Ajker Patrika

হাইতি: স্বাধীনতা আন্দোলনের রোল মডেল থেকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হলো যেভাবে 

আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৪, ২০: ৪৯
হাইতি: স্বাধীনতা আন্দোলনের রোল মডেল থেকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হলো যেভাবে 

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হওয়া প্রথম দেশগুলোর একটি ক্যারিবীয় অঞ্চলের হাইতি। তবে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর কূটচালসহ নানা কারণে দেশটি স্বাধীনতার ২২০ বছর পরও রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। হাইতির এই ছদ্ম পরাধীনতার পেছনের বড় কারণ, পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর সম্মিলিত অপচেষ্টা।

১৯১৪ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস ম্যাকিয়াস হাইতির রাজধানী পোর্ট-আ-প্রিন্সের বন্দরে নোঙর করে। সেই যুদ্ধজাহাজ থেকে আট জন সেনা নেমে হাইতির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বঙ্ক ন্যাসোনাল দে লা রিপাবলিক দ’হাইতি থেকে সেই সময়ের ৫ লাখ ডলার মূল্যমানের সোনা লুট করে নিয়ে চলে যায়। বর্তমান বাজারে যার মূল্য ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সেই সোনা রাখা হয় নিউইয়র্কের ব্যাংক হলগার্টেন অ্যান্ড কোংয়ের ভল্টে। এই ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারী ছিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।

মজার ব্যাপার হলো, বঙ্ক ন্যাসোনাল দে লা রিপাবলিক দ’হাইতি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলেও এটি একই সঙ্গে ছিল বেসরকারি বিদেশি বিনিয়োগ করপোরেশনও। ১৮৮০ সালে ফরাসি ব্যাংকের বিশেষ ছাড়ের ভিত্তিতে এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে এই ব্যাংকে মার্কিন লগ্নিকারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯২০ সাল নাগাদ হাইতির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মালিকানা পুরোটাই চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান ন্যাশনাল সিটি ব্যাংকের হাতে। হাইতির কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলেও সরকারকে প্রত্যেক লেনদেনের বিপরীতে অর্থ পরিশোধ করতে হতো। আর এই ব্যাংকের বিপুল লাভের অংশ গেছে প্যারিস অথবা নিউইয়র্কে।

মূলত ১৯১০–এর দশকে হাইতির রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময় ওয়ালস্ট্রিট স্টক এক্সচেঞ্জ সেখানে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য চাপ দেয়। ওয়াশিংটন বাধ্য হয়ে দেশটিতে সেনা পাঠায়। ১৯১১ সালে মার্কিন মেরিন সেনারা হাইতিতে অবতরণ করে এবং পরবর্তী ১৯ বছর সেখানেই রয়ে যায়।

মার্কিন সেনারা হাইতিতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চরম নির্মমতার পরিচয় দিয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন হাইতিতে মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া মেজর জেনারেল স্মেডলি বাটলার। ১৯৩৫ সালে এক প্রতিবেদনে তিনি লেখেন, ‘ন্যাশনাল সিটি ব্যাংককে রাজস্ব সংগ্রহের জন্য হাইতিকে একটি উপযুক্ত জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি আমি।’

এগুলো সবই ইতিহাসের পাতার গল্প। তবে সম্প্রতি হাইতির প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরিকে পদত্যাগে বাধ্য করা এবং অসংখ্য গ্যাংয়ের উত্থান দেশটিকে আবারও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনামে এনেছে। হাইতির বর্তমান সংকট বুঝতে হলে এর অতীত ইতিহাসটাও ভালো করে বোঝা দরকার।

হাইতির ইতিহাসে দেখা যায়, দেশটির শাসকশ্রেণি সব সময়ই জনগণকে উপেক্ষা–অবজ্ঞা করেছে। সব সময়ই বিদেশি শক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। এসবই পরাশক্তিগুলো নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য করেছে। দখল বজায় রাখতে বিদেশিরা কখনো স্থানীয় রাজনীতিকদের ব্যবহার করেছে, আবার কখনো সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। ফলস্বরূপ, হাইতি এখন আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে গরিব এবং বৈষম্য জর্জরিত দেশগুলোর একটি।

হাইতির ট্র্যাজেডি কেবল জনগণের ওপর নেমে আসা নানামাত্রিক বিপর্যয়ই নয়, দেশটি এখন দুর্নীতি ও আইনের শাসনহীন অবস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ, ২০০ বছর আগে হাইতির জনগণ যখন ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করছিল, তখন দেশটি ছিল মানুষের সম্ভাবনা ও মুক্তির প্রতীক।

১৩ বছরের দীর্ঘ আন্দোলন শেষে ফ্রান্স, ব্রিটেন, স্পেনসহ বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তি ও দাস ব্যবসায়ীদের কবল থেকে ১৮০৪ সালে স্বাধীন হয় হাইতি। ওই সময় বিশ্বজুড়ে ঔপনিবেশিক শক্তি বিরোধী আন্দোলনের নতুন নজির স্থাপন করেছিল দেশটি।

এমন নোংরা শহর-গলিই যেন হাইতিবাসীর চিরস্থায়ী নিয়তি।স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রার শুরুতেই হাইতির শাসনব্যবস্থা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয় সংহতি থাকলেও সার্বভৌম শাসনব্যবস্থায় শুরুতেই অভিজাতদের আধিপত্য কায়েম হয়। হাইতির সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভুরা এমনটিই চেয়েছিল। একই সঙ্গে তারা হাইতির অভিজাত শ্রেণির মধ্যে বিভাজন তৈরি করে রেখেছিল। পশ্চিমা বিশ্ব আপাত হাইতি ছেড়ে গেলেও, নিয়ন্ত্রণের লাগাম তাদের হাতেই ছিল।

সে সময় ইউরোপ–আমেরিকার ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর ভয় ছিল, হাইতির স্বাধীনতা আন্দোলন তাদের উপনিবেশগুলোতে চলমান স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে পারে। এ কারণেই তারা হাইতিকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ও দেশটির বিকশিত হওয়ার পথ রুদ্ধ করার পরিকল্পনা করে।

সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে হাইতির সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভু ফ্রান্স দেশটির কাছে ১৫ কোটি ফ্রাঁ ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসে। যা আজকের বাজারমূল্যে ৪ থেকে ২১ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। মূলত ফরাসি স্থাপনা, স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ফ্রান্স এই অর্থ দাবি করে। প্যারিস কেবল দাবি করেই ক্ষান্ত থাকেনি, পাওনা আদায়ে বাধ্য করতে হাইতির উপকূলে ১৪টি যুদ্ধজাহাজও পাঠিয়েছিল।

পরে অবশ্য সেই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ৯ কোটি ফ্রাঁতে নেমে আসে। ফ্রান্সের দায় পরিশোধ করতে গিয়ে ১৯১৪ সাল নাগাদ হাইতি সরকারকে জাতীয় বাজেটের ৮০ শতাংশই ব্যয় করতে হতো। বছরের পর বছর হাইতি এই দায় শোধ করতে বাধ্য হয়েছে। অথচ, এসব অর্থ ব্যয় করার কথা ছিল, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, কৃষি ও শিল্প খাতের উন্নয়নে। পশ্চিমের ধনী দেশগুলোর ভাঁড়ার ভরতে গিয়ে বছরের পর বছর নিজের ভাঁড়ার খালি করে ফেলেছে হাইতি।

পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো হাইতিকে কেবল দরিদ্র দেশেই পরিণত করেনি, একই সঙ্গে দেশটির রাজনীতিতে বারবার হস্তক্ষেপ করেছে। এমনকি যেসব রাষ্ট্রনায়ক দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের সবাইকে কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ফ্রাঁসোয়া দুভালিয়রের কথা। হাইতিতে ‘পাপা ডক’ নামে পরিচিত এই স্বৈরশাসক ১৯৫৭ সালে হাইতির ক্ষমতায় আসেন। তাঁর শাসনের পুরোটা সময়ে দেশটিতে ভয়াবহ দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলেছে। মার্কিন শাসকেরা তাঁর সমালোচনা করলেও তাঁকে কমিউনিজমবিরোধী ঢাল হিসেবে পৃষ্ঠপোষকতাও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

বিপরীতে জ্যঁ বার্থ এরিস্তিদ জনগণের ভোটে নির্বাচিত ও ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও মার্কিনদের তরফ থেকে ভিন্ন আচরণ পেয়েছেন। তিনি ১৯৯০ সালে ও ২০০১ সালে দুইবার ক্ষমতায় আসেন জনগণের ভোটে। কিন্তু কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। মার্কিন হস্তক্ষেপে ১৯৯১ ও ২০০৪ সালে দুটি ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে উৎখাত করা হয়।

হাইতিতে জনগণ কখনো রাষ্ট্রের সঙ্গে আবার কখনো গ্যাংয়ের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। কোনো বিরাম নেই তাদের জীবনে।মজার ব্যাপার হলো, প্রথমবার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এরিস্তিদ দ্বিতীয়বার মার্কিন সহায়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার যেসব সেনা কর্মকর্তা তাঁকে উৎখাত করে তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ–এর ভাড়াটে। সিআইএ এ বিষয়ে কখনোই রাখঢাক করেনি।

যাই হোক, পশ্চিমা বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর অযাচিত, অনুচিত হস্তক্ষেপের কারণে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে হাইতির অস্তিত্ব প্রায় বিলীন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবা থেকে শুরু করে সব বিষয়েই নীতি নির্ধারণ করে একটি সমান্তরাল সরকার। এই সমান্তরাল শক্তিকে গবেষক জন জনস্টন বলছেন, ‘এইড স্টেট’ বা ‘ত্রাণ রাষ্ট্র’। মূলত বিভিন্ন বিদেশি এনজিও, জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বহুজাতিক কোম্পানির জোট এটি নিয়ন্ত্রণ করে।

হাইতিতে ২০১০ সালের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের পর থেকেই এই সমান্তরাল সরকার সর্বময় ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠেছে। দেশটির সর্বশেষ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরিও তথাকথিত ‘কোর গ্রুপ’–এর সমান্তরাল সরকারেরই নিয়োগপ্রাপ্ত। এই কোর গ্রুপ হলো, পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের একটি জোট। এই জোটই মূলত হাইতির ‘কার্যত শাসক’। 

এর ফলে যা হয়েছে, হাইতির শাসক এবং শাসিতের মধ্যকার সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে। রাষ্ট্রের এই প্রধান দুই গোষ্ঠীর মধ্যকার যোগসূত্রহীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন, যখন দেখা যায়, রাস্তায় রাস্তায় অস্ত্রধারী গ্যাং সদস্যরা মহড়া দেয় কিন্তু তাদের বলার কেউ নেই। ক্ষুধায় কাতর মানুষ উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায় কিন্তু প্রতিকার করার কেউ নেই।

হাইতির এই দুর্দশা দেখে এরিস্তিদ ১৯৮৭ সালে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমরা আজ নিজেরাই নিজেদের ইতিহাসের অধীনস্থে পরিণত হয়েছি। আমরা সেই ইতিহাসের অংশ হতে অস্বীকার করেছি।’

ট্র্যাজেডি হলো হাইতিতে ঠিক উল্টোটা ঘটেছে। হাইতির জনগণ শাসন ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। এই অবস্থার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত হাইতির পরিবর্তনের আশা নেই।

দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত কেনান মালিকের নিবন্ধ, অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

দোনেৎস্ক: শান্তি-আলোচনার টেবিলে পুতিন-জেলেনস্কির অন্তিম বাধা, এর গুরুত্ব কতটা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।

উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।

প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।

পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।

পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।

কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।

দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।

শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।

কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।

উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।

ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।

রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।

দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।

দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।

জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।

রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কী হবে, যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।

সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।

উদ্ভাবন কি থেমে যাবে

অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।

যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো

গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।

বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে

ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে

গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।

চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব

বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।

আল-জাজিরা অবলম্বনে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

জাপানের ‘লৌহমানবী’ কি দেশকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২০
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত

জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে। এই পরিচয়টিকে তাকাইচি নিজেও গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। মার্গারেট থ্যাচারের অনুরাগী এই রক্ষণশীল নেতা ঘরোয়া অর্থনীতি থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন।

তাকাইচির রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল কেন্দ্রে রয়েছে ‘নিপ্পন কেইগি’ নামে জাপানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এই সংগঠন জাপানের সংবিধানের যুদ্ধবিরোধী ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন এবং ঐতিহ্যবাদী মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। পূর্বসুরী শিনজো আবের মতো তাই তাকাইচিও জাপানকে স্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থা, আধুনিক সেনাবাহিনী এবং কঠোর নিরাপত্তা আইন থাকবে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি জাতীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির পক্ষে। একই সঙ্গে কঠোর অভিবাসন নীতি ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রচারও তাঁকে ডানপন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছে। তবে এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সঙ্গে গেঁথে গেছে—বিশেষ করে, তাইওয়ান ইস্যুতে তাঁর অবস্থানের কারণে।

তাকাইচি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন। বেইজিংকে তিনি কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখেন এবং প্রতিরোধমূলক সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের পক্ষে জোর দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে অক্টোবরের শেষ দিকে তাঁর ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাক্ষাৎ দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন সোনালি যুগে প্রবেশ করানোর আভাস দেয়। জাপান প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র বিরল ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেয়।

তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো তাইওয়ানের সঙ্গে তাকাইচির ঘনিষ্ঠতা। তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যা চীনের কাছে স্পষ্ট উত্তেজনাকর পদক্ষেপ হিসেবে ধরা পড়েছে। আরও বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন তাকাইচি প্রকাশ্যে বলেন, তাইওয়ানের নিরাপত্তা জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এমনকি তাইওয়ানে চীনা হামলার ক্ষেত্রে জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।

এ ক্ষেত্রে চীনের প্রতিক্রিয়াও ছিল কঠোর ও দ্রুত। তারা তাকাইচির বিরুদ্ধে ‘পুরোনো সামরিকতাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার’ অভিযোগ তোলে, রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবং জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাঠায়। পাশাপাশি সামুদ্রিক এলাকায় কোস্টগার্ডের টহল বাড়ায় চীন, জাপানি সামুদ্রিক পণ্যে সীমাবদ্ধতা আরোপের হুমকি দেয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ নানা বিবৃতি দেয়।

এদিকে জাপানও পশ্চিম সীমান্তের ইয়োনাগুনি দ্বীপে বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও একই দ্বীপে সামরিক অবকাঠামো শক্তিশালী করছে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি তাকাইচিকে উত্তেজনা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ আগামী এপ্রিলে তিনি বেইজিং সফর করতে চান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাকাইচির নেতৃত্বে জাপান নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। তাঁর দৃঢ় অবস্থান দেশকে হয় পুনরুত্থানের পথে নেবে—নয়তো চীন–তাইওয়ান উত্তেজনার কেন্দ্রে ঠেলে দেবে। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনি কোন পথে হাঁটবেন তার ওপর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

পুতিন-মোদির আসন্ন বৈঠকের মূলে কী আছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯: ৪৫
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠককে ঘিরে দিল্লিতে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক প্রস্তুতি। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ এবং জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার মধ্যেই এই শীর্ষ সম্মেলন হতে যাচ্ছে। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি—এই তিনটি খাত আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে বলে দুই দেশই নিশ্চিত করেছে।

রাষ্ট্রীয় সফরে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) ভারতে পৌঁছে পরদিন শুক্রবার মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন পুতিন। এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা ছাড়াও নতুন কয়েকটি আন্তদপ্তর ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব ধরে রাখতে ভারতের নীতির জন্য এই বৈঠক একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়া থেকে ডিসকাউন্টে ভারতের তেল কেনা দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটনকে অসন্তুষ্ট করে আসছে। এই অসন্তুষ্টি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা মোট শুল্ককে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে। তবে ভারত বলছে, তারা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধী নয়, কিন্তু ১৪০ কোটি মানুষের জ্বালানি চাহিদা মেটাতেই বাধ্য হয়ে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা হচ্ছে। নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ‘রসনেফত’ ও ‘লুকওইল’ এর মতো রাশিয়ার কিছু কোম্পানি থেকে ভারত তেল কিনবে না বলে জানিয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞামুক্ত রুশ সরবরাহকারীদের সঙ্গে বাণিজ্য চালু থাকবে।

পুতিনের এই সফরে দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হবে। ভারত রাশিয়ায় ওষুধ, কৃষিপণ্য ও টেক্সটাইল রপ্তানি বাড়াতে চায় এবং পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের অনুরোধ জানাবে। এ ছাড়া সার সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি এবং রাশিয়ায় ভারতীয় দক্ষ জনশক্তির নিরাপদ ও নিয়মিত অভিবাসন নিয়ে আলোচনা এগোতে পারে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, সমুদ্র পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা ও গণমাধ্যম সহযোগিতা বিষয়ক নথিপত্র চূড়ান্তের কাজও চলছে।

বুধবার এই বিষয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনডিপেনডেন্টের এক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, জ্বালানি সহযোগিতাই পুতিন-মোদি আলোচনার বড় অংশ দখল করবে। ভারতের ফার ইস্টে বিনিয়োগ, রাশিয়ার সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্প এবং কুদানকুলাম প্রকল্পের সম্প্রসারণ নিয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা হবে। স্থানীয়ভাবে যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং তৃতীয় দেশে যৌথ পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হবে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০১৮ সালের ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির আওতায় ভারতের হাতে ইতিমধ্যে রাশিয়ার তিনটি এস-৪০০ স্কোয়াড্রন এসেছে। যুদ্ধজনিত কারণে বাকিগুলোর সরবরাহে যুদ্ধজনিত বিলম্ব হচ্ছে। ভারত এই সরবরাহ দ্রুত নিশ্চিত করতে চাপ দেবে। পাশাপাশি আরও এস-৪০০ কেনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়নি, যদিও বৈঠক থেকে কোনো ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা কম। রুশ নির্মিত এসইউ-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান আপগ্রেড, অস্ত্র সরবরাহ দ্রুততর করা এবং যৌথ সামরিক মহড়ায় সমন্বয় জোরদার করার বিষয়েও আলোচনা হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত বহুজাতিক অস্ত্র সরবরাহকারীদের দিকে নজর বাড়ালেও রাশিয়া এখনো তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা অংশীদার। পুতিনের সফরকে সেই সম্পর্কটি আরও দৃঢ় করার বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত