Ajker Patrika

বিমার ৪৩৭৫ কোটি টাকা দিচ্ছে না ৩২ কোম্পানি

  • ৫ কোম্পানির কাছে পাওনা ৮০ ভাগ টাকা।
  • শেষ ৩ মাসে গ্রাহকের পাওনা বেড়েছে ১ হাজার কোটি।
  • বিমার টাকা না দেওয়ার শীর্ষে আ.লীগসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও নেতাদের কোম্পানি।
মাহফুজুল ইসলাম, ঢাকা
আপডেট : ১৩ মে ২০২৫, ১৩: ১২
বিমার ৪৩৭৫ কোটি টাকা দিচ্ছে না ৩২ কোম্পানি

বিমা করেছেন, কিস্তি দিয়েছেন নিয়মিত, কিন্তু টাকা ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহক—দেশের জীবনবিমা খাতে এ রকম ঘটনা যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ৩২টি জীবনবিমা কোম্পানির কাছে গ্রাহকের আটকে থাকা টাকার পরিমাণ অন্তত ৪ হাজার ৩৭৫ কোটি। বিমার টাকা আদায়ে প্রতিদিনই এসব কোম্পানির অফিসে ধরনা দিচ্ছেন গ্রাহক। অনেকে চার-পাঁচ বছর ঘুরেও টাকা আদায় করতে পারছেন না।

বিমা মেয়াদ শেষ হওয়ার ১০ বছর পেরিয়ে গেলে এখন পর্যন্ত টাকা পাচ্ছেন না বাগেরহাটের আশিকুর রহমান আশিক। মোরেলগঞ্জ থেকে রাজধানীর বিজয়নগরে বায়রা লাইফ ইনস্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয়ে বিমার টাকা চাইতে আসা আশিক বলেন, ‘এজেন্ট ও কোম্পানির কর্মকর্তারা বলেছিলেন ৫০ হাজার টাকার বিমা করলে ১ লাখ টাকা পাব। লাভ তো পেলামই না, মামলা করার পরও মূল টাকা ফেরত পাচ্ছি না।’ তিনি জানান, ২০০৫ সালে করা বিমার মেয়াদ শেষ হয় ২০১০ সালে। এরপর থেকেই বিমা দাবি নিয়ে তিনি ঘুরছেন বায়রা লাইফের স্থানীয় ও প্রধান কার্যালয়ে। টাকার জন্য এ নিয়ে ২১ বার রাজধানীতে এসেছেন তিনি। বায়রা লাইফ টাকা না দেওয়ায় আইডিআরএ, এমনকি আদালত পর্যন্ত গেছেন; কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।

আশিকের মতোই বিমার টাকার জন্য ৯ বছর ধরে ঘুরছেন কুড়িগ্রামের রিকশাচালক সুজন খন্দকার। আর চার বছর ধরে সব ধরনের চেষ্টা করেও বিমার টাকা পাননি বগুড়ার মুহতাদিয়া বানু।

বিমা আইন ২০১০ অনুসারে, পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের কাছে সব কাগজপত্র জমা দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে বিমা দাবি নিষ্পত্তি করতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ বিমা কোম্পানি এ নিয়ম মানছে না।

আইডিআরএর তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন বিমা কোম্পানিতে গ্রাহকদের বকেয়া বিমা দাবি ছিল প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।

এরপরের তিন মাসেই তা থেকে বেড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোপাট ও স্বজনপ্রীতির কারণে অর্থ সংকটে পড়ে গ্রাহকের টাকা নিয়ে গড়িমসি করছে কোম্পানিগুলো।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, সময়মতো বিমার টাকা পরিশোধ না করা বিমা খাতের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। ফলে মানুষ বিমা খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আর এ কারণে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

আইডিআরএর সর্বশেষ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জীবনবিমা খাতে গ্রাহকের অপরিশোধিত অর্থের ৮০ ভাগই আটকে রেখেছে ৫টি বিমা কোম্পানি। বিমা দাবি পরিশোধে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে সানফ্লাওয়ার লাইফ ইনস্যুরেন্স। বিকল্পধারার সাবেক মহাসচিব মেজর (অব.) আব্দুল মান্নানের এই প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকদের পাওনা ৫৯৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। কোম্পানিটি বিমা দাবির ৯৭ দশমিক ৮৭ শতাংশই পরিশোধ করেনি। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাঁরা বলেন, ‘যা বলার আইডিআরএকে বলেছি।’

৯৫ দশমিক ৫১ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ না করায় গ্রাহকের টাকা আটকে রাখার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে এস আলম গ্রুপের পদ্মা ইসলামী লাইফ। প্রতিষ্ঠানটির কাছে গ্রাহকের পাওনা ২৬১ কোটি টাকা। এ ছাড়া ফারইস্ট ইসলামী লাইফ গ্রাহকের ২ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা আটকে রেখেছে, যা প্রতিষ্ঠানটির মোট বিমা দাবির ৯৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। ফারইস্ট ইসলামী লাইফে এস আলমের পাশাপাশি ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে সালমান এফ রহমানের।

বিষয়টি নিয়ে জানতে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের ভারপ্রাপ্ত সিইও শহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘গত ১০-১২ বছরে কোম্পানির প্রায় ৩২০০ কোটি টাকা লুট হয়েছে। ফলে হাতে নগদ টাকা নেই। গ্রাহকের টাকা পরিশোধে গুলশান ও ফেনীতে সম্পদ বিক্রির পরিকল্পনা রয়েছে।’

যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ আবুল বাসারের বায়রা লাইফে গ্রাহকের বিমা দাবির ৯২ দশমিক ৫৮ শতাংশই বকেয়া, যা টাকার অঙ্কে ৮৩ কোটি। এ ছাড়া ৮২ দশমিক ৩২ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ না করে পঞ্চম স্থানে রয়েছে প্রগ্রেসিভ লাইভ ইনস্যুরেন্স। প্রতিষ্ঠানটির কাছে গ্রাহকের বকেয়ার পরিমাণ ২০১ কোটি টাকা।

বায়রা লাইফের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মামুন খান বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে বড় অংশের দাবি পরিশোধ করতে পারব। মালিবাগে কোম্পানির জমি বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে।’

৭৩ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ করেনি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পারিবারিক কোম্পানি সানলাইফ ইনস্যুরেন্স। এ ছাড়া এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেডিসেন্ট জসিম উদ্দিনের মালিকানাধীন কোম্পানি বেঙ্গল ইসলামী লাইফ ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ, প্রয়াত ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্নার ডায়মন্ড লাইফ ৩৩ শতাংশ এবং সরকারি জীবনবিমা কোম্পানি ১৪ শতাংশ দাবি পরিশোধ করেনি।

একইভাবে এস আলম গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান প্রাইম ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স ১০ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মোরশেদ আলমের ন্যাশনাল লাইফ গ্রাহকদের ৮ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ করেনি।

প্রাইম ইসলামী লাইফের সিইও সামসুল আলম বলেন, ‘৩০৬ কোটি টাকা দাবির কথাটি সঠিক নয়, বকেয়া বিমা দাবির পরিমাণ ৩৮ কোটি টাকা। তিনি আরও বলেন, কোম্পানির ফ্ল্যাট-প্লট রয়েছে, তা বিক্রি করে বিমার টাকা দেওয়া শুরু করেছি।’

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এক দশক আগেও দেশের জিডিপিতে বিমা খাতের অবদান ছিল প্রায় ১ শতাংশ, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ০.৪৫ শতাংশে। অর্থাৎ বিমা খাত বিস্তারের বিপরীতে আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। আস্থা হারানোর প্রধান সমস্যা বিমা দাবি পরিশোধ না করা। অনিষ্পন্ন দাবির অঙ্ক বাড়ায়, আর্থিক শৃঙ্খলার জন্য উদ্বেগজনক।

প্রগতি লাইফ ইনস্যুরেন্সের সিইও জালালুল আজিম বলেন, বিমা দাবির টাকা ফেরত না পাওয়ার কারণে জনগণের আস্থা হারাচ্ছে। ফলে খাতটি দেশের অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারছে না।

তবে সংকটের মধ্যেও কিছু কোম্পানি আছে, যারা ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত বিমা দাবি পরিশোধ করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ, চার্টার্ড লাইফ, সোনালী লাইফ, মার্কেন্টাইল, সন্ধানী, মেঘনা ও রূপালী লাইফ ইনস্যুরেন্স।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিআরএর চেয়ারম্যান আসলাম আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কয়েকটি কোম্পানির অনিয়ম পুরো বিমা খাতের ওপর প্রভাব ফেলছে। আমরা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বসে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেছি। সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাসিনা শেখ আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিমা কোম্পানিগুলোর দাবি পরিশোধে আইডিআরএকে আরও কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে তাদের ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল করে দিতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় বাড়ল আরও এক মাস

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ৪৩
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় বাড়ল আরও এক মাস

অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময়সীমা দ্বিতীয় দফায় আরও এক মাস বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, করদাতারা কোনো জরিমানা ছাড়াই আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ই-রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। এর আগে দুই দফা সময় বাড়িয়ে শেষ সময় নির্ধারিত ছিল ৩১ ডিসেম্বর।

আজ রোববার এনবিআরের সচিব মো. একরামুল হক স্বাক্ষরিত এক জরুরি আদেশে এই সময়সীমা বাড়ানোর কথা জানানো হয়েছে। এনবিআর সূত্র বলছে, মূলত করদাতাদের সুবিধার্থে এবং অনলাইন সিস্টেমে চাপ সামলাতে এই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যেহেতু চলতি বছর থেকে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তাই অনেক নতুন ব্যবহারকারী কারিগরি সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিলেন। সেই জটিলতা নিরসনেই এই বাড়তি সময় দেওয়া হলো।

সময় বাড়ানোর আগে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘আমরা প্রথমবারের মতো অনলাইন ব্যবস্থাকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করেছি। এটি একটি বড় ধরনের সংস্কার। আমরা চাই না কোনো করদাতা পদ্ধতিগত কারণে ঝামেলার মুখে পড়ুক। সরকার করদাতাদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করেই এই সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, যাঁরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দেবেন না, তাঁদের ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী বিলম্ব জরিমানা আরোপ হতে পারে।

এনবিআরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ডিজিটাল কর ব্যবস্থার প্রতি জনগণের ব্যাপক সাড়া মিলেছে। এ পর্যন্ত ২৬ লাখের বেশি করদাতা সফলভাবে তাঁদের ই-রিটার্ন জমা দিয়েছেন। গত আগস্ট থেকে সরকারি কর্মকর্তা, বড় কোম্পানি এবং নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণির করদাতার জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করার পর থেকেই ই-রিটার্ন পোর্টালে ট্রাফিক বৃদ্ধি পায়।

ডিজিটাল পদ্ধতিতে করদাতারা ঘরে বসেই যেকোনো সময় রিটার্ন সাবমিট করতে পারবেন। রিটার্ন দাখিলের পর তাৎক্ষণিকভাবে প্রাপ্তি স্বীকারপত্র (Acknowledgment) এবং ট্যাক্স সার্টিফিকেট ডাউনলোড করা যাবে। বিকাশ, নগদ বা রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে কর পরিশোধের সুযোগ রয়েছে।

যেকোনো যান্ত্রিক ত্রুটি বা আইনি জটিলতা এড়াতে করদাতাদের সহায়তার জন্য এনবিআর একটি কল সেন্টারও চালু রেখেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তুলা গবেষণা কেন্দ্রের ফুটি কার্পাসে নতুন সম্ভাবনা

রাতুল মণ্ডল, শ্রীপুর (গাজীপুর)  
বাংলার ঐতিহ্য মসলিনের প্রধান কাঁচামাল ফুটি কার্পাস তুলাগাছে ফুল ফুটেছে। গাজীপুরের শ্রীপুর তুলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
বাংলার ঐতিহ্য মসলিনের প্রধান কাঁচামাল ফুটি কার্পাস তুলাগাছে ফুল ফুটেছে। গাজীপুরের শ্রীপুর তুলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

একসময় বিশ্বজুড়ে বাংলার গর্ব ছিল মসলিন। এর অতুলনীয় সূক্ষ্মতা, মসৃণতা ও আরামদায়ক বৈশিষ্ট্যের কারণে রাজা-বাদশাহ থেকে ইউরোপীয় অভিজাত শ্রেণির কাছে মসলিন ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। মসলিনের প্রাণ ফুটি কার্পাস তুলা ইংরেজ শাসনামলে ঔপনিবেশিক বাণিজ্যনীতির বলি হয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। দীর্ঘ বছর পর সে হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে গাজীপুরের শ্রীপুর তুলা গবেষণা কেন্দ্র।

ফুটি কার্পাসের পুনর্জাগরণকে ঘিরে গবেষক, ঐতিহ্য অনুরাগী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নতুন উদ্দীপনা। এটি শুধু একটি বিপন্ন উদ্ভিদের পুনরুদ্ধার নয়; বরং বাংলার হারানো শিল্প-ঐতিহ্য ও সম্ভাব্য উচ্চমূল্যের টেক্সটাইল খাত পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা।

শ্রীপুর তুলা গবেষণা কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড এবং গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে গবেষণা কার্যক্রম চালাচ্ছে। গবেষণার মূল লক্ষ্য—ফুটি কার্পাস তুলা কীভাবে বাণিজ্যিকভাবে চাষযোগ্য করা যায়, উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে সাধারণ মানুষের নাগালে আনা যায় এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে মসলিনকে আবার পরিচিত করা যায়। গবেষকদের প্রত্যাশা, সঠিক নীতিগত সহায়তা ও বিনিয়োগ পেলে আগামী দিনে মসলিন আবার বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পরিচয় বহন করবে।

সম্প্রতি তুলা গবেষণা কেন্দ্র পরিদর্শনে দেখা যায়, সারি সারি ফুটি কার্পাস তুলাগাছ। প্রায় সব গাছেই প্রচুর ফুল এসেছে, যেগুলোর অনেক ফলেও পরিণত হয়েছে। গবেষকদের তথ্যমতে, পুনরুদ্ধার করা ফুটি কার্পাস গাছের উচ্চতা ১৩ থেকে ১৪ ফুট পর্যন্ত। বীজের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি হলেও আঁশ সূক্ষ্ম ও স্বল্প, যা মসলিন তৈরির জন্য উপযোগী।

তুলা গবেষণা কেন্দ্রের ইনচার্জ আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ফুটি কার্পাসের অস্তিত্বের সূত্র প্রথম পাওয়া যায় দৃক গ্যালারি ও জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে। সাংস্কৃতিককর্মী সাইফুল ইসলাম এর খোঁজ পান। কার্পাস তুলা থেকেই ‘কাপাসিয়া’ নামের উৎপত্তি।

ব্রিটিশ আলবার্ট মিউজিয়ামে সংরক্ষিত মোগল আমলের মসলিন শাড়ির অংশবিশেষ পরীক্ষা করে গবেষকেরা নিশ্চিত হয়েছেন, সে সময়ে ফুটি কার্পাস থেকেই এসব বস্ত্র তৈরি হতো। ইতিহাস বলছে, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে এই তুলার চাষ হতো এবং ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে মসলিন রপ্তানি করা হতো।

তুলা গবেষণা কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল আমিন বলেন, ‘ফুটি কার্পাস শুধু একটি তুলা নয়, এটি বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক। ইংরেজ শাসনামলে নিজস্ব শিল্প রক্ষার জন্য ব্রিটিশরা পরিকল্পিতভাবে মসলিনশিল্প ধ্বংস করেছিল। আমরা এখন সে হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

১ জানুয়ারি কার্যকর: দেশের সব স্থলবন্দরের মাশুল বাড়ল ৫ শতাংশ

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
১ জানুয়ারি কার্যকর: দেশের সব স্থলবন্দরের মাশুল বাড়ল ৫ শতাংশ

দেশের সব স্থলবন্দরের মাশুল ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। সব ধরনের সেবা, কর ও টোলহারের ক্ষেত্রে এই বর্ধিত মাশুল প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বলেছে, এই মাশুলই বন্দরের আয়ের প্রধান উৎস। প্রতিবছরের মতো এবারও মাশুল বাড়ানো হয়েছে, যা আগামী ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। তবে অন্যান্য বন্দরের তুলনায় মাশুল বেশি হওয়ায় বেনাপোল স্থলবন্দরের জন্য বর্ধিত মাশুলের আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

বেনাপোল বন্দরে যাত্রীদের জন্য ২০২৫ সালের মাশুল ছিল ৪৯ টাকা ৭৯ পয়সা, যা ২০২৬ সালে বেড়ে ৫২ টাকা ২৭ পয়সা হয়েছে। আমদানি করা বাস, ট্রাক ও লরির মাশুল নতুন বছরে ১৮৪ টাকা ৭০ পয়সা, যা আগের তুলনায় প্রায় ৯ টাকা বেশি। মোটর কার, জিপ ও পিকআপের জন্য এখন নতুন মাশুল ১১০ টাকা ৮২ পয়সা এবং মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেলের জন্য ৩৬ টাকা ৯৫ পয়সা।

বেনাপোল বন্দরে ট্রাক ও লরির জন্য ওজন মাপার যন্ত্র ব্যবহার করতে হলে ৮৮ টাকা ৬৫ পয়সা দিতে হবে। কাগজপত্র প্রক্রিয়ার মাশুল এখন ১৯৫ টাকা ০৭ পয়সা। কোনো যানবাহন যদি রাতভর বন্দরে থাকে, তবে মাশুল ১১১ টাকা ৪৯ পয়সা। গুদামে পণ্য রাখার মাশুলও পণ্যের সময় অনুযায়ী বাড়ানো হয়েছে।

বেনাপোল ছাড়াও অন্যান্য স্থলবন্দরে মাশুল ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য বন্দরে যাত্রীদের মাশুল ২০২৫ সালে ৪৯ টাকা ৭৯ পয়সা ছিল, যা ২০২৬ সালে বেড়ে ৫২ টাকা ২৭ পয়সা হয়েছে। আমদানি করা বাস, ট্রাক ও লরির জন্য নতুন মাশুল ১৫৯ টাকা ২২ পয়সা, মোটর কার ও জিপের জন্য ৯৫ টাকা ৫২ পয়সা এবং মোটরসাইকেল, স্কুটার ও থ্রি-হুইলারের জন্য ৪৭ টাকা ৮৩ পয়সা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর: ফসল ব্যবস্থাপনায় উত্তরের চার জেলায় কৃষির নতুন প্রকল্প

  • ২৫২ কোটির প্রকল্পে বিতরণ হবে ৩,১৮৫টি কৃষি যন্ত্রপাতি
  • উৎপাদন ৫% বৃদ্ধি ও শস্য নিবিড়তা ২৪১ শতাংশে উন্নীত হবে
  • ২০০টি পেঁয়াজ ও ৩টি সবজির সংরক্ষণাগার স্থাপন
মাহফুজুল ইসলাম, ঢাকা
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

দেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষি খাতে টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের ২৫২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। চার বছরের এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য প্রকল্পের আওতাধীন চার জেলায় আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ কমানো এবং কৃষিকে আরও লাভজনক পেশায় রূপান্তর করা।

বগুড়া কৃষি অঞ্চলের টেকসই উন্নয়ন নামের এই প্রকল্প ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০৩০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় বাস্তবায়িত হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে এবং পুরো ব্যয়ভার বহন করবে সরকার। আধুনিক ফসল ব্যবস্থাপনা, পানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তি এবং কৃষকের দক্ষতা উন্নয়ন—এসবের সমন্বয়ে প্রকল্পের কাঠামো তৈরি হয়েছে।

ডিএই মহাপরিচালক এস এম সোহরাব উদ্দিন বলেন, যমুনা-করতোয়া-পদ্মা-বাঙ্গালীবিধৌত বগুড়া অঞ্চলের কৃষি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, কম বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বন্যা ও নদীভাঙন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে আবাদি জমি কমছে। অপর দিকে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে। সার্বিক বাস্তবতা বিবেচনায় এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) প্রকল্পসংশ্লিষ্ট নথিপত্রে দাবি করা হয়েছে, আধুনিক ফসল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদন ৫ শতাংশ বাড়ানোর পাশাপাশি শস্য নিবিড়তা ২৩৬ শতাংশ থেকে ২৪১ শতাংশে উন্নীত করা হবে। এক হাজার নতুন দক্ষ কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি এবং ৩৫ হাজার কৃষি মানবসম্পদকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়ে উৎপাদন ব্যয় কমানোও প্রকল্পের লক্ষ্য।

এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে থাকছে বগুড়ায় উপপরিচালকের কার্যালয় ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণ, ২০০টি পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার, তিনটি আধুনিক ফল-সবজি ও কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার স্থাপন এবং ৩ হাজার ১৮৫টি কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ। কৃষকদের জন্য মোট ৪ হাজার ৮৪০ ব্যাচ প্রশিক্ষণ আয়োজনের পাশাপাশি ৪১ হাজারের বেশি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রদর্শনী এবং ৭০০টি মাঠ দিবস ও কারিগরি আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনাসচিব এস এম শাকিল আখতার আজকের পত্রিকাকে বলেন, টেকসই কৃষি উন্নয়নের স্বার্থে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। তবে নির্ধারিত কর্মসূচি মাঠপর্যায়ে কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয় কি না, সেটাই প্রকল্পের সাফল্য নির্ধারণ করবে।

একই বিষয়ে কৃষিসচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান আজকের পত্রিকাকে জানান, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার আবাদি জমির সঠিক ফসল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে। উৎপাদিত ফসলের সংরক্ষণব্যবস্থা উন্নত হলে কৃষকের ক্ষতি কমবে এবং আয়ের সুযোগ বাড়বে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত