Ajker Patrika

শরীফ উদ্দিনেরা কি এভাবেই হেরে যাবেন

এ কে এম শামসুদ্দিন
শরীফ উদ্দিনেরা কি এভাবেই হেরে যাবেন

শরীফের বিরুদ্ধে যে নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগ তোলা হয়েছে, এর আগে কর্তৃপক্ষ তাঁকে কারণ দর্শানোর কোনো নোটিশ দিয়েছিল কি না অথবা নিয়ম ভঙ্গের জন্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কি না, সে কথারও কোনো উল্লেখ নেই।

আজকের পত্রিকায় ৬ নভেম্বর প্রকাশিত একটি শিরোনাম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শিরোনামটি ছিল ‘দুদকের সেই শরীফ এখন দোকানদার’। দুদকের চাকরিচ্যুত সাবেক উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনের সঙ্গে যে নির্দয় আচরণ করা হয়েছে, সে-সম্পর্কে অনেকেরই হয়তো কম-বেশি জানা। তাঁর অপরাধ, তিনি সৎপথে থেকে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দুর্নীতিতে জড়িত দেশের কিছু রাঘববোয়ালের আসল চেহারা উন্মোচন করেছিলেন। শরীফ উদ্দিন যখন এ কাজগুলো করছিলেন, তখন হয়তো ভাবেননি যে ভিমরুলের চাকে খোঁচা দিতে যাচ্ছেন; এই খোঁচার ভার তিনি সামাল দিতে পারবেন কি না? দুঃখজনক হলো, শরীফ যে কর্তৃপক্ষের জন্য এই দুঃসাহসিক কাজগুলো করেছিলেন, সেই কর্তৃপক্ষ তাঁকে পুরস্কৃত না করে উল্টো চাকরিচ্যুত করেছে। শরীফ উদ্দিন প্রায় সাড়ে তিন বছর দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। তখন তিনি বড় বড় প্রকল্পের দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বের করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এক ডজনের বেশি মামলা করেছিলেন।

দুদকের নিয়ম অনুযায়ী, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই তিনি এ মামলাগুলো করেছিলেন। অথচ শেষ পর্যন্ত তাঁকেই এই দুর্ভাগ্যের শিকার হতে হলো। শরীফ উদ্দিন তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমোদনক্রমে এসব দুর্নীতির তদন্ত করেন। তাঁর ঊর্ধ্বতনেরাই এ তদন্ত করতে তাঁকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তাই শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তদন্তে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে তিনি রিপোর্ট দিয়েছিলেন। তদন্তের সময় অথবা তিনি যখন মামলার অনুমতি চান, তখনো তাঁর কর্তৃপক্ষ একবারের জন্যও বলেনি যে শরীফের কাজে ভুল হচ্ছে। অথচ মামলা করার পর যখন চারদিক থেকে চাপ আসা শুরু হলো, তখন সেই কর্তৃপক্ষই তাঁর সঙ্গে উল্টো আচরণ করে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। দুর্নীতির আশ্রয় না নিয়েও তাঁর চাকরিটা চলে যায়। পেটের দায়ে তাঁকে চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ক্যাশিয়ার হিসেবে তাঁর ভাইয়ের একটি কনফেকশনারির দোকান সামলাতে হচ্ছে।

মামলা করার পর শরীফের ওপর যখন চারদিক থেকে হুমকি-ধমকি আসা শুরু করে, তখন তিনি তাঁর কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন। দুর্নীতিবাজেরা বাসাবাড়িসহ যেখানে পেয়েছে, সেখানে তাঁকে হুমকি দিয়েছে। তাঁকে জেলের ভাত খাওয়ানোর হুমকি দিয়েছে। এসব বিষয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও তিনি কোনো ফল পাননি।

উল্টো তাঁর বিরুদ্ধে এক ডজনের বেশি অভিযোগ এনে তাঁকেই চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে।

শরীফের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো তাঁকে চাকরিচ্যুত করার জন্য পর্যাপ্ত কি না, সে প্রশ্নও আছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুদকের সচিব মাহবুব হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে শরীফের বিরুদ্ধে ১৩টি অভিযোগ তুলে ধরেন। কিন্তু এসব অভিযোগের একটিও প্রমাণিত হয়েছে—এমন তথ্য তিনি দিতে পারেননি। শরীফের বিরুদ্ধে যে নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগ তোলা হয়েছে, এর আগে কর্তৃপক্ষ তাঁকে কারণ দর্শানোর কোনো নোটিশ দিয়েছিল কি না অথবা নিয়ম ভঙ্গের জন্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কি না, সে কথারও কোনো উল্লেখ নেই। সাধারণত কোনো অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কাউকে চাকরিচ্যুত করার আগে আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়, শরীফের ক্ষেত্রে সে নিয়ম কতটুকু পালন করা হয়েছে, তা-ও পরিষ্কার নয়। শরীফের বিরুদ্ধে দুদকের এহেন পদক্ষেপ, দেশের সচেতন নাগরিকদের হতবাক করেছে। দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ, অন্যান্য কর্মকর্তা এবং স্টাফদের সৎ ও সুষ্ঠুভাবে কাজ করার পরিবেশ কতটুকু রক্ষা করবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। দুর্নীতি দমনে দেশের জন্য এ এক উদ্বেগজনক ঘটনা বটে।

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, শরীফ যথাযথ নিয়ম মেনে কাজ করেননি। নিয়ম অমান্য করেও যদি তিনি দুর্নীতির কোনো তথ্য উদ্‌ঘাটন করে থাকেন, কর্তৃপক্ষ কি অন্য কোনো দক্ষ কর্মকর্তা দিয়ে শরীফের উত্থাপিত তথ্যগুলো যাচাই করে দেখেছে? শরীফের উত্থাপিত দুর্নীতির তথ্য যাচাই-বাছাই করে সেগুলো যে ভুল বা মিথ্যা—এমন প্রমাণ কি তারা পেয়েছে? দুর্নীতি দমনে দুদকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক আছে। তাদের অনেক কর্মকাণ্ডই দেশের স্বার্থের পক্ষে যায় না বলে কেউ কেউ মনে করেন। অনেক সময় দেখা গেছে, অতীতে দেশের অনেক বড় দুর্নীতির বিষয়ে দুদক শীতল আচরণ করেছে। যে কারণে মানুষ মনে করে, দুদক আসলে কাদের স্বার্থে কাজ করে? দেশ, না বিশেষ কোনো মহলের? দুদক শরীফের মতো সৎ ও নিরীহ ব্যক্তির চাকরি খেলেও; দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত অর্থ কেলেঙ্কারির ইস্যু, বেসিক ব্যাংকের তদন্তের সমাপ্তি টানতে পারে না। বেসিক ব্যাংক ইস্যু দুদকের জন্য উভয়সংকট কি না, দেশবাসী সেই রহস্য বুঝতে পারছে না।

বিজ্ঞজনের অনেকেরই ধারণা, তদন্ত করতে গিয়ে বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সঙ্গে এমন কোনো রাঘববোয়ালের সন্ধান পেয়েছে, দুদক আর এ বিষয়ে এগোতে চাইছে না।

দুদকের দুর্বলতায় হোক কিংবা অপারগতায়, ভালোই আছেন ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দুষ্কৃতকারীরা। দেশের আর্থিক খাতে লুটেরার আলোচিত তিন নাম আবদুল হাই বাচ্চু, মো. আব্দুল আজিজ ও প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার)। একসময় দেশের ভালো ব্যাংকের তকমা লাগানো বেসিক ব্যাংক আবদুল হাই বাচ্চু চেয়ারম্যান থাকাকালেই ধসে পড়েছে। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে প্রতারণার মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার মো. আব্দুল আজিজ। দেশের পুঁজিবাজার এবং অন্তত চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লুট করে দুদকসহ অন্যান্য সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশত্যাগ করেছেন পি কে হালদার। অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে এই তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্ত ও অনুসন্ধান চলমান রেখেছে দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থা। দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এসব দুর্নীতিবাজ। পি কে হালদার অবশ্য ভারতে গ্রেপ্তার হয়ে বিচারাধীন আছেন। বিদেশ গমনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরও দুদকের গাফিলতিতে পি কে হালদার দেশত্যাগ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। যেসব কর্মকর্তার দুর্বলতা ও গাফিলতির জন্য পি কে হালদার দেশত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদক কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা নেই।

পি কে হালদার দেশত্যাগের পর শোনা গিয়েছিল দেশের ক্ষমতাবানদের আশীর্বাদের সুযোগ নিয়ে তিনি নাকি দেশত্যাগ করেছিলেন। আর্থিক খাতের আরেক দুষ্কৃতকারী মো. আব্দুল আজিজের বর্তমান অবস্থান কানাডায়। তবে বেশ কয়েকবার তিনি নাকি দেশে এসে ঘুরে গেছেন শোনা যায়। যদিও বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আছে তাঁর ক্ষেত্রেও। বেসিক ব্যাংকের বাচ্চু সপরিবারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন নিউইয়র্ক-লন্ডনে। যখন খুশি, তখন তিনি দেশেও আসেন বলে শোনা যায়।

দুদক চাইলেই কি তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে? এ জন্য ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা দরকার। এসব অর্থ লুটেরা যেসব দেশে অবস্থান করছেন, সেই সব দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাঁদের পাসপোর্ট বাতিল করতে হবে; একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাঁদের ভিসা বাতিল করে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। কূটনৈতিক জোর থাকলে এটা করা সম্ভব। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। ভারতের পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে আনুমানিক ১৩ হাজার কোটি থাকা লোপাট করেছিলেন সে দেশের ডায়মন্ড ব্যবসায়ী নীরব মোদি। তাঁকে ধরার জন্য দেশব্যাপী জারি করা হয়েছিল জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, বিদেশে ইন্টারপোলের রেড নোটিশও জারি করা হয়েছিল। অতঃপর নীরব মোদিকে গ্রেপ্তার করে লন্ডনের ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ড কারাগারে ঢোকানো সম্ভব হয়েছিল। নীরব মোদির পেছনে সে দেশের ক্ষমতাধর কোনো পৃষ্ঠপোষক ছিল না।

তাই এটা সম্ভব হয়েছিল বলে অনেকে বলে থাকেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশে এটা কি সম্ভব? আর্থিক খাতের এই লুটেরা গোষ্ঠী একা এই অর্থ লোপাট করে সম্পূর্ণ হজম করে ফেলবে—এটা বিশ্বাস করতেও কেন যেন খটকা লাগে? তাঁদের পেছনে ক্ষমতাধর কোনো না কোনো রাঘববোয়াল জড়িত থাকে বলে বিশ্বাস। এযাবৎ ঘটে যাওয়া আর্থিক খাতের দুর্নীতির ঘটনা বিশ্লেষণ করে সহজেই বলা যায়, আমাদের দেশে বড় কোনো দুর্নীতি পৃষ্ঠপোষকদের আশীর্বাদ ছাড়া সম্ভব নয়। রাঘববোয়ালেরা পৃষ্ঠপোষকতা করে বলেই শরীফ উদ্দিনের মতো সৎ, সাহসী কর্মকর্তাদের ভালো কাজ করার পরও, চাকরি হারিয়ে দোকানদারি করে জীবন নির্বাহ করতে হয়। শরীফ উদ্দিন, চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্য আদালতে বিচার প্রার্থনা করেছেন। আমাদের প্রত্যাশা, সেখানে তিনি সুবিচার পাবেন। সুবিচারের মাধ্যমে সৎ ও সত্য প্রতিষ্ঠিত হোক—এটাই আমাদের কামনা। তবে সেটা ঝুলিয়ে না রেখে যত দ্রুত সম্ভব হয়, ততই ভালো।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...