Ajker Patrika

সিটি করপোরেশন কেন প্রয়োজন

এম আর খায়রুল উমাম
সিটি করপোরেশন কেন প্রয়োজন

সরকার দেশের সব বিভাগীয় শহরগুলোতে পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে রূপান্তর করছে। এই রূপান্তরের ফলে এখন অনেক পুরোনো পৌরসভা থেকে দাবি উঠেছে, সেগুলোকে সিটি করপোরেশন করার। দাবির পেছনে সবাই অনেক যুক্তি দিয়ে চলেছে। যুক্তিগুলো একেবারে অস্বীকার করা সম্ভব, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। দেড় শ বছরের একটা পৌরসভার দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার বিষয়টিই অনেকের কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। কিন্তু সরকার সব যৌক্তিকতাকে পাশ কাটিয়ে মোটামুটি নির্লিপ্ত থেকেই সিটি করপোরেশন করার দাবি উপেক্ষা করে চলেছে। একটা পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করার জন্য কিছু নীতিমালা আছে। সেই নীতিমালাকে দেখিয়েই পৌরসভার দাবির বিষয়ে দিচ্ছি-দেব করে কালক্ষেপণ চলছে। বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, সরকার এমন অনেক পৌরসভা করেছে, যেগুলোর সব নীতিমালা যথাযথ মানা হয়েছে বলে সরকার দাবি করতে পারবে না। তাই পৌরসভার যৌক্তিক দাবিকেও সরকার নীতিমালা দেখিয়ে উপেক্ষা করতে পারে না।

একটা পৌরসভাকে সিটি করপোরেশন হিসেবে উন্নীত করলে সাধারণ মানুষ কী উপকার পাবে, তা প্রথমে বিবেচনা করা প্রয়োজন। আইন অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব কর্তব্য: ১. জনস্বাস্থ্য, ২. জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ রেজিস্ট্রেশন, ৩. সংক্রামক ব্যাধি, ৪. স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও মাতৃসদন ইত্যাদি, ৫. জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, ৬. হাসপাতাল ও ডিসপেনসারি, ৭. চিকিৎসা সাহায্য ও স্বাস্থ্য শিক্ষা, ৮. পানি সরবরাহ ও পানিনিষ্কাশন প্রণালি, ৯. রাস্তা। প্রাগুক্ত প্রতিটি হেডলাইনের আবার কিছু কিছু কাজ বিস্তারিত করা আছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের যে ১৮ খাতে সেবা দেওয়ার কথা জানা যায়, তা হচ্ছে রাস্তার বৈদ্যুতিক লাইট, হাসপাতাল, করপোরেশনের হাসপাতাল, রাস্তা, নর্দমা, ফুটপাত, বাজার, জন্মনিবন্ধন, ভস্মীকরণ সমাধি স্থান, ব্যায়ামাগার বা কমিউনিটি সেন্টার, মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র, রাস্তার গাড়ি পার্কিং, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা, গ্রন্থাগার, সংগীত স্কুল, বাস টার্মিনাল, পাবলিক টয়লেট, পার্ক এবং খেলার মাঠবিষয়ক সেবা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন যে ১৪টি খাতে সেবা দেওয়ার কথা জানায়, এর মধ্যে আছে রাস্তা খননের অনুমতি, নতুন হোল্ডিং নম্বর, হোল্ডিং ট্যাক্স সার্ভিস কার্যপ্রণালি, হোল্ডিংয়ের নামজারি, ডিওএমএফও, ট্রেড লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন, জন্মসনদ, কবরস্থান ব্যবস্থাপনা, ধূমপানমুক্তকরণ নির্দেশিকা, যান-যন্ত্রপাতি ভাড়ার হার ও নিয়মাবলি, কমিউনিটি সেন্টার বুকিং, বহুতল ভবনের অনাপত্তিপত্র, জিআইএস ম্যাপ ক্রয়, উদ্যোক্তাদের সেবাকেন্দ্র।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সেবা দেওয়ার যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তা দেখে মনে হয় যিনি এসব তথ্য দিয়েছেন, তাঁর হঠাৎ যা মনে এসেছে তা-ই বলে দিয়েছেন। সরকারি আইনে সিটি করপোরেশনের যেসব দায়িত্ব আছে, তার বেশ কিছু কাজ তাঁরা করলেও উল্লেখ করেননি; বরং দুটো পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের সেবাসংক্রান্ত তালিকার পার্থক্যই প্রমাণ করে তথ্য প্রদানকারী তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে কথা বলেননি। তবে এসব কোনো বিষয় নয়, সিটি করপোরেশনের আওতায় যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা সবাই সেবা ও সেবার মান সম্পর্কে জানেন, বোঝেন এবং দেখেন। সচেতন মহলের প্রশ্ন হলো, পৌরসভাগুলোও তো এসব কাজ করে থাকে। তাহলে সিটি করপোরেশন করে মাথাভারী একটা প্রশাসন জনগণের কাঁধে তুলে দেওয়ার যুক্তি কী? সেবার মানের কি কোনো পার্থক্য হবে? বর্তমান পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে তা আশা করার কোনো কারণ নেই।

রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি হতে পারে পৌরসভাকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা। এটা হতে পারে রাজনৈতিক দলের কর্মীদের পদ-পদবির সংখ্যা বৃদ্ধি করার কৌশল, পদমর্যাদা বৃদ্ধির কৌশল, সর্বোপরি যা হবে ভাগ্য পরিবর্তনের সহায়ক ব্যবস্থা। তাই রাজনৈতিক দল জনগণের সেবার মান উন্নত করার কথা বলে, প্রশাসনকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে সিটি করপোরেশনের দাবি করতেই পারে। সাধারণ মানুষ হিসেবে যারা সিটি  করপোরেশনের দাবি করে থাকে, তারা রাজনৈতিক দলের অনুসারী বলেই মনে হয়। অন্য একশ্রেণির মানুষের চাওয়ার কারণ হতে পারে এই, ‘আমরা দাবি করেছিলাম বলে সরকার সিটি করপোরেশন করে দিল’। কিন্তু সাধারণ নাগরিকের ভাবা প্রয়োজন কোনো পৌরসভাকে সিটি করপোরেশন করা হলে সাধারণ মানুষের ওপর ট্যাক্সের বোঝা বাড়বে। এলাকা বাড়বে, মানুষ বাড়বে, পাশাপাশি ট্যাক্সও কিন্তু বাড়বে। কে চায় সানাইদার আমদানি করতে?

একটা সময় অনেক জেলাকে বিভাগ করার দাবি উঠেছিল। এখন তা স্তিমিত হলেও নির্জীব হয়ে যায়নি। সবার যুক্তি যে খণ্ডন করা যায় তা-ও মনে হয় না। এখানেও রাজনৈতিক কারণে দেশের সব পুরোনো জেলাকে বিভাগে উন্নীত করা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এখন দেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের চেয়ে দেশ শাসনের অস্ত্র হিসেবে লাঠির জোরই বেশি প্রয়োজন বলে মনে হয়। লাঠির জোর বাড়াতে প্রশাসন যত ক্ষুদ্র ইউনিটে বিভক্ত হবে, যতই সুবিধা। সে কারণে জনকল্যাণের নামে পৌরসভাকে সিটি করপোরেশন করা হবে, জেলাকে বিভাগে উন্নীত করতে হবে। নতুন নতুন অফিস হবে, নতুন করে অনেক জনবল নিয়োগ করা হবে, উন্নয়ন দৃশ্যমান হবে। সরকারি বিবেচনায় নীতিনির্ধারকদের পরামর্শে উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য এসব করা যেতে পারে। তবে পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় সবকিছু সাধারণ জনগণের গলায় ফাঁস হিসেবে বিবেচিত না হয়ে যায়!

ঢাকা সিটি করপোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করে জনগণের কী কী সুবিধা হয়েছে, তা বিবেচনা করা গেলেই জনকল্যাণের হিসাব করতে সুবিধা হবে। প্রশাসন এখন আর জনগণের সেবক নয়। জনপ্রতিনিধিরাও আমলা দ্বারা পরিচালিত। জনপ্রতিনিধিরা থাকলেও দেশে এখন আমলাদের শাসন চলমান। রাজার প্রতিনিধি হিসেবে শাসন। তাই ম্যাডাম না বলে আপা বলায় তাঁদের হাতে সাধারণ জনগণকে মার খেতে হয়, স্যার বলানোর জন্য আন্দোলন দেখতে হয়, কোনো কারণে অসন্তুষ্ট হলে পুরস্কারের ট্রফিকে আছাড় মারা হয়। এই প্রশাসনকে জনগণের দোরগোড়ায় আনার নামে সিটি করপোরেশনে বা বিভাগ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি করে জনগণের কষ্টের ট্যাক্সের টাকা ব্যয় করার যুক্তি কোথায়? বরং ট্যাক্সের টাকার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার একটা চেক অ্যান্ড ব্যালান্স প্রথমে তৈরি করা সবচেয়ে জরুরি। তাহলেই প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি না করে জনকল্যাণ কিছুটা হলেও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

এক অভিজ্ঞ সংগঠক প্রায়ই সহকর্মীদের বলতেন সদস্যদের কী প্রয়োজন, কিসে মঙ্গল, তা ঠিক করার দায়িত্ব নেতাকে নিতে হয়। নেতারাই সবচেয়ে ভালো জানেন সদস্যদের জন্য কখন কী দাবি করতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকালে মনে বিশ্বাস জাগে, সংগঠকের কথাই ঠিক। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সাধারণ মানুষের কোনো ভূমিকাই নেই। জনগণের একমাত্র দায়িত্ব পাঁচ বছর পর পর যদি সুযোগ পায়, তাহলে একবার ভোট দিয়ে সরকার গঠনে মতামত দেওয়া। তারপর নেতা একবার হয়ে গেলে আর পাঁচ বছর জনগণ বিবেচ্য নয়। তখন তাঁরা যা মনে করেন, সেভাবে উন্নয়নের জোয়ার জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেন। জনগণকে উপেক্ষা করার রীতিতে জনকল্যাণ চলছে এবং চলবে। জনগণ শুধু দেখবে আর বলবে আহা, আহা, বেশ-বেশ। বর্তমান ব্যবস্থাপনায় এর চেয়ে বেশি কিছু করার নেই সাধারণ জনগণের।

লেখক: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ