সেলিম জাহান

পয়লা বৈশাখ এসে গেছে। জানি, বাংলাদেশ এখন তৈরি হয়েছে নববর্ষকে বরণ করে নিতে। ঠিক পয়লা বৈশাখে বাংলাদেশের আনাচ-কানাচ রং আর রেখায় ভরে যায়। রং উঠে আসে মেয়েদের শাড়িতে, ছেলেদের পাঞ্জাবিতে, নানান ফুলের সমাহারে, তোরণের বর্ণচ্ছটায়। রেখা তার স্থান করে নেয় দেয়ালে, আলপনায়, প্রতিচিত্রে।
ঠিক পয়লা বৈশাখের আগের দিন আর্ট কলেজের ছেলে-মেয়েরা সারা রাত জেগে ঢাকার রাস্তায় আলপনা আঁকে, দেয়াল চিত্র শেষ করে নানান রঙের আর ঢংয়ের মুখোশ বানায়, রঙিন কাগজের প্রতিমূর্তি গড়ে পরদিন প্রভাতের শোভাযাত্রার জন্য। উন্মাদনা, উৎসাহের জোয়ার দেখা যায় চারদিকে—আনন্দ, স্ফূর্তি আর উৎসবের আমেজ অনুভব করা যায় আকাশে-বাতাসে।
বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে প্রীতি-সম্ভাষণে, গানে, আমোদে আর মুখরোচক খাদ্যে। মেলা বসে নানান জায়গায়, রমনার বটমূলে বসে গানের আসর, চিরায়ত বাঙালি খাবার উঠে আসে আমাদের রসনায়। নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো, শিশুদের কলকাকলিতে ঘন হয়ে আসে আকাশ-বাতাস।
এই চালচিত্র থেকেই উঠে আসে স্মৃতি-অতীতের স্মৃতি। সেই স্মৃতির আলপনা-রেখার পথ ধরে মন চলে যায় সুদূর অতীতে। মনে পড়ে কত কথা, ৬০ বছর আগের কথা। ছবির মতো বরিশাল শহরের বেশির ভাগ রাস্তাই ছিল লাল সুরকির। ব্রজমোহন কলেজসংলগ্ন আমাদের দোতলা কাঠের বাড়ির ধার ঘেঁষে যে পথটি চলে গেছে, তা শহর পেরিয়ে কাশীপুর হয়ে চলে গেছে। ঐ পথ ধরেই বাস যেত রহমতপুর, ভূরঘাটা, গৌরনদী, চাখার আরও কত জায়গায়। যতবার বাস যেত, ততবারই একটি লাল ধুলোর ঘূর্ণি উঠত রাস্তার ওপরে ক্ষণিকের জন্য। তারপর তা মিলিয়ে যেত। কিন্তু একদিন সেই লাল ধুলোর ঘূর্ণি ঘন হয়ে বসে যেত বাতাসে।
এবং সেটা ওই পয়লা বৈশাখেই। সারা বরিশাল শহরে ঐ পথ ধরে রওনা হতো পশ্চিমে বেলা ৩টায় শুরু হওয়া কাশীপুরের বৈশাখী মেলার দিকে। রিকশায়, সাইকেলে, পদব্রজে লোকের যাত্রা শুরু হয়ে যেত সেই দুপুর ১২টা থেকেই। সে জনস্রোতের একটা বিরাট অংশই ছিল শিশুরা, ঐ যে মেলার মাটির পুতুলের জন্য। গরুর খুরের সৃষ্ট ধূলি থেকে ‘গোধূলি’ শব্দটি এসেছে, কিন্তু আমাদের বরিশালে পয়লা বৈশাখে মানুষের হেঁটে চলার পায়ে-পায়ে যে মনুষ্যধূলির সৃষ্টি হতো, তার কাছে গোধূলি তো নস্যি।
বেশ মনে আছে, ছোটবেলায় বড় কারও হাত ধরে আমরা দুই ভাই-বোন প্রতিবছরই যেতাম সেই বৈশাখী মেলায়। বাবা না যেতে পারলেও পাঠিয়ে দিতেন বড় কারও সঙ্গে। আমাদের দুজনের হাতে দেওয়া হতো একটি করে টাকা, পুতুল বা যা খুশি তা কেনার জন্য। সেই সঙ্গে মিলত মাটির বটুয়ায় জমানো আমাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়। মায়ের নিষেধাজ্ঞা ছিল বাইরের খাবার না কেনার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা? মেলার ধূলিমিশ্রিত নকুল দানা, কিংবা চৌকো করে কাটা তিলের খাজা, অথবা ঝুরঝুরে ঝুরিভাজার স্বর্গীয় স্বাদ কি ঘরের বানানো খাবারে হয়? সুতরাং মায়ের নিষেধাজ্ঞা তত্ত্বেই থাকত, বাস্তবে নয়।
মেলায় গিয়ে পড়তে হতো এক কঠিন সমস্যায়। এত সব সুন্দর সুন্দর মাটির পুতুল—ঘোড়া, বর-বৌ, গরু, হাতি, পাখি কোনটা ছেড়ে কোনটা নেই। পোড়ামাটির ওপরে সুন্দর উজ্জ্বল রঙে চোখ-মুখ আঁকা ঐ সব পুতুলদের দিকে তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হতো, দুহাতে আঁকড়ে ধরে সব পুতুল নিয়ে নেই। কিন্তু সাধ আর সাধ্যে যে বিরাট ফারাক। তারই মধ্যে ছোট্ট মাথা খাঁটিয়ে পছন্দ করতাম কিছু পুতুল। কুমোরেরা যখন তাঁদের ডালি থেকে পুতুলগুলো আমাদের কচি হাতে তুলে দিতেন, তখন মনে হতো, হাতে স্বর্গ পাওয়া গেল।
বাড়ি ফিরে সেই সব ঘোড়া, হাতি আর পাখিদের উল্টেপাল্টে কতবার যে দেখা হতো। রাতে ঘুমোনো হতো ঐ সব পুতুলদের বালিশের পাশে সাজিয়ে। দুটো ঘটনার কথা মনে আছে। একবার নিজের সঞ্চয় থেকে মায়ের জন্য একটা শিশু কোলে মা-পুতুল নিয়ে এসেছিলাম। সেদিন মায়ের মুখে যে খুশির আভা দেখেছিলাম, তা কখনো ভুলব না। আর একবার আমার হাত থেকে আমার ঘোড়া পুতুলটা ভেঙে গিয়েছিল। আমার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বোন তার ঘোড়াটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। তার মূল্য তখন হয়তো বুঝিনি, আজ বুঝি।
সন্ধ্যের দিকে আবার শুরু হতো আরেক পালা, হালখাতা। বাবা আমাকে নিয়ে বেরোতেন মাখন কাকা আর হারাধন জেঠার বইয়ের দোকানে, জহুর চাচার কাপড়ের প্রতিষ্ঠান ‘চিটাগং বস্ত্রালয়ে’, অশ্বিনীদার কাঠের কারখানায়। সুবেশ বিপণি মালিকেরা আমাদের যত্ন করে বসাতেন, সুস্বাদু সব খাবার আসত। তাকিয়ে দেখতাম লাল রঙের নতুন হালখাতা। যত দূর মনে পড়ে বাবা একটা রুপোর টাকা প্রতীকী হিসেবে তাঁদের হাতে তুলে দিতেন।
সেই সব কর্মকাণ্ডে আমার যে কী যত্ন-আত্তি! কাকা-দাদারা হাঁক দিচ্ছেন তাঁদের কর্মচারীদের গরম গরম রসালো মিষ্টান্ন আনার জন্য, পরম যত্নে তুলে দিচ্ছেন আমার পাতে, জোর করছেন এটা ওটা খাবার জন্য। তারই ফাঁকে ফাঁকে বাবার কাছে আশীর্বাদ চাইছেন যাতে সারা বছরটা ভালো যায়। খাবার শেষে পেতলের ঘটি-গেলাসে জল আসত, বাবা একটা পান তুলে নিতেন হাতে, বিপণি মালিকেরা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন।
কিন্তু সব সময়ে যা আমার দৃষ্টি কাড়ত, তা হচ্ছে ঐ হালখাতা। সাদা সুতোয় বাঁধা লাল খাতাটা এলিয়ে থাকত টাকা-পয়সার বাক্সের পাশে। অদূরেই পেতলের ঘটিতে জলে পাঁচটি আমপাতা মুখ উঁচিয়ে থাকত। তার পাশেই কলম আর দোয়াত হিসেব লেখার জন্য। আমি প্রায়ই ঐ লাল খাতাটির ওপরে হাত বুলোতাম। লালসালুর ঐ খাতাটি দেখতে দেখতে কেমন যেন ঘোর লেগে যেত।
তারপর সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসত। বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নেমে চোখে পড়ত, পাশের বাড়ির বন্দনা মাসিমা ওঁদের উঠোনের মাঝখানে তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে। সামনে মাটির প্রদীপ জ্বলছে আর তার আভায় সিঁদুর রাঙা সিঁথি ও জ্বলজ্বলে টিপে মাসিমাকে দেবীর মতো মনে হতো। তাঁর গলায় জড়ানো লাল-সাদা শাড়ির আঁচলে আর তাঁর নিমগ্নতায় কী যে সুন্দর লাগত তাঁকে। বাবা খুব নরম করে বলতেন, ‘যাও, মাসিকে প্রণাম করে এসো।’
আমি ওঁদের উঠোনের দিকে যেতে যেতে মনে হতো, কাল রাতে আমার ঘরের জানালা থেকে দেখেছি, বন্দনা মাসি তাঁদের তুলসীতলা নিকিয়েছেন, বারান্দায় আলপনা এঁকেছেন চালের গুঁড়োর, মঙ্গলঘট বসিয়েছেন সিঁড়ির দুধারে। আজ খুব ভোরে ঘুম চোখে দেখেছি, ওঁদের বাড়ির পেছনের ছোট্ট পুকুরটা এক ডুবে পার হয়ে ওপারের ছোট্ট আমগাছটা থেকে দুটো কচি আম তুলে আবার এক ডুবে ফিরে এসেছেন এ পাড়ের ঘাটে। আমার পায়ের সাড়া পেয়ে বন্দনা মাসিমার তন্ময়তা ভেঙে যেত। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলতেন, ‘কি রে, বাবার সঙ্গে গিয়ে পেটপুজো সেরে এলি’?
আমি কিছু না বলে বন্দনা মাসিমার পায়ের কাছে প্রণত হই। টের পেতাম, মাসিমার স্নেহময় হাত আমার পিঠে। আজ মনে হয়, ঐ আশীর্বাদ, ঐ মমতা আর মায়াই তো ঘিরে রেখেছে আমাকে—শুধু বছরের প্রথম দিনে নয়, সারা বছর এবং সারা জীবনও বটে।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ,জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

পয়লা বৈশাখ এসে গেছে। জানি, বাংলাদেশ এখন তৈরি হয়েছে নববর্ষকে বরণ করে নিতে। ঠিক পয়লা বৈশাখে বাংলাদেশের আনাচ-কানাচ রং আর রেখায় ভরে যায়। রং উঠে আসে মেয়েদের শাড়িতে, ছেলেদের পাঞ্জাবিতে, নানান ফুলের সমাহারে, তোরণের বর্ণচ্ছটায়। রেখা তার স্থান করে নেয় দেয়ালে, আলপনায়, প্রতিচিত্রে।
ঠিক পয়লা বৈশাখের আগের দিন আর্ট কলেজের ছেলে-মেয়েরা সারা রাত জেগে ঢাকার রাস্তায় আলপনা আঁকে, দেয়াল চিত্র শেষ করে নানান রঙের আর ঢংয়ের মুখোশ বানায়, রঙিন কাগজের প্রতিমূর্তি গড়ে পরদিন প্রভাতের শোভাযাত্রার জন্য। উন্মাদনা, উৎসাহের জোয়ার দেখা যায় চারদিকে—আনন্দ, স্ফূর্তি আর উৎসবের আমেজ অনুভব করা যায় আকাশে-বাতাসে।
বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে প্রীতি-সম্ভাষণে, গানে, আমোদে আর মুখরোচক খাদ্যে। মেলা বসে নানান জায়গায়, রমনার বটমূলে বসে গানের আসর, চিরায়ত বাঙালি খাবার উঠে আসে আমাদের রসনায়। নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো, শিশুদের কলকাকলিতে ঘন হয়ে আসে আকাশ-বাতাস।
এই চালচিত্র থেকেই উঠে আসে স্মৃতি-অতীতের স্মৃতি। সেই স্মৃতির আলপনা-রেখার পথ ধরে মন চলে যায় সুদূর অতীতে। মনে পড়ে কত কথা, ৬০ বছর আগের কথা। ছবির মতো বরিশাল শহরের বেশির ভাগ রাস্তাই ছিল লাল সুরকির। ব্রজমোহন কলেজসংলগ্ন আমাদের দোতলা কাঠের বাড়ির ধার ঘেঁষে যে পথটি চলে গেছে, তা শহর পেরিয়ে কাশীপুর হয়ে চলে গেছে। ঐ পথ ধরেই বাস যেত রহমতপুর, ভূরঘাটা, গৌরনদী, চাখার আরও কত জায়গায়। যতবার বাস যেত, ততবারই একটি লাল ধুলোর ঘূর্ণি উঠত রাস্তার ওপরে ক্ষণিকের জন্য। তারপর তা মিলিয়ে যেত। কিন্তু একদিন সেই লাল ধুলোর ঘূর্ণি ঘন হয়ে বসে যেত বাতাসে।
এবং সেটা ওই পয়লা বৈশাখেই। সারা বরিশাল শহরে ঐ পথ ধরে রওনা হতো পশ্চিমে বেলা ৩টায় শুরু হওয়া কাশীপুরের বৈশাখী মেলার দিকে। রিকশায়, সাইকেলে, পদব্রজে লোকের যাত্রা শুরু হয়ে যেত সেই দুপুর ১২টা থেকেই। সে জনস্রোতের একটা বিরাট অংশই ছিল শিশুরা, ঐ যে মেলার মাটির পুতুলের জন্য। গরুর খুরের সৃষ্ট ধূলি থেকে ‘গোধূলি’ শব্দটি এসেছে, কিন্তু আমাদের বরিশালে পয়লা বৈশাখে মানুষের হেঁটে চলার পায়ে-পায়ে যে মনুষ্যধূলির সৃষ্টি হতো, তার কাছে গোধূলি তো নস্যি।
বেশ মনে আছে, ছোটবেলায় বড় কারও হাত ধরে আমরা দুই ভাই-বোন প্রতিবছরই যেতাম সেই বৈশাখী মেলায়। বাবা না যেতে পারলেও পাঠিয়ে দিতেন বড় কারও সঙ্গে। আমাদের দুজনের হাতে দেওয়া হতো একটি করে টাকা, পুতুল বা যা খুশি তা কেনার জন্য। সেই সঙ্গে মিলত মাটির বটুয়ায় জমানো আমাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়। মায়ের নিষেধাজ্ঞা ছিল বাইরের খাবার না কেনার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা? মেলার ধূলিমিশ্রিত নকুল দানা, কিংবা চৌকো করে কাটা তিলের খাজা, অথবা ঝুরঝুরে ঝুরিভাজার স্বর্গীয় স্বাদ কি ঘরের বানানো খাবারে হয়? সুতরাং মায়ের নিষেধাজ্ঞা তত্ত্বেই থাকত, বাস্তবে নয়।
মেলায় গিয়ে পড়তে হতো এক কঠিন সমস্যায়। এত সব সুন্দর সুন্দর মাটির পুতুল—ঘোড়া, বর-বৌ, গরু, হাতি, পাখি কোনটা ছেড়ে কোনটা নেই। পোড়ামাটির ওপরে সুন্দর উজ্জ্বল রঙে চোখ-মুখ আঁকা ঐ সব পুতুলদের দিকে তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হতো, দুহাতে আঁকড়ে ধরে সব পুতুল নিয়ে নেই। কিন্তু সাধ আর সাধ্যে যে বিরাট ফারাক। তারই মধ্যে ছোট্ট মাথা খাঁটিয়ে পছন্দ করতাম কিছু পুতুল। কুমোরেরা যখন তাঁদের ডালি থেকে পুতুলগুলো আমাদের কচি হাতে তুলে দিতেন, তখন মনে হতো, হাতে স্বর্গ পাওয়া গেল।
বাড়ি ফিরে সেই সব ঘোড়া, হাতি আর পাখিদের উল্টেপাল্টে কতবার যে দেখা হতো। রাতে ঘুমোনো হতো ঐ সব পুতুলদের বালিশের পাশে সাজিয়ে। দুটো ঘটনার কথা মনে আছে। একবার নিজের সঞ্চয় থেকে মায়ের জন্য একটা শিশু কোলে মা-পুতুল নিয়ে এসেছিলাম। সেদিন মায়ের মুখে যে খুশির আভা দেখেছিলাম, তা কখনো ভুলব না। আর একবার আমার হাত থেকে আমার ঘোড়া পুতুলটা ভেঙে গিয়েছিল। আমার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বোন তার ঘোড়াটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। তার মূল্য তখন হয়তো বুঝিনি, আজ বুঝি।
সন্ধ্যের দিকে আবার শুরু হতো আরেক পালা, হালখাতা। বাবা আমাকে নিয়ে বেরোতেন মাখন কাকা আর হারাধন জেঠার বইয়ের দোকানে, জহুর চাচার কাপড়ের প্রতিষ্ঠান ‘চিটাগং বস্ত্রালয়ে’, অশ্বিনীদার কাঠের কারখানায়। সুবেশ বিপণি মালিকেরা আমাদের যত্ন করে বসাতেন, সুস্বাদু সব খাবার আসত। তাকিয়ে দেখতাম লাল রঙের নতুন হালখাতা। যত দূর মনে পড়ে বাবা একটা রুপোর টাকা প্রতীকী হিসেবে তাঁদের হাতে তুলে দিতেন।
সেই সব কর্মকাণ্ডে আমার যে কী যত্ন-আত্তি! কাকা-দাদারা হাঁক দিচ্ছেন তাঁদের কর্মচারীদের গরম গরম রসালো মিষ্টান্ন আনার জন্য, পরম যত্নে তুলে দিচ্ছেন আমার পাতে, জোর করছেন এটা ওটা খাবার জন্য। তারই ফাঁকে ফাঁকে বাবার কাছে আশীর্বাদ চাইছেন যাতে সারা বছরটা ভালো যায়। খাবার শেষে পেতলের ঘটি-গেলাসে জল আসত, বাবা একটা পান তুলে নিতেন হাতে, বিপণি মালিকেরা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন।
কিন্তু সব সময়ে যা আমার দৃষ্টি কাড়ত, তা হচ্ছে ঐ হালখাতা। সাদা সুতোয় বাঁধা লাল খাতাটা এলিয়ে থাকত টাকা-পয়সার বাক্সের পাশে। অদূরেই পেতলের ঘটিতে জলে পাঁচটি আমপাতা মুখ উঁচিয়ে থাকত। তার পাশেই কলম আর দোয়াত হিসেব লেখার জন্য। আমি প্রায়ই ঐ লাল খাতাটির ওপরে হাত বুলোতাম। লালসালুর ঐ খাতাটি দেখতে দেখতে কেমন যেন ঘোর লেগে যেত।
তারপর সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসত। বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নেমে চোখে পড়ত, পাশের বাড়ির বন্দনা মাসিমা ওঁদের উঠোনের মাঝখানে তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে। সামনে মাটির প্রদীপ জ্বলছে আর তার আভায় সিঁদুর রাঙা সিঁথি ও জ্বলজ্বলে টিপে মাসিমাকে দেবীর মতো মনে হতো। তাঁর গলায় জড়ানো লাল-সাদা শাড়ির আঁচলে আর তাঁর নিমগ্নতায় কী যে সুন্দর লাগত তাঁকে। বাবা খুব নরম করে বলতেন, ‘যাও, মাসিকে প্রণাম করে এসো।’
আমি ওঁদের উঠোনের দিকে যেতে যেতে মনে হতো, কাল রাতে আমার ঘরের জানালা থেকে দেখেছি, বন্দনা মাসি তাঁদের তুলসীতলা নিকিয়েছেন, বারান্দায় আলপনা এঁকেছেন চালের গুঁড়োর, মঙ্গলঘট বসিয়েছেন সিঁড়ির দুধারে। আজ খুব ভোরে ঘুম চোখে দেখেছি, ওঁদের বাড়ির পেছনের ছোট্ট পুকুরটা এক ডুবে পার হয়ে ওপারের ছোট্ট আমগাছটা থেকে দুটো কচি আম তুলে আবার এক ডুবে ফিরে এসেছেন এ পাড়ের ঘাটে। আমার পায়ের সাড়া পেয়ে বন্দনা মাসিমার তন্ময়তা ভেঙে যেত। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলতেন, ‘কি রে, বাবার সঙ্গে গিয়ে পেটপুজো সেরে এলি’?
আমি কিছু না বলে বন্দনা মাসিমার পায়ের কাছে প্রণত হই। টের পেতাম, মাসিমার স্নেহময় হাত আমার পিঠে। আজ মনে হয়, ঐ আশীর্বাদ, ঐ মমতা আর মায়াই তো ঘিরে রেখেছে আমাকে—শুধু বছরের প্রথম দিনে নয়, সারা বছর এবং সারা জীবনও বটে।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ,জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
২ দিন আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
৪ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৫ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
১১ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

পয়লা বৈশাখের এখনকার চালচিত্র থেকেই উঠে আসে স্মৃতি-অতীতের স্মৃতি। সেই স্মৃতির আলপনা-রেখার পথ ধরে মন চলে যায় সুদূর অতীতে। মনে পড়ে কত কথা, ৬০ বছর আগের কথা। ছবির মতো বরিশাল শহরের বেশির ভাগ রাস্তাই ছিল লাল সুরকির।
১৪ এপ্রিল ২০২৪
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
৪ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৫ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
১১ দিন আগেসম্পাদকীয়

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

পয়লা বৈশাখের এখনকার চালচিত্র থেকেই উঠে আসে স্মৃতি-অতীতের স্মৃতি। সেই স্মৃতির আলপনা-রেখার পথ ধরে মন চলে যায় সুদূর অতীতে। মনে পড়ে কত কথা, ৬০ বছর আগের কথা। ছবির মতো বরিশাল শহরের বেশির ভাগ রাস্তাই ছিল লাল সুরকির।
১৪ এপ্রিল ২০২৪
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
২ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৫ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
১১ দিন আগেসম্পাদকীয়

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।
তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।
কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।
সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।
তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।
কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।
সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

পয়লা বৈশাখের এখনকার চালচিত্র থেকেই উঠে আসে স্মৃতি-অতীতের স্মৃতি। সেই স্মৃতির আলপনা-রেখার পথ ধরে মন চলে যায় সুদূর অতীতে। মনে পড়ে কত কথা, ৬০ বছর আগের কথা। ছবির মতো বরিশাল শহরের বেশির ভাগ রাস্তাই ছিল লাল সুরকির।
১৪ এপ্রিল ২০২৪
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
২ দিন আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
৪ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
১১ দিন আগেসম্পাদকীয়

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

পয়লা বৈশাখের এখনকার চালচিত্র থেকেই উঠে আসে স্মৃতি-অতীতের স্মৃতি। সেই স্মৃতির আলপনা-রেখার পথ ধরে মন চলে যায় সুদূর অতীতে। মনে পড়ে কত কথা, ৬০ বছর আগের কথা। ছবির মতো বরিশাল শহরের বেশির ভাগ রাস্তাই ছিল লাল সুরকির।
১৪ এপ্রিল ২০২৪
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
২ দিন আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
৪ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৫ দিন আগে