Ajker Patrika

চীনে দেশীয় কোম্পানির কাছে আধিপত্য হারাচ্ছে স্টারবাকস

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
বেইজিংয়ের সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্টের একটি অভিজাত শপিং মলে ১৯৯৯ সালে চালু হয় স্টারবাকসের প্রথম শাখা। ছবি: সংগৃহীত
বেইজিংয়ের সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্টের একটি অভিজাত শপিং মলে ১৯৯৯ সালে চালু হয় স্টারবাকসের প্রথম শাখা। ছবি: সংগৃহীত

তিন দশক আগে এশিয়ার দেশ চীনে যাত্রা শুরু করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কফি চেইন স্টারবাকস। মার্কিন এই কফি ব্র্যান্ডের আগমন চা-প্রধান চীনের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে কফি সংস্কৃতির উত্থান ঘটায় এবং দ্রুতই স্টারবাকস হয়ে ওঠে পশ্চিমা প্রভাব ও সমৃদ্ধ জীবনযাত্রার প্রতীক। এক সময় দেশটির অর্থনৈতিক উত্থানের ঢেউয়ে চড়ে স্টারবাকস গড়ে প্রতি ১৫ ঘণ্টায় একটি করে নতুন শাখা খুলতে থাকে। চীন হয়ে ওঠে মার্কিন এই কফি জায়ান্টের বৈশ্বিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু।

১৯৯৯ সালে বেইজিংয়ের সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্টের একটি অভিজাত শপিং মলে চালু হয় স্টারবাকসের প্রথম শাখা। উদ্বোধনী আয়োজনে ছিল ঐতিহ্যবাহী ‘গোল্ডেন লায়ন’ নাচের আয়োজন। আধুনিক এসপ্রেসো মেশিনে তৈরি কফি দিয়ে প্রথমবারের মতো ক্যাপুচিনো চেখে দেখতে ভিড় করেছিলেন চীনারা।

সেই থেকে দীর্ঘ সময় ধরে চীনে এক অপ্রতিরোধ্য অবস্থান ধরে রেখেছিল এই কফি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তিন দশক পর এসে এখন সেই পরিস্থিতি আর নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্য যুদ্ধের ধাক্কা লেগেছে স্টারবাকসের গায়েও।

গত সোমবার স্টারবাকস ঘোষণা দিয়েছে, তারা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এই দেশে নিজেদের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণমূলক শেয়ার বিক্রি করবে এক চীনা বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের কাছে।

চুক্তি অনুযায়ী, বয়ু ক্যাপিটাল নামে ওই চীনা প্রতিষ্ঠানটি স্টারবাকসের ৮ হাজারেরও বেশি আউটলেটসহ খুচরা ব্যবসায় সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ শেয়ার অর্জন করবে। স্টারবাকসের থাকবে ৪০ শতাংশ অংশীদারত্ব এবং নতুন এই যৌথ প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্র্যান্ড ও মেধাস্বত্ব লাইসেন্স দেবে তারা।

স্টারবাকসের এক শাখায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলেন গাড়িশিল্পে কর্মরত ২৮ বছর বয়সী সি হুয়াঝেং। তিনি সিএনএনকে বলেন, “প্রথম যখন স্টারবাকস চীনে আসে, তখন এটি নিজেকে এক ধরনের ‘অ্যাক্সেসিবল লাক্সারি’ (যে বিলাসিতা সবাই উপভোগ করতে পারে) হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। কিন্তু এখন এত দেশীয় কফি ব্র্যান্ড এসেছে যে ওই পরিস্থিতিই বদলে গেছে।”

এখন স্টারবাকস চীনে তীব্র দেশীয় প্রতিযোগিতা, ব্যয়-সচেতন ভোক্তা বাজার এবং নিজেদের ব্র্যান্ডকে সমর্থন দিতে আগ্রহী তরুণ প্রজন্মের কারণে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

চীনের কফির বাজার স্টারবাকসের আগমনের সময়কার চেহারা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২৬ বছর আগে যখন চীনের অর্থনীতি মাত্রই উত্থান শুরু করছিল এবং কোটি কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে প্রবেশ করছিল, তখন দেশটিতে কফি পান করার কোনো মূলধারার সংস্কৃতি ছিল না।

সেই সময় স্টারবাকস ছিল কয়েকটি মার্কিন ফুড ও বেভারেজ চেইনের মধ্যে একটি, যারা ১৯৮০-এর দশকের চীনের উন্মুক্ত নীতির পর দেশটিতে নিজেদের জায়গা করে নিতে চেষ্টা করছিল।

কিন্তু গত কয়েক বছরে চীনের বাজারে একের পর এক নতুন ব্র্যান্ডের উত্থান ঘটেছে। এই ব্র্যান্ডগুলো বেশ ছাড় দিয়ে বিক্রি করতে থাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই তালিকার শীর্ষে আছে লাকিন কফি (Luckin Coffee)। ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করা এই ব্র্যান্ডটি বিক্রয় ও আউটলেট সংখ্যার দিক থেকে স্টারবাকসকে ছাড়িয়ে গেছে।

বর্তমানে চীনে লাকিনের স্টারবাকসের তুলনায় তিন গুণ বেশি দোকান রয়েছে। তাদের কফির দাম স্টারবাকসের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ কম। অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই কফি ব্র্যান্ড এখন পা রেখেছে স্টারবাকসের ঘরের মার্কেটেও। গত জুন মাসে নিউইয়র্ক সিটিতে প্রথম আউটলেট খোলে লাকিন কফি।

এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সময়টিতে চীনে স্টারবাকসের সাফল্যের পেছনে কারণ ছিল পশ্চিমা বিলাসপণ্যের প্রতি দেশটির মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ এবং স্থানীয় বাজারের উপযোগী করে পণ্য তৈরি করার কৌশলের ওপর। যার ফলে ব্র্যান্ডটি চীনের বড় শহরের বাইরের গ্রাহকদের কাছেও জনপ্রিয়তা পায়।

বেইজিংয়ের একটি স্টারবাকস শাখায় বসে ৭০ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত লিউ জিশাং বলেন, বেইজিংয়ে প্রথম স্টারবাকস যখন খুলল, সে সময় কফির স্বাদে অভ্যস্ত হতে চীনা গ্রাহকদের কিছুটা সময় লেগেছিল। এছাড়া তখন স্টারবাকসে যাওয়া মানে শুধু কফি পান নয়, ওদের সংস্কৃতিটাও অনুভব করার বিষয়টি ছিল। তখন মানুষ ভাবতে শুরু করল, এটা তো বেশ ভালো।’

তবে এখন স্টারবাকসের যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তার পেছনে চীনের ভোক্তা ব্যয়ের স্থবিরতাও বড় কারণ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

লিউ বলেন, চীনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দিনকে দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। ধনীর সংখ্যা কমছে। বাড়ি, গাড়ি আর ঋণের চাপ মানুষের খরচ করার ইচ্ছাকে প্রভাবিত করছে। আর এর প্রভাব পড়ছে স্টারবাকসেও।

২০২৫ অর্থবছরে চীনের দোকানগুলোতে ১ শতাংশ বিক্রি কমে যাওয়ার প্রতিবেদন পেয়েছে স্টারবাকস।

এর পাশাপাশি, স্টারবাকস এখন মিক্সু বিংচেং (Mixue Bingcheng), চা-জি (ChaGee) এবং হেইটি (HeyTea)-এর মতো চাভিত্তিক পানীয় চেইনগুলোর উত্থানের কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে।

বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি আউটলেট থাকা খাদ্য ও পানীয় চেইনে পরিণত হওয়া মিক্সু এখন ম্যাকডোনাল্ডস ও স্টারবাকসকেও ছাড়িয়ে গেছে। তাদের জনপ্রিয় পানীয় ও কফির দাম মাত্র ২ থেকে ৮ ইউয়ান (প্রায় ৩০ সেন্ট থেকে ১.২০ ডলার), যা স্টারবাকসের দামের এক-তৃতীয়াংশও নয়।

এমনকি এই বছরের শুরুতে মিক্সু শেয়ারবাজারে যাত্রা শুরু করলে স্টারবাকসের নতুন মালিক বয়ু ক্যাপিটাল তাদের সমর্থন দেয়।

অন্যদিকে জেসমিন গ্রিন মিল্ক টি কিংবা চিজ ফোমসহ আঙুর মিশ্রিত চায়ের মতো অভিনব পানীয় দিয়ে দ্রুত বদলে যাওয়া রুচির তরুণ চীনা ভোক্তাদের আকৃষ্ট করতে পারছে প্রতিদ্বন্দ্বী চা-জি ও হেইটি ব্র্যান্ড।

তবু স্টারবাকস এখনো পরিবেশ ও ‘উচ্চমানের ব্র্যান্ড’ ভাবমূর্তির কারণে অনেকের কাছে আকর্ষণীয় রয়ে গেছে বলে জানান ফাইন্যান্সে কর্মরত ২৮ বছর বয়সী ক্যারি চেন। সপ্তাহে তিন থেকে চারবার স্টারবাকসে যান তিনি।

হ্যাজেলনাট টফি লাতের কাপে চুমুক দিতে দিতে অনলাইন কোর্স করছিলেন চেন। তিনি বলেন, ‘ক্লায়েন্ট মিটিং বা আড্ডা দেওয়ার জন্য যদি স্টারবাকস বেছে নেন, তা মানে আপনি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।’

তবে বর্তমানে বাজারে স্টারবাকস স্বাদ ও অফার নিয়ে খুব বুঝেশুনে খেলছে বলে ধারণা তাঁর।

চীনে স্টারবাকসের বিনিয়োগ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন করলে চেন বলেন, ‘দেশে স্টারবাকসের দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার যুগের হয়তো অবসান হয়েছে, তবে কোনো চীনা পার্টনারের সঙ্গে কাজ করলে ব্র্যান্ডটি হয়তো নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে।’

চীনে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ জিন লু মনে করেন, বৃহৎ অর্থনীতির এই দেশটিতে স্টারবাকসের বিনিয়োগ কমানোর সিদ্ধান্ত মূলত তাদের দুর্বল ব্যবসায়িক কৌশল, তীব্র মূল্য প্রতিযোগিতা এবং দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর প্রতি ভোক্তাদের আগ্রহ বৃদ্ধির কারণে।

আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মর্নিংস্টারের বিশ্লেষক ড্যান সু মনে করেন, স্টারবাকস ও বয়ু ক্যাপিটালের নতুন এই যৌথ উদ্যোগকে সামনে কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হবে। তবে এই অংশীদারিত্ব স্টারবাকসের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে।

তবে চীনে স্টারবাকস যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছে, সেগুলোর অনেকটাই বিশ্বব্যাপী। বিশেষ করে এর নিজস্ব বাজার উত্তর আমেরিকাতেও একই অবস্থা। সেখানে স্বাধীন কফিশপ ও নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী ব্লু বটল (Blue Bottle)-এর চাপের মুখে পড়েছে সিয়াটলভিত্তিক এই কফি কোম্পানি। আবার অনেকে ম্যাকডোনাল্ডস বা ডানকিন-এর তুলনায় স্টারবাকসকে বেশি দামি মনে করে এড়িয়ে যান।

এই প্রেক্ষাপটই তুলে ধরছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্টারবাকসের কৌশলগত ভুল এবং নেতৃত্ব পরিবর্তনের ধাক্কায় কোম্পানিটি টালমাটাল সময় পার করছে। এরই অংশ হিসেবে গত বছর নতুন সিইও হিসেবে ব্রায়ান নিকোল দায়িত্ব নেন। দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় প্রায় শত শত দোকান বন্ধ করার পরিকল্পনা হাতে নেন তিনি, কফি চেইনটির মোট শাখার প্রায় ১ শতাংশ।

তবে ১ বছর পেরিয়ে গেলেও এই সিদ্ধান্তের সুফল পাননি সিইও নিকোল। মেন্যু ছোট করা, দোকান সংস্কার ও বন্ধের পরও গত সপ্তাহে ঘোষিত আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৫ অর্থবছরে কোম্পানির আয় বেড়েছে মাত্র ৩ শতাংশ।

কোম্পানির হিসাব পূর্বাভাস দিচ্ছে, চীনে স্টারবাকসের খুচরা ব্যবসার মোট মূল্য ১৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। চীনে নতুন যৌথ উদ্যোগ প্রসঙ্গে সিইও নিকোল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা বর্তমানে ৮ হাজার কফি হাউস থেকে এক সময় ২০ হাজার হাউসে পৌঁছানোর রূপরেখা দেখতে পাচ্ছি।’

এদিকে বিনিয়োগ কমানোর ঘোষণার পর বিষয়টি নিয়ে চীনা সামাজিক মাধ্যমে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই আশা করছেন, এর ফলে স্টারবাকস হয়তো লাকিন কফির মতো আরও সাশ্রয়ী দামের পানীয় চালু করবে।

চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ওয়েইবোতে একজন লিখেছেন, ‘আমি সাধারণত লাকিন কফি খাই, কারণ স্টারবাকস খুবই দামি। এক কাপ স্টারবাকসের দামে আমি লাকিনের তিন-চার কাপ কিনতে পারি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপির আপত্তি তোলা দুই অধ্যাদেশে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন

লন্ডনে চিকিৎসা যাত্রায় খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী ১৪ জন, তালিকায় ছয় চিকিৎসক ও দুই এসএসএফ

ভারতে পা রাখলেন পুতিন, নিয়ম ভেঙে ‘কোলাকুলি’ করলেন মোদি

ঢাকার তিনটিসহ আরও ২৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা বাকি থাকল

মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ