Ajker Patrika

চবি ছাত্রলীগ নেতাদের ছায়াতলে অপরাধী চক্র

তাসনীম হাসান ও মিনহাজ তুহিন, চট্টগ্রাম
আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২২, ১৮: ২৯
চবি ছাত্রলীগ নেতাদের ছায়াতলে অপরাধী চক্র

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের একেবারে দক্ষিণেই বোটানিক্যাল গার্ডেনের অবস্থান। হরেক রকম গাছ আর দেশীয় অর্কিডের বিশাল সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত এই মনোরম বাগান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই প্রিয়। বন্ধুদের নিয়ে তাই অনেকে ঘুরতে যান সেখানে। কিন্তু আনন্দের সময়টুকু হঠাৎ বিস্বাদে ভরে উঠতে পারে সংঘবদ্ধ চক্রের উপস্থিতিতে। ১৭ জুলাই রাতে এমন এক চক্রের কবলে পড়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী।

ছাত্রলীগের ছায়াতলে থাকা এই চক্রের সদস্যদের কেউ পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউবা কলেজে। সেদিন তাঁরা টাকা আর মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে থামেননি। তাঁরা ওই ছাত্রীকে বেঁধে বিবস্ত্র করে মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা এক বন্ধু প্রতিবাদ করলে তাঁকেও মারধর করা হয়। পরে ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ঘটনাটি কাউকে না বলার হুমকিও দেন। এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার প্রক্টরের কাছে অভিযোগ দেন ওই ছাত্রী। এর এক দিন পর বুধবার তিনি মামলা করেন হাটহাজারী থানায়।

ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর দেশজুড়ে সমালোচনা শুরু হয়। এরপর অভিযান চালিয়ে শুক্রবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আজিম হোসাইন, নৃবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের নুরুল আবসার বাবু, হাটহাজারী কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের নুর হোসেন শাওন, মাসুদ রানা এবং একই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র মোহাম্মদ সাইফুল নামের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

এই পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসছে তাঁদের আমলনামা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তাঁরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত কর্মচারীদের সন্তান; পাশাপাশি যুক্ত আছেন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গেও। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা আর রাজনৈতিক পরিচয় কাজে লাগিয়ে ছাত্রলীগের এই কর্মীরা গড়ে তোলেন একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। এই চক্রের মাথা ছিলেন আজিম হোসাইন।

সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, র‍্যাবের হাতে আটক পাঁচজন ও পলাতক অন্যজন দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, ফরেস্ট্রি এলাকা, জীববিজ্ঞান অনুষদ এলাকায় অপকর্ম করে আসছেন; বিশেষ করে সন্ধ্যা হলেই সক্রিয় হয়ে উঠতেন তাঁরা। মোটরসাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাসে চক্কর দেওয়া শুরু করতেন। তাঁদের একটি গ্রুপ লেডিস ঝুপড়ি এলাকা থেকে নজরদারি শুরু করতেন। ওই ঝুপড়ি থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে কাউকে যেতে দেখলেই মোটরসাইকেল নিয়ে তাঁদের অনুসরণ করতেন। পরে বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় পৌঁছালেই সুযোগ বুঝে তাঁদের সবকিছু হাতিয়ে নিতেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে মাদক কারবারের সঙ্গেও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

কলেজেই ছিনতাইয়ে হাত পাকান তাঁরা
জড়িত ব্যক্তিরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি কলেজে একসঙ্গে পড়েছেন। তখন থেকেই তাঁরা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। আজিম কলেজে পড়া অবস্থায় ২০১৭ সালে ফরেস্ট্রি এলাকায় এক ছাত্রীর মোবাইল ফোন ও সোনার চেইন ছিনতাই করে ধরা পড়েন। পরবর্তী সময়ে থানায় নিয়ে গেলে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান।

অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের সন্তান
র‍্যাবের হাতে আটক পাঁচজনের মধ্যে চারজনের বাসা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে। মূল হোতা আজিমের বাসা ঘটনাস্থলের অদূরে বোটানিক্যাল গার্ডেন-সংলগ্ন ইসলামিয়া কলোনিতে। তাঁর বাবা মো. আমির হোসেন সমাজবিজ্ঞান অনুষদের মালি। নুরুল আবসার বাবুর বাসা বিজ্ঞান অনুষদের পাশের হিল বটম কলোনিতে। তাঁর বাবা বেলায়েত হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাপ্রহরী। মাসুদ রানার বাড়ি সমাজবিজ্ঞান অনুষদের পাশের প্রবাসী কলোনিতে। তাঁর বাবা আবদুল মান্নান রেজিস্ট্রার অফিসের স্টোর শাখার কর্মচারী। নুর হোসেন শাওনের বাসাও প্রবাসী কলোনিতে। তাঁর বাবা জাভেদ হোসেন পরিবহন দপ্তরের বাসচালক।

ছাত্রলীগের নেতাদের ছায়ায় বলীয়ান তাঁরা
বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই প্রায় তিন বছর। আছেন শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তবে এই দুই নেতার দুটি পক্ষ ছাড়াও ক্যাম্পাসে সক্রিয় আছে ছাত্রলীগের আরও কয়েকটি পক্ষ। আজিম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের অনুসারী বলে জানা গেছে। রুবেলের বিভিন্ন বাইক শোডাউনে তাঁকে প্রায়ই দেখা যেত। ঘটনার পর রুবেলের সঙ্গে আজিমের তোলা একাধিক ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তবে এখন আজিমকে নিজের অনুসারী মানতে নারাজ ছাত্রলীগের সভাপতি।

ঘটনার পর ওই ছাত্রীর বন্ধুরা অভিযোগ করেছিলেন, ঘটনার শিকার ছাত্রীকে প্রক্টরের কাছে লিখিত অভিযোগ দিতে বাধা দেন ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল। এ জন্য ঘটনার দুই দিন পর ওই ছাত্রী অভিযোগ দেন প্রক্টরের কাছে। অবশ্য রুবেল দাবি করে আসছেন, তিনি ছাত্রীকে অভিযোগ দিতে বাধা দেননি।

জড়িত অন্যদের মধ্যে তিনজন (মাসুদ, শাওন, বাবু) শাখা ছাত্রলীগের ভিএক্স (ভার্সিটি এক্সপ্রেস) পক্ষের নেতা প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয়ের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হয়েও ভিএক্স গ্রুপের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তাঁরা ভিএক্স পক্ষের কলেজ শাখার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ভিএক্সের নেতা দুর্জয়ের সঙ্গে তাঁদের ছবিও দেখা গেছে। যদিও নিজের কর্মীর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন দুর্জয়। তিনি বলেন, ‘কলেজের ছাত্র কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি করবে?’

রেজাউল হক রুবেল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আজিম সিএফসি (চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার) পক্ষের কর্মী। আর আমি পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি। আর বাকিরা ভিএক্স গ্রুপের কর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হয়েও তারা ভিএক্সের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়।’

দুজন বহিষ্কার
ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র আজিম ও নুরুল আবসার বাবুকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল শনিবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ, রেসিডেন্স ও ডিসিপ্লিনারি কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া গ্রেপ্তার হাটহাজারী কলেজের দুই ছাত্রের বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর শাস্তির আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান।

কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ
অপরাধীদের শনাক্ত করতে সময়ক্ষেপণের অভিযোগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দিকে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান দাবি করেছেন, যৌন নিপীড়নের শিকার ছাত্রীর বক্তব্যে গরমিলের কারণে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্তে দেরি হয়েছে। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী তার অভিযোগে প্রথমে বলেছিল যে তাকে প্রীতিলতা হলের পাশ থেকে অভিযুক্তরা টেনেহিঁচড়ে আড়ালে নিয়ে যায়। কিন্তু তদন্ত চলাকালে সে জানিয়েছে, ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলের পেছনের গলি বা ছোট রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গায় বন্ধুসহ বসে ছিল। সেখানে গিয়ে অভিযুক্তরা তাঁদের মারধর ও অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে। ঘটনাস্থল মূল রাস্তা থেকে ভেতরে হওয়ায় সেখানে স্বাভাবিকভাবেই কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না।’

যৌন নিপীড়নের বিচার হয় না
২০১৮ সালে ‘যৌন হয়রানি নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্র’ নামের সাত সদস্যের কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটির আহ্বায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের নির্দেশনায় ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ সদস্যের একটি ‘অভিযোগ কমিটি’ গঠন করা হয়। এ কমিটির আহ্বায়ক কাজী শামীমা সুলতানা (পদার্থ বিভাগ)। এ পর্যন্ত এই কমিটিতে তিনটি অভিযোগ জমা হয়েছে। এই অভিযোগগুলো ছিল খালেদা জিয়া হলের ছাত্রীকে হেনস্তা, ফরেস্ট্রি বিভাগের শিক্ষকের হাতে ছাত্রী হেনস্তা এবং ছাত্রলীগের চার কর্মীর কাছে দুই ছাত্রী হেনস্তা। কিন্তু অভিযোগগুলোর একটিও এখন পর্যন্ত মীমাংসা হয়নি।

ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ
সারা দেশের ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে হত্যা, ধর্ষণ, র‍্যাগিং, সিট-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ বারবার এসেছে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। গত ১০ বছরে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হাতে ২৪ জন শিক্ষার্থী খুনের শিকার হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল ঢাকায় ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর দিনদুপুরে কুপিয়ে দরজি দোকানদার বিশ্বজিৎ দাসকে হত্যা। ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি সংগঠনের বিরোধীপক্ষের হামলায় আহত হয়ে এক দিন পর মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ। বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে শেরেবাংলা হলে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে শাহ পরান (রা.)-এর মাজার থেকে ফেরার পথে স্বামীর কাছ থেকে তুলে মুরারিচাঁদ কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণ করা হয় এক নারীকে। এ ঘটনায় ছয়জনকে আসামি করে মামলা করা হয়, যাঁদের সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বরিকুল ইসলাম বাঁধন গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, কেউ ছাত্রলীগের সুনাম ক্ষুণ্ন করার লক্ষ্যে কোনো অপকর্ম করলে ছাত্রলীগ সব সময়ের মতো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতিও অনুরোধ থাকবে দোষীদের যেন শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কেরানীগঞ্জে মাদ্রাসায় বিস্ফোরণ: জেএমবির সঙ্গে জড়িতের অভিযোগে পরিচালক গ্রেপ্তার হন দুবার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২: ৫৪
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় মাদ্রাসা ভবনে বিস্ফোরণ। ছবি: আজকের পত্রিকা
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় মাদ্রাসা ভবনে বিস্ফোরণ। ছবি: আজকের পত্রিকা

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় গত শুক্রবার সকালে একটি মাদ্রাসায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে নারী, শিশুসহ চারজন আহত হয়েছে। মাদ্রাসাটি শেখ আল আমিন নামের এক ব্যক্তি পরিচালনা করতেন। যিনি এর আগে নিষিদ্ধ উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দুবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাতটি মামলা রয়েছে। পুলিশ বলছে, ভবনটি বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহৃত হতো।

আজ শনিবার দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, হাসনাবাদ বাজারের ফলপট্টি গলিতে উম্মাল কুরা ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসা। মাদ্রাসায় শিশুদের পাঠদান করা হয়। বিস্ফোরণে চার কক্ষের একতলা ভবনটির পশ্চিম পাশের দুটি কক্ষ সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে, সিঁড়ির পাশের ছাদের একাংশ উড়ে গেছে এবং সব কটি কক্ষের পিলার ও দেয়ালে ফাটল ধরেছে। ঘটনাস্থলে ককটেল, রাসায়নিক দ্রব্য ও বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগের ক্রাইম সিন ইউনিটের কর্মীরা আলামত সংগ্রহ করছেন। তাঁরা পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছেন। ভবনের পাশের একটি ভবনের দোতলার দেয়ালে বিস্ফোরণে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বিস্ফোরণে পাশের একটি অটোরিকশার গ্যারেজের টিনের ছাউনি উড়ে গেছে। টিনের নিচে চাপা পড়েছিলেন গ্যারেজের ম্যানেজার আবুল কালাম।

আবুল কালাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এত বিকট শব্দ হয়েছে যে আমার কানে তব্দা লেগে যায়। আমি টিনের নিচে চাপা পড়ি। পরে হামাগুড়ি দিয়ে বের হই। এরপর দেখি মাদ্রাসার মধ্যে আগুন জ্বলছে। যারা ভেতরে ছিল, তারা দ্রুত বাচ্চাদের নিয়ে বের হয়ে চলে যায়।’

গ্যারেজের মালিক মোশাররফ হোসেন ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘বিস্ফোরণের পর পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। আমিও বাসা থেকে দৌড়ে আসি। আমার গ্যারেজের দুজন অটোচালক দুই শিশুকে ওই ভবন থেকে বের করেন। এক নারী আর এক শিশুকে নিয়ে চলে যায়। এ সময় আল আমিনও দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়। আধা ঘণ্টার মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের লোকজন এসে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।’

মাদ্রাসার পাশের ৫ তলা বাড়ির বাসিন্দা মনোয়ার বলেন, ‘হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। মনে হয়েছিল ভূমিকম্প। কারণ, বিস্ফোরণে সব ভবনে কাঁপুনি লাগে। সবাই চিৎকার করেছিল।’

ওই বাসিন্দা আরও বলেন, ‘মাদ্রাসাটিতে ৩০-৩৫ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত। তবে শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় মাদ্রাসা বন্ধ ছিল। এ কারণে বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।’

ভবনটির পশ্চিম পাশের এক পাশে তিনটি কক্ষে মাদ্রাসার কার্যক্রম পরিচালিত হতো। অপর পাশের একটি কক্ষে পরিচালক শেখ আল আমিন (৩২), তাঁর স্ত্রী আছিয়া বেগম (২৮) এবং তাঁদের তিন সন্তান নিয়ে সেখানেই থাকতেন। বিস্ফোরণে দুই ছেলে উমায়েত (১০) ও আবদুল্লাহ (৭) আহত হয়। এর মধ্যে আছিয়া ও তাঁর দুই সন্তানকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।

পাশের ভবনের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বিস্ফোরণে আমাদের ভবনের কিছু অংশ ফেটে গেছে। ঘরের ভেতরের আসবাবও ভেঙে পড়েছে।’

ঘটনাস্থলেই পুলিশ হেফাজতে বসে ছিলেন ভবনমালিক পারভীন বেগম। ভবনের জমি তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি। সেখানে লিবিয়ায় থাকা তাঁর দুই ছেলে এই ভবন ২০২২ সালে তৈরি করেন। এরপর হারুন অর রশীদ নামের এক ব্যক্তি এটি মাদ্রাসা করবেন বলে ১০ হাজার টাকায় ভাড়া নেন। পারভীন বেগম বলেন, ‘তিন বছর ধরে আমার বাড়ি ভাড়া নিয়ে মুফতি হারুন অর রশীদ মাদ্রাসা পরিচালনা করতেন। হারুন তাঁর শ্যালক আল আমিন ও শ্যালকের স্ত্রী আছিয়াকে মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। তিনি মাঝেমধ্যে মাদ্রাসায় আসতেন। আমি নিয়মিত খোঁজখবর নিতাম। কিন্তু মাদ্রাসার আড়ালে কী কার্যক্রম চলছিল, তা বুঝতে পারিনি। আজ এসে দেখি, ভবনের চারপাশ উড়ে গেছে।’

পারভীন বেগমের পাশেই ছিলেন তাঁর ছোট মেয়ে সোহানা। তিনি বলেন, ‘ভাড়া নেওয়ার সময় শুধু হারুন অর রশীদ একাই এসেছিলেন। এরপর তাঁরা মাদ্রাসা পরিচালনা শুরু করেন। তবে তাঁরা আশপাশের কারও সঙ্গে তেমন মিশতেন না।’

পুলিশ ভবনের ভেতর থেকে কেমিক্যাল, ককটেল, ভেস্ট ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস, কম্পিউটার ও মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা, কোনো বিস্ফোরক তৈরি করতে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়েছে।

ঘটনার বিষয়ে গতকাল বিকেলে জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট শেখ আল আমিন পলাতক রয়েছেন। তবে কেরানীগঞ্জ থেকে তাঁর স্ত্রী আছিয়া বেগম, আছিয়ার ভাই হারুনের স্ত্রী ইয়াছমিন আক্তার এবং ঢাকার বাসাবো থেকে আসমানী খাতুন নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, আল আমিনের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটে। তাঁর বিরুদ্ধে এর আগে ২০১৭ ও ২০২০ সালে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন জেএমবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকা এবং আশপাশের বিভিন্ন থানায় অন্তত সাতটি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার আসমানী খাতুনের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে। গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই বিশেষ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

আজ বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এ সারা দেশে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২ লাখ ৫৮ হাজার ১৬৮টি মোটরসাইকেল ও ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪১১টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ৩ হাজার ৩৯৪টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

বিষয়:

অপরাধ
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে গত রোববার বিকেল থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২৮ হাজার ৭৬৬টি মোটরসাইকেল ও ৪৩ হাজার ৩৫২টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ২৯১টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

হাদিকে গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন ফয়সাল ওরফে দাউদ কে, মাস্ক পরা ব্যক্তিটিই কি তিনি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩: ০৫
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আলোচিত মুখ ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমে বহুল আলোচিত নাম ফয়সাল করিম মাসুদ কিংবা দাউদ খান। গতকাল শুক্রবার হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই এই দুই নামে এক ব্যক্তির ছবি ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।

হাদিকে গুলির ঘটনায় মাস্ক পরা দুই তরুণ জড়িত বলে তাঁর সহযোদ্ধাদের সন্দেহ। তাঁদের দাবি, কয়েকদিন ধরে দুই তরুণ মাস্ক পরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদির সঙ্গে গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন। বার বার তাঁদের মাস্ক খুলতে বলা হলেও তাঁরা রাজি হননি। হাদিঘনিষ্ঠদের সন্দেহ, এই তরুণরা হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর গতিবিধি বোঝার জন্য তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন।

দুজনের মধ্যে মাস্ক পরা একজন হাদির পাশে বসে আছে— এমন একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই তাকে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে মাস্ক করা এই তরুণই যে হাদিকে গুলি করেছেন, কিংবা এই তরুণই যে ফয়সাল, তা নিশ্চিত করে বলছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে শনাক্ত একজনের ছবি প্রকাশ করে ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ডিএমপির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তদের হামলায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেফতারে রাজধানীতে জোর অভিযান পরিচালনা করছে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ছবির ব্যক্তিকে প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করা গেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ তাকে হন্য হয়ে খুঁজছে। উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে কোন তথ্য থাকলে বা তার সন্ধান পেলে দ্রুত নিম্নলিখিত মোবাইল নম্বর অথবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে জানানোর জন্য বিনীত অনুরোধ করা হলো।’

পুলিশের বিবৃতিতে এই তরুণের নাম উল্লেখ করা না হলেও ছবি দেখে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ বলে আন্দাজ করা যায়। এই তরুণকেও আগে হাদীর সঙ্গে দেখা গেছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে হাদির সঙ্গে গণসংযোগে থাকা মাস্ক পরা তরুণটিই ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ এমন কোনো তথ্য পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম। সেই আলোচনার ছবিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

ফয়সাল করিম নামের তরুণ কার্যক্রমনিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধঘোষিত সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৯ সালের ১১ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সদস্য হন। তাঁর পুরো নাম ফয়সাল করিম দাউদ খান।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা–৮ সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদি। হাদিকে বহনকারী রিকশাকে অনুসরণ করে পেছন দিকে থেকে মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে গুলি করে চলে যায় আততায়ীরা। হাদি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার নামে ওসমান হাদির প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সঙ্গে ফয়সাল করিমের কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই ছবিগুলোতে থাকা ফয়সাল করিমের সঙ্গে মাস্ক পরা ব্যক্তির চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য আছে। সেকারণে গুলি ছোড়ার ঘটনায় তাঁকে সন্দেহ করা হচ্ছে।

এর মধ্যেই দুপুরে ডিএমপি সন্দেহভাজনকে শনাক্তের কথা জানায় এবং ওসমান হাদিকে গুলি করা ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।
গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।

আলোচিত ফয়সাল করিম কে?

পেশাদারদের যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনে ফয়সাল করিমের নামে প্রোফাইল আছে। সেখানে তিনি নিজেকে অ্যাপল সফট আইটি, ওয়াইসিইউ টেকনোলজি ও এনলিস্ট ওয়ার্ক নামে তিন প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

লিংকডইন প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম ২০১৩ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। পরে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমবিএ করেছেন বলে সেখানে উল্লেখ রয়েছে।

২০২৪ সালে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীদের দমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের সঙ্গে মাঠে ছিলেন বলে ছাত্রলীগের সূত্র জানিয়েছে।

ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় নাম আসার পর ফয়সাল করিমের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশের দুইবারের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতার ছবি ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে হাদির সঙ্গে ঢাকা–৮ আসনে গণসংযোগ এবং বাংলামোটরে হাদির প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারের আড্ডায় ফয়সালের অংশ নেওয়ার ছবিও ভাইরাল হয়েছে। অনেকে ধারণা করছেন, ফয়সাল করিম ওসমান হাদিকে বেশ কিছুদিন ধরে অনুসরণ করছিলেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সহযোগিতা ও সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ‘ব্যাটল অব ৭১’ নামে একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করেছিল ফয়সাল করিমের মালিকানাধীন ওয়াইসিইউ টেকনোলজি লিমিটেড। সে বছরের নভেম্বরে ওই গেমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেসিসের তৎকালীন সভাপতি এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও উপস্থিত ছিলেন।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা ও সমন্বয়ক কমিটি’ করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ঢাকা–১২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এই আসনের সমন্বয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন ফয়সাল করিম।

অভ্যুত্থানের অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার ফয়সালের দ্রুত জামিন নিয়ে প্রশ্ন সবার

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় আদাবর থানার মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ফয়সাল করিম।

মামলা হওয়ার কিছুদিন পর ৭ নভেম্বর আদাবর এলাকা থেকে ফয়সাল করিমকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁর কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও পাঁচটি গুলিও উদ্ধার করা হয়। ওই মামলায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ফয়সাল করিম। জামিনের সময়সীমা বাড়াতে গত ১২ আগস্ট আবারও আবেদন করলে হাইকোর্ট নতুন করে তাঁর এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন।

জামিনে থাকা অবস্থায় এবার তাঁর বিরুদ্ধে ওসমান হাদিকে গুলি করার অভিযোগ এল। এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কীভাবে জামিন পেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ, কোনো অপরাধমূলক কাজের প্রমাণ না থাকলেও অভ্যুত্থানের পর শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা সভা করায় গ্রেপ্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকের জামিন বারবার নাকচ করা হয়েছিল। আর এ রকম লুটের ঘটনায় দুটি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে এতো দ্রুত জামিন দেওয়া হলো কীভাবে, সেই প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন আলোচনা–সমালোচনায় সরব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত