Ajker Patrika

শিক্ষককে খুন করে ষষ্ঠ হত্যা মামলার আসামি হতে চান যুবলীগ নেতা!

চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধি
আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২২, ১২: ০৬
শিক্ষককে খুন করে ষষ্ঠ হত্যা মামলার আসামি হতে চান যুবলীগ নেতা!

যশোর সদর উপজেলার ইছালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কমিটি গঠন নিয়ে প্রধান শিক্ষককে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে হত্যার হুমকি দিয়েছেন সদর উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাজহারুল ইসলাম। এ ঘটনায় প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে যশোর কোতোয়ালি থানায় গত ৩১ মার্চ সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। 

ফোনে হুমকি দেওয়ার সেই অডিও গতকাল সোমবার ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। গত ২৪ মার্চ দুপুরে তাঁদের মোবাইলে হত্যার এ হুমকি দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী প্রধান শিক্ষক। 

গত ৩১ মার্চ যশোর কোতোয়ালি মডেল থানায় করা জিডিতে প্রধান শিক্ষক উল্লেখ করেছেন, যশোর সদর উপজেলার ইছালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আগের কমিটির অগোচরে যুবলীগ নেতা মাজহার ও তাঁর সহযোগীরা অ্যাডহক কমিটি করেন। কমিটির সভাপতি হিসেবে মনিরুজ্জামান নামের এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেন। এতে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও অভিভাবকেরা কমিটির বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে উচ্চ আদালতে যান। বর্তমানে মামলা চলমান। গত ২৪ মার্চ বেলা ২টার দিকে মাজহারুল তাঁর মোবাইল নম্বর থেকে ফোন দিয়ে কমিটি অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে বলেন। তাঁকে কমিটির বিষয়ে মামলা চলমান রয়েছে জানালে অকথ্য ভাষায় গালাগালি ও জীবননাশের হুমকি দেন। 

জিডির মাধ্যমে নিরাপত্তা চেয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন প্রধান শিক্ষক। 

প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘সে আমাকে বলেছে, সে পাঁচটি হত্যা মামলার আসামি। আমাকে হত্যা করে আরেকটি হত্যা মামলার আসামি হতে চায়। আমি নিরাপত্তাহীনতায় আছি। স্কুলে যাচ্ছি, তবে ভয়ে ভয়ে আছি। পুলিশের সঙ্গে কথা হয়েছে। কোনো ঝামেলা হলে জানাতে বলেছে।’ 

প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলামকে ফোনে হুমকি দেওয়ার অডিও ক্লিপ গতকাল সোমবার রাত থেকে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ৬ মিনিট ৮ সেকেন্ডের ওই অডিওতে শোনা যাচ্ছে, যুবলীগের নেতা মাজহারুল বারবার অশ্লীল ভাষায় প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলামকে গালাগালি করছেন। 

অডিওর অংশ বিশেষ

মাজহারুল: কমিটির আবেদন করবেন না আপনি? 
প্রধান শিক্ষক: এখনো তো করিনি। আমি সুস্থ হয়ে নেই। দেখি কী করা যায়। 

মাজহারুল: আমার এমপি সাহেব (যশোর-৩ আসনের সাংসদ কাজী নাবিল আহমেদ) আমারে পাঠিয়েছে। এখন আমি আপনার স্কুলের চেয়ারের সামনে বসে আছি। ফরিদ ভাই (সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহম্মেদ চৌধুরী) কালকে আপনার বাসায় লোক পাঠাতে চাইল। কিন্তু আমি শুনেছি আপনি অসুস্থ, তাই আসেনি। ফিঙে লিটনের (তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী) গাঁজাখোর, ইয়াবাখোর ছিলেপিলে গিয়ে আপনার সঙ্গে যদি খারাপ ব্যবহার করে, তাহলে পরবর্তীতে আমার ঘাড়েই আসে। 
প্রধান শিক্ষক: না...খারাপ ব্যবহার করবে কেন? খারাপ ব্যাহার করবে কেন? 

মাজহারুল: আপনার কোনো কথা আমি শুনব না জীবনে আর। আপনি কার ক্ষমতায় এই কমিটির আবেদন করছেন না, সেটা আপনাকে বলতে হবে। আর যদি না করেন, তা হলেও বলে দিতে হবে, আমি এই কমিটির আবেদন করব না। তারপর আপনার সঙ্গে এই বিষয়ে বুঝব। 
প্রধান শিক্ষক: তুমি আমার কথা শুনবা না কেন। তোমারে ফোন দিলেই তুমি কেটে দাও শুধু। আমার ফোনটা ধরতে হবে। আর কথাটা শুনতে হবে। 

মাজহারুল: আচ্ছা, বলেন বলেন। 
প্রধান শিক্ষক: আমি কী আবেদন করব। যারা মামলা করেছে, তাদের সঙ্গে তো আমার কথা বলা লাগবে, নাকি? মামলা তুলে দেওয়া লাগবে না? 

মাজহারুল: ওরা মামলা তুলছে না কেন? আপনি আমারে আইন শিখান? আমার এই এট্টসকুনি জীবনে আমি পাঁচটা মার্ডার মামলা খেয়েছি। আপনি আইন শেখান? ওই মামলার কাগজপত্র ছয় মাস পরে সব বাতিল হয়ে যাবে। আপনার কত বড় ক্ষমতা, আপনি এমপি সাহেবের কথা শুনছেন না। সব মামলা আপনি করাচ্ছেন। 
প্রধান শিক্ষক: না, আমি করাতে যাব কেন? মামলা তুলে না নিলে কমিটির আবেদন করা যাবে না তো। তাই সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমি বলব, তুমি বলবা। 

মাজহারুল: শোনেন স্যার, আমি কারও সঙ্গে কথা বলতে পারব না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কার সঙ্গে কথা বলবেন, না কী বলবেন, আপনি জানেন। আপনার কোন আব্বা আছে কোন মার----(অপ্রকাশযোগ্য গালি) আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমিটি যদি আবেদন না করেন, তা হলে আপনি যদি যশোর থাকতে পারেন, তারপরে আমি চুড়ি পরে এই যশোরে ঘুরে বেড়াব। আপনার গুষ্টিডা কালকে---(অপ্রকাশযোগ্য)। আমি আপনার সঙ্গে দুই বছর ভালো ব্যবহার করেছি। তোমারে কিডা ঠেকাই আমি দেখবানে। তোর এত বড় সাহস তুই কাজী নাবিল আহমেদের ডিও লেটারে মামলা করেছিস। তোর কিডা আছে? তুই আজকের পর থেকে নীলগঞ্জে কীভাবে থাকিস, দেখবানে। তোর লোকজন, পুলিশ-র‍্যাব নিয়ে থাকিস। আমি আসছি। 
প্রধান শিক্ষক: তুমি আমার ছাত্র ছিলে, এভাবে বলছ কেন? 

মাজহারুল: ছাত্রর গুষ্টি (অপ্রকাশযোগ্য)। এই শহরে এমন কোনো অফিসার নেই যে আমাকে দেখে নাবিল সাহেবের প্রতিনিধি মনে করে উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ার এগিয়ে দেয় না। আর তোর কত বড় সাহস! তুই নাবিল আহমেদের ডিও লেটারের ওপর এখনো কমিটি আবেদনের দরখাস্ত দিসনে। তোর যে আব্বাগুলো আছে, তাদের বলবি। মাজহারুল এই এই হুমকি দিয়েছে। তাদের আমারে কিছু করে নিতে বলিস। তোর কত বড় ক্ষমতা তুই যশোরে থাক, দেখছি আমি। 
প্রধান শিক্ষক: কারুর বলা লাগবে না। আমি একটু সুস্থ হয়েনি। তারপর দেখছি। 

মাজহারুল: তোর সুস্থর গুষ্টি মারি। তুই আমার রোগ দেখাস। তোর চাকরি গুষ্টির মদ্যি দেব। এত দিন শুধু ভদ্রতা দেখাইছি তুই আমার স্যার তাই। তোর কালকের দিন পর্যন্ত সময় দিলাম। 
প্রধান শিক্ষক: মামলা উঠবে তারপরে। তুমি রাখো। 

মাজহারুল:.... (অপ্রকাশযোগ্য) ছেলে, তোর মামলা আমি উঠোবো, উঠোবো, উঠোবো। আমার নামে মামলা হবে তোর মার্ডার মামলা। রাখ... (অপ্রকাশযোগ্য) ছেলে। 

অভিযোগের বিষয়ে যশোর সদর উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাজহারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলামের কাছে আমি নিজেও পড়েছি। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তাঁর সঙ্গে আমার পড়ে না। ছয় মাস আগে এমপি কাজী নাবিল আহমেদ স্থানীয় মনিরুজ্জামানকে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি করার জন্য ডিও লেটার দেন। কিন্তু প্রধান শিক্ষক কমিটি চেয়ে শিক্ষা বোর্ডে চিঠিই পাঠাননি। যে কারণে ইছালী ইউনিয়নে এমপি নাবিল আহমেদের প্রতিনিধি হিসেবে ওই প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, এটা সত্য। তবে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া অডিওর কিছু কথা এডিট করা।’

যশোর জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও যশোর ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুপম কুমার সরকার বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকের জিডি তদন্তের অনুমতির জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতে আবেদন করা হয়েছে।’ 

সর্বশেষ আজ দুপুরে অভিযুক্ত যুবলীগ নেতা মাজহারুল ইসলামকে যশোর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ডেকে নিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে বিকেল পৌনে ৫টা পর্যন্ত এ বিষয়ে ডিবির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে। গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই বিশেষ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

আজ বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এ সারা দেশে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২ লাখ ৫৮ হাজার ১৬৮টি মোটরসাইকেল ও ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪১১টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ৩ হাজার ৩৯৪টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

বিষয়:

অপরাধ
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে গত রোববার বিকেল থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২৮ হাজার ৭৬৬টি মোটরসাইকেল ও ৪৩ হাজার ৩৫২টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ২৯১টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

হাদিকে গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন ফয়সাল ওরফে দাউদ কে, মাস্ক পরা ব্যক্তিটিই কি তিনি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩: ০৫
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আলোচিত মুখ ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমে বহুল আলোচিত নাম ফয়সাল করিম মাসুদ কিংবা দাউদ খান। গতকাল শুক্রবার হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই এই দুই নামে এক ব্যক্তির ছবি ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।

হাদিকে গুলির ঘটনায় মাস্ক পরা দুই তরুণ জড়িত বলে তাঁর সহযোদ্ধাদের সন্দেহ। তাঁদের দাবি, কয়েকদিন ধরে দুই তরুণ মাস্ক পরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদির সঙ্গে গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন। বার বার তাঁদের মাস্ক খুলতে বলা হলেও তাঁরা রাজি হননি। হাদিঘনিষ্ঠদের সন্দেহ, এই তরুণরা হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর গতিবিধি বোঝার জন্য তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন।

দুজনের মধ্যে মাস্ক পরা একজন হাদির পাশে বসে আছে— এমন একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই তাকে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে মাস্ক করা এই তরুণই যে হাদিকে গুলি করেছেন, কিংবা এই তরুণই যে ফয়সাল, তা নিশ্চিত করে বলছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে শনাক্ত একজনের ছবি প্রকাশ করে ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ডিএমপির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তদের হামলায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেফতারে রাজধানীতে জোর অভিযান পরিচালনা করছে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ছবির ব্যক্তিকে প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করা গেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ তাকে হন্য হয়ে খুঁজছে। উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে কোন তথ্য থাকলে বা তার সন্ধান পেলে দ্রুত নিম্নলিখিত মোবাইল নম্বর অথবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে জানানোর জন্য বিনীত অনুরোধ করা হলো।’

পুলিশের বিবৃতিতে এই তরুণের নাম উল্লেখ করা না হলেও ছবি দেখে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ বলে আন্দাজ করা যায়। এই তরুণকেও আগে হাদীর সঙ্গে দেখা গেছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে হাদির সঙ্গে গণসংযোগে থাকা মাস্ক পরা তরুণটিই ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ এমন কোনো তথ্য পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম। সেই আলোচনার ছবিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

ফয়সাল করিম নামের তরুণ কার্যক্রমনিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধঘোষিত সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৯ সালের ১১ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সদস্য হন। তাঁর পুরো নাম ফয়সাল করিম দাউদ খান।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা–৮ সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদি। হাদিকে বহনকারী রিকশাকে অনুসরণ করে পেছন দিকে থেকে মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে গুলি করে চলে যায় আততায়ীরা। হাদি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার নামে ওসমান হাদির প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সঙ্গে ফয়সাল করিমের কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই ছবিগুলোতে থাকা ফয়সাল করিমের সঙ্গে মাস্ক পরা ব্যক্তির চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য আছে। সেকারণে গুলি ছোড়ার ঘটনায় তাঁকে সন্দেহ করা হচ্ছে।

এর মধ্যেই দুপুরে ডিএমপি সন্দেহভাজনকে শনাক্তের কথা জানায় এবং ওসমান হাদিকে গুলি করা ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।
গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।

আলোচিত ফয়সাল করিম কে?

পেশাদারদের যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনে ফয়সাল করিমের নামে প্রোফাইল আছে। সেখানে তিনি নিজেকে অ্যাপল সফট আইটি, ওয়াইসিইউ টেকনোলজি ও এনলিস্ট ওয়ার্ক নামে তিন প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

লিংকডইন প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম ২০১৩ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। পরে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমবিএ করেছেন বলে সেখানে উল্লেখ রয়েছে।

২০২৪ সালে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীদের দমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের সঙ্গে মাঠে ছিলেন বলে ছাত্রলীগের সূত্র জানিয়েছে।

ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় নাম আসার পর ফয়সাল করিমের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশের দুইবারের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতার ছবি ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে হাদির সঙ্গে ঢাকা–৮ আসনে গণসংযোগ এবং বাংলামোটরে হাদির প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারের আড্ডায় ফয়সালের অংশ নেওয়ার ছবিও ভাইরাল হয়েছে। অনেকে ধারণা করছেন, ফয়সাল করিম ওসমান হাদিকে বেশ কিছুদিন ধরে অনুসরণ করছিলেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সহযোগিতা ও সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ‘ব্যাটল অব ৭১’ নামে একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করেছিল ফয়সাল করিমের মালিকানাধীন ওয়াইসিইউ টেকনোলজি লিমিটেড। সে বছরের নভেম্বরে ওই গেমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেসিসের তৎকালীন সভাপতি এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও উপস্থিত ছিলেন।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা ও সমন্বয়ক কমিটি’ করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ঢাকা–১২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এই আসনের সমন্বয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন ফয়সাল করিম।

অভ্যুত্থানের অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার ফয়সালের দ্রুত জামিন নিয়ে প্রশ্ন সবার

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় আদাবর থানার মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ফয়সাল করিম।

মামলা হওয়ার কিছুদিন পর ৭ নভেম্বর আদাবর এলাকা থেকে ফয়সাল করিমকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁর কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও পাঁচটি গুলিও উদ্ধার করা হয়। ওই মামলায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ফয়সাল করিম। জামিনের সময়সীমা বাড়াতে গত ১২ আগস্ট আবারও আবেদন করলে হাইকোর্ট নতুন করে তাঁর এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন।

জামিনে থাকা অবস্থায় এবার তাঁর বিরুদ্ধে ওসমান হাদিকে গুলি করার অভিযোগ এল। এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কীভাবে জামিন পেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ, কোনো অপরাধমূলক কাজের প্রমাণ না থাকলেও অভ্যুত্থানের পর শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা সভা করায় গ্রেপ্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকের জামিন বারবার নাকচ করা হয়েছিল। আর এ রকম লুটের ঘটনায় দুটি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে এতো দ্রুত জামিন দেওয়া হলো কীভাবে, সেই প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন আলোচনা–সমালোচনায় সরব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

খুনের পর মোবাইল, ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট, ‘গৃহকর্মী আয়েশা’র পরিচয় মেলেনি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯: ৫৭
ছবি: সিসিটিভির ফুটেজ থেকে নেওয়া
ছবি: সিসিটিভির ফুটেজ থেকে নেওয়া

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মা-মেয়েকে খুন করার পর কথিক গৃহকর্মী আয়েশা ওই বাসা থেকে একটি মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, বেশ কিছু স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট করেন। এ ঘটনায় গতকাল সোমবার রাতে মোহাম্মদপুর থানায় করা হত্যা মামলার এজাহারে এই দাবি করা হয়েছে। তবে আয়েশা নামে পরিচয় দেওয়া ওই তরুণীর প্রকৃত পরিচয় মেলেনি এখনো।

স্ত্রী লায়লা আফরোজ (৪৮) ও মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজ (১৫) হত্যার ঘটনায় গতকাল মামলাটি করেন নাটোরের স্থায়ী বাসিন্দা আ জ ম আজিজুল ইসলাম। মামলায় কথিত গৃহকর্মী মোছা. আয়েশাকে (২০) একমাত্র আসামি করা হয়েছে। তবে এজাহারে তাঁর বাবার নাম ও ঠিকানায় ‘অজ্ঞাত’ লেখা হয়েছে।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে আজকের পত্রিকাকে মামলার এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রকিবুজ্জামান তালুকদার। গতকাল সকাল ৭টা ৫১ মিনিট থেকে ৯টা ৩৫ মিনিটের মধ্যে যেকোনো সময় এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।

এজাহারে বাদী আজিজুল লিখেছেন, তিনি পেশায় একজন শিক্ষক। মোহাম্মদপুরে পরিবার নিয়ে থাকেন। চার দিন আগে উল্লিখিত আসামি তাঁর বাসায় খণ্ডকালীন গৃহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। গতকাল সকাল ৭টার দিকে তিনি (আজিজুল) তাঁর কর্মস্থল উত্তরায় চলে যান। কর্মস্থলে থাকাকালে তিনি তাঁর স্ত্রীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

পরে তিনি বেলা ১১টার দিকে বাসায় আসেন। এসে দেখতে পান, তাঁর স্ত্রীর গলাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কাটা। স্ত্রী রক্তাক্ত জখম হয়ে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন আর মেয়ের গলার নিচে ডান পাশে কাটা। মেয়ে গুরুতর অবস্থায় বাসার প্রধান ফটকে পড়ে আছে। মেয়ের এই অবস্থা দেখে তিনি দ্রুত তাকে উদ্ধার করেন। পরিচ্ছন্নতাকর্মী আশিকের মাধ্যমে মেয়েকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

মামলায় আজিজুল আরও লিখেছেন, তিনি বাসার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করেন। এতে তিনি দেখতে পান, আসামি সকাল ৭টা ৫১ মিনিটের সময় কাজ করার জন্য বাসায় আসেন। সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটের সময় আসামি তাঁর (বাদী) মেয়ের স্কুলড্রেস পরে বাসা থেকে পালিয়ে যান। যাওয়ার সময় একটি মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থসহ অন্যান্য মূলবান সামগ্রী নিয়ে যান আসামি।

মামলায় বাদী লিখেছেন, সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে তিনি নিশ্চিত হন যে, অজ্ঞাত কারণে আসামি তাঁর (বাদী) স্ত্রী ও মেয়েকে ছুরি বা অন্য কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে গুরুতর জখম করে হত্যা করেন।

মা-মেয়ে হত্যার আসামিকে শনাক্ত করা যায়নি। মোহাম্মদপুর থানা-পুলিশ জানায়, গৃহকর্মীর পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশ চেষ্টা চালাচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত