Ajker Patrika

ক্রেডিট কার্ড নিয়ে বিশেষ আয়োজন

কার্ডেই লেনদেনের সহজ সমাধান

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা 
আপডেট : ২০ মার্চ ২০২৫, ১৫: ৪৫
কার্ডেই লেনদেনের সহজ সমাধান

ক্রেডিট কার্ড—আপাতদৃষ্টে নেহাত চৌকো এক টুকরো প্লাস্টিক; অথচ জীবনযাত্রাকে বদলে দিয়েছে ব্যাপকভাবে। নগদ অর্থ বহনের ঝামেলা এড়িয়ে দ্রুত ও নিরাপদ লেনদেনের সুবিধা দেয় ক্রেডিট কার্ড। জরুরি প্রয়োজনের সময় নির্দিষ্ট অঙ্কের নগদ অর্থ তুলে দেয় হাতে। ক্রেডিট কার্ড শুধু দৈনন্দিন কেনাকাটায় ব্যবহৃত হচ্ছে না; বিল পরিশোধ, দেশ-বিদেশে অনলাইন পেমেন্ট, কিস্তিতে কেনা বা বিভিন্ন ছাড়ের সুবিধা পাওয়ার কাজেও লাগছে। সব মিলিয়ে এ সময়ের মানুষের খরচের অভ্যাস, আর্থিক ব্যবস্থাপনাসহ জীবনধারায় পরিবর্তন এনেছে এটি। এ বাস্তবতায় ক্রেডিট কার্ড এখন আর বিলাসিতা নয়। উচ্চবিত্ত তো বটেই, সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্যও তা হয়ে উঠছে এক অপরিহার্য আর্থিক হাতিয়ার। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও তা ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রথম ক্রেডিট কার্ড চালু হয় ১৯৫০ সালে। আর বাংলাদেশে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্রেডিট কার্ড চালু করে। এরপর বিভিন্ন ব্যাংক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কার্ড সেবা নিয়ে আসে। এসব কার্ডের মধ্যে ভিসা, মাস্টারকার্ড, আমেরিকান এক্সপ্রেস, ডিসকভার, জেবিসি ও ইউনিয়ন পে উল্লেখযোগ্য। পরিসংখ্যান বলছে, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীরা সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেন সুপারমার্কেট ও রিটেইল আউটলেটে।

বর্তমানে দেশে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক ২৭ লাখ। প্রতি মাসে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার লেনদেন করছেন তাঁরা। করোনার পর থেকে ক্রেডিট কার্ডধারীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে—২০২০ সালে যেখানে এটি ছিল ১৫ লাখ ২৪ হাজার, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ লাখ ৭৪ হাজার ৫১২ জনে। একই সময়ের মধ্যে লেনদেনের অঙ্কও বেড়েছে—২০২০ সালে ১ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা থেকে ২০২৩ সালে ৩ হাজার ৫৩২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান আজকের পত্রিকা’কে বলেন, ‘ক্রেডিট কার্ড নগদ টাকার বিকল্প হিসেবে ব্যাপকভাবে গৃহীত হচ্ছে। এটি শুধু জীবনকে সহজ করছে না, বরং অর্থনীতিকেও ডিজিটাল কাঠামোর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’

ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ডের বাজার আরও সম্প্রসারণ করতে সচেষ্ট। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের কার্ড বিভাগের প্রধান আনোয়ার হোসেনের মতে, গ্রাহকদের সচেতনতা বাড়লে ও নীতিমালা কিছুটা শিথিল করা হলে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার আরও বাড়বে। বর্তমানে প্রতি মাসে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার লেনদেন কিস্তিতে হয়, যেখানে ৭০ শতাংশ গ্রাহক নিয়মিত বিল পরিশোধ করেন। ক্রেডিট কার্ডে ব্যয়িত অর্থ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করলে ৪৫ থেকে ৫৫ দিন পর্যন্ত সুদমুক্ত সুবিধা পাওয়া যায়।

নগদ টাকার বিকল্প, অনেক সুবিধা

ক্রেডিট কার্ড ধীরে ধীরে নগদ টাকার বিকল্প হয়ে উঠছে; বিশেষ করে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এর ব্যবহারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বর্তমানে ৪০টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই সেবা দিচ্ছে। দেশজুড়ে ৫০ হাজার পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস) ও ১৩ হাজার এটিএম বুথে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা সম্ভব। ফলে এখন বহু ক্ষেত্রে নগদ অর্থ বহনের ঝামেলা ছাড়া লেনদেন করা যাচ্ছে। নিরাপত্তার দিক থেকে চিন্তা করলে এটি এক বিরাট সুবিধা। আন্তর্জাতিক লেনদেন ও অনলাইন কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ড দিচ্ছে ক্যাশব্যাক, ডিসকাউন্ট ও রিওয়ার্ড পয়েন্টের সুবিধা। পাশাপাশি সুদমুক্ত সময় ও কিস্তিতে পরিশোধের সুবিধা এটিকে আরও জনপ্রিয় করে তুলছে। নগদহীন লেনদেনের আরেকটি দিক হলো ব্যবহারকারীর অভ্যাসের পরিবর্তন। এর ফলে ডিজিটাল ওয়ালেটে ভার্চুয়াল কার্ড দিয়েও স্মার্টফোনের মাধ্যমে কেনাকাটা করা সম্ভব হচ্ছে। দ্রুত প্রসারমাণ এই ব্যবস্থায় ক্রেডিট ছাড়াও ডেবিট, প্রিপেইড ও অন্যান্য কার্ডেও লেনদেনের সুবিধা রয়েছে, যা ভিসা, মাস্টারকার্ড, আমেরিকান এক্সপ্রেস বা ডিসকভার নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত।

ব্যবহারে যে চ্যালেঞ্জ

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নগদ টাকা যাচ্ছে না ভেবে অতিরিক্ত খরচের প্রবণতা এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিল পরিশোধ না করার কারণে উচ্চ সুদের হার। এসব কারণে কেউ কেউ মনে করেন, ক্রেডিট কার্ড শুধু উচ্চবিত্তদের ব্যাপার। এর ব্যবহারে ঋণের ফাঁদে পড়তে হতে পারে। সুদের হার আগের ২০ শতাংশ থেকে কিছুটা বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। মনে রাখা দরকার, সময়মতো ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ করলে সুদ নেওয়া হয় না। সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনেরা মনে করেন, সচেতন ও পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে ক্রেডিট কার্ডকে একটি কার্যকর আর্থিক টুলে রূপান্তর করা সম্ভব, যা ভোক্তাদের জন্য উপকারী হবে।

বাড়তি নিরাপত্তা

ক্রেডিট কার্ডের অন্যতম বড় সুবিধা হচ্ছে নিরাপত্তা। নগদ টাকার তুলনায় এটি অনেক বেশি নিরাপদ। কারণ, চুরি বা জালিয়াতির ঝুঁকি কম। ব্যাংকগুলোর উন্নত নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে (যেমন চিপযুক্ত কার্ড, ওটিপি ও পিন নম্বর) এতে ঝুঁকিহীন লেনদেন নিশ্চিত করা যায়। কার্ড হারিয়ে গেলে দ্রুত তা বন্ধ করে (ব্লক করা) দেওয়া সম্ভব। এর ফলে জালিয়াতির আশঙ্কা কমে যায়। ডেবিট কার্ডের তুলনায় ক্রেডিট কার্ডের নিরাপত্তাব্যবস্থা বেশি উন্নত।

কীভাবে পাওয়া যায় ক্রেডিট কার্ড

বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ড পেতে হলে কিছু নির্দিষ্ট যোগ্যতা থাকতে হয়। এ জন্য নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করা লাগে। মাসিক আয় ৩০ হাজার টাকা হলে ব্যাংক থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের ক্রেডিট লিমিট পাওয়া যায়। আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংক হিসাব, ট্রেড লাইসেন্স (যদি ব্যবসায়ী হন), বিআইএন ও টিআইএন নম্বর প্রয়োজন হয়। চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে ছয় মাসের চাকরির স্থায়িত্ব দরকার হয়।

ব্যবহারে যে সতর্কতা জরুরি

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিছু সতর্কতা মেনে চলা জরুরি। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতারণা থেকে রক্ষা পেতে শুধু বিশ্বস্ত ওয়েবসাইটে লেনদেন, এইচটিটিপিএস এনক্রিপশন চেক ও টু স্টেপ ভেরিফিকেশন চালু রাখা উচিত। ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) ব্যবহার, পাবলিক ওয়াই-ফাই এড়িয়ে চলা এবং ব্যক্তিগত ও কার্ডের সব তথ্য গোপন রাখা গুরুত্বপূর্ণ। বিল পরিশোধের নির্দিষ্ট তারিখ মেনে চলা, সুদের হার ও ফি সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া অনলাইনে বা মেসেজে সন্দেহজনক কিছু দেখলে দ্রুততম সময়ে ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল: আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪২
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

জ্বালানি তেল প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল সোমবার দুদকের উপপরিচালক (মানি লন্ডারিং) মো. জাহাঙ্গীর আলম মামলাটি করেন।

মামলার আসামিরা হলেন এসএওসিএলের কর্মকর্তা (এইচআর) আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৭), উপব্যবস্থাপক (হিসাব) ও ডিপো ইনচার্জ মোহাম্মদ মাহমুদুল হক (৪৫), গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন গিয়াস (৪৬), আজহার টেলিকমের স্বত্বাধিকারী মো. সোহেল রানা (৪৪) এবং মেসার্স মদিনা কোয়ালিটির স্বত্বাধিকারী মো. মাসুদ মিয়া (৫১)।

দুদক চট্টগ্রামের উপপরিচালক সুবেল আহমেদ বলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের হিসাব থেকে প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বিভিন্নভাবে স্থানান্তর ও আত্মসাৎ করেন।

এজাহার থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসএওসিএলের এলসি-সংক্রান্ত লেনদেনের নামে প্রকৃত সরবরাহকারীর পরিবর্তে ভুয়া ও সম্পর্কহীন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চেক ইস্যু করার বিষয় দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে। পরে এসব চেকের অর্থ বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর কিংবা নগদে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো এলসি খোলা হয়নি এবং লেনদেনগুলো কোম্পানির জেভি-০৮ ও জেনারেল লেজারে অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাঁচটি চেকের মধ্যে তিনটির অর্থ গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজ, আজহার টেলিকম ও মদিনা কোয়ালিটির অ্যাকাউন্টে জমা হয় এবং বাকি দুটি চেকের অর্থ নগদে উত্তোলন করা হয়। চেক জমাদানকারী হিসেবে বারবার আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাম পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট পেমেন্ট ভাউচারে নিরীক্ষা বিভাগের স্বাক্ষর না থাকাও অনিয়মের প্রমাণ হিসেবে উঠে এসেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

গতকাল রোববার (২৮ ডিসেম্বর) ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারে আয়োজিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মুফতি ছাঈদ আহমাদ।

সভায় উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. ওমর ফারুক খাঁন এবং শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সদস্যসচিব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ। এ ছাড়া কাউন্সিলের অন্য সদস্যবৃন্দ সভায় অংশগ্রহণ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যশোরের খেজুর রস: লক্ষ্য ১২০ কোটি টাকার গুড় উৎপাদন

জাহিদ হাসান, যশোর
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

শীতের রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই যশোরের গ্রামাঞ্চলে শুরু হয় ব্যস্ততা। খেজুরগাছের নিচে হাজির হন গাছিরা। আগের বিকেলে কাটা গাছের ‘চোখ’ বেয়ে সারা রাত মাটির হাঁড়িতে জমেছে সুমিষ্ট খেজুর রস। ভোরে সেই রস নামিয়ে শুরু হয় আরেক কর্মযজ্ঞ; চুলায় জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজ। বাড়ির নারীরাই মূলত এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন। কয়েক ঘণ্টা জ্বালানোর পর তৈরি হয় সুস্বাদু খেজুর গুড় ও পাটালি।

শীত মৌসুম এলেই এমন দৃশ্য দেখা যায় খেজুর গুড়ের জেলা খ্যাত যশোরের প্রায় প্রতিটি গ্রামে। সম্প্রতি যশোরের খেজুর গুড় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় এর ঐতিহ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও নতুন করে সামনে এসেছে।

উৎপাদন ও বাজারের চিত্র

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে যশোরে প্রায় ১২০ কোটি টাকার খেজুর রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল করবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

বর্তমানে খেজুরের কাঁচা রস প্রতি মাটির হাঁড়ি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, দানা গুড় প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা এবং পাটালি প্রতি কেজি ৪৫০-৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারদর বাড়লেও গাছিরা বলছেন, শ্রম ও ঝুঁকির তুলনায় লাভ সীমিত।

গাছির সংকট বড় চ্যালেঞ্জ

যশোর সদর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের গাছি আজিবর প্রায় ৩৫ বছর ধরে খেজুর গাছ কাটছেন। তিনি বলেন, ‘আগে দেড় শ গাছ কাটতাম, এখন বয়সের কারণে ৩৫-৪০টার বেশি পারি না। রস ও গুড়ের দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু কাটার মতো গাছ কমে গেছে। আবার গাছ থাকলেও দক্ষ গাছির অভাব। এবার বেশি শীত পড়ায় রসও ভালো নামছে, গুড়ের উৎপাদনও বেশি।’

গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

মনিরামপুর উপজেলার সরসকাটি গ্রামের গাছি অতিয়ারও প্রায় ৪০ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত। তিনি বলেন, এবার ৫০টা গাছ কাটছি। প্রতিদিন ৮-১০ কেজি গুড় তৈরি হয়। কাজটা খুব কষ্টের। তবে শীত মৌসুমে এই আয়েই পুরো বছরের সংসার চলে।

ই-কমার্সে বাড়ছে চাহিদা

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, যশোর জেলায় মোট খেজুরগাছের সংখ্যা ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫। এগুলোর মধ্যে চলতি মৌসুমে রস আহরণের উপযোগী গাছ রয়েছে ৩ লাখ ৭ হাজার ১৩০টি।

উৎপাদিত গুড় প্রথমে স্থানীয় হাটে বিক্রি হয়, পরে পাইকারদের মাধ্যমে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। যশোরের খেজুর গুড় এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। পাশাপাশি ই-কমার্স ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক উদ্যোক্তাদের হাত ধরে গুড় ও পাটালি সরাসরি ভোক্তার ঘরে পৌঁছানো হচ্ছে। এতে বাজার যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান।

কৃষি বিভাগের উদ্যোগ

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, যশোরের খেজুর গুড়ের স্বাদ ও মানের কারণে চাহিদা সব সময় বেশি। এবার শীত বেশি হওয়ায় রসের পরিমাণ ও মান—দুটোই ভালো। চলতি মৌসুমে প্রায় ১২০ কোটি টাকার রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নিরাপদ খেজুর রস এবং গুড় উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গাছিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামি ১০ ও সরকারি ৬ ব্যাংক: ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা 
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২৭
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা

দেশের ব্যাংকিং খাতের ভেতরে জমে থাকা অনিয়ম, রাজনৈতিক আশ্রয় ও কৃত্রিম হিসাবের পর্দা চলতি বছর যেন একে একে সরে যেতে শুরু করেছে। আর তাতেই সামনে এসেছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। সরকারি ও শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের ভারে এখন কার্যত দিশেহারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশে, আর ইসলামি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা আরও বেশি—৫৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, এই দুটি খাতেই বিতরণ করা ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। যেখানে বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপির হার ৪১ দশমিক ৯৫ ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপির হার মাত্র ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শরিয়াহভিত্তিক ১০টি ইসলামি ব্যাংক মোট ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ঋণ বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, প্রতি ১০ টাকার প্রায় ৬ টাকাই এখন আদায় অনিশ্চিত। সেই তুলনায় শরিয়াহসহ দেশীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এই তুলনাতেই স্পষ্ট, খেলাপির বোঝা এককভাবে সবচেয়ে বেশি ইসলামি ব্যাংকগুলোর ঘাড়েই।

সরকারি ছয় ব্যাংকের অবস্থাও খুব একটা ভিন্ন নয়। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় অর্ধেকই সেখানে অনাদায়ি। ব্যাংকার ও বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট রাতারাতি তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে দুর্বল তদারকি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে আড়াল করার প্রবণতা ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলোকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, খেলাপি ঋণের এত উচ্চ হার শুধু ব্যাংকিং খাতের ভেতরের সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি। ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে পারছে না, বিনিয়োগ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে, শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ থেমে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। তাঁর মতে, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ঋণ আদায়ে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।

ইসলামি ব্যাংকিং খাতে এস আলম, নাসা ও বেক্সিমকো গ্রুপের নাম বারবার আলোচনায় এসেছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন সরকারি মদদে এসব গ্রুপ বিপুল ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। এখন সেই বাস্তবতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতের চিত্র আরও উদ্বেগজনক। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর যে অপচেষ্টা ছিল, তা এখন ভেঙে পড়েছে। সঠিক হিসাব সামনে আসায় হার ৩৬ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা বাস্তবতারই প্রতিফলন। তিনি আবারও শীর্ষ ১০ খেলাপির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, আগের সরকারের আমলে লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ প্রকাশ পাওয়ায় এই হার বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ঋণ আদায়ে কঠোর নির্দেশনার কারণে আগের তুলনায় আদায় বেড়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত