১৯ মার্চ ভোরে এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯ জন মানুষের মৃত্যুর ঘটনাটি নতুন করে আবার এই প্রশ্নটি সামনে এনেছে যে আমরা কি কোনো কিছু থেকেই শিক্ষা নেব না? একটি দুর্ঘটনা ঘটবে, কারণ খুঁজব, একটু-আধটু বিলাপও করব কিন্তু কিছুতেই অব্যবস্থাপনা দূর করার চেষ্টা করব না! দেশে ভালো সড়ক অবকাঠামো গড়ে উঠেছে, মানুষের যাতায়াত বেড়েছে, নানা ধরনের যানবাহন বেড়েছে, বেড়েছে যানবাহনের গতি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। ভাবা যায়! এই টাকা পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ের চেয়েও বেশি! ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সড়কে শিক্ষার্থী মৃত্যুর হারও উদ্বেগজনক, শতকরা ১৬ ভাগ।
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে করণীয়গুলো অজানা নয়। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিরা অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে কোনো প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয় না। দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে।
আসা যাক, ১৯ মার্চের দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে। খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ইমাদ পরিবহনের একটি বাস পদ্মা সেতুতে ওঠার আগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে ছিটকে পড়ে। এরপর কমপক্ষে ১০০ ফুট নিচে আন্ডারপাসের দেয়ালের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা লেগে বাসটি দুমড়েমুচড়ে যায়। এতে চালক জাহিদ হাসান, তাঁর সহকারী ইউসুফসহ মোট ১৯ জনের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সেতু থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে, নিরাপত্তাবেষ্টনীহীন এলাকায়। ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে নিরাপত্তাবেষ্টনী আছে। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্পের অধীন সড়কটির সাড়ে ১১ কিলোমিটার অংশে কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই।
নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকার কারণ সম্পর্কে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘এটা ডিজাইনে ছিল না। যে ডিজাইন দেওয়া হয়েছে, সেই ডিজাইন অনুযায়ী আমরা কাজ করেছি। এখন এই ডিজাইনে নিরাপত্তাবেষ্টনী যুক্ত করতে হলে বিশেষজ্ঞ মতামত লাগবে। সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার কাজ ডিজাইন অনুসরণ করা। আমি সেটা করেছি।’ ডিজাইনে নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকার দায় কার? প্রকল্প পরিচালক তা বলেননি। তিনি মাছিমারা কেরানির মতো ডিজাইন অনুসরণ করেছেন।
প্রশ্ন হলো, এই নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকায় এতগুলো মানুষের মৃত্যুর দায় কে নেবে? এত এত সরকারি সংস্থা, এত কর্মকর্তা, তারপরও কেন এই অবহেলা? যাঁরা মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় মোটা মাইনে, গাড়ি-বাড়ি পান, জীবন যাঁদের নিরাপদ, তাঁরা সাধারণ মানুষের চলাচলের ব্যবস্থাটা নিরাপদ করার বিষয়ে উদাসীনতা দেখান কী করে?
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামছুল হক বলেছেন, খুলনা করিডরে অবকাঠামোতে একধরনের ত্রুটি আছে। নিয়ম বলছে, কোনো সড়ক বাঁধ যদি মাটি থেকে ৮ ফুট ওপরে হয়, তাহলে ঝুঁকি বিবেচনায় অবশ্যই টানা নিরাপত্তাবেষ্টনী দিতে হবে। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কিন্তু কোনো টানা রেলিং ছিল না।
অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, যেকোনো কারণেই হোক না কেন, দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু এত ওপর থেকে গাড়ি নিচে পড়তে দেব কেন? এখানে সমান্তরাল নিরাপত্তাবেষ্টনী কেন দেওয়া হলো না? এখানে অবকাঠামো উন্নয়ন নিরাপদ কি না, সে নিরীক্ষা করা দরকার।
যাঁরা এই নির্মাণকাজের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে কি?
বলা হচ্ছে, বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের বাইরে পড়ে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কে। নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে মোট ৭ হাজার ২৪টি দুর্ঘটনার মধ্যে শুধু মহাসড়কে ২ হাজার ৩১৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর সড়কের বাইরে বা খাদে পড়ে এবং উল্টে ৮৪৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে।
বুয়েটের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৮৪ শতাংশ ঘটে অতিরিক্ত গতির কারণে। আর বাঁকের চেয়ে সোজা পথে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।
সোজা পথে দুর্ঘটনা ঘটে ৬৭ শতাংশ। বাকিটা সড়কের বাঁকে।
একটি গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানোর অন্যতম কারণ থাকে ফিটনেস না থাকা। ইমাদ পরিবহনের যে গাড়িটি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে, সেটিরও ফিটনেস ছিল না। জানা গেছে, ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে একই গাড়ি গোপালগঞ্জে একটি দুর্ঘটনা ঘটায়। তখন চারজন মারা যায়। এতে সাময়িকভাবে বাসটির চলাচলের অনুমতি বাতিল করা হয়।
তবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই ফিটনেসবিহীন বাসটি আবারও সড়কে চলছিল। অভিযোগ, এমন ফিটনেসবিহীন বাসের সংখ্যা অনেক, যেগুলো সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এসব যাদের দেখার দায়িত্ব, তারা দেখেও দেখে না।
দুর্ঘটনার পর বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছেন, ‘এখন বাসটির সব ধরনের অনুমতি চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হবে। এর কোনো কাগজের বৈধতা থাকবে না। অনুমতি না থাকার পরও যদি সড়কে চলে, সেটা বাস্তবিক অর্থে বিআরটিএর দেখার সুযোগ নেই। সেটা ট্রাফিক পুলিশ দেখবে। আমরা শুধু তখন বুঝতে পারব যখন বাসটি ফিটনেস রিনিউ করতে আসে। এ ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে বাসটি ফিটনেসের জন্য আসেনি।’
আমাদের কর্মকর্তাদের ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’ অবস্থা। ফিটনেসবিহীন বাস সড়কে চলবে, দুর্ঘটনা ঘটাবে, মানুষ মারবে, তারপর এ-ওর ওপর দায় চাপিয়ে তৃপ্তি বোধ করবে। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন, কার গোয়ালে কে দেবে ধোঁয়া?
পরিবহন কোম্পানির চালকদের বাস চালাতে হয় অনেকটা বিরামহীনভাবে। ইমাদ পরিবহনের চালক জাহিদ হাসানকেও বাস চালাতে হতো ক্লান্ত দেহে, চোখে ঘুম নিয়ে। বিশ্রামের ফুরসত পেতেন না বললেই চলে। তার পরিণতিই যেন রোববারের দুর্ঘটনা। জাহিদ হাসান বৃহস্পতিবার ঢাকার দোলাইরপাড়ের বাসা থেকে বের হন। ওই দিন রাতেই যাত্রীবাহী বাসটি নিয়ে যান পিরোজপুরে। পরের দিন শুক্রবার সকালে পিরোজপুর থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকায় আসেন। শুক্রবার বিকেলে আবার যাত্রী নিয়ে যান পিরোজপুরে। রাতে পিরোজপুর পৌঁছে পরের দিন শনিবার সকালে আবার যাত্রী নিয়ে ঢাকায় আসেন। ঢাকা থেকে শনিবার দুপুরে আবার যান খুলনায়। রাতে বাসের মধ্যে তিন থেকে চার ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে রোববার ভোর ৪টায় খুলনার ফুলতলা থেকে বাসটি নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। এভাবে তিনি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় বাস চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে এক্সপ্রেসওয়ের শুরু। পদ্মা সেতুসহ ৭৫ কিলোমিটারের সড়কটি শেষ হয়েছে ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। এরপর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় আলাদা সড়ক ধরে যানবাহনগুলো চলাচল করে। সরকার এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির গতি নির্ধারণ করেছে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। কিন্তু ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালান চালকেরা। এর আগে গত ১৭ জানুয়ারি অতি দ্রুতগতিতে চলতে গিয়ে রোগীবাহী একটি অ্যাম্বুলেন্স ট্রাকের পেছনে ঢুকে যায়। এতে ছয়জন নিহত হন। ঘটনাটি ঘটে সড়কটির জাজিরার নাওডোবা এলাকায়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিবহন খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা না থাকা এবং পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ না থাকার প্রভাব পড়ছে তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। চালকেরা অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় যান চালানোয় দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। টানা যানবাহন চালানোর পেছনে আরও একটি কারণ হচ্ছে চালকের সংকট।
বিআরটিএর হিসাবে, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত মোট মোটরযানের সংখ্যা সাড়ে ৫৬ লাখের কিছু বেশি। মোটরযান চালকের লাইসেন্স আছে ৫০ লাখের কম; অর্থাৎ নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যার চেয়েও লাইসেন্স কম। যদিও যত লাইসেন্স, তত চালক নেই। কারণ, একজন ব্যক্তির একাধিক ধরনের লাইসেন্স থাকতে পারে। যেমন কেউ মোটরসাইকেল এবং হালকা যানবাহনের লাইসেন্স নিলে দুটি লাইসেন্স হিসেবে গণ্য হবে। এ বিবেচনায় দেশে যানবাহনের চেয়ে চালকের সংখ্যা অনেক কম। বিআরটিএর পূর্বাভাস হচ্ছে, বর্তমানের হারে নিবন্ধন চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ যানবাহনের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এ সময় চালকের প্রয়োজন পড়বে প্রায় দেড় কোটি। কারণ, একটি দূরপাল্লার কিংবা বাণিজ্যিক যানবাহনে একাধিক চালক দরকার।
দেশে বেকারত্ব বাড়ছে। কিন্তু চালক তৈরির প্রয়োজনীয় উদ্যোগ কেন নেওয়া হয় না? দক্ষ চালক তৈরির প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা কি খুবই অসম্ভব? সরকারের ওপর নির্ভর না করে পরিবহন মালিকেরাও তো এটি গড়ে তুলতে পারেন। চাকরির নিশ্চয়তা দিলে, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা ও উপযুক্ত বেতন এবং প্রশিক্ষণের সুযোগ থাকলে তরুণ-যুবকেরা এই পেশায় যোগ দিতে উৎসাহী হয়ে উঠবেন না কেন? আমরা আশা করব, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের মাধ্যমে সড়কের অব্যবস্থাপনা দূর করার বিষয়টিকে আর অবহেলা করা হবে না।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে