Ajker Patrika

বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিন থেরাপিতে সুস্থ বিরল রোগে আক্রান্ত অলিভার

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
অলিভার চু। ছবি: পরিবারের সৌজন্যে
অলিভার চু। ছবি: পরিবারের সৌজন্যে

মাত্র তিন বছরের শিশু অলিভার চু বিরল ও ভয়াবহ একটি জিনগত রোগে আক্রান্ত। কিন্তু সম্প্রতি জিন থেরাপি নেওয়ার পর তাঁর উন্নতি দেখে চিকিৎসকেরা বিস্মিত হয়েছেন। হান্টার সিনড্রোম বা এমপিএস-২ নামে পরিচিত এই রোগে আক্রান্ত অলিভার এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে।

বাবার সঙ্গে অলিভার চু। ছবি: পরিবারের সৌজন্যে
বাবার সঙ্গে অলিভার চু। ছবি: পরিবারের সৌজন্যে

হান্টার সিনড্রোম হলো একটি বিরল ও বংশগত রোগ, যা সাধারণত পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। বিশ্বে প্রতি এক লাখ ছেলেশিশুর মধ্যে একটি এতে আক্রান্ত হয়। এই রোগ ধীরে ধীরে শরীর ও মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীরা সাধারণত ২০ বছরের আগে মারা যায়।

ত্রুটিপূর্ণ জিনের কারণে ছোট অলিভারের শরীর জরুরি একটি এনজাইম উৎপাদন করতে পারত না। কিন্তু ম্যানচেস্টারের চিকিৎসকেরা বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিন থেরাপির মাধ্যমে অলিভারের কোষ পরিবর্তন করে তাকে সুস্থ করে তুলেছেন।

এই থেরাপির দায়িত্বে থাকা প্রফেসর সায়মন জোনস বিবিসিকে বলেন, ‘আমি ২০ বছর ধরে অপেক্ষায় ছিলাম এমন একটি ঘটনার জন্য। অলিভারের মাধ্যমে আমরা এই সফলতা অর্জন করতে পেরেছি।’ অলিভার বিশ্বজুড়ে এই থেরাপি পাওয়া পাঁচ শিশুর মধ্যে প্রথম।

চিকিৎসা শুরুর এক বছর পর এখন অলিভার স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে। তাঁর মা জিংরু আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘আমরা সব সময় অলিভারকে নিয়ে কথা বলি। যখন তার ওই রোগের কথা মনে হয়, আমার কান্না চলে আসে। কিন্তু এখন অলিভার সুস্থ। এটি সত্যিই অবিশ্বাস্য।’

বিবিসি গত এক বছর ধরে অলিভারের চিকিৎসার বিষয়ে খোঁজ রেখেছে। যুক্তরাজ্যে কীভাবে এই জিন থেরাপি তৈরি হলো এবং অর্থাভাবের কারণে কীভাবে অলিভারের চিকিৎসা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, সবই ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ম্যানচেস্টারের হাসপাতালে অলিভার ও তার বাবা রিকির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। হান্টার সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার পর এপ্রিল থেকে অলিভারের জীবন কেটেছে হাসপাতালে।

অলিভারের বড় ভাই স্কাইলারও একই রোগে আক্রান্ত। তার কথাবার্তা ও চলাফেরায় কিছু সমস্যা দেখা দিলে শুরুতে তা কোভিড মহামারির সময় জন্মানোর পরিণতি হিসেবে ধরা হয়েছিল।

রিকি বলেন, ছেলেদের রোগ নির্ণয়ের খবর আকাশ ভেঙে পড়ার মতো ছিল। চিকিৎসকেরা প্রথমেই বলেন—ইন্টারনেটে কিছু খুঁজবেন না। সেখানে ভয়াবহ কেস দেখে মন ভেঙে যাবে। কিন্তু রিকির কথায়, ‘চিকিৎসকেরা নিষেধ করলেও মানুষ এটা খুঁজবে। আমরাও খুঁজেছি আর মনে হয়েছে—ওহ ঈশ্বর! আমার দুই ছেলেরও কি এটাই হতে যাচ্ছে?’

এই অবস্থায় ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে অলিভারের শরীর থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ শুরু হয়। রয়্যাল ম্যানচেস্টার চিলড্রেনস হাসপাতালের চিকিৎসক ক্লেয়ার হরগান বলেন, অলিভারের রক্ত একটি বিশেষ যন্ত্রে পাঠানো হচ্ছে, যা নির্দিষ্ট স্টেম সেল সংগ্রহ করবে। এগুলো ল্যাবে পাঠিয়ে পরিবর্তন করা হবে এবং পরে আবার তার শরীরে দেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, স্টেম সেল হলো বিশেষ ধরনের কোষ। এগুলো শরীরের যেকোনো কোষে রূপান্তরিত হতে পারে এবং শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত অংশকে মেরামত করতে সাহায্য করে। এগুলোকে সাধারণত শরীরের ‘মেরামতব্যবস্থা’ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং স্টেম সেল থেরাপির মাধ্যমে ক্যানসার, ডায়াবেটিস ও হৃদ্‌রোগের মতো বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। মানুষের শরীরে প্রধানত দুই ধরনের স্টেম সেল পাওয়া যায়—ভ্রূণীয় স্টেম সেল ও প্রাপ্তবয়স্ক স্টেম সেল।

অলিভারের কোষগুলোকে লন্ডনের গ্রেট অরমন্ড স্ট্রিট হাসপাতালে পাঠানো হয়।

হান্টার সিনড্রোমে রোগীর জিনে কিছু ত্রুটি থাকে, যার ফলে কোষে আইডিএস নামে জরুরি একটি এনজাইম তৈরি হয় না। বিজ্ঞানীরা সেই অনুপস্থিত জিনটি একটি ভাইরাসে বসিয়ে দেন। তবে এর আগে ওই ভাইরাসের রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া হয়।

গ্রেট অরমন্ড স্ট্রিট হাসপাতালের চিকিৎসক ক্যারেন বাকল্যান্ড বলেন, ‘আমরা এই ভাইরাসকে বাহক হিসেবে ব্যবহার করে স্টেম সেলের ভেতর কার্যকর জিনটি ঢুকিয়ে দিই। পরে এগুলো অলিভারের শরীরে ফিরে গেলে নতুন সাদা রক্তকণিকা ও অনুপস্থিত এনজাইম তৈরি করে।’

মস্তিষ্কে এনজাইম পৌঁছানো সবচেয়ে কঠিন। তাই জিনটিকে এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে উৎপন্ন এনজাইম-রক্ত সহজে মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে পারে।

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অলিভার ম্যানচেস্টারে ফেরত আসে জিন-সম্পাদিত কোষ নিতে। গবেষণা দলের সদস্যরা ক্রায়ো ট্যাংক (বিশেষ ধরনের পাত্র) খুলে বরফ-ঠান্ডা অবস্থায় থাকা কোষগুলো বের করেন। গরম করে সেগুলো অলিভারের শরীরের তাপমাত্রায় আনা হয়।

এরপর একটি ছোট ইনফিউশন ব্যাগে থাকা প্রায় ১২৫ মিলিয়ন জিন-পরিবর্তিত কোষ সিরিঞ্জে তোলা হয়। নার্স ধীরে ধীরে ক্যাথেটারের মাধ্যমে কোষগুলো অলিভারের শরীরে প্রবেশ করান। অলিভারের মা জিংরু তাকে ধরে রাখেন। ১০ মিনিটে প্রথম ইনফিউশন শেষ হয়, তারপর এক ঘণ্টা পর দ্বিতীয় ইনফিউশন।

এতেই শেষ জিন থেরাপির পুরো প্রক্রিয়া। খুব দ্রুত শেষ হলেও এর লক্ষ্য বিশাল—জটিল এক রোগ থামানো। কয়েক দিন পর মা-ছেলে ক্যালিফোর্নিয়া ফিরে যান। এখন অপেক্ষা—থেরাপি কাজ করছে কি না।

চলতি বছরের মে মাসে পরীক্ষার জন্য অলিভার আবার ম্যানচেস্টারে আসে। এবার পরিবারের সবাই এসেছে। পার্কে দেখা হতেই বোঝা গেল অলিভারের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। সে আগের চেয়ে বেশি চলাফেরা করছে, সতেজ ও সক্রিয়।

অলিভারের বাবা রিকি বলেন, সে খুব ভালো করছে। কথা বলা ও চলাফেরায় উন্নতি হচ্ছে। মাত্র তিন মাসে সে অনেক পরিণত হয়েছে।

সবচেয়ে বড় সুখবর—এখন প্রতি সপ্তাহে অলিভারের শরীরে আর এনজাইম প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ছে না। সে এখন নিজেই এনজাইম তৈরি করছে।

অলিভারের মা জিংরু বলেন, চিকিৎসার আগে ও পরে অলিভারের মধ্যে এখন আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সে কথা বলছে, অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছে। বাবা রিকি বলেন, স্কাইলারেরও যদি এমন থেরাপি দেওয়া যেত! মনে হচ্ছে, অলিভার যেন নতুন জীবন পেয়েছে।

হাসপাতালের ছাদবাগানে খেলতে থাকা অলিভারকে দেখে রিকি বলেন, এ যেন সম্পূর্ণ নতুন এক বাচ্চা—দৌড়াচ্ছে, কথা বলছে, হাসছে।

প্রতি তিন মাসে পরীক্ষা করতে অলিভার ম্যানচেস্টারে আসে। আগস্টে নিশ্চিত হয়—থেরাপি সফলভাবে কাজ করছে। এখন নয় মাস পেরিয়েছে। অলিভারের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা প্রফেসর সায়মন জোনস বলেন, আগে অলিভারের শরীরে এনজাইমই তৈরি হতো না, এখন স্বাভাবিকের তুলনায় বহুগুণ বেশি তৈরি হচ্ছে। তবে তিনি সতর্কও করেন, ‘এখন পর্যন্ত সব ভালো, কিন্তু আমাদের আরও সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।’

জানা গেছে, এই জিন থেরাপি ট্রায়ালের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া থেকে পাঁচ শিশুকে নির্বাচন করা হয়েছে। যুক্তরাজ্য থেকে কেউ নেই—কারণ, সেখানকার রোগীরা দেরিতে ধরা পড়েছিল।

দুই বছর পর্যবেক্ষণ শেষে ট্রায়াল সফল হলে জিন থেরাপিটি লাইসেন্সিংয়ের জন্য প্রস্তুত করা হবে। একই পদ্ধতিতে আরও বিরল জিনগত রোগের চিকিৎসা তৈরি হচ্ছে।

রিকি ও জিংরু ম্যানচেস্টারের চিকিৎসক দলের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। তাঁদের মতে, অলিভারের উন্নতি অবিশ্বাস্য। রিকি বলেন, অলিভারের জীবন আর সুচ ও হাসপাতাল দিয়ে ঘেরা নয়। তার কথা বলা, চলাফেরা, শেখার ক্ষমতা—সবকিছুই বেড়েছে।

ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ব্রায়ান বিগারের নেতৃত্বে হান্টার সিনড্রোমের জিন থেরাপি তৈরিতে লেগেছিল ১৫ বছরের বেশি সময়। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ছোট বায়োটেক প্রতিষ্ঠান অ্যাভ্রোবায়োর সঙ্গে ট্রায়ালের চুক্তি হয়। কিন্তু তিন বছর পর প্রতিষ্ঠানটি অর্থাভাবে লাইসেন্স ফিরিয়ে দেয়। এতে প্রথম মানব ট্রায়াল পুরোপুরি হুমকির মুখে পড়ে।

প্রফেসর জোনস বলেন, ‘আমাদের দ্রুত বিকল্প স্পন্সর ও তহবিল খুঁজতে হয়েছে। ঠিক তখনই ব্রিটেনের মেডিকেল রিসার্চ চ্যারিটি লাইফআর্ক ২৫ লাখ পাউন্ড তহবিল দিয়ে এগিয়ে আসে।’

ব্রিটিশ চ্যারিটি সংস্থা লাইফআর্কের সিইও স্যাম ব্যারেল বলেন, যুক্তরাজ্যে ৩৫ লাখ মানুষ বিরল রোগে আক্রান্ত। তাদের জন্য বড় সমস্যা হলো—চিকিৎসার অভাব। ৯৫ শতাংশ রোগেরই চিকিৎসা নেই। তবে জিন থেরাপির মাধ্যমে এসব রোগের চিকিৎসা করা গেলে অনেকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে।

শিশুরা জন্মের পর সুস্থ দেখালেও সাধারণত দুই বছর বয়সে এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়—শারীরিক পরিবর্তন, অঙ্গ-সন্ধির শক্ত হয়ে যাওয়া, খাটো গড়ন, হৃদ্‌যন্ত্র, যকৃৎ, হাড়ের জোড়ায় ক্ষতি এবং গুরুতর ক্ষেত্রে মানসিক প্রতিবন্ধকতা ও স্নায়বিক অবনমন দেখা দেয়। এত দিন হান্টার সিনড্রোমের একমাত্র ওষুধ ছিল এলাপ্রেস, যার বার্ষিক খরচ রোগীপ্রতি প্রায় তিন লাখ পাউন্ড বা পৌনে পাঁচ কোটি টাকা। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে জিন থেরাপি অনুমোদন পেলে এই রোগের চিকিৎসা তুলনামূলক সহজ হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপির আপত্তি তোলা দুই অধ্যাদেশে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন

ভারতে পা রাখলেন পুতিন, নিয়ম ভেঙে ‘কোলাকুলি’ করলেন মোদি

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

গোপালগঞ্জে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ছাত্রীর আত্মহত্যা

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ