Ajker Patrika

ভূ-রাজনীতির বিরোধ বাণিজ্যে, অচল হয়ে পড়ছে ডব্লিউটিও

আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১৮: ০৭
ভূ-রাজনীতির বিরোধ বাণিজ্যে, অচল হয়ে পড়ছে ডব্লিউটিও

ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। যেন বিভক্ত এক বিশ্বের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে সংস্থাটি। আর এই বিভক্তির মূল দৃশ্যপটে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। ‘বাণিজ্যিক স্বার্থ’ পুঁথিগত নামে এসব বিরোধ পরিচিত হলেও এর গণ্ডি বিশ্ব রাজনীতি ছুঁয়েছে। একপক্ষীয় সিদ্ধান্তে গোঁ ধরার কারণে ডব্লিউটিও অচল হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বলেছে, কোভিড-১৯ মহামারির আগে যুক্তরাষ্ট্র ডব্লিউটিওর আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগ আটকে দেয়। দেশটির অভিযোগ ছিল, ক্ষমতার বাইরে গিয়ে চর্চা করছে আপিল বিভাগ। সেই ঘটনার পর বিভিন্ন দেশের ২৯টি অভিযোগ আপিলে জমে আছে।

এসব অভিযোগের মধ্যে চীন, ডোমিনিকান রিপাবলিক, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মরক্কো, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রও রয়েছে। 

এই বিষয়টি ডব্লিউটিওর আপিল বিভাগকে অচলাবস্থার মধ্যে এনে ফেলেছে। বিষয়টি উল্লেখ করে গত মাসে সংস্থাটির সাবেক মহাপরিচালক অ্যালান উলফ এক সম্মেলনে বলেন, ২০২৪ সাল থেকে সদস্য দেশগুলোর আর কোনো বিষয়ে আপিল করা উচিত নয়। অন্তত যতক্ষণ না বিদ্যমান মামলাগুলো সমাধান হচ্ছে। 

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা অনেক আগেই সতর্ক করে বলেছিল—মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ ও মূল্যস্ফীতির মতো বিষয়গুলো বিশ্বায়নের ওপর থেকে মানুষের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে এবং এর ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যিক নীতি নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলোর মধ্যে মতানৈক্য বাড়ছে। গত মাসেও সংস্থাটি সতর্ক করেছিল যে, বৈশ্বিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যদি একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করা যায় তবে তা বিশ্ব অর্থনীতিকে বিভক্ত করে ফেলবে এবং বৈশ্বিক আয় ৫ শতাংশ কমে যাবে।

২০১৮ সালের দিকে বিশ্বজুড়ে আমদানি নীতি শিথিল হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় এসে চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি কমে আসে, কিন্তু অন্য দেশগুলোও জবাবে পাল্টা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেয়। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে বিশ্বে গড়ে ২১টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতো। কিন্তু ২০২২ সালেই এককভাবে ১৩৯টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর অধিকাংশই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো।

এই বিষয়গুলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। যেমন, পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করেছে এবং প্রযুক্তি খাতে উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকি দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রও আলাদাভাবে মূল্যস্ফীতি হ্রাসে আইন করেছে, উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, চীনে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্ব উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

সব মিলিয়ে একপক্ষীয় সিদ্ধান্তের কারণে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ক্রমেই তার প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। এ বিষয়ে সিঙ্গাপুরভিত্তিক থিংক ট্যাংক হাইনরিখ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো কেইথ রকওয়েল বলেন, ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা দিনে দিনে অপ্রাসঙ্গিক এক ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে।’

রকওয়েলের মতে, নীতির প্রশ্নে মানুষ এখন আর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বাধ্যবাধকতার প্রতি খুব বেশি অনুগত থাকার প্রয়োজন বলে মনে করছে না। তবে মাত্র এক দশক আগেও এমন ছিল না। তাঁর মতে, ওয়াশিংটনের কারণেই নিয়মভিত্তিক যে বাণিজ্যিক ব্যবস্থা ছিল তা এখন আর নজরে নেই। 

তার বদলে দেশগুলো এখন নিজস্ব স্বার্থে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মকে ব্যবহার করছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র এই সংস্থার নিয়ম ব্যবহার করে ধাতু আমদানি কমিয়ে দিয়েছে এবং বিভিন্ন উপসাগরীয় দেশ যেমন—কাতারের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করেছে। চীনও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধাতব পদার্থ রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। বিপরীতে টেক দুনিয়ায় চীনের প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে যুক্তরাষ্ট্র। ‘জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে’ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করতে হচ্ছে। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে, সংস্থার সব সদস্যই এক বাক্যে স্বীকার করছে যে, সংস্থার সংস্কার দরকার। কিন্তু বিষয়টি চাইলেই কি সম্ভব? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সংস্থার আপিল বিভাগ সংক্রান্ত কোনো পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্র খুব সহজেই মানতে চাইবে না। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, তথ্য প্রবাহ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সময়ে এসে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংস্থাটি কীভাবে খাপ খাইয়ে নেবে তাও ভাবার বিষয় রয়েছে। 

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ১৩তম মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সংস্কারের বিষয়টি আলোচিত হতে পারে। তবে বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্নমত থাকতে পারে। বিশেষ করে, বিগত কয়েক বছর ধরেই বাইডেন প্রশাসন বিশ্বাস করে আসছে যে, বিশ্ব বাণিজ্যের উদারীকরণ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পক্ষে যায়নি। ২০২৪ সালের দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে মার্কিন জনমানসেও বিষয়টি বদ্ধমূল হতে পারে। 

এই অবস্থায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি-নির্ধারকদের আবেদন হলো—পুনর্বিশ্বায়নের মাধ্যমে বিশ্বকে আবারও একই সুতোয় গাঁথার বা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে। বিশেষ জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ইত্যাদি ইস্যুতে এই বিষয়টি খুবই জরুরি।

এ বিষয়ে ডব্লিউটিওর মহাসচিব এনগোজি ওকোঞ্জো-ওয়েইলা বলেন, ‘আমরা একটি বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে গেছি এবং নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থার পরিবর্তে আমরা ক্ষমতাকেন্দ্রিক একটি ব্যবস্থার অংশ হয়ে গেছি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল: আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

জ্বালানি তেল প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল সোমবার দুদকের উপপরিচালক (মানি লন্ডারিং) মো. জাহাঙ্গীর আলম মামলাটি করেন।

মামলার আসামিরা হলেন এসএওসিএলের কর্মকর্তা (এইচআর) আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৭), উপব্যবস্থাপক (হিসাব) ও ডিপো ইনচার্জ মোহাম্মদ মাহমুদুল হক (৪৫), গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন গিয়াস (৪৬), আজহার টেলিকমের স্বত্বাধিকারী মো. সোহেল রানা (৪৪) এবং মেসার্স মদিনা কোয়ালিটির স্বত্বাধিকারী মো. মাসুদ মিয়া (৫১)।

দুদক চট্টগ্রামের উপপরিচালক সুবেল আহমেদ বলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের হিসাব থেকে প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বিভিন্নভাবে স্থানান্তর ও আত্মসাৎ করেন।

এজাহার থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসএওসিএলের এলসি-সংক্রান্ত লেনদেনের নামে প্রকৃত সরবরাহকারীর পরিবর্তে ভুয়া ও সম্পর্কহীন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চেক ইস্যু করার বিষয় দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে। পরে এসব চেকের অর্থ বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর কিংবা নগদে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো এলসি খোলা হয়নি এবং লেনদেনগুলো কোম্পানির জেভি-০৮ ও জেনারেল লেজারে অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাঁচটি চেকের মধ্যে তিনটির অর্থ গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজ, আজহার টেলিকম ও মদিনা কোয়ালিটির অ্যাকাউন্টে জমা হয় এবং বাকি দুটি চেকের অর্থ নগদে উত্তোলন করা হয়। চেক জমাদানকারী হিসেবে বারবার আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাম পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট পেমেন্ট ভাউচারে নিরীক্ষা বিভাগের স্বাক্ষর না থাকাও অনিয়মের প্রমাণ হিসেবে উঠে এসেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

গতকাল রোববার (২৮ ডিসেম্বর) ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারে আয়োজিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মুফতি ছাঈদ আহমাদ।

সভায় উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. ওমর ফারুক খাঁন এবং শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সদস্যসচিব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ। এ ছাড়া কাউন্সিলের অন্য সদস্যবৃন্দ সভায় অংশগ্রহণ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যশোরের খেজুর রস: লক্ষ্য ১২০ কোটি টাকার গুড় উৎপাদন

জাহিদ হাসান, যশোর
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

শীতের রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই যশোরের গ্রামাঞ্চলে শুরু হয় ব্যস্ততা। খেজুরগাছের নিচে হাজির হন গাছিরা। আগের বিকেলে কাটা গাছের ‘চোখ’ বেয়ে সারা রাত মাটির হাঁড়িতে জমেছে সুমিষ্ট খেজুর রস। ভোরে সেই রস নামিয়ে শুরু হয় আরেক কর্মযজ্ঞ; চুলায় জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজ। বাড়ির নারীরাই মূলত এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন। কয়েক ঘণ্টা জ্বালানোর পর তৈরি হয় সুস্বাদু খেজুর গুড় ও পাটালি।

শীত মৌসুম এলেই এমন দৃশ্য দেখা যায় খেজুর গুড়ের জেলা খ্যাত যশোরের প্রায় প্রতিটি গ্রামে। সম্প্রতি যশোরের খেজুর গুড় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় এর ঐতিহ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও নতুন করে সামনে এসেছে।

উৎপাদন ও বাজারের চিত্র

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে যশোরে প্রায় ১২০ কোটি টাকার খেজুর রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল করবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

বর্তমানে খেজুরের কাঁচা রস প্রতি মাটির হাঁড়ি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, দানা গুড় প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা এবং পাটালি প্রতি কেজি ৪৫০-৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারদর বাড়লেও গাছিরা বলছেন, শ্রম ও ঝুঁকির তুলনায় লাভ সীমিত।

গাছির সংকট বড় চ্যালেঞ্জ

যশোর সদর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের গাছি আজিবর প্রায় ৩৫ বছর ধরে খেজুর গাছ কাটছেন। তিনি বলেন, ‘আগে দেড় শ গাছ কাটতাম, এখন বয়সের কারণে ৩৫-৪০টার বেশি পারি না। রস ও গুড়ের দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু কাটার মতো গাছ কমে গেছে। আবার গাছ থাকলেও দক্ষ গাছির অভাব। এবার বেশি শীত পড়ায় রসও ভালো নামছে, গুড়ের উৎপাদনও বেশি।’

গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

মনিরামপুর উপজেলার সরসকাটি গ্রামের গাছি অতিয়ারও প্রায় ৪০ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত। তিনি বলেন, এবার ৫০টা গাছ কাটছি। প্রতিদিন ৮-১০ কেজি গুড় তৈরি হয়। কাজটা খুব কষ্টের। তবে শীত মৌসুমে এই আয়েই পুরো বছরের সংসার চলে।

ই-কমার্সে বাড়ছে চাহিদা

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, যশোর জেলায় মোট খেজুরগাছের সংখ্যা ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫। এগুলোর মধ্যে চলতি মৌসুমে রস আহরণের উপযোগী গাছ রয়েছে ৩ লাখ ৭ হাজার ১৩০টি।

উৎপাদিত গুড় প্রথমে স্থানীয় হাটে বিক্রি হয়, পরে পাইকারদের মাধ্যমে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। যশোরের খেজুর গুড় এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। পাশাপাশি ই-কমার্স ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক উদ্যোক্তাদের হাত ধরে গুড় ও পাটালি সরাসরি ভোক্তার ঘরে পৌঁছানো হচ্ছে। এতে বাজার যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান।

কৃষি বিভাগের উদ্যোগ

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, যশোরের খেজুর গুড়ের স্বাদ ও মানের কারণে চাহিদা সব সময় বেশি। এবার শীত বেশি হওয়ায় রসের পরিমাণ ও মান—দুটোই ভালো। চলতি মৌসুমে প্রায় ১২০ কোটি টাকার রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নিরাপদ খেজুর রস এবং গুড় উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গাছিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামি ১০ ও সরকারি ৬ ব্যাংক: ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা 
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২৭
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা

দেশের ব্যাংকিং খাতের ভেতরে জমে থাকা অনিয়ম, রাজনৈতিক আশ্রয় ও কৃত্রিম হিসাবের পর্দা চলতি বছর যেন একে একে সরে যেতে শুরু করেছে। আর তাতেই সামনে এসেছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। সরকারি ও শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের ভারে এখন কার্যত দিশেহারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশে, আর ইসলামি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা আরও বেশি—৫৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, এই দুটি খাতেই বিতরণ করা ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। যেখানে বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপির হার ৪১ দশমিক ৯৫ ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপির হার মাত্র ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শরিয়াহভিত্তিক ১০টি ইসলামি ব্যাংক মোট ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ঋণ বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, প্রতি ১০ টাকার প্রায় ৬ টাকাই এখন আদায় অনিশ্চিত। সেই তুলনায় শরিয়াহসহ দেশীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এই তুলনাতেই স্পষ্ট, খেলাপির বোঝা এককভাবে সবচেয়ে বেশি ইসলামি ব্যাংকগুলোর ঘাড়েই।

সরকারি ছয় ব্যাংকের অবস্থাও খুব একটা ভিন্ন নয়। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় অর্ধেকই সেখানে অনাদায়ি। ব্যাংকার ও বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট রাতারাতি তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে দুর্বল তদারকি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে আড়াল করার প্রবণতা ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলোকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, খেলাপি ঋণের এত উচ্চ হার শুধু ব্যাংকিং খাতের ভেতরের সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি। ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে পারছে না, বিনিয়োগ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে, শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ থেমে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। তাঁর মতে, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ঋণ আদায়ে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।

ইসলামি ব্যাংকিং খাতে এস আলম, নাসা ও বেক্সিমকো গ্রুপের নাম বারবার আলোচনায় এসেছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন সরকারি মদদে এসব গ্রুপ বিপুল ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। এখন সেই বাস্তবতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতের চিত্র আরও উদ্বেগজনক। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর যে অপচেষ্টা ছিল, তা এখন ভেঙে পড়েছে। সঠিক হিসাব সামনে আসায় হার ৩৬ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা বাস্তবতারই প্রতিফলন। তিনি আবারও শীর্ষ ১০ খেলাপির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, আগের সরকারের আমলে লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ প্রকাশ পাওয়ায় এই হার বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ঋণ আদায়ে কঠোর নির্দেশনার কারণে আগের তুলনায় আদায় বেড়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত