Ajker Patrika

কান্না সর্বজনীন, সবাই কাঁদে

ইমরান খান
আপডেট : ০৬ মে ২০২১, ২২: ১৩
কান্না সর্বজনীন, সবাই কাঁদে

মীম কাঁদছে। এই পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউ না থাকার বেদনায় তার এ কান্না। মাত্রই ২৬টি লাশের সারি থেকে মা-বাবা ও দুই বোনের লাশ শনাক্তের দগদগে ক্ষত তৈরি হয়েছে নয় বছরের এ শিশুর বুকে। ব্যাগ আঁকড়ে ডুবতে ডুবতে নিজে বেঁচে গেলেও সর্বনাশা পদ্মায় তার অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তার এ বেদনা, অশ্রু সবাইকে স্পর্শ করেছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা, প্রশ্ন খুঁজে পান না সাংবাদিকেরা।

দাদার মৃত্যুর খবর পেয়ে খুলনার তেরখাদায় যাওয়ার পথে ৩ মে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়িতে স্পিডবোট দুর্ঘটনায় জীবনের এ মর্মান্তিক বাঁকে এসে দাঁড়াতে হয়েছে নয় বছরের মীমকে। কাঁদতে কাঁদতে মীমের শরীর শিথিল হয়ে আসে, কান্না বন্ধ হয়; আবার ফুঁপিয়ে শুরু হওয়া কান্না বিলাপ পর্যন্ত গিয়ে থামে। কান্না ছাড়া তার আর কী–বা করার আছে?

কান্না এমনই। কান্নার কাছে `আকবর বাদশা থেকেহরিপদ কেরানি' কারও ভেদ নেই। সত্যিই কি ভেদ নেই? মোঘল সম্রাট আকবর কি সত্যিই কাঁদতেন? সম্রাট আকবর তো ইতিহাসের পাতার আড়ালে লুকিয়েছেন। তাঁর কান্নার হদিস নেওয়া তাই কঠিনই বটে। মহারানি ভিক্টোরিয়ার যুগও গত। তবে আছেন একজন। মহারানি এলিজাবেথ। আচ্ছা ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ কি কাঁদেন?

স্বামীর চিরবিদায়ে কাঁদছেন রানি এলিজাবেথ। যুক্তরাজ্য, ১৭ এপ্রিল, ছবি রয়টার্সএত দিন এই প্রশ্নের উত্তর অজানা ছিল। ডিউক অব এডিনবার্গ প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে রানির অশ্রুসিক্ত চোখ বিশ্বকে এই প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দিল। রানির দুচোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে। অনেকেই ছবির ক্যাপশন লিখেছেন, ‘আজ কোনো প্রটোকল নেই, রানি কাঁদছেন।’

এই কান্না স্বামী হারানোর, সাত দশকের জীবনসঙ্গীর বিদায়ের। এ অশ্রু এক বিশ্বস্ত সঙ্গীর সাহচর্য হারানোর বেদনার। এ কান্না এমন মর্মবেদনার, যা থামিয়ে রাখতে ৭৩০ জন নিরাপত্তাকর্মী কোনো সংখ্যাই নয়। এ যেন রানির ল্যাক্রিমাল গ্রন্থিতে উৎপন্ন সব পানি চোখ থেকে উপচে পড়ার প্রতিজ্ঞার ফল।

হাস্যোজ্বল রানি এলিজাবেথ ও ডিউক অব এডিনবার্গ প্রিন্স ফিলিপ। ১৮ নভেম্বর, ২০১৭ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী ডিউক অব এডিনবার্গ প্রিন্স ফিলিপ গত ৯ এপ্রিল মারা গেলেন, ১৭ এপ্রিল হলো তাঁর শেষকৃত্য। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে সম্ভবত প্রথমবারের মতো রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে কাঁদতে দেখল বিশ্ব। ফিলিপের সঙ্গে রানির বহু হাস্যোজ্জ্বল ছবির পাশে রানির এ অশ্রুসজল চোখ যে কারও মনে ধাক্কা দেয়। একইসঙ্গে স্পষ্ট ঘোষণা দেয়—কান্না সর্বজনীন; সবাই কাঁদে।

অশ্রু কী?
অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী—আবেগ, অসুস্থতা বা ব্যথার কারণে চোখ থেকে প্রবাহিত নোনতা তরলের ফোঁটাকে অশ্রু বলে। আর স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট বিজ্ঞানবর্তিকা বলছে—অশ্রু হচ্ছে পানি, লবণ, কিছু অ্যান্টিবডি ও কিছু অ্যান্টি–মাইক্রোবেয়াল এজেন্টের সংমিশ্রণ, যা মানুষের চোখের ঠিক পাশে থাকা অশ্রু গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়।

আমেরিকান একাডেমি অব অপথালমোলজি ওয়েবসাইটের ফ্যাক্টস অ্যাবাউট টিয়ারস বলছে, বেসল অশ্রু চোখের কর্নিয়াকে ভেজা ও সুরক্ষিত রাখে। চোখে ধোঁয়া, ধূলিকণা বা অন্যকিছু গেলে, তা ধুয়ে ফেলার জন্য উৎপন্ন হয় রিফ্লেক্স অশ্রু।

মানুষ, গরিলা ও হাতির শরীরে আবেগময় অশ্রু নামে আরেক ধরনের অশ্রু পাওয়া যায়। নানা ধরনের মানসিক উত্তেজনা প্রশমনে এ অশ্রু নিঃসৃত হয়। এ অশ্রুতে থাকা বিভিন্ন ধরনের স্ট্রেস হরমোন ন্যাচারাল পেইন কিলার হিসেবে কাজ করে বলেও উল্লেখ করেছে বিজ্ঞানবর্তিকা।

বৈচিত্র্যময় কান্না
কান্নার ধরনে অনেক বৈচিত্র্য আছে। এর মধ্যে মায়া কান্না, চাপা কান্না, বিলাপ করে কান্না, মাতম করে কান্না অন্যতম। অনেকের সামান্য কান্নায় অশ্রুতে চিবুক ভিজে যায়। অনেকে জোরে শব্দ করে বিলাপ করলেও অশ্রুর দেখা মেলে না। কারও কান্নায় শব্দহীন অশ্রু ঝরে, কেউ আবার জনসম্মুখে না কেঁদে একাকী বালিশ ভেজায়।

কে কতবার কাঁদে, তা নিয়েও আছে গবেষণা। আলজেইমার্স রিসার্চ সেন্টারের বর্তমান পরিচালক উইলিয়াম ফ্রে ১৯৮০ সালে এ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। মার্কিন এই প্রাণরসায়নবিদ তাঁর গবেষণায় দেখান, নারীরা মাসে গড়ে ৫ দশমিক ৩ বার কাঁদে। অন্যদিকে পুরুষ কাঁদে মাসে ১ দশমিক ৩ বার। ২০১১ সালে সেইজ জার্নালসে প্রকাশিত এক গবেষণায়ও একই ফল উঠে এসেছে। গবেষণায় দরিদ্র দেশের তুলনায় ধনী দেশের নাগরিকদের কান্নার হার বেশি বলেও তথ্য উঠে আসে।

মানুষ কেন কাঁদে?
মানুষ নানা কারণে কাঁদতে পারে। নানা কারণে চোখে অশ্রু আসতে পারে। শারীরিক ব্যথা, মানসিক দুঃখ, ক্রোধ বা ভয়ে অনেকে কাঁদেন। অনেকর সুখ প্রকাশের মাধ্যমও অশ্রু। বাংলা চলচ্চিত্রে নায়কের সাফল্যে তাঁর মায়ের উক্তি, ‘আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে’ বলে কেঁদে ফেলার দৃশ্যও কোনো বানোয়াট বিষয় নয়। বাস্তব জীবনেও এমন দৃশ্য দেখা যায়। ফল প্রকাশের দিন জিপিএ ৫ পেয়ে মাকে জড়িয়ে কান্নার দৃশ্যও উঠে আসছে পত্রিকার পাতায়। আমাদের নিজের জীবনেও এমন ঘটনা হয়তো অনুপস্থিত নয়।

এই যেমন মন ভাঙায় বেশ কয়েকবারই কেঁদেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তাহুরা তাবাসসুম (২৩)। কখনো খুশি, আবার কখনো হতাশা থেকে তাঁর অশ্রু ঝরেছে। তবে কান্না তাঁর মনের নেতিবাচকতা দূর করে মন ফ্রেশ করেছে; সুন্দর করে নতুন চিন্তা করতে সহায়তা করেছে।

আবার একাকীত্ব বা দুর্ভাবনাও হতে পারে কান্নার কারণ। নতুন চাকরির দ্বিতীয় মাসে করোনা আক্রান্ত হন নাবিউল বাপ্পি (২৮)। কিছুদিন আগে পিতৃবিয়োগ, অফিসে যেতে না পারা, অসুস্থতা, ঘর থেকে বের হতে না পারা মিলে হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর কান্না চলে আসে। কান্না শেষে হাত–মুখ ধুয়ে এলে নিজেকে ভারমুক্ত মনে হয়েছে বলে তিনি জানান।

আবার অন্যের জন্য নয়, মেহেরুন নাহার মেঘলা (২৫) কাঁদেন একান্তই নিজের জন্য। এতে চাপ কমে, চোখ পরিষ্কার হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন। কান্না পেলে কাঁদাই উপকারী বলে মনে করেন এ তরুণী। আর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আসমা ইসলাম (২৪) কাঁদেন রাগ, অভিমান, দুঃসংবাদের জেরে। বললেন, `কান্না আমাকে মানসিক স্থিতিশীলতা দিয়েছে, ভারাক্রান্ত মনে স্বস্তি জুগিয়েছে, সহজে কষ্ট ভুলতে সহায়তা করেছে।’

গবেষণায় দেখা গেছে, আবেগ প্রকাশে কান্না বেশ সহায়ক। ছবি: সংগৃহীতমূলত মনের ভাব প্রকাশের জন্যই মানুষ কাঁদে। পরিস্থিতি অনুযায়ী অনেক সময় অনিচ্ছায়ও কান্না চলে আসে। হেলথলাইন ডটকমে কান্নার ছয়টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে—

* অন্যের সহায়তা পেতে কান্না বেশ সহায়ক। ২০১৩ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়—কেঁদে সাহায্য চাওয়া লোকেদের সাহায্য পাওয়ার হার বেশি।

* রোগের যন্ত্রণা কমাতে কান্না সহায়ক। গবেষণায় দেখা গেছে, কান্নায় শরীরে এন্ডোরফিনস ও অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয়। এসব উপাদান মানসিক কষ্টের পাশাপাশি শারীরিক কষ্ট দূর করতে সহায়তা করে। দীর্ঘস্থায়ী ও সাময়িক রোগের যন্ত্রণায় কান্না সাময়িক স্বস্তি দেয়।

* সামাজিক বন্ধনের ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা আছে। একজনকে কাঁদতে দেখলে অনেকে তার পাশে দাঁড়ায়; কান্নার কারণ জানতে চায়। এতে সমাজের মানুষের মধ্যে অর্থপূর্ণ সংযোগ সৃষ্টি হতে পারে।

* কোনো অনুভূতি চরম আকার ধারণ করলে, তা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ কাঁদে। দুঃখ, অপরাধবোধ, উদ্বেগ, প্রেম, আনন্দ, কৃতজ্ঞতার মতো বহু আবেগ এমন চরম আকার ধারণ করতে পারে।

* মানুষ অনেক সময় অন্যের অনুভূতির সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। একে সহানুভূতি, সমানুভূতি বলা যায়। এ ধারণার মূল কথা হলো অন্যের পরিস্থিতি দেখে বা ওই পরিস্থিতিতে নিজেকে চিন্তা করেও কান্না আসতে পারে। মৃতের বাড়িতে প্রতিবেশীর কান্না এর একটি উদাহরণ।

* দাবি আদায়ের জন্য অনেকে কাঁদেন। পরিবারের সদস্যদের অনেক দাবি সহজে পূরণ না হলে কেঁদে দাবি আদায়, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জনগণের কাছে কান্নাবিজড়িত আহ্বান, সৃষ্টিকর্তার কাছে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে অপরাধের ক্ষমা ও নতুন কিছু চাওয়া এর উদাহরণ। ‘না কাঁদলে মা–ও দুধ দেয় না’ তো প্রবাদই হয়ে গেছে।

কান্নাতন্ত্র
পুরুষতান্ত্রিক দেশে পুরুষদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়—কান্না পুরুষের জন্য নয়। ছেলেরা আছাড় খেয়ে পড়ে গেলে ‘এটুকু ব্যাথায় পুরুষ মানুষের কী হয়’, বলে কান্না থামানোর রেওয়াজও বেশ প্রচলিত। ছোটবেলা থেকে এই ধারণা মনে গেঁথে যাওয়ায় পরবর্তী জীবনেও এর প্রভাব থাকে। হয়তো তাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া কর্তাকেও কাঁদতে দেখা যায় না।

বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, দরিদ্র দেশের তুলনায় ধনী দেশের লোকেদের কান্নার প্রবণতা বেশি। এর পেছনেও আছে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। ধনী দেশের চেয়ে দরিদ্র দেশের নাগরিকেরা সহজেই মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে বলে এমন হয়।

কান্না শেখাচ্ছেন জাপানের মনোবিদ ও কান্নার প্রশিক্ষক হিদেফুমি ইওশিদা। ছবি: হিদেফুমি ইওশিদার ওয়েবসাইটকান্না কি শেখানোর বিষয়?
২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিবিসি বাংলার এক ভিডিও প্রতিবেদনে দেখানো হয়, প্রথাগতভাবে জাপানিদের কান্না নিষিদ্ধ। ছোটবেলা থেকে তাদের না কাঁদতে শেখানো হয়। এটি হয়তো শ্রেষ্ঠত্বের ধারণারই প্রতীক। কিন্তু দেশটির মনোবিদ ও কান্নার প্রশিক্ষক (ক্রায়িং থেরাপিস্ট) হিদেফুমি ইওশিদা মনে করেন, এটা ঠিক নয়। তাঁর মতে, না কাঁদতে পারাটা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কান্না মানুষকে চাপা যন্ত্রণা থেকে সান্ত্বনা দেয়, মন ভালো করে। মানুষের যত অনুভূতি আছে, তার মধ্যে কান্না আসল সত্তাকে বের করে আনে। তাই মানুষকে কান্না করা শেখাতে সেমিনার করছেন ইওশিদা। গত আট বছরে তাঁর প্রচেষ্টায় প্রায় ৫০ হাজার লোকের চোখে পানি এসেছে। মানুষকে কাঁদাতে তিনি সিনেমা, প্রাকৃতিক দৃশ্য, চিঠি ও বই ব্যবহার করেন।

কান্না পেলে কাঁদুন
আবেগ ও ভালো থাকা নিয়ে গবেষণা করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন নেদারল্যান্ডসের টিলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিঞ্জারহয়েটস। তাঁর মতে, সাধারণভাবে অনেক মনোবিদই মনে করেন কান্না দমিয়ে রাখা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তিনি গবেষণা করে দেখেছেন, ‘বেশির ভাগ লোকই মনে করেন কান্না মনকে হালকা করে। তবে কারও কাছে তাঁর সর্বশেষ কান্নার কারণ জানতে চাইলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মন খারাপ হয়ে যায়।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

মধুতে বিষ! শত শত বছর ধরে খেয়ে চলেছে মানুষ এই বিশেষ মধু

রজত কান্তি রায়, ঢাকা  
পৃথিবীর খুব অল্প জায়গায় দেলি বাল কিংবা ম্যাড হানি নামের মধু উৎপাদন হয়। ছবি: সিএনএন
পৃথিবীর খুব অল্প জায়গায় দেলি বাল কিংবা ম্যাড হানি নামের মধু উৎপাদন হয়। ছবি: সিএনএন

শীতকাল এলে সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে গলির মোড়, প্রায় সবখানে মধুর বিজ্ঞাপন চলতে থাকে। কত রকমের যে মধু হতে পারে, তা না দেখলে বোঝা কঠিন। প্রায় সব মধু বিক্রেতার মধুই শতভাগ ‘পিওর’। কারও কারও মধু তো সুন্দরবনের একমাত্র খাঁটি মধু! কারও মধু আবার সরিষা ফুল থেকে তৈরি! যা হোক, শীত মানে বঙ্গদেশে মধুর বাজারে চলে ভীষণ উত্তেজনা। আর দাম? সে তো আপনারা নিজেরাই জানেন।

আমাদের সবার কাছে প্রায় একই রকম তথ্য আছে, মধু হলো উত্তম মিষ্টিজাতীয় খাবার। তার ওপর আর মিষ্টি নেই! সেসব হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু তথ্য যদি বলে, মধুতেও বিষ থাকে! প্রথমে অবিশ্বাস্য, তারপর খতিয়ে দেখার চেষ্টা করবেন অনেকেই। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন। মধুতেও থাকে বিষ। কিংবা মধুও হয় বিষাক্ত। কিন্তু সেটাও খাওয়া হয়। শত শত বছর ধরেই খাওয়া হয়।

যেসব পাহাড়ি জায়গায় রডোডেনড্রন ফুলের প্রাচুর্য আছে, সেসব জায়গায় ম্যাড হানি উৎপন্ন হয়। ছবি: উইকিপিডিয়া
যেসব পাহাড়ি জায়গায় রডোডেনড্রন ফুলের প্রাচুর্য আছে, সেসব জায়গায় ম্যাড হানি উৎপন্ন হয়। ছবি: উইকিপিডিয়া

একটা ছোটগল্প শোনাই। সে বহুকাল আগে, খ্রিষ্টপূর্ব ৪০১ সালের ঘটনা। গ্রিক সেনারা তুরস্কের ট্রাবজোন অঞ্চলে অভিযান চালাল; কিন্তু সেটা ঘটনা নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে সে রকম অভিযানের বহু গল্প আছে। এই অভিযান বিখ্যাত হয়ে আছে, সে অঞ্চলের এক বিশেষ মধুর কারণে। গ্রিক সেনারা ট্রাবজোন অঞ্চলে পাওয়া বিশেষ এক মধু খেয়ে বমি করতে শুরু করল। সেনাদের কেউ কেউ এতটাই মাতাল হয়ে পড়ল যে, তাদের মস্তিষ্কে ‘বিভ্রান্তি’ দেখা দিল। কেউ কেউ মৃত মানুষের মতো পড়ে রইল এবং তারপর যা হওয়ার তা-ই হলো, গ্রিকরা পরাজিত হলো। এ ঘটনার কথা লিখেছিলেন ঐতিহাসিক জেনোফন। সেটাই ছিল এ মধুর বিষক্রিয়ার প্রথম লিখিত বিবরণ।

সেই মধুর নাম ইংরেজিতে ‘ম্যাড হানি’ আর তুরস্কের আঞ্চলিক ভাষায় ‘দেলি বাল’। দেলি অর্থ পাগল, আর বাল অর্থ মধু। দুইয়ে মিলে ইংরেজিতে ম্যাড হানি আর বাংলায় পাগলা মধু।

সীমিত উৎপাদন

সেই মধুর নাম ইংরেজিতে ‘ম্যাড হানি’ আর তুরস্কের আঞ্চলিক ভাষায় ‘দেলি বাল’। দেলি অর্থ পাগল, আর বাল অর্থ মধু। দুইয়ে মিলে ইংরেজিতে ম্যাড হানি আর বাংলায় পাগলা মধু। পৃথিবীর খুব অল্প জায়গায় এই দেলি বাল কিংবা ম্যাড হানি নামের মধু উৎপাদন হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তুরস্কের কৃষ্ণসাগর অঞ্চল আর নেপালের পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের কিছু জায়গায় এই মধু উৎপন্ন হয়। সম্প্রতি সিএনএনের সাংবাদিক মৌরিন ও’হেয়ার এ বিষয়ে একটি লেখা লিখেছেন। তিনি জানিয়েছেন, পৃথিবীর দুটি জায়গায় এই ‘বিরল মধু’ পাওয়া যায়। আবার কিছু সূত্র বলে, এই দুটি জায়গার সঙ্গে জর্জিয়া ও আজারবাইজানের ককেশীয় দেশগুলোতেও সীমিত পরিমাণে এই মধু উৎপন্ন হয়। মূলত যেসব পাহাড়ি জায়গায় রডোডেনড্রন ফুলের প্রাচুর্য আছে, সেসব জায়গায় ম্যাড হানি উৎপন্ন হয়। স্থানীয় পার্বত্য মৌমাছিরা রডোডেনড্রন ফুলের রস সংগ্রহ করে এই বিশেষ মধু তৈরি করে।

বিষাক্ত কেন

রডোডেনড্রন ফুলের পরাগ রেণু ও নেকটারে থাকে গ্রায়ানটক্সিন নামক এক ধরনের নিউরোটক্সিন। এটি মধুতে সঞ্চিত হয়। এই টক্সিনই ম্যাড হানির রহস্যময় ও বিপজ্জনক সব বৈশিষ্ট্য তৈরি করে।

তুরস্কের একটি মৌমাছি পালন ঘর। ছবি: সিএনএন
তুরস্কের একটি মৌমাছি পালন ঘর। ছবি: সিএনএন

এ মধুর স্বাদ কেমন

চেখে যেহেতু দেখা হয়নি, তাই নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে মধু যেহেতু, মিষ্টতা কিছু থাকবেই। তবে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ম্যাড হানির স্বাদ তিতা বা টক অর্থাৎ, সাধারণ মধুর চেয়ে ভিন্ন। এর রং গাঢ় বাদামি বা লালচে রং।

এক দারুণ ঐতিহ্য

বিপদ যতই থাক, যারা এ মধু উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত তারা এটি চেখে দেখবে না, তা তো হয় না। ফলে নেপাল ও তুরস্কের কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে এ মধুকে কেন্দ্র করে শত শত বছর ধরে তৈরি হয়েছে ঐতিহ্য।

নেপালের গুরাং সম্প্রদায় ও তুরস্কের কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের স্থানীয় লোকেরা প্রজন্ম ধরে অল্প পরিমাণে ম্যাড হানি ঔষধি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। তারা এটিকে পেটের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এমনকি যৌনশক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। তবে এর ব্যবহার সব সময়ই একটি জটিল রীতিনীতি ও পরিমিতিবোধের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়।

এটাও বলে রাখি, কিছু মানুষ এটিকে ‘হানি হাই’ বা নেশার জন্যও ব্যবহার করে।

পরিমাণের বেশি খেলে কী হতে পারে?

বিপদ আছে। যেকোনো খাবারই পরিমাণের বেশি খেলে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু এই ম্যাড হানি স্বল্প মাত্রায় খেলেও হতে পারে হালকা ইউফোরিয়া, স্নায়বিক শিথিলতা বা বমি বমি ভাব। আর উচ্চ মাত্রায় খেলে? সে তালিকা বেশ লম্বা।

  • বমি, অতিরিক্ত ঘাম, মাথা ঘোরা।
  • হার্ট রেট ও রক্তচাপ কমে যাওয়া।
  • অস্থিরতা, মাংসপেশির দুর্বলতা।
  • গুরুতর ক্ষেত্রে অ্যারিথমিয়া, শ্বাসকষ্ট, অচেতনতা, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

তবে হ্যাঁ, প্রাকৃতিক এই উত্তেজকের জন্য আছে প্রাকৃতিক চিকিৎসা। জানা যাচ্ছে, সাধারণত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লক্ষণগুলো নিজে থেকে কমে যায়। তবে গুরুতর ক্ষেত্রে হাসপাতালে চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।

বলে রাখা ভালো, এটি বেশির ভাগ দেশে অবৈধ নয়। তবে বিক্রি বা বিপণনে নিয়ন্ত্রণ আছে।

আধুনিক বাণিজ্য ও অপব্যবহার

বিশেষ কিছু অঞ্চলের মানুষদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পরিচালিত জ্ঞানের মাধ্যমে যে মধু একসময় ছিল বিশেষ, সে মধুই এখন ‘অনলাইন পণ্যে’ পরিণত হয়েছে। ফলে চাহিদা বেড়েছে স্বাভাবিকভাবে। নেপাল ও তুরস্ক থেকে এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘এক্সোটিক হানি’ বা ‘সাইকোঅ্যাকটিভ হানি’ হিসেবে বিক্রি হয়। পর্যটকদের মধ্যে এটি খাওয়া একটি ‘অভিজ্ঞতা’ হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, বিশেষ করে নেপালের অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে। আর এ চাহিদা বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে ভেজাল ম্যাড হানির পরিমাণ।

বৈচিত্র্যপিয়াসীরা ভেজাল না খেয়ে আসলের সন্ধান করতে পারেন।

সূত্র:

  • এডিশন ডট সিএনএন ডটকম, মৌরিন ও’হেয়ারের লেখা। ৩ নভেম্বর, ২০২৫
  • The Dangerous Honey of Nepal, BBC, 2019
  • পয়জন ডট ওআরজি
  • জামা নেটওয়ার্ক ডটকম
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

শীতে চাদর স্টাইলিং করবেন যেভাবে

বিভাবরী রায়
ক্রেতাদের চাহিদার কথা ভেবে ফ্যাশন ডিজাইনাররা চাদর নকশাদার করে তুলছেন। ছবি সৌজন্য: সাতকাহন
ক্রেতাদের চাহিদার কথা ভেবে ফ্যাশন ডিজাইনাররা চাদর নকশাদার করে তুলছেন। ছবি সৌজন্য: সাতকাহন

শীত জেঁকে বসেছে। ভারী গরম কাপড় গায়ে না চড়িয়ে বাইরে বের হওয়া কঠিন। তবে চুপি চুপি বলে রাখি, অনলাইন শপিংয়ে যাঁরা পটু, তাঁরা কিন্তু প্রতিবছর নিত্য়নতুন গায়ে চড়ানোর চাদর কিনে ফেলেন। হ্যাঁ, মায়ের বকুনি খাওয়ার ভয়ে হয়তো আলমারিতে বন্দী করে রাখেন। কিন্তু প্রতিবছর এত সুন্দর সুন্দর থিমে চাদর বাজারে আসে, না কিনলেই বরং অপরাধবোধ হয়!

শীতের চাদরের আবেদন সব সময় ছিল। আগে সেগুলো শাড়ি বা সালোয়ার কামিজের সঙ্গে পরতেন মেয়েরা। আর এখন পরছেন জিনস টপসের সঙ্গে। তবে কখন কালার ম্যাচিং এবং কখন কালার কনট্রাস্ট করে পরতে হবে, তা মনে রাখতে হবে। কীভাবে পরবেন, তা নির্ভর করে কোথায় যাচ্ছেন এবং নিজে কতটা ক্যারি করতে পারছেন, তার ওপর। সৌমিক দাস, প্রধান নির্বাহী, রঙ বাংলাদেশ

শীতে স্টাইলিংয়ের জন্য চাদরের তুলনা হয় না। একসময় চাদরের জমিনে ফুটিয়ে তোলা হতো বিভিন্ন নকশা। এখন ক্রেতাদের চাহিদার কথা ভেবে ফ্যাশন ডিজাইনাররাই সেগুলো নকশাদার করে তুলছেন। তৈরি করছেন বিভিন্ন থিমেটিক নকশার চাদরও। নকশাদার ও থিমেটিক এসব চাদর শাড়ি, কুর্তি, টপস, সিঙ্গেল কামিজ, সালোয়ার-কামিজ—সবকিছুর সঙ্গে পরা যায়। কিন্তু কোন পোশাকের সঙ্গে কোন চাদর কীভাবে পরবেন, সেটাও তো জেনে রাখা প্রয়োজন।

শীতে ভ্রমণ, বনভোজন, সকালে রোদ পোহাতে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারগুলো চলতেই থাকে। একেক জায়গায় একেকভাবে চাদর পরা জরুরি। অর্থাৎ সব জায়গায় একইভাবে চাদর পরা যাবে না।

শাড়ির সঙ্গে

শাড়ির সঙ্গে চাদর স্টাইলিং করার খুব বেশি উপায় নেই। হয় গায়ে জড়িয়ে পরা, নয়তো এক কাঁধের ওপর ফেলে রাখা। সেই ফেলে রাখা গুছিয়েও হতে পারে আবার ছেড়ে দিয়েও হতে পারে। যে ক্যারিশমা করতে পারেন, তা হলো একরঙা শাড়ির সঙ্গে ছাপা ও জ্যামিতিক প্যাটার্নের উজ্জ্বল রঙের মিলমিশ রয়েছে এমন চাদর পরুন।

শাড়ির সঙ্গে চাদর বাঙালি জীবনের ধ্রুপদি যুগলবন্দী। ছবি সৌজন্য: সাতকাহন
শাড়ির সঙ্গে চাদর বাঙালি জীবনের ধ্রুপদি যুগলবন্দী। ছবি সৌজন্য: সাতকাহন

লুজ ডেনিম প্যান্টের সঙ্গে

লুজ ডেনিম প্যান্ট এখন বেশ জনপ্রিয়। ডেনিম প্যান্টের ওপর ক্রপ টি-শার্ট পরলেও কিন্তু গায়ে জড়িয়ে নিতে পারেন চাদর। ডেনিমের ওপর জড়িয়ে নিতে পারেন উলের সুতায় বোনা, তসরের কিংবা সিনথেটিক সুতায় বোনা চাদর, সিল্কের চাদর, অ্যান্ডি চাদর অথবা ডুপিয়ান কাপড়ের চাদর। গলায় স্কার্ফের মতো জড়িয়ে হোক বা পুরো গা ঢেকে, দিব্যি বেরিয়ে পরতে পারেন ডেনিমের সঙ্গে চাদর পরে।

কামিজের সঙ্গে

একটু স্টাইলিশভাবে পরতে প্রথমে চাদর গলায় ঝোলান। চাদরের শেষ দুই মাথা একসঙ্গে গিঁট দিয়ে নিন। বড়সড় যে লুপটি তৈরি হলো, তা গলায় পরুন। গিঁটের অংশটি কাঁধের পেছনে থাকবে। এবার টুইস্ট করে দুই বা তিন স্তরে গলায় পরুন এবং প্রয়োজনমতো ছড়িয়ে নিন। যাতে এলোমেলো না হয়ে যায়। সেটা ঠেকাতে গিঁটের সঙ্গে ব্রোচ পিনআপ করে নিতে পারেন।

আরও যেভাবে পরতে পারেন

ডেনিম প্যান্টের ওপর ক্রপ টি-শার্ট পরলেও কিন্তু গায়ে জড়িয়ে নিতে পারেন চাদর। ছবি সৌজন্য: সাতকাহন
ডেনিম প্যান্টের ওপর ক্রপ টি-শার্ট পরলেও কিন্তু গায়ে জড়িয়ে নিতে পারেন চাদর। ছবি সৌজন্য: সাতকাহন

এলিগ্যান্ট স্টাইলের জন্য

অভিজাত লুক পেতে বেছে নিতে পারেন ইউনিক বো স্টাইল। এ স্টাইলের জন্য পাতলা চাদর বেছে নিতে পারেন। কাঁধের দুই পাশে ঝোলানো চাদরের এক প্রান্ত বড় ও অন্য প্রান্তটি ছোট রাখুন। এবার বড় প্রান্তটির শেষ মাথা থেকে ওপরের দিকে লুপ তৈরি করুন। এরপর লুপের মাঝ বরাবর ধরে অন্য প্রান্ত দিয়ে পেঁচিয়ে টাইট করে নিন।

আউটিংয়ে ঝলমলে দেখাতে

একটু ঝলমলে আউটলুক পেতে উজ্জ্বল রঙের শাল বেছে নিতে পারেন। ওজনে হালকা ও উজ্জ্বল প্রিন্টের চাদর আর কুল টোনের কামিজ বা একরঙা টি-শার্ট চটজলদি অভিজাত লুক দেবে। উজ্জ্বল রঙের প্রিন্টের চাদর সাদামাটা শার্ট বা টপসকেও অভিজাত লুকে বদলে দেয়।

বোহিমিয়ান স্টাইল

বোহিমিয়ান স্টাইলে শাল বা চাদর পরতে গলায় দুই প্যাঁচে জড়িয়ে বাঁ পাশের প্রান্তের এক কোনা ডান দিকে চাদরের গলার অংশের সঙ্গে পিনআপ করে নিন। অন্য প্রান্তটি থাকবে ছড়ানো প্রান্তের নিচে।

সালোয়ার ও কামিজের সঙ্গে চোদর। ছবি সৌজন্য: সাতকাহন
সালোয়ার ও কামিজের সঙ্গে চোদর। ছবি সৌজন্য: সাতকাহন

কোথায় পাবেন এসব চাদর

প্রায় সব ফ্যাশন হাউস বিভিন্ন ধরনের চাদর বিক্রি করে। অনেক অনলাইন পেজও এগুলো বিক্রি করে। কোনো কোনো পেজ পছন্দমতো চাদর তৈরিও করে দেয়। প্রতিটি জেলা শহরের সুপারমার্কেটে বা যেকোনো শপিং মলে খুঁজলে পাওয়া যাবে পছন্দের চাদর।

ছবি সৌজন্য: সাতকাহন

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সবুজ পৃথিবীর জন্য ২০২৬: নতুন বছরে কিছু পরিবেশবান্ধব সংকল্প নিন

ফিচার ডেস্ক, ঢাকা 
২০২৬ সালে সবুজ ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে জীবনে যোগ করুন কিছু অভ্যাস। প্রতীকী ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি।
২০২৬ সালে সবুজ ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে জীবনে যোগ করুন কিছু অভ্যাস। প্রতীকী ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি।

২০২৬ সাল আমাদের দোরগোড়ায়। নতুন বছর মানেই নিজের উন্নতির জন্য নতুন সব পরিকল্পনা। কিন্তু এই বছর ব্যক্তিগত লক্ষ্যের পাশাপাশি আমাদের এই সুন্দর গ্রহটিকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্বও কি আমাদের নয়? জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশদূষণের এই সময়ে আমাদের ছোট ছোট কিছু অভ্যাসই পারে বড় পরিবর্তন আনতে। ২০২৬ সালে একটি সবুজ ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে আপনি কিছু অভ্যাস নিজের জীবনে যোগ করতে পারেন।

বর্জ্য নিয়ে নতুন করে ভাবুন

আমাদের প্রতিদিনের ছোট ছোট সমন্বয় বর্জ্য কমাতে বিশাল ভূমিকা রাখে।

একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ছেড়ে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য বোতল বা পাত্র ব্যবহার শুরু করুন। ছবি: পেক্সেলস
একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ছেড়ে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য বোতল বা পাত্র ব্যবহার শুরু করুন। ছবি: পেক্সেলস
  • একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ছেড়ে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য বোতল বা পাত্র ব্যবহার শুরু করুন।
  • খাবার সংরক্ষণের জন্য প্লাস্টিকের বদলে কাচ বা ধাতব পাত্র বেছে নিন, যা রাসায়নিকমুক্ত এবং দীর্ঘস্থায়ী।
  • প্লাস্টিক ব্যাগের চাহিদা কমাতে সব সময় সঙ্গে একটি কাপড়ের ব্যাগ রাখুন।
  • বাড়িতে পেপার ন্যাপকিনের বদলে কাপড়ের ন্যাপকিন ব্যবহার করুন। এগুলো বর্জ্য কমানোর পাশাপাশি আপনার ডাইনিংয়ে আভিজাত্য যোগ করবে।
  • মেকআপ তোলা বা ঘর মোছার জন্য ওয়ান-টাইম ওয়াইপস ব্যবহার বন্ধ করুন। এগুলো পচতে ১০০ বছরের বেশি সময় লাগে। এর বদলে সুতি কাপড় বা রিইউজেবল প্যাড ব্যবহার করুন।
  • প্লাস্টিকে মোড়ানো ফল বা সবজি না কিনে আলগা বা কাগজে মোড়ানো পণ্য কিনুন।

যাতায়াতে আনুন পরিবর্তন

স্বল্প দূরত্বের যাত্রায় গাড়ির বদলে বিকল্প পথ বেছে নিলে বায়ুদূষণ কমে, যানজট হ্রাস পায়। ছবি: ফ্রিপিক
স্বল্প দূরত্বের যাত্রায় গাড়ির বদলে বিকল্প পথ বেছে নিলে বায়ুদূষণ কমে, যানজট হ্রাস পায়। ছবি: ফ্রিপিক

যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া কার্বন নিঃসরণের অন্যতম প্রধান কারণ। আপনি গাড়ি যত কম চালাবেন, পৃথিবী তত বেশি শ্বাস নিতে পারবে। বাস, ট্রেন বা সাবওয়ে ব্যবহার আপনার কার্বন ফুটপ্রিন্ট অনেক কমিয়ে দেয়। ছোট যাত্রায় গাড়ির বদলে বিকল্প পথ বেছে নিলে বায়ুদূষণ কমে, যানজট হ্রাস পায় এবং আপনার ব্যক্তিগত কার্বন ফুটপ্রিন্ট অনেক নিচে নেমে আসে। এটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। দূরে কোথাও যাওয়ার বদলে নিজের এলাকার আশপাশে ঘুরুন বা বন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে কিংবা আপনার বাড়িতেই ছুটি কাটান। এই সময়ে দৈনন্দিন বিরক্তিকর কাজগুলো থেকে ছুটি নিয়ে নিজের এলাকার অচেনা জায়গাগুলো ঘুরে দেখুন, স্থানীয় খাবার চেখে দেখুন। এতে একটি দীর্ঘ বিমানযাত্রা বা ক্লান্তিকর সফর থেকে পরিবেশ বেঁচে যাবে। এতে বিমান বা দীর্ঘ সফরের দূষণ কমবে।

খাদ্যাভ্যাসে আনুন টেকসই ধারা

আপনার খাবার প্লেটের সিদ্ধান্তই ঠিক করে দেয় পরিবেশের ভবিষ্যৎ। প্লেটে নিরামিষ বা প্ল্যান্টবেজড রেসিপি, যেমন মসুর ডাল বা কাজু-পান্তা মাংসের তুলনায় অনেক কম কার্বন নিঃসরণ করে। সপ্তাহে অন্তত এক দিন বা দুই দিন মাংস ছাড়া খাওয়ার চেষ্টা করুন। সব সময় স্থানীয় খামারে উৎপাদিত এবং মৌসুমি ফল ও সবজি কেনার চেষ্টা করুন। প্লাস্টিকে মোড়ানো সবজি এড়িয়ে খোলা সবজি কিনুন। খাবারের অপচয় রোধে আগে থেকেই মিল প্ল্যানিং করুন। এটি আপনাকে বাইরের প্লাস্টিক মোড়ানো খাবারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাবে।

বাড়িতে কম্পোস্টিং শুরু করলে তা আপনার গাছের পুষ্টি জোগাবে এবং বর্জ্য কমাবে। ছবি: পেক্সেলস
বাড়িতে কম্পোস্টিং শুরু করলে তা আপনার গাছের পুষ্টি জোগাবে এবং বর্জ্য কমাবে। ছবি: পেক্সেলস

ঘরে শক্তি সাশ্রয় করুন

বিদ্যুৎ সাশ্রয় আপনার পকেটের পাশাপাশি পৃথিবীরও উপকার করে। অনেক সময় যন্ত্র বন্ধ থাকলেও প্লাগ লাগানো থাকলে বিদ্যুৎ খরচ হয়। কাজ শেষে প্লাগ খুলে রাখুন। হ্যালোজেন বাল্বের বদলে এলইডি ব্যবহার করুন। নতুন কোনো যন্ত্র কেনার আগে সেটির এনার্জি রেটিং দেখে নিন। পুরোনো যন্ত্র বদলে এনার্জি-এফিসিয়েন্ট ফ্রিজ বা ওয়াশিং মেশিন কিনুন। স্মার্ট মিটার ব্যবহার করুন, যা আপনার বিদ্যুৎ খরচের ধরন বুঝতে এবং সাশ্রয় করতে সাহায্য করবে। বাড়িতে সোলার প্যানেল বা এয়ার সোর্স হিট পাম্প লাগানোর কথা ভাবতে পারেন।

পানি সংরক্ষণ ও বনায়ন

পানি জীবন হলেও আমাদের অপচয়ের কারণে এটি ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। লো-ফ্লো ফাউসেট বা শাওয়ার ফিক্সচার ব্যবহার করুন। এ ছাড়া ওয়াশিং মেশিনে কাপড় ধোয়ার সময় লোড পূর্ণ হলে তবেই মেশিন চালান। নিজের জানালার পাশে বা বারান্দায় টমেটো বা হার্বস চাষ শুরু করুন। ঘরোয়া উদ্ভিদের কাটিং থেকে নতুন চারা তৈরি করে বন্ধুদের উপহার দিন। বাড়িতে কম্পোস্টিং শুরু করলে তা আপনার গাছের পুষ্টি জোগাবে এবং বর্জ্য কমাবে।

একা লড়াই করার চেয়ে দলগত কাজ বেশি কার্যকর। আপনি চাইলে স্থানীয় কোনো ক্লাইমেট অ্যাকশন গ্রুপে যোগ দিতে পারেন। তাদের সঙ্গে এলাকা পরিষ্কার করা বা পরিবেশ সচেতনতামূলক প্রচারণায় অংশ নিন। ২০২৬ সাল হোক আমাদের সচেতনতার বছর। আপনার ছোট একটি পদক্ষেপই পারে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে। শুরুটা হোক আজ থেকেই!

সূত্র: ইকোমিনা, গুড এনার্জি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

শীতে ময়শ্চারাইজার ব্যবহারের পাশাপাশি খেতে হবে এই কয়েকটি খাবার

ফিচার ডেস্ক, ঢাকা 
শীতে ত্বকের যত্নে ময়শ্চারাইজার ব্যবহারের পাশাপাশি খেতে হবে পুষ্টিকর খাবার। প্রতীকী ছবি: ফ্রিপিক
শীতে ত্বকের যত্নে ময়শ্চারাইজার ব্যবহারের পাশাপাশি খেতে হবে পুষ্টিকর খাবার। প্রতীকী ছবি: ফ্রিপিক

শীতে ত্বকের অতিরিক্ত শুষ্ক ভাব দূর করতে কত কীই-না করি আমরা। যতবার হাত ধোয়া হচ্ছে, ততবারই ময়শ্চারাইজার না মাখলে হাত খসখসে হয়ে উঠছে। ময়শ্চারাইজার মাখার পরও কিছুক্ষণ বাদে বাদে রিঅ্যাপ্লাই করতে হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, ঠান্ডা নাকি আরও বাড়বে। ফলে শুষ্ক ত্বকের অধিকারীদের চিন্তায় এখনই কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে। রূপবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ত্বকের শুষ্ক ও নির্জীব ভাব দূর করতে বাইরে থেকে যেমন মশ্চারাইজার ব্যবহার করা প্রয়োজন, তেমনি নিয়মিত কয়েকটি খাবার খাওয়া উচিত। এতে করে শীতে ত্বক থাকবে উজ্জ্বল, নরম ও মসৃণ। পাশাপাশি ত্বকে বয়সের ছাপও পড়বে দেরিতে।

শীতে ত্বকের আর্দ্রতা কমে যায়। বয়স যত বেশি, ত্বকের আর্দ্রতা তত কম থাকে এই ঋতুতে। এ সমস্যা দূর করতে সাহায্য করতে পারে কিছু খাবার। ঘি, আমলকী, বাদাম, টমেটো, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি খাবার খেলে ত্বকের স্বাভাবিক তেল উৎপাদন অব্যাহত থাকে। কোলাজেন উৎপাদনও বাড়ে। ফলে ত্বক পরিপুষ্ট হওয়ার পাশাপাশি জেল্লা ছড়ায়। শারমিন কচি, রূপবিশেষজ্ঞ এবং স্বত্বাধিকারী, বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ার

ময়শ্চারাইজার ব্যবহারের পাশাপাশি যেসব খাবার খাবেন

খাঁটি ঘি

প্রতিদিন অন্তত এক চা-চামচ ঘি খান। এতে রয়েছে স্বাস্থ্যকর চর্বি ও চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন। এগুলো খেলে শরীর ভালো রাখার পাশাপাশি ত্বকও পরিপুষ্ট হবে। ত্বকের প্রাকৃতিক তৈলাক্ত ভাব বজায় রাখতেও সাহায্য করে ঘি। ফলে ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক হয়ে ওঠে না।

সালাদে টমেটো রাখুন

শীতে বাজারে যে টমেটো পাওয়া যায়, তাতে প্রচুর লাইকোপিন থাকে, যা ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করে। সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি ত্বকের কোলাজেন ভেঙে দেয়। ফলে বলিরেখা পড়ে। এ ছাড়া এটি শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতেও সহায়তা করে।

শীতে সালাদে রাখুন টমেটো। এ ছাড়াও যেভাবে সম্ভব টমেটো খেতে হবে প্রতিদিন। ছবি: পেক্সেলস
শীতে সালাদে রাখুন টমেটো। এ ছাড়াও যেভাবে সম্ভব টমেটো খেতে হবে প্রতিদিন। ছবি: পেক্সেলস

আমলকী

ত্বক তারুণ্যদীপ্ত রাখে ভিটামিন সি। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শীতকালে শরীরে ভিটামিন সি-এর ঘাটতি একাই পূরণ করতে পারে আমলকী। এই ছোট্ট ফল নিয়মিত খেলে তা কোলাজেন বাড়াতে সাহায্য করে। ত্বকের প্রাকৃতিক আর্দ্র ভাব এবং টান টান ভাব বজায় রাখার জন্য এই কোলাজেন বেশি জরুরি।

তিল

এই শীতে তিলের নাড়ু, হালুয়া, ভর্তা তৈরি করে খেতে পারেন। এটি ত্বকের ইলাস্টিসিটি বজায় রাখতে সহায়তা করে। এতে ত্বক থাকে কোমল ও উজ্জ্বল। তিলে থাকা জিংক ও স্বাস্থ্যকর চর্বি ত্বক প্রাকৃতিকভাবে ময়শ্চারাইজড রাখে।

সামুদ্রিক মাছ

সামুদ্রিক মাছের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও ভিটামিন ডি ত্বক কোমল ও হাড় মজবুত রাখে। সপ্তাহে অন্তত দুদিন সামুদ্রিক মাছ খাওয়া দরকার। তবে এই মাছ রান্নায় অতিরিক্ত তেল ব্যবহার না করাই ভালো।

কাঠবাদাম ও আখরোট

ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে ৬টি ভেজানো কাঠবাদাম খান। এতে ত্বক সুন্দর থাকবে। কাঠবাদামে রয়েছে ভিটামিন ই এবং স্বাস্থ্যকর চর্বি, যা ত্বকের কোষ ভালো রাখে। কাঠবাদাম ছাড়াও খেতে পারেন আখরোট। এতে রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড; যা ত্বকের ইলাস্টিসিটি বজায় রাখে, টক্সিনকে ত্বকের ক্ষতি করতে দেয় না।

বিটরুট

বিটরুটের ভিটামিন এ, সি, পটাশিয়াম ও সুপার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের মৃত কোষ দূর করে ত্বক পরিষ্কার রাখে, ত্বকের পোর বা ছিদ্রগুলো মেরামত করে। প্রতিদিন ৫০০ মিলি লিটার বিটরুটের জুস পান করলে বা সালাদ হিসেবে বিটরুট খেলে ত্বক ভালো থাকে।

টক দই

ত্বকের জন্য যত ধরনের স্বাস্থ্যকর খাবার রয়েছে, সেগুলোর মধ্য়ে প্রোবায়োটিকস খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রোবায়োটিকস হিসেবে টক দই খুব ভালো ও সহজলভ্য একটি খাবার। এতে রয়েছে পেটের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়া, যা অন্ত্রে পৌঁছে অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পেটের স্বাস্থ্যের প্রভাব পড়ে ত্বকে। নিয়মিত খাদ্যতালিকায় টক দই রাখলে ত্বকের স্বাভাবিক তৈলাক্ত ভাব বজায় থাকে। ফলে শীতকালে ত্বকের অতিরিক্ত শুষ্কতা নিয়ে বাড়তি ভাবনা থাকে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত