Ajker Patrika

হাদিসের গল্প: মৃত ব্যক্তির জীবিত হওয়ার বিস্ময়কর ঘটনা

আমজাদ ইউনুস
আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৫, ২০: ৫৩
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন যুগে কয়েকজন মৃত লোকতে জীবিত করেছিলেন। নবী মুসা (আ.)-এর যুগে বনি ইসরাইলের নিহত ব্যক্তিকে জীবিত করেছিলেন। জীবিত হয়ে সে তার হত্যাকারীর পরিচয় প্রকাশ করে। কোরআনে সুরা বাকারায় ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে।

মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং যখন তোমরা এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে, তারপর সে সম্পর্কে পরস্পরকে দোষারোপ করতে লাগলে, অথচ আল্লাহ তা গোপন করছিলেন যা তোমরা গোপন করছিলে। এরপর আমি বললাম, তোমরা এ (গরুর) অংশ দিয়ে তাকে আঘাত করো। এভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং তোমাদের তাঁর নিদর্শন দেখিয়ে থাকেন, যাতে তোমরা অনুধাবন করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৭২-৭৩)

উজাইর (আ.) ছিলেন এক পুণ্যবান ব্যক্তি। যিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদে কিছু হাড় দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন যে কীভাবে আল্লাহ তা পুনরুজ্জীবিত করবেন। তখন আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর গাধাকে একশ বছর মৃত্যুর ঘুমে রেখে দেন এবং পরে পুনরুজ্জীবিত করেন, যাতে তিনি দেখেন কীভাবে আল্লাহ মৃত হাড়গুলো পুনরায় গঠন করেন এবং মাংসে রূপ দেন।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে—অথবা সেই ব্যক্তির মতো, যে কোনো জনপদ অতিক্রম করছিল, যা তার ছাদের ওপর বিধ্বস্ত ছিল। সে বলল, আল্লাহ একে কীভাবে জীবিত করবেন মরে যাওয়ার পর? এরপর আল্লাহ তাকে একশ বছর মৃত রাখলেন। এরপর তাকে পুনরুজ্জীবিত করলেন। বললেন, ‘তুমি কতকাল অবস্থান করেছ? সে বলল, ‘আমি একদিন অথবা দিনের কিছু সময় অবস্থান করেছি’। তিনি বললেন, ‘বরং তুমি একশ বছর অবস্থান করেছ। সুতরাং তুমি তোমার খাবার ও পানীয়ের দিকে তাকাও, সেটি পরিবর্তিত হয়নি এবং তুমি তাকাও তোমরা গাধার দিকে, আর যাতে আমি তোমাকে মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বানাতে পারি এবং তুমি তাকাও হাড়গুলোর দিকে, কীভাবে আমি তা সংযুক্ত করি, এরপর তাকে আবৃত করি গোশ্ত দ্বারা। পরে যখন তার কাছে স্পষ্ট হলো, তখন সে বলল, ‘আমি জানি, নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান’। (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬৯)

বনি ইসরাইলের যুগে এমন আরেকটি ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। বনি ইসরাইলের একটি দলের মৃত্যুর প্রকৃতি ও তার কঠোরতা সম্পর্কে জানার ইচ্ছে হয়েছিল। এ জন্য তারা আল্লাহর কাছে দোয়া করে, যাতে তিনি তাদের জন্য কোনো মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করেন। এতে তারা তার কাছ থেকে মৃত্যুর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে পারে। আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন এবং এক ব্যক্তিকে জীবিত করেন। রাসুল (সা.) সাহাবিদের এ বিস্ময়কর ঘটনাটি শুনিয়েছিলেন। নিচে হাদিসের আলোকে ঘটনাটি বর্ণনা করা হলো—

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, বনি ইসরাইলের একটি দল তাদের একটি কবরস্থানে গিয়ে বলল, ‘চলো, আমরা দুই রাকাত নামাজ আদায় করি এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করি, যেন তিনি আমাদের জন্য কোনো মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করেন, যাতে আমরা তার কাছে মৃত্যুর অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারি।’ তারা তাই করল। এরপর হঠাৎ এক ব্যক্তি তার মাথা কবর থেকে বের করল। সে ছিল গাঢ় বর্ণের, কপালে ছিল সিজদার চিহ্ন। সে বলল, ‘হে লোকসকল, তোমরা আমার কাছে কী চাও? আমি একশ বছর আগে মারা গিয়েছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত মৃত্যুর তীব্রতা আমার থেকে দূর হয়নি। তোমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করো, যেন তিনি আমাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেন।’ (মুসান্নাফে আবি শায়বা ৯ / ৬২)

হাদিসের শিক্ষা

মৃত পুনর্জীবিত করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর: এসব ঘটনায় দেখা যায়, আল্লাহ চাইলেই মৃতদের পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন। শেষোক্ত ঘটনায় তিনি একজন ব্যক্তিকে জীবিত করেছিলেন, যাতে সে মৃত্যুর অবস্থা সম্পর্কে জানাতে পারে।

নেক বান্দাদের প্রতি আল্লাহর সম্মান: শেষোক্ত ঘটনায় একজন সৎ ব্যক্তি পুনরুজ্জীবিত হয়েছিলেন, যার কপালে সিজদার চিহ্ন ছিল। এটি প্রমাণ করে যে আল্লাহ তাঁর নেক বান্দাদের সম্মানিত করেন এবং তাদের মাধ্যমে মানুষকে উপদেশ দেন।

নেককার বান্দাদের দোয়ার গ্রহণযোগ্যতা: যদিও মৃতদের জীবিত করা মানুষের জন্য অস্বাভাবিক ঘটনা, তবু আল্লাহ নেককার মানুষের দোয়া কবুল করে এমন কিছু ঘটাতে পারেন, যা সাধারণ মানুষের বোধ-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার বাইরে।

ভালো কাজের আগে নামাজ আদায়: কোনো ভালো কাজ করার আগে নামাজ আদায় করা উত্তম।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সন্তান আল্লাহর রহমতের স্নেহমাখা উপহার

কাউসার লাবীব
মসজিদের মিনার। ছবি: সংগৃহীত
মসজিদের মিনার। ছবি: সংগৃহীত

সন্তান আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার, এক টুকরা অস্তিত্ব, হৃদয়ের স্পন্দন। সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্ক ভালোবাসা ও দয়ার এক স্বর্গীয় বন্ধন। এই ভালোবাসা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব হৃদয়ে প্রবাহিত এক অলৌকিক অনুভব। এই সম্পর্কের গভীরতা ও গুরুত্ব বোঝাতে কোরআন ও হাদিসে এসেছে দৃষ্টান্ত, যা শুধু ভালোবাসার নয়; বরং দয়া, অনুগ্রহ ও রহমতের নিদর্শন।

সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহ তাঁর রহমতকে ১০০ ভাগে বিভক্ত করেছেন। তার মধ্যে ৯৯ ভাগ তিনি নিজের কাছে সংরক্ষিত রেখেছেন। আর পৃথিবীতে ১ ভাগ পাঠিয়েছেন। ওই ১ ভাগ পেয়ে সৃষ্টিজগৎ পরস্পরের প্রতি দয়া করে। এমনকি ঘোড়া তার বাচ্চার ওপর থেকে পা উঠিয়ে নেয় এই আশঙ্কায় যে সে ব্যথা পাবে।’ (সহিহ্ বুখারি: ৬০০০)

আল্লাহর দেওয়া সেই ভালোবাসা থেকেই মানুষ সন্তানকে কোলে-পিঠে নিয়ে মানুষ করে, আদর করে চুমু খায়, স্নেহ মেখে দেয়। বলা যায়, এ সবই আল্লাহর রহমতের একটি প্রতিফলন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ ক্ষেত্রে নিজের জীবনে ভালোবাসা, স্নেহ ও দয়ার এমন নজির স্থাপন করেছেন, যা যুগে যুগে অভিভাবকদের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবে।

একবার নবী করিম (সা.) প্রিয় নাতি হাসানকে চুমু খান। সে সময় তাঁর কাছে আকরা তামিমি (রা.) বসা ছিলেন। তিনি নবীজিকে বললেন, ‘আমার ১০ ছেলে। আমি তাদের কাউকেই কোনো দিন চুমু দিইনি।’ দয়ার নবী (সা.) তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যে দয়া করে না, সে দয়া পায় না।’ (সহিহ্ বুখারি: ৫৯৯৭)

আরেক হাদিসে এসেছে, ‘এক বেদুইন এসে নবী (সা.)-কে বললেন, আপনারা শিশুদের চুমু দেন, কিন্তু আমরা ওদের চুমু দিই না। প্রিয় নবীজি (সা.) তখন বললেন, আল্লাহ যদি তোমার হৃদয় থেকে দয়ামায়া উঠিয়ে নেন, তাহলে তোমার ওপর আমার কি কোনো অধিকার আছে!’ (সহিহ্ বুখারি: ৫৯৯৮)

সন্তানকে স্নেহ করা, চুমু খাওয়া, কোলে নেওয়া—এসব শুধু আবেগ নয়; বরং একেকটি ইবাদত ও সুন্নাহ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আজকের নামাজের সময়সূচি: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫

ইসলাম ডেস্ক 
আজকের নামাজের সময়সূচি। ছবি: সংগৃহীত
আজকের নামাজের সময়সূচি। ছবি: সংগৃহীত

জীবনকে সুশৃঙ্খল করতে এবং আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে নামাজের কোনো বিকল্প নেই। একজন মুমিনের জন্য নামাজ হলো আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যম। এটি এমন এক ইবাদত—যা আমাদের মনে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি আনে, জীবনের প্রতিটি কাজে আনে বরকত।

প্রতিদিন সময় মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর আবশ্যক। তাই জেনে নেওয়া যাক আজ কোন ওয়াক্তের নামাজ কখন আদায় করতে হবে।

আজ শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ইংরেজি, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বাংলা, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৭ হিজরি। ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকার নামাজের সময়সূচি তুলে ধরা হলো—

আজকের নামাজের সময়সূচি
নামাজওয়াক্ত শুরুওয়াক্ত শেষ
তাহাজ্জুদ ও সেহরির শেষ সময়০০: ০০০৫: ০৬ মিনিট
ফজর০৫: ০৭ মিনিট০৬: ২৬ মিনিট
জোহর১১: ৫০ মিনিট০৩: ৩৪ মিনিট
আসর০৩: ৩৫ মিনিট০৫: ১০ মিনিট
মাগরিব০৫: ১২ মিনিট০৬: ৩১ মিনিট
এশা০৬: ৩২ মিনিট০৫: ০৬ মিনিট

উল্লিখিত সময়ের সঙ্গে যেসব বিভাগের সময় যোগ-বিয়োগ করতে হবে, সেগুলো হলো:

বিয়োগ করতে হবে—
চট্টগ্রাম: ০৫ মিনিট
সিলেট: ০৬ মিনিট

যোগ করতে হবে—
খুলনা: ০৩ মিনিট
রাজশাহী: ০৭ মিনিট
রংপুর: ০৮ মিনিট
বরিশাল: ০১ মিনিট

নামাজ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি যেমন আমাদের দৈহিক পবিত্রতা নিশ্চিত করে, তেমনই আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। আজকের এই নামাজের সময়সূচি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবনের ব্যস্ততা যতই থাকুক না কেন, আল্লাহর জন্য সময় বের করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব।

আসুন, নামাজের মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে তাঁর আরও কাছে নিয়ে যাই। জীবনে নিয়ে আসি ইমানের নুর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

জমাদিউস সানির দ্বিতীয় জুমা: মুমিনের করণীয়

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ 
ক্লোনস্কে মসজিদ, আয়ারল্যান্ড। ছবি: সংগৃহীত
ক্লোনস্কে মসজিদ, আয়ারল্যান্ড। ছবি: সংগৃহীত

জুমাবার ইসলামে একটি অত্যন্ত বরকতময় দিন। এটি সাপ্তাহিক ঈদের দিন হিসেবেও গণ্য। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে জুমার দিনের গুরুত্ব সম্পর্কে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন—‘হে মুমিনগণ, যখন জুমার দিনের আজান দেওয়া হয়, তখন ব্যবসা থামিয়ে জুমার নামাজের জন্য হাজির হও এবং আল্লাহকে স্মরণ করো, যাতে তোমরা কল্যাণ লাভ করো।’ (সুরা জুমা: ৯)

এই আয়াতটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জুমা শুধু ফরজ নামাজের জন্য নয়, বরং আত্মপর্যালোচনা এবং নেক আমল বৃদ্ধির এক মহান সময়। বিশেষ করে জমাদিউস সানি মাসের এই দ্বিতীয় জুমা মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুসলিমদের জন্য আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের সুযোগ এনে দেয়।

অতএব, মাসের এই বরকতময় জুমাবারে নামাজ, দোয়া, কোরআন তিলাওয়াত ও সদকা আল্লাহর নৈকট্য লাভের বিশেষ সুযোগ তৈরি করে দেয়।

জুমার দিনে করণীয় আমলসমূহ

জুমার দিনটি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মূল্যবান। এই দিনে বিশেষভাবে কিছু আমল করা উচিত। যেমন—

  • ১. নামাজে গভীর মনোযোগ দেওয়া।
  • ২. মন দিয়ে খুতবা শোনা।
  • ৩. সদকা ও দান করা।
  • ৪. কোরআন তিলাওয়াত করা।
  • ৫. দোয়া-দরুদ পাঠ করা।

জমাদিউস সানির দ্বিতীয় জুমা আল্লাহর নৈকট্য লাভ, আত্মশুদ্ধি, নেক আমল বৃদ্ধি এবং সমাজে সদকা ও দান করার এক অনন্য সুযোগ। আল্লাহ আমাদের সকলের নেক আমল গ্রহণ করুন এবং জীবনকে শান্তিতে ভরিয়ে দিন।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

মসজিদগুলো হয়ে উঠুক শিশুবান্ধব

ফয়জুল্লাহ রিয়াদ
মসজিদগুলো হয়ে উঠুক শিশুবান্ধব

মসজিদ আল্লাহর ঘর—ইসলামি শিক্ষা, সভ্যতা ও রাষ্ট্র পরিচালনার প্রাণকেন্দ্রও। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম মসজিদের মিম্বর থেকে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। মিম্বরে বসেই যুদ্ধের পরিকল্পনা সাজানো হতো, বিচারিক কার্যক্রমও পরিচালিত হতো এখান থেকে। সে যুগে নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবাই নির্ভয়ে মসজিদে আসতেন। নবীজির মুখনিঃসৃত মূল্যবান নসিহত থেকে নিজেদের জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করতেন।

ইবাদত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের পাশাপাশি মসজিদ ছিল আলোকিত প্রজন্ম গঠনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণস্থল। নবী করিম (সা.)-এর যুগে শিশুরা মসজিদে আসত, ঘুরে বেড়াত, ইবাদত শিখত এবং সাহাবিদের পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করত। মসজিদ ছিল কচিকাঁচাদের ভালোবাসার জায়গা। কোনো ভয় বা নিষেধাজ্ঞার প্রতিবন্ধকতা ছিল না তাদের।

কিন্তু আজকের বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিশুরা মসজিদে এলে অনেকেই তাদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেন, সামান্য দুষ্টুমিতেই ধমক দেন, এমনকি কখনো তাড়িয়েও দেন। এতে করে অনেক অভিভাবকই নিজের সন্তানদের সহজে মসজিদে আনতে চান না। ফলে ধীরে ধীরে মসজিদের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের দূরত্ব তৈরি হয়। অথচ ভবিষ্যতে এই প্রজন্মই উম্মতের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তাই তাদের মসজিদমুখী করা এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।

নবীজির যুগে শিশুদের মসজিদে গমন

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে মসজিদে শিশুদের স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি ছিল। নবীজি (সা.)-এর চারপাশে সাহাবিদের সঙ্গে ছোট বাচ্চাদেরও দেখা যেত। নবীজি (সা.) কখনো তাদের ধমক দিতেন না, তাড়িয়ে দিতেন না। তিনি শিশুদের উপস্থিতিকে স্বাগত জানাতেন। তাদের প্রতি অসীম মমতা দেখাতেন। নামাজ চলাকালেও নবীজি (সা.) শিশুদের প্রতি বিশেষ কোমলতা প্রদর্শন করতেন। তাঁর নাতি হাসান বা হুসাইন (রা.) কখনো তাঁর পিঠে চড়ে বসত। তিনি তাড়াহুড়ো না করে বরং তাদের ভালোবাসার খাতিরে সিজদা দীর্ঘ করতেন।

একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজের সিজদায় গেলে হজরত হাসান কিংবা হোসাইন (রা.) তাঁর পিঠে চড়ে বসে। এ কারণে নবীজি (সা.) খুব দীর্ঘ সময় সিজদায় থাকেন। নামাজ শেষে সাহাবিরা এর কারণ জানতে চাইলে নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমার এই নাতি আমাকে বাহন বানিয়ে নিয়েছিল, তাই তাকে নামিয়ে দিতে আমি তাড়াহুড়ো করতে চাইনি, যতক্ষণ না সে স্বাভাবিকভাবে নেমে আসে।’ (সুনানে নাসায়ি: ১১৪১)। মেয়েশিশুরাও নবীজির স্নেহ থেকে বঞ্চিত হতো না। তারাও মসজিদে আসত। হজরত কাতাদা (রা.) বলেন, ‘নবীজি (সা.) তাঁর কন্যা জাইনাবের মেয়ে উমামাকে কাঁধে নিয়ে নামাজ পড়তেন। সিজদায় গেলে তাকে নামিয়ে দিতেন এবং দাঁড়ালে আবার কাঁধে তুলে নিতেন।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৯১৭)

আমাদের দেশের বেদনাদায়ক বাস্তবতা

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে ‘নামাজের প্রতি শ্রদ্ধা’ দেখানোর লেভেল লাগিয়ে অনেকেই শিশুদের প্রতি রূঢ় আচরণকে বৈধ মনে করেন। তাদের ধমক দিয়ে মসজিদ থেকে বের করে দেন। কোনো কোনো মসজিদ কমিটি ‘বাচ্চাদের মসজিদে আনা নিষিদ্ধ’ লেখা সাইনবোর্ডও টাঙিয়ে রাখেন মসজিদের সামনে। এসব আচরণ শিশুদের কোমল হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে। পরিণতিতে সে মসজিদকে ভয় পেতে শুরু করে। যে রাসুল (সা.) শিশুদের মাথায় মমতার পরশ বুলিয়ে দিতেন, তাঁর উম্মতের কেউ কেউ আজ শিশুদের বকাঝকা করে মসজিদ থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে, এটা বড় লজ্জার বিষয়।

শিশুদের শিক্ষাদানের পদ্ধতি হোক নম্রতা

শিশুরা দেহ-মন উভয় দিক থেকে কোমল। তারা কঠোরতা সহ্য করতে পারে না। নবীজি (সা.) বাচ্চাদের প্রতি খুবই কোমল ছিলেন। আল্লাহ তাআলাও কোমলতা পছন্দ করেন। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা কোমল আচরণকারী, তিনি সর্বক্ষেত্রে কোমলতা ভালোবাসেন।’ (সহিহ বুখারি: ৬০২৪)। অন্য হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নম্রতা থেকে বঞ্চিত, সে প্রকৃত কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত।’ (সহিহ মুসলিম: ২৫৯০)। আমাদেরও উচিত বাচ্চাদের প্রতি কোমলতা প্রদর্শন করা। তাদের কিছু শেখাতে হলেও আদুরে গলায় শিশুসুলভ ভঙ্গিতে শেখানো। বাচ্চাদের জন্য এটি কঠোরতা থেকেও বেশি ফলপ্রসূ।

শিশুরা হোক মসজিদমুখী

শিশুদের মসজিদমুখী করতে হলে নম্রতা, কোমলতা ও ভালোবাসা দিয়ে কাছে টানতে হবে। তাদের জন্য শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। মসজিদের আঙিনায় শিশুদের জন্য আলাদা কর্নার হতে পারে। সেখানে তাদের উপযোগী রঙিন বই, কোরআন শেখার বিভিন্ন মজাদার উপকরণ থাকতে পারে। এতে তারা ধীরে ধীরে মসজিদের প্রতি আকৃষ্ট হবে। পাশাপাশি মসজিদ কমিটি ও ইমাম সাহেবগণ নানা ধরনের উৎসাহমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেন। হতে পারে শিশুদের জন্য সাপ্তাহিক বিশেষ ক্লাস। যেখানে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে তাদের ইসলামের মৌলিক জ্ঞান শেখানো হবে। যারা এতে নিয়মিত উপস্থিত হবে, তাদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ কার্যক্রমও থাকতে পারে।

মসজিদে আসার পর শিশুদের একটু শব্দে কেউ যদি রেগে যায়, বিনয়ের সঙ্গে তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন ‘নবীজির মসজিদেও তো শিশুদের বিচরণ ছিল। আমরা তাদের প্রতি কোমল হই। কঠোর আচরণ পরিত্যাগ করি।’ এভাবে ধীরে ধীরে সমাজের পরিবেশ বদলে যাবে।

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আমরা যদি চাই, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভালো, সচ্চরিত্রবান, নামাজি ও ইসলামি মূল্যবোধসম্পন্ন হোক—তাহলে তাদের জন্য মসজিদ উন্মুক্ত করে দিতে হবে। উৎসাহ, অভয়, ভালোবাসা দিয়ে ও নানা পরিকল্পনা করে তাদের মসজিদমুখী করতে হবে। তাহলেই গড়ে উঠবে আলোকিত প্রজন্ম।

লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুস সুন্নাহ রাজাবাড়ী, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত