নওশাদ জামিল

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে। উপস্থিত হয়েছিলাম আমরা কয়েকজন সাংবাদিক ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ। ঠিক সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে দৃপ্ত পায়ে উপস্থিত হলেন এক চিরসবুজ নায়ক। পরনে তাঁর জিনস প্যান্ট, নীল রঙের হাফহাতা শার্ট। সৌম্যকান্তি চেহারার ৮০ পেরোনো সেই তরুণের নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়! সেমিনার হলে ঢুকেই তিনি বললেন, ‘সুপ্রভাত! বাংলাদেশে এলেই মনটা ভালো হয়ে যায় আমার। কেননা, এই বাংলাদেশের সাথেই তো আমার নাড়ির সংযোগ। তাই সব সময়ই এ দেশের প্রতি নাড়ির টান অনুভব করি।’
অভিনয় কিংবা আবৃত্তি করতে নয়, আমাদের সঙ্গে আলাপচারিতা, বলা যায় আড্ডা দিতেই শিল্পকলা একাডেমিতে হাজির হয়েছিলেন দুই বাংলার কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেদিন সেই আলাপচারিতায়, আড্ডায় প্রাণোচ্ছল ভঙ্গিমায় তিনি বলেছিলেন তাঁর ব্যক্তি ও শিল্পীজীবনের নানা অজানা কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ভালোবাসার কথা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগের কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্র, নাটক, সংস্কৃতি নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা।
১৯৫৯ সালে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে অভিনয়জগতে পথচলা শুরু করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তারপর ইতিহাস, তাঁর হিরণ্ময় পথচলা। বিস্ময়কর সাফল্য, মুগ্ধকর সব অর্জন। সৌমিত্র প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করেছিলেন, যার ফলে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, শুধুই সামনে চলা শুরু হয়ে যায় তাঁর। শুরু হয়ে যায় শিল্পের নানা মাধ্যমে তাঁর পদচারণ। সৌমিত্রের সেই পথচলা থেমে যায় ২০২০ সালের এই দিনে। আজ ১৫ নভেম্বর, মঙ্গলবার তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। দুই শতাধিক চলচ্চিত্র, নাটকে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র, মঞ্চ নাটক, টিভি নাটকসহ শিল্পের নানা মাধ্যমে কাজ করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ ও ভারতের সুধী মহলে উচ্চ প্রশংসিত তাঁর নাট্যাভিনয়, পরিচালনা ও রচনা। অভিনয়, আবৃত্তির পাশাপাশি তিনি একজন কবিও। তাঁর কাব্যচর্চার ফসল পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন, কাজ করেছেন শিল্প-সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে। অভিনয়ের জন্য ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন। দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডিলিটসহ নানা পুরস্কার। ফরাসি সরকারের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩ বছর। তরুণ বয়সে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সময় সৌমিত্র যতটা আকর্ষণীয় ছিলেন, ৮০ বছর বয়সে ‘অহল্যা’ শর্ট ফিল্মে অভিনয়েও ততটাই। কী চমৎকার করে যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কথা বলতেন, কী শুদ্ধভাবে ও সঠিক উচ্চারণে! আহা! আমরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনেছিলাম, তন্ময় হয়ে তাঁকে দেখেছিলাম। কিংবদন্তি অভিনেতার সান্নিধ্য পেয়ে আনন্দ-আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম।
পরিচয়ের পর্ব শেষে শুরু হয় আড্ডা ও আলাপন। ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা ১১টায়। আমাদের আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। সূচনা পর্বে গোলাম কুদ্দুছ ভাই প্রশ্ন করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। পর্যায়ক্রমে আমি তাঁকে নানা প্রশ্ন করি, প্রশ্ন করে আমার কয়েকজন বন্ধু ও কয়েকজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও।
পাক্কা দুই ঘণ্টার আলাপচারিতা। মাঝে চা-কফির আপ্যায়ন। মাঝেমধ্যে হাস্যরস, কৌতুক, সিরিয়াস সব কথাবার্তাও। আড্ডা-আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মেলে ধরেন নিজের মনের জানালা, খুলে দেন তাঁর ঘরে-বাইরের চালচিত্র। উন্মোচন করে যেন ঢেলে দেন কথার ফোয়ারা।
গোলাম কুদ্দুছ ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার বাবা একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর। কিন্তু তখনো অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্নটি ওঠেনি। এ কারণেই হয়তো বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন বাবা। কিন্তু একান্ত নিমগ্নতায় বাবাকে অভিনয় আর আবৃত্তিটাই করতে দেখেছি। প্রথম জীবনে বাবার কাছ থেকেই আবৃত্তি শিখেছি। বাবা আমাকে বোঝাতেন কীভাবে অভিনয় করতে হয়, আবৃত্তি করতে হয়। ছোটবেলায় বাবা জোরে উচ্চারণ করে বোঝাতেন সঠিক উচ্চারণবিধি, বোঝাতেন আবৃত্তির কলাকৌশল। মূলত বাবাকে দেখেই একসময় অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। পরে কলকাতায় শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। তারপর তো অভিনয় হয়ে ওঠে আমার জীবনের আরাধ্য।’
আপনি যদি অভিনেতা না হতেন, তাহলে কী হতেন—আমার এ রকম সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘চলচ্চিত্র ও মঞ্চ দুটিই আমার প্রিয় মাধ্যম। অভিনেতা পরিচয়ই প্রধান পরিচয়। যদি আমি অভিনয় না করতাম, অভিনেতা না হতাম, তাহলে হয়তো আবৃত্তিকার হতাম। কিংবা কবি ও লেখক হতাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে একজন চমৎকার আবৃত্তিশিল্পী ও কবি, সেটা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি শিশুর মতো স্বর্গীয় হাসিতে উজ্জ্বল করে দেন শিল্পকলা একাডেমির ছোট্ট সেমিনার হল। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘আমি কবিতা লিখতে পছন্দ করি, কবিতা আবৃত্তি করতেও পছন্দ করি। কিন্তু আমাকে তো সবাই চেনে অভিনেতা হিসেবেই। কবি হিসেবে তো নামডাক নেই!’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাকি ছোটবেলায় সারাক্ষণ হীনম্মন্যতায় ভুগতেন! যাঁরা ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে ২৩ বছরের সুদর্শন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখেছেন, তারা কি কখনো ভাবতে পেরেছেন, এই মানুষটিই তরুণ বয়সে নিজের চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চমৎকার হাস্যরসের মধ্য দিয়ে শোনালের জীবনের কথা। অভিনয়জীবনের শুরুর দিকের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘অভিনয় যে করব, এই অঙ্গনের মানুষের ভালোবাসা কাড়ব, তা কখনো ভাবিনি। আমার ভেতরে একটা হীনম্মন্যতা ছিল। আর সেটা ছিল আমার চেহারা নিয়ে! একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতার মুখে এ কথা শুনে হয়তো হাসবেন। তবে এর কারণ ছিল। অল্প বয়সে টাইফয়েড হয়েছিল। খুব রুগ্ণ ছিলাম। বাড়ির লোকেরা বলত, ছেলেটা কালো, হ্যাংলা-পাতলা! ব্যঙ্গ করে প্রায়ই বলত, তোর তো চেহারা নেই। নাক-চোখ-মুখেরও তেমন সুন্দর আদল নেই। ছোটবেলায় তা শুনে সংকুচিত হতাম। খেলাধুলো খুব করতাম, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো ছিলাম না। ভালো ছাত্রও ছিলাম না। তবে আমার অভিনয় দেখে অনেকেরই ভালো বলত। অভিনয়ে তো নিজেকে আড়াল করা যায়। নিজেকে আড়াল করার জন্যই অভিনয়ে এসেছিলাম।’
সৌমিত্রের বাবা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় পেশায় উকিল হলেও ভালোবাসতেন আবৃত্তি, নাটক, গান। বাবার কণ্ঠে আবৃত্তি শুনেই ছেলেবেলা পার করেছেন সৌমিত্র। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার আবৃত্তি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কবিতা পড়লে তিনি দেখিয়ে দিতেন কীভাবে পড়তে হয়। কীভাবে সঠিক ও শুদ্ধ উচ্চারণ করতে হয়।’
আড্ডা-আলাপচারিতায় একে একে চলতে থাকে কৌতূহলোদ্দীপক নানা প্রশ্ন। আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যজন সৈয়দ হাসান ইমাম, নাট্যজন কেরামত মওলা, অভিনেতা ও নাট্যজন ড. ইনামুল হকসহ অনেকেই।
অভিনয়ের প্রেমে কীভাবে পড়লেন জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতায় বিখ্যাতদের অভিনয় দেখতাম ছোটবেলা থেকেই। শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। তারপর তাঁর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল। প্রায় তিন বছর তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। থিয়েটার নিয়ে আমার চিন্তাভাবনার ভিত তৈরি হয়েছিল তাঁর কাছ থেকেই। সত্যজিৎ রায় তখন ‘পথের পাঁচালী’ তৈরি করেছেন। এর সিক্যুয়াল ‘অপরাজিতা’ তৈরি করবেন তিনি। তাঁর এক সহকারীর কাছে শুনেছিলাম এসব। শিশিরকুমার ভাদুড়ি একদিন সত্যজিৎ রায়ের বাসায় নিয়ে যান। তখনই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে খানিকটা আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। তিনি যেন সারাক্ষণ মনে মনে অভিনেতাকে খুঁজতেন। চলচ্চিত্রের সঙ্গে মানানসই মুখ খুঁজতেন। আমি তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করি।’
কিছুক্ষণ পর হাসতে হাসতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘সামান্য পরিচয় ও দেখা-সাক্ষাতে আমাকে যে সত্যজিৎ রায় মনে রেখেছিলেন, সেটা ভাবতে পারিনি। তার পরের ছবি ছিল তৃতীয় সিক্যুয়াল ‘অপুর সংসার’। সেই চলচ্চিত্রের জন্য খুঁজছিলেন অভিনেতা। হঠাৎ একদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। নিজের গাড়ি করে নিয়ে গেলেন তাঁর অন্য একটি ছবির শুটিং দেখাতে। সেখানেই সত্যজিৎ রায় নামকরা অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যান। তাঁকে বলেন, এ হচ্ছে অপুর সংসারের অপু। এর আগ পর্যন্ত জানতাম না যে আমিই অপুর সংসারের অপু হব।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সবিনয়ে আমি জানতে চাই প্রথম ক্যামেরার সামনে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা। স্মৃতিচারণ করে সৌমিত্র বলেন, ‘মঞ্চে টুকটাক কাজ করলেও ক্যামেরার সামনে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। শিশিরকুমার ভাদুড়ির কাছেই প্রথম শুনেছিলাম যে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের কাজে কিছু তফাত থাকে। অবশ্য শিশিরকুমার নিজে চিত্রাভিনয়ে তেমন আকৃষ্ট হননি। তাঁর ভালো লাগেনি, মঞ্চেই চলে এসেছিলেন। চিত্রাভিনয়ের খুঁটিনাটি দিক নিয়ে তখন ভাবতাম। নিয়মিত চলচ্চিত্র দেখতাম। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিতা’ দেখলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম সত্যজিৎ রায়ের অভিনয়ের ধারা। বোঝার চেষ্টা করলাম তাঁর পরিচালনা ও ক্যামেরার কাজ। ফলে ‘অপুর সংসার’ করার আগে থেকেই সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কীভাবে কাজ করতে হবে, আমার ভেতরে তার একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়েছিল। ‘অপুর সংসার’-এর শুটিংয়ের অনেক আগে থেকেই সত্যজিৎ রায় আমাকে নিয়ে যেতেন নানা জায়গায়, বিভিন্ন বই পড়তে দিতেন, চলচ্চিত্র দেখতে বলতেন। তখন চিত্রনাট্যের খসড়াও আমাকে দিয়েছিলেন। চিত্রনাট্য পড়ে নিজের মতো প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। সত্যজিৎ রায় আগে থেকেই সব বোঝাচ্ছিলেন যেন ক্যামেরার সামনে আমার কোনো আড়ষ্টতা না থাকে। তখন তিনি আমার কিছু ক্যামেরার টেস্ট নিয়েছিলেন। ক্যামেরা জিনিসটা কী, চিনতে শিখিয়েছিলেন। ক্যামেরায় কীভাবে কাজ করতে হয় তা বুঝিয়েছিলেন। ফলে প্রথম শুটিং করতে গিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি।’
স্মৃতিময় আড্ডায় ও আলাপে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। আড্ডায় উঠে এল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কথাও। আলাপচারিতার এক ফাঁকে রামেন্দু মজুমদার বলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাট্যকার ও সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকার সম্পাদকও। কলকাতার বিখ্যাত ‘এক্ষণ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কবিতার চর্চা করছেন সেই ছোটবেলা থেকেই।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেকে আড়াল করার জন্য অভিনয়ে এসেছিলেন, কিন্তু কবিতায় কীভাবে এলেন—আমার এরকম প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘কবিতায় নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ এল কিশোর বয়সে। তখন মেয়েদের প্রতি ভালো লাগার ব্যাপারটা শুরু হয়। বিশেষ মেয়েকে ভালো লাগার বিষয়টা তো থাকে। তখন তো একটু হাত ধরতেও কত অপেক্ষা করতে হতো! নিজের কথা যেখানে বলা যাচ্ছে না, তার একটা উপায় হিসেবেই কবিতা লেখার শুরু। গোপন প্রেমিকার উদ্দেশ্যেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায় যেন হাসির ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায় সেমিনার হলে। একজন হাসতে হাসতে জানতে চান, যাকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লেখা শুরু, তাকে জীবনে পেয়েছিলেন কি?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও হাসির দীর্ঘ আভা ছড়িয়ে বলেন, যাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম, তাকে পেয়েছিলাম। তাঁর কথায় ও রসিকতায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলাম সবাই।
আমার এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে অতীতসাগরে ডুব দেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ডুবুরির মতো গভীর থেকে যেন তুলে আনেন তাঁর স্মৃতিগুচ্ছ। কবিতা লেখা ও বই পড়ার প্রতি নিজের ভালো লাগার কথা প্রকাশ করে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার ভেতরে কবিতা লেখার তাগিদ টের পাই ছোটবেলায়। অভিনয়, আবৃত্তি, কবিতা—এসব শুরু করেছিলাম পারিবারিক সুন্দর একটা আবহে। কবিতা লেখার আগে থেকেই অভিনয়টার প্রতি টান ছিল। আবৃত্তির প্রতি অনুরাগ ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি অভিনয় করছি, আবৃত্তি করছি। কেননা, আমাদের বাড়িতে থিয়েটারের চর্চা ছিল। আবৃত্তির চর্চাও ছিল। কিশোর বয়সে আমার মধ্যে কবিতা লেখার ঝোঁক এসেছিল। মোটামুটি ষোলো বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। বেশির ভাগ বাঙালি ছেলে যেমন কিশোর বয়সে কবিতা লেখে, তেমনই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। কিশোর বয়সে অধিকাংশ বাঙালি ছেলেই প্রেমে পড়লে কবিতা লেখে, আমিও তেমনভাবে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। অবশ্য এটার পেছনেও অনুপ্রেরণা ছিল পরিবার। আমাদের বাড়িতে সাহিত্যের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা ছিল। আমার দাদু সাহিত্যচর্চা করতেন। আমার বাবা-মা সাহিত্য খুব ভালোবাসতেন। ছোটবেলা থেকে আমাদের বইটই পড়ার কোনো বাধানিষেধ ছিল না। অনেক বাঙালির বাড়িতে নানা রকম বাধা থাকে বাইরের বই পড়ার।আমাদের বাড়িতে তা ছিল না। বলা যায়, আমাকে বেশ উৎসাহ দিতেন বাবা-মা। ছোটবেলা থেকেই আমি বইয়ের পোকা ছিলাম। প্রচুর ছড়া ও কবিতা পড়তাম।’
আলাপের এক ফাঁকে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নাটক সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতার নাটকের অবনমন হয়েছে। মান কমে গেছে। সিনেমারও একই অবস্থা। কলকাতায় এখন সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার রাজনীতিতে নোংরা জৌলুশ আছে। তরুণেরা বাংলা ভুলে যাচ্ছে, মিশ্র ভাষায় কথা বলছে। বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে কথা বলছে। বাঙালি জাতিটাকে টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশই। বাংলা ভাষাকে গৌরব দিয়েছে বাংলাদেশই।’
নাট্যজন কেরামত মওলার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনয় ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না। অভিনয়ই তো আমাকে রুটি-রুজি দিয়েছে। আমাকে খ্যাতি ও সম্মান দিয়েছে, বিপুল মানুষের ভালোবাসা দিয়েছে।’
অভিনয়ের পাশাপাশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাটকও লিখেছেন। নাটক লেখার বিষয়ে প্রশ্ন রামেন্দু মজুমদারের। উত্তরে গুণী এই অভিনেতা বলেন, ‘আসলে প্রয়োজনের তাগিদে নাটক লেখা শুরু করেছিলাম। নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিল রেখে জীবনের সঞ্চিত খাতায় অনেক নাটক লিখেছিলাম। কমবেশি অনেক নাটকই দর্শক ও শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে, মানুষের প্রশংসা পেয়েছে।’
নাটকের ভবিষ্যৎ কী—এমন প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিজ্ঞতা ও ত্যাগ কখনো বিফলে যায় না; যায়নি অতীতে, ভবিষ্যতেও যাবে না হয়তো। সেই সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের জীবনের সঙ্গে মিল রেখে কতটুকু প্রাসঙ্গিক আমাদের নাটক, সেটার ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করে। ভালো নাটক সব সময়ই বেঁচে থাকবে। ভালো নাটক মানুষ গ্রহণ করবেই।
একজন ভালো অভিনেতার গুণাবলি সম্পর্কে জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনেতা হওয়া সহজ নয়। বড় সাধনার বিষয়। ভালো অভিনেতার কাছে মানুষ বিষয়, সমাজ বিষয়, রাষ্ট্রও বিষয়। যে অভিনেতা শুধু আত্মপ্রদর্শন করে, তাকে আমার বড় অভিনেতা মনে হয় না। বড় অভিনেতা তার অভিনয়ে সমাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গ দেখায়, মানুষকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি ভাবতে শেখায়।’
টিভি, চলচ্চিত্র ও মঞ্চ—এসব জায়গায় অভিনয় করতে গিয়ে নিজেকে কি আলাদা করে তৈরি করতে হয়—নাট্যব্যক্তিত্ব কেরামত মওলার প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রথমত অভিনয়, তারপর পরিবেশ বুঝে উপস্থাপন। এতে আমি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। যিনি ছবি আঁকেন, তিনি ছোট ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন, বড় ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন। সে-ই সত্যিকার অভিনেতা, যে সমাজের ভাবনাচিন্তা, অবস্থা অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারে।’
আমাদের আলাপে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নানা দিকও। উঠে এসেছিল দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের কথাও। পাশাপাশি দুই দেশ, পাশাপাশি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। ভাষা এক, সংস্কৃতিও এক। তার পরও দূরত্ব রয়ে গেছে অনেক জায়গায়। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর পথে আরও একটি বিষয় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারত, তা হলো বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে দেখার ব্যবস্থা করা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে সেটি নেই। এ বিষয়ে আমার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলাদেশের নাটক, চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতিকে খুব মিস করি। সাংঘাতিকভাবে মিস করি। এ দেশের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকলেও এ রকম একটি প্রতিবন্ধকতার কারণে সেটা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। এটার উত্তরণ জরুরি।’
আড্ডার এক ফাঁকে আবৃত্তিশিল্পী ও নাট্যনির্দেশক গোলাম সারোয়ার জানতে চান অভিনয়ে আবৃত্তিচর্চার প্রয়োজন আছে কি না। সৌমিত্রের জবাব, ‘অভিনয়ের জন্য আবৃত্তিরও ভীষণ দরকার। যাঁরা এটা বোঝেন না, তাঁরা এখনো চোখ বুজে আছেন। অভিনয়ের প্রারম্ভিক কাজ হলো কথা বলা, সেটা আবৃত্তিচর্চা ছাড়া হয় না। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আবৃত্তি ও গান করি। প্রতিদিন রেওয়াজ করি, সাধনা করি। জীবনে সফল হতে হলে তার কাজকে সাধনার পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা অভিনয় হোক, আর আবৃত্তি হোক কিংবা যেকোনো মাধ্যমই হোক। একজন অভিনেতাকে চার অক্ষরের একটি শব্দ আঁকড়ে রাখতে হয়, সেটা হলো ভালোবাসা। নিজের কাজের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা থাকতে হবে। নিজের কাজ ও দায়িত্বের প্রতি ভালোবাসাই মানুষকে সাফল্য এনে দেয়, পৌঁছে দেয় সঠিক অবস্থানে। ভালোবাসা ছাড়া কিচ্ছু হয় না, হবেও না।’

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে। উপস্থিত হয়েছিলাম আমরা কয়েকজন সাংবাদিক ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ। ঠিক সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে দৃপ্ত পায়ে উপস্থিত হলেন এক চিরসবুজ নায়ক। পরনে তাঁর জিনস প্যান্ট, নীল রঙের হাফহাতা শার্ট। সৌম্যকান্তি চেহারার ৮০ পেরোনো সেই তরুণের নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়! সেমিনার হলে ঢুকেই তিনি বললেন, ‘সুপ্রভাত! বাংলাদেশে এলেই মনটা ভালো হয়ে যায় আমার। কেননা, এই বাংলাদেশের সাথেই তো আমার নাড়ির সংযোগ। তাই সব সময়ই এ দেশের প্রতি নাড়ির টান অনুভব করি।’
অভিনয় কিংবা আবৃত্তি করতে নয়, আমাদের সঙ্গে আলাপচারিতা, বলা যায় আড্ডা দিতেই শিল্পকলা একাডেমিতে হাজির হয়েছিলেন দুই বাংলার কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেদিন সেই আলাপচারিতায়, আড্ডায় প্রাণোচ্ছল ভঙ্গিমায় তিনি বলেছিলেন তাঁর ব্যক্তি ও শিল্পীজীবনের নানা অজানা কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ভালোবাসার কথা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগের কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্র, নাটক, সংস্কৃতি নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা।
১৯৫৯ সালে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে অভিনয়জগতে পথচলা শুরু করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তারপর ইতিহাস, তাঁর হিরণ্ময় পথচলা। বিস্ময়কর সাফল্য, মুগ্ধকর সব অর্জন। সৌমিত্র প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করেছিলেন, যার ফলে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, শুধুই সামনে চলা শুরু হয়ে যায় তাঁর। শুরু হয়ে যায় শিল্পের নানা মাধ্যমে তাঁর পদচারণ। সৌমিত্রের সেই পথচলা থেমে যায় ২০২০ সালের এই দিনে। আজ ১৫ নভেম্বর, মঙ্গলবার তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। দুই শতাধিক চলচ্চিত্র, নাটকে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র, মঞ্চ নাটক, টিভি নাটকসহ শিল্পের নানা মাধ্যমে কাজ করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ ও ভারতের সুধী মহলে উচ্চ প্রশংসিত তাঁর নাট্যাভিনয়, পরিচালনা ও রচনা। অভিনয়, আবৃত্তির পাশাপাশি তিনি একজন কবিও। তাঁর কাব্যচর্চার ফসল পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন, কাজ করেছেন শিল্প-সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে। অভিনয়ের জন্য ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন। দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডিলিটসহ নানা পুরস্কার। ফরাসি সরকারের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩ বছর। তরুণ বয়সে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সময় সৌমিত্র যতটা আকর্ষণীয় ছিলেন, ৮০ বছর বয়সে ‘অহল্যা’ শর্ট ফিল্মে অভিনয়েও ততটাই। কী চমৎকার করে যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কথা বলতেন, কী শুদ্ধভাবে ও সঠিক উচ্চারণে! আহা! আমরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনেছিলাম, তন্ময় হয়ে তাঁকে দেখেছিলাম। কিংবদন্তি অভিনেতার সান্নিধ্য পেয়ে আনন্দ-আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম।
পরিচয়ের পর্ব শেষে শুরু হয় আড্ডা ও আলাপন। ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা ১১টায়। আমাদের আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। সূচনা পর্বে গোলাম কুদ্দুছ ভাই প্রশ্ন করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। পর্যায়ক্রমে আমি তাঁকে নানা প্রশ্ন করি, প্রশ্ন করে আমার কয়েকজন বন্ধু ও কয়েকজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও।
পাক্কা দুই ঘণ্টার আলাপচারিতা। মাঝে চা-কফির আপ্যায়ন। মাঝেমধ্যে হাস্যরস, কৌতুক, সিরিয়াস সব কথাবার্তাও। আড্ডা-আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মেলে ধরেন নিজের মনের জানালা, খুলে দেন তাঁর ঘরে-বাইরের চালচিত্র। উন্মোচন করে যেন ঢেলে দেন কথার ফোয়ারা।
গোলাম কুদ্দুছ ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার বাবা একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর। কিন্তু তখনো অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্নটি ওঠেনি। এ কারণেই হয়তো বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন বাবা। কিন্তু একান্ত নিমগ্নতায় বাবাকে অভিনয় আর আবৃত্তিটাই করতে দেখেছি। প্রথম জীবনে বাবার কাছ থেকেই আবৃত্তি শিখেছি। বাবা আমাকে বোঝাতেন কীভাবে অভিনয় করতে হয়, আবৃত্তি করতে হয়। ছোটবেলায় বাবা জোরে উচ্চারণ করে বোঝাতেন সঠিক উচ্চারণবিধি, বোঝাতেন আবৃত্তির কলাকৌশল। মূলত বাবাকে দেখেই একসময় অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। পরে কলকাতায় শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। তারপর তো অভিনয় হয়ে ওঠে আমার জীবনের আরাধ্য।’
আপনি যদি অভিনেতা না হতেন, তাহলে কী হতেন—আমার এ রকম সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘চলচ্চিত্র ও মঞ্চ দুটিই আমার প্রিয় মাধ্যম। অভিনেতা পরিচয়ই প্রধান পরিচয়। যদি আমি অভিনয় না করতাম, অভিনেতা না হতাম, তাহলে হয়তো আবৃত্তিকার হতাম। কিংবা কবি ও লেখক হতাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে একজন চমৎকার আবৃত্তিশিল্পী ও কবি, সেটা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি শিশুর মতো স্বর্গীয় হাসিতে উজ্জ্বল করে দেন শিল্পকলা একাডেমির ছোট্ট সেমিনার হল। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘আমি কবিতা লিখতে পছন্দ করি, কবিতা আবৃত্তি করতেও পছন্দ করি। কিন্তু আমাকে তো সবাই চেনে অভিনেতা হিসেবেই। কবি হিসেবে তো নামডাক নেই!’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাকি ছোটবেলায় সারাক্ষণ হীনম্মন্যতায় ভুগতেন! যাঁরা ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে ২৩ বছরের সুদর্শন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখেছেন, তারা কি কখনো ভাবতে পেরেছেন, এই মানুষটিই তরুণ বয়সে নিজের চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চমৎকার হাস্যরসের মধ্য দিয়ে শোনালের জীবনের কথা। অভিনয়জীবনের শুরুর দিকের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘অভিনয় যে করব, এই অঙ্গনের মানুষের ভালোবাসা কাড়ব, তা কখনো ভাবিনি। আমার ভেতরে একটা হীনম্মন্যতা ছিল। আর সেটা ছিল আমার চেহারা নিয়ে! একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতার মুখে এ কথা শুনে হয়তো হাসবেন। তবে এর কারণ ছিল। অল্প বয়সে টাইফয়েড হয়েছিল। খুব রুগ্ণ ছিলাম। বাড়ির লোকেরা বলত, ছেলেটা কালো, হ্যাংলা-পাতলা! ব্যঙ্গ করে প্রায়ই বলত, তোর তো চেহারা নেই। নাক-চোখ-মুখেরও তেমন সুন্দর আদল নেই। ছোটবেলায় তা শুনে সংকুচিত হতাম। খেলাধুলো খুব করতাম, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো ছিলাম না। ভালো ছাত্রও ছিলাম না। তবে আমার অভিনয় দেখে অনেকেরই ভালো বলত। অভিনয়ে তো নিজেকে আড়াল করা যায়। নিজেকে আড়াল করার জন্যই অভিনয়ে এসেছিলাম।’
সৌমিত্রের বাবা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় পেশায় উকিল হলেও ভালোবাসতেন আবৃত্তি, নাটক, গান। বাবার কণ্ঠে আবৃত্তি শুনেই ছেলেবেলা পার করেছেন সৌমিত্র। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার আবৃত্তি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কবিতা পড়লে তিনি দেখিয়ে দিতেন কীভাবে পড়তে হয়। কীভাবে সঠিক ও শুদ্ধ উচ্চারণ করতে হয়।’
আড্ডা-আলাপচারিতায় একে একে চলতে থাকে কৌতূহলোদ্দীপক নানা প্রশ্ন। আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যজন সৈয়দ হাসান ইমাম, নাট্যজন কেরামত মওলা, অভিনেতা ও নাট্যজন ড. ইনামুল হকসহ অনেকেই।
অভিনয়ের প্রেমে কীভাবে পড়লেন জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতায় বিখ্যাতদের অভিনয় দেখতাম ছোটবেলা থেকেই। শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। তারপর তাঁর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল। প্রায় তিন বছর তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। থিয়েটার নিয়ে আমার চিন্তাভাবনার ভিত তৈরি হয়েছিল তাঁর কাছ থেকেই। সত্যজিৎ রায় তখন ‘পথের পাঁচালী’ তৈরি করেছেন। এর সিক্যুয়াল ‘অপরাজিতা’ তৈরি করবেন তিনি। তাঁর এক সহকারীর কাছে শুনেছিলাম এসব। শিশিরকুমার ভাদুড়ি একদিন সত্যজিৎ রায়ের বাসায় নিয়ে যান। তখনই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে খানিকটা আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। তিনি যেন সারাক্ষণ মনে মনে অভিনেতাকে খুঁজতেন। চলচ্চিত্রের সঙ্গে মানানসই মুখ খুঁজতেন। আমি তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করি।’
কিছুক্ষণ পর হাসতে হাসতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘সামান্য পরিচয় ও দেখা-সাক্ষাতে আমাকে যে সত্যজিৎ রায় মনে রেখেছিলেন, সেটা ভাবতে পারিনি। তার পরের ছবি ছিল তৃতীয় সিক্যুয়াল ‘অপুর সংসার’। সেই চলচ্চিত্রের জন্য খুঁজছিলেন অভিনেতা। হঠাৎ একদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। নিজের গাড়ি করে নিয়ে গেলেন তাঁর অন্য একটি ছবির শুটিং দেখাতে। সেখানেই সত্যজিৎ রায় নামকরা অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যান। তাঁকে বলেন, এ হচ্ছে অপুর সংসারের অপু। এর আগ পর্যন্ত জানতাম না যে আমিই অপুর সংসারের অপু হব।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সবিনয়ে আমি জানতে চাই প্রথম ক্যামেরার সামনে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা। স্মৃতিচারণ করে সৌমিত্র বলেন, ‘মঞ্চে টুকটাক কাজ করলেও ক্যামেরার সামনে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। শিশিরকুমার ভাদুড়ির কাছেই প্রথম শুনেছিলাম যে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের কাজে কিছু তফাত থাকে। অবশ্য শিশিরকুমার নিজে চিত্রাভিনয়ে তেমন আকৃষ্ট হননি। তাঁর ভালো লাগেনি, মঞ্চেই চলে এসেছিলেন। চিত্রাভিনয়ের খুঁটিনাটি দিক নিয়ে তখন ভাবতাম। নিয়মিত চলচ্চিত্র দেখতাম। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিতা’ দেখলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম সত্যজিৎ রায়ের অভিনয়ের ধারা। বোঝার চেষ্টা করলাম তাঁর পরিচালনা ও ক্যামেরার কাজ। ফলে ‘অপুর সংসার’ করার আগে থেকেই সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কীভাবে কাজ করতে হবে, আমার ভেতরে তার একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়েছিল। ‘অপুর সংসার’-এর শুটিংয়ের অনেক আগে থেকেই সত্যজিৎ রায় আমাকে নিয়ে যেতেন নানা জায়গায়, বিভিন্ন বই পড়তে দিতেন, চলচ্চিত্র দেখতে বলতেন। তখন চিত্রনাট্যের খসড়াও আমাকে দিয়েছিলেন। চিত্রনাট্য পড়ে নিজের মতো প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। সত্যজিৎ রায় আগে থেকেই সব বোঝাচ্ছিলেন যেন ক্যামেরার সামনে আমার কোনো আড়ষ্টতা না থাকে। তখন তিনি আমার কিছু ক্যামেরার টেস্ট নিয়েছিলেন। ক্যামেরা জিনিসটা কী, চিনতে শিখিয়েছিলেন। ক্যামেরায় কীভাবে কাজ করতে হয় তা বুঝিয়েছিলেন। ফলে প্রথম শুটিং করতে গিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি।’
স্মৃতিময় আড্ডায় ও আলাপে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। আড্ডায় উঠে এল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কথাও। আলাপচারিতার এক ফাঁকে রামেন্দু মজুমদার বলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাট্যকার ও সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকার সম্পাদকও। কলকাতার বিখ্যাত ‘এক্ষণ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কবিতার চর্চা করছেন সেই ছোটবেলা থেকেই।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেকে আড়াল করার জন্য অভিনয়ে এসেছিলেন, কিন্তু কবিতায় কীভাবে এলেন—আমার এরকম প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘কবিতায় নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ এল কিশোর বয়সে। তখন মেয়েদের প্রতি ভালো লাগার ব্যাপারটা শুরু হয়। বিশেষ মেয়েকে ভালো লাগার বিষয়টা তো থাকে। তখন তো একটু হাত ধরতেও কত অপেক্ষা করতে হতো! নিজের কথা যেখানে বলা যাচ্ছে না, তার একটা উপায় হিসেবেই কবিতা লেখার শুরু। গোপন প্রেমিকার উদ্দেশ্যেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায় যেন হাসির ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায় সেমিনার হলে। একজন হাসতে হাসতে জানতে চান, যাকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লেখা শুরু, তাকে জীবনে পেয়েছিলেন কি?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও হাসির দীর্ঘ আভা ছড়িয়ে বলেন, যাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম, তাকে পেয়েছিলাম। তাঁর কথায় ও রসিকতায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলাম সবাই।
আমার এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে অতীতসাগরে ডুব দেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ডুবুরির মতো গভীর থেকে যেন তুলে আনেন তাঁর স্মৃতিগুচ্ছ। কবিতা লেখা ও বই পড়ার প্রতি নিজের ভালো লাগার কথা প্রকাশ করে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার ভেতরে কবিতা লেখার তাগিদ টের পাই ছোটবেলায়। অভিনয়, আবৃত্তি, কবিতা—এসব শুরু করেছিলাম পারিবারিক সুন্দর একটা আবহে। কবিতা লেখার আগে থেকেই অভিনয়টার প্রতি টান ছিল। আবৃত্তির প্রতি অনুরাগ ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি অভিনয় করছি, আবৃত্তি করছি। কেননা, আমাদের বাড়িতে থিয়েটারের চর্চা ছিল। আবৃত্তির চর্চাও ছিল। কিশোর বয়সে আমার মধ্যে কবিতা লেখার ঝোঁক এসেছিল। মোটামুটি ষোলো বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। বেশির ভাগ বাঙালি ছেলে যেমন কিশোর বয়সে কবিতা লেখে, তেমনই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। কিশোর বয়সে অধিকাংশ বাঙালি ছেলেই প্রেমে পড়লে কবিতা লেখে, আমিও তেমনভাবে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। অবশ্য এটার পেছনেও অনুপ্রেরণা ছিল পরিবার। আমাদের বাড়িতে সাহিত্যের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা ছিল। আমার দাদু সাহিত্যচর্চা করতেন। আমার বাবা-মা সাহিত্য খুব ভালোবাসতেন। ছোটবেলা থেকে আমাদের বইটই পড়ার কোনো বাধানিষেধ ছিল না। অনেক বাঙালির বাড়িতে নানা রকম বাধা থাকে বাইরের বই পড়ার।আমাদের বাড়িতে তা ছিল না। বলা যায়, আমাকে বেশ উৎসাহ দিতেন বাবা-মা। ছোটবেলা থেকেই আমি বইয়ের পোকা ছিলাম। প্রচুর ছড়া ও কবিতা পড়তাম।’
আলাপের এক ফাঁকে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নাটক সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতার নাটকের অবনমন হয়েছে। মান কমে গেছে। সিনেমারও একই অবস্থা। কলকাতায় এখন সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার রাজনীতিতে নোংরা জৌলুশ আছে। তরুণেরা বাংলা ভুলে যাচ্ছে, মিশ্র ভাষায় কথা বলছে। বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে কথা বলছে। বাঙালি জাতিটাকে টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশই। বাংলা ভাষাকে গৌরব দিয়েছে বাংলাদেশই।’
নাট্যজন কেরামত মওলার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনয় ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না। অভিনয়ই তো আমাকে রুটি-রুজি দিয়েছে। আমাকে খ্যাতি ও সম্মান দিয়েছে, বিপুল মানুষের ভালোবাসা দিয়েছে।’
অভিনয়ের পাশাপাশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাটকও লিখেছেন। নাটক লেখার বিষয়ে প্রশ্ন রামেন্দু মজুমদারের। উত্তরে গুণী এই অভিনেতা বলেন, ‘আসলে প্রয়োজনের তাগিদে নাটক লেখা শুরু করেছিলাম। নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিল রেখে জীবনের সঞ্চিত খাতায় অনেক নাটক লিখেছিলাম। কমবেশি অনেক নাটকই দর্শক ও শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে, মানুষের প্রশংসা পেয়েছে।’
নাটকের ভবিষ্যৎ কী—এমন প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিজ্ঞতা ও ত্যাগ কখনো বিফলে যায় না; যায়নি অতীতে, ভবিষ্যতেও যাবে না হয়তো। সেই সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের জীবনের সঙ্গে মিল রেখে কতটুকু প্রাসঙ্গিক আমাদের নাটক, সেটার ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করে। ভালো নাটক সব সময়ই বেঁচে থাকবে। ভালো নাটক মানুষ গ্রহণ করবেই।
একজন ভালো অভিনেতার গুণাবলি সম্পর্কে জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনেতা হওয়া সহজ নয়। বড় সাধনার বিষয়। ভালো অভিনেতার কাছে মানুষ বিষয়, সমাজ বিষয়, রাষ্ট্রও বিষয়। যে অভিনেতা শুধু আত্মপ্রদর্শন করে, তাকে আমার বড় অভিনেতা মনে হয় না। বড় অভিনেতা তার অভিনয়ে সমাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গ দেখায়, মানুষকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি ভাবতে শেখায়।’
টিভি, চলচ্চিত্র ও মঞ্চ—এসব জায়গায় অভিনয় করতে গিয়ে নিজেকে কি আলাদা করে তৈরি করতে হয়—নাট্যব্যক্তিত্ব কেরামত মওলার প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রথমত অভিনয়, তারপর পরিবেশ বুঝে উপস্থাপন। এতে আমি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। যিনি ছবি আঁকেন, তিনি ছোট ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন, বড় ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন। সে-ই সত্যিকার অভিনেতা, যে সমাজের ভাবনাচিন্তা, অবস্থা অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারে।’
আমাদের আলাপে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নানা দিকও। উঠে এসেছিল দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের কথাও। পাশাপাশি দুই দেশ, পাশাপাশি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। ভাষা এক, সংস্কৃতিও এক। তার পরও দূরত্ব রয়ে গেছে অনেক জায়গায়। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর পথে আরও একটি বিষয় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারত, তা হলো বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে দেখার ব্যবস্থা করা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে সেটি নেই। এ বিষয়ে আমার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলাদেশের নাটক, চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতিকে খুব মিস করি। সাংঘাতিকভাবে মিস করি। এ দেশের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকলেও এ রকম একটি প্রতিবন্ধকতার কারণে সেটা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। এটার উত্তরণ জরুরি।’
আড্ডার এক ফাঁকে আবৃত্তিশিল্পী ও নাট্যনির্দেশক গোলাম সারোয়ার জানতে চান অভিনয়ে আবৃত্তিচর্চার প্রয়োজন আছে কি না। সৌমিত্রের জবাব, ‘অভিনয়ের জন্য আবৃত্তিরও ভীষণ দরকার। যাঁরা এটা বোঝেন না, তাঁরা এখনো চোখ বুজে আছেন। অভিনয়ের প্রারম্ভিক কাজ হলো কথা বলা, সেটা আবৃত্তিচর্চা ছাড়া হয় না। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আবৃত্তি ও গান করি। প্রতিদিন রেওয়াজ করি, সাধনা করি। জীবনে সফল হতে হলে তার কাজকে সাধনার পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা অভিনয় হোক, আর আবৃত্তি হোক কিংবা যেকোনো মাধ্যমই হোক। একজন অভিনেতাকে চার অক্ষরের একটি শব্দ আঁকড়ে রাখতে হয়, সেটা হলো ভালোবাসা। নিজের কাজের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা থাকতে হবে। নিজের কাজ ও দায়িত্বের প্রতি ভালোবাসাই মানুষকে সাফল্য এনে দেয়, পৌঁছে দেয় সঠিক অবস্থানে। ভালোবাসা ছাড়া কিচ্ছু হয় না, হবেও না।’
নওশাদ জামিল

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে। উপস্থিত হয়েছিলাম আমরা কয়েকজন সাংবাদিক ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ। ঠিক সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে দৃপ্ত পায়ে উপস্থিত হলেন এক চিরসবুজ নায়ক। পরনে তাঁর জিনস প্যান্ট, নীল রঙের হাফহাতা শার্ট। সৌম্যকান্তি চেহারার ৮০ পেরোনো সেই তরুণের নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়! সেমিনার হলে ঢুকেই তিনি বললেন, ‘সুপ্রভাত! বাংলাদেশে এলেই মনটা ভালো হয়ে যায় আমার। কেননা, এই বাংলাদেশের সাথেই তো আমার নাড়ির সংযোগ। তাই সব সময়ই এ দেশের প্রতি নাড়ির টান অনুভব করি।’
অভিনয় কিংবা আবৃত্তি করতে নয়, আমাদের সঙ্গে আলাপচারিতা, বলা যায় আড্ডা দিতেই শিল্পকলা একাডেমিতে হাজির হয়েছিলেন দুই বাংলার কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেদিন সেই আলাপচারিতায়, আড্ডায় প্রাণোচ্ছল ভঙ্গিমায় তিনি বলেছিলেন তাঁর ব্যক্তি ও শিল্পীজীবনের নানা অজানা কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ভালোবাসার কথা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগের কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্র, নাটক, সংস্কৃতি নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা।
১৯৫৯ সালে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে অভিনয়জগতে পথচলা শুরু করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তারপর ইতিহাস, তাঁর হিরণ্ময় পথচলা। বিস্ময়কর সাফল্য, মুগ্ধকর সব অর্জন। সৌমিত্র প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করেছিলেন, যার ফলে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, শুধুই সামনে চলা শুরু হয়ে যায় তাঁর। শুরু হয়ে যায় শিল্পের নানা মাধ্যমে তাঁর পদচারণ। সৌমিত্রের সেই পথচলা থেমে যায় ২০২০ সালের এই দিনে। আজ ১৫ নভেম্বর, মঙ্গলবার তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। দুই শতাধিক চলচ্চিত্র, নাটকে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র, মঞ্চ নাটক, টিভি নাটকসহ শিল্পের নানা মাধ্যমে কাজ করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ ও ভারতের সুধী মহলে উচ্চ প্রশংসিত তাঁর নাট্যাভিনয়, পরিচালনা ও রচনা। অভিনয়, আবৃত্তির পাশাপাশি তিনি একজন কবিও। তাঁর কাব্যচর্চার ফসল পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন, কাজ করেছেন শিল্প-সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে। অভিনয়ের জন্য ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন। দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডিলিটসহ নানা পুরস্কার। ফরাসি সরকারের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩ বছর। তরুণ বয়সে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সময় সৌমিত্র যতটা আকর্ষণীয় ছিলেন, ৮০ বছর বয়সে ‘অহল্যা’ শর্ট ফিল্মে অভিনয়েও ততটাই। কী চমৎকার করে যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কথা বলতেন, কী শুদ্ধভাবে ও সঠিক উচ্চারণে! আহা! আমরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনেছিলাম, তন্ময় হয়ে তাঁকে দেখেছিলাম। কিংবদন্তি অভিনেতার সান্নিধ্য পেয়ে আনন্দ-আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম।
পরিচয়ের পর্ব শেষে শুরু হয় আড্ডা ও আলাপন। ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা ১১টায়। আমাদের আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। সূচনা পর্বে গোলাম কুদ্দুছ ভাই প্রশ্ন করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। পর্যায়ক্রমে আমি তাঁকে নানা প্রশ্ন করি, প্রশ্ন করে আমার কয়েকজন বন্ধু ও কয়েকজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও।
পাক্কা দুই ঘণ্টার আলাপচারিতা। মাঝে চা-কফির আপ্যায়ন। মাঝেমধ্যে হাস্যরস, কৌতুক, সিরিয়াস সব কথাবার্তাও। আড্ডা-আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মেলে ধরেন নিজের মনের জানালা, খুলে দেন তাঁর ঘরে-বাইরের চালচিত্র। উন্মোচন করে যেন ঢেলে দেন কথার ফোয়ারা।
গোলাম কুদ্দুছ ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার বাবা একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর। কিন্তু তখনো অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্নটি ওঠেনি। এ কারণেই হয়তো বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন বাবা। কিন্তু একান্ত নিমগ্নতায় বাবাকে অভিনয় আর আবৃত্তিটাই করতে দেখেছি। প্রথম জীবনে বাবার কাছ থেকেই আবৃত্তি শিখেছি। বাবা আমাকে বোঝাতেন কীভাবে অভিনয় করতে হয়, আবৃত্তি করতে হয়। ছোটবেলায় বাবা জোরে উচ্চারণ করে বোঝাতেন সঠিক উচ্চারণবিধি, বোঝাতেন আবৃত্তির কলাকৌশল। মূলত বাবাকে দেখেই একসময় অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। পরে কলকাতায় শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। তারপর তো অভিনয় হয়ে ওঠে আমার জীবনের আরাধ্য।’
আপনি যদি অভিনেতা না হতেন, তাহলে কী হতেন—আমার এ রকম সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘চলচ্চিত্র ও মঞ্চ দুটিই আমার প্রিয় মাধ্যম। অভিনেতা পরিচয়ই প্রধান পরিচয়। যদি আমি অভিনয় না করতাম, অভিনেতা না হতাম, তাহলে হয়তো আবৃত্তিকার হতাম। কিংবা কবি ও লেখক হতাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে একজন চমৎকার আবৃত্তিশিল্পী ও কবি, সেটা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি শিশুর মতো স্বর্গীয় হাসিতে উজ্জ্বল করে দেন শিল্পকলা একাডেমির ছোট্ট সেমিনার হল। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘আমি কবিতা লিখতে পছন্দ করি, কবিতা আবৃত্তি করতেও পছন্দ করি। কিন্তু আমাকে তো সবাই চেনে অভিনেতা হিসেবেই। কবি হিসেবে তো নামডাক নেই!’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাকি ছোটবেলায় সারাক্ষণ হীনম্মন্যতায় ভুগতেন! যাঁরা ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে ২৩ বছরের সুদর্শন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখেছেন, তারা কি কখনো ভাবতে পেরেছেন, এই মানুষটিই তরুণ বয়সে নিজের চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চমৎকার হাস্যরসের মধ্য দিয়ে শোনালের জীবনের কথা। অভিনয়জীবনের শুরুর দিকের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘অভিনয় যে করব, এই অঙ্গনের মানুষের ভালোবাসা কাড়ব, তা কখনো ভাবিনি। আমার ভেতরে একটা হীনম্মন্যতা ছিল। আর সেটা ছিল আমার চেহারা নিয়ে! একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতার মুখে এ কথা শুনে হয়তো হাসবেন। তবে এর কারণ ছিল। অল্প বয়সে টাইফয়েড হয়েছিল। খুব রুগ্ণ ছিলাম। বাড়ির লোকেরা বলত, ছেলেটা কালো, হ্যাংলা-পাতলা! ব্যঙ্গ করে প্রায়ই বলত, তোর তো চেহারা নেই। নাক-চোখ-মুখেরও তেমন সুন্দর আদল নেই। ছোটবেলায় তা শুনে সংকুচিত হতাম। খেলাধুলো খুব করতাম, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো ছিলাম না। ভালো ছাত্রও ছিলাম না। তবে আমার অভিনয় দেখে অনেকেরই ভালো বলত। অভিনয়ে তো নিজেকে আড়াল করা যায়। নিজেকে আড়াল করার জন্যই অভিনয়ে এসেছিলাম।’
সৌমিত্রের বাবা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় পেশায় উকিল হলেও ভালোবাসতেন আবৃত্তি, নাটক, গান। বাবার কণ্ঠে আবৃত্তি শুনেই ছেলেবেলা পার করেছেন সৌমিত্র। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার আবৃত্তি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কবিতা পড়লে তিনি দেখিয়ে দিতেন কীভাবে পড়তে হয়। কীভাবে সঠিক ও শুদ্ধ উচ্চারণ করতে হয়।’
আড্ডা-আলাপচারিতায় একে একে চলতে থাকে কৌতূহলোদ্দীপক নানা প্রশ্ন। আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যজন সৈয়দ হাসান ইমাম, নাট্যজন কেরামত মওলা, অভিনেতা ও নাট্যজন ড. ইনামুল হকসহ অনেকেই।
অভিনয়ের প্রেমে কীভাবে পড়লেন জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতায় বিখ্যাতদের অভিনয় দেখতাম ছোটবেলা থেকেই। শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। তারপর তাঁর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল। প্রায় তিন বছর তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। থিয়েটার নিয়ে আমার চিন্তাভাবনার ভিত তৈরি হয়েছিল তাঁর কাছ থেকেই। সত্যজিৎ রায় তখন ‘পথের পাঁচালী’ তৈরি করেছেন। এর সিক্যুয়াল ‘অপরাজিতা’ তৈরি করবেন তিনি। তাঁর এক সহকারীর কাছে শুনেছিলাম এসব। শিশিরকুমার ভাদুড়ি একদিন সত্যজিৎ রায়ের বাসায় নিয়ে যান। তখনই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে খানিকটা আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। তিনি যেন সারাক্ষণ মনে মনে অভিনেতাকে খুঁজতেন। চলচ্চিত্রের সঙ্গে মানানসই মুখ খুঁজতেন। আমি তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করি।’
কিছুক্ষণ পর হাসতে হাসতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘সামান্য পরিচয় ও দেখা-সাক্ষাতে আমাকে যে সত্যজিৎ রায় মনে রেখেছিলেন, সেটা ভাবতে পারিনি। তার পরের ছবি ছিল তৃতীয় সিক্যুয়াল ‘অপুর সংসার’। সেই চলচ্চিত্রের জন্য খুঁজছিলেন অভিনেতা। হঠাৎ একদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। নিজের গাড়ি করে নিয়ে গেলেন তাঁর অন্য একটি ছবির শুটিং দেখাতে। সেখানেই সত্যজিৎ রায় নামকরা অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যান। তাঁকে বলেন, এ হচ্ছে অপুর সংসারের অপু। এর আগ পর্যন্ত জানতাম না যে আমিই অপুর সংসারের অপু হব।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সবিনয়ে আমি জানতে চাই প্রথম ক্যামেরার সামনে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা। স্মৃতিচারণ করে সৌমিত্র বলেন, ‘মঞ্চে টুকটাক কাজ করলেও ক্যামেরার সামনে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। শিশিরকুমার ভাদুড়ির কাছেই প্রথম শুনেছিলাম যে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের কাজে কিছু তফাত থাকে। অবশ্য শিশিরকুমার নিজে চিত্রাভিনয়ে তেমন আকৃষ্ট হননি। তাঁর ভালো লাগেনি, মঞ্চেই চলে এসেছিলেন। চিত্রাভিনয়ের খুঁটিনাটি দিক নিয়ে তখন ভাবতাম। নিয়মিত চলচ্চিত্র দেখতাম। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিতা’ দেখলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম সত্যজিৎ রায়ের অভিনয়ের ধারা। বোঝার চেষ্টা করলাম তাঁর পরিচালনা ও ক্যামেরার কাজ। ফলে ‘অপুর সংসার’ করার আগে থেকেই সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কীভাবে কাজ করতে হবে, আমার ভেতরে তার একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়েছিল। ‘অপুর সংসার’-এর শুটিংয়ের অনেক আগে থেকেই সত্যজিৎ রায় আমাকে নিয়ে যেতেন নানা জায়গায়, বিভিন্ন বই পড়তে দিতেন, চলচ্চিত্র দেখতে বলতেন। তখন চিত্রনাট্যের খসড়াও আমাকে দিয়েছিলেন। চিত্রনাট্য পড়ে নিজের মতো প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। সত্যজিৎ রায় আগে থেকেই সব বোঝাচ্ছিলেন যেন ক্যামেরার সামনে আমার কোনো আড়ষ্টতা না থাকে। তখন তিনি আমার কিছু ক্যামেরার টেস্ট নিয়েছিলেন। ক্যামেরা জিনিসটা কী, চিনতে শিখিয়েছিলেন। ক্যামেরায় কীভাবে কাজ করতে হয় তা বুঝিয়েছিলেন। ফলে প্রথম শুটিং করতে গিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি।’
স্মৃতিময় আড্ডায় ও আলাপে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। আড্ডায় উঠে এল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কথাও। আলাপচারিতার এক ফাঁকে রামেন্দু মজুমদার বলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাট্যকার ও সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকার সম্পাদকও। কলকাতার বিখ্যাত ‘এক্ষণ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কবিতার চর্চা করছেন সেই ছোটবেলা থেকেই।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেকে আড়াল করার জন্য অভিনয়ে এসেছিলেন, কিন্তু কবিতায় কীভাবে এলেন—আমার এরকম প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘কবিতায় নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ এল কিশোর বয়সে। তখন মেয়েদের প্রতি ভালো লাগার ব্যাপারটা শুরু হয়। বিশেষ মেয়েকে ভালো লাগার বিষয়টা তো থাকে। তখন তো একটু হাত ধরতেও কত অপেক্ষা করতে হতো! নিজের কথা যেখানে বলা যাচ্ছে না, তার একটা উপায় হিসেবেই কবিতা লেখার শুরু। গোপন প্রেমিকার উদ্দেশ্যেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায় যেন হাসির ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায় সেমিনার হলে। একজন হাসতে হাসতে জানতে চান, যাকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লেখা শুরু, তাকে জীবনে পেয়েছিলেন কি?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও হাসির দীর্ঘ আভা ছড়িয়ে বলেন, যাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম, তাকে পেয়েছিলাম। তাঁর কথায় ও রসিকতায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলাম সবাই।
আমার এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে অতীতসাগরে ডুব দেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ডুবুরির মতো গভীর থেকে যেন তুলে আনেন তাঁর স্মৃতিগুচ্ছ। কবিতা লেখা ও বই পড়ার প্রতি নিজের ভালো লাগার কথা প্রকাশ করে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার ভেতরে কবিতা লেখার তাগিদ টের পাই ছোটবেলায়। অভিনয়, আবৃত্তি, কবিতা—এসব শুরু করেছিলাম পারিবারিক সুন্দর একটা আবহে। কবিতা লেখার আগে থেকেই অভিনয়টার প্রতি টান ছিল। আবৃত্তির প্রতি অনুরাগ ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি অভিনয় করছি, আবৃত্তি করছি। কেননা, আমাদের বাড়িতে থিয়েটারের চর্চা ছিল। আবৃত্তির চর্চাও ছিল। কিশোর বয়সে আমার মধ্যে কবিতা লেখার ঝোঁক এসেছিল। মোটামুটি ষোলো বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। বেশির ভাগ বাঙালি ছেলে যেমন কিশোর বয়সে কবিতা লেখে, তেমনই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। কিশোর বয়সে অধিকাংশ বাঙালি ছেলেই প্রেমে পড়লে কবিতা লেখে, আমিও তেমনভাবে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। অবশ্য এটার পেছনেও অনুপ্রেরণা ছিল পরিবার। আমাদের বাড়িতে সাহিত্যের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা ছিল। আমার দাদু সাহিত্যচর্চা করতেন। আমার বাবা-মা সাহিত্য খুব ভালোবাসতেন। ছোটবেলা থেকে আমাদের বইটই পড়ার কোনো বাধানিষেধ ছিল না। অনেক বাঙালির বাড়িতে নানা রকম বাধা থাকে বাইরের বই পড়ার।আমাদের বাড়িতে তা ছিল না। বলা যায়, আমাকে বেশ উৎসাহ দিতেন বাবা-মা। ছোটবেলা থেকেই আমি বইয়ের পোকা ছিলাম। প্রচুর ছড়া ও কবিতা পড়তাম।’
আলাপের এক ফাঁকে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নাটক সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতার নাটকের অবনমন হয়েছে। মান কমে গেছে। সিনেমারও একই অবস্থা। কলকাতায় এখন সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার রাজনীতিতে নোংরা জৌলুশ আছে। তরুণেরা বাংলা ভুলে যাচ্ছে, মিশ্র ভাষায় কথা বলছে। বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে কথা বলছে। বাঙালি জাতিটাকে টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশই। বাংলা ভাষাকে গৌরব দিয়েছে বাংলাদেশই।’
নাট্যজন কেরামত মওলার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনয় ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না। অভিনয়ই তো আমাকে রুটি-রুজি দিয়েছে। আমাকে খ্যাতি ও সম্মান দিয়েছে, বিপুল মানুষের ভালোবাসা দিয়েছে।’
অভিনয়ের পাশাপাশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাটকও লিখেছেন। নাটক লেখার বিষয়ে প্রশ্ন রামেন্দু মজুমদারের। উত্তরে গুণী এই অভিনেতা বলেন, ‘আসলে প্রয়োজনের তাগিদে নাটক লেখা শুরু করেছিলাম। নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিল রেখে জীবনের সঞ্চিত খাতায় অনেক নাটক লিখেছিলাম। কমবেশি অনেক নাটকই দর্শক ও শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে, মানুষের প্রশংসা পেয়েছে।’
নাটকের ভবিষ্যৎ কী—এমন প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিজ্ঞতা ও ত্যাগ কখনো বিফলে যায় না; যায়নি অতীতে, ভবিষ্যতেও যাবে না হয়তো। সেই সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের জীবনের সঙ্গে মিল রেখে কতটুকু প্রাসঙ্গিক আমাদের নাটক, সেটার ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করে। ভালো নাটক সব সময়ই বেঁচে থাকবে। ভালো নাটক মানুষ গ্রহণ করবেই।
একজন ভালো অভিনেতার গুণাবলি সম্পর্কে জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনেতা হওয়া সহজ নয়। বড় সাধনার বিষয়। ভালো অভিনেতার কাছে মানুষ বিষয়, সমাজ বিষয়, রাষ্ট্রও বিষয়। যে অভিনেতা শুধু আত্মপ্রদর্শন করে, তাকে আমার বড় অভিনেতা মনে হয় না। বড় অভিনেতা তার অভিনয়ে সমাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গ দেখায়, মানুষকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি ভাবতে শেখায়।’
টিভি, চলচ্চিত্র ও মঞ্চ—এসব জায়গায় অভিনয় করতে গিয়ে নিজেকে কি আলাদা করে তৈরি করতে হয়—নাট্যব্যক্তিত্ব কেরামত মওলার প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রথমত অভিনয়, তারপর পরিবেশ বুঝে উপস্থাপন। এতে আমি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। যিনি ছবি আঁকেন, তিনি ছোট ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন, বড় ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন। সে-ই সত্যিকার অভিনেতা, যে সমাজের ভাবনাচিন্তা, অবস্থা অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারে।’
আমাদের আলাপে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নানা দিকও। উঠে এসেছিল দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের কথাও। পাশাপাশি দুই দেশ, পাশাপাশি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। ভাষা এক, সংস্কৃতিও এক। তার পরও দূরত্ব রয়ে গেছে অনেক জায়গায়। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর পথে আরও একটি বিষয় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারত, তা হলো বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে দেখার ব্যবস্থা করা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে সেটি নেই। এ বিষয়ে আমার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলাদেশের নাটক, চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতিকে খুব মিস করি। সাংঘাতিকভাবে মিস করি। এ দেশের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকলেও এ রকম একটি প্রতিবন্ধকতার কারণে সেটা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। এটার উত্তরণ জরুরি।’
আড্ডার এক ফাঁকে আবৃত্তিশিল্পী ও নাট্যনির্দেশক গোলাম সারোয়ার জানতে চান অভিনয়ে আবৃত্তিচর্চার প্রয়োজন আছে কি না। সৌমিত্রের জবাব, ‘অভিনয়ের জন্য আবৃত্তিরও ভীষণ দরকার। যাঁরা এটা বোঝেন না, তাঁরা এখনো চোখ বুজে আছেন। অভিনয়ের প্রারম্ভিক কাজ হলো কথা বলা, সেটা আবৃত্তিচর্চা ছাড়া হয় না। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আবৃত্তি ও গান করি। প্রতিদিন রেওয়াজ করি, সাধনা করি। জীবনে সফল হতে হলে তার কাজকে সাধনার পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা অভিনয় হোক, আর আবৃত্তি হোক কিংবা যেকোনো মাধ্যমই হোক। একজন অভিনেতাকে চার অক্ষরের একটি শব্দ আঁকড়ে রাখতে হয়, সেটা হলো ভালোবাসা। নিজের কাজের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা থাকতে হবে। নিজের কাজ ও দায়িত্বের প্রতি ভালোবাসাই মানুষকে সাফল্য এনে দেয়, পৌঁছে দেয় সঠিক অবস্থানে। ভালোবাসা ছাড়া কিচ্ছু হয় না, হবেও না।’

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে। উপস্থিত হয়েছিলাম আমরা কয়েকজন সাংবাদিক ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ। ঠিক সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে দৃপ্ত পায়ে উপস্থিত হলেন এক চিরসবুজ নায়ক। পরনে তাঁর জিনস প্যান্ট, নীল রঙের হাফহাতা শার্ট। সৌম্যকান্তি চেহারার ৮০ পেরোনো সেই তরুণের নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়! সেমিনার হলে ঢুকেই তিনি বললেন, ‘সুপ্রভাত! বাংলাদেশে এলেই মনটা ভালো হয়ে যায় আমার। কেননা, এই বাংলাদেশের সাথেই তো আমার নাড়ির সংযোগ। তাই সব সময়ই এ দেশের প্রতি নাড়ির টান অনুভব করি।’
অভিনয় কিংবা আবৃত্তি করতে নয়, আমাদের সঙ্গে আলাপচারিতা, বলা যায় আড্ডা দিতেই শিল্পকলা একাডেমিতে হাজির হয়েছিলেন দুই বাংলার কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেদিন সেই আলাপচারিতায়, আড্ডায় প্রাণোচ্ছল ভঙ্গিমায় তিনি বলেছিলেন তাঁর ব্যক্তি ও শিল্পীজীবনের নানা অজানা কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ভালোবাসার কথা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগের কথা। বলেছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্র, নাটক, সংস্কৃতি নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা।
১৯৫৯ সালে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে অভিনয়জগতে পথচলা শুরু করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তারপর ইতিহাস, তাঁর হিরণ্ময় পথচলা। বিস্ময়কর সাফল্য, মুগ্ধকর সব অর্জন। সৌমিত্র প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করেছিলেন, যার ফলে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, শুধুই সামনে চলা শুরু হয়ে যায় তাঁর। শুরু হয়ে যায় শিল্পের নানা মাধ্যমে তাঁর পদচারণ। সৌমিত্রের সেই পথচলা থেমে যায় ২০২০ সালের এই দিনে। আজ ১৫ নভেম্বর, মঙ্গলবার তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। দুই শতাধিক চলচ্চিত্র, নাটকে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র, মঞ্চ নাটক, টিভি নাটকসহ শিল্পের নানা মাধ্যমে কাজ করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ ও ভারতের সুধী মহলে উচ্চ প্রশংসিত তাঁর নাট্যাভিনয়, পরিচালনা ও রচনা। অভিনয়, আবৃত্তির পাশাপাশি তিনি একজন কবিও। তাঁর কাব্যচর্চার ফসল পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন, কাজ করেছেন শিল্প-সংস্কৃতির নানা অঙ্গনে। অভিনয়ের জন্য ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন। দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডিলিটসহ নানা পুরস্কার। ফরাসি সরকারের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩ বছর। তরুণ বয়সে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সময় সৌমিত্র যতটা আকর্ষণীয় ছিলেন, ৮০ বছর বয়সে ‘অহল্যা’ শর্ট ফিল্মে অভিনয়েও ততটাই। কী চমৎকার করে যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কথা বলতেন, কী শুদ্ধভাবে ও সঠিক উচ্চারণে! আহা! আমরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনেছিলাম, তন্ময় হয়ে তাঁকে দেখেছিলাম। কিংবদন্তি অভিনেতার সান্নিধ্য পেয়ে আনন্দ-আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম।
পরিচয়ের পর্ব শেষে শুরু হয় আড্ডা ও আলাপন। ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা ১১টায়। আমাদের আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। সূচনা পর্বে গোলাম কুদ্দুছ ভাই প্রশ্ন করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। পর্যায়ক্রমে আমি তাঁকে নানা প্রশ্ন করি, প্রশ্ন করে আমার কয়েকজন বন্ধু ও কয়েকজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও।
পাক্কা দুই ঘণ্টার আলাপচারিতা। মাঝে চা-কফির আপ্যায়ন। মাঝেমধ্যে হাস্যরস, কৌতুক, সিরিয়াস সব কথাবার্তাও। আড্ডা-আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মেলে ধরেন নিজের মনের জানালা, খুলে দেন তাঁর ঘরে-বাইরের চালচিত্র। উন্মোচন করে যেন ঢেলে দেন কথার ফোয়ারা।
গোলাম কুদ্দুছ ভাইয়ের প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার বাবা একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর। কিন্তু তখনো অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্নটি ওঠেনি। এ কারণেই হয়তো বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন বাবা। কিন্তু একান্ত নিমগ্নতায় বাবাকে অভিনয় আর আবৃত্তিটাই করতে দেখেছি। প্রথম জীবনে বাবার কাছ থেকেই আবৃত্তি শিখেছি। বাবা আমাকে বোঝাতেন কীভাবে অভিনয় করতে হয়, আবৃত্তি করতে হয়। ছোটবেলায় বাবা জোরে উচ্চারণ করে বোঝাতেন সঠিক উচ্চারণবিধি, বোঝাতেন আবৃত্তির কলাকৌশল। মূলত বাবাকে দেখেই একসময় অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। পরে কলকাতায় শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। তারপর তো অভিনয় হয়ে ওঠে আমার জীবনের আরাধ্য।’
আপনি যদি অভিনেতা না হতেন, তাহলে কী হতেন—আমার এ রকম সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘চলচ্চিত্র ও মঞ্চ দুটিই আমার প্রিয় মাধ্যম। অভিনেতা পরিচয়ই প্রধান পরিচয়। যদি আমি অভিনয় না করতাম, অভিনেতা না হতাম, তাহলে হয়তো আবৃত্তিকার হতাম। কিংবা কবি ও লেখক হতাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে একজন চমৎকার আবৃত্তিশিল্পী ও কবি, সেটা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি শিশুর মতো স্বর্গীয় হাসিতে উজ্জ্বল করে দেন শিল্পকলা একাডেমির ছোট্ট সেমিনার হল। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘আমি কবিতা লিখতে পছন্দ করি, কবিতা আবৃত্তি করতেও পছন্দ করি। কিন্তু আমাকে তো সবাই চেনে অভিনেতা হিসেবেই। কবি হিসেবে তো নামডাক নেই!’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাকি ছোটবেলায় সারাক্ষণ হীনম্মন্যতায় ভুগতেন! যাঁরা ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে ২৩ বছরের সুদর্শন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখেছেন, তারা কি কখনো ভাবতে পেরেছেন, এই মানুষটিই তরুণ বয়সে নিজের চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চমৎকার হাস্যরসের মধ্য দিয়ে শোনালের জীবনের কথা। অভিনয়জীবনের শুরুর দিকের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘অভিনয় যে করব, এই অঙ্গনের মানুষের ভালোবাসা কাড়ব, তা কখনো ভাবিনি। আমার ভেতরে একটা হীনম্মন্যতা ছিল। আর সেটা ছিল আমার চেহারা নিয়ে! একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতার মুখে এ কথা শুনে হয়তো হাসবেন। তবে এর কারণ ছিল। অল্প বয়সে টাইফয়েড হয়েছিল। খুব রুগ্ণ ছিলাম। বাড়ির লোকেরা বলত, ছেলেটা কালো, হ্যাংলা-পাতলা! ব্যঙ্গ করে প্রায়ই বলত, তোর তো চেহারা নেই। নাক-চোখ-মুখেরও তেমন সুন্দর আদল নেই। ছোটবেলায় তা শুনে সংকুচিত হতাম। খেলাধুলো খুব করতাম, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো ছিলাম না। ভালো ছাত্রও ছিলাম না। তবে আমার অভিনয় দেখে অনেকেরই ভালো বলত। অভিনয়ে তো নিজেকে আড়াল করা যায়। নিজেকে আড়াল করার জন্যই অভিনয়ে এসেছিলাম।’
সৌমিত্রের বাবা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় পেশায় উকিল হলেও ভালোবাসতেন আবৃত্তি, নাটক, গান। বাবার কণ্ঠে আবৃত্তি শুনেই ছেলেবেলা পার করেছেন সৌমিত্র। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার আবৃত্তি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কবিতা পড়লে তিনি দেখিয়ে দিতেন কীভাবে পড়তে হয়। কীভাবে সঠিক ও শুদ্ধ উচ্চারণ করতে হয়।’
আড্ডা-আলাপচারিতায় একে একে চলতে থাকে কৌতূহলোদ্দীপক নানা প্রশ্ন। আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যজন সৈয়দ হাসান ইমাম, নাট্যজন কেরামত মওলা, অভিনেতা ও নাট্যজন ড. ইনামুল হকসহ অনেকেই।
অভিনয়ের প্রেমে কীভাবে পড়লেন জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতায় বিখ্যাতদের অভিনয় দেখতাম ছোটবেলা থেকেই। শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। তারপর তাঁর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল। প্রায় তিন বছর তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। থিয়েটার নিয়ে আমার চিন্তাভাবনার ভিত তৈরি হয়েছিল তাঁর কাছ থেকেই। সত্যজিৎ রায় তখন ‘পথের পাঁচালী’ তৈরি করেছেন। এর সিক্যুয়াল ‘অপরাজিতা’ তৈরি করবেন তিনি। তাঁর এক সহকারীর কাছে শুনেছিলাম এসব। শিশিরকুমার ভাদুড়ি একদিন সত্যজিৎ রায়ের বাসায় নিয়ে যান। তখনই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে খানিকটা আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। তিনি যেন সারাক্ষণ মনে মনে অভিনেতাকে খুঁজতেন। চলচ্চিত্রের সঙ্গে মানানসই মুখ খুঁজতেন। আমি তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করি।’
কিছুক্ষণ পর হাসতে হাসতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘সামান্য পরিচয় ও দেখা-সাক্ষাতে আমাকে যে সত্যজিৎ রায় মনে রেখেছিলেন, সেটা ভাবতে পারিনি। তার পরের ছবি ছিল তৃতীয় সিক্যুয়াল ‘অপুর সংসার’। সেই চলচ্চিত্রের জন্য খুঁজছিলেন অভিনেতা। হঠাৎ একদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। নিজের গাড়ি করে নিয়ে গেলেন তাঁর অন্য একটি ছবির শুটিং দেখাতে। সেখানেই সত্যজিৎ রায় নামকরা অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের কাছে নিয়ে যান। তাঁকে বলেন, এ হচ্ছে অপুর সংসারের অপু। এর আগ পর্যন্ত জানতাম না যে আমিই অপুর সংসারের অপু হব।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সবিনয়ে আমি জানতে চাই প্রথম ক্যামেরার সামনে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা। স্মৃতিচারণ করে সৌমিত্র বলেন, ‘মঞ্চে টুকটাক কাজ করলেও ক্যামেরার সামনে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। শিশিরকুমার ভাদুড়ির কাছেই প্রথম শুনেছিলাম যে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের কাজে কিছু তফাত থাকে। অবশ্য শিশিরকুমার নিজে চিত্রাভিনয়ে তেমন আকৃষ্ট হননি। তাঁর ভালো লাগেনি, মঞ্চেই চলে এসেছিলেন। চিত্রাভিনয়ের খুঁটিনাটি দিক নিয়ে তখন ভাবতাম। নিয়মিত চলচ্চিত্র দেখতাম। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিতা’ দেখলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম সত্যজিৎ রায়ের অভিনয়ের ধারা। বোঝার চেষ্টা করলাম তাঁর পরিচালনা ও ক্যামেরার কাজ। ফলে ‘অপুর সংসার’ করার আগে থেকেই সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কীভাবে কাজ করতে হবে, আমার ভেতরে তার একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়েছিল। ‘অপুর সংসার’-এর শুটিংয়ের অনেক আগে থেকেই সত্যজিৎ রায় আমাকে নিয়ে যেতেন নানা জায়গায়, বিভিন্ন বই পড়তে দিতেন, চলচ্চিত্র দেখতে বলতেন। তখন চিত্রনাট্যের খসড়াও আমাকে দিয়েছিলেন। চিত্রনাট্য পড়ে নিজের মতো প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। সত্যজিৎ রায় আগে থেকেই সব বোঝাচ্ছিলেন যেন ক্যামেরার সামনে আমার কোনো আড়ষ্টতা না থাকে। তখন তিনি আমার কিছু ক্যামেরার টেস্ট নিয়েছিলেন। ক্যামেরা জিনিসটা কী, চিনতে শিখিয়েছিলেন। ক্যামেরায় কীভাবে কাজ করতে হয় তা বুঝিয়েছিলেন। ফলে প্রথম শুটিং করতে গিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি।’
স্মৃতিময় আড্ডায় ও আলাপে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। আড্ডায় উঠে এল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কথাও। আলাপচারিতার এক ফাঁকে রামেন্দু মজুমদার বলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাট্যকার ও সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকার সম্পাদকও। কলকাতার বিখ্যাত ‘এক্ষণ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কবিতার চর্চা করছেন সেই ছোটবেলা থেকেই।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেকে আড়াল করার জন্য অভিনয়ে এসেছিলেন, কিন্তু কবিতায় কীভাবে এলেন—আমার এরকম প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র বলেন, ‘কবিতায় নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ এল কিশোর বয়সে। তখন মেয়েদের প্রতি ভালো লাগার ব্যাপারটা শুরু হয়। বিশেষ মেয়েকে ভালো লাগার বিষয়টা তো থাকে। তখন তো একটু হাত ধরতেও কত অপেক্ষা করতে হতো! নিজের কথা যেখানে বলা যাচ্ছে না, তার একটা উপায় হিসেবেই কবিতা লেখার শুরু। গোপন প্রেমিকার উদ্দেশ্যেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম।’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায় যেন হাসির ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায় সেমিনার হলে। একজন হাসতে হাসতে জানতে চান, যাকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লেখা শুরু, তাকে জীবনে পেয়েছিলেন কি?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও হাসির দীর্ঘ আভা ছড়িয়ে বলেন, যাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম, তাকে পেয়েছিলাম। তাঁর কথায় ও রসিকতায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলাম সবাই।
আমার এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে অতীতসাগরে ডুব দেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ডুবুরির মতো গভীর থেকে যেন তুলে আনেন তাঁর স্মৃতিগুচ্ছ। কবিতা লেখা ও বই পড়ার প্রতি নিজের ভালো লাগার কথা প্রকাশ করে সৌমিত্র বলেন, ‘আমার ভেতরে কবিতা লেখার তাগিদ টের পাই ছোটবেলায়। অভিনয়, আবৃত্তি, কবিতা—এসব শুরু করেছিলাম পারিবারিক সুন্দর একটা আবহে। কবিতা লেখার আগে থেকেই অভিনয়টার প্রতি টান ছিল। আবৃত্তির প্রতি অনুরাগ ছিল। ছোটবেলা থেকেই আমি অভিনয় করছি, আবৃত্তি করছি। কেননা, আমাদের বাড়িতে থিয়েটারের চর্চা ছিল। আবৃত্তির চর্চাও ছিল। কিশোর বয়সে আমার মধ্যে কবিতা লেখার ঝোঁক এসেছিল। মোটামুটি ষোলো বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। বেশির ভাগ বাঙালি ছেলে যেমন কিশোর বয়সে কবিতা লেখে, তেমনই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। কিশোর বয়সে অধিকাংশ বাঙালি ছেলেই প্রেমে পড়লে কবিতা লেখে, আমিও তেমনভাবে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। অবশ্য এটার পেছনেও অনুপ্রেরণা ছিল পরিবার। আমাদের বাড়িতে সাহিত্যের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা ছিল। আমার দাদু সাহিত্যচর্চা করতেন। আমার বাবা-মা সাহিত্য খুব ভালোবাসতেন। ছোটবেলা থেকে আমাদের বইটই পড়ার কোনো বাধানিষেধ ছিল না। অনেক বাঙালির বাড়িতে নানা রকম বাধা থাকে বাইরের বই পড়ার।আমাদের বাড়িতে তা ছিল না। বলা যায়, আমাকে বেশ উৎসাহ দিতেন বাবা-মা। ছোটবেলা থেকেই আমি বইয়ের পোকা ছিলাম। প্রচুর ছড়া ও কবিতা পড়তাম।’
আলাপের এক ফাঁকে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নাটক সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘কলকাতার নাটকের অবনমন হয়েছে। মান কমে গেছে। সিনেমারও একই অবস্থা। কলকাতায় এখন সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার রাজনীতিতে নোংরা জৌলুশ আছে। তরুণেরা বাংলা ভুলে যাচ্ছে, মিশ্র ভাষায় কথা বলছে। বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে কথা বলছে। বাঙালি জাতিটাকে টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশই। বাংলা ভাষাকে গৌরব দিয়েছে বাংলাদেশই।’
নাট্যজন কেরামত মওলার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনয় ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না। অভিনয়ই তো আমাকে রুটি-রুজি দিয়েছে। আমাকে খ্যাতি ও সম্মান দিয়েছে, বিপুল মানুষের ভালোবাসা দিয়েছে।’
অভিনয়ের পাশাপাশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাটকও লিখেছেন। নাটক লেখার বিষয়ে প্রশ্ন রামেন্দু মজুমদারের। উত্তরে গুণী এই অভিনেতা বলেন, ‘আসলে প্রয়োজনের তাগিদে নাটক লেখা শুরু করেছিলাম। নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিল রেখে জীবনের সঞ্চিত খাতায় অনেক নাটক লিখেছিলাম। কমবেশি অনেক নাটকই দর্শক ও শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে, মানুষের প্রশংসা পেয়েছে।’
নাটকের ভবিষ্যৎ কী—এমন প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিজ্ঞতা ও ত্যাগ কখনো বিফলে যায় না; যায়নি অতীতে, ভবিষ্যতেও যাবে না হয়তো। সেই সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের জীবনের সঙ্গে মিল রেখে কতটুকু প্রাসঙ্গিক আমাদের নাটক, সেটার ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করে। ভালো নাটক সব সময়ই বেঁচে থাকবে। ভালো নাটক মানুষ গ্রহণ করবেই।
একজন ভালো অভিনেতার গুণাবলি সম্পর্কে জানতে চাইলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘অভিনেতা হওয়া সহজ নয়। বড় সাধনার বিষয়। ভালো অভিনেতার কাছে মানুষ বিষয়, সমাজ বিষয়, রাষ্ট্রও বিষয়। যে অভিনেতা শুধু আত্মপ্রদর্শন করে, তাকে আমার বড় অভিনেতা মনে হয় না। বড় অভিনেতা তার অভিনয়ে সমাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গ দেখায়, মানুষকে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি ভাবতে শেখায়।’
টিভি, চলচ্চিত্র ও মঞ্চ—এসব জায়গায় অভিনয় করতে গিয়ে নিজেকে কি আলাদা করে তৈরি করতে হয়—নাট্যব্যক্তিত্ব কেরামত মওলার প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রথমত অভিনয়, তারপর পরিবেশ বুঝে উপস্থাপন। এতে আমি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। যিনি ছবি আঁকেন, তিনি ছোট ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন, বড় ক্যানভাসেও আঁকতে পারেন। সে-ই সত্যিকার অভিনেতা, যে সমাজের ভাবনাচিন্তা, অবস্থা অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারে।’
আমাদের আলাপে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নানা দিকও। উঠে এসেছিল দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের কথাও। পাশাপাশি দুই দেশ, পাশাপাশি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। ভাষা এক, সংস্কৃতিও এক। তার পরও দূরত্ব রয়ে গেছে অনেক জায়গায়। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর পথে আরও একটি বিষয় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারত, তা হলো বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে দেখার ব্যবস্থা করা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে সেটি নেই। এ বিষয়ে আমার এক প্রশ্নের জবাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলাদেশের নাটক, চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতিকে খুব মিস করি। সাংঘাতিকভাবে মিস করি। এ দেশের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকলেও এ রকম একটি প্রতিবন্ধকতার কারণে সেটা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। এটার উত্তরণ জরুরি।’
আড্ডার এক ফাঁকে আবৃত্তিশিল্পী ও নাট্যনির্দেশক গোলাম সারোয়ার জানতে চান অভিনয়ে আবৃত্তিচর্চার প্রয়োজন আছে কি না। সৌমিত্রের জবাব, ‘অভিনয়ের জন্য আবৃত্তিরও ভীষণ দরকার। যাঁরা এটা বোঝেন না, তাঁরা এখনো চোখ বুজে আছেন। অভিনয়ের প্রারম্ভিক কাজ হলো কথা বলা, সেটা আবৃত্তিচর্চা ছাড়া হয় না। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আবৃত্তি ও গান করি। প্রতিদিন রেওয়াজ করি, সাধনা করি। জীবনে সফল হতে হলে তার কাজকে সাধনার পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা অভিনয় হোক, আর আবৃত্তি হোক কিংবা যেকোনো মাধ্যমই হোক। একজন অভিনেতাকে চার অক্ষরের একটি শব্দ আঁকড়ে রাখতে হয়, সেটা হলো ভালোবাসা। নিজের কাজের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা থাকতে হবে। নিজের কাজ ও দায়িত্বের প্রতি ভালোবাসাই মানুষকে সাফল্য এনে দেয়, পৌঁছে দেয় সঠিক অবস্থানে। ভালোবাসা ছাড়া কিচ্ছু হয় না, হবেও না।’

আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
১২ দিন আগে
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
২২ দিন আগে
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫তৌহিদুল হক

রক্ত লাল
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে
গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়
ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের
জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে
রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে
প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা
উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।
কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত
শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।
এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়
দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব
মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।
এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ
ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার
অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে
ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে
বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।
যত দেখি
যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে
জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা
শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।
যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।
হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।
যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।
ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত
করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!
সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।
জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ
আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।
তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে
অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই
কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার
প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।
এ যেন কেমন
গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে
চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে
একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির
মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে
এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ
কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা
আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।
সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে
নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার
অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।
জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?
চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার
যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।
চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?
যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!
চলে আসুন সবজি বাজারে
মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু
যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার
উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে
হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।
প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো
পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?
হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে
যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!
চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা
ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।
যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।
আহা! দেখার কেউ নেই!
এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।
কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ
কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?
কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।
চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।
ইতিহাস
আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই
নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব
ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।
আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---
আমি নই কারও!
সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম
ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে
অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ
ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু
এক মুখচ্ছবি।
আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে
হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার
কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।
কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।
দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!
আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না
হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে
ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে
সবকিছুর-ই সময় থাকে---
এরপর---ইতিহাস!

রক্ত লাল
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে
গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়
ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের
জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে
রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে
প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা
উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।
কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত
শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।
এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়
দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব
মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।
এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ
ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার
অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে
ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে
বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।
যত দেখি
যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে
জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা
শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।
যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।
হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।
যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।
ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত
করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!
সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।
জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ
আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।
তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে
অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই
কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার
প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।
এ যেন কেমন
গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে
চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে
একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির
মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে
এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ
কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা
আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।
সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে
নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার
অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।
জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?
চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার
যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।
চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?
যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!
চলে আসুন সবজি বাজারে
মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু
যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার
উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে
হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।
প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো
পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?
হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে
যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!
চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা
ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।
যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।
আহা! দেখার কেউ নেই!
এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।
কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ
কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?
কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।
চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।
ইতিহাস
আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই
নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব
ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।
আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---
আমি নই কারও!
সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম
ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে
অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ
ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু
এক মুখচ্ছবি।
আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে
হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার
কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।
কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।
দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!
আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না
হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে
ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে
সবকিছুর-ই সময় থাকে---
এরপর---ইতিহাস!

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে।
১৫ নভেম্বর ২০২২
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
২২ দিন আগে
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’
‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’
হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,
‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।
হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।
তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’
ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’
হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’
‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’
হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,
‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।
হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।
তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’
ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’
হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে।
১৫ নভেম্বর ২০২২
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
১২ দিন আগে
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে।
১৫ নভেম্বর ২০২২
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
১২ দিন আগে
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
২২ দিন আগে
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫আজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

সেই দিনের কথা, সেই সকালের কথা মাঝেমধ্যেই জ্বলজ্বল করে মনে। সেদিন ছিল শুক্রবার, ২০১৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টায় আসার কথা তাঁর। তবে এর আগেই আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে।
১৫ নভেম্বর ২০২২
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
১২ দিন আগে
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
২২ দিন আগে
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫