Ajker Patrika

১৫ অদ্ভুত ও বিপজ্জনক মানসিক রোগ

জাহাঙ্গীর আলম
আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২১, ১৩: ৩৪
১৫ অদ্ভুত ও বিপজ্জনক মানসিক রোগ

সব দেশের মানুষের মধ্যেই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। লাখ লাখ মানুষ নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় ভোগেন। কিন্তু অনেক মানুষই নিজের রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকেন না। ফলে তাঁরা চিকিৎসকের কাছেও যান না। আবার বাংলাদেশের মতো কিছু দেশে সাধারণ মানুষের অসচেতনতার পাশাপাশি স্বাস্থ্য অবকাঠামোও অত্যন্ত অপ্রতুল।

গবেষণা বলছে, দেশের ৯২ শতাংশ মানুষই মানসিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ এই সেবার আওতায় রয়েছে। আর বর্তমানে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন দেশের ১৭ শতাংশ মানুষ। 

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অন মেন্টাল ইলনেসের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন প্রতি বছর মানসিক অসুস্থতার সম্মুখীন হন। এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রে ১ শতাংশের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক সিজোফ্রেনিয়া এবং প্রায় ২ দশমিক ৬ শতাংশ বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। 

এই ধরনের ব্যাধিগুলো তুলনামূলক ভাবে স্পষ্ট। চিকিৎসক এবং অন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদাররা সাধারণ নির্ণয় পদ্ধতি ব্যবহার করেই রোগগুলো শনাক্ত করতে পারেন। কিন্তু এমন কিছু মানসিক সমস্যা রয়েছে যেগুলো অত্যন্ত বিরল এবং সুনির্দিষ্ট ভাবে শনাক্ত করা বেশ কঠিন। কিন্তু রোগগুলো ভয়ংকর। এতে আক্রান্ত ব্যক্তির পাশাপাশি তার আশপাশের অন্যরাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। 

এ রকম ১৫টি রোগের বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো: 

স্টেনডাল সিনড্রোম
স্টেনডাল সিনড্রোম যাদের আছে তাঁদের ক্ষেত্রে শারীরিক এবং মানসিক উদ্বেগের পাশাপাশি প্যানিক অ্যাটাক, বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা, বিভ্রান্তি এবং কোনো শিল্পকর্ম দেখার পর হ্যালুসিনেশনের মতো ঘটনা ঘটতে পারে।  সাধারণত যে শিল্পকে বিশেষভাবে সুন্দর বলে মনে করা হয় বা যখন একটি স্থানে বিপুল পরিমাণে শিল্পকর্ম রাখা থাকে সেখানে গেলে এমন অভিজ্ঞতা হতে পারে। যেমন জাদুঘর বা আর্ট গ্যালারিতে অতিমাত্রায় স্নায়ু উদ্দীপনা তৈরি হতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট মেডস্কেপে বলা হচ্ছে, এসবের পাশাপাশি প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখেও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। উনিশ শতকের ফরাসি লেখকের নামে এই সমস্যার নামকরণ করা হয়েছে। ১৮১৭ সালে ফ্লোরেন্স ভ্রমণের সময় লেখক এমন উপসর্গ অনুভব করেছিলেন। স্টেনডাল সিনড্রোম আবার হাইপার কালচারেমিয়া বা ফ্লোরেন্স সিনড্রোম নামেও পরিচিত। 

অ্যাপোটেমনোফিলিয়া
শরীরের অখণ্ডতার ধারণা বিকার নামেও পরিচিত। অ্যাপোটেমনোফিলিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি দেহের কোনো সুস্থ অঙ্গ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রবল ইচ্ছা পোষণ করেন। অবশ্য এই মানসিক সমস্যা সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় না। মনোবিদেরা এটিকে স্নায়বিক ব্যাধি বলেই মনে করেন। আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের অঙ্গ কেটে ফেলার চেষ্টা করতে পারেন বা এমন ভাবে কোনো অঙ্গের ক্ষতি করতে পারেন যে সেটি সারাতে অস্ত্রোপচার জরুরি হয়ে পড়ে। 

মস্তিষ্কের ডান প্যারিয়েটাল লোব কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে অ্যাপোটেমনোফিলিয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। এ ধরনের রোগের চিকিৎসা বেশ চ্যালেঞ্জিং, কারণ আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত চিকিৎসকের কাছে যান না। কগনিটিভ বিহ্যাভিওরাল থেরাপি এবং অ্যাভারসন থেরাপির মাধ্যমে অ্যাপোটেমেনোফিলিয়ার চিকিৎসা করা হয়। 

zombieএলিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোম
এই সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তি মনে করেন তাঁর হাত আসলে তাঁর নয়। হাতের যেন আলাদা জীবন আছে। এলিয়েন হ্যান্ড সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির অন্যান্য স্বাভাবিক অনুভূতি আছে। কিন্তু তাঁরা মনে করেন, তাঁদের হাত যেন এক স্বাধীন জীবন্ত বস্তু, হাতের নিজস্ব ইচ্ছা অনুভূতি আছে। আক্রান্ত ব্যক্তিরা অঙ্গটিকে একটি পৃথক সত্তা হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেন। হাত তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আক্রান্ত হাতের নিজস্ব এজেন্ডা থাকে! 

কর্পাস ক্যালোসামের ক্ষতি হলে এমন সমস্যা দেখা দেয়। এই অংশটি মস্তিষ্কের দুটি সেরিব্রাল গোলার্ধকে সংযুক্ত করে। অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-স্ট্রোক এবং প্যারিয়েটাল লোবের ক্ষতি। হাতগুলোর মধ্যে তখন ‘আন্তঃব্যক্তিক দ্বন্দ্ব’ বা ‘আইডিওমোটর অ্যাপ্রাক্সিয়া’ আছে বলে মনে হয়। অর্থাৎ মনে হয় যেন একটি হাত আরেক হাতের বিরুদ্ধে লড়ছে। 

ক্যাপগ্রাস সিনড্রোম
এই সিনড্রোমের নাম রাখা হয়েছে জোসেফ ক্যাপগ্রাস নামে এক ফরাসি মনোরোগ বিশেষজ্ঞের নামে। তিনি ক্যারিয়ারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দ্বিত্বের বিভ্রম অন্বেষণে ব্যয় করেছেন। ক্যাপগ্রাস সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির মনে হয় যেন তাঁর কোনো এক প্রিয়জনের স্থলে একইরকম দেখতে আরেক খারাপ লোক ছদ্মবেশ ধরে ঢুকে পড়েছে। এটি স্বামী, স্ত্রী, ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা পরিবারের সদস্যের ক্ষেত্রে হতে পারে। অর্থাৎ কোনো এক প্রিয় জনকে অন্য ব্যক্তি বলে ধারণা হওয়ার বিভ্রমের মধ্যে থাকেন তিনি। মনে হয় যেন, তার স্বামী আর আগের ব্যক্তিটি নেই। তিনি তাঁর ক্ষতি বা তাঁকে খুন করার ষড়যন্ত্র করছেন। এটি সিজোফ্রেনিয়া, নিদ্রাহীনতা, মৃগীরোগে আক্রান্ত এবং মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়া ব্যক্তির মধ্যে দেখা দিতে পারে। 

Alice-in-Wonderland-Syndromeঅ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিনড্রোম
অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিনড্রোম (এআইডব্লিউএস), টড সিনড্রোম নামেও পরিচিত। এটি একটি স্নায়বিক বিকার জনিত সমস্যা। আক্রান্ত ব্যক্তির মনে হয় তার দেহের ছবি, স্থান এবং/অথবা সময় যেন বিচ্যুত বা বিকৃত হচ্ছে। তাঁরা চারপাশের পরিবেশ বিকৃত ভাবে দেখে। 

অ্যালিস যেমন বাড়ির উচ্চতার চেয়েও অনেক লম্বা হয়ে যায়, অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিরও এ ধরনের অনুভূতি হয়। তাঁরা শান্ত বা জোরে শব্দ শুনতে পান, বস্তুর আকার প্রকৃত আকারের চেয়ে ছোট বা বড় দেখেন। এমনকি সঠিক বেগ বা টেক্সচারের অনুভূতিও হারান। আক্রান্ত ব্যক্তি তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের আকার আকৃতি নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে থাকেন। 

এই উপসর্গগুলো আতঙ্ক ও ভয়ের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি ঘন ঘন মাইগ্রেন, মস্তিষ্কের টিউমার আক্রান্ত বা ড্রাগ আসক্ত হয়ে যেতে পারেন। ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে। 

এ ধরনের ব্যক্তির হ্যালুসিনেশন, সংবেদের বিকার এবং গতি বেগের পরিবর্তিত অনুভূতি হতে পারে। 

সৌভাগ্যবশত, এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিনড্রোম অত্যন্ত বিরল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের ২০-এর দশকে যাদের ব্রেন টিউমার বা ড্রাগ নেওয়ার ইতিহাস আছে তাঁদের মধ্যে দেখা গিয়েছিল। 

paবোয়ানথ্রপি
খুব বিরল কিন্তু ভীতিকর মানসিক ব্যাধি এটি। বোয়ানথ্রপিতে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে গরু বলে মনে করেন। তাঁরা প্রায়শই গরুর মতো আচরণ করেন। কখনো কখনো তাঁদের মাঠে গরুর মতো চরতে দেখা যায়। গরুর পালের মধ্যে চার পায়ে হাঁটেন, ঘাস চিবান এবং নিজেকে গরুর পালেরই একজন সদস্য বলে মনে করেন। বোয়ানথ্রপি আক্রান্ত ব্যক্তি বুঝতে পারে না যে তাঁরা গরুর মতো আচরণ করছেন। গবেষকেরা মনে করেন, এই অদ্ভুত মানসিক ব্যাধি স্বপ্ন বা সম্মোহন থেকেও আরোপ করা যেতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, বাইবেলেও বোয়ানথ্রপির কথা উল্লেখ আছে। সেখানে ব্যাবিলনের রাজা নেবুচাদনেজারকে ‘মানবগোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে গিয়ে ষাঁড়ের মতো ঘাস খেয়েছিলেন’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। 

lycanthropyক্লিনিক্যাল লাইক্যানথ্রোপি
বোয়ানথ্রপির মতো, যারা ক্লিনিক্যাল লাইক্যানথ্রোপিতে ভুগছেন তাঁরাও বিশ্বাস করেন যে, তাঁরা পশুতে পরিণত হতে সক্ষম। নিজেকে নেকড়ে বলে মনে করেন। কখনো অন্য প্রাণী বলেও মনে হয়। ক্লিনিক্যাল লাইক্যানথ্রোপিতে আক্রান্ত ব্যক্তি পশুর মতো আচরণ করেন। নিজেকে নেকড়ে বা বাঘ সিংহ বলে মনে হলে তিনি তখন তেমন হিংস্র আচরণ করতে শুরু করেন। প্রায়শই বনে-জঙ্গলে গিয়ে থাকেন বা কখনো বনে গিয়ে পালিয়ে থাকেন।

কোটার্ড ডিলিউশন
দ্য ওয়াকিং ডেড বা হালের হলিউডি জম্বি সিনেমা নিয়ে মানুষের আগ্রহ ব্যাপক। কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণের সীমা ছাড়িয়ে যায়। তাঁরা এটিকে সত্যি সত্যি স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। এমনকি নিজেকেই এক সময় ওয়াকিং ডেড বা জম্বি ভাবেন। একেই বলে কোটার্ড ডিলিউশন। এই ভয়ানক মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, আক্ষরিক অর্থেই তিনি ওয়াকিং ডেড বা ভূত হয়ে গেছেন। শরীর ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং/অথবা শরীরের সমস্ত রক্ত এবং অভ্যন্তরীণ প্রত্যঙ্গ হারিয়ে ফেলেছেন। শরীর পচে গলে যাওয়ারও একটা অনুভূতি হতে পারে। কোটার্ড ডিলিউশনে ভোগা রোগীর বিষণ্নতার শিকার হওয়া স্বাভাবিক। কিছু ক্ষেত্রে রোগীর না খেয়ে মরার চিন্তাও আসতে পারে। 

এই ভয়ংকর ব্যাধিটি ১৮৮০ সালে প্রথম বর্ণনা করেন স্নায়ুবিদ জুলস কোটার্ড। অবশ্য কোটার্ড ডিলিউশন অত্যন্ত বিরল রোগ। কোটার্ড ডিলিউশনের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটেছিল হাইতিতে। সেখানে এক ব্যক্তি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, তিনি এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এবং বর্তমানে জাহান্নামে আছেন। 

ডায়োজেনিস সিনড্রোম
ডায়োজেনিস সিনড্রোমকে সাধারণত এক ধরনের ‘মজুতদারি’ বোঝায়। অর্থাৎ অকারণে জিনিস পত্র জমিয়ে রাখার একটা সমস্যা। এ কারণে এই রোগ সম্পর্কে প্রায়ই ভুল বোঝাবুঝি হয়। গ্রিক দার্শনিক সিনোপের ডায়োজেনিসের নামে এই রোগের নাম রাখা হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জায়োজেনিস নিজে আসলে মিনিমালিস্ট! আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে অকারণে জিনিসপত্র সংগ্রহ করার প্রবণতা দেখা যায়। অনিয়ন্ত্রিত মজুত ছাড়াও, ডায়োজেনিস সিনড্রোমের সঙ্গে নিজের প্রতি চরম অবহেলা, নিজের বা অন্যদের প্রতি উদাসীনতা, সমাজকে অগ্রাহ্য করা এবং নিজের ‘বদভ্যাসের’ জন্য কখনোই লজ্জিত না হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। বয়স্ক, নিদ্রাহীনতায় আক্রান্ত এবং যারা জীবনের কোনো এক সময় পরিত্যক্ত হয়েছিলেন বা যারা কোনো স্থিতিশীল পরিবেশে বেড়ে ওঠেননি তাঁদের মধ্যে ডায়োজেনিস সিনড্রোম দেখা যেতে পারে। 

বিচ্ছিন্ন পরিচয় বোধের সমস্যা
ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার (ডিআইডি)। একসঙ্গে একাধিক ব্যক্তিত্ব ধারণের ব্যাধি নামেও পরিচিত। এটি একটি ভয়ংকর মানসিক রোগ। এ ধরনের সমস্যা নিয়ে অসংখ্য সিনেমা এবং টেলিভিশন শো নির্মিত হয়েছে। এ ধরনের সমস্যায় ভোগা লোকের দুতিনটি আলাদা পরিচয় থাকে। কখনো কখনো আরও বেশি। ভুক্তভোগীরা নিয়মিতভাবে ব্যক্তিত্ব পরিবর্তনের একটি চক্রের মধ্যে থাকেন। কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক বছর পরপর তিনি আলাদা একটি পরিচয়ে বিরাজ করেন। তাঁদের আত্মপরিচয় মুহূর্তের মধ্যে বদলেও যেতে পারে। পরিচয় বদলের আগে তাঁদের মধ্যে কোনো ধরনের সতর্কতার লক্ষণও দেখা যায় না। এ ধরনের সমস্যায় যে তিনি আক্রান্ত, এটা তাকে বোঝানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই কারণে, ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার যাদের আছে তাঁরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে অক্ষম। তাঁদের মানসিক হাসপাতালে পাঠাতে বাধ্য হন স্বজনেরা। 

ফ্যাকটিশাস ডিসঅর্ডার বা কপট বিকার
হাঁচির সঙ্গে গায়ে কাঁপুনি দেওয়া সর্দি-জ্বর বা অন্য কোনো অসুস্থতার ইঙ্গিত। কিন্তু ফ্যাকটিশাস ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এটা সত্য নয়। এরা অসুস্থতা নিয়ে মিথ্যা বলে, কপট আচরণ করে। আদতে এটি একটি ভয়ংকর মানসিক ব্যাধি। ফ্যাকটিশাস ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত অধিকাংশ ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে অসুস্থ করে তোলেন। তাঁদের মধ্যে অসুস্থ হওয়ার একটা অবসেশন দেখা যায়। ডাক্তারের শরণাপন্ন যেন হতে হয় সেই চেষ্টাই তাঁরা সব সময় করেন। কখনো কখনো তাঁরা অসুস্থতার ভান করেন। মানুষকে বিশ্বাস করানোর জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করেন। রোগ নিয়ে বিশাল গল্প ফেঁদে বসেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষণ উপসর্গ বলেন এবং হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটে বেড়ান। অসুস্থতার প্রতি এই জাতীয় আবেশ (অবসেশন) প্রায়ই অতীতের কোনো আঘাত বা গুরুতর অসুস্থতা থেকে তৈরি হতে পারে।

Kluver-Bucy-Syndromeক্লুভার-বুসি সিনড্রোম
হাভাতের মতো একটি বইয়ের স্বাদ কল্পনা করা বা একটি গাড়ির সঙ্গে যৌন সম্পর্কের আকাঙ্ক্ষা করা- ক্লুভার-বুসি সিনড্রোমে দ্বারা আক্রান্তরা এমন অদ্ভুত আচরণই করেন। তাঁদের মধ্যে স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, অখাদ্য বস্তু খাওয়ার ইচ্ছা এবং অটোমোবাইলের মতো নির্জীব বস্তুর প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করার মতো আচরণ দেখা যায়। ক্লুভার-বুসি সিনড্রোমে আক্রান্তরা অতি পরিচিত বস্তু বা ব্যক্তিকেও চিনতে পারেন না। এই ভয়ানক মানসিক ব্যাধি শনাক্ত করা কঠিন। মস্তিষ্কের টেমপোরাল লোবে গুরুতর আঘাতের ফল এই রোগ। এই রোগের কোনো প্রতিকার নেই। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি হয়তো সারা জীবন এই সমস্যায় ভোগেন। 

অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার
এই সমস্যাটির কথা ব্যাপকভাবে শোনা যায়। অনেকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে উপহাস করেন। খুব কম লোকই অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (ওসিডি) বুঝতে পারেন। ওসিডি বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পেতে পারে। তবে আতঙ্কে জড়োসরো থাকা, উদ্বেগ এবং পুনরাবৃত্তিমূলক দুশ্চিন্তা গ্রস্ত থাকা এসব লক্ষণ দেখে ওসিডি চিহ্নিত করা যেতে পারে। বারবার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার মতো কাজের পুনরাবৃত্তি করে থাকেন এসব লোক। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট কাজ করার অবসেশন দেখা যায় তাঁদের মধ্যে। ওসিডি আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়শই পুরোপুরি সচেতন থাকেন যে তাঁদের ভয় বা উদ্বেগ একেবারে অযৌক্তিক, এই উপলব্ধি তখন তাঁদের মধ্যে আরেক উদ্বেগের জন্ম দেয়। ফলে তিনি উদ্বেগের একটি চক্রে ঢুকে পড়েন।

Paris-Syndromeপ্যারিস সিনড্রোম
প্যারিস সিনড্রোম একটি অত্যন্ত অদ্ভুত অস্থায়ী মানসিক ব্যাধি। এ ধরনের ব্যক্তি প্যারিস শহরে গিয়ে অভিভূত হয়ে যান। মজার ব্যাপার হলো, এটা জাপানি পর্যটকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। প্রতি বছর প্যারিসে আনুমানিক ৬০ লাখ জাপানি পর্যটক যান। তাঁদের মধ্যে এক থেকে দুই ডজন জাপানি অতিমাত্রায় উদ্বেগ, কোনো কিছুতে ব্যক্তিত্ব আরোপ, অবাস্তব অনুভূতি, নিপীড়নমূলক চিন্তাভাবনা, হ্যালুসিনেশন এবং ভয়ংকর ভ্রান্তিতে ভোগেন। এগুলোই প্যারিস সিনড্রোমের বৈশিষ্ট্য। দেখা গেছে, প্যারিস সিনড্রোমে আক্রান্ত বেশির ভাগ লোকের মানসিক রোগের কোনো ইতিহাস নেই। ধারণা করা হয়, ভাষাগত সীমাবদ্ধতা, শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি এবং কল্পনার সঙ্গে প্যারিসের বাস্তবতার পার্থক্য এই মারাত্মক মানসিক সমস্যা তৈরি করে। 

রিডুপ্লিকেটিভ অ্যামনেসিয়া
রিডুপ্লিকেটিভ অ্যামনেসিয়া, ক্যাপগ্রাস সিনড্রোমের মতোই। এখানে মানুষের ডুপ্লিকেট ভাবার বদলে আক্রান্ত ব্যক্তি স্থানের ডুপ্লিকেট ভাবে। অর্থাৎ কোনো স্থানে গিয়ে তার কাছে স্থানটি অন্য কোনো স্থানের অনুরূপ বলে মনে হয়। এই বিশ্বাসটি বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পেতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, একটি স্থান একই সঙ্গে দুই জায়গাতে বিরাজ করছে। ধরা যাক, বান্দরবানে দেখা কোনো পাহাড়কে রাঙামাটিতে গিয়ে দেখা আরেকটি পাহাড়ের অনুরূপ মনে হচ্ছে। হোটেল কক্ষকে তার মনে হচ্ছে বাড়িতে নিজের ঘর। ‘রিডুপ্লিকেটিভ অ্যামনেসিয়া’ শব্দটি প্রথম ১৯০৩ সালে ব্যবহার করেন স্নায়ুবিদ আর্নল্ড পিক। স্মৃতিভ্রংশ (আলঝেইমার) রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তিনি এ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। টিউমার, নিদ্রাহীনতা, মস্তিষ্কের আঘাত বা অন্যান্য মানসিক রোগীদের মধ্যে এই সমস্যাটি দেখা যায়। 

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কিডনি রোগীর বন্ধু কামরুল

  • নিজের হাতে ২০০০তম কিডনি প্রতিস্থাপন।
  • নিজে কোনো পারিশ্রমিক নেন না ডা. কামরুল।
  • কিডনি প্রতিস্থাপন ২ লাখ ১৫ হাজার টাকায়।
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯: ২৫
অধ্যাপক কামরুল ইসলাম।
অধ্যাপক কামরুল ইসলাম।

বাংলাদেশে যেখানে কিডনি প্রতিস্থাপন এখনো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, সেখানে অসহায় ও দরিদ্র রোগীদের শেষ ভরসা হয়ে উঠেছেন কিডনির শল্যচিকিৎসক অধ্যাপক কামরুল ইসলাম। দেশে যত কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়, সেগুলোর একটি বড় অংশই করেন তিনি। নিজের প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (সিকেডি) হাসপাতালে গতকাল মঙ্গলবার তিনি ২০০০তম কিডনি প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করেছেন। ব্যয়বহুল এই শল্য-চিকিৎসায় নিজে কোনো পারিশ্রমিক নেন না ২০২২ সালে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত এই চিকিৎসক।

কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে কিডনি রোগের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। প্রায় ২ কোটি মানুষ কিডনির কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগছেন। দেশে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় পাঁচজন রোগীর মৃত্যু হচ্ছে কিডনি অকেজো হয়ে। কিডনি প্রতিস্থাপন সীমিত এবং ডায়ালাইসিস ব্যয়বহুল। ফলে অধিকাংশ রোগী চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত ও চিকিৎসা নিলে ৬০ শতাংশ রোগীর জীবন রক্ষা সম্ভব।

কামরুল ইসলামের জন্ম ১৯৬৫ সালে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে বোর্ডের মেধাতালিকায় যথাক্রমে ১৫তম ও ১০তম স্থান লাভ করেছিলেন তিনি। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৪০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজের মধ্যে সম্মিলিত এমবিবিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে স্বর্ণপদক পান। এরপর ১৯৯৫ সালে এফসিপিএস, ২০০০ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইউরোলজিতে এমএস এবং ২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ থেকে এফআরসিএস ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।

ডা. কামরুলের কর্মজীবন শুরু ১৯৯৩ সালে, বিসিএসের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দিয়ে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি এবং ২০০৭ সালে প্রথম সফল কিডনি প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করেন। ২০১১ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে বেসরকারি একটি মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক পদে দায়িত্ব নেন। পরে ২০১৪ সালে নিজ উদ্যোগে রাজধানীর শ্যামলীতে সিকেডি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।

সিকেডি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ডা. কামরুলের নেতৃত্বে সপ্তাহে ছয়টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। কিডনি দাতা ও গ্রহীতার জন্য একই সঙ্গে দুটি কক্ষে অস্ত্রোপচার চলে। প্রতিটি অস্ত্রোপচারে সাধারণত ১০-১২ জন চিকিৎসক অংশ নেন। যাঁদের মধ্যে থাকেন অবেদনবিদ, কিডনি বিশেষজ্ঞ, ইউরোলজির শল্যচিকিৎসকসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞ, পাশাপাশি নার্স ও টেকনোলজিস্ট।

ডা. কামরুল বলেন, সিকেডিতে প্রতিদিন গড়ে একটি কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়। প্রতিটি অস্ত্রোপচারে ১০-১২ জন চিকিৎসক কাজ করেন। তিনি নিজে পারিশ্রমিক নেন না, তবে অস্ত্রোপচারে আনুষঙ্গিক খরচ থাকে। তাঁর হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্যাকেজ এখন ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা। যার মধ্যে অস্ত্রোপচার, ওষুধ, আইসিইউ এবং অন্যান্য খরচ অন্তর্ভুক্ত। কিডনি দাতা সাধারণত ৩ থেকে ৭ দিন এবং কিডনি গ্রহীতা ৭ থেকে ১০ দিন হাসপাতালে থাকেন।

হাসপাতালের অন্যান্য সার্জারি ও চিকিৎসাসেবার আয়ের অর্থে কিডনি প্রতিস্থাপনের খরচের পুরো প্রক্রিয়া চালানো হয়। সেখানে প্রতিদিন ৭-১২টি কিডনি স্টোন সার্জারি, কিডনি ক্যানসার, প্রস্টেট ক্যানসারসহ অন্যান্য সার্জারি করা হয়। হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা চার শতাধিক। আউটডোরে প্রতিদিন ২৫০-৩০০ রোগী, ইনডোরে প্রায় ১০০ রোগী সেবা নেন। ১০০ শয্যার হাসপাতালটিতে আরও ৫০ শয্যা বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়েছে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে সিকেডি হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাসিন্দা মাইনুল রহমান। ৪৪ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ীর কিডনি অকেজো হয়ে গেলে স্ত্রীর দেওয়া কিডনি নিয়ে তাঁর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। ডা. কামরুল ইসলাম এই অস্ত্রোপচার করেন।

কিডনি প্রতিস্থাপনে সিকেডি হাসপাতাল সোয়া দুই লাখ টাকা নিয়েছে জানিয়ে মাইনুল রহমান গতকাল সন্ধ্যায় আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সিকেডি হাসপাতাল যদি অন্য হাসপাতালের মতো খরচ নিত, তাহলে আমরা তা বহন করতে পারতাম না। এখন প্রতি মাসে ফলোআপ চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। সেখানে গেলে সবকিছু বিনা মূল্যে পাওয়া যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসকের ফি দিতে হয় না।’

এর আগে ২০২৩ সালের অক্টোবরে স্ত্রীর দেওয়া কিডনি নিজের শরীরে প্রতিস্থাপন করেন নারায়ণগঞ্জের ৩৭ বছর বয়সী আবু বকর। তিনি বলেন, ‘ডা. কামরুল স্যার খুবই মানবিক। আমরা খরচের ভয়ে চিকিৎসায় যেতে চাইনি। তিনি কয়েকবার ফোন করে আমাদের খোঁজ নিয়েছেন, তিনি কিডনি বসিয়ে দিয়েছেন।’

ডা. কামরুল জানান, কিডনি প্রতিস্থাপন করা রোগীরা বাসায় গেলে প্রথম এক থেকে দুই বছর অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়; বিশেষ করে ওষুধ ঠিকমতো না খাওয়া, সময়মতো ডোজ না নেওয়া এবং অনিয়মিত জীবনধারা ঝুঁকি বাড়ায়। আবার রোগীরা খরচের ভয়ে ফলোআপ চিকিৎসায় আসতে চান না। ফলে তাঁদের এসব চিকিৎসা আজীবন বিনা মূল্যে করেন তিনি।

ডা. কামরুলের স্ত্রীও একজন চিকিৎসক। তিনি বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। তাঁদের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে শিক্ষানবিশ চিকিৎসক, মেজ মেয়ে এমবিবিএস অধ্যয়ন করছেন।

নিজের প্রতিষ্ঠিত সিকেডি হাসপাতালকে ‘বড় গাছের মতো’ দেখেন ডা. কামরুল ইসলাম। যেখানে আয়ের একটি অংশ দরিদ্র রোগী ও কিডনি প্রতিস্থাপনে ব্যয় করা হয়। তিনি বলেন, ‘মানুষকে নিখুঁত চিকিৎসা দেওয়া আমার কর্তব্য। আমি কিডনি রোগীদের খরচ হাসপাতালের অন্যান্য আয়ের মাধ্যমে বহন করি। এটি যেকোনো হাসপাতালই করতে পারে এবং এর জন্য লোকসান হয়; তা কিন্তু নয়।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কবিরাজিসহ প্রথাগত চিকিৎসার কার্যকারিতা খতিয়ে দেখছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯: ৪৭
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

আফ্রিকায় ভেষজ চিকিৎসকেরা ক্ষত বা ব্যথা উপশমে গাছগাছড়া সংগ্রহ করছেন; চীনে আকুপাংচার বিশেষজ্ঞরা সুচ ব্যবহার করে মাইগ্রেন সারাচ্ছেন; আবার ভারতে যোগীরা ধ্যানচর্চা করছেন—এ ধরনের প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো ক্রমেই কার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে এবং এগুলো আরও বেশি মনোযোগ ও গবেষণার দাবি রাখে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক কর্মকর্তা।

ডব্লিউএইচওর গ্লোবাল ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন সেন্টারের প্রধান ডা. শ্যামা কুরুবিল্লার মতে, ঐতিহাসিকভাবে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অভাবের কারণে যেসব প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতিকে অনেক সময় অবহেলা করা হয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ বাড়লে সেই ধারণা বদলাতে পারে।

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের শুরুতে বিভিন্ন দেশ সম্মত হয়েছে যে আগামী এক দশকের জন্য ডব্লিউএইচও একটি নতুন বৈশ্বিক প্রথাগত চিকিৎসা কৌশল গ্রহণ করবে।

এই কৌশলের লক্ষ্য—প্রমাণভিত্তিকভাবে স্বাস্থ্য ও কল্যাণে প্রথাগত, পরিপূরক ও সমন্বিত চিকিৎসার সম্ভাবনাময় অবদানকে কাজে লাগানো।

এই কৌশলের আওতায় প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতির জন্য শক্তিশালী প্রমাণভিত্তি তৈরি, চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গড়ে তোলা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী এসব পদ্ধতিকে আধুনিক জৈব-চিকিৎসাভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

কুরুবিল্লা বলেন, ‘এটা ভীষণ রোমাঞ্চকর। আমি বলছি না, আমরা এখনই জানি—কোনটা কাজ করে আর কোনটা করে না। তবে এ মুহূর্তে বিষয়টি জানার বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে।’

প্রথাগত চিকিৎসা বলতে এমন স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেগুলোর উদ্ভব আধুনিক বায়োমেডিসিনের আগেই হয়েছে। এসব চিকিৎসা পদ্ধতির ধরন নানাবিধ—ভেষজ চা থেকে শুরু করে ভারতের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাব্যবস্থা পর্যন্ত।

কুরুবিল্লা বলেন, শত শত বছর ধরে চলে আসা এসব পদ্ধতির মধ্যে অনেকগুলোরই বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জিনোমিক্স ও মস্তিষ্ক স্ক্যানসহ আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন সেগুলো নতুনভাবে অনুসন্ধান করা সম্ভব।

তাঁর মতে, প্রথাগত চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে থাইল্যান্ড ভালো উদাহরণ। দেশটিতে গবেষকেরা প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ ও নথিবদ্ধ করছেন এবং ভেষজ চিকিৎসাকে প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। গত মে মাসে থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পেশির ব্যথা ও কোষ্ঠকাঠিন্যসহ কিছু রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের আধুনিক ওষুধের বদলে প্রথাগত চিকিৎসা ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শীতে খিচুড়ি কেন খাবেন

ফিচার ডেস্ক
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ১৮
শীতে খিচুড়ি কেন খাবেন

শীতের সকাল কিংবা সন্ধ্যায় ধোঁয়া ওঠা এক বাটি খিচুড়ির চেয়ে আরামদায়ক আর কী হতে পারে। খিচুড়ি শুধু একটি খাবার নয়। শীতকাল মানে আরাম করে হরেক রকমের সবজি দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি খাওয়া। এতে যেমন মন ভরে, তেমনি পুষ্টিগুণে ভরপুর এ খাবার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। এ ছাড়া এটি শরীরে বিভিন্ন উপাদানের ভারসাম্য বজায় রাখতেও সহায়ক। শীতকালীন ক্লান্তি দূর করতে এবং ঋতু পরিবর্তনের অসুস্থতা থেকে বাঁচতে খিচুড়ি একটি আদর্শ খাবার। এটি সহজে হজম হয়।

কেন খাবেন খিচুড়ি

পুষ্টিবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী, খিচুড়ির প্রতিটি উপাদান আমাদের শরীরের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। এতে থাকা চাল থেকে পাওয়া যায় পর্যাপ্ত শর্করা ও শক্তি। ডাল জোগায় প্রোটিন ও আঁশ, যা হজমে বিশেষভাবে সাহায্য করে। ঘি শরীরের তাপমাত্রা ধরে রাখতে এবং পুষ্টি শোষণে সহায়ক। হলুদে থাকা কারকিউমিন ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করে এবং আদা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে শরীর উষ্ণ রাখে। খিচুড়িতে সবজি যোগ করলে আঁশের মাত্রা বাড়ে। গোলমরিচ ও জিরার মতো মসলা বিপাক প্রক্রিয়া উন্নত করে। এ ছাড়া সাবুদানার খিচুড়ি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এ ছাড়া এটি তাৎক্ষণিক শক্তি জোগাতে কার্যকর।

mog-dal

মুগ ডালের খিচুড়ি

চাল ও মুগ ডালের মিশেলে তৈরি এই খিচুড়ি যেমন সহজপাচ্য, তেমনি পুষ্টিগুণে ভরপুর। এর বিশেষত্বের চাবিকাঠি লুকিয়ে রয়েছে মসলায়। একেবারে হলুদ, লবণ, জিরা অথবা ধনেগুঁড়ার মতো সাধারণ কিছু মসলা দিয়ে এটি রান্না করা হয়। এটা রান্নার সময় মুগ ডালের সঙ্গে চালও ভেজে নিতে পারেন। এতে মুগ ডালের একটা ভিন্ন গন্ধ পাওয়া যাবে। হলুদের পরিবর্তে এতে ব্যবহার করতে পারেন সবুজ মুগডাল।

উপকারিতা: শরীর উষ্ণ রাখে এবং দীর্ঘক্ষণ শক্তি জোগায়।

khichuri

সবজি খিচুড়ি

গাজর, মটরশুঁটি, ফুলকপি, আলু, টমেটো ইত্যাদি শীতের সবজি দিয়ে তৈরি রান্না করা সবজি খিচুড়ি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। এর সঙ্গে শীতে পাওয়া যায় এমন প্রায় সব শাক ও সবজি যোগ করতে হবে। সবজিগুলো ছোট টুকরা করে কেটে নিতে হবে।

যে সবজিগুলো সেদ্ধ হতে বেশি সময় নেয়, সেগুলো আগে ভেজে নিন অথবা প্রেশার কুকারে দিন। এরপর তেল বা ঘিতে জিরা, তেজপাতা ও অন্যান্য মসলা দিয়ে পেঁয়াজ, আদা, রসুন ভাজার পর সবজিগুলো হালকা ভেজে নিন। ভেজে রাখা সবজি, চাল, ডাল ও পানি দিয়ে প্রেশার কুকারে বা হাঁড়িতে রান্না করুন। নরম খিচুড়ি চাইলে পানি বেশি দিতে পারেন। শেষ মুহূর্তে পালংসহ অন্য নরম শাক এতে যোগ করতে পারেন।

উপকারিতা: এটি অন্যান্য উপকারের সঙ্গে কোষ্ঠকাঠিন্য কমায় এবং দ্রুত শক্তি পুনরুদ্ধার করে।

তিল-খিচুড়ি

তিল খিচুড়ি

ঠান্ডা পাহাড়ি অঞ্চলে শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে এই খিচুড়ি অত্যন্ত জনপ্রিয়। চাল, মাষকলাইয়ের ডাল এবং তিল এর প্রধান উপকরণ। রান্নার আগে চাল ও ডাল ভিজিয়ে রাখা হয়। তিল হালকা ভেজে গুঁড়া করে নেওয়া হয়। তিল থেকে পাওয়া স্বাস্থ্যকর চর্বি ও খনিজ উপাদান শীতের দিনে শরীরের জন্য খুবই উপকারী। জিরা, হিং, হলুদ এবং লাল মরিচ গুঁড়ার সুগন্ধি মিশ্রণ এতে অনন্য স্বাদ যোগ করে। খাঁটি ঘি অথবা তেল-মসলার ফোড়ন দিয়ে এটি রান্না করা হয়। প্রোটিন, চর্বি এবং মিনারেলসমৃদ্ধ এই খাবার শীত জয়ের এক অমোঘ হাতিয়ার হতে পারে।

উপকারিতা: এটি শরীরে তাৎক্ষণিক শক্তি জোগানোর পাশাপাশি দীর্ঘক্ষণ শরীর গরম রাখতে সাহায্য করে।

আমলকীর-খিচুড়ি

আমলকী খিচুড়ি

সচরাচর খাওয়া হয় এমন কোনো খিচুড়ি খেতে না চাইলে রান্না করতে পারেন আমলকী খিচুড়ি। এটি কোনো সাধারণ খাবার নয়। এ খিচুড়ি রান্না করা হয় চাল, খোসা ছাড়ানো কালো মাষকলাইয়ের ডাল এবং তাজা আমলকী দিয়ে। নরম ধরনের এ খিচুড়ির স্বাদ ও সুগন্ধ বাড়াতে রান্নায় জিরা, হিং, হলুদ ও লাল মরিচের গুঁড়া ব্যবহার করতে পারেন। এগুলো এতে রাজকীয় স্বাদ যোগ করবে। সবশেষে ঘি বা তেলের সুগন্ধি ফোড়ন এই খিচুড়িকে করে তোলে আরও সুস্বাদু। কেউ চাইলে এই খিচুড়ির পুষ্টিমান আরও বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের ঋতুভিত্তিক সবজি যোগ করতে পারেন। শীতের এই উৎসবের দিনগুলোতে শরীর সতেজ রাখতে এবং রসনা তৃপ্তিতে আমলকী খিচুড়ি হতে পারে আপনার সেরা পছন্দ।

উপকারিতা: এটি শরীরে শক্তি জোগানোর পাশাপাশি হজমশক্তি এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। এ ছাড়া শরীর ডিটক্সে সহায়তা করে, হজম প্রক্রিয়া উন্নত হয়, গ্যাস্ট্রিক কমায়, কোলাজেন উৎপাদন বাড়ায় এবং ওজন কমাতে সহায়ক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

এই শীতে কেন খাবেন তেজপাতা ও লবঙ্গ চা

আলমগীর আলম
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ০৪
এই শীতে কেন খাবেন তেজপাতা ও লবঙ্গ চা

তেজপাতা ও লবঙ্গ—উভয়ই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর। এতে রয়েছে শক্তিশালী প্রদাহবিরোধী ও ব্যাকটেরিয়ারোধী গুণাবলি, যা শরীরের ভেতরে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। তবে এই চা সাধারণত সবার জন্য নিরাপদ হলেও গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী মায়েদের এটি পান করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

১. হজমশক্তি বৃদ্ধিতে: বদহজমের সমস্যায় ভুগলে তেজপাতা দারুণ মুক্তি দিতে পারে। অন্যদিকে, লবঙ্গ এনজাইম নিঃসরণ বাড়িয়ে হজমপ্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত এবং পেটের অস্বস্তি দূর করে।

২. ব্যথা ও প্রদাহ উপশমে: আর্থ্রাইটিসের মতো রোগে যাঁরা ভোগেন, তাঁদের জন্য এই চা অত্যন্ত উপকারী। ইউরিক অ্যাসিডের ব্যথা কমাতে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশের প্রদাহ বা ফোলা ভাব রোধে তেজপাতা ও লবঙ্গ লড়তে সাহায্য করে।

৩. রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে: লবঙ্গে থাকা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া

ও ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে। এর সঙ্গে তেজপাতা যুক্ত হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যায়, যা বিশেষ করে ঠান্ডা ও ফ্লু মৌসুমে সুরক্ষা দেয়।

৪. দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমাতে: এই চা শরীরে ক্ষতিকর ফ্রি র‍্যাডিক্যালের বিরুদ্ধে লড়াই করে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়। ফলে হৃদ্‌রোগ এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি কমে পায়।

৫. দাঁত ও মাড়ির সুরক্ষায়: লবঙ্গ তেল দাঁতের জন্য উপকারী হিসেবে স্বীকৃত। নিয়মিত লবঙ্গ চা পান করলে মাড়ি ও দাঁত সুস্থ রাখা সম্ভব।

তেজপাতা ও লবঙ্গ চা তৈরি করবেন যেভাবে

উপকরণ সংগ্রহ করা এবং এই চা তৈরি করার প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ—

উপকরণ: ৩-৪টি শুকনো তেজপাতা, ৫-৬টি আস্ত লবঙ্গ এবং ৪ কাপ পানি। স্বাদ বাড়াতে মধু বা লেবু ব্যবহার করতে পারেন।

প্রণালি: প্রথমে একটি পাত্রে পানি ফুটিয়ে নিতে হবে। তাতে তেজপাতা ও লবঙ্গ দিয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে দিন। ১৫ মিনিট মিশ্রণটি সেদ্ধ করার পর চুলা নিভিয়ে আরও ৫ মিনিট পাত্রটি ঢেকে রেখে দিন। এরপর ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে তেজপাতা ও লবঙ্গ ফেলে দিয়ে পানি আলাদা করে নিন। স্বাদ অনুযায়ী মধু কিংবা লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন।

সেবনবিধি ও সতর্কতা

ভালো ফল পেতে প্রতিদিন এক কাপ এই চা-পান করা ভালো; বিশেষ করে খাবারের পর এটি পান করলে হজমশক্তি বাড়াতে সবচেয়ে ভালো কাজ করে।

লেখক: খাদ্য পথ্য ও আকুপ্রেশার বিশেষজ্ঞ, প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত