Ajker Patrika

আমাদের হলোটা কী-২

জাহীদ রেজা নূর
আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২২, ১৪: ০০
আমাদের হলোটা কী-২

সংস্কৃতিকে এক শ হাত দূরে রেখে কি রাজনীতি এগোতে পারে? আমরা ধীরে ধীরে সেই সর্বনেশে কাজটাই সম্পন্ন করেছি। রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্কটাকে নষ্ট করে ফেলেছি। আমরা যে নিজেদের আত্মপরিচয়কে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে পারলাম না, তার একটা বড় কারণ জীবন থেকে সংস্কৃতির নির্বাসন, সেটা বোঝার কোনো চেষ্টাও নেই রাজনৈতিক মহলে।

চারদিকে পয়সাওয়ালা মানুষ দেখা যায়, কিন্তু সংস্কৃতিমান মানুষের খোঁজ মেলে অতি কষ্টে। মুখে মুখে হোমার, শেক্‌সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আওড়ানো মানুষ অনেক পাওয়া যাবে, কিন্তু তাঁদের লেখা আত্মস্থ করা মানুষ খুঁজতে হারিকেন লাগবে। বিটোফেন, মোৎসার্ট, আলাউদ্দিন খাঁ, রবিশঙ্কর নিয়ে কথা বলার মানুষ পাওয়া যাবে, কিন্তু তাঁদের অনুপ্রেরণা হিসেবে ধরে নিজে চর্চা করবে, এমন মানুষ কই?

রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষ তার প্রয়োজনীয় প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হয় এবং এর জবাব পাওয়ার চেষ্টা করে। শোষণ-বঞ্চনার বোধ মানুষকে আচ্ছন্ন করলে সে মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকে। কিন্তু যিনি মুক্তির দিশা দেখাচ্ছেন, তিনি যদি আত্মবিশ্বাসী না হন, তিনি যদি শুধু বক্তৃতার মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে চান, তাহলে কি সত্যিই সোনার মানুষ গড়ে উঠবে? 

দুই
দেশপ্রেম আকাশ থেকে পড়ে না। ওটা জীবন থেকেই আসে। প্রাত্যহিক জীবনেই তার অবস্থান। আর সংস্কৃতি মানেই শুধু গান-বাজনা নয়, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপই সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। যে আবহে গড়ে ওঠে মন, সেই আবহেই সে পরবর্তী সময় চলবে। নতুন কোনো আবহের সঙ্গে যতক্ষণ পর্যন্ত সংঘাত না হচ্ছে, ততক্ষণ সে তার মানসিক অবস্থান পরিবর্তন করবে না। মোটাদাগে এভাবে বলা যায়।

সংস্কৃতিবোধ জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংস্কৃতিকে গোল্লায় পাঠানো মানুষদের হাতে ক্ষমতা গেলে কী হয়, তা তো প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের মানুষ হরহামেশাই প্রকাশ করছেন।

খুব ছোট একটা বিষয় বলি। আমরা মাঝে মাঝেই সরকারি গাড়িচালকের কোটি টাকা নিয়ে কথা বলি। কিন্তু কখনোই জানতে আগ্রহী হই না, কী করে একজন গাড়িচালক এই চুরির পথটি খুঁজে পেলেন। যদি সরকারি সেই বিভাগে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা না থাকে, তাহলে কীভাবে এই টাকা কামানো সম্ভব? নিশ্চয়ই জাদুর মাধ্যমে তিনি এই টাকার মুখ দেখেননি। দরপত্র নিয়ে কারবার, নিয়োগ নিয়ে কারবার করে যদি টাকার মালিক হতে পারেন কোনো গাড়িচালক, তাহলে তো বুঝতেই হবে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। গাড়িচালক গাড়ি চালনা ছাড়াও এত কাজে ব্যস্ত থাকছেন, অথচ কেউ কিছু দেখছেন না—এ কী করে সম্ভব?

তার মানে, প্রশাসনের নানা জায়গায় এতভাবে টাকাপয়সা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যে এ রকম অল্প কয়েক কোটি টাকা কোনো গাড়িচালক ‘উপার্জন’ করতে পারলে তাতে কারও কিছু আসে-যায় না। এ থেকে আরও ভয়ংকর তথ্য এসে হাজির হয়: ওপরের দিকের কোটিপতিরা থেকে যাচ্ছেন লোকচক্ষুর আড়ালে।

ইচ্ছে করেই এখানে অন্য পেশার লোকদের কথা আনলাম না। যেমন হাজার-কোটি টাকা ঋণ নিয়ে গায়েব করে দিচ্ছেন যিনি, তিনি কি শুধু খারাপ মানুষ বলেই সেটা পারছেন? ব্যাংকে কেউ কি নেই, যাঁদের মনে একটু সন্দেহ হবে? আসলে তো সবই হচ্ছে রিকল্পনামাফিক। সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন, কেন একজন মানুষ এ রকম ঋণ পাচ্ছেন এবং এটাও বলা দরকার, যাঁরা ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে যুক্ত থাকছেন, তাঁরাও কামিয়ে নিচ্ছেন বড় অঙ্কের টাকা। এ কথাগুলো এখানে বলব না। বলব পরে।

তিন
যে যুগ এসেছে, তাতে ঘুষখোরকে কি ঘৃণা করেন তাঁর পরিবার আর স্বজনেরা? এখন তো জানা হয়ে গেছে, পরিশ্রমের পথে সাফল্য আসে ধীরে, কিন্তু ঘুষের পথে সাফল্য খুব কাছে এসে ধরা দেয়। সৎপথে রাজনীতি করলে পাশে কেউ থাকবে না, নগদ কড়ি ফেলতে পারলে তিনিই হবেন নেতা। আমাদের দেশের সবগুলো রাজনৈতিক দলের সংস্কৃতির দিকে চোখ রাখুন। নেতাদের মুখের ভাষা এবং দেহের ভাষা দেখুন। বুঝতে পারবেন, তাঁদের অনেকেরই চালিকাশক্তি দেশ ও দশের সেবার আকাঙ্ক্ষায় নয়, কীভাবে নিজের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেওয়া যায়, সেদিকেই তাঁদের নজর।

ফলে পরিবারের মধ্যে সেই ব্যক্তিকেই সফল হিসেবে ধরা হয়, যাঁর একটা ফোনে পুলিশ চুপ করে যাবে, এক হুংকারে রাস্তায় হবে ধর্মঘট, এক নির্দেশে চাঁদা দিতে বাধ্য হবেন রাস্তার দোকানিরা। সব ধরনের অঘটনঘটনপটিয়সী যিনি, তিনিই দৃষ্টি কাড়েন রাজনীতিবিদদের। তিনিই হয়ে ওঠেন ডানহাত। আর বড় নেতার ডানহাতের ক্ষমতা কত দূর যেতে পারে, সে তো আর অজানা নেই কারও।

রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়; বরং প্রবলভাবে রাজনীতিবিদদের পক্ষে এই লেখা। কিন্তু সেটা কোন রাজনীতিবিদের পক্ষে? যে রাজনীতিবিদ দেশ ও দশের সেবার অঙ্গীকার নিয়ে রাজনীতি করতে আসেন। কিন্তু আমাদের দেশে তাঁরা এখন সবচেয়ে বিপন্ন, একেবারে বিপন্ন প্রাণীদের মতোই তাঁদের দেখা যায় কম। এই হাজার-কোটি টাকার রাজনৈতিক প্রবাহে সততা আর দেশপ্রেম নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যে যায় না, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। তাহলে এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আশার আলো জ্বালাবেন কে?

পারিবারিক সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়ে এখন এই অমানবদেরই গুণগান করা হচ্ছে; অর্থাৎ পারিবারিকভাবেই তাঁরা স্বীকৃতি পাচ্ছেন, তাহলে সমাজও তো তা মেনে নেবে, কারণ অসত্যেরই জয় হয়েছে বলে ধারণা করা হবে, তাই তাঁদের ঠেকাবে কে?

জাহীদ রেজা নূরচার
নিজের পরিচয় নিয়ে আমাদের বিভ্রান্তি কাটেনি এখনো। দেশভাগের আগে-পরে হঠাৎ করেই বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু একই সঙ্গে বাঙালি হয়ে উঠেছিল। তাদের আত্মপরিচয়ে ‘বাঙালি’ শব্দটাই হয়ে উঠেছিল মুখ্য। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু কিন্তু বাঙালি মুসলমানকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে কুণ্ঠা বোধ করত। অন্যদিকে বাঙালি মুসলমানও তার নিজের পরিচয়কে এই মাটির পরিচয় ভুলিয়ে দিয়ে আরব মুল্লুকে নিতে পারলে স্বচ্ছন্দবোধ করত। এই যে ফাঁকটা রয়ে গিয়েছিল, তা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেনি বাঙালি। মনে করে দেখেনি, রাজনৈতিক হিন্দু-মুসলমানের বাইরে যে দরিদ্র বাঙালি ছিল, তাদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করার কোনো ইচ্ছে তখন জাগেনি। একই সাংস্কৃতিক বলয়ে তারা বেড়ে উঠেছে। নিজেদের লোকজ উৎসবে অংশ নিয়েছে সবাই।

সেই বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুর মধ্যে বিভাজনটা প্রকট হয়ে উঠল রাজনৈতিক কারণেই। এর দায়ভার সাবেক অখণ্ড ভারতবর্ষের শিক্ষিত হিন্দু ও মুসলমানকেই নিতে হবে। অবাক কাণ্ড হলো, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে কুড়ি বছরের মতো সময় হিন্দু-মুসলমান হিসেবে নিজেকে ভাবেনি সেই শিক্ষিত সম্প্রদায়ও। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে আবার সেই লেজটি বেরিয়ে পড়ল। লেজটি জানান দিল, আসলে যুক্তি ও উদারতা দিয়ে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ব না। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ব ঘৃণা দিয়ে, ক্ষমতা দিয়ে, অপমান দিয়ে। আর তাই ইচ্ছে হলেই আমাদের দেশে মূর্তি ভেঙে হিন্দুদের ঠ্যাঙানো যাবে, ইচ্ছে হলেই গো-মাংস খাওয়ার অভিযোগ তুলে ভারতে হত্যা করা যাবে কোনো মুসলিমকে।

অথচ বেশির ভাগ মানুষই ধর্মের নামে এই মাস্তানির পক্ষে নয়। কিন্তু একসময় হাতে হাত ধরে দাঙ্গার বিরুদ্ধে কিংবা নির্যাতনের বিরুদ্ধে যেভাবে মানুষ বুক টান করে দাঁড়াতে পারত, এখন তা পারছে না কেন? তার একটি কারণ সংস্কৃতিহীনতা।

সংস্কৃতির মধ্যে মিলনের যে বার্তা ছিল, তা একেবারেই ভুলে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। আমরা অনেকটাই বিচ্ছিন্নতার মন্ত্রে দীক্ষিত হচ্ছি। আর তাই ভেতর থেকে ধর্ম গেছে উচ্ছন্নে, বাইরে তা শরীরের পোশাকে এসে ঠেকেছে। ধর্মের মূল বাণীর মধ্যে মানুষের সততা, ন্যায়বিচার, পরমতসহিষ্ণুতা, ত্যাগ, অসাম্প্রদায়িকতা কিন্তু রয়েছে সূক্ষ্মভাবে। কিন্তু আমাদের জীবনাচরণে সেগুলোর ব্যবহার গেল কোথায়?

সেগুলোই তো সংস্কৃতির পরিচায়ক। সেই পরিচয়েই তো বলীয়ান হবে মানুষ। সংস্কৃতিই তো ভালো এবং মন্দের সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে পারে।

কিন্তু এখনকার ধর্ম-প্রদর্শনের মধ্যে যে সত্যিকার ধর্ম নেই, সে কথা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না। নারীর শরীর নিয়ে কিংবা বিধর্মীর বিরুদ্ধে কথা বলা এবং কট্টর সালাফিবাদের ধ্বজা ধরা ছাড়া তারা আর কী করছে? তারা কি কখনো ঘুষের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে? আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে? এক জেলা থেকে অন্য জেলায় পণ্য পরিবহনের সময় যে চাঁদাবাজি হয়, তা নিয়ে সোচ্চার হয়েছে? মসজিদ বা মন্দিরে ঘুষখোরদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে? ঘুষখোর বা অসৎ পথে টাকার মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া বন্ধ করেছে? এ রকম হাজারো প্রশ্ন করা যাবে, কিন্তু নিশ্চিত জানি, তার উত্তর মিলবে না। 

পাঁচ
পাঠক নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, সংস্কৃতি বলতে আমি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকিনি। বলতে চেয়েছি, একেবারে ছোটকাল থেকে মানুষের মনে যে ভাবনা ও রুচির বীজ বুনে দিলে একটি শিশু ধীরে ধীরে রুচিশীল হয়ে ওঠে, সেই জায়গাটাতেই ভীষণ বড় ফাঁক দেখা যাচ্ছে। মূল্যবোধ পরিবর্তিত হয়, একই বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে থাকলে পৃথিবীর সচলতাকে অগ্রাহ্য করা হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পুরোনো থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞান মিলিয়ে নতুন সময়ের উপযোগী করে চলাই তো জীবন। নতুন ও পুরোনো মিলে তৈরি করবে এমন এক নতুন ভাবনার, নতুন সম্ভাবনার, যার শিকড় থাকবে সংস্কৃতির অতি গভীরে। আর সংস্কৃতি বিশ্বের অন্যান্য সংস্কৃতি থেকেও গ্রহণ করবে ভালোটা। ঋদ্ধ করবে নিজেকে।

সেই জায়গাটায় টান পড়েছে আমাদের। আমরা যে এই রুচিহীনতা থেকে বের হতে পারছি না, তার একটা বড় কারণ হচ্ছে, সংগীতের জায়গায় আমরা খিস্তিখেউড়কেই দাম দিচ্ছি বেশি। এখান থেকে বেরিয়ে আসার পথসন্ধান করাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ