আব্দুর রহমান

দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে সম্পদশালী এলাকা জোহানেসবার্গে শুরু হয়েছে বিশ্বের উদীয়মান শীর্ষ পাঁচ অর্থনীতির—ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা—জোট ব্রিকসের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলন। কোভিড মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ব অর্থনীতি নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বলয়ের সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার নানামাত্রিক দ্বন্দ্ব ভূরাজনীতিকেও নতুন মোড়ে টেনে এসেছে। এমন সময়ে এবারের ব্রিকস সম্মেলনকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্য মোকাবিলায় এবং বৈশ্বিক নানা বিষয়ে জোরালো অবস্থান তৈরির মাধ্যমে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এই জোট। এবারের সম্মেলন দেশগুলোর জন্য গর্বের ও মুক্তির এবং একই সঙ্গে অস্বস্তিরও।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সম্মেলনে সশরীরে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া—এই মুহূর্তে জোটের জন্য সবচেয়ে স্বস্তির। এতে আয়োজক দক্ষিণ আফ্রিকা অনেকটাই নির্ভার। কারণ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পুতিন সম্মেলনে এলে নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ বিপদেই পড়ত। সদস্য দেশ হিসেবে আদালতের নির্দেশনা মেনে সহযোগিতা করতে হতো দেশটিকে।
যেসব বিষয়কে সামনে রেখে ব্রিকস সম্মেলন শুরু হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট কাটিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বৈরথের প্রভাব মোকাবিলা করে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা উল্লেখযোগ্য। আর এখানেই প্রশ্ন আসে, তাহলে কি ব্রিকস পশ্চিমা বিশ্ববিরোধী অবস্থান নিতে যাচ্ছে? কিংবা তারা নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়তে যাচ্ছে—নিদেনপক্ষে এমন কোনো চেষ্টা করছে কি?
চলতি বছরের মাঝামাঝি কেপটাউনে অনুষ্ঠিত ব্রিকস জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে রাশিয়ার সাংবাদিকেরা বিবিসির সাংবাদিক অ্যান্ড্রু হার্ডিংকে বলেছিলেন, ‘তোমরা তোমাদের পশ্চিমা দুনিয়ায় মানবাধিকারের স্বর্গ সাজাতে থাকো। আমরা দুনিয়াকে নতুন করে গড়তে যাচ্ছি।’
কিন্তু চাইলেই কি ব্রিকস দুনিয়াকে নতুন করে গড়তে পারবে? এর জন্য ব্রিকসের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলির বোঝাপড়া জরুরি। ২০০১ সালের দিকে বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাস প্রথম চারটি দেশের অর্থনীতির সম্ভাব্য অগ্রগতি বোঝাতে ব্রিক-বিআরআইসি (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন) ধারণা নিয়ে আসে। চীনের উদ্যোগে এর সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকাকে যুক্ত করে যাত্রা শুরু করে ব্রিকস। প্রথম সম্মেলন হয় ২০০৯ সালে।
যাত্রা শুরুর পর অনেক বিশ্লেষক ধারণা করেন, ব্রিকস শিগগিরই শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭-এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করবে। তবে অভ্যন্তরীণ কোন্দল শুরুতে কিছুটা সংশয় তৈরি করে। কিন্তু বাস্তবে বিশ্লেষকদের ধারণাকে জোরালো করে জোট বিকশিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২২ আগস্ট জোটের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলন হচ্ছে।
এই সম্মেলনে উল্লিখিত দুটি বিষয় ছাড়াও অন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব পাবে, তাহলো জোটের বিস্তার। এই বিষয়ে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট—চীন ও রাশিয়া জোটের সম্প্রসারণ চায়। কিন্তু ভারত ও ব্রাজিলের অবস্থান এর বিপরীত। ‘বৃহত্তর ব্রিকস’-এর অর্থ পশ্চিমা বিশ্বের জন্য বড় হুমকি আসন্ন। কিন্তু সেটা সামরিক হুমকি না হওয়া এখনই পশ্চিমের অতটা ভীত হওয়ার কিছু নেই।
পশ্চিমা বিশ্বের ভীত না হওয়ার কারণ জোটের গঠনের মধ্যেই নিহিত। কারণ, জোটের দেশগুলো আদর্শিক বা শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর দিক থেকে এক রকম নয়। যেমন—ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চললেও চীন-রাশিয়ায় তা নেই। শুধু তা-ই নয়, এ দুই দেশ পশ্চিমা গণতন্ত্র ও উদারনৈতিকতার বড় সমালোচকও। ভারত, চীন ও রাশিয়া পারমাণবিক শক্তিধর হলেও ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা তা নয়। আবার ব্রাজিল ও রাশিয়ার পণ্যের অন্যতম বড় গন্তব্যস্থল চীন হলেও এর বিপরীত হার খুবই সামান্য। অর্থাৎ তাদের মধ্যে বড় বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু জোটের বাকি সদস্য দেশগুলোর মোট অর্থনীতির আকার চীনের চেয়ে অনেক ছোট। এ ছাড়া ভারত ও চীনের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এ ছাড়া জোটের এখনো কোনো নির্দিষ্ট সনদ, গঠনতন্ত্র বা সদস্য গ্রহণের নির্ধারিত কোনো শর্তাবলি নেই।
ফলে জোটের টিকে থাকার বিষয়টি এখনো একটি মৌলিক প্রশ্ন। তবে জোটের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যেমন মতপার্থক্য রয়েছে, তেমনি আবার জোটকে টিকিয়ে রাখার জন্য একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও রয়েছে। এর একটি হলো পশ্চিমা বিশ্বের সমালোচনা। বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে ‘গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণের’ দেশগুলোকে (পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলো) একপাশে সরিয়ে রেখেছে সে বিষয়ে মুখর ব্রিকসের দেশগুলো। পাশাপাশি দেশগুলো চেষ্টা করছে গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠার। এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্করের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তি এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। যার ফলে অধিকাংশ দেশকেই অল্প কয়েকটি দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে।
জোটের টিকে থাকার আরেকটি কারণ হলো—নিজের সম্মান রক্ষা করা। বিশেষ করে যেসব দেশ বিশ্বসম্প্রদায়ে টিকে থাকতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। যেমন ২০১৩ সালের পর থেকে ব্রাজিল, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সামষ্টিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ১ শতাংশেরও কম। বিপরীতে ভারত ও চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশেরও বেশি। ফলে নিজেদের সম্মান রক্ষায় কিছু দেশের জন্য জোটে থাকাটা অনেকটা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের জন্য ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ব্রিকস সম্মেলনকে বড় করে দেখানোটা বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। টানা কয়েক দশক ক্ষমতায় থাকার পর এই প্রথম দলটির ক্ষমতার ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে।
এর বাইরে জোটটি পতিতদের আশ্রয়স্থলে হিসেবে একটি ভালো জায়গা। যেমন ব্রাজিলে যখন জাইর বলসোনারে ক্ষমতায় ছিলেন তখন তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর মিত্র ছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়ার পর যুক্তরাষ্ট্র বলসোনারোর ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। পরে বলসোনারো ব্রিকসকে নিজের আশ্রয় হিসেবে খুঁজে নেন। একইভাবে ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়া যখন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত, তখন দেশটির জন্য সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হলো ব্রিকস। ব্রিকসের সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে ব্রিকসে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে দ্য ইকোনমিস্টের তরফ থেকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, জোটের উদ্দেশ্য কী? জবাবে রুশ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আরও বন্ধু বাড়ানো।’
রাশিয়ার মতো চীনেরও অবস্থান একই। বেইজিংও চায় জোট সম্প্রসারিত হোক। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এবং এর পশ্চিমা মিত্ররা যেভাবে চীনের সঙ্গে আচরণ করছে তাতে ব্রিকসের মাধ্যমে নতুন ‘বন্ধু’ বাড়ানোর প্রচেষ্টা অমূলক নয়। কারণ, চীনের দৃষ্টি থেকে বিবেচনা করলে পশ্চিমা বিশ্বের বিপরীতে একটি পাল্টা জোট হয়ে ওঠার যতটা সম্ভাবনা রয়েছে অন্য জোট—সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা, জি-২০-এর সে রকম সম্ভাবনা নেই। কারণ, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা অনেকটাই ইউরেশিয়া চরিত্রের এবং জি-২০ জোটেও পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর প্রাধান্য। তাই পশ্চিমা বিশ্বের ‘ক্ষুদ্র বৃত্তের’ বিপরীতে ব্রিকসকে একটি ‘বড় পরিবারে’ পরিণত করতেই আগ্রহ বেশি।
চীন যে এই প্রথম সদস্য বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে তা কিন্তু নয়। এর আগে, বেইজিংই দক্ষিণ আফ্রিকাকে জোটের নেওয়ার উকালতি করেছিল। এখন ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় বেইজিং আবারও জোটে সদস্য বাড়ানোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। যদিও জোটে সদস্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবারই ঐকমত্য জরুরি তারপরও চীনের প্রভাব উপেক্ষা করা অনেকটাই কঠিন। কারণ ব্রিকসের মোট উৎপাদনের প্রায় ৭০ শতাংশ একাই করে থাকে চীন। যার বড় ভোক্তা আবার বাকি চার দেশ।
জোটটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোন দেশগুলো সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেছে তার তালিকা প্রকাশ করেনি। তবে দ্য ইকোনমিস্ট বিভিন্ন শর্ত মিলিয়ে হিসেবে করে দেখেছে যে ১৮টি দেশ সম্ভবত ব্রিকসের সদস্য হতে চায়। এই তালিকায় বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশ রয়েছে। এসব দেশের মধ্যে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত উল্লেখযোগ্য। ব্রিকসে জোট দেওয়ার মাধ্যমে দেশ দুটি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার পাশাপাশি তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক নতুন করে ঝালিয়ে নিতে চায়।
বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়ার মতো জনবহুল এবং এত দিন জোট নিরপেক্ষ বলে পরিচিত দেশও জোটের সদস্য হতে চায়। তাদের উদ্দেশ্য হলো পশ্চিমা মানদণ্ডের মানবাধিকারের যে সমালোচনা তা থেকে আশ্রয় খুঁজে পাওয়া। এর বাইরে আর্জেন্টিনা, ইথিওপিয়া, মেক্সিকো ও নাইজেরিয়ার মতো জনবহুল দেশগুলোও জোটের সদস্য হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। শেষ পর্যন্ত যদি এই ১৮টি দেশই জোটের সদস্য হয়ে যায়, তবে হয়তো জোটটি নতুন নাম নেবে। এ ছাড়া জোটটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল জোটে পরিণত হবে এবং জোটের মোট জিডিপির পরিমাণ হবে বিশ্বের মোট জিডিপির ৩৪ শতাংশ।
জোটকে কার্যকরী করতে ব্রিকস দেশগুলো শিক্ষা, গবেষণা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রী, থিংক ট্যাংক এমনকি ক্ষমতাসীন দলগুলোর প্রতিনিধি পর্যায়ের সম্মেলনও আয়োজন করছে নিয়মিত। কিছুদিন আগেই দক্ষিণ আফ্রিকায় হয়ে গেল ব্রিকস ইয়ুথ সামিট। রাশিয়া এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে তাঁরা আগামী বছর প্যারিস অলিম্পিকের আগেই ব্রিকস গেমসের আয়োজন করবে। এই যে আন্তদেশীয় সফট টুলসের ব্যবহার এগুলো জোটের স্থায়ীত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এ বিষয়ে ব্রাজিলীয় থিংক ট্যাংক গুতলিও ভার্গাস ফাউন্ডেশনের ফেলো অলিভার স্টুয়েঙ্কেল বলেন, ‘এসব বৈঠক চরিত্রগত দিক থেকে খুব নিরামিষ হলেও এগুলো কূটনীতিবিদদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়।’
জোটের টিকে থাকার ক্ষেত্রে আরও বড় একটি রক্ষাকবচ হলো দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যেগুলো রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, মিনি বিশ্বব্যাংক এবং মিনি আইএমএফ। সদস্য দেশগুলোকে সহজশর্তে ঋণ দেওয়ার জন্য গঠিত হয়েছে কন্টিনজেন্ট রিজার্ভ অ্যারাঞ্জমেন্ট বা সিআরএ—যা মিনি আইএমএফ নামে পরিচিত। সহজশর্তে উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার জন্য গঠিত হয়েছে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এনডিবি। ২০১৫ সালে গঠনের পর থেকে মিনি বিশ্বব্যাংক বা এনডিবি ৩৩ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংকের তুলনায় ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এনডিবি এখনো অনেক পিছিয়ে। এ ছাড়া এনডিবির কার্যক্রমের স্বচ্ছতা এবং অন্যান্য বিষয়ে দক্ষতা এখনো বিশ্ব ব্যাংকের তুলনায় কম। বিষয়টি আমলে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড্যানিয়েল ব্র্যাডলো বলেন, বিশ্বব্যাংক এনডিবির তুলনায় এখনো অনেক বেশি স্বচ্ছ এবং দায়বদ্ধ।
অনেক সীমাবদ্ধতার পরও টিকে থাকার চেষ্টায় ব্রিকস অনেকটাই সফল। তবে জোটটির ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে, তা অনেকগুলো শর্তের ওপর নির্ভর করে। বিশেষ করে ভারত-চীন সম্পর্ক, ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক, ভারত ও ব্রাজিলের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক ইত্যাদি সমীকরণ মেলানোর পর বোঝা যাবে আসলে জোটের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দুর্বলতা থাকলেও তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিশেষ করে জোট সম্প্রসারণ এবং নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ার বিষয়ে। এ বিষয়ে জোটের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি পরিষ্কার না হলেও এ বিষয়ে যে নজর রয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, তিনটি মহাদেশের কোটি কোটি মানুষের প্রতিনিধি করা ব্রিকসের দেশগুলোর একটি বিষয়ে মিল রয়েছে, আর তা হলো, ধনী পশ্চিমাশক্তির হয়ে কাজ করা বিশ্বব্যবস্থার প্রতি অনীহা।
এ বিষয়ে এশিয়া ও ব্রিকসবিষয়ক দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ অনিল সুকলাল গত শুক্রবার এএফপিকে বলেন, এই জোটে যোগ দেওয়ার জন্য আগ্রহ বাড়ছে কোনো কোনো দেশের। এর অন্যতম কারণ, মেরুকৃত বিশ্বের আরও মেরুকরণ হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে। তাই দেশগুলোকে বাধ্য হয়ে কোনো পক্ষে যেতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘দক্ষিণের দেশগুলো কাকে সমর্থন করবে, কীভাবে আচরণ করবে এবং কীভাবে তাদের সার্বভৌম বিষয়গুলো পরিচালনা করবে, তা বলতে চায় না। তারা এখন তাদের নিজ নিজ অবস্থান জাহির করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী।’ ফলে ‘বিশ্বকাঠামো’ পুনর্গঠন করতে চাওয়া দেশগুলোর জন্য ব্রিকস আশা জাগিয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে।
লিম্পোপো বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাষক লেবোগং লেগোডি এই বিষয়ে একমত যে বর্তমান বিশ্বে কর্তৃত্বের বিকল্প হিসেবে অনেক দেশই এখন ব্রিকসে যোগদানে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিন্তু ব্রিকসের প্রতি নজর রাখা বিশ্লেষকেরা এই সম্মেলনের ফলাফল নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী নন। কেননা, বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ক্ষমতা এখনো পশ্চিমা দেশগুলোর হাতেই রয়েছে এবং চীন এখনো প্রভাবশালী শক্তি হয়ে ওঠেনি।
সব মিলিয়ে জোহানেসবার্গে চলমান ব্রিকস সম্মেলন জোটকে নতুন করে ‘সংজ্ঞায়িত’ করার মুহূর্ত। কারণ, জোটের সম্প্রসারণ একই সঙ্গে এতে চীনের প্রভাবকে বৃদ্ধি করবে এবং একই সঙ্গে জোটের পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব বাড়বে, যা রাশিয়াকেও প্রকারান্তে সুবিধা দেবে। এতে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়া নিয়ে যে আলোচনা চলমান তার পালে হাওয়া লাগবে।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, এএফপি, দ্য ইকোনমিস্ট এবং বিবিসি

দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে সম্পদশালী এলাকা জোহানেসবার্গে শুরু হয়েছে বিশ্বের উদীয়মান শীর্ষ পাঁচ অর্থনীতির—ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা—জোট ব্রিকসের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলন। কোভিড মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ব অর্থনীতি নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বলয়ের সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার নানামাত্রিক দ্বন্দ্ব ভূরাজনীতিকেও নতুন মোড়ে টেনে এসেছে। এমন সময়ে এবারের ব্রিকস সম্মেলনকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্য মোকাবিলায় এবং বৈশ্বিক নানা বিষয়ে জোরালো অবস্থান তৈরির মাধ্যমে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এই জোট। এবারের সম্মেলন দেশগুলোর জন্য গর্বের ও মুক্তির এবং একই সঙ্গে অস্বস্তিরও।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সম্মেলনে সশরীরে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া—এই মুহূর্তে জোটের জন্য সবচেয়ে স্বস্তির। এতে আয়োজক দক্ষিণ আফ্রিকা অনেকটাই নির্ভার। কারণ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পুতিন সম্মেলনে এলে নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ বিপদেই পড়ত। সদস্য দেশ হিসেবে আদালতের নির্দেশনা মেনে সহযোগিতা করতে হতো দেশটিকে।
যেসব বিষয়কে সামনে রেখে ব্রিকস সম্মেলন শুরু হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট কাটিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বৈরথের প্রভাব মোকাবিলা করে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা উল্লেখযোগ্য। আর এখানেই প্রশ্ন আসে, তাহলে কি ব্রিকস পশ্চিমা বিশ্ববিরোধী অবস্থান নিতে যাচ্ছে? কিংবা তারা নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়তে যাচ্ছে—নিদেনপক্ষে এমন কোনো চেষ্টা করছে কি?
চলতি বছরের মাঝামাঝি কেপটাউনে অনুষ্ঠিত ব্রিকস জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে রাশিয়ার সাংবাদিকেরা বিবিসির সাংবাদিক অ্যান্ড্রু হার্ডিংকে বলেছিলেন, ‘তোমরা তোমাদের পশ্চিমা দুনিয়ায় মানবাধিকারের স্বর্গ সাজাতে থাকো। আমরা দুনিয়াকে নতুন করে গড়তে যাচ্ছি।’
কিন্তু চাইলেই কি ব্রিকস দুনিয়াকে নতুন করে গড়তে পারবে? এর জন্য ব্রিকসের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলির বোঝাপড়া জরুরি। ২০০১ সালের দিকে বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাস প্রথম চারটি দেশের অর্থনীতির সম্ভাব্য অগ্রগতি বোঝাতে ব্রিক-বিআরআইসি (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন) ধারণা নিয়ে আসে। চীনের উদ্যোগে এর সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকাকে যুক্ত করে যাত্রা শুরু করে ব্রিকস। প্রথম সম্মেলন হয় ২০০৯ সালে।
যাত্রা শুরুর পর অনেক বিশ্লেষক ধারণা করেন, ব্রিকস শিগগিরই শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭-এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করবে। তবে অভ্যন্তরীণ কোন্দল শুরুতে কিছুটা সংশয় তৈরি করে। কিন্তু বাস্তবে বিশ্লেষকদের ধারণাকে জোরালো করে জোট বিকশিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২২ আগস্ট জোটের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলন হচ্ছে।
এই সম্মেলনে উল্লিখিত দুটি বিষয় ছাড়াও অন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব পাবে, তাহলো জোটের বিস্তার। এই বিষয়ে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট—চীন ও রাশিয়া জোটের সম্প্রসারণ চায়। কিন্তু ভারত ও ব্রাজিলের অবস্থান এর বিপরীত। ‘বৃহত্তর ব্রিকস’-এর অর্থ পশ্চিমা বিশ্বের জন্য বড় হুমকি আসন্ন। কিন্তু সেটা সামরিক হুমকি না হওয়া এখনই পশ্চিমের অতটা ভীত হওয়ার কিছু নেই।
পশ্চিমা বিশ্বের ভীত না হওয়ার কারণ জোটের গঠনের মধ্যেই নিহিত। কারণ, জোটের দেশগুলো আদর্শিক বা শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর দিক থেকে এক রকম নয়। যেমন—ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চললেও চীন-রাশিয়ায় তা নেই। শুধু তা-ই নয়, এ দুই দেশ পশ্চিমা গণতন্ত্র ও উদারনৈতিকতার বড় সমালোচকও। ভারত, চীন ও রাশিয়া পারমাণবিক শক্তিধর হলেও ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা তা নয়। আবার ব্রাজিল ও রাশিয়ার পণ্যের অন্যতম বড় গন্তব্যস্থল চীন হলেও এর বিপরীত হার খুবই সামান্য। অর্থাৎ তাদের মধ্যে বড় বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু জোটের বাকি সদস্য দেশগুলোর মোট অর্থনীতির আকার চীনের চেয়ে অনেক ছোট। এ ছাড়া ভারত ও চীনের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এ ছাড়া জোটের এখনো কোনো নির্দিষ্ট সনদ, গঠনতন্ত্র বা সদস্য গ্রহণের নির্ধারিত কোনো শর্তাবলি নেই।
ফলে জোটের টিকে থাকার বিষয়টি এখনো একটি মৌলিক প্রশ্ন। তবে জোটের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যেমন মতপার্থক্য রয়েছে, তেমনি আবার জোটকে টিকিয়ে রাখার জন্য একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও রয়েছে। এর একটি হলো পশ্চিমা বিশ্বের সমালোচনা। বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে ‘গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণের’ দেশগুলোকে (পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলো) একপাশে সরিয়ে রেখেছে সে বিষয়ে মুখর ব্রিকসের দেশগুলো। পাশাপাশি দেশগুলো চেষ্টা করছে গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠার। এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্করের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তি এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। যার ফলে অধিকাংশ দেশকেই অল্প কয়েকটি দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে।
জোটের টিকে থাকার আরেকটি কারণ হলো—নিজের সম্মান রক্ষা করা। বিশেষ করে যেসব দেশ বিশ্বসম্প্রদায়ে টিকে থাকতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। যেমন ২০১৩ সালের পর থেকে ব্রাজিল, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সামষ্টিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ১ শতাংশেরও কম। বিপরীতে ভারত ও চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশেরও বেশি। ফলে নিজেদের সম্মান রক্ষায় কিছু দেশের জন্য জোটে থাকাটা অনেকটা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের জন্য ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ব্রিকস সম্মেলনকে বড় করে দেখানোটা বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। টানা কয়েক দশক ক্ষমতায় থাকার পর এই প্রথম দলটির ক্ষমতার ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে।
এর বাইরে জোটটি পতিতদের আশ্রয়স্থলে হিসেবে একটি ভালো জায়গা। যেমন ব্রাজিলে যখন জাইর বলসোনারে ক্ষমতায় ছিলেন তখন তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর মিত্র ছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়ার পর যুক্তরাষ্ট্র বলসোনারোর ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। পরে বলসোনারো ব্রিকসকে নিজের আশ্রয় হিসেবে খুঁজে নেন। একইভাবে ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়া যখন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত, তখন দেশটির জন্য সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হলো ব্রিকস। ব্রিকসের সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে ব্রিকসে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে দ্য ইকোনমিস্টের তরফ থেকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, জোটের উদ্দেশ্য কী? জবাবে রুশ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আরও বন্ধু বাড়ানো।’
রাশিয়ার মতো চীনেরও অবস্থান একই। বেইজিংও চায় জোট সম্প্রসারিত হোক। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এবং এর পশ্চিমা মিত্ররা যেভাবে চীনের সঙ্গে আচরণ করছে তাতে ব্রিকসের মাধ্যমে নতুন ‘বন্ধু’ বাড়ানোর প্রচেষ্টা অমূলক নয়। কারণ, চীনের দৃষ্টি থেকে বিবেচনা করলে পশ্চিমা বিশ্বের বিপরীতে একটি পাল্টা জোট হয়ে ওঠার যতটা সম্ভাবনা রয়েছে অন্য জোট—সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা, জি-২০-এর সে রকম সম্ভাবনা নেই। কারণ, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা অনেকটাই ইউরেশিয়া চরিত্রের এবং জি-২০ জোটেও পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর প্রাধান্য। তাই পশ্চিমা বিশ্বের ‘ক্ষুদ্র বৃত্তের’ বিপরীতে ব্রিকসকে একটি ‘বড় পরিবারে’ পরিণত করতেই আগ্রহ বেশি।
চীন যে এই প্রথম সদস্য বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে তা কিন্তু নয়। এর আগে, বেইজিংই দক্ষিণ আফ্রিকাকে জোটের নেওয়ার উকালতি করেছিল। এখন ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় বেইজিং আবারও জোটে সদস্য বাড়ানোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। যদিও জোটে সদস্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবারই ঐকমত্য জরুরি তারপরও চীনের প্রভাব উপেক্ষা করা অনেকটাই কঠিন। কারণ ব্রিকসের মোট উৎপাদনের প্রায় ৭০ শতাংশ একাই করে থাকে চীন। যার বড় ভোক্তা আবার বাকি চার দেশ।
জোটটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোন দেশগুলো সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেছে তার তালিকা প্রকাশ করেনি। তবে দ্য ইকোনমিস্ট বিভিন্ন শর্ত মিলিয়ে হিসেবে করে দেখেছে যে ১৮টি দেশ সম্ভবত ব্রিকসের সদস্য হতে চায়। এই তালিকায় বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশ রয়েছে। এসব দেশের মধ্যে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত উল্লেখযোগ্য। ব্রিকসে জোট দেওয়ার মাধ্যমে দেশ দুটি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার পাশাপাশি তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক নতুন করে ঝালিয়ে নিতে চায়।
বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়ার মতো জনবহুল এবং এত দিন জোট নিরপেক্ষ বলে পরিচিত দেশও জোটের সদস্য হতে চায়। তাদের উদ্দেশ্য হলো পশ্চিমা মানদণ্ডের মানবাধিকারের যে সমালোচনা তা থেকে আশ্রয় খুঁজে পাওয়া। এর বাইরে আর্জেন্টিনা, ইথিওপিয়া, মেক্সিকো ও নাইজেরিয়ার মতো জনবহুল দেশগুলোও জোটের সদস্য হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। শেষ পর্যন্ত যদি এই ১৮টি দেশই জোটের সদস্য হয়ে যায়, তবে হয়তো জোটটি নতুন নাম নেবে। এ ছাড়া জোটটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল জোটে পরিণত হবে এবং জোটের মোট জিডিপির পরিমাণ হবে বিশ্বের মোট জিডিপির ৩৪ শতাংশ।
জোটকে কার্যকরী করতে ব্রিকস দেশগুলো শিক্ষা, গবেষণা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রী, থিংক ট্যাংক এমনকি ক্ষমতাসীন দলগুলোর প্রতিনিধি পর্যায়ের সম্মেলনও আয়োজন করছে নিয়মিত। কিছুদিন আগেই দক্ষিণ আফ্রিকায় হয়ে গেল ব্রিকস ইয়ুথ সামিট। রাশিয়া এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে তাঁরা আগামী বছর প্যারিস অলিম্পিকের আগেই ব্রিকস গেমসের আয়োজন করবে। এই যে আন্তদেশীয় সফট টুলসের ব্যবহার এগুলো জোটের স্থায়ীত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এ বিষয়ে ব্রাজিলীয় থিংক ট্যাংক গুতলিও ভার্গাস ফাউন্ডেশনের ফেলো অলিভার স্টুয়েঙ্কেল বলেন, ‘এসব বৈঠক চরিত্রগত দিক থেকে খুব নিরামিষ হলেও এগুলো কূটনীতিবিদদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়।’
জোটের টিকে থাকার ক্ষেত্রে আরও বড় একটি রক্ষাকবচ হলো দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যেগুলো রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, মিনি বিশ্বব্যাংক এবং মিনি আইএমএফ। সদস্য দেশগুলোকে সহজশর্তে ঋণ দেওয়ার জন্য গঠিত হয়েছে কন্টিনজেন্ট রিজার্ভ অ্যারাঞ্জমেন্ট বা সিআরএ—যা মিনি আইএমএফ নামে পরিচিত। সহজশর্তে উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার জন্য গঠিত হয়েছে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এনডিবি। ২০১৫ সালে গঠনের পর থেকে মিনি বিশ্বব্যাংক বা এনডিবি ৩৩ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংকের তুলনায় ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এনডিবি এখনো অনেক পিছিয়ে। এ ছাড়া এনডিবির কার্যক্রমের স্বচ্ছতা এবং অন্যান্য বিষয়ে দক্ষতা এখনো বিশ্ব ব্যাংকের তুলনায় কম। বিষয়টি আমলে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড্যানিয়েল ব্র্যাডলো বলেন, বিশ্বব্যাংক এনডিবির তুলনায় এখনো অনেক বেশি স্বচ্ছ এবং দায়বদ্ধ।
অনেক সীমাবদ্ধতার পরও টিকে থাকার চেষ্টায় ব্রিকস অনেকটাই সফল। তবে জোটটির ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে, তা অনেকগুলো শর্তের ওপর নির্ভর করে। বিশেষ করে ভারত-চীন সম্পর্ক, ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক, ভারত ও ব্রাজিলের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক ইত্যাদি সমীকরণ মেলানোর পর বোঝা যাবে আসলে জোটের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দুর্বলতা থাকলেও তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিশেষ করে জোট সম্প্রসারণ এবং নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ার বিষয়ে। এ বিষয়ে জোটের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি পরিষ্কার না হলেও এ বিষয়ে যে নজর রয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, তিনটি মহাদেশের কোটি কোটি মানুষের প্রতিনিধি করা ব্রিকসের দেশগুলোর একটি বিষয়ে মিল রয়েছে, আর তা হলো, ধনী পশ্চিমাশক্তির হয়ে কাজ করা বিশ্বব্যবস্থার প্রতি অনীহা।
এ বিষয়ে এশিয়া ও ব্রিকসবিষয়ক দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ অনিল সুকলাল গত শুক্রবার এএফপিকে বলেন, এই জোটে যোগ দেওয়ার জন্য আগ্রহ বাড়ছে কোনো কোনো দেশের। এর অন্যতম কারণ, মেরুকৃত বিশ্বের আরও মেরুকরণ হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে। তাই দেশগুলোকে বাধ্য হয়ে কোনো পক্ষে যেতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘দক্ষিণের দেশগুলো কাকে সমর্থন করবে, কীভাবে আচরণ করবে এবং কীভাবে তাদের সার্বভৌম বিষয়গুলো পরিচালনা করবে, তা বলতে চায় না। তারা এখন তাদের নিজ নিজ অবস্থান জাহির করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী।’ ফলে ‘বিশ্বকাঠামো’ পুনর্গঠন করতে চাওয়া দেশগুলোর জন্য ব্রিকস আশা জাগিয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে।
লিম্পোপো বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাষক লেবোগং লেগোডি এই বিষয়ে একমত যে বর্তমান বিশ্বে কর্তৃত্বের বিকল্প হিসেবে অনেক দেশই এখন ব্রিকসে যোগদানে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিন্তু ব্রিকসের প্রতি নজর রাখা বিশ্লেষকেরা এই সম্মেলনের ফলাফল নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী নন। কেননা, বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ক্ষমতা এখনো পশ্চিমা দেশগুলোর হাতেই রয়েছে এবং চীন এখনো প্রভাবশালী শক্তি হয়ে ওঠেনি।
সব মিলিয়ে জোহানেসবার্গে চলমান ব্রিকস সম্মেলন জোটকে নতুন করে ‘সংজ্ঞায়িত’ করার মুহূর্ত। কারণ, জোটের সম্প্রসারণ একই সঙ্গে এতে চীনের প্রভাবকে বৃদ্ধি করবে এবং একই সঙ্গে জোটের পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব বাড়বে, যা রাশিয়াকেও প্রকারান্তে সুবিধা দেবে। এতে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়া নিয়ে যে আলোচনা চলমান তার পালে হাওয়া লাগবে।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, এএফপি, দ্য ইকোনমিস্ট এবং বিবিসি

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।
ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।
ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।
ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।
এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।
‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।
সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।
ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।
ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।
ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।
এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।
‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।
সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

সব মিলিয়ে জোহানেসবার্গে চলমান ব্রিকস সম্মেলন জোটকে নতুন করে ‘সংজ্ঞায়িত’ করার মুহূর্ত। কারণ, জোটের সম্প্রসারণ একই সঙ্গে এতে চীনের প্রভাবকে বৃদ্ধি করবে এবং একই সঙ্গে জোটের পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব বাড়বে, যা রাশিয়াকেও প্রকারান্তে সুবিধা দেবে। এতে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়া নিয়ে যে আলোচনা চলমান, তার পালে হাওয়া
২৩ আগস্ট ২০২৩
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।
গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।
মিলার কী বলেছেন
গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’
মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।
মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।
অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে
২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।
১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।
পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।
কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে
না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।
১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।
২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।
শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।
আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।
গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।
মিলার কী বলেছেন
গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’
মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।
মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।
অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে
২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।
১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।
পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।
কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে
না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।
১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।
২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।
শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।
আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

সব মিলিয়ে জোহানেসবার্গে চলমান ব্রিকস সম্মেলন জোটকে নতুন করে ‘সংজ্ঞায়িত’ করার মুহূর্ত। কারণ, জোটের সম্প্রসারণ একই সঙ্গে এতে চীনের প্রভাবকে বৃদ্ধি করবে এবং একই সঙ্গে জোটের পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব বাড়বে, যা রাশিয়াকেও প্রকারান্তে সুবিধা দেবে। এতে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়া নিয়ে যে আলোচনা চলমান, তার পালে হাওয়া
২৩ আগস্ট ২০২৩
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।
ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।
শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।
ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’
ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।
‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।
ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।
এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।
তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।
যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।
বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।
ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।
শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।
ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’
ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।
‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।
ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।
এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।
তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।
যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।
বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

সব মিলিয়ে জোহানেসবার্গে চলমান ব্রিকস সম্মেলন জোটকে নতুন করে ‘সংজ্ঞায়িত’ করার মুহূর্ত। কারণ, জোটের সম্প্রসারণ একই সঙ্গে এতে চীনের প্রভাবকে বৃদ্ধি করবে এবং একই সঙ্গে জোটের পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব বাড়বে, যা রাশিয়াকেও প্রকারান্তে সুবিধা দেবে। এতে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়া নিয়ে যে আলোচনা চলমান, তার পালে হাওয়া
২৩ আগস্ট ২০২৩
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’
ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।
কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’
কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’
কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’
তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো
পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।
মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’
এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।
ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।
অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।
কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’
ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’
শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’
ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।
কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’
কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’
কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’
তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো
পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।
মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’
এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।
ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।
অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।
কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’
ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’
শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

সব মিলিয়ে জোহানেসবার্গে চলমান ব্রিকস সম্মেলন জোটকে নতুন করে ‘সংজ্ঞায়িত’ করার মুহূর্ত। কারণ, জোটের সম্প্রসারণ একই সঙ্গে এতে চীনের প্রভাবকে বৃদ্ধি করবে এবং একই সঙ্গে জোটের পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব বাড়বে, যা রাশিয়াকেও প্রকারান্তে সুবিধা দেবে। এতে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়া নিয়ে যে আলোচনা চলমান, তার পালে হাওয়া
২৩ আগস্ট ২০২৩
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে