় পরিণত হয়েছে। তথ্য বলতে যে নিরাকার একটি বস্তুকে মানুষ বোঝে, তা এখন নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ—সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মূল সূত্র এখন সে। অথচ এই তথ্য-দুনিয়ার নিয়ন্তারা মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মেকি ‘গণতন্ত্রপনা’ দিয়ে এই অস্পৃশ্য ব্যাপারটি আবার আড়াল করা যাচ্ছে সহজেই।

কতটা? ইন্টারনেট বস্তুটি যে মার্কিন মুলুক থেকে যাত্রা করেছিল ধীরে ধীরে, তার অধিকর্তাদের একচেটিয়াপনা থামানোর পথ খুঁজে এখন রীতিমতো হয়রান মার্কিন আইনসভা ও বিচার বিভাগই। চিরাচরিত পুঁজির কারবারিরাও এখন এই নয়া দুনিয়ায় নিজের জায়গাটি করে নিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। করবেন না কেন? ২০২১ সালে অনলাইনে পণ্য বিক্রি হয়েছে কত জানেন? ৪ লাখ ২০০ কোটি ডলারের। আরেকটু হলেই তা জার্মান অর্থনীতিকে (সাড়ে ৪ লাখ কোটি ডলার) ছাড়িয়ে যেত।
মজার বিষয় হলো, এই এত এত একচেটিয়া গল্পের পরও, এত কিছু সামনে থাকার পরও, ইন্টারনেট বস্তুটি কিন্তু সামনে সটান এগিয়ে যাচ্ছে এক ‘নিরপেক্ষতার’ মুখোশ পরে। এর পেছনে এর ভেতরে থাকা সম্ভাবনার শক্তি যেমন আছে, তেমনি আছে কেন্দ্রে থাকা গুটিকয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতাও। সম্ভাবনাটি হচ্ছে, মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর, প্রযুক্তির মালিকানা বুঝে নেওয়ার। আর পৃষ্ঠপোষকতা? সেটা স্বয়ং রাষ্ট্রের এবং পুঁজির তো বটেই। রাষ্ট্র এটি একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, আবার অক্ষতও রাখতে চায়।
একটু বুঝে নেওয়া যাক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসার পর সত্যিকারের দুনিয়ায় মানুষ বিস্তর বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এখন কারও বাড়িতে না গিয়েও ঈদের শুভেচ্ছা জানানো যাচ্ছে, চাইলে অনলাইন সালাম ও সালামি আদান-প্রদানও চলছে হরদম। এ জন্য কারও সংস্পর্শে আসার প্রয়োজনই পড়ছে না। ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতে ফিরতে অনায়াসে মোবাইল স্ক্রিনে একটি লাভ ইমো, লাইক, স্যাড ইত্যাদি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে নিজের উপস্থিতি। শুভেচ্ছাবার্তা লিখতে আলসেমি লাগলেও সমস্যা নেই, অজস্র ডিজিটাল কার্ড তৈরি আছে; খুঁজতেও হবে না। সাজেশনে আসবে, বেছে নিয়ে একটা দিলেই হলো। যাকে পাঠানো হলো, তার মানসিক পরিস্থিতি যেমন বিবেচ্য নয়, তেমনি যে পাঠাচ্ছে তারও মানসিক অবস্থা এখানে একেবারে ঊহ্য। তাহলে সয়াবিন তেল বা অন্য যেকোনো ইস্যুতে জনদুর্ভোগের বেলায় কী ঘটছে? এ সম্পর্কিত খবরের তলায় একটি অ্যাংরি ইমো বা বেশি খেপে গেলে একটা স্ট্যাটাস, একটা প্রোফাইল পিকচার বা এমন যেকোনো কিছু দিলেই দায়িত্ব চুকে গেল। এতে তেলের দাম না কমলেও, ওয়াসার পানি পরিষ্কার না হলেও, সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ না হলেও এমনকি কিছুই না হলেও কাজটি কিন্তু হয়ে গেল। এবার পাশ ফিরে আরামে ঘুমানো যেতেই পারে। এমন মোক্ষম একটি প্রতিরক্ষা বর্মকে তবে রাষ্ট্র কেন হাতছাড়া করবে? মাঝেমধ্যে একটু বকে দিলেও একে রক্ষায়, একে বেড়ে উঠতে দিতে রাষ্ট্র বরং সব রকম চেষ্টা করবে। এ কারণেই মার্কিন সিনেট থেকে শুনানি শেষে মার্ক জাকারবার্গ হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসতে পারেন। তিনি জানেন, বিশ্বের সব সিনেটই তাঁকে পাশে চায়।
প্রযুক্তি মোগলদের সুরক্ষায় অন্য পুঁজিপতিরাও সদা তৎপর। তারা তাদের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ধসিয়ে না দিয়ে নিজেরাই একেকটি সাম্রাজ্য গড়ায় বরং মন দিচ্ছে। কারণ, এটাই পুঁজির ধর্ম। দুর্বলের সবল হয়ে ওঠায় সবলদের বিশ্বাস ও আন্তরিকতা থাকবে কেন? থাকার কথা নয়, নেইও। ফলে ইন্টারনেট ক্যাপিটালিজম ভাঙা নয়, বরং একে আরও দৃঢ় করতেই তারা বেশি নিবিষ্ট। উভয়েরই প্রয়োজন এক বিপুল ভোক্তা শ্রেণি। প্রচলিত পুঁজিপতিরা তাই নিজেদের পছন্দমতো একেকটি ভার্চুয়াল মিত্র খুঁজে নিয়েছে ও নিচ্ছে। যার সঙ্গে যার মিল হয় আরকি! ফলে নিজ নিজ ক্ষেত্রে তো বটেই একাধিক খাত মিলিয়ে একচেটিয়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে গুগল, ফেসবুক বা মেটা, অ্যাপল, আমাজন, ইউটিউব, এয়ারবিএনবি, পেপাল, নেটফ্লিক্স, আলিবাবার মতো প্রতিষ্ঠান। এমনকি জুড়ি খুঁজে দেওয়ার মতো বিষয়েও তৈরি হচ্ছে নানা ম্যাচমেকার প্ল্যাটফর্ম, যাদের কিছু কিছু এরই মধ্যে নিজেদের ভিত শক্ত করে একচেটিয়া বাণিজ্যের দিকেই এগোচ্ছে।
এহেন একচেটিয়া ইন্টারনেট বা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বসে তাই যতই সমাজ বদল বা স্বাধীনতার গল্প ও তর্ক হোক না কেন, তা দিন শেষে পণ্য হিসেবেই বিক্রি করছে সাম্রাজ্যপতিরা। ব্যক্তি ও তার তাবৎ অনুভূতি ও ক্রিয়া আজ ভোক্তা ও পণ্যে পুনঃ পুনঃ রূপায়ণের চক্রে আবদ্ধ, যেন নিজের লেজকেই গিলে খাওয়া সেই সাপ সে। পুরাণ নয়, এ আজকের দিনের নিদারুণ বাস্তবতা।
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত পড়ুন:

বন্ধুকে খুঁজে বের করতে হবে, মনের অজান্তেই হাত বা কার্সর চলে যায় স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের ফেসবুক-টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া আইকনে। শপিং করতে বা শপিংয়ে যাওয়ার আগে বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য ই-কমার্স সাইটগুলোয় বা তেমন দক্ষ না হলে নিদেনপক্ষে গুগলে ঢুঁ মারাটা তো আজকের দিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ঘরের মধ্যেই আস্ত সিনেমা হল ঢুকে পড়ার গল্প তো এখন পুরোনো। সব মিলিয়ে গোটা বিশ্ব সত্যিই এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু কার হাতের? নিজের হাতের দিকে না তাকিয়ে বরং সত্যিকারের হাতটি খুঁজুন। ভেবে দেখুন আদতে কতগুলো আইকনে আপনার চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে না চাইতেই।
হ্যাঁ, ১৯৯০-এর দশকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ) যুগে বিশ্ব প্রবেশের পর এর শুধু বিস্তার দেখছে মানুষ। আজকের দিনে এই থ্রি-ডব্লিউ ছাড়া একটি দিন কাটানো আপাত-সুবিধাপ্রাপ্ত জনতার জন্য ভাবনার অতীত। কিন্তু এই যুগে প্রবেশের সময় যে আশা বা আদর্শের কথা প্রচার করা হয়েছিল, তা কি এখন বাস্তব? এক কথায় উত্তর দেওয়ার সুযোগ নেই।
একটু বুঝে নেওয়া যাক বিষয়টি। থ্রি-ডব্লিউ-এর নেতৃত্বাধীন আজকের ইন্টারনেট জমানার শুরুর সময় গণতন্ত্রবাদী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নানা স্তরের মানুষ বেশ আশা দেখেছিল। অনেকে তো একে একেবারে বিপ্লব হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। বলা হচ্ছিল, তথ্য কুক্ষিগত করার চল শেষ হবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সঙ্গে ছিল নিরাপত্তার ধোঁয়াটে বিষয়াদিও। কিন্তু এর একটিও কি দেখা গেছে? নাকি সময়ের সঙ্গে এই সবকিছুকেই মানুষ গুটিকয় কিছু করপোরেশনের হাতে বন্দী হতে দেখছে?
বর্তমান দুনিয়ায় থ্রি-ডব্লিউ ও ইন্টারনেট আদতে সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমার্থক হয়ে উঠেছে, যেখানে কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে তথ্যের দুনিয়াকে বন্দী অবস্থায় আমরা দেখি। আর এটি করা হয়েছে ধীরে ও কৌশলী ধারায়। ডিজিটাল রেভল্যুশন নামে ১৯৯০-এর মাঝামাঝি যে ইন্টারনেটের যাত্রা, তা আর বিপ্লব হয়ে ওঠেনি সাধারণের জন্য। অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন এটি আনতে পারেনি। অথচ এর যাত্রাবিন্দুতে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা বহু মানুষ একে তাদের সম্ভাব্য হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তারা ভেবেছিল, পুঁজির মালিক হিসেবে গুটিকয়ের যে শাসন, তাকে তারা এর মাধ্যমে ভেঙে দিতে পারবে।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পরীক্ষাগার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মানুষের জন্য উন্মুক্ত হতে শুরু করে ইন্টারনেট। আজ এই ইন্টারনেটই মানুষে-মানুষে যোগাযোগ, শিক্ষা, বিনোদন, ব্যবসা ইত্যাদির সবচেয়ে সহজ পথ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা বিশ্বব্যাপী একচেটিয়া শাসনের কাঠামোকে হটাতে পারেনি, বরং তাকে আরও কেন্দ্রীভূত করেছে। ইন্টারনেটের যাত্রা শুরুর সে সময়ে মার্কিন সমাজবিদ ডেনিয়েল বেল শিল্প বিপ্লবোত্তর সমাজের বদলে তথ্য-সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্নের কতটা অর্জন হয়েছে। ইউরোপের সার্ন পরীক্ষাগার থেকে বিশ্বভ্রমণে বেরোনো ইন্টারনেট এখনো তার ভ্রমণ অক্ষুণ্ন রেখেছে। তবে তা মুখ্যত করপোরেট পুঁজির হাত ধরে। তার পরনে মুক্তমত ও তথ্যের স্বাধীনতার খোলস থাকলেও ভেতরে আছে একচেটিয়াকরণের হাড়-মাংস।
এর আদলটিও অন্য যেকোনো পুঁজিবাদী কাঠামোর মেনে চলা তিনটি মূলনীতিকেই অনুসরণ করে। প্রথমত, এটি পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বকে আড়াল করে; দ্বিতীয়ত, গুটিকয় করপোরেট খেলোয়াড়ের জন্যই শুধু প্রতিযোগিতার ভূমিটি উন্মুক্ত রাখে এবং তৃতীয়ত, সাধারণ জনতা বলতে যাদের বোঝায়, তাদের সামনে প্রভাববলয়ে ঢোকার পথটি সম্ভাব্য সব বাধা দিয়ে আকীর্ণ করে তাকে ‘অগণতান্ত্রিক’ কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার ‘মহান আদর্শ’ মেনে চলার ফুসলানি দেয়। এটি তিন শ্রেণির মানুষের জন্য তিনটি ভিন্ন সম্ভাবনার কথা বলে।

প্রথমত, এটি জ্ঞানপিপাসু শ্রেণিকে নিজের দিকে টেনে নেয়। বলা হয়, ইন্টারনেট হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাঠাগার, যেখানে এসে জড়ো হতে থাকবে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো জ্ঞান। উইকিপিডিয়ার মতো উন্মুক্ত বিশ্বকোষগুলো এই সম্ভাবনার একটি বাস্তব উদাহরণ হিসেবে সামনে হাজির থাকে। সত্যিই তো, আজ যেকোনো কিছু জানার জন্য ইন্টারনেটে একটু ঢুঁ মারলেই তো চলছে। তাহলে কথা তো অসত্য নয়।
দ্বিতীয় যে সম্ভাবনা বা আশঙ্কা সামনে আনা হয়, তা হলো নিরাপত্তা। মূলত রক্ষণশীল ও সামরিক-মনস্কদের লক্ষ্য করেই এই ‘নিরাপত্তা’ কার্ডটি খেলা হয়। দক্ষ রাষ্ট্রের মতো করেই জনমানসে এই ইন্টারনেটকে একটি প্রতিরক্ষা বর্ম হিসেবে হাজির করা হয়। বলা হয়, সবকিছু ভেঙে পড়লে এই ইন্টারনেটই বিকল্প যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। আজ ইন্টারনেট একধরনের সর্বজনীন হয়ে ওঠার পর এর আবার নানা ধরনও তৈরি করা হয়েছে। গড়ে উঠছে সাইবার আর্মিও।

আর তৃতীয় সম্ভাবনা হিসেবে ‘গণতন্ত্রের’ কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এটি মূলত সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা লোকজনের জন্য এক উৎকৃষ্ট বড়ি। এই তিন সম্ভাব্যতাই আবার একটি অভিন্ন অনুভূতির জন্ম দেয়। আর তা হলো—ভয়। মুফতে পাওয়া ‘জ্ঞানকোষ’ হারানো, ‘গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ খর্ব হওয়া এবং অতি অবশ্যই সামরিক ভয়। যে স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এর জন্ম হয়েছিল, সেই স্নায়ুযুদ্ধ কখনোই মানুষের পিছু ছাড়েনি। আর আজকের রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট এই সামরিক ভয়কে তো বাস্তব করে তুলেছে। তথ্যহীনতা বা তথ্যের প্রাপ্তি নিয়ে সংশয় বা ভয় মানুষকে বিস্তর ‘অপতথ্যের’ ভয়ের দুনিয়ায় আজ নিয়ে এসেছে।
পুঁজিতান্ত্রিক কাঠামোর প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠার কারণেই কিনা, এরও রয়েছে পুঁজির মতোই ক্ষুধা। প্রতিনিয়তই সে নিজেকে বাড়িয়ে তুলছে। প্রবৃদ্ধির দৌড়ে কিন্তু ইন্টারনেট নিজেই হাজির। সেটা কেমন? ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ প্রতি মিনিটে ভিডিও আপলোডের পরিমাণ কততে গিয়ে দাঁড়িয়েছে জানেন? মিনিটে ৫০০ ঘণ্টা।
কী আছে এই প্রতি মিনিটের ৫০০ ঘণ্টা আপলোড হওয়া ভিডিওগুলোতে? তথ্য। হ্যাঁ, তথ্যই আছে। কোনটি সত্য বা কোনটি মিথ্যা, সে মীমাংসা পরে। মূল কথা হলো, তথ্য আছে এসবের মধ্যে, সে এবার সিনেমা, নাটক, মিম, কৌতুক, তথ্যচিত্র, টিউটোরিয়াল—যে আঙ্গিকেই হোক না কেন। আদতে গত ৩০ বছরের ইন্টারনেট-জীবন মানুষকে এক তথ্যের সাগরে নিয়ে এসেছে। এই তথ্যের সমুদ্রের মধ্য থেকে কোনটি সে নেবে, আর কোনটি নেবে না—তা নির্বাচন করাটা এক কঠিন বিষয় হয়ে উঠেছে। তার চেয়ে বেশি যা কঠিন হয়েছে, তা হলো মার্কিন কবি ও অ্যাকটিভিস্ট জন পেরি বারলো ঘোষিত সাইবার স্পেসের স্বাধীনতা। ১৯৯৫ সালে তিনি এই সাইবার স্পেসের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর তার পরের বছরই ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব বাণিজ্যিকভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত হয়। ফলে বারলো ঘোষিত স্বাধীনতা যেন বলতে না-বলতেই হাতে চলে এল।

আজকের প্রযুক্তি দুনিয়ায় মহিরুহ হয়ে ওঠা চার প্রতিষ্ঠান—আমাজন, গুগল, মেটা ও অ্যাপলের দিকে তাকালে বোঝা যাবে সেই ক্ষণিকের স্বাধীনতা কতটা হৃত হয়েছে। ২০২১ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজেদের ব্যবসায় দাঁড়ানোর পরই এই প্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলোকে কিনতে শুরু করে। কতটা? জন্মের পর থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত অ্যাপল মোট ১২৩টি ছোট-বড় কোম্পানিকে কিনেছে। এর মধ্যে ২৭টি ছিল নিজ ঘরানার প্রতিষ্ঠান। বাকি সবই তার জন্য নতুন ক্ষেত্র। আমাজন এ ক্ষেত্রে নিজের ধারার প্রতিষ্ঠান কিনেছে ৪০টি। আর নতুন ধারার কিনেছে ৭১টি। গুগল শুধু সার্চ ইঞ্জিনই কিনেছে ৮১টি। আর নতুন ধারার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কিনেছে ১৮৭টি। এই দৌড়ে ফেসবুক বা হালের মেটা কিছুটা পিছিয়ে আছে। তারা নিজ ধারার প্রতিষ্ঠান কিনেছে ২৮টি, আর নতুন ধারার ৭৭টি। এই প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজ ধারার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিনে অন্যদের বেড়ে ওঠার পথ রুদ্ধ করেছে। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা হয়ে উঠেছে একচেটিয়া। আর নতুন ধারার প্রতিষ্ঠান কিনে তারা নিজেদের ‘অস্ত্রাগার’ সমৃদ্ধ করেছে। প্রতিটি নতুন ধারার প্রযুক্তিতে নিজেদের অবস্থানের জানান দিয়ে তারা একইভাবে সংশ্লিষ্ট ধারায় নতুন কারও বেড়ে ওঠার পথকে রুদ্ধ করেছে।
এ তো গেল ২০২১ সাল পর্যন্ত হিসাব, যা জানাল ওয়াশিংটন পোস্ট। জেফ বেজোসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি কিন্তু নিজেদেরও এই মহলে ঢুকে পড়া আটকাতে পারেনি। তারা জানিয়েছে, ইন্টারনেট-দুনিয়ায় নিজেকে একচেটিয়া করে তুলতে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে বেজোস যে বিনিয়োগ শুরু করেন, সে পথ ধরেই ওয়াশিংটন পোস্টও তাঁর থলিতে গিয়ে জমা হয়। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে বিশ্বের শীর্ষ ১০ হাজার ওয়েবসাইটের মধ্যে অর্ধেকেরই হোস্টিং অথোরিটি চলে আসে বেজোসের হাতে। সে যাক। ২০২১ সালের পর কী হলো? ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানাচ্ছে, ২০২১ সালে টেক-জায়ান্টরা অন্য কোম্পানি কেনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে। পরিমাণটা কত? ২৬ হাজার ৪০০ কোটি ডলার!
এগুলো যে মানুষের জীবনকে সহজ করেনি, এমন নয়। করেছে। বিস্ময়কর পরিবর্তন এসেছে এসব প্রযুক্তির কল্যাণে। কিন্তু আলাপটি প্রযুক্তির উৎকর্ষ নিয়ে নয়; বরং এর কেন্দ্রীভূত হওয়া নিয়ে। যে তথ্যের প্রাপ্যতার জন্য মানুষ এত কিছুর সঙ্গে নিজের সমন্বয় করল, তা হাতছাড়া হওয়া নিয়ে। সাইবার স্পেসের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে, কীভাবে—সে প্রশ্নটি মগজ থেকে একেবারে উধাও হওয়া নিয়েই বরং এ প্রশ্ন। মানুষ এখন চূড়ান্ত ভোক্তায় পরিণত হয়েছে। তথ্য বলতে যে নিরাকার একটি বস্তুকে মানুষ বোঝে, তা এখন নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ—সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মূল সূত্র এখন সে। অথচ এই তথ্য-দুনিয়ার নিয়ন্তারা মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মেকি ‘গণতন্ত্রপনা’ দিয়ে এই অস্পৃশ্য ব্যাপারটি আবার আড়াল করা যাচ্ছে সহজেই।

কতটা? ইন্টারনেট বস্তুটি যে মার্কিন মুলুক থেকে যাত্রা করেছিল ধীরে ধীরে, তার অধিকর্তাদের একচেটিয়াপনা থামানোর পথ খুঁজে এখন রীতিমতো হয়রান মার্কিন আইনসভা ও বিচার বিভাগই। চিরাচরিত পুঁজির কারবারিরাও এখন এই নয়া দুনিয়ায় নিজের জায়গাটি করে নিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। করবেন না কেন? ২০২১ সালে অনলাইনে পণ্য বিক্রি হয়েছে কত জানেন? ৪ লাখ ২০০ কোটি ডলারের। আরেকটু হলেই তা জার্মান অর্থনীতিকে (সাড়ে ৪ লাখ কোটি ডলার) ছাড়িয়ে যেত।
মজার বিষয় হলো, এই এত এত একচেটিয়া গল্পের পরও, এত কিছু সামনে থাকার পরও, ইন্টারনেট বস্তুটি কিন্তু সামনে সটান এগিয়ে যাচ্ছে এক ‘নিরপেক্ষতার’ মুখোশ পরে। এর পেছনে এর ভেতরে থাকা সম্ভাবনার শক্তি যেমন আছে, তেমনি আছে কেন্দ্রে থাকা গুটিকয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতাও। সম্ভাবনাটি হচ্ছে, মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর, প্রযুক্তির মালিকানা বুঝে নেওয়ার। আর পৃষ্ঠপোষকতা? সেটা স্বয়ং রাষ্ট্রের এবং পুঁজির তো বটেই। রাষ্ট্র এটি একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, আবার অক্ষতও রাখতে চায়।
একটু বুঝে নেওয়া যাক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসার পর সত্যিকারের দুনিয়ায় মানুষ বিস্তর বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এখন কারও বাড়িতে না গিয়েও ঈদের শুভেচ্ছা জানানো যাচ্ছে, চাইলে অনলাইন সালাম ও সালামি আদান-প্রদানও চলছে হরদম। এ জন্য কারও সংস্পর্শে আসার প্রয়োজনই পড়ছে না। ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতে ফিরতে অনায়াসে মোবাইল স্ক্রিনে একটি লাভ ইমো, লাইক, স্যাড ইত্যাদি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে নিজের উপস্থিতি। শুভেচ্ছাবার্তা লিখতে আলসেমি লাগলেও সমস্যা নেই, অজস্র ডিজিটাল কার্ড তৈরি আছে; খুঁজতেও হবে না। সাজেশনে আসবে, বেছে নিয়ে একটা দিলেই হলো। যাকে পাঠানো হলো, তার মানসিক পরিস্থিতি যেমন বিবেচ্য নয়, তেমনি যে পাঠাচ্ছে তারও মানসিক অবস্থা এখানে একেবারে ঊহ্য। তাহলে সয়াবিন তেল বা অন্য যেকোনো ইস্যুতে জনদুর্ভোগের বেলায় কী ঘটছে? এ সম্পর্কিত খবরের তলায় একটি অ্যাংরি ইমো বা বেশি খেপে গেলে একটা স্ট্যাটাস, একটা প্রোফাইল পিকচার বা এমন যেকোনো কিছু দিলেই দায়িত্ব চুকে গেল। এতে তেলের দাম না কমলেও, ওয়াসার পানি পরিষ্কার না হলেও, সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ না হলেও এমনকি কিছুই না হলেও কাজটি কিন্তু হয়ে গেল। এবার পাশ ফিরে আরামে ঘুমানো যেতেই পারে। এমন মোক্ষম একটি প্রতিরক্ষা বর্মকে তবে রাষ্ট্র কেন হাতছাড়া করবে? মাঝেমধ্যে একটু বকে দিলেও একে রক্ষায়, একে বেড়ে উঠতে দিতে রাষ্ট্র বরং সব রকম চেষ্টা করবে। এ কারণেই মার্কিন সিনেট থেকে শুনানি শেষে মার্ক জাকারবার্গ হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসতে পারেন। তিনি জানেন, বিশ্বের সব সিনেটই তাঁকে পাশে চায়।
প্রযুক্তি মোগলদের সুরক্ষায় অন্য পুঁজিপতিরাও সদা তৎপর। তারা তাদের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ধসিয়ে না দিয়ে নিজেরাই একেকটি সাম্রাজ্য গড়ায় বরং মন দিচ্ছে। কারণ, এটাই পুঁজির ধর্ম। দুর্বলের সবল হয়ে ওঠায় সবলদের বিশ্বাস ও আন্তরিকতা থাকবে কেন? থাকার কথা নয়, নেইও। ফলে ইন্টারনেট ক্যাপিটালিজম ভাঙা নয়, বরং একে আরও দৃঢ় করতেই তারা বেশি নিবিষ্ট। উভয়েরই প্রয়োজন এক বিপুল ভোক্তা শ্রেণি। প্রচলিত পুঁজিপতিরা তাই নিজেদের পছন্দমতো একেকটি ভার্চুয়াল মিত্র খুঁজে নিয়েছে ও নিচ্ছে। যার সঙ্গে যার মিল হয় আরকি! ফলে নিজ নিজ ক্ষেত্রে তো বটেই একাধিক খাত মিলিয়ে একচেটিয়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে গুগল, ফেসবুক বা মেটা, অ্যাপল, আমাজন, ইউটিউব, এয়ারবিএনবি, পেপাল, নেটফ্লিক্স, আলিবাবার মতো প্রতিষ্ঠান। এমনকি জুড়ি খুঁজে দেওয়ার মতো বিষয়েও তৈরি হচ্ছে নানা ম্যাচমেকার প্ল্যাটফর্ম, যাদের কিছু কিছু এরই মধ্যে নিজেদের ভিত শক্ত করে একচেটিয়া বাণিজ্যের দিকেই এগোচ্ছে।
এহেন একচেটিয়া ইন্টারনেট বা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বসে তাই যতই সমাজ বদল বা স্বাধীনতার গল্প ও তর্ক হোক না কেন, তা দিন শেষে পণ্য হিসেবেই বিক্রি করছে সাম্রাজ্যপতিরা। ব্যক্তি ও তার তাবৎ অনুভূতি ও ক্রিয়া আজ ভোক্তা ও পণ্যে পুনঃ পুনঃ রূপায়ণের চক্রে আবদ্ধ, যেন নিজের লেজকেই গিলে খাওয়া সেই সাপ সে। পুরাণ নয়, এ আজকের দিনের নিদারুণ বাস্তবতা।
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত পড়ুন:

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
৪ দিন আগে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৭ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৮ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
১১ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।
ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।
ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।
ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।
এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।
‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।
সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।
ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।
ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।
ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।
এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।
‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।
সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

১৯৯০-এর দশকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ) যুগে বিশ্ব প্রবেশের পর এর শুধু বিস্তার দেখছে মানুষ। আজকের দিনে এই থ্রি-ডব্লিউ ছাড়া একটি দিন কাটানো আপাত-সুবিধাপ্রাপ্ত জনতার জন্য ভাবনার অতীত। কিন্তু এই যুগে প্রবেশের সময় যে আশা বা আদর্শের কথা প্রচার করা হয়েছিল, তা কি এখন বাস্তব?
০৯ মে ২০২২
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৭ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৮ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
১১ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।
গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।
মিলার কী বলেছেন
গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’
মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।
মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।
অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে
২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।
১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।
পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।
কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে
না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।
১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।
২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।
শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।
আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।
গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।
মিলার কী বলেছেন
গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’
মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।
মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।
অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে
২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।
১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।
পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।
কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে
না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।
১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।
২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।
শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।
আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

১৯৯০-এর দশকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ) যুগে বিশ্ব প্রবেশের পর এর শুধু বিস্তার দেখছে মানুষ। আজকের দিনে এই থ্রি-ডব্লিউ ছাড়া একটি দিন কাটানো আপাত-সুবিধাপ্রাপ্ত জনতার জন্য ভাবনার অতীত। কিন্তু এই যুগে প্রবেশের সময় যে আশা বা আদর্শের কথা প্রচার করা হয়েছিল, তা কি এখন বাস্তব?
০৯ মে ২০২২
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
৪ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৮ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
১১ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।
ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।
শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।
ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’
ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।
‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।
ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।
এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।
তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।
যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।
বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।
ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।
শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।
ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’
ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।
‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।
ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।
এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।
তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।
যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।
বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

১৯৯০-এর দশকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ) যুগে বিশ্ব প্রবেশের পর এর শুধু বিস্তার দেখছে মানুষ। আজকের দিনে এই থ্রি-ডব্লিউ ছাড়া একটি দিন কাটানো আপাত-সুবিধাপ্রাপ্ত জনতার জন্য ভাবনার অতীত। কিন্তু এই যুগে প্রবেশের সময় যে আশা বা আদর্শের কথা প্রচার করা হয়েছিল, তা কি এখন বাস্তব?
০৯ মে ২০২২
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
৪ দিন আগে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৭ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
১১ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’
ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।
কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’
কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’
কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’
তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো
পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।
মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’
এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।
ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।
অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।
কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’
ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’
শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’
ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।
কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’
কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’
কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’
তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো
পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।
মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’
এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।
ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।
অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।
কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’
ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’
শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

১৯৯০-এর দশকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের (ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ) যুগে বিশ্ব প্রবেশের পর এর শুধু বিস্তার দেখছে মানুষ। আজকের দিনে এই থ্রি-ডব্লিউ ছাড়া একটি দিন কাটানো আপাত-সুবিধাপ্রাপ্ত জনতার জন্য ভাবনার অতীত। কিন্তু এই যুগে প্রবেশের সময় যে আশা বা আদর্শের কথা প্রচার করা হয়েছিল, তা কি এখন বাস্তব?
০৯ মে ২০২২
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
৪ দিন আগে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৭ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৮ দিন আগে