Ajker Patrika

জাতিসংঘে বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপোর্ট ২০২৫

এলডিসির পথনকশায় সরকারের মধ্যবর্তী অবস্থানের বার্তা

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা ­­
এলডিসির পথনকশায় সরকারের মধ্যবর্তী অবস্থানের বার্তা

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের উন্নয়শীল দেশে উত্তরণ প্রক্রিয়া পিছিয়ে দেওয়ার বিষয়ে ব্যবসায়ী মহলের আবদার জাতিসংঘে প্রদত্ত ‘বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপোর্ট ২০২৫’-এ গুরুত্ব পায়নি। অর্থাৎ উত্তরণ প্রক্রিয়া পিছিয়ে দেওয়ার কোনো সুপারিশ করা হয়নি। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে সংস্থাটির কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসিকে (ইউএনসিডিপি) পাঠানো প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সরকার এই প্রক্রিয়ায় একধরনের মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে টেকসই উত্তরণের পথে দৃঢ়ভাবে এগোচ্ছে। দেশের তিনটি মূল মানদণ্ড—মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা—ইতিমধ্যেই পূর্ণ হয়েছে। এসব মানদণ্ড দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রস্তুতির শক্তিশালী অবস্থাকেই প্রতিফলিত করে; যা নিশ্চিত করে, বাংলাদেশ সময়মতো উত্তরণের পথে স্বচ্ছ ও ধারাবাহিক অগ্রগতি অর্জনের সক্ষমতা রাখে।

তবে প্রতিবেদনে সতর্কবার্তাও তুলে ধরা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক চাপ, বৈশ্বিক অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা— এসব চ্যালেঞ্জ দেশের অর্থনীতি ও বিনিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নীতি-সংস্কারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, বেসরকারি খাতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা নিশ্চিত করা জরুরি।

অ্যানহ্যান্সড মনিটরিং মেকানিজমের নিয়ম অনুযায়ী, উত্তরণে থাকা সব দেশকে প্রতিবছর এ ধরনের অগ্রগতি প্রতিবেদন জাতিসংঘে পাঠানো বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপোর্ট ২০২৫ তারই ধারাবাহিকতা। আজ মঙ্গলবার ইউএনসিডিপি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এই প্রতিবেদন নিয়ে ভার্চুয়াল বৈঠক করবে। এ ছাড়া আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ইউএনসিডিপির বার্ষিক প্লেনারি সভায় বাংলাদেশের অবস্থার পর্যালোচনা হবে।

ইউএনসিডিপি প্রতি তিন বছর পর এলডিসিগুলোর অবস্থা পর্যালোচনা করে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত স্বীকৃতি আসে ২০২১ সালে। এখন সেগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষার চূড়ান্ত মূল্যায়নের সময়, যার তথ্য-উপাত্ত জানান দিচ্ছে, সব কটি সূচকের মানদণ্ডেই উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা রাখে।

তবে দেশে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ অমূলক নয়। সরকারের অনুরোধে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য জাতিসংঘের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভের কার্যালয়ের (ইউএন-ওএইচআরএলএলএস) একটি প্রতিনিধিদল ১০ থেকে ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সফর করে স্বাধীন পর্যালোচনা করে। তবে কোনো রিপোর্টেই উত্তরণ পেছানোর বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উঠে আসেনি।

ব্যবসায়ী মহলের উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও কান্ট্রি প্রতিবেদনে উত্তরণ পেছানোর ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। বরং দাবি করা হয়েছে, সঠিক প্রস্তুতি ও কার্যকর নীতি প্রয়োগ নিশ্চিত করলে টেকসই অগ্রগতি এবং উন্নয়শীল দেশে উত্তরণের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।

বিষয়টি নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের পক্ষ থেকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় জানানো হয়, উত্তরণ পেছানোর বিষয়টি যেমন সরকারের হাতে নেই, তেমনি এলডিসি থেকে উত্তরণে সব সময় চ্যালেঞ্জ থাকবে, যদিও সেগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব। কারণ, বাংলাদেশ তিনটি মানদণ্ডে এখনো যোগ্যতার অনেক ওপরে রয়েছে।

প্রতিবেদন স্পষ্টভাবে বলা হয়, উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা সীমিত হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও কানাডা তিন বছরের জন্য সুবিধা বাড়ালেও দীর্ঘ মেয়াদে শর্ত কঠোর হবে। ট্রিপসের আওতায় ওষুধশিল্পের জন্য সুবিধা শেষ হলে বিনিয়োগ, উৎপাদন এবং গবেষণা-উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তৈরি পোশাক খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার চাপ, রপ্তানি ঝুঁকি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তাপ—সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন, প্রশাসনিক পুনর্গঠন, রাজস্ব ঘাটতি এবং বিনিয়োগের ধীরগতি সাময়িক স্থবিরতা সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি এলিট গোষ্ঠীর আধিপত্য এবং ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের পুঁজি পাচার ব্যাংক খাত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে। তবে সহিংস পটপরিবর্তনের পরও বাংলাদেশের অর্থনীতি অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্রুত পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে।

উত্তরণের সিদ্ধান্ত সরকার একতরফাভাবে নিতে পারে না

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক

চেয়ারম্যান, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‍্যাপিড)।

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের টেকসই উত্তরণের সিদ্ধান্ত সরকার একতরফাভাবে নিতে পারে না; এটি জাতিসংঘের প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ২০২৬ সালের নভেম্বরেই বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হবে।

জাতিসংঘ বর্তমানে বাংলাদেশের অগ্রগতি, প্রস্তুতি ও সক্ষমতা পর্যালোচনা করছে। উত্তরণ-পরবর্তী ঝুঁকি, সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ বিবেচনা করে আগামী জানুয়ারিতে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন প্রতিবেদন দেবে। সেই প্রতিবেদন পাওয়ার পরই সরকার প্রয়োজন হলে উত্তরণ-প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করতে পারবে। সরকারের ভূমিকা মূলত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তি উপস্থাপন, কূটনৈতিক তদবির এবং প্রস্তুতি নিশ্চিত করা।

তবে অস্বীকারের উপায় নেই, উত্তরণের পর বাংলাদেশ কিছু সুবিধা হারাবে, বিশেষ করে রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাজার-সুবিধা। তাই রপ্তানি টিকিয়ে রাখতে এবং বাজার বাড়াতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ানো অপরিহার্য। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমানোর সুযোগ কাজে লাগানোও জরুরি।

ইউরোপ, আমেরিকা ও অন্যান্য প্রধান বাণিজ্য অংশীদারের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বা প্রেফারেনশিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (পিটিএ) ছাড়া বিকল্প নেই। এসব চুক্তি বাংলাদেশের পণ্য নতুন শুল্ক বাস্তবতায়ও বাজার ধরে রাখবে।

এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতা দূরীকরণে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি কমানো প্রয়োজন, কারণ এগুলো উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। লজিস্টিক খাতের দক্ষতা বাড়ানোও জরুরি, কারণ বন্দরের অকার্যকরতা ও সড়কে জট রপ্তানির খরচ বাড়াচ্ছে। সার্বিকভাবে, এলডিসি থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের অগ্রগতির স্বীকৃতি হলেও নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে। তাই নীতিগত প্রস্তুতি, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং বাণিজ্য ও কূটনীতি জোরদার করা এখনই অপরিহার্য।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ