Ajker Patrika

সোনার ছেলে গড়তে ইতিহাস জানতে হবে

ড. নূরুন নবী, মুক্তিযোদ্ধা
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১২: ৩১
সোনার ছেলে গড়তে ইতিহাস জানতে হবে

আসলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যারা যোগ দিয়েছিল, তাদের মধ্যে বিভিন্ন ক্যাটাগরির মানুষ ছিল। একটা ছিল জেনে-শুনে-বুঝে যুদ্ধে যাওয়া। আরেকটা ছিল, পরিস্থিতির শিকার হয়ে। আরেকটা ছিল, আত্মরক্ষার জন্য। আমি ছিলাম প্রথম ক্যাটাগরিতে—জেনে-শুনে-বুঝে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম। ব্যাখ্যা করে বলি, যখন বেড়ে উঠছিলাম তখন আমাদের চারপাশে অর্থনৈতিক অবনতি দৃশ্যমান হচ্ছিল গ্রাম-শহরে মানুষের জীবনে। আমার মনে প্রশ্ন ছিল, পশ্চিম পাকিস্তান সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, আমরা কেন পেছনে যাচ্ছি?

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন, পাকিস্তানের কাঠামোয় বাঙালিদের ভাগ্যের কোনো উন্নতি হবে না। কারণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক বৈষম্য দুই প্রদেশের মধ্যে বেড়েই চলছিল। পূর্ব বাংলার বাঙালি নাগরিকেরা পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সমাধানে ছয় দফা, তথা স্বায়ত্ত-শাসনের দাবি উত্থাপন করেন। ৬ দফায় যে দফাগুলো ছিল, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্ব দুর্বল হয়ে যেত এবং যেকোনো সময় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারত।

এ বিষয়টি বঙ্গবন্ধু যেমন বুঝতেন, পাকিস্তানি শাসকেরাও বুঝতেন। কাজেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন মেনে নিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু জানতেন, আন্দোলন করে বাঙালিদের স্বাধিকার আদায় করতে হবে। এ লক্ষ্যেই ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এ লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধু ভাষা-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানিরা ছয় দফাকে নস্যাৎ করার জন্য এবং আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার জন্য ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল।

আমি সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রলীগের কর্মী। আমরা ছাত্রসমাজ ১১ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে সরকারকে বাধ্য করি, আইয়ুব শাহির বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হয়। আইয়ুব খান পদত্যাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন আরেক সেনাপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে। ইয়াহিয়া খান জনগণের চাপে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন।

 নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনা করার ম্যান্ডেট পান এবং তিনিই যে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী, সেটাও প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ইয়াহিয়া খান এবং নির্বাচনে সংখ্যালঘিষ্ঠ দলনেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার জন্য ষড়যন্ত্র করেন। ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট বুঝতে পারেন, তাঁর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার এক গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি এই ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। বাঙালি জাতি সেই ডাকে সাড়া দেয়। ইয়াহিয়া খান আলোচনার নামে ঢাকায় এসে সময়ক্ষেপণ করেন এবং গোপনে গভীর রাতে পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ও সৈন্য আনতে শুরু করেন। ২৬ মার্চ রাতে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সামরিক আক্রমণ চালান। শুরু হয় বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যা। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

আমরা যাঁরা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে যে তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন, তা হৃদয়ে ধারণ করেছিলাম। তার একটি হলো, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তিনি আরও বলেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’; ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ।’ জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা যখন এই বাক্যগুলো উচ্চারণ করেন, আমরা যাঁরা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম, তাঁদের কাছে এটাই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। যুদ্ধে যাওয়া ও ত্যাগ স্বীকারের ঘোষণা। ২৬ মার্চের সামরিক অভিযানের পরই বাঙালিরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, রাজনৈতিক কর্মী এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈন্যরা যুদ্ধে যোগ দেন। গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী।

নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে এবং ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতায় আমরা ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করি। যদিও নয় মাসের যুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন, তাঁর আহ্বানেই আমরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিই এবং স্বাধীনতা অর্জন করি।

স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্বনেতাদের চাপে বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং বাংলাদেশে প্রথমে রাষ্ট্রপতি ও পরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেন। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশকে একটি আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা কমিশন, শাসনতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পুনর্গঠন, বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি লাভ এবং ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যখন তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন, দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই দেশ-বিদেশের পরাজিত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি দুজন মেজরের নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। তাঁর দুই কন্যা বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যান।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশকে একটি মিনি পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত যে চারটি স্তম্ভ, সেগুলো পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়; কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সেটি মেনে নেয়নি। আন্দোলনের মাধ্যমে পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক সরকার ও বিএনপি সরকারকে পরাজিত করে বঙ্গবন্ধুকন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে পুনর্গঠনের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ দেন।

শেখ হাসিনা বাঙালি জাতির প্রাণের দাবি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিয়ে জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন মেগা প্রজেক্ট গ্রহণ করেন। অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশে বিরাজ করছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের যে অন্যতম স্তম্ভ, অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা গঠনের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সম্প্রতি কুমিল্লাসহ বেশ কিছু এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে আক্রমণ হয়েছে, এটা তারই উদাহরণ।

মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িকতার যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, তা কোনোভাবেই ব্যাহত হতে দেওয়া যাবে না। এই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে।

গত ৫০ বছরে আমরা অনেক কিছু অর্জন করেছি। আরও অনেক কিছু অর্জন করার সুযোগ রয়েছে। যেমন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং সব মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির ব্যবস্থা করা আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষ ৫৪ হাজার বর্গমাইল এলাকায় বাস করে। এ রকম একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশে অনেক সমস্যা আছে, সমাধান করা খুবই কঠিন। জটিল সমস্যাগুলো সমাধানের কোনো সহজ উপায় নেই। কিন্তু আমরা যদি বদ্ধপরিকর হই, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার মনে রাখি, তাহলে আমরা এর সমাধান করতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে যেসব বিষয় ছিল, তার একটি হলো দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। দুর্নীতি এবং আইনের শাসন একসঙ্গে চলতে পারে না। দুর্নীতির ব্যাপারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে কথাটি বলেন, জিরো টলারেন্স, সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ, শান্তিপূর্ণ, উন্নয়নশীল ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হলো দুর্নীতিমুক্ত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা।

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতির যে ত্যাগ আমি স্বচক্ষে দেখেছি, ৩০ লাখ শহীদ, ২ লাখের বেশি মা-বোনের নির্যাতন এবং স্বাধীনতার জন্য জনগণের যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, সেটা পৃথিবীর স্বাধীনতার ইতিহাসে বিরল। আমরা যদি এই বিপুল বিশাল ত্যাগের কথা নতুন প্রজন্মকে না জানাতে পারি, তাহলে তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে না। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গঠনের জন্য সোনার ছেলে দরকার। মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা আত্মস্থ না করলে সোনার ছেলে গড়ে উঠবে না। সে জন্য আমি মনে করি এবং ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার।

ড. নূরুন নবী, মুক্তিযোদ্ধা, সভাপতি, যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করে যা বলল ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

দুই মামলা থেকে মির্জা আব্বাস-আমান-গয়েশ্বরসহ ৪৫ জনকে অব্যাহতি

ওসমান হাদির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন

হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, হেলমেট ও ভুয়া নম্বরপ্লেট উদ্ধার

বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ