রাকিব হাসান

সিআর-৭ ফ্রি-কিক নিচ্ছে। ডি-বক্সের সামান্য বাইরে ডান পাশ থেকে। কিকের আগে তার সেই ট্রেডমার্ক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা দেখতে মন্দ লাগে না। এ দিকে, আমার ঠোঁটে সিগারেট অর্ধেকটা পুড়ে ছাই। রোনালদোর ফ্রি-কিক বেপথু হয়নি। রক্ষণভাগে থাকা প্রহরীদের মাথার ওপর দিয়ে বলটা কেমন যেন নেচে উঠল। বারের ঠিক কোনা দিয়ে পর্তুগিজ সেনার লেখা ঠিকানায় পৌঁছে গেল বলটি। রোনালদোরা ১-০ তে এগিয়ে গেছে। পাশ থেকে কে যেন ‘গোল’ বলে খানিক শব্দও করল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমাদের দেশে এমন নিখুঁত ফুটবল কবে হবে!
গোল্ডলিফে শেষ টানটা দিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে কটা বাজে দেখলাম। এক কাপ চা হলে ভালো হয়। টেলিভিশনে চোখ রেখেই দোকানিকে বললাম, ‘মামা, দুধ বাড়ায়া ছোট করে একটা চা দাও।’
লঞ্চ ছাড়বে রাত ঠিক ১২টা ৩০। কাঁধের ব্যাগ খানিক পরপর ঝুলে যাচ্ছে। বেচারা মনে হয় আমার কাঁধে ঝুলে আরাম পাচ্ছে না! ঠিক তোমার মতো। হাতে সময় এখনো ঘণ্টাখানেক। ঘাটের ভেতর আরও পরে ঢুকব বলে মনস্থির করলাম। ততক্ষণ কী করা যায় ভাবছি। এত রাত; সদরঘাট এলাকা ছেড়ে এদিক-সেদিক ঘোরার উপায় নেই। দেশের অবস্থা বেহাল। ছিনতাইকারী না ধরলেও পুলিশের খপ্পরে পড়া নিশ্চিত!
দোকানের বাইরে থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না খেলা লাইভ নাকি পুরোনো। দোকানি খদ্দর বিদায় করতে গিয়ে চ্যানেল পাল্টাতে ভুলে গেছে হয়তো! আবার দারুণ ফুটবলপ্রেমীও হতে পারে। ব্যাপারটা এই পরিবেশের সাথে যায় না আসলে। কলকাতা সিনেমার কোনো গান কিংবা বেবি ডল হলে জমত। চারদিকের হাজার হাজার ওয়াটের বাতিগুলো পরিবেশে একটা উৎসব ভাব এনেছে।
ইতিউতি দেখতেই ১৮-২০, আবার ২১-২২ বছরও হতে পারে। এখনকার মেয়েদের বয়স ঠাওর করা কঠিন হ্যাপার কাজ। জিনস আর টিশার্টে বেশ লাগছে মেয়েটাকে। কে জানে? কাছে গেলে দেখা যাবে, ভালো লাগা উবে গেছে কিংবা গলার স্বর শুনে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে! অগত্যা টিভিতেই তাকালাম। খেলা অনেকটা শেষের দিকে। রোনালদোর দল আরও এক গোল দিল বোধয়।
দোকানি ঠিকঠাক চা করে সামনে রেখেছে, আমার সেদিকে খেয়াল নেই। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবার মেয়েটির দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে পাশ করে দাঁড়িয়ে। বেশ আঁটসাঁট টিশার্টে তার শারীরিক অস্তিত্ব স্পষ্ট জানান দিচ্ছে। ওইদিকে এর-ওর নজরও পড়ছে। মেয়েটিও সেটা খেয়াল করছে বলে মনে হলো। তবে সে নির্লিপ্ত। হয়তো ভাবছে ক্ষতি কী? বাসন্তী বাতাসে তার কাঁধ পর্যন্ত নামা অবাধ্য খোলা চুলগুলো শুকনো খড়ের মতো উড়ছে। একটু পরপর সেগুলো ঠিক করছে সে। আর এমন ভাব করছে, পারলে দু–চার কথা শুনিয়ে দেয় যেন! গালে হালকা মেকআপের কারুকাজ তাকে বেশ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। কমলার কোয়ার মতো ঠোঁটে গোলাপি রঙের ম্যাট লিপস্টিক, আর গাঢ় কাজল দিয়ে চোখ দুটিকে ডাগর করার সফল চেষ্টা। বেশ গোছালো।
তার টিশার্টে ঠিক বুকের ওপর কী যেন লেখা। শেষের শব্দটি দেখতে পাচ্ছি পাশ থেকে, ‘এট মি’। কী হতে পারে পুরো বাক্যটি! ‘ডোন্ট লুক এট মি’, ‘লুক এট মি’ নাকি অন্য কিছু। কিছুক্ষণ ফিল ইন দ্য গ্যাপ পূরণের খেলা খেললাম।
তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এক্সকিউজ মি। আপনি কী একা...? কারও জন্য অপেক্ষা করছেন? লঞ্চে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই। ইয়ে মানে...আমিও একা। লঞ্চে একা জার্নি করা বিরক্তিকর। আপনি চাইলে আমি আপনাকে সঙ্গ দিতে পারি। আমার সঙ্গ খারাপ লাগবে না, গ্যারান্টি।’ দৃশ্যটি কল্পনা করতেই বুকের ভেতর পালপিটেশন বেড়ে গেছে।
হা. . হা...নিজের মনেই হেসে ফেললাম। এতটা বেহায়া কী হওয়া যায়!
এসব ভাবনা যখন মস্তিষ্কের এ গলি ও গলি ছুটছে, তখনই নজর পড়ল বাঁ পাশে থাকা আরেক রমণীর দিকে। ভাগ্যদেবী শুধু মুখ তুলেই আমার দিকে তাকায়নি; একেবারে কোলে নিয়ে বসেছে বোধয়। তা না হলে আমার মতো এহেন অভাগার বাঁ-ডানে দুই সুন্দরী। এ যেন কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরি দশা! আচ্ছা, দুজনের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী? নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম যেন। সুন্দরের সংজ্ঞাই বা কী? স্বয়ং কবিগুরু পর্যন্ত সুন্দরের সংজ্ঞা দিতে পারেননি। ‘মুই কী হনুরে!’
তুলনা করা যেতে পারে। প্রথম জন; মানে জিনস আর টিশার্ট পরা তরুণীর মধ্যে আবিষ্কার করার কিছু নেই। অনেকটা ওপেন সিক্রেট। তবে তার পোশাকের কারণে শরীরের প্রত্যেকটি ভাঁজ রহস্য তৈরি করেছে। কেমন যেন ঢেউ খেলে গেছে কোনো কোনো জায়গায়। আর সাঁতার প্রিয় কেউ এমন শান্ত ঢেউয়ে সাঁতার কাটতে আরাম পাবেন নিশ্চিত! তার অবস্থা এমন যেন, মধ্যবিত্ত ঘরে মেজবান আসা উপলক্ষে বিছানায় অনেক দিন পর বের করা বালিশের কভার, চাদর। টি-টেবিলে ভাঁজ না ভাঙা টেবিলক্লথ, দেয়ালের একপাশে রবীন্দ্র-নজরুল কিংবা ম্যারাডোনার কোনো ছবি ঝোলানো। অন্যপাশে দেয়াল ঘড়িটা তার কাজ করে যাচ্ছে টিকটিক করে। ক্যালেন্ডারের পাতাও ঠিকভাবে ওলটানো। দেখেই বোঝা যায় সব পরিকল্পনা মতো সাজিয়ে রাখা।
দ্বিতীয় জন; যার পরনে হালকা কচু পাতা রঙের শিফন শাড়ি। বেশ খানিকটা অগোছালো। আঁচলে প্লিট করা নেই, উঁচু বুকের ওপর এমনি ফেলে রাখা হয়েছে। চওড়া কাঁধ আর বেশ খানিকটা খোলা পিঠ বেয়ে চুলের বেনীটাও ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। শাড়ির বুননে লুকিয়ে থাকা কোমরের খাঁজে হালকা মেদ আর উঁকি মারা তকতকে পেট তাকে আরও যেন নরম তুলতুলে করে তুলেছে। চোখ পড়তেই যেন ছুঁতে মন চায়।
বড়লোকের ড্রয়িং রুমের মতো সবই আছে। ইতালিয়ান ফিটিংস, দেয়ালে দামি পেইন্টিং, দামি সোফা, শুধু অতিথি আসবে বলে গোছানোর সময় পায়নি কেউ। কিংবা ফাঁকিবাজ কাজের লোকের কাছে যে অতিথি আসবেন, তার কোনো দামই নেই।
কী নেই মেয়েটির মাঝে? খোলা পিঠ, চওড়া কাঁধ, উঁচু বুক, ভারী নিতম্ব, গাছপাকা পেয়ারার মতো গায়ের রং। সবই আছে, আমি কবি-সাহিত্যিক হলে আরও ভালো বলতে পারতাম হয়তো। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে, তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে বেশ খানিকটা পরিশ্রম করতে হবে। অথবা জহুরির চোখ লাগবে। শরীর বেয়ে তার মুখে উঠলাম। ওর চোখ আমার চোখ একটু কথা বলে নিল যেন। কিন্তু কেউ কারও কথা বুঝলাম না। চোখ দু’টি; আহা...ঠিক যেন চৈত্রের ভোরে বাঁধানো দিঘির শান্ত পানি। ইচ্ছে হচ্ছে এখনই ডুব মারি।
একটু স্মৃতিমেদুর হলাম; এই চোখই সব শেষ করল আমার।
একই অফিসে যখন ছিলাম তখন তোমার চোখ আর আমার চোখ সারা বেলাই গুটুরগুটুর আলাপ করত। একদিন লিফটের ভেতর তুমি মোবাইল নম্বর চেয়ে নিলে। পরে ফোন দেবে আমি ভাবিনি।
কোনো এক রাতে তুমি ফোন দিয়েছিলে এবং আমাদের সারা রাত কথা হয় সেদিন। আমার ফোনে ব্যালেন্স ছিল না। তোমারই তিন-চারটা নম্বর। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছর কেটে গেল। হাত ধরে সারা ঢাকা চষে বেড়িয়েছি। কখনো ঘণ্টা চুক্তিতে রিকশা, কখনো দুই পা-ই ছিল ভরসা। কখনো নীলক্ষেতের ঘুপচি দোকান, কখনো আবার শহরের দামি কোনো রেস্তোরাঁ। আমার এই রুগ্ণ কাঁধে মাথা রেখে কত বিকেল পার করেছ তার ইয়ত্তা নেই। মাঝে মধ্যে একান্তে কিছু সময় কাটাতে আমার ভাড়া বাসার ছোট্ট রুম ছাড়াও আশ্রয় নিতে এর ওর বাসায়। পোষা বিড়াল ছানার মতো তোমায় কোলে নিয়ে রাত পার করে দিয়েছি কত। তুমি ঘুমাতে আর আমি তোমার বন্ধ চোখে স্বপ্ন দেখতাম। মাঝেমধ্যে ঘামে ভিজে যাওয়া তোমার শরীরের নেশা ধরা গন্ধে মাদকের স্বাদ নিতে নিতে নিজেই ঘুমিয়ে পড়তাম। রাত পোহালে তোমার শুকনো ঠোঁটের ছোঁয়ায় অদ্ভুত রকমের ভালো লাগায় কেঁপে উঠতাম। আর জেগে উঠে তোমাকে আবিষ্কারের কঠোর পরিশ্রম। প্রথম প্রহরের সেই শারীরিক ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশের শব্দ আমার ঝাঁপিতে নেই, সত্যি বলছি।
চা শেষ। আরেকটা সিগারেট দরকার। শরীর এত নিকোটিন চাইছে কেন বুঝতে পারছি না। অসুস্থ শরীর নিকোটিন নেয় না। তার মানে আমি পুরোপুরি ফিট! ‘এটাই শেষ। লঞ্চে উঠে আর দুইটা খাব।’ মনে মনে আরেকটা অসম্ভব প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম। মানুষ আসলে যা পারবে না সেটা করার জন্যই প্রতিজ্ঞা করে। যেটা পারবে কিংবা হওয়ার সেটা এমনিতেই হয়।
সেদিন গুলশান-১–এর ১১৬ নম্বর রোডের শেষ মাথায় তুমিসহ দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। আমি সিগারেট ধরাতেই তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে ‘হঠাৎ গোল্ডলিফ কেন?’ বলেছিলাম, ‘১৬ টাকার সিগারেটে পোষায় না।’ চা-সিগারেট শেষ করে তোমার গালে আলতো ছুঁয়ে বলেছিলাম, ‘এতটুকু কমেনি আমার ভালোবাসা।’ তুমি তখন কথা দিয়ে বলেছিলে, ‘তোমাকে কখনো ছেড়ে যাব না। সেটা সম্ভব না।’ মনে হয় নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছিলে। যেটা পরে তুমি রাখতে পারবে না কিংবা রাখবে না বলে নিশ্চিতভাবেই জানতে।
লঞ্চ ঢেকুর তুলছে। আমার মনে হচ্ছে ডুকরে কেঁদে উঠেছে। দোকানির কাছ থেকে তড়িঘড়ি বিদায় নিয়ে ঘাটের দিকে পা বাড়িয়েছি। একেবারে ঠিক সময়ে ছেড়েছে লঞ্চ। ভেতরেই টিকিটের ব্যবস্থা। নামার সময় কাটলেও নাকি চলে। রিস্ক নিতে চাইলাম না। ১০০ টাকায় পুরো লঞ্চ কিনে নিলাম! একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা এই লঞ্চ শেষ কোথায় ভিড়বে?’ সেই লোক খুব গুছিয়ে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলো, ‘আপনে কই যাইবেন?’
সেদিন তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘তুমি আমার সঙ্গে এখন দেখা করতে চাও না কেন?’ তুমি বলছিলে, ‘এত দেখা করে কী হবে!’
লঞ্চ নদীর বুকে ভাসতে শুরু করেছে। ঘাট ছেড়ে এসেছে ২০-২৫ মিনিট হলো। তুমি আমাকে ছেড়ে গেছ প্রায় পৌনে চার মাস।
প্রতিদিন তোমার সাথে দেখা করার একটা জেদ কাজ করে ইদানীং। দেখা না হলে মাথা ভার হয়ে আসে, এরপর আধ কপালী মাথাব্যথা শুরু হয়। খুবই অসহ্য। তুমি বিরক্ত হও বুঝি। তবু যাই; না গিয়ে উপায় আছে? তুমি-ই বলেছিলে, ‘আমি কোথায় হারাব? তুমি তো আমার সব চেনো। গিয়ে নিয়ে আসবে।’
তোমার সামনে যাই। ‘কেন চলে যাবে?’ জিজ্ঞেস করলে বল, ‘এখন তোমাকে আমার ভালো লাগে না।’ যুক্তিসংগত কথা। ভালো না লাগলে আর কী করা। মানুষ তো আর রোবট না যে, সুইচ ঘুরিয়ে দিলাম আর ভালো লাগা শুরু হলো। আচ্ছা; একইভাবে সুইচ ঘুরিয়ে খারাপ লাগানোও তো সম্ভব না! দুইটার একটারও ব্যবস্থা নাই। তা হলে আমি দ্বিতীয়টি করার চেষ্টা করতাম। তোমাকে জ্বালাতন থেকে মুক্তি দিতাম অন্তত।
সেদিন আবার বললে, ‘তোমার সাথে আমার অ্যাডজাস্ট হয় না।’
কী যে বল না তুমি! আমি তো আর কম্পিউটারের ইউএসবি পোর্ট না। তুমিও পেনড্রাইভ কিংবা ক্যাবল না যে অ্যাডজাস্ট হতে হবে। এত দিন যেভাবে ছিলে সেভাবে থাকবে।’ উত্তর দিয়েছিলাম।
‘এত দিন কোথায় ছিলাম? আমি এত দিন ছিলাম না। তুমি জোর করেছ। তাই-ই ছিলাম।’ তোমার পাল্টা জবাব ছিল এটা।
আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে এত দিন তুমি আমাকে ভালোবাসনি! তোমার সবকিছু; আমাকে দেওয়া কথা, দেখানো স্বপ্ন ধোঁকা ছিল! ঘুমের ঘোরে মাতাল করা সেই ভালোবাসা, আমার শরীর থেকে পুরুষ মাংসের স্বাদ নেওয়া, আনন্দের চূড়ায় উঠে ছোট্ট করে ভালোবাসি বলা, সব মিথ্যা ছিল! ধোঁকা? অভিমান ভাঙাতে আমার গালে প্রজাপতি চুমু এঁকে দেওয়া, বিদায় বেলায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফরাসি চুমু; এসব, সব মিথ্যা, অভিনয়, ধোঁকা!’
তোমার এসব কথা শোনার পর ক্ষণিকের জন্য সব যেন থেমে গিয়েছিল সেদিন। বোমি আসছিল, সামনের সবকিছু হলুদ মনে হয়েছিল। সেসব তোমাকে বুঝতে দিইনি। তুমিও বুঝতে চাওনি।
চশমার গ্লাসগুলো মুছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘আচ্ছা, আমি যদি এখন জোর করি তাহলে থাকবে? তুমিতো বলেছিলে চলে গেলে তোমাকে যাতে যেতে না দিই।’ ‘সেটা আর সম্ভব নয়। আমি মরে গেলেও তোমাকে আপন করতে পারব না। তোমার সাথে সম্পর্ক রাখা তো অনেক দূরের কথা।’ কথাগুলো যখন বলছিলে তোমাকে অনেকটা ডিটারমাইন্ড দেখলাম তখন।
ব্যাপারটা এমন যেন, তোমার মন চাইল, দরকার ছিল তুমি থাকলে এখন মন চাইল কিংবা দরকার শেষ চলে গেলে। মানে, ‘আপনা বুঝ, লাল তরমুজ!’ এখন তোমার লক্ষ্য দেখেশুনে পয়সা ওয়ালা, সফল (তোমার ভাষ্যমতে) কারও সাথে বাকি জীবন পার করা। সেটা কথা প্রসঙ্গে একবার আমাকে বলেও ছিলে। সেদিন ভেবেছিলাম ঠাট্টা। এখন মনে হচ্ছে না সেটাই সত্য।
আচ্ছা তাহলে আমি কী ছিলাম? আমার সাজানো মাঠে খেললে তাহলে? এই এখন কিংবা ভবিষ্যতে ভালো খেলার জন্য নিজেকে তৈরি করেছ এই মাঠে! ঠিকঠাক কোন পিচে কত গতিতে বল করবে, কত ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে সেই বল টার্ন করাবে কিংবা কোন বল ফ্রন্ট ফুটে খেলবে নাকি ব্যাকফুটে খেলবে এসব? আমাকে দিয়ে তুমি নেট প্র্যাকটিস করেছ তাহলে! আসলে মাধবীলতারা উপন্যাসেই থাকে, বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যায় না।
আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে সমাধান?’ ‘হয় তুমি মরে যাও। অথবা আমাকে মেরে ফেল।’ সাফ জবাব দিয়েছিলে তুমি। ‘তোমাকে মারা সম্ভব হবে না। আর নিজে মরব এতটা সাহস আমার নেই।’ আমি আত্মসমর্পণের চেষ্টা করেছিলাম।
আজ মনে হয় পূর্ণিমা। চাঁদের গা থেকে এক-দুই ফোঁটা করে আলো ঝরে পড়ছে। সেই আলোয় নদীর পানি ভিজে যাচ্ছে। চাঁদের আলো গায়ে মেখে লঞ্চ সাঁতরাচ্ছে। আচ্ছা, কত লঞ্চতো ডুবে যায়। কত মানুষ তো মরে ভেসে ওঠে। অনেকের তো লাশও মেলে না। স্বজনেরা লাশের অপেক্ষায় থাকে। অপেক্ষা করতে করতে ভুলে যায় যে, তারা অপেক্ষা করছে। ‘অপেক্ষা’ কঠিন এক জিনিস। তুমি কী অপেক্ষা করবে, আমার প্রাণহীন শরীরের জন্য? যার অর্ধেকটা কিংবা কোনো অংশ নদীর তলে থাকা কোনো প্রাণী খাবলে নেবে কিংবা পচে যাবে। হয়তো আমার পুরো শরীরটিই পচে দুর্গন্ধ বের হবে। তুমি কী সত্যি দেখতে আসবে আমার পচে, গলে গন্ধ বের হওয়া সেই শরীর? নাকি তোমার তরতাজাটাই চাই?
জোছনায় ভিজে ভিজে লঞ্চ কষ্টের নিশ্বাস ফেলছে। আমি তাকিয়ে জোছনা ভেজা নদীর পানিতে। জলদানবের কষ্ট আর আমার কষ্ট মিলেমিশে একাকার। দুজনেই জোছনা ভেজা পানিতে সাঁতরাচ্ছি।
কে যেন বলেছিল, ‘মানুষে মেশিনে এত মিল, কালে কালে ক্ষয়ে যায়।’
আচ্ছা, ওই তরুণীদের দেখছি না যে? তারা কী এই লঞ্চে উঠেছে? নাকি ঠিকানা পেয়ে গেছে, আজ রাতের জন্য?

সিআর-৭ ফ্রি-কিক নিচ্ছে। ডি-বক্সের সামান্য বাইরে ডান পাশ থেকে। কিকের আগে তার সেই ট্রেডমার্ক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা দেখতে মন্দ লাগে না। এ দিকে, আমার ঠোঁটে সিগারেট অর্ধেকটা পুড়ে ছাই। রোনালদোর ফ্রি-কিক বেপথু হয়নি। রক্ষণভাগে থাকা প্রহরীদের মাথার ওপর দিয়ে বলটা কেমন যেন নেচে উঠল। বারের ঠিক কোনা দিয়ে পর্তুগিজ সেনার লেখা ঠিকানায় পৌঁছে গেল বলটি। রোনালদোরা ১-০ তে এগিয়ে গেছে। পাশ থেকে কে যেন ‘গোল’ বলে খানিক শব্দও করল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমাদের দেশে এমন নিখুঁত ফুটবল কবে হবে!
গোল্ডলিফে শেষ টানটা দিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে কটা বাজে দেখলাম। এক কাপ চা হলে ভালো হয়। টেলিভিশনে চোখ রেখেই দোকানিকে বললাম, ‘মামা, দুধ বাড়ায়া ছোট করে একটা চা দাও।’
লঞ্চ ছাড়বে রাত ঠিক ১২টা ৩০। কাঁধের ব্যাগ খানিক পরপর ঝুলে যাচ্ছে। বেচারা মনে হয় আমার কাঁধে ঝুলে আরাম পাচ্ছে না! ঠিক তোমার মতো। হাতে সময় এখনো ঘণ্টাখানেক। ঘাটের ভেতর আরও পরে ঢুকব বলে মনস্থির করলাম। ততক্ষণ কী করা যায় ভাবছি। এত রাত; সদরঘাট এলাকা ছেড়ে এদিক-সেদিক ঘোরার উপায় নেই। দেশের অবস্থা বেহাল। ছিনতাইকারী না ধরলেও পুলিশের খপ্পরে পড়া নিশ্চিত!
দোকানের বাইরে থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না খেলা লাইভ নাকি পুরোনো। দোকানি খদ্দর বিদায় করতে গিয়ে চ্যানেল পাল্টাতে ভুলে গেছে হয়তো! আবার দারুণ ফুটবলপ্রেমীও হতে পারে। ব্যাপারটা এই পরিবেশের সাথে যায় না আসলে। কলকাতা সিনেমার কোনো গান কিংবা বেবি ডল হলে জমত। চারদিকের হাজার হাজার ওয়াটের বাতিগুলো পরিবেশে একটা উৎসব ভাব এনেছে।
ইতিউতি দেখতেই ১৮-২০, আবার ২১-২২ বছরও হতে পারে। এখনকার মেয়েদের বয়স ঠাওর করা কঠিন হ্যাপার কাজ। জিনস আর টিশার্টে বেশ লাগছে মেয়েটাকে। কে জানে? কাছে গেলে দেখা যাবে, ভালো লাগা উবে গেছে কিংবা গলার স্বর শুনে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে! অগত্যা টিভিতেই তাকালাম। খেলা অনেকটা শেষের দিকে। রোনালদোর দল আরও এক গোল দিল বোধয়।
দোকানি ঠিকঠাক চা করে সামনে রেখেছে, আমার সেদিকে খেয়াল নেই। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবার মেয়েটির দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে পাশ করে দাঁড়িয়ে। বেশ আঁটসাঁট টিশার্টে তার শারীরিক অস্তিত্ব স্পষ্ট জানান দিচ্ছে। ওইদিকে এর-ওর নজরও পড়ছে। মেয়েটিও সেটা খেয়াল করছে বলে মনে হলো। তবে সে নির্লিপ্ত। হয়তো ভাবছে ক্ষতি কী? বাসন্তী বাতাসে তার কাঁধ পর্যন্ত নামা অবাধ্য খোলা চুলগুলো শুকনো খড়ের মতো উড়ছে। একটু পরপর সেগুলো ঠিক করছে সে। আর এমন ভাব করছে, পারলে দু–চার কথা শুনিয়ে দেয় যেন! গালে হালকা মেকআপের কারুকাজ তাকে বেশ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। কমলার কোয়ার মতো ঠোঁটে গোলাপি রঙের ম্যাট লিপস্টিক, আর গাঢ় কাজল দিয়ে চোখ দুটিকে ডাগর করার সফল চেষ্টা। বেশ গোছালো।
তার টিশার্টে ঠিক বুকের ওপর কী যেন লেখা। শেষের শব্দটি দেখতে পাচ্ছি পাশ থেকে, ‘এট মি’। কী হতে পারে পুরো বাক্যটি! ‘ডোন্ট লুক এট মি’, ‘লুক এট মি’ নাকি অন্য কিছু। কিছুক্ষণ ফিল ইন দ্য গ্যাপ পূরণের খেলা খেললাম।
তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এক্সকিউজ মি। আপনি কী একা...? কারও জন্য অপেক্ষা করছেন? লঞ্চে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই। ইয়ে মানে...আমিও একা। লঞ্চে একা জার্নি করা বিরক্তিকর। আপনি চাইলে আমি আপনাকে সঙ্গ দিতে পারি। আমার সঙ্গ খারাপ লাগবে না, গ্যারান্টি।’ দৃশ্যটি কল্পনা করতেই বুকের ভেতর পালপিটেশন বেড়ে গেছে।
হা. . হা...নিজের মনেই হেসে ফেললাম। এতটা বেহায়া কী হওয়া যায়!
এসব ভাবনা যখন মস্তিষ্কের এ গলি ও গলি ছুটছে, তখনই নজর পড়ল বাঁ পাশে থাকা আরেক রমণীর দিকে। ভাগ্যদেবী শুধু মুখ তুলেই আমার দিকে তাকায়নি; একেবারে কোলে নিয়ে বসেছে বোধয়। তা না হলে আমার মতো এহেন অভাগার বাঁ-ডানে দুই সুন্দরী। এ যেন কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরি দশা! আচ্ছা, দুজনের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী? নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম যেন। সুন্দরের সংজ্ঞাই বা কী? স্বয়ং কবিগুরু পর্যন্ত সুন্দরের সংজ্ঞা দিতে পারেননি। ‘মুই কী হনুরে!’
তুলনা করা যেতে পারে। প্রথম জন; মানে জিনস আর টিশার্ট পরা তরুণীর মধ্যে আবিষ্কার করার কিছু নেই। অনেকটা ওপেন সিক্রেট। তবে তার পোশাকের কারণে শরীরের প্রত্যেকটি ভাঁজ রহস্য তৈরি করেছে। কেমন যেন ঢেউ খেলে গেছে কোনো কোনো জায়গায়। আর সাঁতার প্রিয় কেউ এমন শান্ত ঢেউয়ে সাঁতার কাটতে আরাম পাবেন নিশ্চিত! তার অবস্থা এমন যেন, মধ্যবিত্ত ঘরে মেজবান আসা উপলক্ষে বিছানায় অনেক দিন পর বের করা বালিশের কভার, চাদর। টি-টেবিলে ভাঁজ না ভাঙা টেবিলক্লথ, দেয়ালের একপাশে রবীন্দ্র-নজরুল কিংবা ম্যারাডোনার কোনো ছবি ঝোলানো। অন্যপাশে দেয়াল ঘড়িটা তার কাজ করে যাচ্ছে টিকটিক করে। ক্যালেন্ডারের পাতাও ঠিকভাবে ওলটানো। দেখেই বোঝা যায় সব পরিকল্পনা মতো সাজিয়ে রাখা।
দ্বিতীয় জন; যার পরনে হালকা কচু পাতা রঙের শিফন শাড়ি। বেশ খানিকটা অগোছালো। আঁচলে প্লিট করা নেই, উঁচু বুকের ওপর এমনি ফেলে রাখা হয়েছে। চওড়া কাঁধ আর বেশ খানিকটা খোলা পিঠ বেয়ে চুলের বেনীটাও ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। শাড়ির বুননে লুকিয়ে থাকা কোমরের খাঁজে হালকা মেদ আর উঁকি মারা তকতকে পেট তাকে আরও যেন নরম তুলতুলে করে তুলেছে। চোখ পড়তেই যেন ছুঁতে মন চায়।
বড়লোকের ড্রয়িং রুমের মতো সবই আছে। ইতালিয়ান ফিটিংস, দেয়ালে দামি পেইন্টিং, দামি সোফা, শুধু অতিথি আসবে বলে গোছানোর সময় পায়নি কেউ। কিংবা ফাঁকিবাজ কাজের লোকের কাছে যে অতিথি আসবেন, তার কোনো দামই নেই।
কী নেই মেয়েটির মাঝে? খোলা পিঠ, চওড়া কাঁধ, উঁচু বুক, ভারী নিতম্ব, গাছপাকা পেয়ারার মতো গায়ের রং। সবই আছে, আমি কবি-সাহিত্যিক হলে আরও ভালো বলতে পারতাম হয়তো। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে, তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে বেশ খানিকটা পরিশ্রম করতে হবে। অথবা জহুরির চোখ লাগবে। শরীর বেয়ে তার মুখে উঠলাম। ওর চোখ আমার চোখ একটু কথা বলে নিল যেন। কিন্তু কেউ কারও কথা বুঝলাম না। চোখ দু’টি; আহা...ঠিক যেন চৈত্রের ভোরে বাঁধানো দিঘির শান্ত পানি। ইচ্ছে হচ্ছে এখনই ডুব মারি।
একটু স্মৃতিমেদুর হলাম; এই চোখই সব শেষ করল আমার।
একই অফিসে যখন ছিলাম তখন তোমার চোখ আর আমার চোখ সারা বেলাই গুটুরগুটুর আলাপ করত। একদিন লিফটের ভেতর তুমি মোবাইল নম্বর চেয়ে নিলে। পরে ফোন দেবে আমি ভাবিনি।
কোনো এক রাতে তুমি ফোন দিয়েছিলে এবং আমাদের সারা রাত কথা হয় সেদিন। আমার ফোনে ব্যালেন্স ছিল না। তোমারই তিন-চারটা নম্বর। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছর কেটে গেল। হাত ধরে সারা ঢাকা চষে বেড়িয়েছি। কখনো ঘণ্টা চুক্তিতে রিকশা, কখনো দুই পা-ই ছিল ভরসা। কখনো নীলক্ষেতের ঘুপচি দোকান, কখনো আবার শহরের দামি কোনো রেস্তোরাঁ। আমার এই রুগ্ণ কাঁধে মাথা রেখে কত বিকেল পার করেছ তার ইয়ত্তা নেই। মাঝে মধ্যে একান্তে কিছু সময় কাটাতে আমার ভাড়া বাসার ছোট্ট রুম ছাড়াও আশ্রয় নিতে এর ওর বাসায়। পোষা বিড়াল ছানার মতো তোমায় কোলে নিয়ে রাত পার করে দিয়েছি কত। তুমি ঘুমাতে আর আমি তোমার বন্ধ চোখে স্বপ্ন দেখতাম। মাঝেমধ্যে ঘামে ভিজে যাওয়া তোমার শরীরের নেশা ধরা গন্ধে মাদকের স্বাদ নিতে নিতে নিজেই ঘুমিয়ে পড়তাম। রাত পোহালে তোমার শুকনো ঠোঁটের ছোঁয়ায় অদ্ভুত রকমের ভালো লাগায় কেঁপে উঠতাম। আর জেগে উঠে তোমাকে আবিষ্কারের কঠোর পরিশ্রম। প্রথম প্রহরের সেই শারীরিক ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশের শব্দ আমার ঝাঁপিতে নেই, সত্যি বলছি।
চা শেষ। আরেকটা সিগারেট দরকার। শরীর এত নিকোটিন চাইছে কেন বুঝতে পারছি না। অসুস্থ শরীর নিকোটিন নেয় না। তার মানে আমি পুরোপুরি ফিট! ‘এটাই শেষ। লঞ্চে উঠে আর দুইটা খাব।’ মনে মনে আরেকটা অসম্ভব প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম। মানুষ আসলে যা পারবে না সেটা করার জন্যই প্রতিজ্ঞা করে। যেটা পারবে কিংবা হওয়ার সেটা এমনিতেই হয়।
সেদিন গুলশান-১–এর ১১৬ নম্বর রোডের শেষ মাথায় তুমিসহ দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। আমি সিগারেট ধরাতেই তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে ‘হঠাৎ গোল্ডলিফ কেন?’ বলেছিলাম, ‘১৬ টাকার সিগারেটে পোষায় না।’ চা-সিগারেট শেষ করে তোমার গালে আলতো ছুঁয়ে বলেছিলাম, ‘এতটুকু কমেনি আমার ভালোবাসা।’ তুমি তখন কথা দিয়ে বলেছিলে, ‘তোমাকে কখনো ছেড়ে যাব না। সেটা সম্ভব না।’ মনে হয় নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছিলে। যেটা পরে তুমি রাখতে পারবে না কিংবা রাখবে না বলে নিশ্চিতভাবেই জানতে।
লঞ্চ ঢেকুর তুলছে। আমার মনে হচ্ছে ডুকরে কেঁদে উঠেছে। দোকানির কাছ থেকে তড়িঘড়ি বিদায় নিয়ে ঘাটের দিকে পা বাড়িয়েছি। একেবারে ঠিক সময়ে ছেড়েছে লঞ্চ। ভেতরেই টিকিটের ব্যবস্থা। নামার সময় কাটলেও নাকি চলে। রিস্ক নিতে চাইলাম না। ১০০ টাকায় পুরো লঞ্চ কিনে নিলাম! একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা এই লঞ্চ শেষ কোথায় ভিড়বে?’ সেই লোক খুব গুছিয়ে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলো, ‘আপনে কই যাইবেন?’
সেদিন তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘তুমি আমার সঙ্গে এখন দেখা করতে চাও না কেন?’ তুমি বলছিলে, ‘এত দেখা করে কী হবে!’
লঞ্চ নদীর বুকে ভাসতে শুরু করেছে। ঘাট ছেড়ে এসেছে ২০-২৫ মিনিট হলো। তুমি আমাকে ছেড়ে গেছ প্রায় পৌনে চার মাস।
প্রতিদিন তোমার সাথে দেখা করার একটা জেদ কাজ করে ইদানীং। দেখা না হলে মাথা ভার হয়ে আসে, এরপর আধ কপালী মাথাব্যথা শুরু হয়। খুবই অসহ্য। তুমি বিরক্ত হও বুঝি। তবু যাই; না গিয়ে উপায় আছে? তুমি-ই বলেছিলে, ‘আমি কোথায় হারাব? তুমি তো আমার সব চেনো। গিয়ে নিয়ে আসবে।’
তোমার সামনে যাই। ‘কেন চলে যাবে?’ জিজ্ঞেস করলে বল, ‘এখন তোমাকে আমার ভালো লাগে না।’ যুক্তিসংগত কথা। ভালো না লাগলে আর কী করা। মানুষ তো আর রোবট না যে, সুইচ ঘুরিয়ে দিলাম আর ভালো লাগা শুরু হলো। আচ্ছা; একইভাবে সুইচ ঘুরিয়ে খারাপ লাগানোও তো সম্ভব না! দুইটার একটারও ব্যবস্থা নাই। তা হলে আমি দ্বিতীয়টি করার চেষ্টা করতাম। তোমাকে জ্বালাতন থেকে মুক্তি দিতাম অন্তত।
সেদিন আবার বললে, ‘তোমার সাথে আমার অ্যাডজাস্ট হয় না।’
কী যে বল না তুমি! আমি তো আর কম্পিউটারের ইউএসবি পোর্ট না। তুমিও পেনড্রাইভ কিংবা ক্যাবল না যে অ্যাডজাস্ট হতে হবে। এত দিন যেভাবে ছিলে সেভাবে থাকবে।’ উত্তর দিয়েছিলাম।
‘এত দিন কোথায় ছিলাম? আমি এত দিন ছিলাম না। তুমি জোর করেছ। তাই-ই ছিলাম।’ তোমার পাল্টা জবাব ছিল এটা।
আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে এত দিন তুমি আমাকে ভালোবাসনি! তোমার সবকিছু; আমাকে দেওয়া কথা, দেখানো স্বপ্ন ধোঁকা ছিল! ঘুমের ঘোরে মাতাল করা সেই ভালোবাসা, আমার শরীর থেকে পুরুষ মাংসের স্বাদ নেওয়া, আনন্দের চূড়ায় উঠে ছোট্ট করে ভালোবাসি বলা, সব মিথ্যা ছিল! ধোঁকা? অভিমান ভাঙাতে আমার গালে প্রজাপতি চুমু এঁকে দেওয়া, বিদায় বেলায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফরাসি চুমু; এসব, সব মিথ্যা, অভিনয়, ধোঁকা!’
তোমার এসব কথা শোনার পর ক্ষণিকের জন্য সব যেন থেমে গিয়েছিল সেদিন। বোমি আসছিল, সামনের সবকিছু হলুদ মনে হয়েছিল। সেসব তোমাকে বুঝতে দিইনি। তুমিও বুঝতে চাওনি।
চশমার গ্লাসগুলো মুছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘আচ্ছা, আমি যদি এখন জোর করি তাহলে থাকবে? তুমিতো বলেছিলে চলে গেলে তোমাকে যাতে যেতে না দিই।’ ‘সেটা আর সম্ভব নয়। আমি মরে গেলেও তোমাকে আপন করতে পারব না। তোমার সাথে সম্পর্ক রাখা তো অনেক দূরের কথা।’ কথাগুলো যখন বলছিলে তোমাকে অনেকটা ডিটারমাইন্ড দেখলাম তখন।
ব্যাপারটা এমন যেন, তোমার মন চাইল, দরকার ছিল তুমি থাকলে এখন মন চাইল কিংবা দরকার শেষ চলে গেলে। মানে, ‘আপনা বুঝ, লাল তরমুজ!’ এখন তোমার লক্ষ্য দেখেশুনে পয়সা ওয়ালা, সফল (তোমার ভাষ্যমতে) কারও সাথে বাকি জীবন পার করা। সেটা কথা প্রসঙ্গে একবার আমাকে বলেও ছিলে। সেদিন ভেবেছিলাম ঠাট্টা। এখন মনে হচ্ছে না সেটাই সত্য।
আচ্ছা তাহলে আমি কী ছিলাম? আমার সাজানো মাঠে খেললে তাহলে? এই এখন কিংবা ভবিষ্যতে ভালো খেলার জন্য নিজেকে তৈরি করেছ এই মাঠে! ঠিকঠাক কোন পিচে কত গতিতে বল করবে, কত ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে সেই বল টার্ন করাবে কিংবা কোন বল ফ্রন্ট ফুটে খেলবে নাকি ব্যাকফুটে খেলবে এসব? আমাকে দিয়ে তুমি নেট প্র্যাকটিস করেছ তাহলে! আসলে মাধবীলতারা উপন্যাসেই থাকে, বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যায় না।
আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে সমাধান?’ ‘হয় তুমি মরে যাও। অথবা আমাকে মেরে ফেল।’ সাফ জবাব দিয়েছিলে তুমি। ‘তোমাকে মারা সম্ভব হবে না। আর নিজে মরব এতটা সাহস আমার নেই।’ আমি আত্মসমর্পণের চেষ্টা করেছিলাম।
আজ মনে হয় পূর্ণিমা। চাঁদের গা থেকে এক-দুই ফোঁটা করে আলো ঝরে পড়ছে। সেই আলোয় নদীর পানি ভিজে যাচ্ছে। চাঁদের আলো গায়ে মেখে লঞ্চ সাঁতরাচ্ছে। আচ্ছা, কত লঞ্চতো ডুবে যায়। কত মানুষ তো মরে ভেসে ওঠে। অনেকের তো লাশও মেলে না। স্বজনেরা লাশের অপেক্ষায় থাকে। অপেক্ষা করতে করতে ভুলে যায় যে, তারা অপেক্ষা করছে। ‘অপেক্ষা’ কঠিন এক জিনিস। তুমি কী অপেক্ষা করবে, আমার প্রাণহীন শরীরের জন্য? যার অর্ধেকটা কিংবা কোনো অংশ নদীর তলে থাকা কোনো প্রাণী খাবলে নেবে কিংবা পচে যাবে। হয়তো আমার পুরো শরীরটিই পচে দুর্গন্ধ বের হবে। তুমি কী সত্যি দেখতে আসবে আমার পচে, গলে গন্ধ বের হওয়া সেই শরীর? নাকি তোমার তরতাজাটাই চাই?
জোছনায় ভিজে ভিজে লঞ্চ কষ্টের নিশ্বাস ফেলছে। আমি তাকিয়ে জোছনা ভেজা নদীর পানিতে। জলদানবের কষ্ট আর আমার কষ্ট মিলেমিশে একাকার। দুজনেই জোছনা ভেজা পানিতে সাঁতরাচ্ছি।
কে যেন বলেছিল, ‘মানুষে মেশিনে এত মিল, কালে কালে ক্ষয়ে যায়।’
আচ্ছা, ওই তরুণীদের দেখছি না যে? তারা কী এই লঞ্চে উঠেছে? নাকি ঠিকানা পেয়ে গেছে, আজ রাতের জন্য?
রাকিব হাসান

সিআর-৭ ফ্রি-কিক নিচ্ছে। ডি-বক্সের সামান্য বাইরে ডান পাশ থেকে। কিকের আগে তার সেই ট্রেডমার্ক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা দেখতে মন্দ লাগে না। এ দিকে, আমার ঠোঁটে সিগারেট অর্ধেকটা পুড়ে ছাই। রোনালদোর ফ্রি-কিক বেপথু হয়নি। রক্ষণভাগে থাকা প্রহরীদের মাথার ওপর দিয়ে বলটা কেমন যেন নেচে উঠল। বারের ঠিক কোনা দিয়ে পর্তুগিজ সেনার লেখা ঠিকানায় পৌঁছে গেল বলটি। রোনালদোরা ১-০ তে এগিয়ে গেছে। পাশ থেকে কে যেন ‘গোল’ বলে খানিক শব্দও করল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমাদের দেশে এমন নিখুঁত ফুটবল কবে হবে!
গোল্ডলিফে শেষ টানটা দিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে কটা বাজে দেখলাম। এক কাপ চা হলে ভালো হয়। টেলিভিশনে চোখ রেখেই দোকানিকে বললাম, ‘মামা, দুধ বাড়ায়া ছোট করে একটা চা দাও।’
লঞ্চ ছাড়বে রাত ঠিক ১২টা ৩০। কাঁধের ব্যাগ খানিক পরপর ঝুলে যাচ্ছে। বেচারা মনে হয় আমার কাঁধে ঝুলে আরাম পাচ্ছে না! ঠিক তোমার মতো। হাতে সময় এখনো ঘণ্টাখানেক। ঘাটের ভেতর আরও পরে ঢুকব বলে মনস্থির করলাম। ততক্ষণ কী করা যায় ভাবছি। এত রাত; সদরঘাট এলাকা ছেড়ে এদিক-সেদিক ঘোরার উপায় নেই। দেশের অবস্থা বেহাল। ছিনতাইকারী না ধরলেও পুলিশের খপ্পরে পড়া নিশ্চিত!
দোকানের বাইরে থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না খেলা লাইভ নাকি পুরোনো। দোকানি খদ্দর বিদায় করতে গিয়ে চ্যানেল পাল্টাতে ভুলে গেছে হয়তো! আবার দারুণ ফুটবলপ্রেমীও হতে পারে। ব্যাপারটা এই পরিবেশের সাথে যায় না আসলে। কলকাতা সিনেমার কোনো গান কিংবা বেবি ডল হলে জমত। চারদিকের হাজার হাজার ওয়াটের বাতিগুলো পরিবেশে একটা উৎসব ভাব এনেছে।
ইতিউতি দেখতেই ১৮-২০, আবার ২১-২২ বছরও হতে পারে। এখনকার মেয়েদের বয়স ঠাওর করা কঠিন হ্যাপার কাজ। জিনস আর টিশার্টে বেশ লাগছে মেয়েটাকে। কে জানে? কাছে গেলে দেখা যাবে, ভালো লাগা উবে গেছে কিংবা গলার স্বর শুনে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে! অগত্যা টিভিতেই তাকালাম। খেলা অনেকটা শেষের দিকে। রোনালদোর দল আরও এক গোল দিল বোধয়।
দোকানি ঠিকঠাক চা করে সামনে রেখেছে, আমার সেদিকে খেয়াল নেই। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবার মেয়েটির দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে পাশ করে দাঁড়িয়ে। বেশ আঁটসাঁট টিশার্টে তার শারীরিক অস্তিত্ব স্পষ্ট জানান দিচ্ছে। ওইদিকে এর-ওর নজরও পড়ছে। মেয়েটিও সেটা খেয়াল করছে বলে মনে হলো। তবে সে নির্লিপ্ত। হয়তো ভাবছে ক্ষতি কী? বাসন্তী বাতাসে তার কাঁধ পর্যন্ত নামা অবাধ্য খোলা চুলগুলো শুকনো খড়ের মতো উড়ছে। একটু পরপর সেগুলো ঠিক করছে সে। আর এমন ভাব করছে, পারলে দু–চার কথা শুনিয়ে দেয় যেন! গালে হালকা মেকআপের কারুকাজ তাকে বেশ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। কমলার কোয়ার মতো ঠোঁটে গোলাপি রঙের ম্যাট লিপস্টিক, আর গাঢ় কাজল দিয়ে চোখ দুটিকে ডাগর করার সফল চেষ্টা। বেশ গোছালো।
তার টিশার্টে ঠিক বুকের ওপর কী যেন লেখা। শেষের শব্দটি দেখতে পাচ্ছি পাশ থেকে, ‘এট মি’। কী হতে পারে পুরো বাক্যটি! ‘ডোন্ট লুক এট মি’, ‘লুক এট মি’ নাকি অন্য কিছু। কিছুক্ষণ ফিল ইন দ্য গ্যাপ পূরণের খেলা খেললাম।
তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এক্সকিউজ মি। আপনি কী একা...? কারও জন্য অপেক্ষা করছেন? লঞ্চে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই। ইয়ে মানে...আমিও একা। লঞ্চে একা জার্নি করা বিরক্তিকর। আপনি চাইলে আমি আপনাকে সঙ্গ দিতে পারি। আমার সঙ্গ খারাপ লাগবে না, গ্যারান্টি।’ দৃশ্যটি কল্পনা করতেই বুকের ভেতর পালপিটেশন বেড়ে গেছে।
হা. . হা...নিজের মনেই হেসে ফেললাম। এতটা বেহায়া কী হওয়া যায়!
এসব ভাবনা যখন মস্তিষ্কের এ গলি ও গলি ছুটছে, তখনই নজর পড়ল বাঁ পাশে থাকা আরেক রমণীর দিকে। ভাগ্যদেবী শুধু মুখ তুলেই আমার দিকে তাকায়নি; একেবারে কোলে নিয়ে বসেছে বোধয়। তা না হলে আমার মতো এহেন অভাগার বাঁ-ডানে দুই সুন্দরী। এ যেন কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরি দশা! আচ্ছা, দুজনের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী? নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম যেন। সুন্দরের সংজ্ঞাই বা কী? স্বয়ং কবিগুরু পর্যন্ত সুন্দরের সংজ্ঞা দিতে পারেননি। ‘মুই কী হনুরে!’
তুলনা করা যেতে পারে। প্রথম জন; মানে জিনস আর টিশার্ট পরা তরুণীর মধ্যে আবিষ্কার করার কিছু নেই। অনেকটা ওপেন সিক্রেট। তবে তার পোশাকের কারণে শরীরের প্রত্যেকটি ভাঁজ রহস্য তৈরি করেছে। কেমন যেন ঢেউ খেলে গেছে কোনো কোনো জায়গায়। আর সাঁতার প্রিয় কেউ এমন শান্ত ঢেউয়ে সাঁতার কাটতে আরাম পাবেন নিশ্চিত! তার অবস্থা এমন যেন, মধ্যবিত্ত ঘরে মেজবান আসা উপলক্ষে বিছানায় অনেক দিন পর বের করা বালিশের কভার, চাদর। টি-টেবিলে ভাঁজ না ভাঙা টেবিলক্লথ, দেয়ালের একপাশে রবীন্দ্র-নজরুল কিংবা ম্যারাডোনার কোনো ছবি ঝোলানো। অন্যপাশে দেয়াল ঘড়িটা তার কাজ করে যাচ্ছে টিকটিক করে। ক্যালেন্ডারের পাতাও ঠিকভাবে ওলটানো। দেখেই বোঝা যায় সব পরিকল্পনা মতো সাজিয়ে রাখা।
দ্বিতীয় জন; যার পরনে হালকা কচু পাতা রঙের শিফন শাড়ি। বেশ খানিকটা অগোছালো। আঁচলে প্লিট করা নেই, উঁচু বুকের ওপর এমনি ফেলে রাখা হয়েছে। চওড়া কাঁধ আর বেশ খানিকটা খোলা পিঠ বেয়ে চুলের বেনীটাও ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। শাড়ির বুননে লুকিয়ে থাকা কোমরের খাঁজে হালকা মেদ আর উঁকি মারা তকতকে পেট তাকে আরও যেন নরম তুলতুলে করে তুলেছে। চোখ পড়তেই যেন ছুঁতে মন চায়।
বড়লোকের ড্রয়িং রুমের মতো সবই আছে। ইতালিয়ান ফিটিংস, দেয়ালে দামি পেইন্টিং, দামি সোফা, শুধু অতিথি আসবে বলে গোছানোর সময় পায়নি কেউ। কিংবা ফাঁকিবাজ কাজের লোকের কাছে যে অতিথি আসবেন, তার কোনো দামই নেই।
কী নেই মেয়েটির মাঝে? খোলা পিঠ, চওড়া কাঁধ, উঁচু বুক, ভারী নিতম্ব, গাছপাকা পেয়ারার মতো গায়ের রং। সবই আছে, আমি কবি-সাহিত্যিক হলে আরও ভালো বলতে পারতাম হয়তো। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে, তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে বেশ খানিকটা পরিশ্রম করতে হবে। অথবা জহুরির চোখ লাগবে। শরীর বেয়ে তার মুখে উঠলাম। ওর চোখ আমার চোখ একটু কথা বলে নিল যেন। কিন্তু কেউ কারও কথা বুঝলাম না। চোখ দু’টি; আহা...ঠিক যেন চৈত্রের ভোরে বাঁধানো দিঘির শান্ত পানি। ইচ্ছে হচ্ছে এখনই ডুব মারি।
একটু স্মৃতিমেদুর হলাম; এই চোখই সব শেষ করল আমার।
একই অফিসে যখন ছিলাম তখন তোমার চোখ আর আমার চোখ সারা বেলাই গুটুরগুটুর আলাপ করত। একদিন লিফটের ভেতর তুমি মোবাইল নম্বর চেয়ে নিলে। পরে ফোন দেবে আমি ভাবিনি।
কোনো এক রাতে তুমি ফোন দিয়েছিলে এবং আমাদের সারা রাত কথা হয় সেদিন। আমার ফোনে ব্যালেন্স ছিল না। তোমারই তিন-চারটা নম্বর। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছর কেটে গেল। হাত ধরে সারা ঢাকা চষে বেড়িয়েছি। কখনো ঘণ্টা চুক্তিতে রিকশা, কখনো দুই পা-ই ছিল ভরসা। কখনো নীলক্ষেতের ঘুপচি দোকান, কখনো আবার শহরের দামি কোনো রেস্তোরাঁ। আমার এই রুগ্ণ কাঁধে মাথা রেখে কত বিকেল পার করেছ তার ইয়ত্তা নেই। মাঝে মধ্যে একান্তে কিছু সময় কাটাতে আমার ভাড়া বাসার ছোট্ট রুম ছাড়াও আশ্রয় নিতে এর ওর বাসায়। পোষা বিড়াল ছানার মতো তোমায় কোলে নিয়ে রাত পার করে দিয়েছি কত। তুমি ঘুমাতে আর আমি তোমার বন্ধ চোখে স্বপ্ন দেখতাম। মাঝেমধ্যে ঘামে ভিজে যাওয়া তোমার শরীরের নেশা ধরা গন্ধে মাদকের স্বাদ নিতে নিতে নিজেই ঘুমিয়ে পড়তাম। রাত পোহালে তোমার শুকনো ঠোঁটের ছোঁয়ায় অদ্ভুত রকমের ভালো লাগায় কেঁপে উঠতাম। আর জেগে উঠে তোমাকে আবিষ্কারের কঠোর পরিশ্রম। প্রথম প্রহরের সেই শারীরিক ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশের শব্দ আমার ঝাঁপিতে নেই, সত্যি বলছি।
চা শেষ। আরেকটা সিগারেট দরকার। শরীর এত নিকোটিন চাইছে কেন বুঝতে পারছি না। অসুস্থ শরীর নিকোটিন নেয় না। তার মানে আমি পুরোপুরি ফিট! ‘এটাই শেষ। লঞ্চে উঠে আর দুইটা খাব।’ মনে মনে আরেকটা অসম্ভব প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম। মানুষ আসলে যা পারবে না সেটা করার জন্যই প্রতিজ্ঞা করে। যেটা পারবে কিংবা হওয়ার সেটা এমনিতেই হয়।
সেদিন গুলশান-১–এর ১১৬ নম্বর রোডের শেষ মাথায় তুমিসহ দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। আমি সিগারেট ধরাতেই তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে ‘হঠাৎ গোল্ডলিফ কেন?’ বলেছিলাম, ‘১৬ টাকার সিগারেটে পোষায় না।’ চা-সিগারেট শেষ করে তোমার গালে আলতো ছুঁয়ে বলেছিলাম, ‘এতটুকু কমেনি আমার ভালোবাসা।’ তুমি তখন কথা দিয়ে বলেছিলে, ‘তোমাকে কখনো ছেড়ে যাব না। সেটা সম্ভব না।’ মনে হয় নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছিলে। যেটা পরে তুমি রাখতে পারবে না কিংবা রাখবে না বলে নিশ্চিতভাবেই জানতে।
লঞ্চ ঢেকুর তুলছে। আমার মনে হচ্ছে ডুকরে কেঁদে উঠেছে। দোকানির কাছ থেকে তড়িঘড়ি বিদায় নিয়ে ঘাটের দিকে পা বাড়িয়েছি। একেবারে ঠিক সময়ে ছেড়েছে লঞ্চ। ভেতরেই টিকিটের ব্যবস্থা। নামার সময় কাটলেও নাকি চলে। রিস্ক নিতে চাইলাম না। ১০০ টাকায় পুরো লঞ্চ কিনে নিলাম! একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা এই লঞ্চ শেষ কোথায় ভিড়বে?’ সেই লোক খুব গুছিয়ে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলো, ‘আপনে কই যাইবেন?’
সেদিন তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘তুমি আমার সঙ্গে এখন দেখা করতে চাও না কেন?’ তুমি বলছিলে, ‘এত দেখা করে কী হবে!’
লঞ্চ নদীর বুকে ভাসতে শুরু করেছে। ঘাট ছেড়ে এসেছে ২০-২৫ মিনিট হলো। তুমি আমাকে ছেড়ে গেছ প্রায় পৌনে চার মাস।
প্রতিদিন তোমার সাথে দেখা করার একটা জেদ কাজ করে ইদানীং। দেখা না হলে মাথা ভার হয়ে আসে, এরপর আধ কপালী মাথাব্যথা শুরু হয়। খুবই অসহ্য। তুমি বিরক্ত হও বুঝি। তবু যাই; না গিয়ে উপায় আছে? তুমি-ই বলেছিলে, ‘আমি কোথায় হারাব? তুমি তো আমার সব চেনো। গিয়ে নিয়ে আসবে।’
তোমার সামনে যাই। ‘কেন চলে যাবে?’ জিজ্ঞেস করলে বল, ‘এখন তোমাকে আমার ভালো লাগে না।’ যুক্তিসংগত কথা। ভালো না লাগলে আর কী করা। মানুষ তো আর রোবট না যে, সুইচ ঘুরিয়ে দিলাম আর ভালো লাগা শুরু হলো। আচ্ছা; একইভাবে সুইচ ঘুরিয়ে খারাপ লাগানোও তো সম্ভব না! দুইটার একটারও ব্যবস্থা নাই। তা হলে আমি দ্বিতীয়টি করার চেষ্টা করতাম। তোমাকে জ্বালাতন থেকে মুক্তি দিতাম অন্তত।
সেদিন আবার বললে, ‘তোমার সাথে আমার অ্যাডজাস্ট হয় না।’
কী যে বল না তুমি! আমি তো আর কম্পিউটারের ইউএসবি পোর্ট না। তুমিও পেনড্রাইভ কিংবা ক্যাবল না যে অ্যাডজাস্ট হতে হবে। এত দিন যেভাবে ছিলে সেভাবে থাকবে।’ উত্তর দিয়েছিলাম।
‘এত দিন কোথায় ছিলাম? আমি এত দিন ছিলাম না। তুমি জোর করেছ। তাই-ই ছিলাম।’ তোমার পাল্টা জবাব ছিল এটা।
আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে এত দিন তুমি আমাকে ভালোবাসনি! তোমার সবকিছু; আমাকে দেওয়া কথা, দেখানো স্বপ্ন ধোঁকা ছিল! ঘুমের ঘোরে মাতাল করা সেই ভালোবাসা, আমার শরীর থেকে পুরুষ মাংসের স্বাদ নেওয়া, আনন্দের চূড়ায় উঠে ছোট্ট করে ভালোবাসি বলা, সব মিথ্যা ছিল! ধোঁকা? অভিমান ভাঙাতে আমার গালে প্রজাপতি চুমু এঁকে দেওয়া, বিদায় বেলায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফরাসি চুমু; এসব, সব মিথ্যা, অভিনয়, ধোঁকা!’
তোমার এসব কথা শোনার পর ক্ষণিকের জন্য সব যেন থেমে গিয়েছিল সেদিন। বোমি আসছিল, সামনের সবকিছু হলুদ মনে হয়েছিল। সেসব তোমাকে বুঝতে দিইনি। তুমিও বুঝতে চাওনি।
চশমার গ্লাসগুলো মুছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘আচ্ছা, আমি যদি এখন জোর করি তাহলে থাকবে? তুমিতো বলেছিলে চলে গেলে তোমাকে যাতে যেতে না দিই।’ ‘সেটা আর সম্ভব নয়। আমি মরে গেলেও তোমাকে আপন করতে পারব না। তোমার সাথে সম্পর্ক রাখা তো অনেক দূরের কথা।’ কথাগুলো যখন বলছিলে তোমাকে অনেকটা ডিটারমাইন্ড দেখলাম তখন।
ব্যাপারটা এমন যেন, তোমার মন চাইল, দরকার ছিল তুমি থাকলে এখন মন চাইল কিংবা দরকার শেষ চলে গেলে। মানে, ‘আপনা বুঝ, লাল তরমুজ!’ এখন তোমার লক্ষ্য দেখেশুনে পয়সা ওয়ালা, সফল (তোমার ভাষ্যমতে) কারও সাথে বাকি জীবন পার করা। সেটা কথা প্রসঙ্গে একবার আমাকে বলেও ছিলে। সেদিন ভেবেছিলাম ঠাট্টা। এখন মনে হচ্ছে না সেটাই সত্য।
আচ্ছা তাহলে আমি কী ছিলাম? আমার সাজানো মাঠে খেললে তাহলে? এই এখন কিংবা ভবিষ্যতে ভালো খেলার জন্য নিজেকে তৈরি করেছ এই মাঠে! ঠিকঠাক কোন পিচে কত গতিতে বল করবে, কত ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে সেই বল টার্ন করাবে কিংবা কোন বল ফ্রন্ট ফুটে খেলবে নাকি ব্যাকফুটে খেলবে এসব? আমাকে দিয়ে তুমি নেট প্র্যাকটিস করেছ তাহলে! আসলে মাধবীলতারা উপন্যাসেই থাকে, বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যায় না।
আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে সমাধান?’ ‘হয় তুমি মরে যাও। অথবা আমাকে মেরে ফেল।’ সাফ জবাব দিয়েছিলে তুমি। ‘তোমাকে মারা সম্ভব হবে না। আর নিজে মরব এতটা সাহস আমার নেই।’ আমি আত্মসমর্পণের চেষ্টা করেছিলাম।
আজ মনে হয় পূর্ণিমা। চাঁদের গা থেকে এক-দুই ফোঁটা করে আলো ঝরে পড়ছে। সেই আলোয় নদীর পানি ভিজে যাচ্ছে। চাঁদের আলো গায়ে মেখে লঞ্চ সাঁতরাচ্ছে। আচ্ছা, কত লঞ্চতো ডুবে যায়। কত মানুষ তো মরে ভেসে ওঠে। অনেকের তো লাশও মেলে না। স্বজনেরা লাশের অপেক্ষায় থাকে। অপেক্ষা করতে করতে ভুলে যায় যে, তারা অপেক্ষা করছে। ‘অপেক্ষা’ কঠিন এক জিনিস। তুমি কী অপেক্ষা করবে, আমার প্রাণহীন শরীরের জন্য? যার অর্ধেকটা কিংবা কোনো অংশ নদীর তলে থাকা কোনো প্রাণী খাবলে নেবে কিংবা পচে যাবে। হয়তো আমার পুরো শরীরটিই পচে দুর্গন্ধ বের হবে। তুমি কী সত্যি দেখতে আসবে আমার পচে, গলে গন্ধ বের হওয়া সেই শরীর? নাকি তোমার তরতাজাটাই চাই?
জোছনায় ভিজে ভিজে লঞ্চ কষ্টের নিশ্বাস ফেলছে। আমি তাকিয়ে জোছনা ভেজা নদীর পানিতে। জলদানবের কষ্ট আর আমার কষ্ট মিলেমিশে একাকার। দুজনেই জোছনা ভেজা পানিতে সাঁতরাচ্ছি।
কে যেন বলেছিল, ‘মানুষে মেশিনে এত মিল, কালে কালে ক্ষয়ে যায়।’
আচ্ছা, ওই তরুণীদের দেখছি না যে? তারা কী এই লঞ্চে উঠেছে? নাকি ঠিকানা পেয়ে গেছে, আজ রাতের জন্য?

সিআর-৭ ফ্রি-কিক নিচ্ছে। ডি-বক্সের সামান্য বাইরে ডান পাশ থেকে। কিকের আগে তার সেই ট্রেডমার্ক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা দেখতে মন্দ লাগে না। এ দিকে, আমার ঠোঁটে সিগারেট অর্ধেকটা পুড়ে ছাই। রোনালদোর ফ্রি-কিক বেপথু হয়নি। রক্ষণভাগে থাকা প্রহরীদের মাথার ওপর দিয়ে বলটা কেমন যেন নেচে উঠল। বারের ঠিক কোনা দিয়ে পর্তুগিজ সেনার লেখা ঠিকানায় পৌঁছে গেল বলটি। রোনালদোরা ১-০ তে এগিয়ে গেছে। পাশ থেকে কে যেন ‘গোল’ বলে খানিক শব্দও করল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমাদের দেশে এমন নিখুঁত ফুটবল কবে হবে!
গোল্ডলিফে শেষ টানটা দিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে কটা বাজে দেখলাম। এক কাপ চা হলে ভালো হয়। টেলিভিশনে চোখ রেখেই দোকানিকে বললাম, ‘মামা, দুধ বাড়ায়া ছোট করে একটা চা দাও।’
লঞ্চ ছাড়বে রাত ঠিক ১২টা ৩০। কাঁধের ব্যাগ খানিক পরপর ঝুলে যাচ্ছে। বেচারা মনে হয় আমার কাঁধে ঝুলে আরাম পাচ্ছে না! ঠিক তোমার মতো। হাতে সময় এখনো ঘণ্টাখানেক। ঘাটের ভেতর আরও পরে ঢুকব বলে মনস্থির করলাম। ততক্ষণ কী করা যায় ভাবছি। এত রাত; সদরঘাট এলাকা ছেড়ে এদিক-সেদিক ঘোরার উপায় নেই। দেশের অবস্থা বেহাল। ছিনতাইকারী না ধরলেও পুলিশের খপ্পরে পড়া নিশ্চিত!
দোকানের বাইরে থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না খেলা লাইভ নাকি পুরোনো। দোকানি খদ্দর বিদায় করতে গিয়ে চ্যানেল পাল্টাতে ভুলে গেছে হয়তো! আবার দারুণ ফুটবলপ্রেমীও হতে পারে। ব্যাপারটা এই পরিবেশের সাথে যায় না আসলে। কলকাতা সিনেমার কোনো গান কিংবা বেবি ডল হলে জমত। চারদিকের হাজার হাজার ওয়াটের বাতিগুলো পরিবেশে একটা উৎসব ভাব এনেছে।
ইতিউতি দেখতেই ১৮-২০, আবার ২১-২২ বছরও হতে পারে। এখনকার মেয়েদের বয়স ঠাওর করা কঠিন হ্যাপার কাজ। জিনস আর টিশার্টে বেশ লাগছে মেয়েটাকে। কে জানে? কাছে গেলে দেখা যাবে, ভালো লাগা উবে গেছে কিংবা গলার স্বর শুনে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে! অগত্যা টিভিতেই তাকালাম। খেলা অনেকটা শেষের দিকে। রোনালদোর দল আরও এক গোল দিল বোধয়।
দোকানি ঠিকঠাক চা করে সামনে রেখেছে, আমার সেদিকে খেয়াল নেই। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবার মেয়েটির দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে পাশ করে দাঁড়িয়ে। বেশ আঁটসাঁট টিশার্টে তার শারীরিক অস্তিত্ব স্পষ্ট জানান দিচ্ছে। ওইদিকে এর-ওর নজরও পড়ছে। মেয়েটিও সেটা খেয়াল করছে বলে মনে হলো। তবে সে নির্লিপ্ত। হয়তো ভাবছে ক্ষতি কী? বাসন্তী বাতাসে তার কাঁধ পর্যন্ত নামা অবাধ্য খোলা চুলগুলো শুকনো খড়ের মতো উড়ছে। একটু পরপর সেগুলো ঠিক করছে সে। আর এমন ভাব করছে, পারলে দু–চার কথা শুনিয়ে দেয় যেন! গালে হালকা মেকআপের কারুকাজ তাকে বেশ দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। কমলার কোয়ার মতো ঠোঁটে গোলাপি রঙের ম্যাট লিপস্টিক, আর গাঢ় কাজল দিয়ে চোখ দুটিকে ডাগর করার সফল চেষ্টা। বেশ গোছালো।
তার টিশার্টে ঠিক বুকের ওপর কী যেন লেখা। শেষের শব্দটি দেখতে পাচ্ছি পাশ থেকে, ‘এট মি’। কী হতে পারে পুরো বাক্যটি! ‘ডোন্ট লুক এট মি’, ‘লুক এট মি’ নাকি অন্য কিছু। কিছুক্ষণ ফিল ইন দ্য গ্যাপ পূরণের খেলা খেললাম।
তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এক্সকিউজ মি। আপনি কী একা...? কারও জন্য অপেক্ষা করছেন? লঞ্চে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই। ইয়ে মানে...আমিও একা। লঞ্চে একা জার্নি করা বিরক্তিকর। আপনি চাইলে আমি আপনাকে সঙ্গ দিতে পারি। আমার সঙ্গ খারাপ লাগবে না, গ্যারান্টি।’ দৃশ্যটি কল্পনা করতেই বুকের ভেতর পালপিটেশন বেড়ে গেছে।
হা. . হা...নিজের মনেই হেসে ফেললাম। এতটা বেহায়া কী হওয়া যায়!
এসব ভাবনা যখন মস্তিষ্কের এ গলি ও গলি ছুটছে, তখনই নজর পড়ল বাঁ পাশে থাকা আরেক রমণীর দিকে। ভাগ্যদেবী শুধু মুখ তুলেই আমার দিকে তাকায়নি; একেবারে কোলে নিয়ে বসেছে বোধয়। তা না হলে আমার মতো এহেন অভাগার বাঁ-ডানে দুই সুন্দরী। এ যেন কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরি দশা! আচ্ছা, দুজনের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী? নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম যেন। সুন্দরের সংজ্ঞাই বা কী? স্বয়ং কবিগুরু পর্যন্ত সুন্দরের সংজ্ঞা দিতে পারেননি। ‘মুই কী হনুরে!’
তুলনা করা যেতে পারে। প্রথম জন; মানে জিনস আর টিশার্ট পরা তরুণীর মধ্যে আবিষ্কার করার কিছু নেই। অনেকটা ওপেন সিক্রেট। তবে তার পোশাকের কারণে শরীরের প্রত্যেকটি ভাঁজ রহস্য তৈরি করেছে। কেমন যেন ঢেউ খেলে গেছে কোনো কোনো জায়গায়। আর সাঁতার প্রিয় কেউ এমন শান্ত ঢেউয়ে সাঁতার কাটতে আরাম পাবেন নিশ্চিত! তার অবস্থা এমন যেন, মধ্যবিত্ত ঘরে মেজবান আসা উপলক্ষে বিছানায় অনেক দিন পর বের করা বালিশের কভার, চাদর। টি-টেবিলে ভাঁজ না ভাঙা টেবিলক্লথ, দেয়ালের একপাশে রবীন্দ্র-নজরুল কিংবা ম্যারাডোনার কোনো ছবি ঝোলানো। অন্যপাশে দেয়াল ঘড়িটা তার কাজ করে যাচ্ছে টিকটিক করে। ক্যালেন্ডারের পাতাও ঠিকভাবে ওলটানো। দেখেই বোঝা যায় সব পরিকল্পনা মতো সাজিয়ে রাখা।
দ্বিতীয় জন; যার পরনে হালকা কচু পাতা রঙের শিফন শাড়ি। বেশ খানিকটা অগোছালো। আঁচলে প্লিট করা নেই, উঁচু বুকের ওপর এমনি ফেলে রাখা হয়েছে। চওড়া কাঁধ আর বেশ খানিকটা খোলা পিঠ বেয়ে চুলের বেনীটাও ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। শাড়ির বুননে লুকিয়ে থাকা কোমরের খাঁজে হালকা মেদ আর উঁকি মারা তকতকে পেট তাকে আরও যেন নরম তুলতুলে করে তুলেছে। চোখ পড়তেই যেন ছুঁতে মন চায়।
বড়লোকের ড্রয়িং রুমের মতো সবই আছে। ইতালিয়ান ফিটিংস, দেয়ালে দামি পেইন্টিং, দামি সোফা, শুধু অতিথি আসবে বলে গোছানোর সময় পায়নি কেউ। কিংবা ফাঁকিবাজ কাজের লোকের কাছে যে অতিথি আসবেন, তার কোনো দামই নেই।
কী নেই মেয়েটির মাঝে? খোলা পিঠ, চওড়া কাঁধ, উঁচু বুক, ভারী নিতম্ব, গাছপাকা পেয়ারার মতো গায়ের রং। সবই আছে, আমি কবি-সাহিত্যিক হলে আরও ভালো বলতে পারতাম হয়তো। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে, তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে বেশ খানিকটা পরিশ্রম করতে হবে। অথবা জহুরির চোখ লাগবে। শরীর বেয়ে তার মুখে উঠলাম। ওর চোখ আমার চোখ একটু কথা বলে নিল যেন। কিন্তু কেউ কারও কথা বুঝলাম না। চোখ দু’টি; আহা...ঠিক যেন চৈত্রের ভোরে বাঁধানো দিঘির শান্ত পানি। ইচ্ছে হচ্ছে এখনই ডুব মারি।
একটু স্মৃতিমেদুর হলাম; এই চোখই সব শেষ করল আমার।
একই অফিসে যখন ছিলাম তখন তোমার চোখ আর আমার চোখ সারা বেলাই গুটুরগুটুর আলাপ করত। একদিন লিফটের ভেতর তুমি মোবাইল নম্বর চেয়ে নিলে। পরে ফোন দেবে আমি ভাবিনি।
কোনো এক রাতে তুমি ফোন দিয়েছিলে এবং আমাদের সারা রাত কথা হয় সেদিন। আমার ফোনে ব্যালেন্স ছিল না। তোমারই তিন-চারটা নম্বর। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছর কেটে গেল। হাত ধরে সারা ঢাকা চষে বেড়িয়েছি। কখনো ঘণ্টা চুক্তিতে রিকশা, কখনো দুই পা-ই ছিল ভরসা। কখনো নীলক্ষেতের ঘুপচি দোকান, কখনো আবার শহরের দামি কোনো রেস্তোরাঁ। আমার এই রুগ্ণ কাঁধে মাথা রেখে কত বিকেল পার করেছ তার ইয়ত্তা নেই। মাঝে মধ্যে একান্তে কিছু সময় কাটাতে আমার ভাড়া বাসার ছোট্ট রুম ছাড়াও আশ্রয় নিতে এর ওর বাসায়। পোষা বিড়াল ছানার মতো তোমায় কোলে নিয়ে রাত পার করে দিয়েছি কত। তুমি ঘুমাতে আর আমি তোমার বন্ধ চোখে স্বপ্ন দেখতাম। মাঝেমধ্যে ঘামে ভিজে যাওয়া তোমার শরীরের নেশা ধরা গন্ধে মাদকের স্বাদ নিতে নিতে নিজেই ঘুমিয়ে পড়তাম। রাত পোহালে তোমার শুকনো ঠোঁটের ছোঁয়ায় অদ্ভুত রকমের ভালো লাগায় কেঁপে উঠতাম। আর জেগে উঠে তোমাকে আবিষ্কারের কঠোর পরিশ্রম। প্রথম প্রহরের সেই শারীরিক ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশের শব্দ আমার ঝাঁপিতে নেই, সত্যি বলছি।
চা শেষ। আরেকটা সিগারেট দরকার। শরীর এত নিকোটিন চাইছে কেন বুঝতে পারছি না। অসুস্থ শরীর নিকোটিন নেয় না। তার মানে আমি পুরোপুরি ফিট! ‘এটাই শেষ। লঞ্চে উঠে আর দুইটা খাব।’ মনে মনে আরেকটা অসম্ভব প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম। মানুষ আসলে যা পারবে না সেটা করার জন্যই প্রতিজ্ঞা করে। যেটা পারবে কিংবা হওয়ার সেটা এমনিতেই হয়।
সেদিন গুলশান-১–এর ১১৬ নম্বর রোডের শেষ মাথায় তুমিসহ দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। আমি সিগারেট ধরাতেই তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে ‘হঠাৎ গোল্ডলিফ কেন?’ বলেছিলাম, ‘১৬ টাকার সিগারেটে পোষায় না।’ চা-সিগারেট শেষ করে তোমার গালে আলতো ছুঁয়ে বলেছিলাম, ‘এতটুকু কমেনি আমার ভালোবাসা।’ তুমি তখন কথা দিয়ে বলেছিলে, ‘তোমাকে কখনো ছেড়ে যাব না। সেটা সম্ভব না।’ মনে হয় নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছিলে। যেটা পরে তুমি রাখতে পারবে না কিংবা রাখবে না বলে নিশ্চিতভাবেই জানতে।
লঞ্চ ঢেকুর তুলছে। আমার মনে হচ্ছে ডুকরে কেঁদে উঠেছে। দোকানির কাছ থেকে তড়িঘড়ি বিদায় নিয়ে ঘাটের দিকে পা বাড়িয়েছি। একেবারে ঠিক সময়ে ছেড়েছে লঞ্চ। ভেতরেই টিকিটের ব্যবস্থা। নামার সময় কাটলেও নাকি চলে। রিস্ক নিতে চাইলাম না। ১০০ টাকায় পুরো লঞ্চ কিনে নিলাম! একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা এই লঞ্চ শেষ কোথায় ভিড়বে?’ সেই লোক খুব গুছিয়ে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলো, ‘আপনে কই যাইবেন?’
সেদিন তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘তুমি আমার সঙ্গে এখন দেখা করতে চাও না কেন?’ তুমি বলছিলে, ‘এত দেখা করে কী হবে!’
লঞ্চ নদীর বুকে ভাসতে শুরু করেছে। ঘাট ছেড়ে এসেছে ২০-২৫ মিনিট হলো। তুমি আমাকে ছেড়ে গেছ প্রায় পৌনে চার মাস।
প্রতিদিন তোমার সাথে দেখা করার একটা জেদ কাজ করে ইদানীং। দেখা না হলে মাথা ভার হয়ে আসে, এরপর আধ কপালী মাথাব্যথা শুরু হয়। খুবই অসহ্য। তুমি বিরক্ত হও বুঝি। তবু যাই; না গিয়ে উপায় আছে? তুমি-ই বলেছিলে, ‘আমি কোথায় হারাব? তুমি তো আমার সব চেনো। গিয়ে নিয়ে আসবে।’
তোমার সামনে যাই। ‘কেন চলে যাবে?’ জিজ্ঞেস করলে বল, ‘এখন তোমাকে আমার ভালো লাগে না।’ যুক্তিসংগত কথা। ভালো না লাগলে আর কী করা। মানুষ তো আর রোবট না যে, সুইচ ঘুরিয়ে দিলাম আর ভালো লাগা শুরু হলো। আচ্ছা; একইভাবে সুইচ ঘুরিয়ে খারাপ লাগানোও তো সম্ভব না! দুইটার একটারও ব্যবস্থা নাই। তা হলে আমি দ্বিতীয়টি করার চেষ্টা করতাম। তোমাকে জ্বালাতন থেকে মুক্তি দিতাম অন্তত।
সেদিন আবার বললে, ‘তোমার সাথে আমার অ্যাডজাস্ট হয় না।’
কী যে বল না তুমি! আমি তো আর কম্পিউটারের ইউএসবি পোর্ট না। তুমিও পেনড্রাইভ কিংবা ক্যাবল না যে অ্যাডজাস্ট হতে হবে। এত দিন যেভাবে ছিলে সেভাবে থাকবে।’ উত্তর দিয়েছিলাম।
‘এত দিন কোথায় ছিলাম? আমি এত দিন ছিলাম না। তুমি জোর করেছ। তাই-ই ছিলাম।’ তোমার পাল্টা জবাব ছিল এটা।
আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে এত দিন তুমি আমাকে ভালোবাসনি! তোমার সবকিছু; আমাকে দেওয়া কথা, দেখানো স্বপ্ন ধোঁকা ছিল! ঘুমের ঘোরে মাতাল করা সেই ভালোবাসা, আমার শরীর থেকে পুরুষ মাংসের স্বাদ নেওয়া, আনন্দের চূড়ায় উঠে ছোট্ট করে ভালোবাসি বলা, সব মিথ্যা ছিল! ধোঁকা? অভিমান ভাঙাতে আমার গালে প্রজাপতি চুমু এঁকে দেওয়া, বিদায় বেলায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফরাসি চুমু; এসব, সব মিথ্যা, অভিনয়, ধোঁকা!’
তোমার এসব কথা শোনার পর ক্ষণিকের জন্য সব যেন থেমে গিয়েছিল সেদিন। বোমি আসছিল, সামনের সবকিছু হলুদ মনে হয়েছিল। সেসব তোমাকে বুঝতে দিইনি। তুমিও বুঝতে চাওনি।
চশমার গ্লাসগুলো মুছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘আচ্ছা, আমি যদি এখন জোর করি তাহলে থাকবে? তুমিতো বলেছিলে চলে গেলে তোমাকে যাতে যেতে না দিই।’ ‘সেটা আর সম্ভব নয়। আমি মরে গেলেও তোমাকে আপন করতে পারব না। তোমার সাথে সম্পর্ক রাখা তো অনেক দূরের কথা।’ কথাগুলো যখন বলছিলে তোমাকে অনেকটা ডিটারমাইন্ড দেখলাম তখন।
ব্যাপারটা এমন যেন, তোমার মন চাইল, দরকার ছিল তুমি থাকলে এখন মন চাইল কিংবা দরকার শেষ চলে গেলে। মানে, ‘আপনা বুঝ, লাল তরমুজ!’ এখন তোমার লক্ষ্য দেখেশুনে পয়সা ওয়ালা, সফল (তোমার ভাষ্যমতে) কারও সাথে বাকি জীবন পার করা। সেটা কথা প্রসঙ্গে একবার আমাকে বলেও ছিলে। সেদিন ভেবেছিলাম ঠাট্টা। এখন মনে হচ্ছে না সেটাই সত্য।
আচ্ছা তাহলে আমি কী ছিলাম? আমার সাজানো মাঠে খেললে তাহলে? এই এখন কিংবা ভবিষ্যতে ভালো খেলার জন্য নিজেকে তৈরি করেছ এই মাঠে! ঠিকঠাক কোন পিচে কত গতিতে বল করবে, কত ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে সেই বল টার্ন করাবে কিংবা কোন বল ফ্রন্ট ফুটে খেলবে নাকি ব্যাকফুটে খেলবে এসব? আমাকে দিয়ে তুমি নেট প্র্যাকটিস করেছ তাহলে! আসলে মাধবীলতারা উপন্যাসেই থাকে, বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যায় না।
আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে সমাধান?’ ‘হয় তুমি মরে যাও। অথবা আমাকে মেরে ফেল।’ সাফ জবাব দিয়েছিলে তুমি। ‘তোমাকে মারা সম্ভব হবে না। আর নিজে মরব এতটা সাহস আমার নেই।’ আমি আত্মসমর্পণের চেষ্টা করেছিলাম।
আজ মনে হয় পূর্ণিমা। চাঁদের গা থেকে এক-দুই ফোঁটা করে আলো ঝরে পড়ছে। সেই আলোয় নদীর পানি ভিজে যাচ্ছে। চাঁদের আলো গায়ে মেখে লঞ্চ সাঁতরাচ্ছে। আচ্ছা, কত লঞ্চতো ডুবে যায়। কত মানুষ তো মরে ভেসে ওঠে। অনেকের তো লাশও মেলে না। স্বজনেরা লাশের অপেক্ষায় থাকে। অপেক্ষা করতে করতে ভুলে যায় যে, তারা অপেক্ষা করছে। ‘অপেক্ষা’ কঠিন এক জিনিস। তুমি কী অপেক্ষা করবে, আমার প্রাণহীন শরীরের জন্য? যার অর্ধেকটা কিংবা কোনো অংশ নদীর তলে থাকা কোনো প্রাণী খাবলে নেবে কিংবা পচে যাবে। হয়তো আমার পুরো শরীরটিই পচে দুর্গন্ধ বের হবে। তুমি কী সত্যি দেখতে আসবে আমার পচে, গলে গন্ধ বের হওয়া সেই শরীর? নাকি তোমার তরতাজাটাই চাই?
জোছনায় ভিজে ভিজে লঞ্চ কষ্টের নিশ্বাস ফেলছে। আমি তাকিয়ে জোছনা ভেজা নদীর পানিতে। জলদানবের কষ্ট আর আমার কষ্ট মিলেমিশে একাকার। দুজনেই জোছনা ভেজা পানিতে সাঁতরাচ্ছি।
কে যেন বলেছিল, ‘মানুষে মেশিনে এত মিল, কালে কালে ক্ষয়ে যায়।’
আচ্ছা, ওই তরুণীদের দেখছি না যে? তারা কী এই লঞ্চে উঠেছে? নাকি ঠিকানা পেয়ে গেছে, আজ রাতের জন্য?

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

ঘুমের ঘোরে মাতাল করা সেই ভালোবাসা, আমার শরীর থেকে পুরুষ মাংসের স্বাদ নেওয়া, আনন্দের চূড়ায় উঠে ছোট্ট করে ভালোবাসি বলা, সব মিথ্যা ছিল! ধোঁকা?
১২ মার্চ ২০২৩
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫আজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

ঘুমের ঘোরে মাতাল করা সেই ভালোবাসা, আমার শরীর থেকে পুরুষ মাংসের স্বাদ নেওয়া, আনন্দের চূড়ায় উঠে ছোট্ট করে ভালোবাসি বলা, সব মিথ্যা ছিল! ধোঁকা?
১২ মার্চ ২০২৩
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
রকিব হাসানের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর। তিনি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ছেলে কাজী মায়মুর হোসেনের স্ত্রী।
মাসুমা মায়মুর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোক গমন করেছেন। ডায়ালাইসিস চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ওনার জীবনাবসান ঘটে। আপনারা ওনার পবিত্র আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।’
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন রকিব হাসান। বাবার চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখান থেকে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও অফিসের বাঁধাধরা জীবনে তাঁর মন টেকেনি। অবশেষে তিনি লেখালেখিকে বেছে নেন জীবনের একমাত্র পথ হিসেবে।

সেবা প্রকাশনী থেকে তাঁর লেখকজীবনের সূচনা হয়। প্রথমদিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর টারজান, গোয়েন্দা রাজু, রেজা-সুজা সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই লেখেন। তবে তাঁর পরিচয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজ বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর কৈশোরের সঙ্গী।
মূলত রবার্ট আর্থারের থ্রি ইনভেস্টিগেটরস সিরিজ অবলম্বনে তিন গোয়েন্দার সূচনা হয়। তবে রকিব হাসানের লেখনশৈলীতে এটি পেয়েছে একেবারে নতুন রূপ। বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠেছে এটি। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজারো কিশোর পাঠকের প্রিয় লেখক।
নিজ নামে লেখার পাশাপাশি তিনি ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ছদ্মনাম। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে তিনি অনুবাদ করেছিলেন জুল ভার্নের বইগুলো।
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন গোয়েন্দা লেখক নন, তিনি কয়েক প্রজন্মের শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসার মানুষ।

ঘুমের ঘোরে মাতাল করা সেই ভালোবাসা, আমার শরীর থেকে পুরুষ মাংসের স্বাদ নেওয়া, আনন্দের চূড়ায় উঠে ছোট্ট করে ভালোবাসি বলা, সব মিথ্যা ছিল! ধোঁকা?
১২ মার্চ ২০২৩
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য।
১০ অক্টোবর ২০২৫আজকের পত্রিকা ডেস্ক

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার (২০২৫ সালে) সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঁর দীর্ঘ, দার্শনিক বাক্য ও মানবজীবনের বিশৃঙ্খলার গভীর অনুসন্ধানী সাহিত্যকর্মের জন্য। সুইডিশ একাডেমি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে ‘শিল্পের শক্তিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার’ জন্য। লেখক সুসান সনটাগ অবশ্য তাঁকে একসময় ‘মহাপ্রলয়ের হাঙ্গেরিয়ান গুরু’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
সাহিত্যজগতে অনেকের কাছে ক্রাসনাহোরকাইয়ের নোবেল পাওয়ার এই ঘোষণাটি যেন কয়েক দশক ধরে চলা একটি বাক্যের সমাপ্তি।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির ছোট শহর জিউলা-তে জন্ম নেওয়া ক্রাসনাহোরকাই ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্যাটানট্যাঙ্গো (১৯৮৫) একটি বৃষ্টিস্নাত, ধ্বংসপ্রায় গ্রামের কাহিনি—যেখানে প্রতারক, মাতাল ও হতাশ মানুষেরা মিথ্যা আশায় আঁকড়ে থাকে। পরিচালক বেলা-তার তাঁর এই উপন্যাসটিকে দীর্ঘ ৭ ঘণ্টার এক সাদাকালো চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই বইতেই ধরা পড়ে ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখার বৈশিষ্ট্যসমূহ, যেমন—অবিরাম দীর্ঘ বাক্য, দার্শনিক হাস্যরস ও পতনের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯) ও সেইবো দেয়ার বিলো (২০০৮)—তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মহাজাগতিক পরিসরে বিস্তৃত করেছে। ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’–এ তিনি এক নথি প্রহরীর গল্প বলেছেন, যিনি রহস্যময় এক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে নিউইয়র্কে পালিয়ে যান এবং আত্মহত্যা করেন—যেন ক্রম বিলীন পৃথিবীতে অর্থ ধরে রাখার এক মরিয়া চেষ্টা তাঁর।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখায় কাহিনি প্রায় সময়ই বাক্যের ভেতর হারিয়ে যায়। তিনি লিখেছেন এমন বাক্য, যা একাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠককে টেনে নেয় অবচেতনে, অবিরাম প্রবাহে।
তাঁর সাহিত্যে হাস্যরস ও ট্র্যাজেডি পাশাপাশি চলে। স্যাটানট্যাঙ্গো–এর মাতাল নাচের দৃশ্য যেমন নিঃশেষের প্রতীক, তেমনি ‘ব্যারন ওয়েঙ্কহাইমস হোমকামিং’ (২০১৬)-এ দেখা যায়, ফিরে আসা এক পরাজিত অভিজাতকে। যার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সভ্যতার পচন ও মানুষের হাস্যকর ভ্রান্তি।
২০১৫ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ক্রাসনাহোরকাই। অনুবাদক জর্জ সির্টেস ও ওটিলি মুলজেট তাঁর জটিল হাঙ্গেরিয়ান ভাষাকে ইংরেজিতে রূপ দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ‘হাডসন রিভিউ’ তাঁকে বর্ণনা করেছিল ‘অন্তহীন বাক্যের ভ্রমণশিল্পী’ হিসেবে।
চল্লিশ বছরের সৃষ্টিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভুবন চিত্র, সংগীত, দর্শন ও ভাষার মিলনে বিস্তৃত। সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘হার্শট ০৭৭৬৯’ (২০২৪)–এ তিনি এক প্রবাহিত বাক্যে লিখেছেন নব্য-নাৎসি, নেকড়ে আর এক হতভাগ্য পদার্থবিদের কাহিনি—আধুনিক ইউরোপের নৈতিক পক্ষাঘাতের রূপক হিসেবে।
তাঁর সমগ্র সাহিত্যজগৎ এক অন্ধকার ও ধ্যানমগ্ন মহাবিশ্ব—যেখানে পতন, শূন্যতা ও করুণা পাশাপাশি থাকে। ‘সেইবো দেয়ার বিলো’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৌন্দর্য, যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তা পবিত্রতার প্রতিবিম্ব।’ এই বিশ্বাসই লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে সেই বিরল লেখক করে তুলেছে, যাঁর নৈরাশ্যও মুক্তির মতো দীপ্ত।

ঘুমের ঘোরে মাতাল করা সেই ভালোবাসা, আমার শরীর থেকে পুরুষ মাংসের স্বাদ নেওয়া, আনন্দের চূড়ায় উঠে ছোট্ট করে ভালোবাসি বলা, সব মিথ্যা ছিল! ধোঁকা?
১২ মার্চ ২০২৩
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
২ দিন আগে
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২১ দিন আগে
জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান মারা গেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস চলাকালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
১৫ অক্টোবর ২০২৫