Ajker Patrika

হাইতি: স্বাধীনতা আন্দোলনের রোল মডেল থেকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হলো যেভাবে 

আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৪, ২০: ৪৯
হাইতি: স্বাধীনতা আন্দোলনের রোল মডেল থেকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হলো যেভাবে 

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হওয়া প্রথম দেশগুলোর একটি ক্যারিবীয় অঞ্চলের হাইতি। তবে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর কূটচালসহ নানা কারণে দেশটি স্বাধীনতার ২২০ বছর পরও রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। হাইতির এই ছদ্ম পরাধীনতার পেছনের বড় কারণ, পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর সম্মিলিত অপচেষ্টা।

১৯১৪ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস ম্যাকিয়াস হাইতির রাজধানী পোর্ট-আ-প্রিন্সের বন্দরে নোঙর করে। সেই যুদ্ধজাহাজ থেকে আট জন সেনা নেমে হাইতির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বঙ্ক ন্যাসোনাল দে লা রিপাবলিক দ’হাইতি থেকে সেই সময়ের ৫ লাখ ডলার মূল্যমানের সোনা লুট করে নিয়ে চলে যায়। বর্তমান বাজারে যার মূল্য ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সেই সোনা রাখা হয় নিউইয়র্কের ব্যাংক হলগার্টেন অ্যান্ড কোংয়ের ভল্টে। এই ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারী ছিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।

মজার ব্যাপার হলো, বঙ্ক ন্যাসোনাল দে লা রিপাবলিক দ’হাইতি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলেও এটি একই সঙ্গে ছিল বেসরকারি বিদেশি বিনিয়োগ করপোরেশনও। ১৮৮০ সালে ফরাসি ব্যাংকের বিশেষ ছাড়ের ভিত্তিতে এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে এই ব্যাংকে মার্কিন লগ্নিকারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯২০ সাল নাগাদ হাইতির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মালিকানা পুরোটাই চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান ন্যাশনাল সিটি ব্যাংকের হাতে। হাইতির কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলেও সরকারকে প্রত্যেক লেনদেনের বিপরীতে অর্থ পরিশোধ করতে হতো। আর এই ব্যাংকের বিপুল লাভের অংশ গেছে প্যারিস অথবা নিউইয়র্কে।

মূলত ১৯১০–এর দশকে হাইতির রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময় ওয়ালস্ট্রিট স্টক এক্সচেঞ্জ সেখানে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য চাপ দেয়। ওয়াশিংটন বাধ্য হয়ে দেশটিতে সেনা পাঠায়। ১৯১১ সালে মার্কিন মেরিন সেনারা হাইতিতে অবতরণ করে এবং পরবর্তী ১৯ বছর সেখানেই রয়ে যায়।

মার্কিন সেনারা হাইতিতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চরম নির্মমতার পরিচয় দিয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন হাইতিতে মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া মেজর জেনারেল স্মেডলি বাটলার। ১৯৩৫ সালে এক প্রতিবেদনে তিনি লেখেন, ‘ন্যাশনাল সিটি ব্যাংককে রাজস্ব সংগ্রহের জন্য হাইতিকে একটি উপযুক্ত জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি আমি।’

এগুলো সবই ইতিহাসের পাতার গল্প। তবে সম্প্রতি হাইতির প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরিকে পদত্যাগে বাধ্য করা এবং অসংখ্য গ্যাংয়ের উত্থান দেশটিকে আবারও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনামে এনেছে। হাইতির বর্তমান সংকট বুঝতে হলে এর অতীত ইতিহাসটাও ভালো করে বোঝা দরকার।

হাইতির ইতিহাসে দেখা যায়, দেশটির শাসকশ্রেণি সব সময়ই জনগণকে উপেক্ষা–অবজ্ঞা করেছে। সব সময়ই বিদেশি শক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। এসবই পরাশক্তিগুলো নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য করেছে। দখল বজায় রাখতে বিদেশিরা কখনো স্থানীয় রাজনীতিকদের ব্যবহার করেছে, আবার কখনো সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। ফলস্বরূপ, হাইতি এখন আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে গরিব এবং বৈষম্য জর্জরিত দেশগুলোর একটি।

হাইতির ট্র্যাজেডি কেবল জনগণের ওপর নেমে আসা নানামাত্রিক বিপর্যয়ই নয়, দেশটি এখন দুর্নীতি ও আইনের শাসনহীন অবস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ, ২০০ বছর আগে হাইতির জনগণ যখন ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করছিল, তখন দেশটি ছিল মানুষের সম্ভাবনা ও মুক্তির প্রতীক।

১৩ বছরের দীর্ঘ আন্দোলন শেষে ফ্রান্স, ব্রিটেন, স্পেনসহ বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তি ও দাস ব্যবসায়ীদের কবল থেকে ১৮০৪ সালে স্বাধীন হয় হাইতি। ওই সময় বিশ্বজুড়ে ঔপনিবেশিক শক্তি বিরোধী আন্দোলনের নতুন নজির স্থাপন করেছিল দেশটি।

এমন নোংরা শহর-গলিই যেন হাইতিবাসীর চিরস্থায়ী নিয়তি।স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রার শুরুতেই হাইতির শাসনব্যবস্থা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় সংহতি থাকলেও সার্বভৌম শাসনব্যবস্থায় শুরুতেই অভিজাতদের আধিপত্য কায়েম হয়। হাইতির সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভুরা এমনটিই চেয়েছিল। একই সঙ্গে তারা হাইতির অভিজাত শ্রেণির মধ্যে বিভাজন তৈরি করে রেখেছিল। পশ্চিমা বিশ্ব আপাত হাইতি ছেড়ে গেলেও, নিয়ন্ত্রণের লাগাম তাদের হাতেই ছিল।

সে সময় ইউরোপ–আমেরিকার ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর ভয় ছিল, হাইতির স্বাধীনতা আন্দোলন তাদের উপনিবেশগুলোতে চলমান স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে পারে। এ কারণেই তারা হাইতিকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ও দেশটির বিকশিত হওয়ার পথ রুদ্ধ করার পরিকল্পনা করে।

সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে হাইতির সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভু ফ্রান্স দেশটির কাছে ১৫ কোটি ফ্রাঁ ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসে। যা আজকের বাজারমূল্যে ৪ থেকে ২১ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। মূলত ফরাসি স্থাপনা, স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ফ্রান্স এই অর্থ দাবি করে। প্যারিস কেবল দাবি করেই ক্ষান্ত থাকেনি, পাওনা আদায়ে বাধ্য করতে হাইতির উপকূলে ১৪টি যুদ্ধজাহাজও পাঠিয়েছিল।

পরে অবশ্য সেই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ৯ কোটি ফ্রাঁতে নেমে আসে। ফ্রান্সের দায় পরিশোধ করতে গিয়ে ১৯১৪ সাল নাগাদ হাইতি সরকারকে জাতীয় বাজেটের ৮০ শতাংশই ব্যয় করতে হতো। বছরের পর বছর হাইতি এই দায় শোধ করতে বাধ্য হয়েছে। অথচ, এসব অর্থ ব্যয় করার কথা ছিল, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, কৃষি ও শিল্প খাতের উন্নয়নে। পশ্চিমের ধনী দেশগুলোর ভাঁড়ার ভরতে গিয়ে বছরের পর বছর নিজের ভাঁড়ার খালি করে ফেলেছে হাইতি।

পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো হাইতিকে কেবল দরিদ্র দেশেই পরিণত করেনি, একই সঙ্গে দেশটির রাজনীতিতে বারবার হস্তক্ষেপ করেছে। এমনকি যেসব রাষ্ট্রনায়ক দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের সবাইকে কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ফ্রাঁসোয়া দুভালিয়রের কথা। হাইতিতে ‘পাপা ডক’ নামে পরিচিত এই স্বৈরশাসক ১৯৫৭ সালে হাইতির ক্ষমতায় আসেন। তাঁর শাসনের পুরোটা সময়ে দেশটিতে ভয়াবহ দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলেছে। মার্কিন শাসকেরা তাঁর সমালোচনা করলেও তাঁকে কমিউনিজমবিরোধী ঢাল হিসেবে পৃষ্ঠপোষকতাও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

বিপরীতে জ্যঁ বার্থ এরিস্তিদ জনগণের ভোটে নির্বাচিত ও ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও মার্কিনদের তরফ থেকে ভিন্ন আচরণ পেয়েছেন। তিনি ১৯৯০ সালে ও ২০০১ সালে দুইবার ক্ষমতায় আসেন জনগণের ভোটে। কিন্তু কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। মার্কিন হস্তক্ষেপে ১৯৯১ ও ২০০৪ সালে দুটি ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে উৎখাত করা হয়।

হাইতিতে জনগণ কখনো রাষ্ট্রের সঙ্গে আবার কখনো গ্যাংয়ের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। কোনো বিরাম নেই তাদের জীবনে।মজার ব্যাপার হলো, প্রথমবার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এরিস্তিদ দ্বিতীয়বার মার্কিন সহায়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার যেসব সেনা কর্মকর্তা তাঁকে উৎখাত করে তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ–এর ভাড়াটে। সিআইএ এ বিষয়ে কখনোই রাখঢাক করেনি।

যাই হোক, পশ্চিমা বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর অযাচিত, অনুচিত হস্তক্ষেপের কারণে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে হাইতির অস্তিত্ব প্রায় বিলীন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবা থেকে শুরু করে সব বিষয়েই নীতি নির্ধারণ করে একটি সমান্তরাল সরকার। এই সমান্তরাল শক্তিকে গবেষক জন জনস্টন বলছেন, ‘এইড স্টেট’ বা ‘ত্রাণ রাষ্ট্র’। মূলত বিভিন্ন বিদেশি এনজিও, জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বহুজাতিক কোম্পানির জোট এটি নিয়ন্ত্রণ করে।

হাইতিতে ২০১০ সালের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের পর থেকেই এই সমান্তরাল সরকার সর্বময় ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠেছে। দেশটির সর্বশেষ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরিও তথাকথিত ‘কোর গ্রুপ’–এর সমান্তরাল সরকারেরই নিয়োগপ্রাপ্ত। এই কোর গ্রুপ হলো, পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের একটি জোট। এই জোটই মূলত হাইতির ‘কার্যত শাসক’। 

এর ফলে যা হয়েছে, হাইতির শাসক এবং শাসিতের মধ্যকার সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে। রাষ্ট্রের এই প্রধান দুই গোষ্ঠীর মধ্যকার যোগসূত্রহীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন, যখন দেখা যায়, রাস্তায় রাস্তায় অস্ত্রধারী গ্যাং সদস্যরা মহড়া দেয় কিন্তু তাদের বলার কেউ নেই। ক্ষুধায় কাতর মানুষ উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায় কিন্তু প্রতিকার করার কেউ নেই।

হাইতির এই দুর্দশা দেখে এরিস্তিদ ১৯৮৭ সালে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমরা আজ নিজেরাই নিজেদের ইতিহাসের অধীনস্থে পরিণত হয়েছি। আমরা সেই ইতিহাসের অংশ হতে অস্বীকার করেছি।’

ট্র্যাজেডি হলো হাইতিতে ঠিক উল্টোটা ঘটেছে। হাইতির জনগণ শাসন ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। এই অবস্থার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত হাইতির পরিবর্তনের আশা নেই।

দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত কেনান মালিকের নিবন্ধ, অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩০
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্যদেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকার এই স্বঘোষিত স্বাধীন মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডটির প্রতি ইসরায়েলের এই গভীর আগ্রহ নিছক কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশকের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা, নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।

সোমালিল্যান্ডের অবস্থান এডেন উপসাগরের তীরে, যা সরাসরি ইয়েমেনের উল্টো দিকে এবং বাব আল-মানদেব প্রণালির ঠিক পাশেই অবস্থিত। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলপথের বাণিজ্য এই পথেই পরিচালিত হয়।

২০২৩ সাল থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। সোমালিল্যান্ডের উপকূলরেখা থেকে হুতিদের মূল ঘাঁটি হোদেইদাহর দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ বা সম্মুখ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।

ইসরায়েলি থিংকট্যাংক (আইএনএসএস)-এর মতে, সোমালিল্যান্ডে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইয়েমেনে আসা অস্ত্র চোরাচালান এবং হুতিদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হবে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মিত বারবেরা বন্দর ইসরায়েলি নৌ টহল বা ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

হর্ন অব আফ্রিকায় ইসরায়েলের এই প্রবেশ মূলত তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য কমানোর একটি পাল্টা কৌশল। তুরস্ক ইতিমধ্যে সোমালিয়ার মোগাদিশুতে বিশাল সামরিক ঘাঁটি এবং বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে জোরালো মৈত্রী এই অঞ্চলে তুরস্কের একক আধিপত্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।

এ ছাড়া ইসরায়েল সব সময় নিজের সীমানার বাইরে মিত্র দেশগুলোতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। সোমালিল্যান্ডের মতো একটি স্থিতিশীল এবং পশ্চিমাপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ইসরায়েলকে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বলয়ে একক কর্তৃত্ব দেবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারও আগ্রহের মূলে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সোমালিল্যান্ড কেবল একটি কৌশলগত বন্দর নয়, বরং এটি সম্পদের একটি অব্যবহৃত খনি।

সোমালিল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ মজুত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির কারখানায় এই কাঁচামালগুলো অত্যন্ত জরুরি।

ইসরায়েল ইতিমধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি পরিশোধন, উন্নত সেচব্যবস্থা এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সোমালিল্যান্ডের জন্য এই অংশীদারত্ব হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।

তবে এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইসরায়েলের এই স্বীকৃতি যেমন সোমালিল্যান্ডের জন্য বৈধতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি আঞ্চলিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।

সোমালিয়া এই পদক্ষেপকে তাদের অখণ্ডতার ওপর ‘সরাসরি আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) এবং আরব লিগ এই স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে যে এটি আফ্রিকা মহাদেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।

পশ্চিমা বিশ্বও ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ সোমালিল্যান্ডকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই এই পথে হাঁটবে না, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

সর্বোপরি ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে ইসরায়েলের সমমনা বলেই মনে করা হয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল লোহিত সাগরে নিজের নৌ-শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে এই পদক্ষেপ যদি ইথিওপিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করবে। তবে এর ফলে হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূরাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। এটি যেমন একটি নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কোন আইএসকে আঘাত করল মার্কিন বাহিনী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামিক স্টেট কী

ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।

পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়

মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল

আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।

আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা

কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।

নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কেন হামলা চালাল মার্কিন বাহিনী, খ্রিষ্টান নিপীড়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।

কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন

অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।

তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে

নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।

নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান

ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।

নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।

এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’

এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত