Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

বৈষম্যহীন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা হারিয়ে গেছে

সামিনা লুৎফা নিত্রা

সামিনা লুৎফা নিত্রা জুলাই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। ‘বটতলা’ নাট্য দলের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের অর্জন-ব্যর্থতা এবং রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

মাসুদ রানা

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আপনি একাত্ম ছিলেন। এক বছর পর এই আন্দোলনের অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগের সব রকম গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়া—পুরো বিষয়টা একটা অর্জন। কিন্তু এসব ছাড়া আর কোনো অর্জন তেমন একটা নেই।

বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা যেটা খুঁজেও পাচ্ছি না—অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াটা ছিল জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে কয়েকটি কারফিউ ভেঙেছি এবং প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, আমরা বারবার বলেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যাঁরা আহত হয়েছেন এবং যাঁদের আন্দোলনের সময় আটক করা হয়েছে, তাঁদের মামলাগুলোকে ঠিকভাবে দেখতে হবে। আহতদের সঠিক চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতিটা পদে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো জুলাইয়ের নিহতদের তালিকায় শুধু ৮০০ জনের নাম পাওয়া গেছে। অথচ জাতিসংঘের গবেষণায় সেটার সংখ্যা ১৪০০। সরকার এক বছরে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারল না। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? তাঁদের জীবনের বিনিময়ে অনেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। আন্দোলনে যুক্ত না হয়েও কেউ কেউ সরকারের পার্ট হয়েছেন।

বাংলাদেশ তো আসলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বাইরে না। সেই জায়গা থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা ভেঙে গেছে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যখন একজন ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা কূটনৈতিকভাবেও অদ্ভুত ব্যাপার। এটাও ব্যর্থতা। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের অবজেকটিভ সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটা সরকার তৈরি করতে পারেনি।

সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। বাজারে পণ্যের দামে একটা প্রবল ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সেটা সরকারের একটা অর্জন। তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার হলো, জুলাই আন্দোলনের মামলা নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে। শত শত অজ্ঞাত এবং অপরাধী নয়, এ রকম মানুষদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অপরাধীরা যাঁদের ছবি ও ভিডিও আছে তাঁরা বহাল তবিয়তে পাশের দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে চলে গেছেন। আবার তাঁরাই সেখান থেকে নানা ধরনের কাণ্ডকারখানা করছেন। যদি এই মানুষগুলোকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিচারের আওতায় আনা যেত, তাহলে তাঁরা বিদেশে বসে যে অ্যাকটিভিজম করছেন, সেটা এত সহজে সম্ভব হতো না।

দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক ছিলেন, যাঁরা ভয়াবহ নিপীড়নেও একটা টুঁ শব্দ করেননি এবং এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদেরও কোনো ধরনের অনুশোচনা হয়নি। আসলে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না যে সঠিকভাবে বিচারটা শুরু হয়েছে। ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলেশনে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা শুধু ভাঙাভাঙি দেখছি। আমরা বুঝতে পারছি, আলটিমেটলি জননিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে যখন বৈধতা দেওয়া হয়, তখন এই সহিংসতা নিজের বিরুদ্ধে হবে, তখন কিছু বলার আর থাকে না। মূল সমস্যাটা হলো বিচার। সরকার সেটা করছে না কেন? সঠিক পদ্ধতি না মেনে একদল মানুষ যখন বিচার করতে বসেন, সে অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? আগস্টের ৫ তারিখে ভাস্কর্য ভাঙা, বত্রিশ বা গণভবন ভাঙা ছিল আন্দোলনকারী জনতার রোষ। কিন্তু সাত-আট মাস পর যখন ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা, বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের সামনে জেয়াফত করা—সেটা তো সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর সবগুলো ঘটনা সরকারের ব্যর্থতার কারণে ঘটেছে।

জুলাই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না, বরং এটাকে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান বলা যায়। রেজিম পরিবর্তনের পরে সামাজিক শক্তিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কেন?

সামাজিক শক্তির একতা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডগুলো থামানোর জন্য। আর হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল একটা জায়গা থেকে। মানে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার এবং তার বাহিনী দ্বারা। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। সেই বাহিনীগুলো আবার দলীয় প্রভাবে পরিচালিত হয়েছে। সেই জায়গায় পুরো দেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। এখন কিন্তু সবাই সবার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন। সে জন্য অনেকের অনেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষার কারণে যে যত বেশি স্কোর করতে পারে সেই স্কোরের খেলায় সবাই সবার বিরুদ্ধে লেগে গেছে। যাঁরা জুলাইয়ে রাস্তায় ছিলেন তাঁদের কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁদের অনুভূতিটা কী? সরকারের কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করেনি।

আমি নিজেই তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে শামিল ছিলেন। সবার মধ্যে প্রবল বোধ তৈরি হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে তাঁদের কেউ গোনার মধ্যে রাখেনি এবং তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। তাঁদের যে ভয়াবহ আন্দোলনের ট্রমা আছে, সেই ট্রমাটা যদি কেউ ড্রিল না করে তাহলে সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ জাগ্রত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘ফিলিং অব এলিয়েনেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতার বোধ’। পাশাপাশি শিকড় ছেড়া অবস্থা তৈরি হয়। তাঁরা কিছু পেয়েছে কি পায়নি, তার চেয়েও বড় কথা হলো, তাঁরা সমাজের সঙ্গে যুক্ততা বোধ করছেন না এখন আর। কারণ, এত বড় ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জনগোষ্ঠীকে যখন মূল্য দেওয়া হয় না এবং তাদের চরকিনাচনের মধ্যে রাখা হয়, তাদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তখন অস্বাভাবিক দিকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

আহত-নিহতদের দায়িত্ব না নেওয়ার দায়টা আসলে কার?

প্রথম দায়টা হলো সরকারের। দ্বিতীয় দায় হলো গণ-অভ্যুত্থানের ফলভোগী দলগুলোরও।

এই গণ-অভ্যুত্থান একটা বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ এনেছিল, সে সুযোগটা হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?

হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ। তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছিল সেটাকে সবচেয়ে অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। আর রাজনৈতিক দলগুলোর বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হলে তারা কী করবে! যদিও তারা এখন ক্রেডিটের দাবি তুলছে। এই ক্রেডিটের দাবি নিয়ে তারা আবার সবাই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। সবকিছুই কিন্তু প্রবলভাবে ক্ষতটাকে আরও খুঁচিয়েছে। তারা আবার পুরোনো বন্দোবস্তের রাস্তায় হাঁটছে। তারা ভাবছেই না এখানে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা জাগ্রত সচেতনতার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানো দরকার। তারা এই জাগ্রত অবস্থাটাকে আবার কীভাবে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ফর্মুলা নিয়ে সারাক্ষণ জপছে। দর্শক হিসেবে আমার এসবই মনে হয়।

অসংখ্য তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তারা কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে। এই সচেতন ছেলেমেয়েগুলোকে স্পেস দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আসলে তাদের কোনো ভাবনা ও প্রস্তুতিই নেই। সত্যিই তাদের গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই, যে গণতন্ত্রে দলগুলোকে কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। কারণ, শিক্ষার্থীরা তো সবাইকে প্রশ্ন করছিল। এখনো তারা সেটা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় রাজনৈতিক দলগুলো। এ কারণে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তেমন কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা মনে করছেন তাঁরা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছেন বা ক্ষমতায় অলরেডি চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু সাড়া পেলেও বেশির ভাগ তরুণ দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে।

এই তরুণদের প্রচণ্ড শক্তিকে দেশের কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। তারা যেভাবে ট্রাফিকব্যবস্থা, বন্যা পরিস্থিতি এবং ডাকাতি অবস্থাকে ট্যাকেল করল—প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা কিন্তু তাদের কর্তব্যটা পালন করেছে। তারা তাদের কর্তব্যের চেয়ে বেশি পালন করেছে। এই তরুণদের চেয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর সামর্থ্য বেশি তারা কিন্তু তরুণদের কাজে লাগাতে পারেনি। এই জায়গা থেকে আমি বলব, আসলেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটা স্লিপ করে গেছে। তারা সংস্কার নিয়ে এক জিনিসের মধ্যে যে আটকে আছে, সেখান থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ জনগণ এখনো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে আছে। তারা প্রবল বাধার মুখেও কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তাদের মতামতটা ব্যক্ত করতে চাচ্ছে। এগুলো সবই ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু তাদের যে সহযোগিতা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পায়নি। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই শক্তিকে বুঝতেই পারছে না।

অন্তর্বর্তী সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কেন কিছু করতে পারছে না?

সরকার কেন পারছে না, সেটা তো উপদেষ্টাদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। কারণ, বেশির ভাগ উপদেষ্টার ব্যাকগ্রাউন্ড হলো এনজিও। তাঁরা তো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে দায়িত্ব নেননি। তাঁরা তো নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য গেছেন। এখন তাঁরা আরও সময় নিচ্ছেন, সেটা তো অন্য হিসাব। আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের সে জায়গায় নিয়ে গেছে।

প্রথম থেকে কি এ সরকারকে মনে হয়েছে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যাবে? তারা তো আসলে নিউ লিবারেল ডেভলপমেন্টের অন্যতম মুখপাত্র। সে কারণে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইবে না। যেমন ধরুন, শিক্ষার্থীদের যে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। এই দল যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, সেটা তাদের ক্ষতি করছে। এনসিপির মধ্যে যদি বৈপ্লবিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, সেগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে। এখন তারা জনগণের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ছয় মাস আগে সেটা করা দরকার ছিল। আমি তাদের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বলেছিলাম, তাদের আসলে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যাওয়া উচিত। কিন্তু তখন তারা সরকারে চলে গেছে। তারা যে এক বছরের মধ্যে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যেতে পারল না, সেটা হতাশাজনক।

অভ্যুত্থানে নারীদের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখছি নারীরা বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এরপর মুরাদনগরে ভয়াবহ যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটল। কেন সরকার নারীদের সুরক্ষায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না?

সরকার বলছে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমরা নাকি সেসব দেখতে পাই না। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে পাশের দেশ থেকে একটা বিশাল ক্যাম্পেইন করা হয়েছে—‘শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে, দেশটা নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।’ সেই ক্যাম্পেইনের বিষয়টা স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, এখন যেকোনো ঘটনাকে বেশি করে প্রচারে আনা হয়। যেটা আগে তারা করত না, অন্য কেউ করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সমস্যা থাকার পরেও সরকারের উচিত ছিল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তারা যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সেটা নিয়ে পরিষ্কার করে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। যেমন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট যখন পেশ করা হলো, তখন প্রধান উপদেষ্টা বললেন, এটা একটা যুগান্তকারী দলিল, এটা সবার জন্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কিন্তু যেই মুহূর্তে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য শোনা যায়নি। সরকারই কিন্তু নারী কমিশনের জন্য সম্মানিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই নারীদের অপমানের শিকার হতে হলো। তার বিরুদ্ধে সরকার তো কিছু বলল না এবং করল না। এ দায় যে সরকারের সেটাও স্বীকার করল না। সরকার কি তাহলে তাদের ভয় পেয়েছে? না আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, সরকার ভয় পায়। এটা নিয়ে আমি একটু সন্দিহান। আমার কাছে মনে হয়, দুটোই হতে পারে।

যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে চিন্তার ব্যাপার। আর প্রথমটি হলে অন্য রকম চিন্তার ব্যাপার। দুটোই আসলে বাংলাদেশের নারীদের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ নারীদের জন্য সারভাইবালের বিষয়। আমার যা বয়স, আমাকে কেউ সাইবার বুলিং করলে আমি সেটাকে পাত্তা দেব না। কিন্তু ১৭, ১৮, ১৯ বছর বয়সের মেয়েদের যখন এটা করা হবে, সেটা তো তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ সাইবার স্পেসে বুলিংটা তো জনপরিসরে করা হয়ে থাকে। আর সেটা আবার থেকে যাচ্ছে। কারও যদি ডিপ ফেক ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটা থেকে যাচ্ছে। অনলাইনে অনেকে এ ধরনের ভিডিওকে আলাদা করতে পারে না। সে কারণে নারীটির সারা জীবনের জন্য ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সব কিছু নেতিবাচকতার দিকে চলে যায়। তাঁর পরিবার থেকে সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে থাকে।

এসবের পরেও যেসব নারী রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, তাঁদের স্যালুট জানাই। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এটা একমাত্র দেশের নারীদের অর্জন। এত কিছুর পরেও তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে এ রকম সক্রিয় নারীদের অংশগ্রহণ এর আগে আমরা কিন্তু দেখিনি। সব আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও এভাবে আর কখনো নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়নি।

কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, দেশে আবার দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

সেটা তো আসতেই পারে। তবে এর দায়টা আসলে সবার। আমরা সবাই পদপদবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। যেই মুহূর্তে পদপদবি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলো, সেই সময়ে এ-ওর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিল। আওয়ামী লীগের লোকের বিরুদ্ধে নয় কিন্তু, নিজেরা নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে। কারণ, তখন ‘কলঙ্কিতকরণ’ পদ্ধতিটাকে ব্যবহার করা হলো। আপনি যখন নিজের সহযোদ্ধাকে কলঙ্কিত করছেন, যাতে তিনি কোনো পদপদবি না পান। এর চেয়ে সুবিধাজনক সময় ফ্যাসিবাদের কাছে কী থাকতে পারে? কারণ, বিগত সরকার তার আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কাঠামো রেখে গেছে। কিন্তু সেই কাঠামোকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।

আর এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের সমাজ তৈরি ছিল না। সরকার গঠনের আগে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। আর এলিটরা তো সেই কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইবে না। সে জন্য বলছি, বিগত সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেগুলো তৈরি করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আগে যেমন আওয়ামী লীগ করার জন্য সবকিছু পাওয়া যেত, এখন সেখানে আওয়ামী লীগ করেন না, সেটা প্রমাণ করতে পারলে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছেন। কেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা গেল না, সেই দায় এই সুবিধাভোগীদের। কিন্তু বেশি দায় হলো সরকারের—যারা সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু সময়টা পার করল, কিন্তু কোনোভাবেই আসল কাজটি করল না।

জুলাই আন্দোলনের চেতনা কেন আমরা ধরে রাখতে পারলাম না?

জুলাই আন্দোলনের চেতনাটা আসলে কী? সেটাও তো আমরা সবাই জানি না। কারণ, সে সময় তো এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমরা সবাই চেয়েছি হত্যাকাণ্ড থামানো এবং শেখ হাসিনার পতন। দিন দিন সরকার বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে এবং আরও বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু এইবার যখন এত বেশি ফোর্স প্রয়োগ করার পরেও মানুষ মনে করেছে হাসিনাকে সরাতে পারলে হত্যাকাণ্ড থামানো যাবে। তাঁকে হটানো ছাড়া এর বেশি কোনো চিন্তা কারও মধ্যে ছিল না।

তবে আমি দেখেছিলাম, জুলাই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে সময় দেয়ালে যেসব কথাবার্তা লিখেছে বা ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়েছে, সেখানে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাদের কাছে ইনক্লুসিভনেসের কথা ছিল। তারা বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য মুক্তির কথা বলেছে। আমরা আসলেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন এবং ইনক্লুসিভনেসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হারিয়ে গেছে। কারণ, ৫ আগস্টের পর আমরা দেখলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষাটা এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম ৩ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল। এদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে—এ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? আমার মনে হয়, এ পরিস্থিতিটাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার এদের গুরুত্ব হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কারও শক্তি থাকতে পারে। এদের পেছনে আসলে দেশের মধ্যে বা বাইরের কোনো শক্তি বা উত্তর পাড়ার ইন্ধন থাকতে পারে কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার কাছে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাটাই আমার চাওয়া ছিল।

আর একটা কথা, জুলাই চেতনাকে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শবোধ দ্বারা দেখতে চেয়েছি। এ কারণে কারও সঙ্গে কারওটা মেলেনি। অনেকে হয়তো বলতে পারে, আমরা প্রতারিত হয়েছি। আসলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর মানুষ তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে।

আর ডানপন্থী ফ্যাসিবাদ আসার যে আশঙ্কার কথা বললেন, সেটা তো সারা বিশ্বে এসেছে। তবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে আমি বলতে চাই, যারা এ ধরনের ফ্যাসিবাদ চান না এবং যাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি ছিলেন, তাঁদের সবার উচিত একটা প্ল্যাটফর্মে আসা, আমরা যাতে পরের ধাপে অগ্রসর হতে পারি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তারেকের প্রত্যাবর্তন: অভিমত

রাজনৈতিক ভবিষ্যতের এক মাহেন্দ্রক্ষণ

অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান
ড. কামরুল আহসান।
ড. কামরুল আহসান।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্ম রাজনৈতিক পরিবারে, আজ থেকে ছয় দশক আগে। বাবা দলের প্রতিষ্ঠাতা ও সফল রাষ্ট্রনায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। মা বিএনপির চেয়ারপারসন ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তাই জন্মসূত্রে তারেক বিরল ভাগ্যের অধিকারী। যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছেন, সেদিন থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কীভাবে পরিচালিত হয়েছে, তা তিনি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছেন। বহু প্রতিভার অধিকারী বাবা জিয়াউর রহমান কীভাবে চড়াই-উতরাই মোকাবিলা করে দেশকে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নিয়েছেন, তাও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। মা খালেদা জিয়া হলেন তাঁর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের মাত্র ১০ মাসের মধ্যেই স্বৈরাচারী এরশাদ প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। তখন বিএনপির খুব দুঃসময়। হাল ধরলেন খালেদা জিয়া। তারেক রহমান প্রত্যক্ষ করেছেন, নবাগত তাঁর মা কীভাবে ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে সুসংগঠিত করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনবার দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে তারেক রহমানের রাজনৈতিক পথচলা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে পৈতৃক নিবাস বগুড়া জেলায় দলের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের মাধ্যমে। তৃণমূল সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে পরিচিত হন, যা ছিল তাঁর জন্য মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা তাঁর পরিবার থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতার ঝুলিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করার কাজে সেই অভিজ্ঞতাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন। অতঃপর এই অঙ্গনে তাঁর কর্মকাণ্ড ছিল নিরন্তর প্রবহমান। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশব্যাপী প্রচার-কার্যক্রম পরিচালনার পাঠ গ্রহণ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে আধুনিক ও কার্যকর প্রচারের কৌশল প্রণয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং বিএনপির অমিত সম্ভাবনাময় নেতা হিসেবে তাঁর অভ্যুদয় ঘটে। ২০০১ সালে নির্বাচিত হন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে। ২০০৯ সালে দলের কাউন্সিলের মাধ্যমে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। অল্প সময়ের মধ্যেই তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক গণসংযোগ ও যুবসমাজকে রাজনীতির প্রশিক্ষণ দিয়ে নেতা-কর্মী, সমর্থকসহ দেশবাসীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সাংগঠনিক দক্ষতা তাঁকে দলের ভেতরে ও দেশবাসীর কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তোলে। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় জুলুমের শিকার কারাবন্দী দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার স্থলে ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে রয়েছে অনেক চড়াই-উতরাই। কখনো সংগ্রাম সফলতার মুখ দেখে, আবার কখনো-বা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে নেতাকে অপশক্তির রোষানলে পড়তে হয়। কৈশোরের অনুরূপ তারেক রহমানের রাজনৈতিক অঙ্গনে পথ চলাও নিয়ত সরলরৈখিক হয়নি। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে যে সেনা সরকার এসেছিল, তা জরুরি অবস্থা জারি করে বিরাজনীতিকরণের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়।

বিশেষ করে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করতে সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনী এবং টাস্কফোর্সের নামে হামলা-মামলা, জুলুম ও নির্যাতন চালায়। দেশনেত্রীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই নির্যাতন ও জুলুমের শিকার নেতা-কর্মীদের মধ্যে তারেক রহমানের ওপর নেমে আসা নির্যাতনের মাত্রা ও ধরন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ৭ মার্চ ২০০৭ তারিখে গ্রেপ্তারের পর তাঁর ওপর নেমে আসে পৈশাচিক নির্যাতন। এই আক্রমণ তাঁর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার জন্যই করা হয়েছিল। তিনি ভাগ্যক্রমে এবং দেশবাসীর দোয়ায় বেঁচে যান। ৭ মার্চ ২০০৭ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখে তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। এটি তাঁর জন্য একদিক থেকে যেমন নির্বাসনের যন্ত্রণা ভোগের শামিল, অন্যদিক থেকে দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়ে তাঁর নিজের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকে আরও দৃঢ় করার একটি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া। রাজনৈতিক জীবনের এই আঁকাবাঁকা পথ চলায় তিনি যে জীবনমুখী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা তাঁর বর্তমান পথ চলার ক্ষেত্রে পাথেয় হিসেবে ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যতে দেশের দায়িত্ব পালন করার সময় তাঁর এই অভিজ্ঞতার সুবাদে সূচিত হতে পারে বাংলাদেশে সুস্থ রাজনীতির গতিধারা। পৃথিবীর স্বনামধন্য রাজনীতিকগণের জীবন ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, তাঁদের অনেকেরই রাষ্ট্র পরিচালনায় সফল হওয়ার পেছনে রয়েছে অনেক সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা ও চড়াই-উতরাই পার হওয়ার করুণ কাহিনি। সুখ-দুঃখের এই মিশ্র অভিজ্ঞতাগুলো তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকে আরও জোরালো করেছে। তারেক রহমানের রয়েছে নির্যাতনের দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করার অভিজ্ঞতা। রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সফলতম রাষ্ট্রনায়ক পিতা জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের করুণ কাহিনি প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা। আরও রয়েছে মা খালেদা জিয়ার ৪০ বছর যাবৎ বসবাস করা নিজ বাসস্থান থেকে বিতাড়িত হওয়ার করুণ অভিজ্ঞতা। প্রতিনিয়ত নেতা-কর্মীদের ওপর ঘটে যাওয়া অসংখ্য নিপীড়ন-নির্যাতনের কাহিনি তো রয়েছেই। এই অভিজ্ঞতাগুলো তারেক রহমানকে করে তুলেছে এক সর্বংসহা রাজনীতিক হিসেবে। তাঁর মধ্যে এমন এক বোধ তৈরি হয়েছে, যা তাঁকে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অপরিহার্য করে তুলেছে।

সুতরাং বলা যায়, যে অভিজ্ঞতাগুলো একজন মানুষকে ব্যক্তি, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ উপলব্ধিতে সাহায্য করে, তারেক রহমান সেই অভিজ্ঞতার আলোকে প্রায় অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে রাজনীতির পঙ্কিল পথে নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার-আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণে এর চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে কি? বোধ করি নেই।

এখন প্রয়োজন হলো, এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সেই বাংলাদেশ বিনির্মাণে সচেষ্ট হওয়া, যার স্বপ্ন নিয়ে এ দেশ রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছিল এবং যার সূচনা করেছিলেন তাঁরই পিতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা ও পরবর্তী সময়ে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার মাধ্যমে।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের শেষ দিন ৫ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন, সেদিন থেকেই এই স্বপ্ন পূরণের বাস্তব এক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। প্রতিশোধের অগণতান্ত্রিক পথ পরিহার করে তারেক রহমান জাতির উদ্দেশ্যে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।

ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত থাকবে, সেটাই জাতির প্রত্যাশা। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন শুধু একজন ব্যক্তির ফিরে আসা নয় বরং গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করে এক নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের এক সুবর্ণ সুযোগ।

অন্তর্বর্তী সরকার তারেক রহমানসহ সকল রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমে এই সুযোগের বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকা উচিত। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার বজায় থাকলে প্রতিহিংসার বিপরীতে গণতান্ত্রিক ইতিবাচক প্রতিযোগিতার বিজয় অনিবার্য।

লেখক: অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান, উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বড়দিনের শুভেচ্ছা

সম্পাদকীয়
বড়দিনের শুভেচ্ছা

দেখতে দেখতেই যেন বছরটা শেষ হয়ে আসছে। ২০২৫ সালের হতাশা-প্রত্যাশার হিসাব কষতে কষতে বড়দিন কড়া নেড়ে দিল দরজায়। সব হতাশা ভুলে প্রত্যাশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিতে প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের আগমন হয়, ভালোবাসা ও একতার বাণী ছড়িয়ে। এ দিনে পৃথিবীতে যিশুখ্রিষ্টের আগমন, শান্তি আর সৎপথের বার্তা নিয়ে। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য তাই দিনটি বিশেষ।

আজ বড়দিন। যিশুর অনুসারী তথা খ্রিষ্টানদের সবচেয়ে বড় উৎসব। পবিত্র এ দিনটি আজ বিশ্বজুড়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছে। বহুবিধ সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশেও ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই মিলে উদ্‌যাপন করছে যিশুর জন্মদিন। গির্জা কিংবা ঘরোয়া পার্বণ—সবখানে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে সেই যিশুকে, যিনি বেথলেহেমের এক গোয়ালঘরে জন্মেছিলেন। স্মরণ করা হচ্ছে তাঁর জন্মের পবিত্র লগ্নকে।

আজ যিশুর বন্দনা গাওয়ার দিন। কারণ, এই দিনে ধরণিতে তাঁর আবির্ভাব হয় বিশেষ উদ্দেশ্যে—ত্রাতা হিসেবে। তিনি অন্যকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন পাপ-পঙ্কিলতা বর্জন করে করুণা, পবিত্রতা ও সুন্দর পথে কীভাবে জীবন পরিচালনা করা যায়। ঈশ্বরের প্রতি আস্থা এনে মুক্তির পথ খুঁজতে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

বড়দিনে যিশুখ্রিষ্টের জন্মের কাহিনি পাঠ ও ধ্যান করা হয়। সেই কাহিনি অবলম্বনে গির্জায় এবং বাড়িতে বাড়িতে গোশালা নির্মাণ করে ফুলপাতা দিয়ে সাজানো হয়। এ দিনে চলে গানবাজনা, নামসংকীর্তন, ভোজন, আনন্দ-উল্লাস। এসব উৎসব-আয়োজনের চেয়েও বড় ব্যাপার হয়ে ওঠে নিজেদের হৃদয়-মন ও অন্তরাত্মাকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করার প্রয়াস। তাই খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা বড়দিনের পূর্ববর্তী চার সপ্তাহব্যাপী ধ্যান-অনুধ্যান, মন পরীক্ষা, ব্যক্তিগত পাপ স্বীকার, সমবেত পুনর্মিলন বা ক্ষমা-অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষে-মানুষে সুসম্পর্ক গড়তে সচেষ্ট হন।

ঈশ্বরের মহান বার্তাবাহক যিশুকে অনুসরণ করলে কতই না সুন্দর একটি সমাজ গঠন করা যায়! অথচ পাপাচারের পৃথিবীতে সেই সমাজ থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে বাস করি। মানবজাতির জন্য এ এক দুর্ভাগ্য! এ রকম সংকটের মুহূর্তেই যিশুর বাণী, বড়দিনের বার্তা যেন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে—মানুষে-মানুষে ভালোবাসা ও একতার বীজ বুনতে হবে; ধর্ম-বর্ণ-জাতিনির্বিশেষে সবার প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। কোনো জাতি, ধর্ম বা তার অনুসারীর প্রতিই বিরুদ্ধাচরণ কাম্য নয়।

বড়দিন উপলক্ষে প্রতিবছর বাংলাদেশে সরকারি ছুটি থাকে। শান্তিপূর্ণভাবে উদ্‌যাপনের পাশাপাশি দিনটিতে প্রিয় স্বদেশের মঙ্গল কামনার জন্য খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা প্রার্থনা করতে ভোলেন না। এই প্রার্থনা আর শান্তিরাজ যিশুর দেখানো পথে চলার প্রয়াসই কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে পারে। বড়দিন সবাইকে বারবার সুযোগ দেয় দুর্নীতি, অনাচার, পাপাচার বর্জন করে সৎপথে চলার। সেই সুযোগ হেলায় হারানো যাবে না। বরং কাজে লাগিয়ে গড়তে হবে একতার বাংলাদেশ; যে বাংলাদেশে ধর্মকে পুঁজি করে মিথ্যা অপবাদে কাউকে হত্যা করা হবে না—সে যে কেউ হোক।

সবার জীবনে বড়দিন শান্তি বয়ে আনুক। সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বিশ্বজুড়েই কেন গণমাধ্যম আক্রান্ত

রাজিউল হাসান
১২ মাসে নিহত সাংবাদিকদের প্রায় অর্ধেকেরই প্রাণ গেছে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে। ছবি: এএফপি
১২ মাসে নিহত সাংবাদিকদের প্রায় অর্ধেকেরই প্রাণ গেছে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে। ছবি: এএফপি

গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। এই দর্পণে চোখ রাখলে সমাজ তার অন্ধকার দিকগুলো আবিষ্কার করতে পারে, ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগ পায়। এ কারণেই যুগে যুগে সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া ব্যক্তিরা গণমাধ্যমকে ‘শত্রু’ মনে করে এসেছে। অর্থশক্তি, পেশিশক্তি দিয়ে তারা সমাজের এই দর্পণের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেছে। সেই ধারাবাহিকতা ২০২৫ সালেও ছিল। এ বছরেও গণমাধ্যম আক্রান্ত হয়েছে, সাংবাদিকদের প্রাণ গেছে।

সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ফ্রান্সের প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডাসের তথ্য বলছে, বিদ্বেষ ও দায়মুক্তির সংস্কৃতির কারণে ২০২৫ সালেও সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন। এ বছর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিক শুধু প্রাণই দেননি, তাঁরা হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্যবস্তুও হয়েছেন।

সংগঠনটির তথ্য বলছে, বিগত ১২ মাসে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকসহ ৬৭ জন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৫৩ জনই প্রাণ দিয়েছেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিংবা অপরাধী চক্রের লক্ষ্যবস্তু হয়ে। এই ৬৭ জনের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরই প্রাণ গেছে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে। এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধেও সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে সাংবাদিকদের। আফ্রিকার দেশ সুদান সাংবাদিকদের জন্য হয়ে উঠেছে প্রাণঘাতী যুদ্ধক্ষেত্র। মেক্সিকোয় অপরাধী চক্রের হাতে প্রাণ গেছে ৯ সাংবাদিকের। উত্তর আমেরিকার এই দেশটিকে বলা হয় সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের দ্বিতীয় বিপজ্জনক রাষ্ট্র।

সাংবাদিকেরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শুধু প্রাণই দিচ্ছেন না, তাঁরা আটক-গ্রেপ্তারেরও শিকার হয়েছেন। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অন্তত ৫০৩ জন সাংবাদিক কারান্তরীণ হয়ে আছেন।

কেবল অপরাধ চক্রের উৎপাতে অতিষ্ঠ দেশ কিংবা যুদ্ধকবলিত দেশই নয়, গণতন্ত্রের চর্চার দাবি করা দেশেও সাংবাদিকেরা দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছেন। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকের ওপর সহিংসতা বেড়ে গেছে। ফ্রিডম অব দ্য প্রেস ফাউন্ডেশন নামের অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যত সাংবাদিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তা গত তিন বছরের মোট সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনার সংখ্যার বেশি।

ফ্রিডম অব দ্য প্রেস ফাউন্ডেশন বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে নিপীড়নের শিকার সাংবাদিকদের বেশির ভাগই আক্রান্ত হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা।

প্রশ্ন উঠতে পারে, সাংবাদিক কেন আক্রান্ত হন? বিশ্বজুড়েই দেখা যায়, যখন কোথাও অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়, সাংবাদিক সেখানে যান পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবে তথ্য সংগ্রহ করতে। তিনি কারও পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কাজ করেন না। শুধু জনসাধারণকে সঠিক তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর এই প্রচেষ্টায় কোনো না কোনো পক্ষ ক্ষুব্ধ হয় সেই পক্ষের উদ্দেশ্য প্রকাশ হওয়ার ভয়ে।

আবার অপরাধী চক্র সাংবাদিককে আক্রমণ করে তাদের গোমর ফাঁসের ভয়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আরও বেশি থাকে। কারণ, এমন পরিস্থিতিতে মানবাধিকারের বালাই থাকে না। মাঠের পরিস্থিতি যেন বিশ্বমানবতা জানতে না পারে, সে চেষ্টার অংশ হিসেবে আক্রমণ করা হয় সাংবাদিককে।

কখনো কখনো শুধু রোষের বশেও সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করা হয়। শুধু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী না, কখনো কখনো রাষ্ট্রও গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরে। সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন, এর উদাহরণ বিশ্বজুড়েই রয়েছে। নতুন করে আর কোনো দেশের নামোল্লেখ করতে চাই না।

কিন্তু গণমাধ্যম সরকার ও সমাজের বন্ধু হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল সমাজের নানা ত্রুটি তুলে ধরে গণমাধ্যম রাষ্ট্র গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। গণমাধ্যম সে প্রচেষ্টা করেও যাচ্ছে। গণমাধ্যমের শাসক কিংবা কোনো গোষ্ঠীর ‘দাসে’ পরিণত হওয়ার রেকর্ড যদিও আছে, কিন্তু সেটা হাতে গোনা বলা চলে। বাকি গণমাধ্যমগুলো সমাজকে সঠিক পথ দেখাতেই নিরন্তর কাজ করে চলেছে। উদাহরণও আছে ভূরি ভূরি। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে ওয়াশিংটন পোস্ট ও দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ভূমিকা রেখেছিল, তা যুগ যুগ ধরে আলোচনা হবে। কিংবা হাল আমলে যুক্তরাজ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের করোনাকালীন ভূমিকা বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ সে দেশের গণমাধ্যমগুলো যেভাবে প্রকাশ করেছিল, সেটাও বড় উদাহরণ।

একটি জাতি গঠন কিংবা সমাজ গঠন—যে গঠনের কথাই বলা হোক না কেন, গণমাধ্যমের ভূমিকা কিছুতেই খাটো করে দেখা যাবে না। সমাজের ভুলত্রুটিগুলো তুলে ধরাই সাংবাদিকের কাজ। এমনকি শাসক দল যখন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়, তখন গণমাধ্যমই তাদের কথা সবার সামনে তুলে ধরে। অথচ এমনও দেখা গেছে, সেই বিরোধী দল যখন সরকারে যায়, তারাও গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার চেষ্টা করেছে। এভাবেই যুগে যুগে সংবাদমাধ্যমকে বাকরুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে।

আমরা যদি একটু গভীরে ভাবি, তাহলে দেখব, সাংবাদিক যে পারিশ্রমিক পান, সে তুলনায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি যে ঝুঁকি নেন, তা অনেক অনেক বেশি। কার এমন দায় পড়েছে নগণ্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি জীবনের ঝুঁকি নেবেন। তারপরও তিনি ঝুঁকি নেন দায়িত্বের জায়গা থেকে, তিনি ঝুঁকি নেন জনসাধারণকে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ার নেশা থেকে। এই নেশাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া উচিত, দমন করা উচিত নয়। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ মানে একটি সমাজের মৃত্যুর ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া। সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

একবার ভাবুন, একটি দেশের গণমাধ্যমের কণ্ঠ যদি পুরোদমে রোধ করে দেওয়া হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের অবস্থা কী হবে। কেবল ‘বাতাবি লেবুর রেকর্ড ফলনেরই’ গান শুনতে হবে পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়। কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে কেউ থাকবে না কথা বলার।

কাজেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সবার জন্যই জরুরি। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে গণমাধ্যমের সেই স্বাধীনতার সুযোগে সে দূর করতে পারে সমাজের পঙ্কিলতা। বিরোধীরা চাইলে সেই স্বাধীনতার সুযোগে সরকারের অন্ধকার দিকগুলো সমাজের সামনে তুলে ধরতে পারবে। এভাবে পুরো সমাজ-রাষ্ট্রে নিশ্চিত হতে পারে জবাবদিহি।

কিন্তু বিশ্বে গণমাধ্যম নিয়ে এমন নীতি খুব কমই দেখা যায়। বরং উল্টো ঘটনাই বেশি ঘটছে। তারপরও গণমাধ্যম তার কাজ করে চলেছে, যাবে। কারণ, গণমাধ্যম হলো ফিনিক্স পাখির মতো। সে আক্রান্ত হবে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে, তারপর সেখান থেকে মাথা তুলে দাঁড়াবে। গণমাধ্যম এমন একটি শিল্প, এমন একটি দায়বদ্ধতা, যা কখনো কোনো দিন কোনো হামলা, হুমকি, ত্রাসের কাছে মাথা নত করবে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তি: বৈশ্বিক নিরাপত্তা কোন পথে

ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার
২০ জন সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ইউরোপীয় তদন্ত কর্মকর্তারা। ছবি: সংগৃহীত
২০ জন সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ইউরোপীয় তদন্ত কর্মকর্তারা। ছবি: সংগৃহীত

একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় যুদ্ধের ধারণা আমূল বদলে গেছে। রাষ্ট্রের সীমান্ত, সেনাবাহিনী কিংবা প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্র আর একমাত্র ক্ষমতার মানদণ্ড নয়; বরং অদৃশ্য, নীরব ও প্রযুক্তিনির্ভর এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সাইবার স্পেস। আজ তথ্যই শক্তি, ডেটাই অস্ত্র এবং নেটওয়ার্কই নতুন ফ্রন্টলাইন। রাষ্ট্রের অর্থনীতি, সামরিক সক্ষমতা, কূটনীতি, এমনকি নাগরিকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে উঠছে ডিজিটাল অবকাঠামোর ওপর।

সাইবার যুদ্ধ এখন আর কল্পবিজ্ঞান নয়; এটি বাস্তব, চলমান এবং ক্রমাগত বিস্তৃত এক বৈশ্বিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা অচল করা, ব্যাংকিং সিস্টেমে অনুপ্রবেশ, নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ, ভুয়া তথ্য ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ—সবকিছুই আজ সাইবার আক্রমণের আওতায় পড়ে। এসব আক্রমণ কোনো যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই, কোনো গুলির শব্দ ছাড়াই একটি রাষ্ট্রকে কার্যত অচল করে দিতে পারে। ফলে সামরিক শক্তির পাশাপাশি সাইবার সক্ষমতা এখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এরই সঙ্গে দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে নজরদারি প্রযুক্তি। জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে রাষ্ট্রগুলো নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ, যোগাযোগ পর্যবেক্ষণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ডেটা বিশ্লেষণের দিকে ঝুঁকছে। ক্যামেরা, বায়োমেট্রিক ডেটা, মেটাডেটা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—সবকিছুই নজরদারির আওতায় চলে আসছে। এতে একদিকে সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধ দমনের সম্ভাবনা তৈরি হলেও, অন্যদিকে ব্যক্তিস্বাধীনতা, গোপনীয়তা ও মানবাধিকারের প্রশ্নও তীব্র হয়ে উঠছে।

এই প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কোন পথে যাচ্ছে—সে প্রশ্ন ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। সাইবার অস্ত্র প্রতিযোগিতা, ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব, তথ্যনির্ভর আধিপত্য এবং প্রযুক্তিগত অসমতা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা তৈরি করছে। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যেখানে প্রযুক্তিকে আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, সেখানে উন্নয়নশীল ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলো পড়ছে নতুন ধরনের ঝুঁকির মুখে।

এই কলামে সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তির উদ্ভব, রাষ্ট্রীয় কৌশলে এর প্রভাব এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তাকাঠামোর ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রতিফলন বিশ্লেষণ করা হবে। একই সঙ্গে প্রশ্ন তোলা হবে—নিরাপত্তার নামে কতটা নজরদারি গ্রহণযোগ্য এবং এই অদৃশ্য যুদ্ধের যুগে মানবিক মূল্যবোধ ও আন্তর্জাতিক নৈতিকতা আদৌ টিকে থাকবে কি না।

আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থার কৌশলগত আচরণে সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তি এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সামরিক শক্তি প্রদর্শনের প্রচলিত কাঠামোর বাইরে গিয়ে এই অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে তথ্য, ডেটা এবং ডিজিটাল অবকাঠামোর নিয়ন্ত্রণই হয়ে উঠেছে প্রভাব বিস্তারের প্রধান হাতিয়ার। রাষ্ট্রের পাশাপাশি বহুজাতিক করপোরেশন, হ্যাকার গোষ্ঠী, সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক এবং রাষ্ট্র-সমর্থিত সাইবার ইউনিটগুলোও সাইবার স্পেসকে ব্যবহার করছে কৌশলগত সুবিধা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে।

এই প্রেক্ষাপটে সাইবার হামলা, ডিজিটাল স্পাইয়িং, তথ্য চুরি, গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্কে ব্যাঘাত সৃষ্টি এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রোপাগান্ডা আধুনিক সংঘাতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। কোনো একটি দেশের বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা, আর্থিক খাত, সামরিক যোগাযোগ বা নির্বাচনব্যবস্থায় সামান্য ডিজিটাল হস্তক্ষেপও তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই ধরনের আক্রমণ প্রায়ই অজ্ঞাতনামা, সীমান্তহীন এবং যুদ্ধ ঘোষণার বাইরে সংঘটিত হয়, যা প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন ও নিরাপত্তাকাঠামোকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

ফলস্বরূপ, সাইবার যুদ্ধ এবং নজরদারি প্রযুক্তি আজ আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত সক্ষমতা, প্রতিরক্ষা নীতি এবং নিরাপত্তা পরিকল্পনার একটি কেন্দ্রীয় উপাদানে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রগুলো শুধু আক্রমণ প্রতিরোধেই নয়, বরং আগাম হুমকি শনাক্তকরণ, প্রতিপক্ষের দুর্বলতা বিশ্লেষণ এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই প্রযুক্তির ওপর ক্রমবর্ধমানভাবে নির্ভর করছে। এর পাশাপাশি, সাইবার সক্ষমতা এখন আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব, সামরিক জোট এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

তবে এই বাস্তবতা শুধু প্রযুক্তিগত বা সামরিক সক্ষমতার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নয়। সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তির বিস্তার জিওপলিটিকসের সামগ্রিক কাঠামো, রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা স্থিতিশীলতার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। ক্ষমতার ভারসাম্য, সার্বভৌমত্বের ধারণা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা—সবকিছুই নতুন করে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে এই ডিজিটাল যুগে।

এই প্রেক্ষাপটে আধুনিক সাইবার ক্ষেত্রের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব রাষ্ট্রগুলোর জন্য কৌশলগত সতর্কতা, নীতি সমন্বয় এবং বহুপক্ষীয় নিরাপত্তা অংশীদারত্বের প্রয়োজনীয়তাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। বৈশ্বিক নিরাপত্তা কোন পথে অগ্রসর হচ্ছে—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই কলামে সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তির বহুমাত্রিক প্রভাব বিশ্লেষণের প্রয়াস নেওয়া হয়েছে।

সাইবার যুদ্ধ এবং নজরদারি প্রযুক্তি আধুনিক জিওপলিটিকসের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। এটি আর শুধু প্রতিরক্ষা বা আক্রমণের হাতিয়ার নয়; বরং রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত প্রভাব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা স্থিতিশীলতার মূল নির্ধারণকারী। প্রতিটি ডিজিটাল নেটওয়ার্ক, তথ্যপ্রবাহ এবং নজরদারি সক্ষমতা আজ রাষ্ট্রকে শক্তিশালী বা দুর্বল করতে পারে—এটি শুধু প্রযুক্তির নয়, ক্ষমতারও খেলা।

এই বাস্তবতায় রাষ্ট্রগুলোর জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে কৌশলগত সতর্কতা, তথ্যভিত্তিক নীতিনির্ধারণ এবং বহুপক্ষীয় অংশীদারত্বের মাধ্যমে বৈশ্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ন্যায্য এবং নিয়ন্ত্রিত সাইবার ক্ষমতার ব্যবহার আজ শুধু প্রতিরক্ষা নয়; এটি রাষ্ট্রের কূটনীতি, শক্তি ভারসাম্য এবং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার রক্ষাকবচে পরিণত হয়েছে।

ফলস্বরূপ আধুনিক জিওপলিটিকসে সাইবার যুদ্ধ এবং নজরদারি প্রযুক্তি শুধু এক হাতিয়ার নয়; এটি রাষ্ট্রগুলোর ভবিষ্যৎ, বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা এবং শান্তি রক্ষার এক অদৃশ্য, কিন্তু শক্তিশালী ভিত্তি। প্রযুক্তির অদৃশ্য স্রোতগুলোর মধ্যে আজ রাষ্ট্রের ক্ষমতা, নিরাপত্তা এবং প্রভাবের মান নির্ধারিত হচ্ছে—এটি আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা, যা দীর্ঘদিন আমাদের স্মৃতিতে এবং নীতিতে টেকসই রেশ রেখে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত