
সামিনা লুৎফা নিত্রা জুলাই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। ‘বটতলা’ নাট্য দলের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের অর্জন-ব্যর্থতা এবং রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আপনি একাত্ম ছিলেন। এক বছর পর এই আন্দোলনের অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগের সব রকম গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়া—পুরো বিষয়টা একটা অর্জন। কিন্তু এসব ছাড়া আর কোনো অর্জন তেমন একটা নেই।
বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা যেটা খুঁজেও পাচ্ছি না—অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াটা ছিল জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে কয়েকটি কারফিউ ভেঙেছি এবং প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, আমরা বারবার বলেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যাঁরা আহত হয়েছেন এবং যাঁদের আন্দোলনের সময় আটক করা হয়েছে, তাঁদের মামলাগুলোকে ঠিকভাবে দেখতে হবে। আহতদের সঠিক চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতিটা পদে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো জুলাইয়ের নিহতদের তালিকায় শুধু ৮০০ জনের নাম পাওয়া গেছে। অথচ জাতিসংঘের গবেষণায় সেটার সংখ্যা ১৪০০। সরকার এক বছরে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারল না। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? তাঁদের জীবনের বিনিময়ে অনেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। আন্দোলনে যুক্ত না হয়েও কেউ কেউ সরকারের পার্ট হয়েছেন।
বাংলাদেশ তো আসলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বাইরে না। সেই জায়গা থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা ভেঙে গেছে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যখন একজন ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা কূটনৈতিকভাবেও অদ্ভুত ব্যাপার। এটাও ব্যর্থতা। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের অবজেকটিভ সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটা সরকার তৈরি করতে পারেনি।
সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। বাজারে পণ্যের দামে একটা প্রবল ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সেটা সরকারের একটা অর্জন। তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার হলো, জুলাই আন্দোলনের মামলা নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে। শত শত অজ্ঞাত এবং অপরাধী নয়, এ রকম মানুষদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অপরাধীরা যাঁদের ছবি ও ভিডিও আছে তাঁরা বহাল তবিয়তে পাশের দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে চলে গেছেন। আবার তাঁরাই সেখান থেকে নানা ধরনের কাণ্ডকারখানা করছেন। যদি এই মানুষগুলোকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিচারের আওতায় আনা যেত, তাহলে তাঁরা বিদেশে বসে যে অ্যাকটিভিজম করছেন, সেটা এত সহজে সম্ভব হতো না।
দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক ছিলেন, যাঁরা ভয়াবহ নিপীড়নেও একটা টুঁ শব্দ করেননি এবং এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদেরও কোনো ধরনের অনুশোচনা হয়নি। আসলে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না যে সঠিকভাবে বিচারটা শুরু হয়েছে। ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলেশনে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা শুধু ভাঙাভাঙি দেখছি। আমরা বুঝতে পারছি, আলটিমেটলি জননিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে যখন বৈধতা দেওয়া হয়, তখন এই সহিংসতা নিজের বিরুদ্ধে হবে, তখন কিছু বলার আর থাকে না। মূল সমস্যাটা হলো বিচার। সরকার সেটা করছে না কেন? সঠিক পদ্ধতি না মেনে একদল মানুষ যখন বিচার করতে বসেন, সে অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? আগস্টের ৫ তারিখে ভাস্কর্য ভাঙা, বত্রিশ বা গণভবন ভাঙা ছিল আন্দোলনকারী জনতার রোষ। কিন্তু সাত-আট মাস পর যখন ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা, বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের সামনে জেয়াফত করা—সেটা তো সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর সবগুলো ঘটনা সরকারের ব্যর্থতার কারণে ঘটেছে।
জুলাই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না, বরং এটাকে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান বলা যায়। রেজিম পরিবর্তনের পরে সামাজিক শক্তিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কেন?
সামাজিক শক্তির একতা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডগুলো থামানোর জন্য। আর হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল একটা জায়গা থেকে। মানে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার এবং তার বাহিনী দ্বারা। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। সেই বাহিনীগুলো আবার দলীয় প্রভাবে পরিচালিত হয়েছে। সেই জায়গায় পুরো দেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। এখন কিন্তু সবাই সবার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন। সে জন্য অনেকের অনেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষার কারণে যে যত বেশি স্কোর করতে পারে সেই স্কোরের খেলায় সবাই সবার বিরুদ্ধে লেগে গেছে। যাঁরা জুলাইয়ে রাস্তায় ছিলেন তাঁদের কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁদের অনুভূতিটা কী? সরকারের কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করেনি।
আমি নিজেই তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে শামিল ছিলেন। সবার মধ্যে প্রবল বোধ তৈরি হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে তাঁদের কেউ গোনার মধ্যে রাখেনি এবং তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। তাঁদের যে ভয়াবহ আন্দোলনের ট্রমা আছে, সেই ট্রমাটা যদি কেউ ড্রিল না করে তাহলে সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ জাগ্রত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘ফিলিং অব এলিয়েনেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতার বোধ’। পাশাপাশি শিকড় ছেড়া অবস্থা তৈরি হয়। তাঁরা কিছু পেয়েছে কি পায়নি, তার চেয়েও বড় কথা হলো, তাঁরা সমাজের সঙ্গে যুক্ততা বোধ করছেন না এখন আর। কারণ, এত বড় ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জনগোষ্ঠীকে যখন মূল্য দেওয়া হয় না এবং তাদের চরকিনাচনের মধ্যে রাখা হয়, তাদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তখন অস্বাভাবিক দিকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আহত-নিহতদের দায়িত্ব না নেওয়ার দায়টা আসলে কার?
প্রথম দায়টা হলো সরকারের। দ্বিতীয় দায় হলো গণ-অভ্যুত্থানের ফলভোগী দলগুলোরও।
এই গণ-অভ্যুত্থান একটা বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ এনেছিল, সে সুযোগটা হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ। তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছিল সেটাকে সবচেয়ে অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। আর রাজনৈতিক দলগুলোর বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হলে তারা কী করবে! যদিও তারা এখন ক্রেডিটের দাবি তুলছে। এই ক্রেডিটের দাবি নিয়ে তারা আবার সবাই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। সবকিছুই কিন্তু প্রবলভাবে ক্ষতটাকে আরও খুঁচিয়েছে। তারা আবার পুরোনো বন্দোবস্তের রাস্তায় হাঁটছে। তারা ভাবছেই না এখানে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা জাগ্রত সচেতনতার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানো দরকার। তারা এই জাগ্রত অবস্থাটাকে আবার কীভাবে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ফর্মুলা নিয়ে সারাক্ষণ জপছে। দর্শক হিসেবে আমার এসবই মনে হয়।
অসংখ্য তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তারা কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে। এই সচেতন ছেলেমেয়েগুলোকে স্পেস দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আসলে তাদের কোনো ভাবনা ও প্রস্তুতিই নেই। সত্যিই তাদের গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই, যে গণতন্ত্রে দলগুলোকে কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। কারণ, শিক্ষার্থীরা তো সবাইকে প্রশ্ন করছিল। এখনো তারা সেটা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় রাজনৈতিক দলগুলো। এ কারণে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তেমন কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা মনে করছেন তাঁরা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছেন বা ক্ষমতায় অলরেডি চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু সাড়া পেলেও বেশির ভাগ তরুণ দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে।
এই তরুণদের প্রচণ্ড শক্তিকে দেশের কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। তারা যেভাবে ট্রাফিকব্যবস্থা, বন্যা পরিস্থিতি এবং ডাকাতি অবস্থাকে ট্যাকেল করল—প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা কিন্তু তাদের কর্তব্যটা পালন করেছে। তারা তাদের কর্তব্যের চেয়ে বেশি পালন করেছে। এই তরুণদের চেয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর সামর্থ্য বেশি তারা কিন্তু তরুণদের কাজে লাগাতে পারেনি। এই জায়গা থেকে আমি বলব, আসলেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটা স্লিপ করে গেছে। তারা সংস্কার নিয়ে এক জিনিসের মধ্যে যে আটকে আছে, সেখান থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ জনগণ এখনো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে আছে। তারা প্রবল বাধার মুখেও কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তাদের মতামতটা ব্যক্ত করতে চাচ্ছে। এগুলো সবই ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু তাদের যে সহযোগিতা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পায়নি। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই শক্তিকে বুঝতেই পারছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কেন কিছু করতে পারছে না?
সরকার কেন পারছে না, সেটা তো উপদেষ্টাদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। কারণ, বেশির ভাগ উপদেষ্টার ব্যাকগ্রাউন্ড হলো এনজিও। তাঁরা তো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে দায়িত্ব নেননি। তাঁরা তো নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য গেছেন। এখন তাঁরা আরও সময় নিচ্ছেন, সেটা তো অন্য হিসাব। আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের সে জায়গায় নিয়ে গেছে।
প্রথম থেকে কি এ সরকারকে মনে হয়েছে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যাবে? তারা তো আসলে নিউ লিবারেল ডেভলপমেন্টের অন্যতম মুখপাত্র। সে কারণে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইবে না। যেমন ধরুন, শিক্ষার্থীদের যে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। এই দল যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, সেটা তাদের ক্ষতি করছে। এনসিপির মধ্যে যদি বৈপ্লবিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, সেগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে। এখন তারা জনগণের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ছয় মাস আগে সেটা করা দরকার ছিল। আমি তাদের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বলেছিলাম, তাদের আসলে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যাওয়া উচিত। কিন্তু তখন তারা সরকারে চলে গেছে। তারা যে এক বছরের মধ্যে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যেতে পারল না, সেটা হতাশাজনক।
অভ্যুত্থানে নারীদের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখছি নারীরা বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এরপর মুরাদনগরে ভয়াবহ যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটল। কেন সরকার নারীদের সুরক্ষায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না?
সরকার বলছে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমরা নাকি সেসব দেখতে পাই না। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে পাশের দেশ থেকে একটা বিশাল ক্যাম্পেইন করা হয়েছে—‘শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে, দেশটা নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।’ সেই ক্যাম্পেইনের বিষয়টা স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, এখন যেকোনো ঘটনাকে বেশি করে প্রচারে আনা হয়। যেটা আগে তারা করত না, অন্য কেউ করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সমস্যা থাকার পরেও সরকারের উচিত ছিল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তারা যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সেটা নিয়ে পরিষ্কার করে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। যেমন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট যখন পেশ করা হলো, তখন প্রধান উপদেষ্টা বললেন, এটা একটা যুগান্তকারী দলিল, এটা সবার জন্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কিন্তু যেই মুহূর্তে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য শোনা যায়নি। সরকারই কিন্তু নারী কমিশনের জন্য সম্মানিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই নারীদের অপমানের শিকার হতে হলো। তার বিরুদ্ধে সরকার তো কিছু বলল না এবং করল না। এ দায় যে সরকারের সেটাও স্বীকার করল না। সরকার কি তাহলে তাদের ভয় পেয়েছে? না আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, সরকার ভয় পায়। এটা নিয়ে আমি একটু সন্দিহান। আমার কাছে মনে হয়, দুটোই হতে পারে।
যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে চিন্তার ব্যাপার। আর প্রথমটি হলে অন্য রকম চিন্তার ব্যাপার। দুটোই আসলে বাংলাদেশের নারীদের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ নারীদের জন্য সারভাইবালের বিষয়। আমার যা বয়স, আমাকে কেউ সাইবার বুলিং করলে আমি সেটাকে পাত্তা দেব না। কিন্তু ১৭, ১৮, ১৯ বছর বয়সের মেয়েদের যখন এটা করা হবে, সেটা তো তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ সাইবার স্পেসে বুলিংটা তো জনপরিসরে করা হয়ে থাকে। আর সেটা আবার থেকে যাচ্ছে। কারও যদি ডিপ ফেক ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটা থেকে যাচ্ছে। অনলাইনে অনেকে এ ধরনের ভিডিওকে আলাদা করতে পারে না। সে কারণে নারীটির সারা জীবনের জন্য ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সব কিছু নেতিবাচকতার দিকে চলে যায়। তাঁর পরিবার থেকে সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে থাকে।
এসবের পরেও যেসব নারী রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, তাঁদের স্যালুট জানাই। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এটা একমাত্র দেশের নারীদের অর্জন। এত কিছুর পরেও তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে এ রকম সক্রিয় নারীদের অংশগ্রহণ এর আগে আমরা কিন্তু দেখিনি। সব আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও এভাবে আর কখনো নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়নি।
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, দেশে আবার দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
সেটা তো আসতেই পারে। তবে এর দায়টা আসলে সবার। আমরা সবাই পদপদবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। যেই মুহূর্তে পদপদবি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলো, সেই সময়ে এ-ওর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিল। আওয়ামী লীগের লোকের বিরুদ্ধে নয় কিন্তু, নিজেরা নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে। কারণ, তখন ‘কলঙ্কিতকরণ’ পদ্ধতিটাকে ব্যবহার করা হলো। আপনি যখন নিজের সহযোদ্ধাকে কলঙ্কিত করছেন, যাতে তিনি কোনো পদপদবি না পান। এর চেয়ে সুবিধাজনক সময় ফ্যাসিবাদের কাছে কী থাকতে পারে? কারণ, বিগত সরকার তার আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কাঠামো রেখে গেছে। কিন্তু সেই কাঠামোকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
আর এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের সমাজ তৈরি ছিল না। সরকার গঠনের আগে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। আর এলিটরা তো সেই কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইবে না। সে জন্য বলছি, বিগত সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেগুলো তৈরি করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আগে যেমন আওয়ামী লীগ করার জন্য সবকিছু পাওয়া যেত, এখন সেখানে আওয়ামী লীগ করেন না, সেটা প্রমাণ করতে পারলে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছেন। কেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা গেল না, সেই দায় এই সুবিধাভোগীদের। কিন্তু বেশি দায় হলো সরকারের—যারা সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু সময়টা পার করল, কিন্তু কোনোভাবেই আসল কাজটি করল না।
জুলাই আন্দোলনের চেতনা কেন আমরা ধরে রাখতে পারলাম না?
জুলাই আন্দোলনের চেতনাটা আসলে কী? সেটাও তো আমরা সবাই জানি না। কারণ, সে সময় তো এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমরা সবাই চেয়েছি হত্যাকাণ্ড থামানো এবং শেখ হাসিনার পতন। দিন দিন সরকার বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে এবং আরও বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু এইবার যখন এত বেশি ফোর্স প্রয়োগ করার পরেও মানুষ মনে করেছে হাসিনাকে সরাতে পারলে হত্যাকাণ্ড থামানো যাবে। তাঁকে হটানো ছাড়া এর বেশি কোনো চিন্তা কারও মধ্যে ছিল না।
তবে আমি দেখেছিলাম, জুলাই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে সময় দেয়ালে যেসব কথাবার্তা লিখেছে বা ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়েছে, সেখানে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাদের কাছে ইনক্লুসিভনেসের কথা ছিল। তারা বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য মুক্তির কথা বলেছে। আমরা আসলেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন এবং ইনক্লুসিভনেসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হারিয়ে গেছে। কারণ, ৫ আগস্টের পর আমরা দেখলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষাটা এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম ৩ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল। এদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে—এ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? আমার মনে হয়, এ পরিস্থিতিটাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার এদের গুরুত্ব হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কারও শক্তি থাকতে পারে। এদের পেছনে আসলে দেশের মধ্যে বা বাইরের কোনো শক্তি বা উত্তর পাড়ার ইন্ধন থাকতে পারে কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার কাছে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাটাই আমার চাওয়া ছিল।
আর একটা কথা, জুলাই চেতনাকে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শবোধ দ্বারা দেখতে চেয়েছি। এ কারণে কারও সঙ্গে কারওটা মেলেনি। অনেকে হয়তো বলতে পারে, আমরা প্রতারিত হয়েছি। আসলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর মানুষ তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে।
আর ডানপন্থী ফ্যাসিবাদ আসার যে আশঙ্কার কথা বললেন, সেটা তো সারা বিশ্বে এসেছে। তবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে আমি বলতে চাই, যারা এ ধরনের ফ্যাসিবাদ চান না এবং যাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি ছিলেন, তাঁদের সবার উচিত একটা প্ল্যাটফর্মে আসা, আমরা যাতে পরের ধাপে অগ্রসর হতে পারি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আপনি একাত্ম ছিলেন। এক বছর পর এই আন্দোলনের অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগের সব রকম গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়া—পুরো বিষয়টা একটা অর্জন। কিন্তু এসব ছাড়া আর কোনো অর্জন তেমন একটা নেই।
বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা যেটা খুঁজেও পাচ্ছি না—অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াটা ছিল জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে কয়েকটি কারফিউ ভেঙেছি এবং প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, আমরা বারবার বলেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যাঁরা আহত হয়েছেন এবং যাঁদের আন্দোলনের সময় আটক করা হয়েছে, তাঁদের মামলাগুলোকে ঠিকভাবে দেখতে হবে। আহতদের সঠিক চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতিটা পদে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো জুলাইয়ের নিহতদের তালিকায় শুধু ৮০০ জনের নাম পাওয়া গেছে। অথচ জাতিসংঘের গবেষণায় সেটার সংখ্যা ১৪০০। সরকার এক বছরে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারল না। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? তাঁদের জীবনের বিনিময়ে অনেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। আন্দোলনে যুক্ত না হয়েও কেউ কেউ সরকারের পার্ট হয়েছেন।
বাংলাদেশ তো আসলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বাইরে না। সেই জায়গা থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা ভেঙে গেছে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যখন একজন ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা কূটনৈতিকভাবেও অদ্ভুত ব্যাপার। এটাও ব্যর্থতা। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের অবজেকটিভ সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটা সরকার তৈরি করতে পারেনি।
সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। বাজারে পণ্যের দামে একটা প্রবল ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সেটা সরকারের একটা অর্জন। তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার হলো, জুলাই আন্দোলনের মামলা নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে। শত শত অজ্ঞাত এবং অপরাধী নয়, এ রকম মানুষদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অপরাধীরা যাঁদের ছবি ও ভিডিও আছে তাঁরা বহাল তবিয়তে পাশের দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে চলে গেছেন। আবার তাঁরাই সেখান থেকে নানা ধরনের কাণ্ডকারখানা করছেন। যদি এই মানুষগুলোকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিচারের আওতায় আনা যেত, তাহলে তাঁরা বিদেশে বসে যে অ্যাকটিভিজম করছেন, সেটা এত সহজে সম্ভব হতো না।
দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক ছিলেন, যাঁরা ভয়াবহ নিপীড়নেও একটা টুঁ শব্দ করেননি এবং এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদেরও কোনো ধরনের অনুশোচনা হয়নি। আসলে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না যে সঠিকভাবে বিচারটা শুরু হয়েছে। ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলেশনে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা শুধু ভাঙাভাঙি দেখছি। আমরা বুঝতে পারছি, আলটিমেটলি জননিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে যখন বৈধতা দেওয়া হয়, তখন এই সহিংসতা নিজের বিরুদ্ধে হবে, তখন কিছু বলার আর থাকে না। মূল সমস্যাটা হলো বিচার। সরকার সেটা করছে না কেন? সঠিক পদ্ধতি না মেনে একদল মানুষ যখন বিচার করতে বসেন, সে অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? আগস্টের ৫ তারিখে ভাস্কর্য ভাঙা, বত্রিশ বা গণভবন ভাঙা ছিল আন্দোলনকারী জনতার রোষ। কিন্তু সাত-আট মাস পর যখন ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা, বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের সামনে জেয়াফত করা—সেটা তো সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর সবগুলো ঘটনা সরকারের ব্যর্থতার কারণে ঘটেছে।
জুলাই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না, বরং এটাকে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান বলা যায়। রেজিম পরিবর্তনের পরে সামাজিক শক্তিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কেন?
সামাজিক শক্তির একতা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডগুলো থামানোর জন্য। আর হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল একটা জায়গা থেকে। মানে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার এবং তার বাহিনী দ্বারা। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। সেই বাহিনীগুলো আবার দলীয় প্রভাবে পরিচালিত হয়েছে। সেই জায়গায় পুরো দেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। এখন কিন্তু সবাই সবার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন। সে জন্য অনেকের অনেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষার কারণে যে যত বেশি স্কোর করতে পারে সেই স্কোরের খেলায় সবাই সবার বিরুদ্ধে লেগে গেছে। যাঁরা জুলাইয়ে রাস্তায় ছিলেন তাঁদের কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁদের অনুভূতিটা কী? সরকারের কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করেনি।
আমি নিজেই তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে শামিল ছিলেন। সবার মধ্যে প্রবল বোধ তৈরি হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে তাঁদের কেউ গোনার মধ্যে রাখেনি এবং তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। তাঁদের যে ভয়াবহ আন্দোলনের ট্রমা আছে, সেই ট্রমাটা যদি কেউ ড্রিল না করে তাহলে সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ জাগ্রত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘ফিলিং অব এলিয়েনেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতার বোধ’। পাশাপাশি শিকড় ছেড়া অবস্থা তৈরি হয়। তাঁরা কিছু পেয়েছে কি পায়নি, তার চেয়েও বড় কথা হলো, তাঁরা সমাজের সঙ্গে যুক্ততা বোধ করছেন না এখন আর। কারণ, এত বড় ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জনগোষ্ঠীকে যখন মূল্য দেওয়া হয় না এবং তাদের চরকিনাচনের মধ্যে রাখা হয়, তাদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তখন অস্বাভাবিক দিকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আহত-নিহতদের দায়িত্ব না নেওয়ার দায়টা আসলে কার?
প্রথম দায়টা হলো সরকারের। দ্বিতীয় দায় হলো গণ-অভ্যুত্থানের ফলভোগী দলগুলোরও।
এই গণ-অভ্যুত্থান একটা বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ এনেছিল, সে সুযোগটা হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ। তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছিল সেটাকে সবচেয়ে অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। আর রাজনৈতিক দলগুলোর বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হলে তারা কী করবে! যদিও তারা এখন ক্রেডিটের দাবি তুলছে। এই ক্রেডিটের দাবি নিয়ে তারা আবার সবাই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। সবকিছুই কিন্তু প্রবলভাবে ক্ষতটাকে আরও খুঁচিয়েছে। তারা আবার পুরোনো বন্দোবস্তের রাস্তায় হাঁটছে। তারা ভাবছেই না এখানে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা জাগ্রত সচেতনতার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানো দরকার। তারা এই জাগ্রত অবস্থাটাকে আবার কীভাবে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ফর্মুলা নিয়ে সারাক্ষণ জপছে। দর্শক হিসেবে আমার এসবই মনে হয়।
অসংখ্য তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তারা কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে। এই সচেতন ছেলেমেয়েগুলোকে স্পেস দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আসলে তাদের কোনো ভাবনা ও প্রস্তুতিই নেই। সত্যিই তাদের গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই, যে গণতন্ত্রে দলগুলোকে কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। কারণ, শিক্ষার্থীরা তো সবাইকে প্রশ্ন করছিল। এখনো তারা সেটা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় রাজনৈতিক দলগুলো। এ কারণে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তেমন কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা মনে করছেন তাঁরা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছেন বা ক্ষমতায় অলরেডি চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু সাড়া পেলেও বেশির ভাগ তরুণ দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে।
এই তরুণদের প্রচণ্ড শক্তিকে দেশের কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। তারা যেভাবে ট্রাফিকব্যবস্থা, বন্যা পরিস্থিতি এবং ডাকাতি অবস্থাকে ট্যাকেল করল—প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা কিন্তু তাদের কর্তব্যটা পালন করেছে। তারা তাদের কর্তব্যের চেয়ে বেশি পালন করেছে। এই তরুণদের চেয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর সামর্থ্য বেশি তারা কিন্তু তরুণদের কাজে লাগাতে পারেনি। এই জায়গা থেকে আমি বলব, আসলেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটা স্লিপ করে গেছে। তারা সংস্কার নিয়ে এক জিনিসের মধ্যে যে আটকে আছে, সেখান থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ জনগণ এখনো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে আছে। তারা প্রবল বাধার মুখেও কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তাদের মতামতটা ব্যক্ত করতে চাচ্ছে। এগুলো সবই ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু তাদের যে সহযোগিতা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পায়নি। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই শক্তিকে বুঝতেই পারছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কেন কিছু করতে পারছে না?
সরকার কেন পারছে না, সেটা তো উপদেষ্টাদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। কারণ, বেশির ভাগ উপদেষ্টার ব্যাকগ্রাউন্ড হলো এনজিও। তাঁরা তো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে দায়িত্ব নেননি। তাঁরা তো নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য গেছেন। এখন তাঁরা আরও সময় নিচ্ছেন, সেটা তো অন্য হিসাব। আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের সে জায়গায় নিয়ে গেছে।
প্রথম থেকে কি এ সরকারকে মনে হয়েছে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যাবে? তারা তো আসলে নিউ লিবারেল ডেভলপমেন্টের অন্যতম মুখপাত্র। সে কারণে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইবে না। যেমন ধরুন, শিক্ষার্থীদের যে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। এই দল যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, সেটা তাদের ক্ষতি করছে। এনসিপির মধ্যে যদি বৈপ্লবিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, সেগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে। এখন তারা জনগণের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ছয় মাস আগে সেটা করা দরকার ছিল। আমি তাদের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বলেছিলাম, তাদের আসলে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যাওয়া উচিত। কিন্তু তখন তারা সরকারে চলে গেছে। তারা যে এক বছরের মধ্যে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যেতে পারল না, সেটা হতাশাজনক।
অভ্যুত্থানে নারীদের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখছি নারীরা বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এরপর মুরাদনগরে ভয়াবহ যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটল। কেন সরকার নারীদের সুরক্ষায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না?
সরকার বলছে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমরা নাকি সেসব দেখতে পাই না। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে পাশের দেশ থেকে একটা বিশাল ক্যাম্পেইন করা হয়েছে—‘শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে, দেশটা নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।’ সেই ক্যাম্পেইনের বিষয়টা স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, এখন যেকোনো ঘটনাকে বেশি করে প্রচারে আনা হয়। যেটা আগে তারা করত না, অন্য কেউ করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সমস্যা থাকার পরেও সরকারের উচিত ছিল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তারা যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সেটা নিয়ে পরিষ্কার করে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। যেমন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট যখন পেশ করা হলো, তখন প্রধান উপদেষ্টা বললেন, এটা একটা যুগান্তকারী দলিল, এটা সবার জন্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কিন্তু যেই মুহূর্তে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য শোনা যায়নি। সরকারই কিন্তু নারী কমিশনের জন্য সম্মানিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই নারীদের অপমানের শিকার হতে হলো। তার বিরুদ্ধে সরকার তো কিছু বলল না এবং করল না। এ দায় যে সরকারের সেটাও স্বীকার করল না। সরকার কি তাহলে তাদের ভয় পেয়েছে? না আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, সরকার ভয় পায়। এটা নিয়ে আমি একটু সন্দিহান। আমার কাছে মনে হয়, দুটোই হতে পারে।
যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে চিন্তার ব্যাপার। আর প্রথমটি হলে অন্য রকম চিন্তার ব্যাপার। দুটোই আসলে বাংলাদেশের নারীদের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ নারীদের জন্য সারভাইবালের বিষয়। আমার যা বয়স, আমাকে কেউ সাইবার বুলিং করলে আমি সেটাকে পাত্তা দেব না। কিন্তু ১৭, ১৮, ১৯ বছর বয়সের মেয়েদের যখন এটা করা হবে, সেটা তো তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ সাইবার স্পেসে বুলিংটা তো জনপরিসরে করা হয়ে থাকে। আর সেটা আবার থেকে যাচ্ছে। কারও যদি ডিপ ফেক ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটা থেকে যাচ্ছে। অনলাইনে অনেকে এ ধরনের ভিডিওকে আলাদা করতে পারে না। সে কারণে নারীটির সারা জীবনের জন্য ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সব কিছু নেতিবাচকতার দিকে চলে যায়। তাঁর পরিবার থেকে সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে থাকে।
এসবের পরেও যেসব নারী রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, তাঁদের স্যালুট জানাই। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এটা একমাত্র দেশের নারীদের অর্জন। এত কিছুর পরেও তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে এ রকম সক্রিয় নারীদের অংশগ্রহণ এর আগে আমরা কিন্তু দেখিনি। সব আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও এভাবে আর কখনো নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়নি।
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, দেশে আবার দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
সেটা তো আসতেই পারে। তবে এর দায়টা আসলে সবার। আমরা সবাই পদপদবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। যেই মুহূর্তে পদপদবি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলো, সেই সময়ে এ-ওর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিল। আওয়ামী লীগের লোকের বিরুদ্ধে নয় কিন্তু, নিজেরা নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে। কারণ, তখন ‘কলঙ্কিতকরণ’ পদ্ধতিটাকে ব্যবহার করা হলো। আপনি যখন নিজের সহযোদ্ধাকে কলঙ্কিত করছেন, যাতে তিনি কোনো পদপদবি না পান। এর চেয়ে সুবিধাজনক সময় ফ্যাসিবাদের কাছে কী থাকতে পারে? কারণ, বিগত সরকার তার আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কাঠামো রেখে গেছে। কিন্তু সেই কাঠামোকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
আর এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের সমাজ তৈরি ছিল না। সরকার গঠনের আগে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। আর এলিটরা তো সেই কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইবে না। সে জন্য বলছি, বিগত সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেগুলো তৈরি করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আগে যেমন আওয়ামী লীগ করার জন্য সবকিছু পাওয়া যেত, এখন সেখানে আওয়ামী লীগ করেন না, সেটা প্রমাণ করতে পারলে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছেন। কেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা গেল না, সেই দায় এই সুবিধাভোগীদের। কিন্তু বেশি দায় হলো সরকারের—যারা সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু সময়টা পার করল, কিন্তু কোনোভাবেই আসল কাজটি করল না।
জুলাই আন্দোলনের চেতনা কেন আমরা ধরে রাখতে পারলাম না?
জুলাই আন্দোলনের চেতনাটা আসলে কী? সেটাও তো আমরা সবাই জানি না। কারণ, সে সময় তো এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমরা সবাই চেয়েছি হত্যাকাণ্ড থামানো এবং শেখ হাসিনার পতন। দিন দিন সরকার বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে এবং আরও বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু এইবার যখন এত বেশি ফোর্স প্রয়োগ করার পরেও মানুষ মনে করেছে হাসিনাকে সরাতে পারলে হত্যাকাণ্ড থামানো যাবে। তাঁকে হটানো ছাড়া এর বেশি কোনো চিন্তা কারও মধ্যে ছিল না।
তবে আমি দেখেছিলাম, জুলাই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে সময় দেয়ালে যেসব কথাবার্তা লিখেছে বা ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়েছে, সেখানে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাদের কাছে ইনক্লুসিভনেসের কথা ছিল। তারা বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য মুক্তির কথা বলেছে। আমরা আসলেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন এবং ইনক্লুসিভনেসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হারিয়ে গেছে। কারণ, ৫ আগস্টের পর আমরা দেখলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষাটা এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম ৩ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল। এদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে—এ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? আমার মনে হয়, এ পরিস্থিতিটাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার এদের গুরুত্ব হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কারও শক্তি থাকতে পারে। এদের পেছনে আসলে দেশের মধ্যে বা বাইরের কোনো শক্তি বা উত্তর পাড়ার ইন্ধন থাকতে পারে কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার কাছে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাটাই আমার চাওয়া ছিল।
আর একটা কথা, জুলাই চেতনাকে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শবোধ দ্বারা দেখতে চেয়েছি। এ কারণে কারও সঙ্গে কারওটা মেলেনি। অনেকে হয়তো বলতে পারে, আমরা প্রতারিত হয়েছি। আসলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর মানুষ তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে।
আর ডানপন্থী ফ্যাসিবাদ আসার যে আশঙ্কার কথা বললেন, সেটা তো সারা বিশ্বে এসেছে। তবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে আমি বলতে চাই, যারা এ ধরনের ফ্যাসিবাদ চান না এবং যাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি ছিলেন, তাঁদের সবার উচিত একটা প্ল্যাটফর্মে আসা, আমরা যাতে পরের ধাপে অগ্রসর হতে পারি।

সামিনা লুৎফা নিত্রা জুলাই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। ‘বটতলা’ নাট্য দলের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের অর্জন-ব্যর্থতা এবং রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আপনি একাত্ম ছিলেন। এক বছর পর এই আন্দোলনের অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগের সব রকম গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়া—পুরো বিষয়টা একটা অর্জন। কিন্তু এসব ছাড়া আর কোনো অর্জন তেমন একটা নেই।
বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা যেটা খুঁজেও পাচ্ছি না—অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াটা ছিল জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে কয়েকটি কারফিউ ভেঙেছি এবং প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, আমরা বারবার বলেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যাঁরা আহত হয়েছেন এবং যাঁদের আন্দোলনের সময় আটক করা হয়েছে, তাঁদের মামলাগুলোকে ঠিকভাবে দেখতে হবে। আহতদের সঠিক চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতিটা পদে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো জুলাইয়ের নিহতদের তালিকায় শুধু ৮০০ জনের নাম পাওয়া গেছে। অথচ জাতিসংঘের গবেষণায় সেটার সংখ্যা ১৪০০। সরকার এক বছরে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারল না। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? তাঁদের জীবনের বিনিময়ে অনেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। আন্দোলনে যুক্ত না হয়েও কেউ কেউ সরকারের পার্ট হয়েছেন।
বাংলাদেশ তো আসলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বাইরে না। সেই জায়গা থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা ভেঙে গেছে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যখন একজন ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা কূটনৈতিকভাবেও অদ্ভুত ব্যাপার। এটাও ব্যর্থতা। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের অবজেকটিভ সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটা সরকার তৈরি করতে পারেনি।
সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। বাজারে পণ্যের দামে একটা প্রবল ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সেটা সরকারের একটা অর্জন। তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার হলো, জুলাই আন্দোলনের মামলা নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে। শত শত অজ্ঞাত এবং অপরাধী নয়, এ রকম মানুষদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অপরাধীরা যাঁদের ছবি ও ভিডিও আছে তাঁরা বহাল তবিয়তে পাশের দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে চলে গেছেন। আবার তাঁরাই সেখান থেকে নানা ধরনের কাণ্ডকারখানা করছেন। যদি এই মানুষগুলোকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিচারের আওতায় আনা যেত, তাহলে তাঁরা বিদেশে বসে যে অ্যাকটিভিজম করছেন, সেটা এত সহজে সম্ভব হতো না।
দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক ছিলেন, যাঁরা ভয়াবহ নিপীড়নেও একটা টুঁ শব্দ করেননি এবং এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদেরও কোনো ধরনের অনুশোচনা হয়নি। আসলে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না যে সঠিকভাবে বিচারটা শুরু হয়েছে। ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলেশনে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা শুধু ভাঙাভাঙি দেখছি। আমরা বুঝতে পারছি, আলটিমেটলি জননিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে যখন বৈধতা দেওয়া হয়, তখন এই সহিংসতা নিজের বিরুদ্ধে হবে, তখন কিছু বলার আর থাকে না। মূল সমস্যাটা হলো বিচার। সরকার সেটা করছে না কেন? সঠিক পদ্ধতি না মেনে একদল মানুষ যখন বিচার করতে বসেন, সে অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? আগস্টের ৫ তারিখে ভাস্কর্য ভাঙা, বত্রিশ বা গণভবন ভাঙা ছিল আন্দোলনকারী জনতার রোষ। কিন্তু সাত-আট মাস পর যখন ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা, বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের সামনে জেয়াফত করা—সেটা তো সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর সবগুলো ঘটনা সরকারের ব্যর্থতার কারণে ঘটেছে।
জুলাই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না, বরং এটাকে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান বলা যায়। রেজিম পরিবর্তনের পরে সামাজিক শক্তিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কেন?
সামাজিক শক্তির একতা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডগুলো থামানোর জন্য। আর হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল একটা জায়গা থেকে। মানে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার এবং তার বাহিনী দ্বারা। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। সেই বাহিনীগুলো আবার দলীয় প্রভাবে পরিচালিত হয়েছে। সেই জায়গায় পুরো দেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। এখন কিন্তু সবাই সবার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন। সে জন্য অনেকের অনেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষার কারণে যে যত বেশি স্কোর করতে পারে সেই স্কোরের খেলায় সবাই সবার বিরুদ্ধে লেগে গেছে। যাঁরা জুলাইয়ে রাস্তায় ছিলেন তাঁদের কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁদের অনুভূতিটা কী? সরকারের কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করেনি।
আমি নিজেই তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে শামিল ছিলেন। সবার মধ্যে প্রবল বোধ তৈরি হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে তাঁদের কেউ গোনার মধ্যে রাখেনি এবং তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। তাঁদের যে ভয়াবহ আন্দোলনের ট্রমা আছে, সেই ট্রমাটা যদি কেউ ড্রিল না করে তাহলে সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ জাগ্রত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘ফিলিং অব এলিয়েনেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতার বোধ’। পাশাপাশি শিকড় ছেড়া অবস্থা তৈরি হয়। তাঁরা কিছু পেয়েছে কি পায়নি, তার চেয়েও বড় কথা হলো, তাঁরা সমাজের সঙ্গে যুক্ততা বোধ করছেন না এখন আর। কারণ, এত বড় ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জনগোষ্ঠীকে যখন মূল্য দেওয়া হয় না এবং তাদের চরকিনাচনের মধ্যে রাখা হয়, তাদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তখন অস্বাভাবিক দিকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আহত-নিহতদের দায়িত্ব না নেওয়ার দায়টা আসলে কার?
প্রথম দায়টা হলো সরকারের। দ্বিতীয় দায় হলো গণ-অভ্যুত্থানের ফলভোগী দলগুলোরও।
এই গণ-অভ্যুত্থান একটা বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ এনেছিল, সে সুযোগটা হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ। তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছিল সেটাকে সবচেয়ে অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। আর রাজনৈতিক দলগুলোর বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হলে তারা কী করবে! যদিও তারা এখন ক্রেডিটের দাবি তুলছে। এই ক্রেডিটের দাবি নিয়ে তারা আবার সবাই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। সবকিছুই কিন্তু প্রবলভাবে ক্ষতটাকে আরও খুঁচিয়েছে। তারা আবার পুরোনো বন্দোবস্তের রাস্তায় হাঁটছে। তারা ভাবছেই না এখানে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা জাগ্রত সচেতনতার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানো দরকার। তারা এই জাগ্রত অবস্থাটাকে আবার কীভাবে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ফর্মুলা নিয়ে সারাক্ষণ জপছে। দর্শক হিসেবে আমার এসবই মনে হয়।
অসংখ্য তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তারা কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে। এই সচেতন ছেলেমেয়েগুলোকে স্পেস দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আসলে তাদের কোনো ভাবনা ও প্রস্তুতিই নেই। সত্যিই তাদের গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই, যে গণতন্ত্রে দলগুলোকে কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। কারণ, শিক্ষার্থীরা তো সবাইকে প্রশ্ন করছিল। এখনো তারা সেটা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় রাজনৈতিক দলগুলো। এ কারণে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তেমন কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা মনে করছেন তাঁরা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছেন বা ক্ষমতায় অলরেডি চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু সাড়া পেলেও বেশির ভাগ তরুণ দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে।
এই তরুণদের প্রচণ্ড শক্তিকে দেশের কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। তারা যেভাবে ট্রাফিকব্যবস্থা, বন্যা পরিস্থিতি এবং ডাকাতি অবস্থাকে ট্যাকেল করল—প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা কিন্তু তাদের কর্তব্যটা পালন করেছে। তারা তাদের কর্তব্যের চেয়ে বেশি পালন করেছে। এই তরুণদের চেয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর সামর্থ্য বেশি তারা কিন্তু তরুণদের কাজে লাগাতে পারেনি। এই জায়গা থেকে আমি বলব, আসলেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটা স্লিপ করে গেছে। তারা সংস্কার নিয়ে এক জিনিসের মধ্যে যে আটকে আছে, সেখান থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ জনগণ এখনো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে আছে। তারা প্রবল বাধার মুখেও কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তাদের মতামতটা ব্যক্ত করতে চাচ্ছে। এগুলো সবই ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু তাদের যে সহযোগিতা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পায়নি। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই শক্তিকে বুঝতেই পারছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কেন কিছু করতে পারছে না?
সরকার কেন পারছে না, সেটা তো উপদেষ্টাদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। কারণ, বেশির ভাগ উপদেষ্টার ব্যাকগ্রাউন্ড হলো এনজিও। তাঁরা তো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে দায়িত্ব নেননি। তাঁরা তো নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য গেছেন। এখন তাঁরা আরও সময় নিচ্ছেন, সেটা তো অন্য হিসাব। আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের সে জায়গায় নিয়ে গেছে।
প্রথম থেকে কি এ সরকারকে মনে হয়েছে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যাবে? তারা তো আসলে নিউ লিবারেল ডেভলপমেন্টের অন্যতম মুখপাত্র। সে কারণে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইবে না। যেমন ধরুন, শিক্ষার্থীদের যে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। এই দল যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, সেটা তাদের ক্ষতি করছে। এনসিপির মধ্যে যদি বৈপ্লবিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, সেগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে। এখন তারা জনগণের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ছয় মাস আগে সেটা করা দরকার ছিল। আমি তাদের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বলেছিলাম, তাদের আসলে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যাওয়া উচিত। কিন্তু তখন তারা সরকারে চলে গেছে। তারা যে এক বছরের মধ্যে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যেতে পারল না, সেটা হতাশাজনক।
অভ্যুত্থানে নারীদের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখছি নারীরা বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এরপর মুরাদনগরে ভয়াবহ যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটল। কেন সরকার নারীদের সুরক্ষায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না?
সরকার বলছে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমরা নাকি সেসব দেখতে পাই না। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে পাশের দেশ থেকে একটা বিশাল ক্যাম্পেইন করা হয়েছে—‘শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে, দেশটা নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।’ সেই ক্যাম্পেইনের বিষয়টা স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, এখন যেকোনো ঘটনাকে বেশি করে প্রচারে আনা হয়। যেটা আগে তারা করত না, অন্য কেউ করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সমস্যা থাকার পরেও সরকারের উচিত ছিল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তারা যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সেটা নিয়ে পরিষ্কার করে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। যেমন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট যখন পেশ করা হলো, তখন প্রধান উপদেষ্টা বললেন, এটা একটা যুগান্তকারী দলিল, এটা সবার জন্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কিন্তু যেই মুহূর্তে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য শোনা যায়নি। সরকারই কিন্তু নারী কমিশনের জন্য সম্মানিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই নারীদের অপমানের শিকার হতে হলো। তার বিরুদ্ধে সরকার তো কিছু বলল না এবং করল না। এ দায় যে সরকারের সেটাও স্বীকার করল না। সরকার কি তাহলে তাদের ভয় পেয়েছে? না আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, সরকার ভয় পায়। এটা নিয়ে আমি একটু সন্দিহান। আমার কাছে মনে হয়, দুটোই হতে পারে।
যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে চিন্তার ব্যাপার। আর প্রথমটি হলে অন্য রকম চিন্তার ব্যাপার। দুটোই আসলে বাংলাদেশের নারীদের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ নারীদের জন্য সারভাইবালের বিষয়। আমার যা বয়স, আমাকে কেউ সাইবার বুলিং করলে আমি সেটাকে পাত্তা দেব না। কিন্তু ১৭, ১৮, ১৯ বছর বয়সের মেয়েদের যখন এটা করা হবে, সেটা তো তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ সাইবার স্পেসে বুলিংটা তো জনপরিসরে করা হয়ে থাকে। আর সেটা আবার থেকে যাচ্ছে। কারও যদি ডিপ ফেক ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটা থেকে যাচ্ছে। অনলাইনে অনেকে এ ধরনের ভিডিওকে আলাদা করতে পারে না। সে কারণে নারীটির সারা জীবনের জন্য ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সব কিছু নেতিবাচকতার দিকে চলে যায়। তাঁর পরিবার থেকে সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে থাকে।
এসবের পরেও যেসব নারী রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, তাঁদের স্যালুট জানাই। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এটা একমাত্র দেশের নারীদের অর্জন। এত কিছুর পরেও তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে এ রকম সক্রিয় নারীদের অংশগ্রহণ এর আগে আমরা কিন্তু দেখিনি। সব আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও এভাবে আর কখনো নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়নি।
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, দেশে আবার দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
সেটা তো আসতেই পারে। তবে এর দায়টা আসলে সবার। আমরা সবাই পদপদবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। যেই মুহূর্তে পদপদবি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলো, সেই সময়ে এ-ওর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিল। আওয়ামী লীগের লোকের বিরুদ্ধে নয় কিন্তু, নিজেরা নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে। কারণ, তখন ‘কলঙ্কিতকরণ’ পদ্ধতিটাকে ব্যবহার করা হলো। আপনি যখন নিজের সহযোদ্ধাকে কলঙ্কিত করছেন, যাতে তিনি কোনো পদপদবি না পান। এর চেয়ে সুবিধাজনক সময় ফ্যাসিবাদের কাছে কী থাকতে পারে? কারণ, বিগত সরকার তার আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কাঠামো রেখে গেছে। কিন্তু সেই কাঠামোকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
আর এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের সমাজ তৈরি ছিল না। সরকার গঠনের আগে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। আর এলিটরা তো সেই কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইবে না। সে জন্য বলছি, বিগত সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেগুলো তৈরি করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আগে যেমন আওয়ামী লীগ করার জন্য সবকিছু পাওয়া যেত, এখন সেখানে আওয়ামী লীগ করেন না, সেটা প্রমাণ করতে পারলে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছেন। কেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা গেল না, সেই দায় এই সুবিধাভোগীদের। কিন্তু বেশি দায় হলো সরকারের—যারা সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু সময়টা পার করল, কিন্তু কোনোভাবেই আসল কাজটি করল না।
জুলাই আন্দোলনের চেতনা কেন আমরা ধরে রাখতে পারলাম না?
জুলাই আন্দোলনের চেতনাটা আসলে কী? সেটাও তো আমরা সবাই জানি না। কারণ, সে সময় তো এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমরা সবাই চেয়েছি হত্যাকাণ্ড থামানো এবং শেখ হাসিনার পতন। দিন দিন সরকার বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে এবং আরও বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু এইবার যখন এত বেশি ফোর্স প্রয়োগ করার পরেও মানুষ মনে করেছে হাসিনাকে সরাতে পারলে হত্যাকাণ্ড থামানো যাবে। তাঁকে হটানো ছাড়া এর বেশি কোনো চিন্তা কারও মধ্যে ছিল না।
তবে আমি দেখেছিলাম, জুলাই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে সময় দেয়ালে যেসব কথাবার্তা লিখেছে বা ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়েছে, সেখানে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাদের কাছে ইনক্লুসিভনেসের কথা ছিল। তারা বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য মুক্তির কথা বলেছে। আমরা আসলেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন এবং ইনক্লুসিভনেসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হারিয়ে গেছে। কারণ, ৫ আগস্টের পর আমরা দেখলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষাটা এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম ৩ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল। এদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে—এ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? আমার মনে হয়, এ পরিস্থিতিটাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার এদের গুরুত্ব হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কারও শক্তি থাকতে পারে। এদের পেছনে আসলে দেশের মধ্যে বা বাইরের কোনো শক্তি বা উত্তর পাড়ার ইন্ধন থাকতে পারে কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার কাছে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাটাই আমার চাওয়া ছিল।
আর একটা কথা, জুলাই চেতনাকে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শবোধ দ্বারা দেখতে চেয়েছি। এ কারণে কারও সঙ্গে কারওটা মেলেনি। অনেকে হয়তো বলতে পারে, আমরা প্রতারিত হয়েছি। আসলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর মানুষ তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে।
আর ডানপন্থী ফ্যাসিবাদ আসার যে আশঙ্কার কথা বললেন, সেটা তো সারা বিশ্বে এসেছে। তবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে আমি বলতে চাই, যারা এ ধরনের ফ্যাসিবাদ চান না এবং যাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি ছিলেন, তাঁদের সবার উচিত একটা প্ল্যাটফর্মে আসা, আমরা যাতে পরের ধাপে অগ্রসর হতে পারি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আপনি একাত্ম ছিলেন। এক বছর পর এই আন্দোলনের অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগের সব রকম গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়া—পুরো বিষয়টা একটা অর্জন। কিন্তু এসব ছাড়া আর কোনো অর্জন তেমন একটা নেই।
বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা যেটা খুঁজেও পাচ্ছি না—অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াটা ছিল জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে কয়েকটি কারফিউ ভেঙেছি এবং প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, আমরা বারবার বলেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যাঁরা আহত হয়েছেন এবং যাঁদের আন্দোলনের সময় আটক করা হয়েছে, তাঁদের মামলাগুলোকে ঠিকভাবে দেখতে হবে। আহতদের সঠিক চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতিটা পদে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো জুলাইয়ের নিহতদের তালিকায় শুধু ৮০০ জনের নাম পাওয়া গেছে। অথচ জাতিসংঘের গবেষণায় সেটার সংখ্যা ১৪০০। সরকার এক বছরে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারল না। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? তাঁদের জীবনের বিনিময়ে অনেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। আন্দোলনে যুক্ত না হয়েও কেউ কেউ সরকারের পার্ট হয়েছেন।
বাংলাদেশ তো আসলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বাইরে না। সেই জায়গা থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা ভেঙে গেছে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যখন একজন ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা কূটনৈতিকভাবেও অদ্ভুত ব্যাপার। এটাও ব্যর্থতা। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের অবজেকটিভ সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটা সরকার তৈরি করতে পারেনি।
সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। বাজারে পণ্যের দামে একটা প্রবল ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সেটা সরকারের একটা অর্জন। তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার হলো, জুলাই আন্দোলনের মামলা নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে। শত শত অজ্ঞাত এবং অপরাধী নয়, এ রকম মানুষদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অপরাধীরা যাঁদের ছবি ও ভিডিও আছে তাঁরা বহাল তবিয়তে পাশের দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে চলে গেছেন। আবার তাঁরাই সেখান থেকে নানা ধরনের কাণ্ডকারখানা করছেন। যদি এই মানুষগুলোকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিচারের আওতায় আনা যেত, তাহলে তাঁরা বিদেশে বসে যে অ্যাকটিভিজম করছেন, সেটা এত সহজে সম্ভব হতো না।
দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক ছিলেন, যাঁরা ভয়াবহ নিপীড়নেও একটা টুঁ শব্দ করেননি এবং এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদেরও কোনো ধরনের অনুশোচনা হয়নি। আসলে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না যে সঠিকভাবে বিচারটা শুরু হয়েছে। ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলেশনে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা শুধু ভাঙাভাঙি দেখছি। আমরা বুঝতে পারছি, আলটিমেটলি জননিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে যখন বৈধতা দেওয়া হয়, তখন এই সহিংসতা নিজের বিরুদ্ধে হবে, তখন কিছু বলার আর থাকে না। মূল সমস্যাটা হলো বিচার। সরকার সেটা করছে না কেন? সঠিক পদ্ধতি না মেনে একদল মানুষ যখন বিচার করতে বসেন, সে অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? আগস্টের ৫ তারিখে ভাস্কর্য ভাঙা, বত্রিশ বা গণভবন ভাঙা ছিল আন্দোলনকারী জনতার রোষ। কিন্তু সাত-আট মাস পর যখন ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা, বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের সামনে জেয়াফত করা—সেটা তো সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর সবগুলো ঘটনা সরকারের ব্যর্থতার কারণে ঘটেছে।
জুলাই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না, বরং এটাকে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান বলা যায়। রেজিম পরিবর্তনের পরে সামাজিক শক্তিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কেন?
সামাজিক শক্তির একতা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডগুলো থামানোর জন্য। আর হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল একটা জায়গা থেকে। মানে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার এবং তার বাহিনী দ্বারা। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। সেই বাহিনীগুলো আবার দলীয় প্রভাবে পরিচালিত হয়েছে। সেই জায়গায় পুরো দেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। এখন কিন্তু সবাই সবার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন। সে জন্য অনেকের অনেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষার কারণে যে যত বেশি স্কোর করতে পারে সেই স্কোরের খেলায় সবাই সবার বিরুদ্ধে লেগে গেছে। যাঁরা জুলাইয়ে রাস্তায় ছিলেন তাঁদের কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁদের অনুভূতিটা কী? সরকারের কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করেনি।
আমি নিজেই তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে শামিল ছিলেন। সবার মধ্যে প্রবল বোধ তৈরি হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে তাঁদের কেউ গোনার মধ্যে রাখেনি এবং তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। তাঁদের যে ভয়াবহ আন্দোলনের ট্রমা আছে, সেই ট্রমাটা যদি কেউ ড্রিল না করে তাহলে সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ জাগ্রত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘ফিলিং অব এলিয়েনেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতার বোধ’। পাশাপাশি শিকড় ছেড়া অবস্থা তৈরি হয়। তাঁরা কিছু পেয়েছে কি পায়নি, তার চেয়েও বড় কথা হলো, তাঁরা সমাজের সঙ্গে যুক্ততা বোধ করছেন না এখন আর। কারণ, এত বড় ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জনগোষ্ঠীকে যখন মূল্য দেওয়া হয় না এবং তাদের চরকিনাচনের মধ্যে রাখা হয়, তাদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তখন অস্বাভাবিক দিকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আহত-নিহতদের দায়িত্ব না নেওয়ার দায়টা আসলে কার?
প্রথম দায়টা হলো সরকারের। দ্বিতীয় দায় হলো গণ-অভ্যুত্থানের ফলভোগী দলগুলোরও।
এই গণ-অভ্যুত্থান একটা বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ এনেছিল, সে সুযোগটা হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ। তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছিল সেটাকে সবচেয়ে অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। আর রাজনৈতিক দলগুলোর বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হলে তারা কী করবে! যদিও তারা এখন ক্রেডিটের দাবি তুলছে। এই ক্রেডিটের দাবি নিয়ে তারা আবার সবাই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। সবকিছুই কিন্তু প্রবলভাবে ক্ষতটাকে আরও খুঁচিয়েছে। তারা আবার পুরোনো বন্দোবস্তের রাস্তায় হাঁটছে। তারা ভাবছেই না এখানে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা জাগ্রত সচেতনতার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানো দরকার। তারা এই জাগ্রত অবস্থাটাকে আবার কীভাবে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ফর্মুলা নিয়ে সারাক্ষণ জপছে। দর্শক হিসেবে আমার এসবই মনে হয়।
অসংখ্য তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তারা কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে। এই সচেতন ছেলেমেয়েগুলোকে স্পেস দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আসলে তাদের কোনো ভাবনা ও প্রস্তুতিই নেই। সত্যিই তাদের গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই, যে গণতন্ত্রে দলগুলোকে কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। কারণ, শিক্ষার্থীরা তো সবাইকে প্রশ্ন করছিল। এখনো তারা সেটা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় রাজনৈতিক দলগুলো। এ কারণে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তেমন কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা মনে করছেন তাঁরা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছেন বা ক্ষমতায় অলরেডি চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু সাড়া পেলেও বেশির ভাগ তরুণ দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে।
এই তরুণদের প্রচণ্ড শক্তিকে দেশের কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। তারা যেভাবে ট্রাফিকব্যবস্থা, বন্যা পরিস্থিতি এবং ডাকাতি অবস্থাকে ট্যাকেল করল—প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা কিন্তু তাদের কর্তব্যটা পালন করেছে। তারা তাদের কর্তব্যের চেয়ে বেশি পালন করেছে। এই তরুণদের চেয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর সামর্থ্য বেশি তারা কিন্তু তরুণদের কাজে লাগাতে পারেনি। এই জায়গা থেকে আমি বলব, আসলেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটা স্লিপ করে গেছে। তারা সংস্কার নিয়ে এক জিনিসের মধ্যে যে আটকে আছে, সেখান থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ জনগণ এখনো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে আছে। তারা প্রবল বাধার মুখেও কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তাদের মতামতটা ব্যক্ত করতে চাচ্ছে। এগুলো সবই ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু তাদের যে সহযোগিতা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পায়নি। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই শক্তিকে বুঝতেই পারছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কেন কিছু করতে পারছে না?
সরকার কেন পারছে না, সেটা তো উপদেষ্টাদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। কারণ, বেশির ভাগ উপদেষ্টার ব্যাকগ্রাউন্ড হলো এনজিও। তাঁরা তো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে দায়িত্ব নেননি। তাঁরা তো নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য গেছেন। এখন তাঁরা আরও সময় নিচ্ছেন, সেটা তো অন্য হিসাব। আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের সে জায়গায় নিয়ে গেছে।
প্রথম থেকে কি এ সরকারকে মনে হয়েছে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যাবে? তারা তো আসলে নিউ লিবারেল ডেভলপমেন্টের অন্যতম মুখপাত্র। সে কারণে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইবে না। যেমন ধরুন, শিক্ষার্থীদের যে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। এই দল যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, সেটা তাদের ক্ষতি করছে। এনসিপির মধ্যে যদি বৈপ্লবিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, সেগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে। এখন তারা জনগণের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ছয় মাস আগে সেটা করা দরকার ছিল। আমি তাদের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বলেছিলাম, তাদের আসলে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যাওয়া উচিত। কিন্তু তখন তারা সরকারে চলে গেছে। তারা যে এক বছরের মধ্যে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যেতে পারল না, সেটা হতাশাজনক।
অভ্যুত্থানে নারীদের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখছি নারীরা বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এরপর মুরাদনগরে ভয়াবহ যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটল। কেন সরকার নারীদের সুরক্ষায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না?
সরকার বলছে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমরা নাকি সেসব দেখতে পাই না। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে পাশের দেশ থেকে একটা বিশাল ক্যাম্পেইন করা হয়েছে—‘শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে, দেশটা নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।’ সেই ক্যাম্পেইনের বিষয়টা স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, এখন যেকোনো ঘটনাকে বেশি করে প্রচারে আনা হয়। যেটা আগে তারা করত না, অন্য কেউ করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সমস্যা থাকার পরেও সরকারের উচিত ছিল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তারা যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সেটা নিয়ে পরিষ্কার করে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। যেমন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট যখন পেশ করা হলো, তখন প্রধান উপদেষ্টা বললেন, এটা একটা যুগান্তকারী দলিল, এটা সবার জন্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কিন্তু যেই মুহূর্তে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য শোনা যায়নি। সরকারই কিন্তু নারী কমিশনের জন্য সম্মানিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই নারীদের অপমানের শিকার হতে হলো। তার বিরুদ্ধে সরকার তো কিছু বলল না এবং করল না। এ দায় যে সরকারের সেটাও স্বীকার করল না। সরকার কি তাহলে তাদের ভয় পেয়েছে? না আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, সরকার ভয় পায়। এটা নিয়ে আমি একটু সন্দিহান। আমার কাছে মনে হয়, দুটোই হতে পারে।
যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে চিন্তার ব্যাপার। আর প্রথমটি হলে অন্য রকম চিন্তার ব্যাপার। দুটোই আসলে বাংলাদেশের নারীদের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ নারীদের জন্য সারভাইবালের বিষয়। আমার যা বয়স, আমাকে কেউ সাইবার বুলিং করলে আমি সেটাকে পাত্তা দেব না। কিন্তু ১৭, ১৮, ১৯ বছর বয়সের মেয়েদের যখন এটা করা হবে, সেটা তো তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ সাইবার স্পেসে বুলিংটা তো জনপরিসরে করা হয়ে থাকে। আর সেটা আবার থেকে যাচ্ছে। কারও যদি ডিপ ফেক ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটা থেকে যাচ্ছে। অনলাইনে অনেকে এ ধরনের ভিডিওকে আলাদা করতে পারে না। সে কারণে নারীটির সারা জীবনের জন্য ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সব কিছু নেতিবাচকতার দিকে চলে যায়। তাঁর পরিবার থেকে সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে থাকে।
এসবের পরেও যেসব নারী রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, তাঁদের স্যালুট জানাই। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এটা একমাত্র দেশের নারীদের অর্জন। এত কিছুর পরেও তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে এ রকম সক্রিয় নারীদের অংশগ্রহণ এর আগে আমরা কিন্তু দেখিনি। সব আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও এভাবে আর কখনো নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়নি।
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, দেশে আবার দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
সেটা তো আসতেই পারে। তবে এর দায়টা আসলে সবার। আমরা সবাই পদপদবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। যেই মুহূর্তে পদপদবি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলো, সেই সময়ে এ-ওর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিল। আওয়ামী লীগের লোকের বিরুদ্ধে নয় কিন্তু, নিজেরা নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে। কারণ, তখন ‘কলঙ্কিতকরণ’ পদ্ধতিটাকে ব্যবহার করা হলো। আপনি যখন নিজের সহযোদ্ধাকে কলঙ্কিত করছেন, যাতে তিনি কোনো পদপদবি না পান। এর চেয়ে সুবিধাজনক সময় ফ্যাসিবাদের কাছে কী থাকতে পারে? কারণ, বিগত সরকার তার আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কাঠামো রেখে গেছে। কিন্তু সেই কাঠামোকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
আর এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের সমাজ তৈরি ছিল না। সরকার গঠনের আগে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। আর এলিটরা তো সেই কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইবে না। সে জন্য বলছি, বিগত সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেগুলো তৈরি করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আগে যেমন আওয়ামী লীগ করার জন্য সবকিছু পাওয়া যেত, এখন সেখানে আওয়ামী লীগ করেন না, সেটা প্রমাণ করতে পারলে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছেন। কেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা গেল না, সেই দায় এই সুবিধাভোগীদের। কিন্তু বেশি দায় হলো সরকারের—যারা সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু সময়টা পার করল, কিন্তু কোনোভাবেই আসল কাজটি করল না।
জুলাই আন্দোলনের চেতনা কেন আমরা ধরে রাখতে পারলাম না?
জুলাই আন্দোলনের চেতনাটা আসলে কী? সেটাও তো আমরা সবাই জানি না। কারণ, সে সময় তো এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমরা সবাই চেয়েছি হত্যাকাণ্ড থামানো এবং শেখ হাসিনার পতন। দিন দিন সরকার বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে এবং আরও বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু এইবার যখন এত বেশি ফোর্স প্রয়োগ করার পরেও মানুষ মনে করেছে হাসিনাকে সরাতে পারলে হত্যাকাণ্ড থামানো যাবে। তাঁকে হটানো ছাড়া এর বেশি কোনো চিন্তা কারও মধ্যে ছিল না।
তবে আমি দেখেছিলাম, জুলাই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে সময় দেয়ালে যেসব কথাবার্তা লিখেছে বা ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়েছে, সেখানে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাদের কাছে ইনক্লুসিভনেসের কথা ছিল। তারা বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য মুক্তির কথা বলেছে। আমরা আসলেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন এবং ইনক্লুসিভনেসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হারিয়ে গেছে। কারণ, ৫ আগস্টের পর আমরা দেখলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষাটা এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম ৩ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল। এদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে—এ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? আমার মনে হয়, এ পরিস্থিতিটাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার এদের গুরুত্ব হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কারও শক্তি থাকতে পারে। এদের পেছনে আসলে দেশের মধ্যে বা বাইরের কোনো শক্তি বা উত্তর পাড়ার ইন্ধন থাকতে পারে কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার কাছে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাটাই আমার চাওয়া ছিল।
আর একটা কথা, জুলাই চেতনাকে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শবোধ দ্বারা দেখতে চেয়েছি। এ কারণে কারও সঙ্গে কারওটা মেলেনি। অনেকে হয়তো বলতে পারে, আমরা প্রতারিত হয়েছি। আসলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর মানুষ তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে।
আর ডানপন্থী ফ্যাসিবাদ আসার যে আশঙ্কার কথা বললেন, সেটা তো সারা বিশ্বে এসেছে। তবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে আমি বলতে চাই, যারা এ ধরনের ফ্যাসিবাদ চান না এবং যাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি ছিলেন, তাঁদের সবার উচিত একটা প্ল্যাটফর্মে আসা, আমরা যাতে পরের ধাপে অগ্রসর হতে পারি।

ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৬ ঘণ্টা আগে
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৬ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৬ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগে
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অসংগতি, বৈষম্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন তিনি। শিক্ষা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান, ছাত্র সংসদ, ছাত্ররাজনীতির গতিধারা এবং শিক্ষাব্যবস্থার নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা
মাসুদ রানা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মূল দাবি ছিল ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন’। গত দেড় বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেই কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীনতার পথে কতটুকু এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
প্রশ্ন হলো, বৈষম্যহীনতা মূল রেখে, ডালপালা ছাঁটলে তো কোনো লাভ হবে না। বৈষম্য তো রয়ে গেছে আমাদের মূলে। একটা দেশে কীভাবে কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, বাংলা মিডিয়াম, বাংলার আবার ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যম থাকতে পারে? আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি, এইসব শিক্ষাকাঠামোর কোথাও মিলনস্থান নেই। এভাবে আমরা আমাদের দেশের মানুষকে শিক্ষা, অর্থনীতি ও ধর্ম দিয়ে বিভাজিত করেছি। এ রকম একটা সমাজে বৈষম্যহীন করার জন্য যে ধরনের প্রজ্ঞা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি লাগে, তার তো সব অনুপস্থিতি এখনো আছে।
সুতরাং আমি গত দেড় বছরে বাংলাদেশের কোনো পর্যায়েই বৈষম্যহীনতা তো দূরের কথা, বৈষম্য কমানোর চেষ্টা দেখিনি। গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছে, ধনীরা হয়তোবা আরও বেশি ধনী হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য কোনো দিক দিয়েই কমেনি।
আগের সরকারের প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। বর্তমান সরকার যে পরিমার্জন এনেছে, তা শিক্ষাব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা কি রেখেছে?
আগের সরকার যা করেছে এবং বর্তমান সরকার যা করছে, আসলে তা হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আগের সরকার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যবহার করেছে। আর এই সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই চব্বিশের আন্দোলনকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কোনো বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটা সময় লাগে। ইতিহাসকে আসলে একটা সময় দিতে হয়। এটা সত্যি সত্যি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য কি না, সেটা সময়ের আলোকে আসলে রেকটিফাই ও টেস্ট করতে হয়। মানে ফিল্টারিং প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখনই এটা দেওয়ার মানে হলো, আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান, ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছিল। ইতিহাস তো ব্যবহার্য বিষয় না। ইতিহাস তো ধারণ করার বিষয়।
চব্বিশকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা মানেই হলো, আপনাদের কোনো লাভের বিষয় আছে। আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান টিস্যু পেপারের মতো। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে আপনারা আপনাদের হীন স্বার্থ হাসিলের ব্যবস্থা করবেন, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। কাকে বাদ দেওয়া হবে? রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দকে বাদ দেওয়া যায়? এঁদের কবিতা ও অন্যান্য লেখা দিয়ে ধর্ম ও জাতিভেদের ব্যাপারগুলো টেনে নিয়ে আসা ঠিক না। তাঁরা সময় দ্বারা পরীক্ষিত। ভালো মানের লোক দিয়ে একটা শিক্ষা কমিশন করা দরকার ছিল। কিন্তু এই সরকারের কি ম্যান্ডেট থাকতে পারে আমলাদের দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বিষয় যোগ বা বিয়োগ করার? তাদের এই যোগ ও বাদ দেওয়ার কোনোটাই সমর্থন করতে পারি না।
গত দেড় বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির পটপরিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের রাজনীতি করবে, লেজুড়বৃত্তি করবে না। কোনো দলের জাতীয় নেতারা অন্যায় করলে সেটার প্রতিবাদ করবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে থাকবে, শিক্ষায় কীভাবে বাজেট বৃদ্ধি করা যায়, গবেষণায় কীভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায়; শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে ও এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে যুক্ত থাকবে এবং সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবে—দেশ কোন দিকে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন দলীয় বৃত্তের মধ্যে চলে যায়, তখন একটা দলের মধ্যে আটকে থাকলে তো তারা পুরো আকাশ দেখতে পাবে না। সে কারণে তারা সেই দলের কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডকে মাফ করে দেয়। আর অন্য দলের সামান্য অন্যায়কে বড় করে দেখে থাকে। এটা শিক্ষার্থীদের চরিত্র হওয়া উচিত না। এই আকাঙ্ক্ষাটা জুলাই আন্দোলনের পর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা আবার ফিরে এসেছে। দলান্ধতা আবার বেড়ে
গেছে। কিন্তু সবার না। যেমন উগ্র ডানপন্থীদের কার্যক্রম প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেছে। কিন্তু এটাকে প্রতিহত করার জন্য তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমানে ডাকসুসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের কার্যক্রমকে কীভাবে দেখেন?
ছাত্র সংসদের কিছু দায়িত্ব আছে। তারা কী করতে পারে এবং কী করা উচিত এবং কী করা উচিত না, সেগুলোর সবকিছু লিখিত না থাকলেও অধিকাংশ জনের কাছে সেগুলোর একটা ধারণা আছে। ছাত্র সংসদের কাজ তো ছিন্নমূল মানুষকে লাঠির বাড়ি দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া না। ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয় বা কাউকে পেটানো না। তারা নিজেদের প্রশাসনের অংশ মনে করে। উপাচার্য বলেন, ‘তোমরা আমাদেরই পার্ট।’ তা হতে পারে না।
ছাত্র সংসদের নির্ধারিত কাজ হচ্ছে সাংস্কৃতিক, খেলাধুলার বিষয়গুলো দেখভাল করা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণাকে কীভাবে অগ্রসর করা যায়, কীভাবে লেখাপড়ার মান আরও উন্নত করা যায়—এসব নিয়ে কাজ করা। উন্নত দেশের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা নতুন ছাত্র যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের প্রয়োজনে বাসস্ট্যান্ড ও বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে থাকে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে বা গ্রাম থেকে যখন শিক্ষার্থীরা আসে, নতুন একটা শহর চেনার কথা না। ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের কাজ আসলে এগুলোই। শিক্ষার্থীরা কীভাবে স্কলারশিপ পাবে, কে আর্থিকভাবে দুর্বল—এদের জন্যই তারা কাজ করবে। কিন্তু আসল কাজ বাদ দিয়ে এরা যা করছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটা দলকে কীভাবে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী করা যায়, সেগুলোতে তাদের মূল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ ফিরে এসেছে?
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই সরকার তো নির্দলীয়। এই নির্দলীয় সরকার কি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সত্যিকারের একাডেমিকভাবে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়েছে? সব ক্ষেত্রেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ দলীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই দলীয় উপাচার্যরা নিয়োগ পাওয়ার পর প্রশাসনিক সব পদে প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ডিনদের দলীয়ভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। গত সরকার যা করেছে, এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন যা করেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেও কোনো পার্থক্য দেখা গেল না।
সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে। তারা কি শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে নতুন আশার আলো দেখাতে পারবে?
এই দেশে সবদিক দিয়ে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। যেহেতু দেশের শিক্ষা ও সরকারি হাসপাতালের মান ভালো না, সেহেতু দেশের লক্ষ-কোটি টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। প্রতিবছর দেশ থেকে প্রায় ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী শুধু পড়ালেখার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ শুধু শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। শুধু অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে না, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও বিদেশে চলে যাচ্ছেন। কোনো সরকার কি পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছে, যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তার কত অংশ দেশে ফিরে আসছেন? এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা শেষ করে এই যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন, এটাকেই বলা হয় ‘ব্রেন ড্রেন’। আমরা যাঁদের মেধাবী হিসেবে তৈরি করছি, তাঁদের সেবাটা পাচ্ছে না এ দেশ। তার চিত্রটা দেখা পাওয়া যায় রাস্তাঘাটে হাঁটলে। শুধু তা-ই না, এ দেশে আরেকটা সমস্যা তৈরি হয়েছে—গত সাড়ে ১৫ বছরে থিয়েটার, টেলিভিশন, গানের শিল্পীসহ নানা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে গেছেন। সুতরাং শিক্ষক, ছাত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে যাওয়ার কারণে দেশে মেধাবীদের একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
একটা দেশ উন্নত হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটা নির্দিষ্টসংখ্যক উচ্চ মানের মানুষের। এঁদের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে শরীরের রক্তশূন্যতার মতো। আমরা এখন সেই রক্তশূন্যতার মধ্যে ভুগছি। প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে। সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়া দরকার।
শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ভালো করা না যায়, তাহলে দেশে বেকার সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের শিক্ষার মান খারাপ হওয়ার কারণে বেকারের সংখ্যা প্রচুর। বেকারত্বের কারণেই দেশে নানা ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের কাছে আমার আবেদন বা অনুরোধ থাকবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তৈরি হয়। আগে উন্নত মানুষ তৈরি করতে হবে। কারণ, উন্নত মানুষের মাধ্যমেই কেবল উন্নত দেশ গড়া সম্ভব। দালানকোঠা নির্মাণ করে দেশ উন্নত করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর এমন একটা দেশ পাওয়া যাবে না, যে দেশ শিক্ষায় উন্নত না হয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পেরেছে। একটা উদাহরণ দিই। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ১০০-এর মধ্যে ছিল না। সেই চীনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০-এর মধ্যে অবস্থান করছে। আশা করা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা দশের মধ্যে চলে আসবে। এই যে চলে আসা এবং তাদের যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন, দুটিই হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মূল দাবি ছিল ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন’। গত দেড় বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেই কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীনতার পথে কতটুকু এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
প্রশ্ন হলো, বৈষম্যহীনতা মূল রেখে, ডালপালা ছাঁটলে তো কোনো লাভ হবে না। বৈষম্য তো রয়ে গেছে আমাদের মূলে। একটা দেশে কীভাবে কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, বাংলা মিডিয়াম, বাংলার আবার ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যম থাকতে পারে? আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি, এইসব শিক্ষাকাঠামোর কোথাও মিলনস্থান নেই। এভাবে আমরা আমাদের দেশের মানুষকে শিক্ষা, অর্থনীতি ও ধর্ম দিয়ে বিভাজিত করেছি। এ রকম একটা সমাজে বৈষম্যহীন করার জন্য যে ধরনের প্রজ্ঞা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি লাগে, তার তো সব অনুপস্থিতি এখনো আছে।
সুতরাং আমি গত দেড় বছরে বাংলাদেশের কোনো পর্যায়েই বৈষম্যহীনতা তো দূরের কথা, বৈষম্য কমানোর চেষ্টা দেখিনি। গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছে, ধনীরা হয়তোবা আরও বেশি ধনী হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য কোনো দিক দিয়েই কমেনি।
আগের সরকারের প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। বর্তমান সরকার যে পরিমার্জন এনেছে, তা শিক্ষাব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা কি রেখেছে?
আগের সরকার যা করেছে এবং বর্তমান সরকার যা করছে, আসলে তা হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আগের সরকার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যবহার করেছে। আর এই সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই চব্বিশের আন্দোলনকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কোনো বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটা সময় লাগে। ইতিহাসকে আসলে একটা সময় দিতে হয়। এটা সত্যি সত্যি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য কি না, সেটা সময়ের আলোকে আসলে রেকটিফাই ও টেস্ট করতে হয়। মানে ফিল্টারিং প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখনই এটা দেওয়ার মানে হলো, আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান, ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছিল। ইতিহাস তো ব্যবহার্য বিষয় না। ইতিহাস তো ধারণ করার বিষয়।
চব্বিশকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা মানেই হলো, আপনাদের কোনো লাভের বিষয় আছে। আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান টিস্যু পেপারের মতো। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে আপনারা আপনাদের হীন স্বার্থ হাসিলের ব্যবস্থা করবেন, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। কাকে বাদ দেওয়া হবে? রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দকে বাদ দেওয়া যায়? এঁদের কবিতা ও অন্যান্য লেখা দিয়ে ধর্ম ও জাতিভেদের ব্যাপারগুলো টেনে নিয়ে আসা ঠিক না। তাঁরা সময় দ্বারা পরীক্ষিত। ভালো মানের লোক দিয়ে একটা শিক্ষা কমিশন করা দরকার ছিল। কিন্তু এই সরকারের কি ম্যান্ডেট থাকতে পারে আমলাদের দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বিষয় যোগ বা বিয়োগ করার? তাদের এই যোগ ও বাদ দেওয়ার কোনোটাই সমর্থন করতে পারি না।
গত দেড় বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির পটপরিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের রাজনীতি করবে, লেজুড়বৃত্তি করবে না। কোনো দলের জাতীয় নেতারা অন্যায় করলে সেটার প্রতিবাদ করবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে থাকবে, শিক্ষায় কীভাবে বাজেট বৃদ্ধি করা যায়, গবেষণায় কীভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায়; শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে ও এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে যুক্ত থাকবে এবং সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবে—দেশ কোন দিকে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন দলীয় বৃত্তের মধ্যে চলে যায়, তখন একটা দলের মধ্যে আটকে থাকলে তো তারা পুরো আকাশ দেখতে পাবে না। সে কারণে তারা সেই দলের কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডকে মাফ করে দেয়। আর অন্য দলের সামান্য অন্যায়কে বড় করে দেখে থাকে। এটা শিক্ষার্থীদের চরিত্র হওয়া উচিত না। এই আকাঙ্ক্ষাটা জুলাই আন্দোলনের পর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা আবার ফিরে এসেছে। দলান্ধতা আবার বেড়ে
গেছে। কিন্তু সবার না। যেমন উগ্র ডানপন্থীদের কার্যক্রম প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেছে। কিন্তু এটাকে প্রতিহত করার জন্য তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমানে ডাকসুসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের কার্যক্রমকে কীভাবে দেখেন?
ছাত্র সংসদের কিছু দায়িত্ব আছে। তারা কী করতে পারে এবং কী করা উচিত এবং কী করা উচিত না, সেগুলোর সবকিছু লিখিত না থাকলেও অধিকাংশ জনের কাছে সেগুলোর একটা ধারণা আছে। ছাত্র সংসদের কাজ তো ছিন্নমূল মানুষকে লাঠির বাড়ি দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া না। ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয় বা কাউকে পেটানো না। তারা নিজেদের প্রশাসনের অংশ মনে করে। উপাচার্য বলেন, ‘তোমরা আমাদেরই পার্ট।’ তা হতে পারে না।
ছাত্র সংসদের নির্ধারিত কাজ হচ্ছে সাংস্কৃতিক, খেলাধুলার বিষয়গুলো দেখভাল করা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণাকে কীভাবে অগ্রসর করা যায়, কীভাবে লেখাপড়ার মান আরও উন্নত করা যায়—এসব নিয়ে কাজ করা। উন্নত দেশের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা নতুন ছাত্র যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের প্রয়োজনে বাসস্ট্যান্ড ও বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে থাকে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে বা গ্রাম থেকে যখন শিক্ষার্থীরা আসে, নতুন একটা শহর চেনার কথা না। ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের কাজ আসলে এগুলোই। শিক্ষার্থীরা কীভাবে স্কলারশিপ পাবে, কে আর্থিকভাবে দুর্বল—এদের জন্যই তারা কাজ করবে। কিন্তু আসল কাজ বাদ দিয়ে এরা যা করছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটা দলকে কীভাবে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী করা যায়, সেগুলোতে তাদের মূল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ ফিরে এসেছে?
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই সরকার তো নির্দলীয়। এই নির্দলীয় সরকার কি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সত্যিকারের একাডেমিকভাবে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়েছে? সব ক্ষেত্রেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ দলীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই দলীয় উপাচার্যরা নিয়োগ পাওয়ার পর প্রশাসনিক সব পদে প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ডিনদের দলীয়ভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। গত সরকার যা করেছে, এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন যা করেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেও কোনো পার্থক্য দেখা গেল না।
সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে। তারা কি শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে নতুন আশার আলো দেখাতে পারবে?
এই দেশে সবদিক দিয়ে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। যেহেতু দেশের শিক্ষা ও সরকারি হাসপাতালের মান ভালো না, সেহেতু দেশের লক্ষ-কোটি টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। প্রতিবছর দেশ থেকে প্রায় ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী শুধু পড়ালেখার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ শুধু শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। শুধু অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে না, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও বিদেশে চলে যাচ্ছেন। কোনো সরকার কি পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছে, যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তার কত অংশ দেশে ফিরে আসছেন? এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা শেষ করে এই যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন, এটাকেই বলা হয় ‘ব্রেন ড্রেন’। আমরা যাঁদের মেধাবী হিসেবে তৈরি করছি, তাঁদের সেবাটা পাচ্ছে না এ দেশ। তার চিত্রটা দেখা পাওয়া যায় রাস্তাঘাটে হাঁটলে। শুধু তা-ই না, এ দেশে আরেকটা সমস্যা তৈরি হয়েছে—গত সাড়ে ১৫ বছরে থিয়েটার, টেলিভিশন, গানের শিল্পীসহ নানা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে গেছেন। সুতরাং শিক্ষক, ছাত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে যাওয়ার কারণে দেশে মেধাবীদের একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
একটা দেশ উন্নত হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটা নির্দিষ্টসংখ্যক উচ্চ মানের মানুষের। এঁদের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে শরীরের রক্তশূন্যতার মতো। আমরা এখন সেই রক্তশূন্যতার মধ্যে ভুগছি। প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে। সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়া দরকার।
শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ভালো করা না যায়, তাহলে দেশে বেকার সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের শিক্ষার মান খারাপ হওয়ার কারণে বেকারের সংখ্যা প্রচুর। বেকারত্বের কারণেই দেশে নানা ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের কাছে আমার আবেদন বা অনুরোধ থাকবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তৈরি হয়। আগে উন্নত মানুষ তৈরি করতে হবে। কারণ, উন্নত মানুষের মাধ্যমেই কেবল উন্নত দেশ গড়া সম্ভব। দালানকোঠা নির্মাণ করে দেশ উন্নত করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর এমন একটা দেশ পাওয়া যাবে না, যে দেশ শিক্ষায় উন্নত না হয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পেরেছে। একটা উদাহরণ দিই। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ১০০-এর মধ্যে ছিল না। সেই চীনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০-এর মধ্যে অবস্থান করছে। আশা করা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা দশের মধ্যে চলে আসবে। এই যে চলে আসা এবং তাদের যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন, দুটিই হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।

আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং
১৩ জুলাই ২০২৫
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৬ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৬ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগেসৈয়দা সাদিয়া শাহরীন

অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন—নির্বাচন হবে। কবে হবে? সে উত্তরটাও সুনির্ধারিতভাবে পাওয়া গেছে বছরের শেষ দিকে এসে। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। আকাঙ্ক্ষিত তফসিল। সারা বছর যাঁরা ‘নির্বাচন কবে হবে’—এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করেছেন, তাঁরা নির্বাচনের তারিখটা জেনে নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছেন। এবার বহুল আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনটা আসছে বছর ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেই ব্যাপারটা সোনায় সোহাগা হবে!
ভবিষ্যতের কথা থাক। লেখাটা আসলে এ বছরের আলোচিত ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দিতে ছাপা হয়েছে, যেন অতীতের ভুল শুধরে নতুন বছরে আমরা ভালো কিছু করে এর সুফল ভোগ করতে পারি। ২০২৫ সালে এত ঘটনা ঘটে গেছে যে একে ‘ঘটনার ঘনঘটার বছর’ বললে নিশ্চয়ই দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ হবে না! দেখুন তো পাঠক, নিচের ঘটনাগুলো আপনার মনে পড়ছে কি না।
২. ২০২৫। সালটা ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে কেটেছে অনেকের। শিশু ধর্ষণ থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি—কী হয়নি এ বছর? অপরাধ যে কয়েক গুণ বেড়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা মাগুরার আট বছর বয়সী শিশুর ধর্ষণের বিচার চেয়েছিলাম। বছরের শুরুতে সেই শিশুর ওপর নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল পুরো দেশ। তবু ঢাকার কেরানীগঞ্জে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী। রাঙামাটিতে তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে ষাট বছরের বৃদ্ধ। ঝিনাইদহে চকলেটের প্রলোভনে ধর্ষণের শিকার হয় চার বছর বয়সী শিশু।
৩. ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগ নামের এক ব্যক্তির মাথা থেঁতলে মেরে ফেলা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। এই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল নেট দুনিয়ায়। ফুটেজটা কোনো দুঃস্বপ্ন হলেই ভালো হতো। কিন্তু না, বাস্তব ঘটনার সাক্ষী এটি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় একই রকমভাবে একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। এলাকাবাসী সেদিন সাহসের পরিচয় দিয়ে রুখে দিয়েছেন হামলাকারীকে। চাঁদাবাজি নিয়ে মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল বলে দেশের মানুষ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল তখন।
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বছরের শুরুর দিকেই এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল হাসান দীপু এবং ইপিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান) যুগ্ম সদস্যসচিব এহতেশামুল হক হামলার শিকার হন। পরে বেরিয়ে আসে এই হামলার পেছনে হাত রয়েছে চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে জামিনে ছাড়া পাওয়া দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর। কারাগারে থাকতেই যেখানে তাঁরা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা যায়, সেখানে তাঁদের জামিন দেওয়া কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে, তা ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই জনগণ নির্ধারণ করে ফেলেছে।
৪. সোনার দাম যেভাবে এ বছর বেড়েছে, তা এক ব্যাপার বটে! এর চেয়েও বড় ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল যখন এক ব্যবসায়ী নিজের সোনার দোকানে নিজেই ডাকাতি করিয়ে ‘কট’ খেয়ে যান। মানিকগঞ্জ শহরের স্বর্ণকারপট্টি এলাকায় শুভ দাস লোক ভাড়া করে নিজের দোকানে ডাকাতির নাটক সাজিয়ে গ্রাহকদের স্বর্ণালংকার আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলেন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি তাঁর এই চালাকি।
তবে রাজধানীর বনশ্রীর ঘটনাটি দুঃখজনক ছিল। আনোয়ার হোসেন নামে এক সোনার ব্যবসায়ীকে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে ১৬০ ভরি সোনা ও এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছয়-সাতজন দুর্বৃত্ত।
৫. আপনারা হয়তো কোনো কমেডি সিনেমায় দেখে থাকবেন, ছিনতাইকারী শুধু টাকাপয়সা বা ফোন ছিনতাই করে না, গায়ের জামা-পায়ের জুতা সবই নিয়ে চলে যায়। রাজধানীর শ্যামলীতে সত্যিই যখন এ রকম একটি ঘটনা ঘটল, তখন এর সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি জব্দ করা হয় ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও চাপাতি। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে মেলে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ছিনতাইকারী চক্রটি চাপাতি ও মোটরসাইকেল ভাড়া দেয় মাঠপর্যায়ে ছিনতাইকারীদের। প্রতিদিন ঢাকার একাধিক এলাকায় চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে ছিনতাই কার্যক্রম চালায় চক্রটি। চাপাতি-মোটরসাইকেলের ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করতে হয় না তাদের, ছিনতাই শেষে মালপত্র বিক্রির পর ভাড়া দিতে হয়। এমনকি ছিনতাইয়ের মালপত্র বিক্রিও করতে হয় ছিনতাইকারী চক্রের মূল হোতাদের কাছে। ছিনতাই করার এক আধুনিক প্যাকেজ বটে!
বছরজুড়ে মোহাম্মদপুর এলাকাটিও কিন্তু ছিনতাইয়ের ঘটনার জন্য এক আতঙ্কের জায়গা হয়ে রয়েছে। যখন-তখন চাপাতি নিয়ে তেড়ে আসা তরুণেরা এলাকাটির ত্রাস। পুলিশ তৎপরতা না বাড়ালে সেখানকার অপরাধ চলতেই থাকবে।
৬. বছরের আলোচিত একটি হত্যাকাণ্ড ছিল প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারভেজ হত্যাকাণ্ড। শুধু হাসির ‘অপরাধে’ প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে।
বাড্ডায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপির নেতা কামরুল আহসান সাধনকে। পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম লতিফপুর এলাকায় ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পল্লবীতে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে প্রবেশ করে মুখোশ ও হেলমেট পরা সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়াকে। চট্টগ্রামে চলন্ত প্রাইভেট কার থামিয়ে প্রকাশ্যে দিনদুপুরে বিএনপি-সমর্থিত এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক কারণ নাকি ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত শত্রুতা রয়েছে—সবই জটিল রহস্যে মুড়ে আছে।
লক্ষ্মীপুরে বিএনপির নেতা বেলাল হোসেনের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দগ্ধ হয়ে তাঁর দুই সন্তানের মৃত্যু পুরো দেশকেই মর্মাহত করেছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা করে ও লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা বর্বরতার সব মাত্রা যেন ছাড়িয়ে গেছে। কবর থেকে উঠিয়ে নুরাল পাগলার লাশ পুড়িয়ে তথাকথিত মব কী অর্জন করতে পেরেছে, তা এক রহস্য। মবের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সংবাদমাধ্যমও। একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছে সংবাদকর্মীরা।
নাটকীয় কায়দায় যেভাবে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদিকে দিনদুপুরে গুলি করা হলো, তা এই বছরটির জন্য এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদির মৃত্যুর পর সারা দেশ এখনো জনরোষে ফুঁসছে, বিচার চাইছে সবাই। কিন্তু বিচার কার হবে? পলাতক হত্যাকারীকে অবিলম্বে খুঁজে বের করা হোক। তবেই না হবে বিচার।
৭. ২০২৫ সালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা কোনটি? এর উত্তরে বলতে হয়—বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ৬ হাজার ৩১৪ দিন পর দেশে ফিরেছেন। ফিরেই মাটির স্পর্শ নিয়েছেন। জানিয়েছেন দেশ নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা। তাঁকে সংবর্ধনা দিতে মানুষের যে ঢল নেমেছিল ঢাকার পূর্বাচলের পথে, তা প্রত্যাবর্তনের এক অভূতপূর্ব দৃশ্য বলে মেনে নিতে হয়।
আবার সেই নির্বাচনে ফিরে আসা যাক। তারেক রহমানের আগমনে দেশের রাজনৈতিক পট কতটা আর কীভাবে পরিবর্তন হবে, তা সময় বলে দেবে। নির্বাচনের ওপর কেমন আর কতটা প্রভাব পড়বে, তা-ও সময়ই বলে দেবে। কিন্তু নির্বাচনে যাঁরা জয়ী হবেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন এ বছর যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা কিংবা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা নতুন বছরে ঠেকানো যাবে কি না। কারণ,
দেশের হাল যাঁরা ধরবেন, দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা তো তাঁদেরই হাতে থাকবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে তাঁরা থাকবেন জনগণের হৃদয়ে। হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া কি খুব কঠিন?
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন—নির্বাচন হবে। কবে হবে? সে উত্তরটাও সুনির্ধারিতভাবে পাওয়া গেছে বছরের শেষ দিকে এসে। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। আকাঙ্ক্ষিত তফসিল। সারা বছর যাঁরা ‘নির্বাচন কবে হবে’—এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করেছেন, তাঁরা নির্বাচনের তারিখটা জেনে নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছেন। এবার বহুল আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনটা আসছে বছর ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেই ব্যাপারটা সোনায় সোহাগা হবে!
ভবিষ্যতের কথা থাক। লেখাটা আসলে এ বছরের আলোচিত ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দিতে ছাপা হয়েছে, যেন অতীতের ভুল শুধরে নতুন বছরে আমরা ভালো কিছু করে এর সুফল ভোগ করতে পারি। ২০২৫ সালে এত ঘটনা ঘটে গেছে যে একে ‘ঘটনার ঘনঘটার বছর’ বললে নিশ্চয়ই দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ হবে না! দেখুন তো পাঠক, নিচের ঘটনাগুলো আপনার মনে পড়ছে কি না।
২. ২০২৫। সালটা ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে কেটেছে অনেকের। শিশু ধর্ষণ থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি—কী হয়নি এ বছর? অপরাধ যে কয়েক গুণ বেড়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা মাগুরার আট বছর বয়সী শিশুর ধর্ষণের বিচার চেয়েছিলাম। বছরের শুরুতে সেই শিশুর ওপর নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল পুরো দেশ। তবু ঢাকার কেরানীগঞ্জে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী। রাঙামাটিতে তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে ষাট বছরের বৃদ্ধ। ঝিনাইদহে চকলেটের প্রলোভনে ধর্ষণের শিকার হয় চার বছর বয়সী শিশু।
৩. ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগ নামের এক ব্যক্তির মাথা থেঁতলে মেরে ফেলা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। এই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল নেট দুনিয়ায়। ফুটেজটা কোনো দুঃস্বপ্ন হলেই ভালো হতো। কিন্তু না, বাস্তব ঘটনার সাক্ষী এটি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় একই রকমভাবে একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। এলাকাবাসী সেদিন সাহসের পরিচয় দিয়ে রুখে দিয়েছেন হামলাকারীকে। চাঁদাবাজি নিয়ে মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল বলে দেশের মানুষ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল তখন।
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বছরের শুরুর দিকেই এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল হাসান দীপু এবং ইপিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান) যুগ্ম সদস্যসচিব এহতেশামুল হক হামলার শিকার হন। পরে বেরিয়ে আসে এই হামলার পেছনে হাত রয়েছে চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে জামিনে ছাড়া পাওয়া দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর। কারাগারে থাকতেই যেখানে তাঁরা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা যায়, সেখানে তাঁদের জামিন দেওয়া কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে, তা ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই জনগণ নির্ধারণ করে ফেলেছে।
৪. সোনার দাম যেভাবে এ বছর বেড়েছে, তা এক ব্যাপার বটে! এর চেয়েও বড় ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল যখন এক ব্যবসায়ী নিজের সোনার দোকানে নিজেই ডাকাতি করিয়ে ‘কট’ খেয়ে যান। মানিকগঞ্জ শহরের স্বর্ণকারপট্টি এলাকায় শুভ দাস লোক ভাড়া করে নিজের দোকানে ডাকাতির নাটক সাজিয়ে গ্রাহকদের স্বর্ণালংকার আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলেন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি তাঁর এই চালাকি।
তবে রাজধানীর বনশ্রীর ঘটনাটি দুঃখজনক ছিল। আনোয়ার হোসেন নামে এক সোনার ব্যবসায়ীকে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে ১৬০ ভরি সোনা ও এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছয়-সাতজন দুর্বৃত্ত।
৫. আপনারা হয়তো কোনো কমেডি সিনেমায় দেখে থাকবেন, ছিনতাইকারী শুধু টাকাপয়সা বা ফোন ছিনতাই করে না, গায়ের জামা-পায়ের জুতা সবই নিয়ে চলে যায়। রাজধানীর শ্যামলীতে সত্যিই যখন এ রকম একটি ঘটনা ঘটল, তখন এর সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি জব্দ করা হয় ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও চাপাতি। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে মেলে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ছিনতাইকারী চক্রটি চাপাতি ও মোটরসাইকেল ভাড়া দেয় মাঠপর্যায়ে ছিনতাইকারীদের। প্রতিদিন ঢাকার একাধিক এলাকায় চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে ছিনতাই কার্যক্রম চালায় চক্রটি। চাপাতি-মোটরসাইকেলের ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করতে হয় না তাদের, ছিনতাই শেষে মালপত্র বিক্রির পর ভাড়া দিতে হয়। এমনকি ছিনতাইয়ের মালপত্র বিক্রিও করতে হয় ছিনতাইকারী চক্রের মূল হোতাদের কাছে। ছিনতাই করার এক আধুনিক প্যাকেজ বটে!
বছরজুড়ে মোহাম্মদপুর এলাকাটিও কিন্তু ছিনতাইয়ের ঘটনার জন্য এক আতঙ্কের জায়গা হয়ে রয়েছে। যখন-তখন চাপাতি নিয়ে তেড়ে আসা তরুণেরা এলাকাটির ত্রাস। পুলিশ তৎপরতা না বাড়ালে সেখানকার অপরাধ চলতেই থাকবে।
৬. বছরের আলোচিত একটি হত্যাকাণ্ড ছিল প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারভেজ হত্যাকাণ্ড। শুধু হাসির ‘অপরাধে’ প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে।
বাড্ডায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপির নেতা কামরুল আহসান সাধনকে। পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম লতিফপুর এলাকায় ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পল্লবীতে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে প্রবেশ করে মুখোশ ও হেলমেট পরা সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়াকে। চট্টগ্রামে চলন্ত প্রাইভেট কার থামিয়ে প্রকাশ্যে দিনদুপুরে বিএনপি-সমর্থিত এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক কারণ নাকি ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত শত্রুতা রয়েছে—সবই জটিল রহস্যে মুড়ে আছে।
লক্ষ্মীপুরে বিএনপির নেতা বেলাল হোসেনের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দগ্ধ হয়ে তাঁর দুই সন্তানের মৃত্যু পুরো দেশকেই মর্মাহত করেছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা করে ও লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা বর্বরতার সব মাত্রা যেন ছাড়িয়ে গেছে। কবর থেকে উঠিয়ে নুরাল পাগলার লাশ পুড়িয়ে তথাকথিত মব কী অর্জন করতে পেরেছে, তা এক রহস্য। মবের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সংবাদমাধ্যমও। একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছে সংবাদকর্মীরা।
নাটকীয় কায়দায় যেভাবে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদিকে দিনদুপুরে গুলি করা হলো, তা এই বছরটির জন্য এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদির মৃত্যুর পর সারা দেশ এখনো জনরোষে ফুঁসছে, বিচার চাইছে সবাই। কিন্তু বিচার কার হবে? পলাতক হত্যাকারীকে অবিলম্বে খুঁজে বের করা হোক। তবেই না হবে বিচার।
৭. ২০২৫ সালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা কোনটি? এর উত্তরে বলতে হয়—বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ৬ হাজার ৩১৪ দিন পর দেশে ফিরেছেন। ফিরেই মাটির স্পর্শ নিয়েছেন। জানিয়েছেন দেশ নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা। তাঁকে সংবর্ধনা দিতে মানুষের যে ঢল নেমেছিল ঢাকার পূর্বাচলের পথে, তা প্রত্যাবর্তনের এক অভূতপূর্ব দৃশ্য বলে মেনে নিতে হয়।
আবার সেই নির্বাচনে ফিরে আসা যাক। তারেক রহমানের আগমনে দেশের রাজনৈতিক পট কতটা আর কীভাবে পরিবর্তন হবে, তা সময় বলে দেবে। নির্বাচনের ওপর কেমন আর কতটা প্রভাব পড়বে, তা-ও সময়ই বলে দেবে। কিন্তু নির্বাচনে যাঁরা জয়ী হবেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন এ বছর যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা কিংবা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা নতুন বছরে ঠেকানো যাবে কি না। কারণ,
দেশের হাল যাঁরা ধরবেন, দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা তো তাঁদেরই হাতে থাকবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে তাঁরা থাকবেন জনগণের হৃদয়ে। হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া কি খুব কঠিন?
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং
১৩ জুলাই ২০২৫
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৬ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৬ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে। এই চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হলো নির্বাচনের ব্যয়।
সুস্থ গণতন্ত্রের প্রধান অন্তরায় হলো টাকার রাজনীতি। নির্বাচনী ব্যয় যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে নির্বাচন-পরবর্তী দুর্নীতি রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ, নির্বাচনের পেছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, বিজয়ীরা ক্ষমতায় গিয়ে সুদে-আসলে সেই অর্থ জনগণের পকেট থেকেই আদায় করার চেষ্টা করেন।
নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন অনেকগুলো যুগোপযোগী সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এই সুপারিশগুলোর একটি বড় অংশই উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যয় মনিটরিং কমিটি গঠন করে নিবিড় নজরদারি করার প্রস্তাবটি গৃহীত না হওয়া একটি বড় ক্ষতির জায়গা তৈরি করতে পারে ভবিষ্যতে।
‘মনোনয়ন-বাণিজ্যের’ মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধির সংস্কৃতি আগে থেকেই শিকড় গেড়ে আছে। যখন একজন প্রার্থী কোটি কোটি টাকা খরচ করে মনোনয়ন কেনেন এবং নির্বাচনে লড়েন, তখন জনসেবা নয় বরং ‘বিনিয়োগের মুনাফা’ তোলাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মূল উৎস।
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। এসব বিষয় উপেক্ষার কারণে ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জাতীয় ঐক্যেরও কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশন এবং সরকারকে বুঝতে হবে যে, লোকদেখানো সংস্কার দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। নির্বাচন সংস্কার কমিশন যে সুপারিশগুলো দিয়েছে, তা কেবল কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রায়ণ এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
দেশের সচেতন মানুষের প্রত্যাশা ছিল, এবার হয়তো নির্বাচনী ব্যবস্থার একটা আমূল সংস্কার করা সম্ভব হবে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের বৈঠকে বিভিন্ন দলের নেতাদের মতামত নেওয়ার জন্য চা-নাশতা বাবদ রাষ্ট্রের টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু সেই বৈঠকগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল যে আসেনি, তা পরবর্তী সময়ে কমিশনের রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হওয়া গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিরসন করা সম্ভব না হলে নির্বাচনের পরে সেগুলো নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার কোনো বিলাসিতার বিষয় নয়। এটি রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করার অপরিহার্য শর্ত। সরকারকে নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে এবং সংস্কার কমিশনের বাকি সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে একটি প্রকৃত অর্থবহ পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। অন্যথায় ভোটের নামে অর্থের খেলা চলবেই এবং দুর্নীতি নামক দানবটি আমাদের শাসনব্যবস্থাকে কুরে কুরে খেতে থাকবে।

সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে। এই চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হলো নির্বাচনের ব্যয়।
সুস্থ গণতন্ত্রের প্রধান অন্তরায় হলো টাকার রাজনীতি। নির্বাচনী ব্যয় যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে নির্বাচন-পরবর্তী দুর্নীতি রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ, নির্বাচনের পেছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, বিজয়ীরা ক্ষমতায় গিয়ে সুদে-আসলে সেই অর্থ জনগণের পকেট থেকেই আদায় করার চেষ্টা করেন।
নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন অনেকগুলো যুগোপযোগী সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এই সুপারিশগুলোর একটি বড় অংশই উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যয় মনিটরিং কমিটি গঠন করে নিবিড় নজরদারি করার প্রস্তাবটি গৃহীত না হওয়া একটি বড় ক্ষতির জায়গা তৈরি করতে পারে ভবিষ্যতে।
‘মনোনয়ন-বাণিজ্যের’ মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধির সংস্কৃতি আগে থেকেই শিকড় গেড়ে আছে। যখন একজন প্রার্থী কোটি কোটি টাকা খরচ করে মনোনয়ন কেনেন এবং নির্বাচনে লড়েন, তখন জনসেবা নয় বরং ‘বিনিয়োগের মুনাফা’ তোলাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মূল উৎস।
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। এসব বিষয় উপেক্ষার কারণে ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জাতীয় ঐক্যেরও কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশন এবং সরকারকে বুঝতে হবে যে, লোকদেখানো সংস্কার দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। নির্বাচন সংস্কার কমিশন যে সুপারিশগুলো দিয়েছে, তা কেবল কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রায়ণ এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
দেশের সচেতন মানুষের প্রত্যাশা ছিল, এবার হয়তো নির্বাচনী ব্যবস্থার একটা আমূল সংস্কার করা সম্ভব হবে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের বৈঠকে বিভিন্ন দলের নেতাদের মতামত নেওয়ার জন্য চা-নাশতা বাবদ রাষ্ট্রের টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু সেই বৈঠকগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল যে আসেনি, তা পরবর্তী সময়ে কমিশনের রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হওয়া গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিরসন করা সম্ভব না হলে নির্বাচনের পরে সেগুলো নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার কোনো বিলাসিতার বিষয় নয়। এটি রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করার অপরিহার্য শর্ত। সরকারকে নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে এবং সংস্কার কমিশনের বাকি সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে একটি প্রকৃত অর্থবহ পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। অন্যথায় ভোটের নামে অর্থের খেলা চলবেই এবং দুর্নীতি নামক দানবটি আমাদের শাসনব্যবস্থাকে কুরে কুরে খেতে থাকবে।

আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং
১৩ জুলাই ২০২৫
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৬ ঘণ্টা আগে
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৬ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।
গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।
বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।
এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।
গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।
বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।
এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং
১৩ জুলাই ২০২৫
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৬ ঘণ্টা আগে
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৬ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৬ ঘণ্টা আগে