Ajker Patrika

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের আলো কতটুকু ছড়াল

ড. এম আবদুল আলীম
আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০৮: ৪৯
বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের আলো কতটুকু ছড়াল

‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ এই অমোঘ মন্ত্র বুকে ধারণ করে ১৯২৬ সালে ঢাকায় যাত্রা শুরু করেছিল বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন। ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র ব্যানারে এই আন্দোলনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, কাজী আনোয়ারুল কাদীর, আবদুল কাদির, আবুল ফজল প্রমুখ চিন্তাবিদ।

বস্তুত বাঙালি মুসলমান-সমাজে যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা আচার-বিশ্বাস-সংস্কার, ধর্মান্ধতা, অশিক্ষা এবং পশ্চাৎপদতার মূলোৎপাটন করে তার পরিবর্তে যুক্তিবাদ, ইহজাগতিকতা, মানবতা, বিজ্ঞানমনস্কতা তথা রেনেসাঁর আলোয় তাদের আলোকিত করাই ছিল এই আন্দোলনের ধারক-বাহকদের প্রধান লক্ষ্য।

‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনের কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছিল: ‘আমরা চক্ষু বুজিয়া পরের কথা শুনিতে চাই না বা শুনিয়াই মানিয়া লইতে চাই না; আমরা চাই চোখ মেলিয়া দেখিতে, সত্যকে জীবনে প্রকৃতভাবে অনুভব করিতে। আমরা কল্পনা ও ভক্তির মোহ আবরণে সত্যকে ঢাকিয়া রাখিতে চাই না। আমরা চাই জ্ঞান-শিক্ষা দ্বারা অসার সংস্কারকে ভস্মীভূত করিতে এবং সনাতন সত্যকে কুহেলিকা মুক্ত করিয়া ভাস্বর ও দীপ্তিমান করিতে।

আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে চাই না, আমরা চাই বর্তমান মুসলমান সমাজের বদ্ধ কুসংস্কার এবং বহুকাল সঞ্চিত আবর্জনা দূর করিতে।’ আলোচনা, বক্তৃতা, লেখনী সঞ্চালন এবং শিখা নামের পত্রিকার মাধ্যমে তাঁরা এই চিন্তার বিস্তার ঘটান। এ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রেরণা ছিল হজরত মুহাম্মদ (সা.), শেখ সাদী, রোমা রলাঁ, রামমোহন রায়, ডিরোজিও, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গ্যেটে, মোস্তফা কামাল পাশা, প্রমথ চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ।

বাঙালি সমাজে ভক্তিবাদ, আধ্যাত্মিকতা, মানবতা এসবের স্ফুরণ প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ করা গেলেও ইউরোপীয় রেনেসাঁপুষ্ট ভাবধারার উন্মেষ ঘটে উনিশ শতকে এবং সেটা হয় প্রধানত কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে। রাজা রামমোহন রায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, লুই বিভিয়ান ডিরোজিও, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখ ছিলেন এই রেনেসাঁসের আলোক সারথি। তাঁরা ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন প্রভৃতির প্রভাবে বাঙালি-সমাজে নবচিন্তার প্রতিফলন ঘটান। তবে এই আলো প্রধানভাবে বাংলার হিন্দুসমাজের উচ্চকোটীতে পড়ে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থাকে এর বাইরে; বিশেষ করে বাংলার মুসলমান-সমাজে এর প্রভাব পড়েনি বললেই চলে।

হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা যখন যুগের বাস্তবতা মেনে ইংরেজ শাসনকে আশীর্বাদ মনে করে তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে আধুনিক জ্ঞান-বুদ্ধি এবং বিত্ত ও চিত্তবৈভবে এগিয়ে যেতে থাকে, তখন মুসলমান-সমাজ ইংরেজকে শত্রু মনে করে তাদের সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে থাকে। এ অবস্থার পরিবর্তন হতে দীর্ঘ সময় লাগে। সেই পরিবর্তনকে আত্মস্থ করেই একঝাঁক বাস্তববাদী মুসলমান চিন্তাবিদ যখন এগিয়ে আসেন, তখনই ধীরে ধীরে মুসলমানেরা সম্মোহন কাটিয়ে সমকালীন জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পথ-চলা শুরু করে।

সেই বাস্তবতায় গত শতাব্দীর বিশের দশকে ঢাকায় শুরু হয় ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’। এই আন্দোলনের ভাবযোগী কাজী আবদুল ওদুদ বলেছিলেন: ‘বুদ্ধির মুক্তি, অর্থাৎ বিচার-বুদ্ধিকে অন্ধ সংস্কার ও শাস্ত্রানুগত্য থেকে মুক্তিদান, বাংলা মুসলমান-সমাজে (হয়তোবা ভারতের মুসলমান সমাজে) এ ছিল এক অভূতপূর্ব ব্যাপার।...দৃশ্যত এর প্রেরণা এসেছিল মুস্তফা কামালের উদ্যম থেকে, কিন্তু তারও চাইতে গূঢ়তর যোগ এর ছিল বাংলার বা ভারতের একালের জাগরণের সঙ্গে আর সেই সূত্রে মানুষের প্রায় সর্বকালের উদার জাগরণ-প্রয়াসের সঙ্গে।’

‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’ যখন ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার মূলোৎপাটনে এবং মুসলমান-সমাজের চিন্তার দৈন্য ঘোচাতে একের পর এক লেখা প্রকাশ করতে থাকে, তখন ঢাকার পিছিয়ে থাকা রক্ষণশীল মুসলমানদের টনক নড়ে। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, কাজী আবদুল ওদুদের ‘সম্মোহিত মুসলমান’, আবুল হুসেনের ‘নিষেধের বিড়ম্বনা’, ‘আদেশের নিগ্রহ’ প্রকাশের পর যেন মৌচাকে ঢিল ছোড়ার দশা হয়।

আবুল হুসেনের ‘আদেশের নিগ্রহ’ (আশ্বিন, ১৩৩৬) প্রবন্ধটি প্রকাশের পর ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় কঠোর সমালোচনা করা হয় এবং তাতে বলা হয়, ‘আলোচ্য প্রবন্ধে এছলাম ধর্মের উপর যেরূপ আক্রমণ চালানো হইয়াছে, তাহাতে আর্যসমাজী ও খৃষ্টান মিশনারীরা তাঁহার নিকট হার মানিতে বাধ্য হইবে।’ আবুল হুসেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ত্যাগ করে ঢাকা জজ কোর্টে আইন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর প্রবন্ধ পড়ে ঢাকার ধর্মান্ধ মুসলমানেরা বিক্ষুব্ধ হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২৯ সালের ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় আহসান মঞ্জিলে বিচার-সভা বসানো হয়। সভায় আবুল হুসেনের ওপর এমন চাপ প্রয়োগ করা হয় যে তিনি ‘ক্ষমাপত্র’ লিখতে বাধ্য হন; যাতে বলা হয়, ‘ঐ প্রবন্ধের (আদেশের নিগ্রহ) ভাষা মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দের মনে যে বিশেষ আঘাত দিয়াছে, সে জন্য আমি অপরাধী।’

এই অপমানজনক ঘটনার পরদিন তিনি ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র সম্পাদক পদ থেকে ইস্তফা দেন। কিন্তু তাতেও থেমে থাকে না বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের কার্যক্রম, শিখা নামের পত্রিকার মাধ্যমে এর সভ্যগণ তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরতে থাকেন। মাতৃভাষা-বিতর্ক, শিক্ষা-সম্প্রসারণ, আর্থিক দৈন্য লাঘব, সমাজ-রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে তাঁরা ক্ষুরধার বক্তব্য প্রচার করতে থাকেন, যা চলমান থাকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত।

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল মুসলমান-সমাজের সার্বিক জাগরণ ও কল্যাণ সাধন। তখন মুসলমান-সমাজে বড় সংকট ছিল আত্মপরিচয়ের সংকট; আগে বাঙালি, না মুসলমান—এই দ্বন্দ্বে তারা দোলাচলে ভুগেছে। বিষয়টি ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র কর্ণধারদের গভীরভাবে ভাবিত করে।

তাই ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র প্রথম অধিবেশনেই বলা হয়, ‘একটা বিষম আন্দোলন শুনতে পাই যে বাংলাদেশে মুসলমানদের মাতৃভাষা কী?’ এ প্রশ্নের উত্তরও খোঁজা হয় ওই অধিবেশনে। তাতে মূল সভাপতির অভিভাষণে খান বাহাদুর তসদ্দক আহমদ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, বাংলা ভাষাই বাঙালি মুসলমানের একমাত্র মাতৃভাষা। এ বিষয়ে একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।

আত্মপরিচয় সংকটের পাশাপাশি তাঁদের নজরে আসে মুসলমানদের শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার দিকটিও। তাঁরা ঘোষণা দেন, মুসলিম সমাজে শিক্ষাবিস্তারে সহায়তা করা ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র অন্যতম কর্তব্য। তাঁদের বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন করে মুসলমানদের আর্থিক দুর্গতি।

এর লাঘবে তাই তাঁরা চাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, কৃষি প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানদের আত্মনিয়োগের পরামর্শ দেন। তাঁরা বলেন, ‘আর্থিক দুর্গতি দূর করতে হ’লে আজ আমাদিগকে সত্যিকার সৃজনমূলক আন্দোলনে হাত দিতে হবে, গ্রামে গ্রামে শিল্প বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করে গ্রামবাসীকে সমৃদ্ধিশালী করে তুলতে হবে, তাদের জীবনের অলসতাকে দূর করে তাদেরকে কর্মী করে গড়ে তুলতে হবে, এক কথায় তাদের অন্তরে জীবনের স্বাদ পৌঁছিয়ে দিয়ে তাদেরকে জগৎ ও জীবনের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত ক’রে তুলতে হবে।’

এ ছাড়া সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলমানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। পরাধীনতা মুক্তি এবং হিন্দু-মুসলিম মিলনের দিকেও দৃষ্টিসম্পাত করা হয়। এভাবে তাঁরা মুক্তবুদ্ধি ও সামগ্রিক দৃষ্টিতে সমাজের অগ্রগতির পথ বাতলে দিয়ে এক দশক বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের দীপ্তি ছড়িয়ে ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র পথ-চলার আনুষ্ঠানিক ইতি ঘটে।

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রতিভূগণ সেই বিশ-তিরিশের দশকে বাঙালি মুসলমান-সমাজে যে দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন, তার আলো সময়-সময় উজ্জ্বলরূপে সমাজের অন্ধকার কুঠুরিতে পড়লেও, বর্তমানে তা যেন একেবারে ক্ষীণ হয়ে গেছে।

ফলে ধর্মান্ধতা যেমন বেড়েছে, তেমনি পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ অবক্ষয়। মনুষ্যত্ব, বিবেকবোধ এসব আজ অপসৃত, ভোগ-বিলাসিতায় মত্ত সমাজে কেবল যেন পশুত্বেরই জয়জয়কার! এ থেকে উত্তরণে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে’র ধারার পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে, শিখার সেই আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে দিতে হবে সবখানে।

লেখক: অধ্যাপক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তর্কে জড়ানো চিকিৎসককে বরখাস্তের নির্দেশ ডিজির

খালেদা জিয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত, মেডিকেল বোর্ডের সবুজসংকেতের অপেক্ষা

সবকিছু প্রস্তুত হচ্ছে, তারেক রহমান ফিরবেন যেকোনো সময়: আমীর খসরু

মুর্শিদাবাদে ‘বাবরি মসজিদ’: সৌদি আলেমদের আমন্ত্রণ, ৪০ হাজার মানুষের জন্য রান্না হচ্ছে বিরিয়ানি

আজকের রাশিফল: ভার্চুয়াল হাতাহাতি থেকে দূরে থাকুন, সিদ্ধান্ত ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিন

এলাকার খবর
Loading...