Ajker Patrika

যেভাবে কাটছে গাজা যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া শিশুদের জীবন

যুদ্ধ ঘুরিয়ে দিয়েছে শিশুদের জীবনের গতিপথ। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
যুদ্ধ ঘুরিয়ে দিয়েছে শিশুদের জীবনের গতিপথ। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

ফিলিস্তিনের যুদ্ধবিধ্বস্ত উপত্যকা গাজার বাসিন্দা জাকারিয়া। গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধ শুরুর পর থেকে হাজার হাজার মরদেহ দেখেছে বলে ধারণা তার। ১১ বছর বয়সী এই শিশুর স্কুলে অন্য শিশুদের সঙ্গে পড়ায় মনোযোগ দেওয়ার কথা, সে সময় জাকারিয়া গাজার আল-আকসা হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছে। যুদ্ধে আহতদের নিয়ে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স যখন দেইর আল-বালাহ শহরের এই হাসপাতালে এসে থামে, তখন জাকারিয়া ভিড় সরিয়ে রোগীদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য ভেতরে নিয়ে যায়।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বেশ কয়েকজন স্কুলবন্ধুকে হারিয়েছে জাকারিয়া। হাসপাতালে কাটানো সময়টিতে হাজারো ভয়ংকর দৃশ্যের সাক্ষী হচ্ছে সে। জাকারিয়া বলে, একবার একটি ইসরায়েলি হামলার পর তার চোখের সামনে আগুনে পুড়ে একটি ছেলে মারা গেছে।

বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সে বলে, ‘আমি অন্তত ৫ হাজার মরদেহ দেখেছি। নিজ চোখে দেখেছি।’

গাজা: হাও টু সারভাইভ অ্যা ওয়ার জোন তথ্যচিত্র তৈরি করতে গিয়ে বিবিসি যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে, তাদের মধ্যে একজন এই জাকারিয়া। প্রায় নয় মাস ধরে গাজাবাসী যুদ্ধক্ষেত্রে কীভাবে বেঁচে থাকার লড়াই করছে তা নিয়ে কাজ করছিল বিবিসির কর্মীরা।

এই তথ্যচিত্রের সহ-পরিচালক জেমি রবার্টস বলেন, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের গাজা উপত্যকায় প্রবেশ করে স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন তৈরির অনুমতি দেয়নি ইসরায়েল। আমি ও আমার সহকর্মী ইউসুফ হাম্মাশ লন্ডন থেকে সহ-পরিচালনার মাধ্যমে এই তথ্যচিত্রে কাজ করেছি।

ভিডিওচিত্র ও সাক্ষাৎকার সংগ্রহের কাজ করেন গাজার বাসিন্দা চিত্রগ্রাহক আমজাদ আল ফাইউমি ও ইব্রাহিম আবু ঈশাইবা। নিয়মিতভাবে বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ, ইন্টারনেট কল ও মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যোগাযোগ রেখে এই তথ্যচিত্রের কাজ করা হয়।

রবার্টস বলেন, ‘আমি ও ইউসুফ এই তথ্যচিত্র তৈরি করতে চেয়েছিলাম, যাতে দেখানো যায় গাজার সাধারণ মানুষ কীভাবে প্রতিদিনের জীবনে এই ভয়াবহ যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। আমরা কয়েক সপ্তাহ আগে চিত্রগ্রহণ শেষ করেছি, যেদিন থেকে বর্তমান যুদ্ধবিরতি শুরু হয়।’

জাকারিয়া বড় হয়ে প্যারামেডিক হতে চায়। ছবি: বিবিসি
জাকারিয়া বড় হয়ে প্যারামেডিক হতে চায়। ছবি: বিবিসি

আমরা তিনজন শিশু এবং সদ্য মা হওয়া তরুণীর কথা এই তথ্যচিত্রে তুলে এনেছি, যারা এই যুদ্ধের নিরপরাধ শিকার।

হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে গাজায় এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজার ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ জনকে হত্যা এবং ২৫১ জনকে বন্দী করার জবাবে এই সামরিক অভিযান শুরু হয়।

ইংরেজিতে পারদর্শী আবদুল্লাহ। ছবি: বিবিসি
ইংরেজিতে পারদর্শী আবদুল্লাহ। ছবি: বিবিসি

জেমি রবার্টস বলেন, “আমরা মূলত গাজার দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে কাজ করেছি, যা ইসরায়েলের সেনাবাহিনী ‘মানবিক অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। ফিলিস্তিনিদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য সেখানে যেতে বলা হয়েছিল। ”

তবে বিবিসি ভেরিফাইয়ের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মে থেকে চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যে এই অঞ্চলে শতাধিক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করে, তারা সেখানে সক্রিয় হামাস যোদ্ধাদের লক্ষ্যে হামলা করেছিল।

রবার্টস বলেন, ‘আমরা জানতে চেয়েছিলাম, শিশুরা কীভাবে খাবার সংগ্রহ করে, কোথায় ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মধ্যে কীভাবে নিজেদের ব্যস্ত রাখে।’

জাকারিয়ার পর ১৩ বছর বয়সী আবদুল্লাহর কাছে এই যুদ্ধক্ষেত্রে তার জীবন নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। সে এই তথ্যচিত্রের বর্ণনাকারী। আবদুল্লাহ যুদ্ধের আগে গাজার ব্রিটিশ স্কুলে পড়ত। ইংরেজিতে চমৎকার কথা বলতে পারে সে। শিক্ষাজীবন চালিয়ে যাওয়ার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করছে সে।

রান্নার ভিডিও বানিয়ে সময় কাটে ছোট্ট রেনাদের। ছবি: বিবিসি
রান্নার ভিডিও বানিয়ে সময় কাটে ছোট্ট রেনাদের। ছবি: বিবিসি

আরেকটি শিশু বেঁচে থাকার এই লড়াইয়ে সময় কাটাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টিকটকে রান্নার একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। ১০ বছর বয়সী রেনাদ তার বড় বোনের সাহায্যে টিকটকে এই অনুষ্ঠানটি করে থাকে। যুদ্ধের কারণে প্রয়োজনীয় সব উপকরণ তারা সংগ্রহ করতে না পারলেও বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করে। টিকটকে তাদের অনুসরণকারী এক মিলিয়নেরও বেশি।

রবার্টস বলেন, ‘আমরা ২৪ বছর বয়সী রানার কথা তুলে এনেছি তথ্যচিত্রে। নির্ধারিত সময়ের আগেই মা হয়েছেন তিনি। সদ্যোজাত কন্যাসন্তান ও দুই ছেলেকে নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে বর্তমানে হাসপাতালের কাছে বসবাস করছেন রানা। এ পর্যন্ত তিনবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন তিনি।

তথ্যচিত্রে বিবিসি আল-আকসা হাসপাতালের চিকিৎসকদের দিনরাত লড়াই তুলে ধরেছে। আহতদের বাঁচিয়ে রাখার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করছেন তাঁরা। সেখানেই জাকারিয়াকে পেয়েছিলেন বিবিসির কর্মীরা।

সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে তাঁবুতে থাকতে হচ্ছে রানাকে। ছবি: বিবিসি
সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে তাঁবুতে থাকতে হচ্ছে রানাকে। ছবি: বিবিসি

রবার্টস বলেন, ‘হাসপাতালের সবাই এই ছেলেটিকে চেনে। যদিও সে এখনো শিশু এবং কোনো প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী নয়, তবু সে সব সময় আশপাশে ঘুরে বেড়ায়, কাউকে সাহায্য করার সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, যাতে বিনিময়ে কিছু খাবার বা অর্থ পেতে পারে। কখনো সে স্থানীয় সাংবাদিকদের জন্য সরঞ্জাম বহন করে, আবার কখনো আহত বা মৃতদের বহন করতে সাহায্য করে।’

জাকারিয়া বলে, ‘যখন হাসপাতাল কিছুটা ফাঁকা থাকে, তখন অ্যাম্বুলেন্স থেকে রক্ত ও ময়লা পরিষ্কার করতে সাহায্য করে সে। তার স্কুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীও সে। তবে পরিবারের সঙ্গে থাকে না, কারণ সেখানে পর্যাপ্ত খাবার বা পানি নেই। তাই হাসপাতালেই থাকে, যেখানে সম্ভব সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। এক রাতে সিটি স্ক্যান রুমে, আরেক রাতে সাংবাদিকদের তাঁবুতে বা অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে।’

অনেক রাত তাকে না খেয়েই ঘুমাতে হয়েছে বলে জানায় ১১ বছর বয়সী শিশুটি।

হাসপাতালের কর্মীরা যতই চেষ্টা করুক, তারা তাকে আহতদের চিকিৎসার বিশৃঙ্খলা থেকে দূরে রাখতে পারে না। তারা দেখেন, জাকারিয়া কীভাবে রোগীদের যত্ন নিচ্ছে। তারা তাকে একজন রোগীকে ইনট্রাভেনাস (আইভি) ড্রিপ দেওয়া শেখান। তার প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে, হাসপাতালের কর্মীরা তার জন্য ছোট আকারের একটি নীল চিকিৎসাকর্মীর পোশাক তৈরি করে দেন।

জাকারিয়া প্যারামেডিকদের খুব পছন্দ করে এবং নিজেকে তাদের দলের একজন হিসেবে দেখতে চায়। প্যারামেডিক সাঈদকে বেশ পছন্দ করে জাকারিয়া। সে বলে, জাকারিয়াকে একজন শিশু হিসেবে আচরণ করলে সে কষ্ট পায়।

সহপরিচালক রবার্টস বলেন, সাঈদ চেষ্টা করেন যাতে ছেলেটি তার শৈশবের কিছু অংশ উপভোগ করতে পারে এবং ডকুমেন্টারিতে তাদের সৈকতে ঘুরে বেড়ানোর সময়টিও ধারণ করেছি।

প্যারামেডিক সাঈদ চিন্তা করেন, জাকারিয়া এত মৃত্যুর ও ধ্বংসের সাক্ষী হয়ে গেছে যে সে হয়তো আর কখনোই তার বয়সী অন্য শিশুদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারবে না।

জাকারিয়া নিজেও পরবর্তী সময়ের দিকে তাকিয়ে। সে বলে, ‘আমি প্যারামেডিক হতে চাই। কিন্তু আগে আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইয়েমেন সংঘাতে মুখোমুখি অবস্থানে সৌদি ও আরব আমিরাত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আমিরাত সমর্থিত ‘সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল’-এর সৈন্যরা। ছবি: দ্য টাইমস
আমিরাত সমর্থিত ‘সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল’-এর সৈন্যরা। ছবি: দ্য টাইমস

ইয়েমেনের দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে এবার নতুন মাত্রার উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এক সময় একই জোটে থাকা সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এখন কার্যত বিপরীত অবস্থানে। সাম্প্রতিক বিমান হামলা ও কূটনৈতিক বক্তব্যে এই বিভাজন প্রকাশ্যে এসেছে, যা ওই অঞ্চলের যুদ্ধকে আরও জটিল করে তুলছে।

যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক ইনডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, মঙ্গলবার ভোরে সৌদি আরব ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলে বিমান হামলা চালায়। এই হামলার লক্ষ্য ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত–সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ‘সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল’ (এসটিসি)।

সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের দাবি—হাদরামাউতের বন্দরনগরী মুকাল্লায় এসটিসির জন্য অস্ত্র ও সাঁজোয়া যান নামানো হচ্ছিল, যা তাদের ‘সীমারেখা’ অতিক্রমের সমান। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, জাহাজগুলোর ট্র্যাকিং সিস্টেম বন্ধ ছিল এবং এসব অস্ত্র তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করছিল।

অন্যদিকে, এসটিসি এই হামলা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের দাবি, হামলায় হাদরামাউতে মোতায়েন এসটিসির অভিজাত ইউনিটগুলোকে লক্ষ্য করা হয়েছে। যদিও সৌদি কর্তৃপক্ষ বলছে, রাতের আঁধারে হামলা চালানো হয়েছে যাতে বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি না হয়।

এই সংঘর্ষ সৌদি আরব ও ইউএইর মধ্যে বাড়তে থাকা মতবিরোধকে প্রকাশ্যে এনেছে। হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন একসঙ্গে লড়াই করলেও, ইয়েমেনের ভেতরে দুই দেশ ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে আসছে। সৌদি আরবের অভিযোগ, এসটিসিকে আমিরাতের সমর্থন ইয়েমেন ও পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। রিয়াদ একে নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হিসেবেও উল্লেখ করেছে।

এই উত্তেজনার মধ্যেই ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের প্রেসিডেনশিয়াল লিডারশিপ কাউন্সিলের প্রধান রাশাদ আল-আলিমি আরব আমিরাতের সঙ্গে যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি বাতিল করেন এবং দেশটি থেকে আমিরাতের সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি সাময়িক সময়ের জন্য আকাশ ও নৌ অবরোধও ঘোষণা করেন।

বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ ইয়েমেনে এসটিসির দ্রুত সম্প্রসারণ দেশটিকে কার্যত বিভক্ত করার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। দক্ষিণে গুরুত্বপূর্ণ তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল ও বন্দর, আর উত্তরে রাজধানী সানাসহ হুতিদের শক্ত ঘাঁটি—এই বাস্তবতায় ইয়েমেন আবারও এক গভীর ও বহুমাত্রিক সংকটের দিকে এগোচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘২০২৫’ নিয়ে ১৯৯৮ সালে করা আমেরিকানদের ভবিষ্যদ্বাণী কতটুকু মিলেছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০: ৫৭
ছবি: সিএনএন
ছবি: সিএনএন

১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও সমাজ বাস্তবতা ছিল একেবারেই ভিন্ন। সেই বছর প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন অভিশংসন প্রক্রিয়ার মুখে পড়েছিলেন, অস্কারে রাজত্ব করেছিল টাইটানিক, আর অধিকাংশ আমেরিকানের ঘরে ছিল ল্যান্ডলাইন ফোন। ঠিক সেই সময়েই গ্যালাপ ও ইউএসএ টুডে এক ব্যতিক্রমী জরিপ চালায়। ল্যান্ডলাইন ফোনে ১ হাজার ৫৫ জন আমেরিকানের সঙ্গে কথা বলে জানতে চাওয়া হয়—দূর ভবিষ্যৎ ‘২০২৫ সাল’ কেমন হবে বলে তাঁরা মনে করেন।

সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) সিএনএন জানিয়েছে, ২০২৫ সাল নিয়ে সে সময় মার্কিনরা যে ভবিষ্যদ্বাণীগুলো করেছিল, সেগুলো সংরক্ষিত আছে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রোপার সেন্টারের জরিপ আর্কাইভে। ২০২৫ সালের শেষ প্রান্তে এসে এখন দেখা যাচ্ছে—সেই সব অনুমানের কোনোটা মিলেছে, আর কোনোটা মেলেনি।

এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সেই সময়ের অনেক পূর্বাভাসই ছিল বিস্ময়করভাবে সঠিক। অধিকাংশ আমেরিকান তখনই ধারণা করেছিলেন, আগামী ২৭ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন, সমকামী বিবাহ বৈধ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে এবং একটি ‘মারাত্মক নতুন রোগ’ বিশ্বকে নাড়িয়ে দেবে। বাস্তবে বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট হওয়া, সমকামী বিবাহের আইনি স্বীকৃতি এবং করোনা মহামারি সেই অনুমানগুলোকে সত্য প্রমাণ করেছে।

একইভাবে অনেকেই সেই সময় সঠিকভাবে ধারণা করেছিলেন, সাধারণ মানুষের জন্য মহাকাশ ভ্রমণ খুব সাধারণ বিষয় হয়ে উঠবে না এবং ভিনগ্রহের প্রাণীর সঙ্গে মানুষের সরাসরি যোগাযোগ ঘটবে না।

তবে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবতার সঙ্গে মেলেনি। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করেছিলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একজন নারী প্রেসিডেন্ট পাবে—যা এখনো ঘটেনি। অর্ধেকের বেশি মানুষ আশা করেছিলেন ক্যানসারের নিরাময় আবিষ্কৃত হবে এবং ৬১ শতাংশ মনে করেছিলেন মানুষ নিয়মিতভাবে ১০০ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচবে। বাস্তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অগ্রগতি হলেও এসব প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণ হয়নি।

জরিপে দেশের সামগ্রিক দিকনির্দেশনা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। সেখানে ফুটে উঠেছিল প্রবল হতাশা। ৭০ শতাংশ মনে করেছিলেন ধনীদের জীবনমান উন্নত হবে, কিন্তু মধ্যবিত্তদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভক্ত মতামত ছিল। দরিদ্রদের জীবন আরও কঠিন হবে—এমনটাই ভাবতেন বেশির ভাগ। প্রায় ৮০ শতাংশ ধারণা করেছিলেন ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কমবে, আর ৫৭ শতাংশ মনে করেছিলেন ব্যক্তিগত স্বাধীনতাও হ্রাস পাবে। অপরাধ বৃদ্ধি, পরিবেশের অবনতি এবং নৈতিক মূল্যবোধের পতনের আশঙ্কাও ছিল প্রবল। ৭১ শতাংশ মত দিয়েছিলেন, সন্তানকে ভালো মানুষ হিসেবে বড় করা আরও কঠিন হবে।

তবে কিছু আশাবাদী দিকও ছিল। অধিকাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করতেন, জাতিগত সম্পর্কের উন্নতি হবে এবং চিকিৎসাসেবা আরও সহজলভ্য হবে—যদিও তা হবে ব্যয়বহুল।

গ্যালাপ আজও জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে, যদিও এখন ল্যান্ডলাইনের ওপর নির্ভরতা কম। এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে জনমতও নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। ১৯৯৮ সালে যেখানে প্রায় ৬০ শতাংশ আমেরিকান দেশের গতিপথ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন, বর্তমানে সেই হার নেমে এসেছে মাত্র ২৪ শতাংশে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পুতিনের বাসভবনে ড্রোন হামলার অভিযোগ—‘মিথ্যা’ বলছে ইউক্রেন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪: ২৭
ইউক্রেনের ভলোদিমির জেলেনস্কি ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: এএফপি
ইউক্রেনের ভলোদিমির জেলেনস্কি ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: এএফপি

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বাসভবন লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইউক্রেন—এমন অভিযোগ করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার এই দাবিকে পুরোপুরি ‘মিথ্যা ও সাজানো’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই হামলার কারণে চলমান শান্তি আলোচনায় রাশিয়ার অবস্থানের ‘পরিবর্তন বা পুনর্বিবেচনা’ করা হতে পারে। তবে মস্কো এখনই আলোচনা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে না।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন সের্গেই লাভরভের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, গতকাল রোববার রাত থেকে আজ সোমবার ভোর পর্যন্ত পুতিনের বাসভবন লক্ষ্য করে ৯১টি দূরপাল্লার ড্রোন হামলা চালায় ইউক্রেন। রুশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সবকটি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। তবে এতে কোনো হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি।

লাভরভ হুমকি দিয়ে বলেন, ইউক্রেনের এমন হঠকারী কর্মকাণ্ডের জবাব দেওয়া হবে। রুশ সামরিক বাহিনী ইতিমধ্যে পাল্টা হামলার জন্য লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে ফেলেছে। তবে হামলার সময় প্রেসিডেন্ট পুতিন নোভগোরোদের ওই বাসভবনে ছিলেন কি না, তা স্পষ্ট করা হয়নি।

ফ্লোরিডায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক শেষ করে ইউরোপে ফেরার পথে জেলেনস্কি রাশিয়ার এই দাবিকে নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া আবারও ভয়ংকর সব মিথ্যা বিবৃতি দিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক অগ্রগতির সাফল্য নষ্ট করতেই এমন নাটক সাজানো হচ্ছে। তারা মূলত কিয়েভের সরকারি ভবনগুলোতে বড় ধরনের হামলার ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য এই অজুহাত দিচ্ছে।’

জেলেনস্কি জানান, ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার প্রায় ৯০ শতাংশ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, যা রাশিয়াকে বিচলিত করে তুলেছে।

এদিকে ক্রেমলিন বলছে, আজ প্রেসিডেন্ট পুতিন টেলিফোনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এই ড্রোন হামলার বিষয়টি জানিয়েছেন। পুতিন ট্রাম্পকে বলেছেন, এই হামলার পর রাশিয়া তাদের শান্তি আলোচনার শর্তগুলো পুনরায় খতিয়ে দেখবে।

রুশ গণমাধ্যমগুলো ক্রেমলিনের সহকারী ইউরি উশাকভের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, এই খবর শুনে ট্রাম্প ‘বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ’ হয়েছেন। তবে হোয়াইট হাউস থেকে এই ফোনালাপকে কেবল ‘ইতিবাচক’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে, বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তাইওয়ানকে ঘিরে ধরেছে চীনের যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান ও ড্রোন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মহড়ায় সরাসরি গুলির অনুশীলনও করা হচ্ছে। ছবি: চীনের পূর্বাঞ্চলীয় থিয়েটার কমান্ড
মহড়ায় সরাসরি গুলির অনুশীলনও করা হচ্ছে। ছবি: চীনের পূর্বাঞ্চলীয় থিয়েটার কমান্ড

তাইওয়ানকে ঘিরে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া শুরু করেছে চীন। সোমবার শুরু হওয়া এই মহড়ায় যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান, ড্রোন ও সরাসরি গোলাবর্ষণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ‘জাস্টিস মিশন ২০২৫’ নামের এই অভিযানে তাইওয়ানকে চারদিক থেকে ঘিরে সাতটি সামুদ্রিক অঞ্চলে সমন্বিত স্থল, নৌ ও আকাশ মহড়া চালানো হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি এখন পর্যন্ত তাইওয়ানকে লক্ষ্য করে চীনের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে আক্রমণাত্মক সামরিক প্রদর্শন।

চীনের পূর্বাঞ্চলীয় থিয়েটার কমান্ড জানিয়েছে—মহড়ায় স্থল ও সমুদ্রের লক্ষ্যবস্তুর ওপর সিমুলেটেড হামলা, পাশাপাশি তাইওয়ানের প্রধান বন্দরগুলো অবরোধ করার অনুশীলন করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে তাইওয়ানকে বিচ্ছিন্ন করতে বা চাপের মুখে ফেলতে এই ধরনের অবরোধ ব্যবহৃত হতে পারে বলে মনে করছেন সামরিক বিশ্লেষকেরা। সরাসরি গোলাবর্ষণের মহড়া মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) পর্যন্ত চলবে এবং আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এবার তাইওয়ানের আরও কাছাকাছি ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে।

এই মহড়ার ফলে বেসামরিক বিমান ও নৌ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন তাদের ফ্লাইটের রুট পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে এবং তাইওয়ানের বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বিকল্প আকাশপথ ব্যবহারের প্রস্তুতি নিয়েছে। চীনা সামরিক কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, এই মহড়া ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতাপন্থী শক্তি’ ও ‘বিদেশি হস্তক্ষেপের’ বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবার্তা।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি তাইওয়ানের কাছে ১১.১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যা ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্যাকেজ। এতে রয়েছে ৮২টি হিমার্স রকেট লঞ্চার, ৪২০টি দূরপাল্লার এটিএসিএমএস ক্ষেপণাস্ত্র, স্বচালিত হাউইটজার, উন্নত ড্রোন ব্যবস্থা ও অ্যান্টি-আর্মার অস্ত্র। বেইজিং এই অস্ত্রচুক্তিকে তীব্রভাবে নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এতে তাইওয়ান একটি ‘বারুদের স্তূপে’ পরিণত হচ্ছে।

তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মহড়া চলাকালে তাদের দ্বীপভূমির চারপাশে ৮৯টি চীনা সামরিক বিমান, ১৪টি নৌজাহাজ ও ১৪টি কোস্ট গার্ড জাহাজ শনাক্ত করা হয়েছে। কিছু চীনা জাহাজ তাইওয়ানের উপকূলের খুব কাছাকাছি অবস্থানে এসে চোখ রাঙাচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রেখেছে তাইওয়ান।

চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম জানিয়েছে, মহড়ার মূল লক্ষ্য তাইওয়ানের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর—উত্তরের কিলুং ও দক্ষিণের কাওশিয়ুং বন্ধ করে দেওয়ার সক্ষমতা পরীক্ষা। চীন তাইওয়ানকে নিজের ভূখণ্ড দাবি করলেও তাইওয়ান বলছে, দ্বীপটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার শুধু সেখানকার জনগণেরই আছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত