Ajker Patrika

হাসিনার পতন ও অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে ভারতীয় কূটনীতিক পিনাক রঞ্জনের বিশ্লেষণ

আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০১: ১৮
হাসিনার পতন ও অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে ভারতীয় কূটনীতিক পিনাক রঞ্জনের বিশ্লেষণ

পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী, বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার। সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের কূটনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক শুভজিৎ রায়ের সঞ্চালনায় ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে দীর্ঘতম সময় ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার পতনের কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন পিনাক। 

লাইভ অনুষ্ঠানটি ধারণ করা হয় গত ৩০ আগস্ট। এরপর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান পর্যালোচনা, মূল্যায়ন ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ করার জন্য ৯ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করেছে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারত থেকে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ সম্পর্কে বিবৃতি দেওয়ায় অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন। অবশ্য ড. ইউনূস সম্প্রতি বলেছেন, শাসক পরিবর্তন হলেও ঢাকা–দিল্লি সম্পর্ক ‘খুব ঘনিষ্ঠ’ হওয়া উচিত। তবে এই সম্পর্কে উভয় দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকতে হবে। ৩০ আগস্টের ওই আলাপে পিনাক রঞ্জন যেসব বিষয় তুলে ধরেছিলেন তা সংক্ষেপে এমন— 

শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশের জন্য যা করেছে
শেখ হাসিনার সময় অবশ্যই বাংলাদেশ এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটিতে পরিণত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে স্থিতিশীল সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং আমরা জ্বালানি সংযোগ, রেলপথ এবং পরিবহন সংযোগের উন্নয়ন করেছি। দুটি অর্থনীতি ক্রমবর্ধমানভাবে উভয়ের সুবিধার জন্য একসঙ্গে চলছিল এবং বাণিজ্য প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার (কোভিডের আগের পরিসংখ্যান) বেড়েছে। বাংলাদেশিরা ভারতে বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশীদারে পরিণত হয়েছেন। 

নেতিবাচক দিক হলো, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অপর প্রধান দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচন বয়কট করেছে। এরপর জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক সংগঠন ও দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

শেখ হাসিনা জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকেও নিষিদ্ধ করেছেন। এ ছাড়া, তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানপন্থী জামায়াত নেতাদের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন। সেই নেতাদের দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল; যা অসন্তোষ তৈরি করে। এরপর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হন। এ ধরনের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি এই ধারণা প্রবল করে যে শেখ হাসিনা ক্রমশ স্বৈরাচারী হয়ে উঠছেন। সেসব কাজে ভারতের কোনো ভূমিকা ছিল না; এগুলো সম্পূর্ণরূপে অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল। 

হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক
পূর্ববর্তী বিএনপি–জামায়াত সরকারের সঙ্গে ভারতের সমস্যা ছিল নিরাপত্তা ইস্যু এবং পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) সঙ্গে তাদের মৈত্রী। বিএনপি বরাবরই একটু ডানপন্থী এবং পাকিস্তানপন্থী। জামায়াত, অবশ্যই, সব সময় পাকিস্তানপন্থী ছিল, যদিও তারা এখন দাবি করে যে তারা আলাদা। বিএনপিও দাবি করে, তারা বদলে গেছে। 

কিন্তু ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তিনি বলেছিলেন, তাঁরা বাংলাদেশের মাটি ভারতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে দেবেন না। এই সবকিছু প্রত্যাশিত কাজ তিনি করেছেন। ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শেখ হাসিনা নিশ্চিত করেছেন যে বিদ্রোহীদের শিবির উপড়ে ফেলা হয়েছে এবং (তাদের) হস্তান্তর করা হয়েছে। তাই সেই দিক থেকে হাসিনা আমাদের কাছে অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যিনি নিরাপত্তার বিষয়টিতে (ভারতের চাহিদা) পূরণ করেছেন। 

শেখ হাসিনা আরও বুঝতে পেরেছিলেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করা ভালো হবে। আমার মনে আছে, কীভাবে হাসিনা আমাকে প্রথম বলেছিলেন যে তাঁর ভারত থেকে বিদ্যুৎ দরকার। এভাবেই গ্রিড সংযোগের প্রকল্প শুরু হয়। আজ আমরা প্রায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সরবরাহ করি। আমরা ডিজেল এবং পেট্রোলিয়াম পণ্য সরবরাহ করার জন্য নুমালিগড় শোধনাগার থেকে উত্তর বাংলাদেশ পর্যন্ত পাইপলাইন স্থাপনের পরিকল্পনাও করেছি, যা নৌকা এবং অন্যান্য নদী দিয়ে চলাচলকারী কার্গোর জ্বালানি সরবরাহ করার মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতিকে সাহায্য করবে। এটি নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় নৌকা ও কার্গো সর্বত্রই যাতায়াত করতে পারে। 

অর্থনীতি নিয়ে অসন্তোষ, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে
আমি মনে করি, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু না হওয়া পর্যন্ত এবং জ্বালানি ও খাদ্যের দাম আকাশচুম্বী না হওয়া পর্যন্ত মানুষ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে স্বাগত জানিয়েছে। তদুপরি, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্ভবত ন্যায়সংগত ছিল না। সৃষ্ট কর্মসংস্থান ছিল অপর্যাপ্ত এবং একটি তরুণ প্রজন্ম অর্থনীতিতে প্রবেশ করছে। এ কারণে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। কারণ, এই কোটা সরকারি কর্মসংস্থানে প্রবেশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ ছাড়া, নির্বাচনের সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, নতুন ভোটাররা মনে করেন যে তাঁদের হাতে অপশন থাকছে না (পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ের অধিকার তাঁরা পাচ্ছেন না)। সেটাও ক্রমবর্ধমান অসন্তোষকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে কোটা পদ্ধতি চালু হয়। এরপর সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন—তাঁদের কিছু অগ্রাধিকার দেওয়ার। এরপর তাঁদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা নির্ধারণ করা হয়। বছরের পর বছর ধরে চলার পর সেই প্রজন্ম যখন অতীত হয়ে গেছে, তখন তাঁরা দাবি করলেন যে কোটা অব্যাহত রাখতে হবে এবং তাঁদের সন্তানদের ও পরে তাঁদের নাতি–নাতনিদের দিতে হবে।

এই মতবিরোধের সূত্রপাত তখনই হলো যখন দেখা গেল, সংখ্যালঘু, নারী ইত্যাদির জন্য কোটা রাখলে মোট কোটা প্রায় ৫৬ শতাংশে পৌঁছায়। ২০১২ সালে প্রথম কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ২০১৮ সালে শেখ হাসিনা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং বাতিল করার জন্য একটি সরকারি আদেশও জারি করেছিলেন। কিন্তু কোটার সুবিধাভোগীরা পরে সেই আদেশ চ্যালেঞ্জ করেন। এরপর হাইকোর্ট সেই আদেশ স্থগিত করেন এবং তখনই আবার আন্দোলন শুরু হয়। 

কোটাবিরোধী আন্দোলন কীভাবে বড় হয়েছে
আমার বিশ্বাস, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর আন্দোলন থেমে যেত। কারণ, আদালত কোটা মাত্র ৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছিলেন। ওই আন্দোলনে তিন শতাধিক মানুষ নিহত হয়। ৯ দফা দাবি নিয়ে ফিরেছে আন্দোলনকারীরা। তারা মন্ত্রী, পুলিশ কমিশনার প্রমুখের পদত্যাগ চেয়েছিল। এখন, কেন তারা এমনটি করেছে তা একটি রহস্য। আমার দৃষ্টিভঙ্গি হলো যে সেখানে অন্যান্য প্রভাব কাজ করেছে—বেশির ভাগ বিদেশি এবং কিছু অভ্যন্তরীণ। হাসিনা স্পষ্টতই তাঁর মন্ত্রীদের বরখাস্ত করতে রাজি না হওয়ায় তারা (আন্দোলনকারীরা) আবার বিক্ষোভ শুরু করে। এই সময়, আমি মনে করি, তাদের পেছনে খুব কার্যকর একটি শক্তি সমর্থন জুগিয়েছে। 

কেন এই আন্দোলন এতটা রাজনৈতিক হয়ে উঠল, যা ঢাকায় পদযাত্রা ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে গিয়ে ঠেকল? এটা একটা প্রশ্ন। আমি বলব, শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীই তাঁকে এই বলে অপসারণ করেছিল যে, না, আমরা আপনাকে আর রক্ষা করতে পারব না। আমরা এই বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করব না। 

ভারত এটা অনুমান করতে পেরেছিল কি না? 
আমরা কি বাংলাদেশে যা ঘটছিল, তা জানতাম? অবশ্যই, আমরা জানতাম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা তাঁর পতনের কথা অনুমান করতে পেরেছিলেন কি না। আমার বোধ হয় যে তিনি না পারেননি। সম্ভবত, আপনি যদি ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকেন, তবে আপনার মনে হবে যে সবকিছু ঠিকঠাকই আছে! 

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রসঙ্গে
এই সরকার বিভিন্ন ধরনের লোক নিয়ে গঠিত। সেখানে রয়েছেন উগ্র ডানপন্থী দল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের একজন নেতা। এরপর আছেন বিএনপির সহানুভূতিশীলেরা। এবং তারপর, অবশ্যই, অধ্যাপক ইউনূস আছেন, তিনি একজন বড়, আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। আমি বলব, তিনি অত্যন্ত হাসিনাবিরোধী এবং তিনি (হাসিনা) তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা করেছেন। যেমন—অর্থ আত্মসাতের মামলা। আমার চিন্তা হলো, তারা (সরকারের বিভিন্ন বিভাগ) একসঙ্গে কাজ করতে পারবে কি? এরা সবাই সরকারকে বিভিন্ন দিকে টানতে পারে। উপদেষ্টা পরিষদে দুজন ছাত্রনেতা রয়েছেন এবং স্পষ্টতই, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে তদারকির জন্য দুজন ছাত্র নিযুক্ত রয়েছেন। অবশ্যই, কিছু ইঙ্গিত এখানে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, আমাদের অবশ্যই দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। তিনি আরও বলেছেন যে তিনি চাইবেন বাংলাদেশ সাউথ–ইস্ট এশিয়ান নেশনস অ্যাসোসিয়েশনে (আসিয়ান) যোগ দেওয়ার সুযোগ পাক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তবতা আপনাকে পীড়া দেবে। সব জিনিস আগের অবস্থাতেই রয়েছে: হিন্দুদের ওপর হামলা হয়েছে, দুর্ভাগ্যবশত তাদের আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২০০১ সালে বিএনপি–জামায়াত সরকার ক্ষমতায় আসার পরও একই ঘটনা ঘটেছিল। 

ভারতে শেখ হাসিনার উপস্থিতি প্রসঙ্গে
শেখ হাসিনা আগেও এখানে ছিলেন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ছিলেন। যখন তাঁর পুরো পরিবারকে রাজনৈতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি আবার এসেছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাঁর কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে? আমি বলব, আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হওয়ার সম্ভাবনাকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। তাঁরা এমন কোনো দল নয় যে অদৃশ্য হয়ে যাবে। তারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। তাহলে কি হাসিনা ফিরে যাবেন? তাঁকে মামলা ও তদন্তের মুখোমুখি হতে হবে এবং তারা তাঁকে জেলে পাঠাতে পারে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যা করা হয়েছে, প্রতিহিংসার রাজনীতি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি নতুন নেতা তৈরি করবে? এসবই কেবল সম্ভাবনার কথা। হাসিনা এখানে থাকবেন কি না, সেটা তাঁর বিষয়। আমি মনে করি না, ভারত সরকার তাঁকে বের করে দেবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এনসিপিসহ ১০ দলের জোট ঘোষণা করলেন জামায়াতের আমির

দিনাজপুরে খালেদা জিয়ার আসনে মনোনয়নপত্র নিলেন বিএনপির আরেক নেতা

সমঝোতায় পৌঁছেছি, আমরা জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেব: নাহিদ ইসলাম

চট্টগ্রাম-১৪ আসনে ধানের শীষ পেলেন বেনজীরের ব্যবসায়িক সহযোগী জসিম

‘তোর পুরস্কার গুলিতে মৃত্যু, দাফন-কাফনের জন্য তৈরি হ’

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩০
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্যদেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকার এই স্বঘোষিত স্বাধীন মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডটির প্রতি ইসরায়েলের এই গভীর আগ্রহ নিছক কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশকের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা, নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।

সোমালিল্যান্ডের অবস্থান এডেন উপসাগরের তীরে, যা সরাসরি ইয়েমেনের উল্টো দিকে এবং বাব আল-মানদেব প্রণালির ঠিক পাশেই অবস্থিত। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলপথের বাণিজ্য এই পথেই পরিচালিত হয়।

২০২৩ সাল থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। সোমালিল্যান্ডের উপকূলরেখা থেকে হুতিদের মূল ঘাঁটি হোদেইদাহর দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ বা সম্মুখ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।

ইসরায়েলি থিংকট্যাংক (আইএনএসএস)-এর মতে, সোমালিল্যান্ডে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইয়েমেনে আসা অস্ত্র চোরাচালান এবং হুতিদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হবে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মিত বারবেরা বন্দর ইসরায়েলি নৌ টহল বা ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

হর্ন অব আফ্রিকায় ইসরায়েলের এই প্রবেশ মূলত তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য কমানোর একটি পাল্টা কৌশল। তুরস্ক ইতিমধ্যে সোমালিয়ার মোগাদিশুতে বিশাল সামরিক ঘাঁটি এবং বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে জোরালো মৈত্রী এই অঞ্চলে তুরস্কের একক আধিপত্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।

এ ছাড়া ইসরায়েল সব সময় নিজের সীমানার বাইরে মিত্র দেশগুলোতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। সোমালিল্যান্ডের মতো একটি স্থিতিশীল এবং পশ্চিমাপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ইসরায়েলকে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বলয়ে একক কর্তৃত্ব দেবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারও আগ্রহের মূলে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সোমালিল্যান্ড কেবল একটি কৌশলগত বন্দর নয়, বরং এটি সম্পদের একটি অব্যবহৃত খনি।

সোমালিল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ মজুত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির কারখানায় এই কাঁচামালগুলো অত্যন্ত জরুরি।

ইসরায়েল ইতিমধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি পরিশোধন, উন্নত সেচব্যবস্থা এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সোমালিল্যান্ডের জন্য এই অংশীদারত্ব হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।

তবে এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইসরায়েলের এই স্বীকৃতি যেমন সোমালিল্যান্ডের জন্য বৈধতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি আঞ্চলিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।

সোমালিয়া এই পদক্ষেপকে তাদের অখণ্ডতার ওপর ‘সরাসরি আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) এবং আরব লিগ এই স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে যে এটি আফ্রিকা মহাদেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।

পশ্চিমা বিশ্বও ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ সোমালিল্যান্ডকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই এই পথে হাঁটবে না, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

সর্বোপরি ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে ইসরায়েলের সমমনা বলেই মনে করা হয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল লোহিত সাগরে নিজের নৌ-শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে এই পদক্ষেপ যদি ইথিওপিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করবে। তবে এর ফলে হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূরাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। এটি যেমন একটি নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এনসিপিসহ ১০ দলের জোট ঘোষণা করলেন জামায়াতের আমির

দিনাজপুরে খালেদা জিয়ার আসনে মনোনয়নপত্র নিলেন বিএনপির আরেক নেতা

সমঝোতায় পৌঁছেছি, আমরা জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেব: নাহিদ ইসলাম

চট্টগ্রাম-১৪ আসনে ধানের শীষ পেলেন বেনজীরের ব্যবসায়িক সহযোগী জসিম

‘তোর পুরস্কার গুলিতে মৃত্যু, দাফন-কাফনের জন্য তৈরি হ’

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কোন আইএসকে আঘাত করল মার্কিন বাহিনী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামিক স্টেট কী

ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।

পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়

মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল

আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।

আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা

কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।

নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এনসিপিসহ ১০ দলের জোট ঘোষণা করলেন জামায়াতের আমির

দিনাজপুরে খালেদা জিয়ার আসনে মনোনয়নপত্র নিলেন বিএনপির আরেক নেতা

সমঝোতায় পৌঁছেছি, আমরা জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেব: নাহিদ ইসলাম

চট্টগ্রাম-১৪ আসনে ধানের শীষ পেলেন বেনজীরের ব্যবসায়িক সহযোগী জসিম

‘তোর পুরস্কার গুলিতে মৃত্যু, দাফন-কাফনের জন্য তৈরি হ’

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কেন হামলা চালাল মার্কিন বাহিনী, খ্রিষ্টান নিপীড়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।

কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন

অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।

তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে

নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।

নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান

ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।

নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।

এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’

এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এনসিপিসহ ১০ দলের জোট ঘোষণা করলেন জামায়াতের আমির

দিনাজপুরে খালেদা জিয়ার আসনে মনোনয়নপত্র নিলেন বিএনপির আরেক নেতা

সমঝোতায় পৌঁছেছি, আমরা জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেব: নাহিদ ইসলাম

চট্টগ্রাম-১৪ আসনে ধানের শীষ পেলেন বেনজীরের ব্যবসায়িক সহযোগী জসিম

‘তোর পুরস্কার গুলিতে মৃত্যু, দাফন-কাফনের জন্য তৈরি হ’

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এনসিপিসহ ১০ দলের জোট ঘোষণা করলেন জামায়াতের আমির

দিনাজপুরে খালেদা জিয়ার আসনে মনোনয়নপত্র নিলেন বিএনপির আরেক নেতা

সমঝোতায় পৌঁছেছি, আমরা জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেব: নাহিদ ইসলাম

চট্টগ্রাম-১৪ আসনে ধানের শীষ পেলেন বেনজীরের ব্যবসায়িক সহযোগী জসিম

‘তোর পুরস্কার গুলিতে মৃত্যু, দাফন-কাফনের জন্য তৈরি হ’

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত