Ajker Patrika

বাংলাদেশে আরবি ভাষা চর্চা ও ক্রমবিকাশ

উস্তাজ শফিকুল ইসলাম ইমদাদি রাহাত
বাংলাদেশে আরবি ভাষা চর্চা ও ক্রমবিকাশ

বাংলাদেশের ইতিহাসে কিছু ভাষা এসেছে বজ্রনিনাদের মতো—ঘোষণা দিয়ে, আন্দোলন গড়ে, সময়কে কাঁপিয়ে। আবার কিছু ভাষা এসেছে নীরব পদচারণে—কোনো শোরগোল না তুলে, ধীরে ধীরে মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস ও আত্মার গভীরে শিকড় গেড়ে বসেছে। আরবি ভাষা তেমনি এক নীরব অথচ গভীর ভাষা। বহু শতাব্দী আগে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল, অথচ যার ধ্বনি আজও এ ভূখণ্ডের মসজিদ, মাদ্রাসা, পাঠশালা ও হৃদয়ের অলিগলিতে প্রতিধ্বনিত। এ দেশে আরবি ভাষা কোনো রাজসিংহাসনের আদেশে আসেনি, কোনো রাষ্ট্রীয় ফরমানের ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি; বরং এসেছে বিশ্বাসের আলোকরেখা হয়ে, জ্ঞানের বাতি জ্বালিয়ে, মানুষের অন্তরে আশ্রয় নিয়ে—নীরবে, কিন্তু চিরস্থায়ীভাবে।

বাংলাদেশে আরবি ভাষা চর্চার সূচনা খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হয় সমুদ্রপথের সেই দূর অতীতে। অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে আরব বণিক ও দায়িগণ বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী বন্দর ও জনপদে এসে পৌঁছান। তাঁদের সঙ্গে আসে ইসলাম, আর ইসলামের সঙ্গে আসে কোরআনের ভাষা—আরবি। প্রথমে তা ছিল ইবাদতের ভাষা, দোয়ার ভাষা, পবিত্র পাঠের ভাষা। সাধারণ মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত না হলেও হৃদয়ের গভীরে আরবি ধীরে ধীরে জায়গা করে নেয়। এভাবেই শুরু হয় এক নীরব ভাষাযাত্রা।

পরবর্তীকালে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আরবি ভাষা চর্চা আরও সুসংহত রূপ পায়। যদিও সুলতানি ও মোগল আমলে প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে ফারসি প্রাধান্য লাভ করে, তবু জ্ঞান ও ধর্মচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে আরবি ভাষা তার আসন অক্ষুণ্ন রাখে। মসজিদ, মক্তব ও খানকাহে কোরআন, হাদিস ও ফিকহ শিক্ষার মাধ্যমে আরবি ভাষা বেঁচে থাকে। সেই সময়ের আলেম ও সুফিগণ আরবি ভাষাকে কেবল পাঠ্য ভাষা হিসেবে নয়; বরং আত্মশুদ্ধি, চিন্তা ও আধ্যাত্মিক সাধনার ভাষা হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেন।

ঔপনিবেশিক যুগে আরবি ভাষার সামনে আসে কঠিন একসময়। পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তারে ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিক্ষাধারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। কিন্তু ঠিক এই সংকটের ভেতর থেকেই জন্ম নেয় কওমি মাদ্রাসা আন্দোলন, যা আরবি ভাষার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। কওমি মাদ্রাসাগুলো আরবি ভাষাকে পাঠ্যসূচির একটি অংশ হিসেবে নয়; বরং শিক্ষার প্রাণভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। নাহু-সরফ, বালাগাত ও আদবের পাঠে শিক্ষার্থীরা আরবি ভাষার সৌন্দর্য ও গভীরতার সঙ্গে পরিচিত হয়।

বিশ শতকে কওমি ও আলিয়া—এই দুই ধারার মাদ্রাসার হাত ধরে আরবি ভাষা চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। আলিয়া মাদ্রাসাব্যবস্থায় আরবি আধুনিক শিক্ষার কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত হয়, আর কওমি মাদ্রাসায় তা টিকে থাকে ঐতিহ্যের বিশুদ্ধতায়। এই যুগের আলেমগণ নিভৃতে আরবি ভাষায় পাঠদান, ব্যাখ্যা ও লেখালেখির মাধ্যমে ভাষাটিকে জীবন্ত রাখেন। তাঁদের কলম ও কণ্ঠে আরবি ছিল চিন্তার ভাষা, জ্ঞানের ভাষা।

সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে আরবি ভাষা চর্চা কোনো ক্ষণিকের প্রয়াস নয়; এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা এক সুশান্ত কিন্তু অদম্য জ্ঞানধারা। আরব দায়িদের হাতে যার প্রথম বীজ রোপিত হয়েছিল, আলেম ও সুফিদের সাধনায় যা পেয়েছে,আত্মা ও গভীরতা, আর কওমি মাদ্রাসার নিরলস লালনে যা হয়েছে সুসংহত ও প্রজন্মবাহী—সে আরবি ভাষা আজও বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। কওমি মাদ্রাসাগুলো যুগ যুগ ধরে আরবি ভাষাকে কেবল সংরক্ষণই করেনি; বরং সময়ের দাবি অনুযায়ী তাকে শাণিত, সমৃদ্ধ ও জীবন্ত করে তুলেছে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, জামিয়াতুল উস্তাজ শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী ঢাকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ